এমন একদিন সেদিন পর্ব-৪০+৪১+৪২

0
2

#এমন_একদিন_সেদিন
#মুমুর্ষিরা_শাহরীন
পর্ব-৪০
৮৫.
হক বাড়িতে আজ বিয়ের সন্ধ্যা। চারিদিকে উৎসব-উল্লাসের ঢল। বাগানের মাঝখানে বড় করে চাদোঁয়া টানানো। একপাশে বাবুর্চির হাতে বড় বড় ডেচকিতে চলছে রান্না। দুষ্টু ছুটাছুটি করে যাচ্ছিলো। প্রচ্ছদ হাত টেনে ধরলো। হৃদপিণ্ড স্তম্ভিত থেমে গেলো। বিস্ময় নিয়ে একবার হাতের দিকে তাকিয়ে, কালো পাঞ্জাবি পড়া প্রচ্ছদের ওই শুভ্র, পেলব মুখটার দিকে তাকালো। অপ্রস্তুত হেসে বলল,

‘আপনারা না বরপক্ষ? এখনো যাচ্ছেন না কেনো? বরযাত্রী হয়ে আসতে হবে না আবার? কনে বাড়িতে থাকতে বুঝি এতোটাই ভালো লাগছে?’

প্রচ্ছদ মাথা দুলিয়ে হাসলো। দুষ্টু সেকেন্ড কতক তাকিয়ে থেকে চোখ সরালো। বিয়ের রাতে ছাড়া প্রচ্ছদকে দুষ্টু কক্ষনো পাঞ্জাবীতে দেখেনি। আজ এতোদিন বাদে এই কৃষ্ণ বর্ণের পাঞ্জাবিতে তাকে দেখতে লাগছে অমায়িক! হঠাৎ মনে পরলো, বিয়ের রাত….! কি সময়টায় না ছিলো তখন! আর এখন? নীড়ের বিয়ে হচ্ছে। তার প্রাক্তন প্রেমিক, তার ভালোবাসার বিয়ে হচ্ছে। তার কি ভীষণ মাত্রায় দুঃখ পাওয়া উচিত নয়? দরজা আটকে হাত-পা ছড়িয়ে কেঁদে শ্বাস রোধ করার কথা না! কিন্তু এমন কিছু তো হলোই না উল্টে হাসি মুখে, আনন্দে-উচ্ছ্বাসে বিয়ের সার্ভিস দিয়ে বেড়ালো। কি আশ্চর্য! সর্বদা কল্পনাময়ী মেয়েটা কবে এই কঠিন বাস্তবতা হাসিমুখে মেনে নিতে শিখলো?

‘কি ভাবো সারাক্ষণ?’

দুষ্টু সম্ভিত ফিরে চমকে উঠে। অবুঝ কণ্ঠে বলে,

‘হ্যা? কি? কিছু লাগবে? মানিব্যাগ নিয়েছেন? গেটে কিন্তু টাকা দিতে হবে।’

প্রচ্ছদ মৃদু হেসে বলল, ‘আচ্ছা, রেডি হয়ে নাও।’

দুষ্টু কপালে ভাঁজ ফেলে। চিন্তিত ভঙ্গিতে বলল,

‘শাড়ি পড়তে হবে তাই না?’
‘তোমার ইচ্ছে।’
‘বড় ভাবীকে একটু ডেকে দেন।’
‘বড় ভাবী ব্যস্ত।’
দুষ্টু মৃদুস্বরে বলল, ‘ওহ।’
পুনরায় বলে, ‘আচ্ছা তাহলে আন্টিকে ডেকে দেন।’
‘মা তো আরো ব্যস্ত।’
সে মন খারাপ নিয়ে বলল, ‘লেহেঙ্গা পরি?’

প্রচ্ছদ দু’দিকে মাথা নাড়িয়ে না করে বলে,

‘বড় ভাবী, নীরা, মা, কাক্কি সবাই শাড়ি পরবে।’

দুষ্টু চোখ পাক্কিয়ে তাকালো, ‘ডিরেক্ট বলে দিলেই হয় শাড়ি পরো।’

‘লেহেঙ্গা পরলে ভালো দেখাবে না।’

দুষ্টু ভ্রু কুটি করে বলে, ‘একটু আগে না বললেন আমার ইচ্ছে?’

পরক্ষণেই বলে, ‘দূর, আমি রেডি হবো না। বিয়েতেও যাবো না।’

বিষন্ন চোখে বিছানায় রাখা মেরুন রঙের শাড়িটার দিকে তাকালো৷ শাড়ির পাশে রাখা গাজরায় চোখ পড়তেই মন’টা কেমন করে উঠলো! বুকের মাঝে কান্নার একটা উদ্বেল হুংকার দিয়ে বেরিয়ে আসতে চাইলো। তখন হঠাৎ পাশ থেকে ফিসফিসানি শব্দ কানে এসে লাগলো। দুষ্টুর চোখ দুটো ক্রমেই বিস্ফোরিত হয়ে উঠলো,

‘আমি শাড়ি পরিয়ে দি?’

দুষ্টু চোখ রাঙিয়ে তাকায়। প্রচ্ছদ ঘর কাঁপিয়ে হাসতে হাসতে বলল,

‘আচ্ছা বড় ভাবীকে পাঠিয়ে দিচ্ছি। তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে নাও।’

৮৬.
শ্রেয়সীর সাথে শ্রেয়া এসেছে। শ্রেয়সী উকিঁঝুঁকি দিয়ে একবার দেখলো। হাতে গিফট বক্স। প্রযুক্তকে আসতে দেখে হালকা ভয়ার্ত মুখে মুচকি হাসির সঞ্চার হলো। প্রযুক্ত এসে নিচুস্বরে বলল,

‘আমি আপনার সাথে সাথে থাকতে পারবো না। বাবা-মা উপস্থিত। আপনি আপুর কাছে যান।’

শ্রেয়সী গলার স্বর নিচে নামালো, ‘আপু কোথায়?’

