#এমন_একদিন_সেদিন
#মুমুর্ষিরা_শাহরীন
পর্ব-১২.
২৬.
ক্ষীণ কুয়াশার পর্দা ভেদ করেছে আলতো রোদ্দুর। পাতায় পাতায় সকালের আলোড়ন। ঝকঝকে মন্থর পরিষ্কার ঊষায় উত্তরে জানালার ধারে বসা দাড় কাকটি অবাক পানে তাকিয়ে। হক বাড়ির দু’তলার ডান পাশের ঘরের পর্দা গুটানো। বিছানা টান টান, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন। বারান্দায় কাপড় নাড়ার দড়ি শূন্য। টেবিলের উপর বইগুলোও সুনির্দিষ্ট ভাবে বিন্যস্ত। আলমারির একটা পাল্লা খোলা। ক্ষণে ক্ষণে কাপড় টান টান করে ভাঁজ করে নিবদ্ধ করা হচ্ছে তাতে। পরিপাটি ঘরেতে এক বিন্দু পরিমাণ ময়লা নেই। সাদা মেঝে ঝকঝকে তকতকে। দুষ্টুকে এই মুহুর্তে দেখা যাচ্ছে, ভঙ্গুর প্রভাতে এলোমেলো চুলে কাপড় ভাঁজ করতে। বাপের বাড়ি যাওয়ার অনুমতি প্রদান করা হয়েছে। কাল সারা রাত প্রচ্ছদ ঘরে ফেরেনি। ভোরের দিকে ফিরতেই বলল,
‘সকাল সকাল তৈরি থাকবে। দু’দিন থাকার পারমিশন এক্সেপ্টেড। যাওয়ার আগে ঘর পরিপাটি করে গুছিয়ে রেখে যাবে।’
হুকুমজারি! দুষ্টুর চোখ মুখ কুচকে গেলো। ওয়াশরুমের দরজায় খট করে শব্দ হলো। শেষ কাপড়’টা ভাঁজ করে রাখতে রাখতে সে পেছন ফিরে চাইলো। প্রচ্ছদ মৃদু অদর্শিত হেসে খাটে বসলো। দুষ্টু আলমারির পাল্লা লাগাতে লাগাতে খেঁক করে উঠলো। প্রচ্ছদ চমকে অর্ধ বসে সটান দাঁড়িয়ে পরলো।
‘বিছানায় বসেছেন কেনো? উঠুন জলদি। ঘর গোছাতে কষ্ট হয়। এত্তো বড় হাতির শরীর নিয়ে বসে তো চাদরে ভাঁজ ফেলে দিলেন।’
প্রচ্ছদ বিস্ময় নিয়ে বলল, ‘ আমি বসলে বিছানায় কখনোই ভাঁজ পরে না। আমি অধিক সচেতন ঘরওয়ালা এবং অত্যধিক গোছানো।’
দুষ্টু বিরবির করে বলল, ‘নিজের ঢোল নিজে পিটায়।’
‘জি নাহ। নিজে পিটাই না। তুমি দেখো, যেভাবে ঘর গুছিয়ে যাচ্ছো দু’দিন পর এসে সেভাবেই পাবে।’
দুষ্টুর হাত জোড়া দৈবাৎ থমকে গেলো। আচম্বিতে সে বলে বসলো, ‘আর যদি না আসি?’
প্রচ্ছদ মাথা মুছছিলো। দুষ্টুর অতর্কিত প্রশ্নে থেমে গেলো তার হাত জোড়াও। পেলব স্থির নয়নে তাকিয়ে থাকলো ক্ষণকাল। এরপর আবারো তুমুল বেগে মাথা মুছতে মুছতে উত্তর এলো,
‘তোমার ইচ্ছে।’
‘আপনি যাবেন না?’
‘যাবো।’
‘থাকবেন না?’
‘না।’
‘কেনো?’
‘আমি কোথাও গিয়ে কম্ফোর্টেবল ফিল করি না।’
‘না যাওয়াই ভালো। দুটো দিন পূর্বের নিয়মে চলবে আমার জীবন যানবাহন।’
বলেই দুষ্টু উল্লাসে নীড়কে ফোন দিয়ে বারান্দার দিকে পা বাড়ালো। এরপর ঘন্টা খানিকের ন্যায় চলবে তাদের কথোপকথন। সেসব কথার দু’একটা শব্দ ইচ্ছেবশত কানে এসে লাগবে প্রচ্ছদের। প্রায় সময় তাও লাগে না! নিশ্চুপতার ভিড় জমে মস্তিষ্কের ভেতর। ভিড়ে ভিড়ে দ্বন্ধ লেগে ছিন্নভিন্ন করবে প্রচ্ছদের অন্তর্কূল। হঠাৎ ভেসে এলো দুষ্টুর প্রাণোচ্ছল কণ্ঠধ্বনি। প্রচ্ছদের কান’টা পরে রইল ওদিকে। আচ্ছা, ছেলেটার কণ্ঠ বুঝি এতো সুন্দর, যা শোনা মাত্রই দুষ্টু উল্লাসে ভাসে? নাম কি তার? আচ্ছা, প্রচ্ছদের বিন্দুমাত্র অস্তিত্ব, উপস্থিতি কি দমায় না মেয়ে’টাকে? নিঃশ্বাসে অস্বস্থি সৃষ্টি করে না? মনের মধ্যে কুণ্ঠিত বোধ জাগ্রত হয় না? সব ভালোবাসায় টান থাকা কি এতোটা জরুরি? কিছু ভালোবাসা কি বুঝে, তারা মাঝে মাঝে দুঃখ বয়ে আনে, মন ভাঙে, সম্পর্ক ভাঙে, পবিত্র হয়েও পবিত্রতা বিনষ্ট করে? ইশশ.. কেনো.. মা ওকে স্টেশন থেকে ধরে নিয়ে এসেছিলো? কেনোই বা আমি ওকে বিয়ে করেছিলাম?
২৭.
রান্নাঘরে খুটুরমুটুর আওয়াজ। দুষ্টু পা বাড়ালো সেদিকে। বেলা সাড়ে সাতটায়, এখনো কারোর দরজার খিল খুলেনি। এতো সকালে ইরাকে রান্নাঘরে দেখে দুষ্টু আস্তে করে ওর পেছনে গিয়ে দাঁড়ালো। ইরা পেছন ফিরে তাকাতেই ভয়ে বুকে থুতু দিয়ে সৌজন্যে হেসে বলল,
‘কি অবস্থা? এতো সকালেই বাড়ি যাওয়ার জন্য তৈরি?’
ইরার প্রাণবন্ততা কণ্ঠস্বর শুনে মনে হলো এর আগে কতই না কথা হয়েছে দুষ্টুর সাথে! দুষ্টু ক্ষণসময় তাকিয়ে থাকলো ইরার ফর্সা টসটসে আননে। আদুরে, মায়া, পেলব বর্ণের কপোলে লালাভ রাঙা। স্নিগ্ধ, অভিনব মুখ’টার দিকে অনন্তকাল চেয়ে থাকলেও ক্লান্তি আসবে না বরং বাড়বে চোখের তৃষ্ণা। তাকিয়ে থাকার কালেই দুষ্টু ভাবলো, ইরার চেহারায় ওই মায়াময়ী… পবিত্র একটা ছায়া-প্রতিচ্ছায়ার জন্যই মন থেকে শ্রদ্ধা আসে, ভালোবাসা আসে, আদর করতে ইচ্ছে হয় সাথে এও ভাবলো, এ বাড়ির যেকোনো ধরনের খবর সবার আগে জানার অলৌকিক কোনো জোর আছে ইরার। সবাই তাকে বিশ্বাস করে, ভরসা করে, একান্ত ব্যক্তিগত গোপনীয় কথাগুলোও তার সামনে বলা যায় অনায়াসে। হয়তো তার সেই অকৃত্রিম ক্ষমতার জোরেই সে এতো বিশ্বাসযোগ্য নারী। তা নাহলে কাল অনেক রাতে প্রচ্ছদের সাথে ঝগড়া হলো। প্রচ্ছদ ঘর ছেড়ে বেরিয়ে এলো। হয়তো তখনি সিড়িন আন্টিকে বাড়ি যাওয়ার জন্য পারমিশন দিতে বলেছে। কিন্তু সকাল হতে না হতেই দুষ্টুর বাপের বাড়ি যাওয়ার খবর ইরা কীভাবে জানলো? বাড়ির বড় বউদের বুঝি এতোটাই নমনীয় এবং লোকাতীত অভূতপূর্ব শক্তি থাকতে হয়?