‘বাড়ির ভেতরে যাবেন। দু’তলার ডান পাশের ঘরে। প্রচ্ছদের ঘরে আছে।’

‘আপনি একটু চলুন না!’

শ্রেয়সীর করুণ সুর। সবার আড়াল থেকেই প্রযুক্ত শ্রেয়সীর গালে হাত রেখে নরম গলায় বলল,

‘একটু ম্যানেজ করে নিন। আমাকে এখন আবার বরকে আনতে যেতে হবে।’

শ্রেয়া পাশ থেকে ফিসফিসিয়ে বলল, ‘দুলাভাই, এই শালি থাকতে বউকে নিয়ে নো টেনশন।’

শ্রেয়সী মুখ বাঁকালো। প্রযুক্তর ডাক পড়লো। ব্যস্ত পায়ে চলে যেতেই শ্রেয়সী ওর হাতে গিফট বক্স’টা ধরিয়ে দিতে চাইলে সে বলল,

‘আমাকে দিয়ে কি হবে? আপুকে দিও। টাটা।

শ্রেয়সী দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, ‘চল, শ্রেয়া।’

‘আমি? আমি কোথাও যাবো না। তুমি যাও আপু। আমি এখানেই ঘুরে ঘুরে ডেকোরেশন দেখতে থাকি।’

শ্রেয়সী বিরক্ত হলো, ‘চল তো। হারিয়ে যাবি নাহয়?’

‘ওমা! হারাবো কেনো? আমি বাচ্চা? আর ফোন আছে না? ফোন করবা। যাও তুমি। আমি যাবো না। বেশি জোরাজোরি করলে বাসায় চলে যাবো। তুমি কিন্তু আমায় জোর করে এনেছো।’

‘ধ্যাত।’

শ্রেয়সী চলে গেলো চোখে মুখে অস্বস্থিকর বিরক্তির ছাপ ফুটিয়ে। শ্রেয়া গেটে সাজানো ফুল থেকে একটা ফুল ছিড়ে নিয়ে বিরবির করলো,

‘এ্যাহ, এমনি সারাদিন বলে, পড় পড় পড়। সামনে বোর্ড এক্সাম। আর এখন যেই জামাই বলল নাচঁতে নাচঁতে আমাকেও বগলদাবা করে নিয়ে বিয়ে খেতে চলে এলো।’

সাজিদ হন্তদন্ত হয়ে বেরুচ্ছিলো। আয়না কেনা হয়নি। বিয়েতে নাকি বর বউ একজন আরেকজন মুখ আয়নায় দেখে নানানরকম সুন্দর উপমা দেয়! তাই সাজিদ যাচ্ছে এই অসময়ে আয়না কিনতে। তার গায়ে নেভি ব্লু পাঞ্জাবি। চোখে মুখে অস্থিরতা। গেট পেরুতেই বিরবির করতে থাকা শ্রেয়ার সাথে লাগলো সজোরে ধাক্কা। ধাক্কার টালে শ্রেয়া পিছিয়ে গেলো খানিকটা। সাজিদের চোখ বিস্ফোরিত। বুকে কম্পন। বিস্ময়ের চোটে দু’ঠোঁটের মেঝে বিশাল বড় ফাঁক। শ্রেয়া তাকিয়ে আছে ভ্রু কুটি করে। তার ধারণা এই লোক এখানেও তাকে ফলো করে এসেছে। পরক্ষণেই আবার মত পাল্টালো। নাহ, ফলো করে আসলে বাইরে থাকতো, ভেতরে থাকতো না আর এতো সেজেগুজেও থাকতো না। তখনি পেছন থেকে একজন সুন্দরী রমণী ডেকে উঠলো,

‘শোনো, বাবুর জন্য ডাইপার এনো।’

নীরা চলে গেলো। শ্রেয়ার চোখ গুলো এবার গোল গোল বড় বড় মার্বেলের আকার ধারণ করলো। এই লোকের বউ-বাচ্চা আছে? শ্রেয়া অবাক কণ্ঠে বলল,

‘ছি! আপনি এতো চরিত্রহীন? বউ-বাচ্চা থাকতে অন্য মেয়ের দিকে…। ছি!’

সাজিদ কোনোমতে মাথা নিচু করে তড়িঘড়ি করে চলে গেলো এলোমেলো পায়ে। ওই ঘৃণ্য স্বরে বলা বাক্যে ভেতরটা পুড়ে যাচ্ছে, ভেঙে চুরমার হচ্ছে। তার বুঝে এলো না এই মেয়ে এখানে কি করে? কিন্তু সব ভাবনা একপাশে ছুড়ে সে কোনোরকম ভাবে পালিয়ে গেলো।

শ্রেয়া তখনো তাজ্জব বনে তাকিয়ে থাকলো সাজিদের হাটার দিকে। তার ভেতরে যতটা ঘৃণার উদ্রেক হচ্ছে ঠিক ততটা প্রশান্তি বোধ হচ্ছে। আর একটু হলে এই লোকের মোহনায় শ্রেয়ার কোমল হৃদয়ের প্রথম টানের আটকে যাওয়ার সম্ভাবনা ছিল। আল্লাহ বাঁচিয়েছে! সে হাফ ছেড়ে বাঁচলো। ফোন লাগালো শ্রেয়সীকে। কি আজব! হাত-পা গুলো কেমন কাঁপছে! চোখের পলকে ঘটে যাওয়া এহেন অপ্রত্যাশিত ঘটনার জন্য শ্রেয়া যেন মোটেও প্রস্তুত ছিলো না। মোটেও না! কিন্তু তবুও ভালো….।