দুষ্টু হঠাৎই ইরাকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরলো। আচম্বিতে এহেন বার্তাহীন আবেগে ইরা বিস্মিত হলো। এক হাত দিয়ে দুষ্টুর থুতনি ধরে অতি প্রীতির সুরে বলল,
‘কি হলো?’
দুষ্টু মাথা নেড়ে বলে, ‘কিছু না।’
ইরা মুচকি হাসলো। দুষ্টুর মাথা এক হাতে কাধে চেপে রেখেই বলল,
‘জানো, কাল অনেক রাতে এসে প্রচ্ছদ দরজা ধাক্কিয়ে আমাকে জাগালো। দরজা খুলতেই বলল, মা’র কাছ থেকে পারমিশন এনে দাও। দুষ্টু কাল ওর বাড়ি যাবে।’
দুষ্টু ইরার কাধে মাথা রেখে খুব শান্তিতে বলল,
‘তোমার মধ্যে না একটা মা মা ব্যাপার আছে। এতো ভালো কেনো লাগছে আমার?’
‘তাই?’
‘হুম।’
‘এভাবে কেউ আগে কখনো বলেনি।’
দুষ্টু মাথা উঠালো। অতি উচ্ছ্বাসে বলল, ‘আমি তাহলে ফার্স্ট?’
ইরা হেসে মাথা ঝাকায়। দুষ্টু ঠোঁট উল্টে প্রশ্ন করে, ‘কি করো তুমি? তোমার না রান্নাঘরে আসা বারণ?’
‘তোমার ভাইয়ার প্রেসার উঠেছে। তাই তেঁতুলের শরবত বানাই।’
‘ওহ। আচ্ছা, তুমি আমার বিয়েতে যাওনি?’
‘নাহ। সময় পাইনি। বাড়িতে সব কিছু গোছগাছ করতে হয়েছে। মাও বাড়িতে ছিলো না। কিন্তু নীরা গিয়েছিলো।’
‘বাদ দাও ওর কথা।’
‘কেনো?’
‘এমনি।’
ইরা একবার তাকিয়ে হাসলো। দুষ্টুর পাশে দাঁড়িয়ে ওর মাথার চুল ঠিক করে দিতে দিতে বলল, ‘পড়াশোনা তো শেষ। এবার কি করার ইচ্ছে?’
দুষ্টু তাকের সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে চোখ উল্টে ভাবলো। বলল,
‘বিসিএস এর ভাইভার জন্য অপেক্ষা করছি। সামনের মাসে পরীক্ষা। আই ওয়ান্ট টু বি আ ম্যাজিস্ট্রেট।’
ইরা আঁতকে উঠলো, ‘এ বাড়ির বউরা চাকরি বাকরি করে না। মা এসব পছন্দ করে না।’
দুষ্টু তুচ্ছ-তাচ্ছিল্যের ন্যায় হেসে বলে, ‘আমাকে না করবে না। আমি তো তোমাদের বাড়ির পার্মানেন্ট বউ না।’
ইরা অপ্রতিভ নয়নে তাকালো। প্রচ্ছদের ডাক পরলো। দুষ্টু বিরক্ত গলায় বলল, ‘আচ্ছা এ বাড়ির সবাই কখন ঘুম থেকে উঠে?’
‘সবাই ফজর নামাজ পড়ে জেগেই থাকে। কিন্তু ঘরের দোর খুলে আট’টার দিকে। শুধু টিয়া, নীরা বেলা পর্যন্ত ঘুমোয়।’
প্রচ্ছদের দ্বিতীয় দফার হাঁকানি ভেসে এলো। দুষ্টু তিক্ততা নিয়ে চোখ পাকিয়ে ঘরের দিকে তাকালো। তেতুঁলের শরবত গ্লাসে ঢালতে ঢালতে ইরা হেসে বলল,
‘যাও।’
‘যাচ্ছি। শুনো, তুমি আমাকে তুই করে ডাকবে, ঠিকাছে?’