৮৭.
দু’তলা’টা ফাঁকা। যে যার নিজের কাজে। প্রতি ঘরের দুয়ার বন্ধ। একটা ঘরের দরজা ভিড়ানো। সূক্ষ ফাঁক দিয়ে ছিটকে বেরিয়ে আসছে সরু আলোর রেখা। বেলকনি থেকে ভেসে আসছে কনকনে ঠান্ডা হাওয়া। শ্রেয়সী এগিয়ে গেলো ধীর পায়ে, হাসিমুখে। প্রযুক্তর কথা অনুযায়ী সে ডান দিকের ঘরের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে এবং সেই ঘর থেকেই এক ফালি সরু কৃত্রিম আলো ছিটকে বেরিয়ে এসে তার শরীরে অবস্থান করছে। শ্রেয়সী হালকা হাতে দরজা ধাক্কা দিলো। ধাক্কা দিতেই খুলে গেলো। অপরিচিত মেয়ের শাড়ির কুচি ঠিক করায় ব্যস্ত ইরা তাকালো। ঠোঁট প্রসারিত করে হাসলো। উচ্ছ্বসিত স্বরে বলল,

‘আরে শ্রেয়সী, এসো এসো। দুষ্টু দেখো!’

দুষ্টু চমকে মাথা উঠালো। আগমনীর দিকে তাকাতেই হৃদপিণ্ড স্তব্ধ হয়ে গেলো।

অপরিচিত মেয়েটার মুখ দেখেই থমকে গেলো শ্রেয়সী। তখনি শ্রেয়ার ফোন’টা এলো। ফোন ধরতেই ওপাশ থেকে বলল,

‘আপু আমার শরীর ভালো লাগছে না। বাসায় গেলাম।

সে আচ্ছা বলে ফোন রেখে দেয়। ইরা এগিয়ে আসে। শ্রেয়সীকে ধরে পরিচিত করিয়ে দিলো দুষ্টুর সাথে। দুষ্টু মৃদুস্বরে বলল,

‘ও তোমার কে হয়?’

ইরা কিছু বলতে গিয়েও থেমে গেলো, ‘আমার ছোট বোন।’

দুষ্টু ভ্রু কুচকালো। ইরা বলল,

‘শ্রেয়সী শাড়ি পড়াতে পারো?’

শ্রেয়সী ঘোরের মাঝে মাথা নাড়ায়। ইরা দুষ্টুর আচঁল ঠিক করতে করতে বলে,

‘তবে দুষ্টুকে একটু পরিয়ে দাও। আমার অনেক কাজ পরে আছে। গল্প করো দুজনে, ঠিকাছে?’

ইরা চলে যাওয়ার বেশ মিনিট সাতের পর নিরবিচ্ছিন্ন নিরবতা, অস্বস্থি, অবাকতা কাটিয়ে দুষ্টু চোখ বন্ধ করে জিজ্ঞেস করলো,

‘তুই-ই প্রযুক্ত ভাইয়ার বউ তাই না?’

শ্রেয়সী কথার উত্তর না দিয়ে উল্টে প্রশ্ন করলো,

‘আর তুই এই বাড়ির বউ?’

দুষ্টু উত্তর দেয় না। শ্রেয়সী তাচ্ছিল্য নিয়ে বলে,

‘তোর মতোন বেঈমান আর দুটো দেখিনি আমি।’

দুষ্টু বিস্ময় ভরা দৃষ্টিতে তাকালো। চোখের কোণায় জমলো জল। বলল,

‘আমি বেঈমান? আর তুই কি? তুই নিজেও বিয়ে করেছিস। অথচ একটা বার বলার প্রয়োজন মনে করিসনি। আমার সাথে কোনো যোগাযোগ রাখিসনি।’

শ্রেয়সী হাসলো। বিদ্রুপাত্মক চেহারায় বলল,

‘আমি তো তবুও কাউকে ঠকিয়ে বিয়ে করিনি। যাকে ভালোবেসেছিলাম তাকেই বিয়ে করেছি।’

দুষ্টুর গলা থেকে ছিটকে আর্তনাদের ন্যায় বেরুলো শব্দটা, ‘শ্রেয়সী…..!’

শ্রেয়সী তাকালো। কেমনতর চোখে! সেই চোখে নেই বন্ধুসুলভ আচরণ! নেই বুঝদারতা! নেই আজ দুষ্টুর জন্য উদারতা! দুজনে কথা বলছে শত্রুপক্ষের ন্যায়। কোথায় যেনো হারিয়ে গেছে সোনালি দিনের সেই বন্ধুত্বের আমোদিত দিনগুলো। এতোগুলো ক্ষণ, এতোগুলো দিন, মাস, বছরের সুসম্পর্ক গুলো একটা ঘটনার মাঝেই সব ভুলে গেলো। হয়ে গেলো দুঃসম্পর্ক!

দুষ্টু আহত গলায় বলল,

‘তুই সব জানিস। আমি কোন পরিস্থিতিতে পরে বিয়ে’টা করেছি। তবুও এভাবে বলতে পারলি?’

শ্রেয়সী কেমন ভৎসর্নার ন্যায় জবাব দিলো,

‘তোর লজ্জা করলো না? না জানি নীড় কতটা কষ্ট পাচ্ছে!’