ইরা মৃদু হেসে বলল, ‘ঠিকাছে।’
‘আর আমি তোমাকে সুন্দর ভাবী বলে ডাকবো। তোমাকে দেখলেই আমার আদর করতে ইচ্ছে করছে।’
ইরা অবাক হয়ে তাকালো। আশ্চর্যান্বিত দর্শনেন্দ্রিয় দিয়ে তাকিয়ে থাকার কালেই কার্ণিশে মুক্তোর ন্যায় বিন্দু বিন্দু পানি জমলো। প্রথম প্রথম এ বাড়িতে তার বেশ কদর থাকলেও তা ক্রমেই কমে এলো বাচ্চা হয় না বলে। তারউপর ছোট জা নীরার আগে বাচ্চা হয়ে যাওয়ায় তার দাম তলায় এসে থেমেছিলো সবার কাছে। কিন্তু সে বুঝে আদতে.. তা তার মনের ভুল। সবাই তাকে ভালোবাসে, বিশ্বাস করে কিন্তু কোথাও একটা ফাঁক রয়ে যায় নিজের কাছে। দুষ্টু ডাকলো নরম উদ্বেল কণ্ঠে বারংবার,
‘সুন্দর ভাবী, সুন্দর ভাবী।’
ইরার ভালোবাসার মুক্ত খাতাটা পরিপূর্ণ স্বামীর ভালোবাসা দিয়ে। আজ এই স্ফটিক রোদ্দুরে প্রত্যুষে… মানুষে ভর্তি হলেও নিস্তব্ধ বাড়িটায়.. বোধহয় নতুন কেউ সংযুক্ত হতে চাইছে! সে উচ্ছ্বাসী, অপরূপ, অত্যদ্ভুত, প্রাণাবেগ, প্রানবন্ত চমৎকার একটি মেয়ে। তার উপমার আদ্যোপান্ত নেই ! সেই মেয়ের মোলায়েম ডাকে ইরার আত্মা ধক করে উঠলো। বুক পিঠ ছেয়ে গেলো অপ্রত্যাশিত ভালোবাসাময় ডাকে। মেয়েটা এতো সুন্দর করে ‘সুন্দর ভাবী’ কেনো ডাকলো? ইরার বুকের উথাল-পাতাল ঢেউ গুলো এবার সামাল দেবে কে? একটু পর যখন কান্না হয়ে গড়িয়ে পরবে চোখ থেকে… মেয়েটা তো চলে যাবে বাপের বাড়ি.. ওর চোখ দুটো মুছিয়ে দেবে কে?
২৮.
দুষ্টু-প্রচ্ছদ বের হওয়ার পর পরই বাড়ি ছেড়ে বের হলো সাজিদ। বের হওয়ার আগ মুহুর্তে নীরা অগ্নিশর্মার ন্যায় নিত্যকার ন্যায় নিত্য অভিযোগ তুলল,
‘আমি যখন বিয়ে করে এসেছিলাম তখন তো সাতদিনের আগে বাপের বাড়ি যেতে দেয়নি। আবার নিজের ছেলের বউকে তো ঠিকই যেতে দিলো।’
সাজিদ ত্যক্তবিরক্ত মুখে বলল, ‘ও তিনমাস পরে ডিভোর্স নেবে, তুমিও কি তাই নিতে?’