দুষ্টু ঘাড় বাকিঁয়ে তাচ্ছিল্য করে হাসলো। নিচ থেকে ভেসে এলো চিৎকার ‘বর এসেছে, বর এসেছে’। দুষ্টু শক্ত করে শ্রেয়সীর হাত’টা ধরে টানতে টানতে নিয়ে গেলো বাগানে।

কঠিন মুখে, বিরক্তি নিয়ে শ্রেয়সী দুষ্টুকে বারংবার বলল হাত’টা ছাড়তে। কিন্তু দুষ্টু ওকে টেনে নিয়ে দাড় করালো গেটের সামনে। সবুজা হক নীড়কে মিষ্টি খাওয়াচ্ছেন। শ্রেয়সী দ্বিতীয় দফায় বিস্ময় নিয়ে দেখলো। চোখ যেন কোটর ছেড়ে বেরিয়ে আসবে। নীড়ও তখন তাকিয়েছে। পাশাপাশি অনেকদিন বাদে দুষ্টু-শ্রেয়সীকে দেখে তার ঠোঁটে অবাকতার মৃদু হাসি ফুটলো। সাথে একটা অপরাধবোধও কাজ করলো। কারণ সে শ্রেয়সীকে বিয়ের ব্যাপারে কিচ্ছু বলেনি। এদিকে শ্রেয়সীর মাথা টলছে। হাত-পা অসার হয়ে আসছে। দুষ্টুর হাত’টা ঝাপটে ধরে অস্ফুটস্বরে সে বলতে পারলো শুধু,

নীড়?’

দুষ্টু একদৃষ্টিতে তাকিয়ে ক্ষীণ গলায় বলল,

‘হুম। আমার ননদের সাথে বিয়ে। ওর মামাতো বোন।’

শ্রেয়সীর চরম পর্যায়ের অবাক হওয়ার পালা আজ। সে দেখলো দুষ্টুর শুকনো ঠোঁটের ঝিলিক হাসি। পাশ থেকে একজন ভদ্রমহিলা গম্ভীর গলায় তখন জিজ্ঞেস করলো,

‘তোমার পাশে কে দুষ্টু?’

দুষ্টু বলতে গিয়েও থমকে দাড়ালো। সিড়িন হকের দিকে তাকিয়ে দৃঢ় গলায় বলল,

‘আমার পরিচিত একজন।’

শ্রেয়সী আশ্চর্যান্বিত দর্শনেন্দ্রিয় দিয়ে অবলোকন করে গেলো দুষ্টুর সূক্ষ্ম অপমান৷ বন্ধু বলতে আজ এতোটাই দ্বিধা? শ্রেয়সীর ঠোঁটে তাচ্ছিল্যের হাসি। ঠিক একইরকম হাসি ফুটে উঠলো দুষ্টুর ওষ্ঠেও। সে বলল,

‘যে বন্ধু বন্ধুত্বের মর্ম বোঝে না তাকে বন্ধু বলে পরিচয় দেওয়ার কোনো মানে হয় না।’

শ্রেয়সী ব্যথিত নয়নে তাকায়। অতঃপর ঠোঁট বাঁকিয়ে হেসে অকপটে জবাব দেয়,

‘সরি, আমি আপনার বন্ধুত্বের পরিচয়ে এ বাড়িতে পা রাখিনি। আমি এসেছি আমার নিজস্ব পরিচয়ে। আমার স্বামীর পরিচয়।’

‘বেশ, তবে জানানো যাক সকলকে।’

‘কি?’

‘আপনার পরিচয়?’

‘দুষ্টু…।’ শ্রেয়সীর আশ্চর্যজনিত অস্পষ্ট স্বর।

‘উহু, দুষ্টু হক।’

চলবে

#এমন_একদিন_সেদিন
#মুমুর্ষিরা_শাহরীন
পর্ব-৪১
৮৮.
বাসর রাত! খেঁক শেয়ালের আর্তনাদের ডাক। দ্বিজরাজের কুয়াশা মাখা ঝাপসা আলো। ম্লান মুখে বসে থাকা টিয়ার মাথা ঘোমটা বিহীন। ক্ষণসময় পর রাজার বেশে প্রবেশ নীড়ের।

নতুন ফ্ল্যাট। ওপাশের দুই ঘরে জায়গা করে নিয়েছে প্রচ্ছদ, প্রযুক্ত, অর্জন, সাজিদ। কনের সাথে আসা বাকি কিছু আত্মীয় স্বজনরা চলে গেছেন মিনিট ত্রিশেক হলো! সে পাগড়ি খুলল। টিয়া উঠলো না। সালাম করলো না। সাইড টেবিলের কোণায় রাখা দুধ’টা খেতে দিলো না। এক প্রকার নির্বিকার বসে থাকা তাকে, শেরওয়ানীর বোতাম খুলতে থাকা নীড় বলল,

‘কাবার্ডে তোমার সেলোয়ার-কামিজ রাখা আছে।’

টিয়া আস্তে করে উত্তর দিলো, ‘আচ্ছা।’

বলেই সে কাপড় নিয়ে ওয়াশরুমে ডুকে যায়। ওপাশের ঘর’টাতেই প্রচ্ছদ, প্রযুক্ত শুয়েছে। দেয়ালে হাত রেখে টিয়া কেঁদে উঠলো নিরবে। শব্দহীন হেচকি কান্নায় পিঠ বারংবার কেঁপে ফুলে ফুলে উঠলো। আদেও কি সহ্য করা যায়? তবুও যেতো! নিজেকে মিথ্যে বুঝ দেওয়া যেতো। কিন্তু যার হয়ে মিথ্যে বুঝ দেবে সে যখন নির্বিঘ্নে চোখের সামনে তার বাসর রাতেও চলে আসে তখন কীভাবে নিজেকে মানাবে? আচ্ছা! লোকটা কি কোনোদিন একবারের জন্যেও বোঝেনি টিয়া তাকে ভালোবাসে? একবারের জন্যেও অনুধাবন করেনি? কীভাবে সম্ভব? অনুভব শক্তিহীন পুরুষ মানুষ নাকি? এতোভাবে টিয়া বোঝানোর চেষ্টা করেছে যে অন্যরা বুঝে গেছে অথচ সে বুঝেনি? এ কি বিশ্বাসযোগ্য?

আজ-কাল নীড় সিগারেট খাওয়া শিখেছে। আজ-কাল বললে ভুল হবে। বিগত প্রায় পনেরো দিন যাবৎ সে মাত্রাতিরিক্ত ধূমপানে আসক্ত। সারাদিন নানান ব্যস্ততার মাঝে আজ একটাও খাওয়া হয়নি বিধায় সে বারান্দায় রেলিং ঘেঁষে দাঁড়িয়ে সিগারেট ধরালো। এরপর ফোন লাগালো দীর্ঘ পরিচিত নাম্বারে। ফোন ধরেই ওপাশ থেকে কান্নার সুরে শ্রেয়সী বলে উঠলো,

‘তুই আমাকে আর কোনোদিনও ফোন দিবি না নীড়।’
‘আচ্ছা।’
‘আমার সাথে আর কক্ষনো দেখা করবি না।’
‘আচ্ছা।’
‘আমার সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করবি না।’
‘আচ্ছা।’
‘আজ থেকে তোর সাথে আমার আর কোনো বন্ধুত্ব নেই।’
‘আছে।’
শ্রেয়সী কেঁদে দিলো সশব্দে, ‘আই হেইট ইউ। আই জাস্ট হেইট ইউ।’

নীড় হাসলো। সিগারেটে টান দিয়ে ধোঁয়া ছেড়ে দিলো কুয়াশায়। বলল,

‘থ্যাঙ্কিউ। এবার শোন, আজ না আমার বাসর রাত! তো অল দ্যা বেস্ট করবি না?’

‘নীড়, আমার সাথে একদম ফাইযলামি করবি না।’

‘আল্লাহ রে! আমার কান’টা গেলো। আস্তে চিল্লা।’

শ্রেয়সী দাঁতে দাঁত চেপে বলে,

‘তোকে আমার জাস্ট অসহ্য লাগছে, তুই ফোন রাখ।’

নীড় ক্রুদ্ধ স্বরে বলে উঠে,

‘কেনো অসহ্য লাগছে? তোর বান্ধবী বিয়ে করেনি? তোকে না জানিয়ে বিয়ে করেনি? আমাকে ঠকিয়ে বিয়ে করেনি? আমি কি কাউকে ঠকিয়েছি? তাহলে আমি বিয়ে করেছি তাতে এতো সমস্যা হচ্ছে কেনো?’

শ্রেয়সী হতবাক হয়ে গেলো,

‘নীড়…! তোর আর ওর মাঝে পার্থক্য’টা কোথায় রইল তবে? তুইও তো ঠকালি। যেই মেয়েটা তোকে বিয়ে করলো সে সারাজীবনের জন্য ঠকে গেলো। আর তুই আমাকে জানাসনি কারণ তোর সাহসে কুলায়নি। দুষ্টু কিন্তু সেই পরিস্থিতিতে ছিলো না। ওকে জোর করে বিয়ে দেওয়া হয়েছে। ও তোর মতো নিজ ইচ্ছায় নাচতে নাচতে বিয়ে করতে যায়নি। আর আমি? তোর হয়ে ওকে যা নয় তাই শুনালাম।’

নীড় কথা বলল না। বেশ খানিকক্ষণ মৌন থেকে শ্রেয়সী বলে উঠে,

‘আমি রাখছি।’

‘তোকে কে দাওয়াত দিয়েছিলো? তোর সো কল্ড প্রাণের বান্ধবী ছাড়া তো আর কেউ নেই ওই বাড়িতে। আবার বড় বড় কথা বলোস? তোর বান্ধবী ইচ্ছে করে তোরে দাওয়াত দিয়ে নিয়ে আসছে যাতে আমাকে তোর সামনে খারাপ বানাতে পারে। কতটা চিপ মাইন্ডের মেয়ে!’

শ্রেয়সী চোখ বন্ধ করে হাতের মুঠো শক্ত করে ঘৃণার সহিত বলে,

‘হাও মিন ইউ আর! লিসেন, আমি ওখানে গিয়েছিলাম আপুর দাওয়াতে।’

নীড় ভ্রু কুচকায়, ‘আপু মানে?’

‘ইরা আপু।’

‘বড় ভাবী তোর আপু কবে থেকে লাগে?’

‘প্রযুক্তর আপু।’

নীড় পুনরায় ভ্রু কুটি করে,

‘প্রযুক্ত ভাইয়ার আপু! হ্যাঁ। তুই চিনস কেমনে?’

শ্রেয়সী বড় একটা নিঃশ্বাস নিজের মাঝে টেনে নিলো। খানিক বাদে থেমে থেমে বলল,

‘আমাদের মধ্যে রিলেশন ছিলো। কিছুদিন হলো বিয়ে করেছি।’

কারোর এমন হয় কিনা কে জানে! কিন্তু কথাটা নীড়ের কানে যাওয়া মাত্র সে অবাক, হতবাক, নির্বাক। বিস্ময়ের চোটে বাক্যশক্তি লোপ পেলো যেনো তার। বেশ অনেকক্ষণ পর ঠোঁট দুটো আলগা করে বলতে পারলো শুধু,

‘কিহ?’