নীরা নাক ফুলিয়ে বলল, ‘গুষ্টিসুদ্ধ পেয়েছে এক বুলি।’
,
রাস্তায় জ্যাম পরলো। গাড়িতে বাড়ি মেরে সাজিদ বলল, ‘সকাল’টাই শুরু হচ্ছে খারাপ দিয়ে।’
পাশেই হলিক্রস কলেজ। হলিক্রসের ড্রেস পড়া একটা মেয়ে কলেজে ঢুকতে গিয়েও ঢুকলো না। যে পথ দিয়ে এসেছিলো উল্টো ফিরে চলে গেলো সে পথে। সাজিদের চোখ আটকে গেলো সেখান’টাতেই। বেহায়া চোখ সরাতে চাইলেও সরলো না। তাকিয়ে থাকলো সেই দুই ঝুটিওয়ালা সিল্কি চুলের ভাঁজে। সাদা ইউনিফর্মে। মেদহীন শরীরের প্রতিটি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে। খুব কষ্টে চোখ সরিয়ে নিলেও নির্লজ্জ নির্লিপ্ত চোখ দুটো গিয়ে ভিড় জমালো আবারো সেই কিশোরীতে। নিষ্কলুষ পুরুষটিকে সেই নারী মুহুর্তেই কলুষিত করে দিয়ে গেল। জ্যাম ছেড়ে দিলো। কাজে না গিয়ে কেমন একটা মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে সাজিদ গাড়ি নিয়ে পথ ধরলো সেই মেয়ের পেছনে। তার চোখ লাল। অসম্ভব লাল। সেই চোখে তাকে দেখে মনে হচ্ছে ‘সে বশভূত বাদ্য শিষ্য’। ইহকালে সে এমন বশবর্তী হয়ে কখনো কোনো নারীর পেছন পথ ধরেনি। এমন আজ্ঞাবহ হয়ে সে এই অজ্ঞাত নারীর পথ ধরেছে, যেন ভুলে গেছে সে বিবাহিত সাথে বেমালুম ভুলে বসে আছে, তার একটা ফুটফুটে আকাশ আছে। হাসলে যাকে আকাশের মতোই সুন্দর দেখায়। ফোকলা দাঁতে হেসে আধো আধো করে দু’এক পা ফেলতেই টুপ করে পরে যায় সাজিদের কোলে! সাজিদ তখন ঝাপটে ধরে নরম রাঙা গালে চুমু খায় অজস্র!
চলবে❤️
#এমন_একদিন_সেদিন
#মুমুর্ষিরা_শাহরীন
পর্ব-১৩
বাসার কাছাকাছি আসতে আসতেই শ্রেয়া প্রায় এলোমেলো হয়ে গেলো। ঝুটি’র বাঁধন আলগা হলো। অগোছালো চুল মুখ জুড়ে ছেয়ে গেলো। চোখ ভরা ক্লান্তির রেশ। এক হাত কোমরে আরেক হাত পেটের উপর রেখে হাঁপালো মিনিট দুয়েক। নরম শীত-রোদ্দুরে হাওয়ায় মৃদু উড়ছে গলায় ফেলে রাখা সাদা স্কাপের একাংশ। নিরুপদ্রব হলদে বর্ণের রোদ’টা শ্রেয়ার মলিন মুখের একপাশ’টায় পড়তেই, তাকে দেখালো স্বর্ণ কিশোরীর মতোন। সাজিদ তাকিয়ে রইলো অপলক! যেনো এহেন আশ্চর্য সুন্দরী কিশোরীর দেখা সে ইহজনমে আর কখনো পায়নি। সে জানে, এ পাপ। তবুও… তবুও কোনো এক আধ্যাত্মিক চেতনায় সে চোখ সরাতে পারলো না। তাকিয়ে থাকতে থাকতে চোখ জ্বলে উঠে। মুখে তিক্ত অনুভূত হলো। শরীর কেমন ঝনঝন করলো। তবুও নজর সরাতে পারলো না। আটকে গেছে। কি এমন যাদু করলো এই মেয়ে!
শ্রেয়ার বাসার সামনে গাড়ি’টা থেমেছে। নীল বর্ণের গেট দিয়ে ঢুকতে গিয়ে শ্রেয়া একবার চোখ মুখ খিচে শরীর বাঁকিয়ে পেছনে ঝুঁকে ডান দিকে তাকালো। তার ঝুটি দুটো হেলে গেলো। সাজিদ অপ্রস্তুত, ভয়হীন, লজ্জাহীন কিন্তু এক মুগ্ধকর চোখে তা দেখলো। গাড়িটার দিকে কিছুক্ষণ ভ্রু কুচকে তাকিয়ে থেকে শ্রেয়া ভেতরে ঢুকলো। গাড়ি’টা অনেকক্ষণ থেকে তাকে অনুসরণ করছিলো, সে খেয়াল করেছে।
জুতা খুলে ঘরে ঢুকতে যাবে এমন সময় শ্রেয়সীকে বের হতে দেখা গেলো। শ্রেয়ার দিকে ভ্রু নাচিয়ে সে জিজ্ঞেস করলো,
‘কি ব্যাপার? তুই না কলেজ গেলি?’