‘হুম।’

শ্রেয়সীর নিচু উত্তর। চারিদিকে থমথমে একধরনের ঝড়ের আগাম বার্তার নিরবতায় ছেয়ে গেলো। এর মাঝ থেকেই হঠাৎ নীড়ের চিৎকার ভেসে এলো,

‘তোরা সবাই তো এক নায়ের মাঝি। আবার আমাকে বলতাছোস? তুই বিয়ে করছোস? কীভাবে? একবারো জানালি না? ওহ… আমাকে জানাবি কেন? তোর পরাণের বান্ধবী আছে তো। নিশ্চয়ই বান্ধবীর শ্বশুড় বাড়ি বেড়াতে গিয়েই প্রযুক্ত ভাইয়ার সাথে দেখা হয়ে প্রেম’টা হইছে। তোরা সব প্ল্যান করে করছোস এগুলা তাই না? দুজনে মিলে আমাকে ধোকা দিছিস? সিরিয়াসলি? আই কান্ট বিলিভ। আই হেইট ইউ শ্রেয়সী। আই হেইট বোথ অফ ইউ। কোনোদিন তোদের চেহারা দেখাবি না আমাকে।’

বলতে না বলতেই ফোন’টা ছুড়ে পড়লো বারান্দার কিনার ঘেঁষে। ফুলের টব’টা ভেঙে চার-পাঁচ টুকরো হলো। নীড় দু’হাত দিয়ে চুল খামচে ধরে বসে পড়লো ময়লা মেঝেতে। খানিক বাদে মুখে বিন্দু বিন্দু পানি সহিত টিয়া এসে হাজির হলো। ক্ষীণ আওয়াজে বলল,

‘কি হয়েছে?’

নীড় রক্তলাল চোখে তাকায়। চট করে উঠে দাঁড়িয়ে বলে,

‘প্রযুক্ত ভাই কই? ডাকো তাকে?’

‘ডাকবো মানে? আমি কেনো তাকে ডাকতে যাবো?’

তখনি দরজায় শব্দ হয়। টিয়া নীড়ের দিকে অবাক চোখে তাকিয়ে দরজা খুলতে এগিয়ে যায়। প্রচ্ছদ, প্রযুক্ত হুড়মুড় করে ঘরে ঢুকে অস্থির কণ্ঠে জিজ্ঞেস করে,

‘কি হয়েছে? নীড় চিৎকার করলো কেনো?’

প্রযুক্ত ভেতরে ঢুকে নীড়কে ডাকতে ডাকতে,

‘নীড়, এই নীড়, চিৎকার করতাছোস কেন?’

নীড় শক্ত কণ্ঠে শুধায়, ‘চেঁচাবো না?’

প্রচ্ছদ এগিয়ে আসে। চোখ ঘুরিয়ে বলে,

‘না চেঁচাবি না। বাসর রাতে চেঁচাবি কেনো? আমার বোন ভয় পাচ্ছে।’

‘পাক। তোর বন্ধু বিয়ে করছে জানোস না? অথচ আমাকে বলস নাই একবারো।’

সাথে সাথে প্রচ্ছদ আকাশ থেকে মাটিতে পড়লো। মাথায় যেনো বারো তলা বিল্ডিং এর ছাদ ভেঙে দু’টুকরো হয়ে পড়লো। বিস্ময়ে অবাকতায় চোখ হয়ে উঠলো লাল। গলা থেকে ছিটকে বেরুলো,

‘কিহ?’

‘হুম।’

পাশে দাঁড়িয়ে থাকা প্রযুক্ত ইতস্তত করে বেক্কলের মতোন হেসে বলল,

‘আরে দোস্ত, ও বিয়ে করে পাগল হয়ে গেছে। ওর কথা কানে নিস না।’

নীড় তেড়ে যায়,

‘এই তুমি কথা বলবা না। তুমি বিয়ে করছো কেনো?’

প্রচ্ছদ নীড়ের কোমড় ঝাপটে ধরে আটকায়। প্রযুক্ত ভয়ার্ত চোখে পেছনের দিকে হেলে যায়। হাত দুটো সামনে দেয় আত্মরক্ষার জন্য। টিয়ার বুঝে আসছে না এই অহেতুক কমেডি শো এর মানে। ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে সে। প্রযুক্ত তুতলিয়ে বলে,

‘আমি বিয়ে করছি তাতে তোর কী? তুই করছস না? তোর ভাই করছে না? ওওও…. সবাই বিয়ে করলে কিছু না আর আমি করলেই দোষ?’

প্রচ্ছদ প্রযুক্তর দিকে কড়া চোখে তাকিয়ে বলে,

‘এ্যাহ, চোরের মায়ের বড় গলা। এই বেত্তমিজ, আমরা কি তোর মতো পলায়ে বিয়ে করেছি?’

প্রযুক্ত যেনো এহেন কথা জীবনেও শোনেনি এমন ভান ধরে বলল,

‘হোয়াট ইজ পলায়ে? এসব কি ভাষা, প্রচ্ছদ? তুমি একজন শিক্ষক মানুষ তোমার মুখে এসব ভাষা মানা..’

‘চুপ…।’
প্রচ্ছদ চিল্লিয়ে এবার নীড়কে ধমকে উঠলো,

‘ও বিয়ে করুক না হয় নিকাহ্ করুক তাতে তোর বাপের কি?’

নীড় করুণ সুরে বলে,

‘তোর বন্ধু আমার বন্ধুকে কেনো বিয়ে করবে?’

প্রযুক্ত লাফিয়ে উঠে,

‘আস্তাগফিরুল্লাহ্, বিশ্বাস কর নীড়। আমি একজন মেয়েকে বিবাহ করেছি। ছেলে না। ‘

নীড় দাঁত কিড়িমিড়ি করে আবার তেড়ে যায়,

‘তোমাকে তো আজকে আমি….।’

প্রযুক্ত সারা ঘর নীড়কে দৌড় পারালো। বাসর রাত তো নয় এটা দৌড় প্রতিযোগিতা খেলার রাত। অবশেষে টিয়া মাঝখানে গিয়ে দাঁড়ায়। দু’পাশের দুজনেই থেমে গেলো। সে বরফের চেয়েও ঠান্ডা গলায় বলল,

‘তোমার সমস্যা কি নীড় ভাইয়া? সে বিয়ে করুক বা না করুক। তাতে তোমার কি?’

নীড় কঠিন গলায় বলে,

‘সে আমার বান্ধবী শ্রেয়সীকে বিয়ে করেছে।’

প্রযুক্তের চোখ দুটো ছানাবড়া হয়ে গেলো। প্রচ্ছদ নিজের বুকের বা’পাশে হাত রাখলো। এতো চমক আর হজম হয় না। টিয়া অবাক হয়ে তাকালো। বিয়েতে দেখেছে প্রযুক্তর সাথে সুন্দর রকমের একটা মেয়েকে কথা বলতে। তখনি আন্দাজ করে নিয়েছিল সে। কিন্তু মেয়েটা নীড়ের বান্ধবী…? তার চোখের মণি দুটো স্তব্ধ হয়ে এলো। প্রযুক্তর দিকে এক পলক তাকিয়ে বলল,

‘আচ্ছা, আপনারা কথা বলুন। আমি একটু ভাইয়ার কাছে যাই।’

প্রকৃতি যেন হঠাৎ স্থবির হয়ে গেলো! প্রযুক্ত প্রচ্ছদের দিকে আড়চোখে তাকিয়ে বলে,

‘দোস্ত, রাগ করছিস?’

প্রচ্ছদ দাঁতে দাঁত চেপে বলে, ‘জাস্ট কিপ ইউর মাউথ সাট, শালা।’

‘কিন্তু আমি অর্জন ভাইয়ার শালা। নীড় তুই-ই বল..। আমি অর্জন ভাইয়ার শালা না?’

নীড় প্রচ্ছদ একসাথে চেঁচিয়ে উঠে, ‘সাট আপ…..।’

চলবে

#এমন_একদিন_সেদিন
#মুমুর্ষিরা_শাহরীন
পর্ব-৪২
৮৯.
ভারী কম্বল’টা ভাঁজ করতে করতে কানের কাছে কারো ফিসফিসানি স্বর শুনতে পাওয়া গেলো। প্রভাতের প্রথম প্রহরে নিস্তব্ধ সময়টাতে স্বর’টা প্রতিধ্বনির ন্যায় কানের ভেতরে ঢুকে গেলো। দুষ্টু চমকে ঘাড় ঘুরালো। সদ্য ঘুম ভাঙা চোখ দুটো’তে রাজ্যের অবাকতা নিয়ে তাকাতেই প্রচ্ছদ হেসে বলল,

‘কি খবর?’

দুষ্টু ভ্রু কুচকায়। ঘরের মাঝ বরাবর দেয়ালে টানানো ঘড়িটার দিকে একবার তাকিয়ে বিস্ময়ের সুরে প্রশ্ন করে,

‘আপনি এতো সকালে?’

প্রচ্ছদ পাঞ্জাবির বোতাম খুলতে খুলতে বলল,

‘হুম, এলাম। একদম ভালো লাগছিলো না।’

দুষ্টু পুনরায় ভ্রু কুচকায়, ‘কেনো?’

‘তোমাকে ছাড়া কিচ্ছু ভালো লাগছিলো না। অভ্যাস হয়ে গেছো তো!’

কথাটা বলে প্রচ্ছদ থমকালো। একবার দুষ্টুর দিকে তাকিয়ে দেখলো। দুষ্টু নিজ মনে কম্বল ভাঁজ করায় মনোযোগ দিতেই সে হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো। তবে বেশিক্ষণ টিকলো না। দুষ্টু তীর্যক কণ্ঠে বলেই উঠলো,

‘আর তো মাত্র একটা মাসের মতোন আছি। এরপর থাকবেন কীভাবে?’

প্রচ্ছদ উত্তর দেয় না। কপালে ভাঁজ ফেলে গম্ভীর গলায় বলে,

‘রেডি হয়ে থেকো। এগারোটা নাগাদ বের হতে হবে।’

‘কোথায়?’

‘ওই… প্রেগন্যান্সি টেস্ট করাতে।’

দুষ্টু কতক্ষণ পর উত্তর দিলো, ‘করাবো না।’

প্রচ্ছদ অবাক কণ্ঠে শুধায়,

‘করাবে না মানে? ডিভোর্সের ডেট পেছাবে তাহলে।’

‘আশ্চর্য তো! আপনি কি ঠিকমতো কোনোদিনও আমার হাতটা ধরেছেন? আর আমি প্রেগন্যান্সির টেস্ট করাতে যাবো? হাস্যকর বিষয়! যান তো আপনি।’

‘এতো কথা বুঝি না। টেস্ট করাতে যেতে হবে। তা নাহয় ডিভোর্সের টাইম পেছাবে।’

‘টিয়াদের নিয়ে এলেন না?’

‘ওরা দুপুর দিকে আসবে প্রযুক্ত, ভাইয়াদের সাথে।’

দুষ্টুর কপালে সূক্ষ্ম ভাঁজ পড়লো। চিন্তিত ভঙ্গিতে মাথা নাড়িয়ে বলল, ‘আচ্ছা।’

‘আমি কি বললাম শুনছো তো?’

দুষ্টু বিরক্ত হলো। চোখ ঘুরিয়ে বিশাল শ্বাস ফেলে বলল,

‘আপনার গ্রামের বাড়ি থেকে ঘুরে আসি আগে। তারপর।’

প্রচ্ছদ ভ্রু বাঁকিয়ে তাকায়,

‘কি ব্যাপার বলো তো? প্রথমে বললে বিয়ের ঝামেলা মিটুক এখন আবার গ্রামের বাড়ি থেকে ঘুরে আসার পর। মানে…’

দুষ্টু তাকে মাঝপথেই থামিয়ে দেয়,

‘আপনার কি ব্যাপার বলুন তো? এতো তাড়াহুড়ো করছেন কেনো? ডিভোর্স’টা মনে হয় আপনার জন্যই বেশি জরুরি।’

প্রচ্ছদ কাধ ঝাঁকায়। পাত্তাহীন গলায় বলে,

‘অবশ্যই। আমার আবার বিয়ে করতে হবে না? তুমি যত তাড়াতাড়ি ভাগবে, তত তাড়াতাড়ি নতুন কেউ এন্ট্রি নেওয়ার সুযোগ পাবে।’