শ্রেয়া চোখ মুখ কুচকে বলে, ‘তলপেট ব্যাথা। কোমরেও ভয়ানক ব্যথা। বোধ হয় পিরিয়ড হবে। ডেট মিসড অলরেডি।’
শ্রেয়সী ব্যাগ দেখে নিতে নিতে বলল, ‘গরম পানির ছেঁক দিয়ে একটু রেস্ট নিয়ে পড়তে বসবি। নো ফাঁকিবাজি। সামনে কিন্তু বোর্ড এক্সাম। মাথায় যেনো থাকে।’
—
সাজিদ শ্রেয়ার বাসার সামনে বসে আছে প্রায় আধ ঘন্টা হলো। কেনো বসে আছে কে জানে। এই সময়’টা কি তার প্রেমে পড়ার? ভালোবাসার সময়গুলো কি আরো অনেক আগেই পার হয়ে যায়নি? তার ঘরে বউ আছে, বাচ্চা আছে। সে তো টগবগে যুবক নয়, সে একজন পূর্ণাঙ্গ পুরুষ। যার জীবনে সব আছে, হয়ে গেছে, ঘটে গেছে। নতুন করে তো আর কোনো কিছু হবার নেই।
তার ভেতরটা কেমন একটা অস্বস্থিকর কাঁটা দিয়ে উঠলো। নিজের কাজ-কর্ম নিজের কাছেই ভীষণ তিক্ত এবং লজ্জার বলে বোধ হলো। মেয়েদের পেছনে ঘুরার মতো বয়স’টা কি এখন তার আছে? আর মেয়েটাও অনেক ছোট হবে। ইন্টার ফার্স্ট কিংবা সেকেন্ড ইয়ার হয়তো পড়ে। এতসব চিন্তা ভাবনার পরেও সাজিদের ভেতর থেকে একটা অবাধ্য সুর বলে উঠলো, আমার-ই বা এমন কি বয়স? উনত্রিশ পেরিয়ে ত্রিশ চলছে। ছোট বয়সে বিয়ে দিয়েছে বলেই না বউ-বাচ্চা হয়েছে। হ্যাঁ অবশ্যই ছোট বয়স, প্রচ্ছদ ওর থেকে মাত্র চার মাসের ছোট অথচ সে তো কেবলে বিয়ের পাট চুকালো। ওই বয়সটা তো সাজিদের বিয়ে করার বয়স ছিলো না। আদতে… তার বিয়ে করার বয়স তো এখন। সাতাশ বছর বয়সে বিয়ে করাটা এখন নিছক তুচ্ছ, বোকামি বলে বোধ হচ্ছে। জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল। তিনবছরের এই প্রথমবার মনেতে হঠাৎ উঁকি দিচ্ছে, ‘নীরার মতো একটা জীবনসঙ্গিনী কি তার যোগ্য হয়?’
২৯.
বদ্ধ গাড়ির কালো কাচের ভেতর দুষ্টু জড়োসড়ো হয়ে বসে আছে। প্রচ্ছদ দুষ্টুর দিকে তাকিয়ে পুনরায় দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। সামনের শূন্য রাস্তায় একদৃষ্টিতে তাকিয়ে কঠিন গলায় বলল,
‘দুষ্টু নামো।’
দুষ্টু সিটের সাথে আরো খানিকটা লেগে বসলো। সিটে মাথা এলিয়ে দিয়ে বলল,
‘আপনাকে ছাড়া যাওয়া যাবে না। বাড়িতে ঢুকতেই পারবো না আমি।’
প্রচ্ছদ বিরক্ত হলো, ‘আমার ক্লাস আছে। বাচ্চাদের মতোন করছো কেনো? নামতে বলেছি, নামো জলদি।’
দুষ্টু নির্বিকার বসে রইল। বরং হেলানো মাথাটা অন্যপাশে কাৎ করে চোখ বন্ধ করে রইলো। প্রচ্ছদ প্রলম্বিত এক শ্বাস নিজের মাঝে টেনে নিয়ে হতাশ মিশ্রিত স্বরে বলল,
‘চলো কিন্তু দশ মিনিট। এর বেশি থাকতে পারবো না।’
—
জানালার পর্দা গুলো উড়ছে মুক্ত বিহঙ্গের ন্যায়। এক ফালি কড়া রোদ জানালা গলিয়ে মেঝের উপর লম্বা ছায়া ফেলেছে। দুষ্টু জানালার আঁকাবাঁকা গ্রিল ধরে ম্লান মুখে দাড়াঁলো। প্রচ্ছদ আট মিনিটের মাথায়ই চলে গেছে। এক গ্লাস শরবত কোনোমতে তার পেটে পরেছে। মা কতশত রান্না করেছে। প্রচ্ছদ কিচ্ছু মুখে না দিয়ে চলে যেতেই তিনি চোখ পাঁকিয়ে তাকালেন। যেনো দোষ’টা দুষ্টুর। প্রচ্ছদ দুষ্টুর উপর নাখোশ বলেই এ বাড়ির খাবার পর্যন্ত মুখে তুললো না। আর দুষ্টুও বা কেনো জোর করে তুলে তুলে আহ্লাদ দেখিয়ে বারংবার তোষামোদি করে নিজের স্বামীকে খাবার দিলো না? এই নিয়ে মা আর তার মধ্যে একদফা কথা কাটাকাটিও হয়ে গেছে।
বড় করে শ্বাস টেনে নিয়ে অতঃপর ছেড়ে দুষ্টু ঝাপসা চোখে এদিক সেদিক তাকালো। তাকাতেই উত্তপ্ত রাস্তার একটা ধারে চোখজোড়া আটকে গেলো। অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকলো। কুচকানো ভ্রু জোড়া সোজা হলো তখন, যখন নীড়ের ফোন এলো। দুরুদুরু বুকে কল’টা রিসিভ করে দুষ্টু স্তব্ধ হৃদপিন্ডে স্থির দাঁড়িয়ে রইল। ওপাশ থেকে নীড় উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে বলল,
‘দুষ্টুপাখি, একটু নিচে এসো।’
দুষ্টু রাস্তার ওই ধারে তাকিয়ে প্রশ্ন ছুড়লো, ‘কোথায় তুমি?’
মাথার পেছনের চুলে চুলকে নীড় বলে, ‘এই আরকি, তোমার বাসার নিচে। আসো না একটু!’
ফোন কেটে দুষ্টু ঘরের এদিক ওদিক তাকালো। ভাগ্যক্রমে যে আজ-ই নীড় এসেছে। যদি অন্য কোনোদিন আসতো তখন কি বলে সামাল দিতো দুষ্টু? ঘর ছেড়ে বেরিয়ে এসে কাজের মেয়েটাকে ইশারায় ডেকে সে ফিসফিস করে বলল,
‘মা কোথায়?’
‘খালাম্মা তো ঘরে। খালুরে ওষুধ খাওয়ায়। ডাইক্যা দিমু?’
‘নাহ। তুই যা।’
টিপটিপ পায়ে দুষ্টু নিচে নেমে এলো। গেটের পাশে নীড়কে দেখে ভয়ার্ত কণ্ঠ খাদে নামিয়ে বলল,
‘একদম গেটের সামনে দাঁড়িয়ে আছো কেনো?’
নীড় জোরপূর্বক হেসে বলে, ‘কেনো? কি হয়েছে? প্রথমবার তো আসছি না। আগেও এসেছি। এতো ভয় পাচ্ছো কেনো?’
দুষ্টু সতর্ক দৃষ্টিতে এদিক ওদিক তাকিয়ে বলল, ‘এমনি, বাবা অসুস্থ না? মা তেমন বাইরে বের হতে দেয় না।’
‘ওহ।’
দুষ্টু নীড়ের হাতের ছোট্ট লাল শপিংব্যাগ’টার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘এটা কি?’
নীড় কিঞ্চিৎ হেসে ব্যাগ থেকে একটা লাল গোলাপ ফুলের গাজরা বের করলো। দুষ্টুর দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল,
‘আসার সময় পছন্দ হলো। তাই তোমার জন্য নিয়ে এলাম।’
নীড়ের ঠোঁটে অমায়িক হাসি। দুষ্টু নিষ্প্রাণ চোখে ওই হাসির দিকে আটকে রইল বহুক্ষণ। নীড় মাথা ঝাঁকিয়ে আবারো স্বভাবসুলভ হেসে বলল,
‘আমি কল্পনা করি, গাজরা পড়লে তোমায় পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সুন্দরী প্রিয়তমা দেখাবে। আমার যদি কখনো ক্ষমতা হয় আমি তোমার ওই কালো চুলের চারপাশে সোনার গাজরা পরিয়ে দেবো। ঠিকাছে?’
দুষ্টুর ঝাপসা চোখ মোহাচ্ছন্ন! কুয়াশাচ্ছন্ন! স্বপ্নাচ্ছন্ন!চোখের এদিক ওদিক ছড়াছড়ি নীরের দল। গাজরা’টা হাতে নিয়ে অস্পষ্ট চোখেই হাসলো। একবার ঠোঁট ছোঁয়াতেই টলমলে চোখ থেকে গড়িয়ে পরলো অম্বু। নীড়ের হাস্যোজ্জ্বল মুখটা থমথমে হলো। উত্তেজিত কন্ঠে বলল,
‘কি হয়েছে, দুষ্টু?’
দুষ্টু নাক টেনে হেসে মাথা দুলিয়ে বলে, ‘কিছু না। খুব সুন্দর এটা! না পঁচুক! আমি সারাজীবন রেখে দিতে চাই।’
নীড় প্রণয়ন দৃষ্টিতে চাইলো। দুষ্টু গাজরার দিকে আচ্ছন্ন ভরপুর দৃষ্টিতে তাকিয়ে মোলায়েম স্বরে বলল,
‘আমি তোমায় কখনো কষ্ট দিতে চাই না, নীড়। যদি কখনো, কোনোদিন, কোনোকালে আমি তোমায় তীব্র ভাবে কষ্ট দিয়ে ফেলি, ক্ষমা করবে আমায়?’
বলতেই দুষ্টু নিঃশব্দে ঠোঁট ভেঙে কেঁদে দিলো। নীড় বিস্মিত। অবাক আশ্চর্য চোখে বুলিহীন চেয়ে রইল কতক্ষণ। অতঃপর জোরপূর্বক মৃদু হেসে বলল,
‘তুমি আমাকে কক্ষনো কষ্ট দিতেই পারবে না। কারণ তার আগে তো তুমি নিজে মরে যাবে।’
দুষ্টুর বুক’টা হুহু করে উঠলো। কত্ত ভরসা! অথচ…? ছিহ! দুষ্টু কত নিচ! নীড়ের বিশ্বাস’কে পা দিয়ে পিষে ইতিমধ্যে সে সজ্ঞানে মৃত্যু সমতুল্য কষ্টের সূচনা ঘটিয়ে ফেলেছে। কিন্তু ও যে এখনো মরেনি। নীড়’কে কষ্ট দেওয়ার দায়ে, অপরাধে, বিশ্বাসঘাতকতা করায় ওর কি এক্ষুণি শ্বাসরুদ্ধ হয়ে মরে যাওয়া উচিত নয়?
অথচ দুষ্টু জানে বিবেকের দংশনে ও প্রতিনিয়ত মরছে। অনিচ্ছাকৃত ওর মাথায় চাপিয়ে দেওয়া প্রতারণার.. ঠকবাজের.. প্রবঞ্চকের নিষ্ঠুর প্রলেপের কিছু স্তূপ ও সর্বত্র বয়ে বেড়াচ্ছে।
দুষ্টু দৌড়ে চলে গেলো। নীড় চেয়ে থাকলো যতক্ষণ দেখা যায় ততক্ষণ। মাথার ভেতর শুয়ো পোকার মতো কামড়ালো অপ্রত্যাশিত প্রশ্নটা। তার চেয়েও বেশি যন্ত্রণা দিলো প্রিয়তমার চোখের পানি। থমকানো হৃদয়ে হাজারো প্রশ্ন নিয়ে পথ ধরে কয়েক কদম এগিয়ে যেতেই আচম্বিতে একটা হুট তোলা রিক্সা তার সামনে দাড়াঁলো। মিষ্টি হেসে এক আশ্চর্য সুন্দরী মাথা বের করলো। গেঁজ দাঁত ঝিলিক দিলো। নীড় পলকবিহীন মেয়েটার দিকে তাকিয়ে বিরবির করলো,
‘হাসলে মেয়েটাকে সুন্দর দেখায়। তবে আমার একান্ত নারী’টাকে তার থেকেও বেশি ঋজু সুরম্য দেখায়!’
চলবে❤️