বলতে বলতে প্রচ্ছদ চোখ টিপলো। দুষ্টু অন্যদিকে চোখ ঘুরায়। কথাটা ভালো লাগলো না। এতোদিন একসাথে থাকার পর কি এতো সহজে একে অন্যকে ভুলে যেতে পারে? পারবে? পারা যায়? হয়তো! দুষ্টুও অবশ্যই পারবে। ও আস্তে আস্তে খাতায় রাবার ঘষে মোছার চেষ্টা চালাচ্ছে রঙ পেন্সিল দিয়ে লেখা নীড়কে। কিন্তু মুছতে গিয়ে ঝাপসার ন্যায় লেপ্টে যাচ্ছে। হয়তো, কিছুদিন পর এই চেষ্টাই প্রত্যাবর্তিত হবে প্রচ্ছদের উপর। মানুষের জীবন কি শুধুমাত্র এই মনে রাখা আর ভুলে যাওয়ার নীল নকশার খেলা! নাকি লাল গুটির চাল! নাকি সবুজ ধরণীর ন্যায় বিশাল!

দুষ্টু গলা পরিষ্কার করে। বলে,

‘যান, ফ্রেশ হয়ে আসুন। এতো সকালে তো বোধ হয় নাস্তাও তৈরি হয়নি।’

‘নাহ খাবো না। ফ্রেশ হয়ে এসে ঘুমাতে হবে। রাতে ঘুম হয়নি।’

দুষ্টু কুটিল চোখে তাকায়,

‘কেনো? আপনারও বাসর রাত গিয়েছে নাকি?’

প্রচ্ছদ চমকে ঘাড় ফিরালো। বাম পাশের বুকে হাত রেখে ভঙ্গি করে বলল,

‘বাসর রাতের কথা মনে করিয়ে দিও না আর। আমার বাসর রাত তো গিয়েছে বউয়ের ডিভোর্স ডিভোর্স খেলা নিয়ে। আর নীড়ের বাসর রাত গেলো দৌড় প্রতিযোগিতা আর মারামারি দিয়ে।’

দুষ্টু ঢোক গিলে। শুকনো ঠোঁট দুটো জিহ্বা দিয়ে ভিজিয়ে আস্তে করে শুধায়,

‘কেনো?’

প্রচ্ছদ দাঁতে দাঁত চেপে বলে,

‘আরে, প্রযুক্ত বিয়ে করছে। তাও আবার লুকিয়ে। শালা হারামি একটা। আর মেয়ে হচ্ছে নীড়ের বান্ধবী।’

দুষ্টু বড় করে শ্বাস নিলো, ফেলল। খানিক আগে শীতে কাঁপতে থাকা শরীর’টা ক্রমেই ভীতির উষ্ণতায় নিবিড় হলো। হঠাৎ গুরুত্বপূর্ণ কিছু মনে পরেছে এমন ভঙ্গিতে প্রচ্ছদ বলল,

‘এই, নীড় তো তোমার বন্ধু তাই না?’

দুষ্টু কম্পনজাত গলায় বলে, ‘ছিলো।’

‘তাহলে তো শ্রেয়সীকেও চেনার কথা।’

দুষ্টু অন্যদিকে চোখ ঘুরায়। অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকে বাইরের সফেদ কুয়াশা ভিঙিয়ে আসা সরু সোনালি রোদ্দুরে। এরপর দূর্বল গলায় বলে,

‘কি জানি! হয়তো দেখেছিলাম কখনো। হয়তো জানি! কিন্তু চিনি না।’

‘হু?’

দুষ্টু প্রচ্ছদের দিকে তাকিয়ে হঠাৎ ব্যস্ত কণ্ঠে বলল,

‘তখন টিয়া কোথায় ছিলো?’

‘টিয়া সেখানেই ছিলো। মেয়েটা বিয়ের পর থেকেই একদম চুপচাপ। কেনো কিছু জানো?’

দুষ্টু গোপনে শ্বাস ছাড়ে। স্ফটিক, মিহি, স্বর্ণ বর্ণের রৌদ্র’টা জানালার কাঁচ ভেদ করে এসে আছড়ে পরে তার সদ্য ঘুম ভাঙা তৈলাক্ত পেলব মুখটা’য়। আননের কপোল গুলো চিকচিক করে উঠে। প্রচ্ছদ তাকিয়ে থাকে অনেকক্ষণ। দুষ্টুর চোখের কোণায় কয়েক বিন্দু ধারালো অশ্রু টলমল করে উঠে। জানান দেয় দুঃখ কষ্টের ক্লেশ। মেতে উঠে প্রচ্ছদের বুকের আলোড়ন। সে ধীর পায়ে কাছে এলো। পবিত্র আলোর ছায়া পড়া ওই লাল মুখ’টার দিকে চেয়ে ভোরের লালাভ সূর্যের দিকে তাকালো। উদ্দেশ্য তুলনা করা! কার স্বর্ণবর্ণের লালাভ সূর্য’টা সবথেকে সুন্দর? প্রকৃতির না প্রচ্ছদের?

দুষ্টু দৈবাৎ শুনতে পেলো তার কানে প্রতিধ্বনি হয়ে এসে লাগলো পুনরায় আরেকটি গোপন আড়ালে থাকা শরীরে লোম দাঁড় করানো ফিসফিসানি কণ্ঠস্বর। সেই পুরুষাভ গহীন কণ্ঠ’টি বলছে আকুল-ব্যকুলতায় ভরে উঠে,

“সেই নারী,
আমার হৃদ-সিন্দুকের রানী,
অন্তর্বত্নীর সন্ধানী,
নাম তার গোপনী।”

প্রচ্ছদ চলে গেলো ওয়াশরুমের দিকে। পাঞ্জাবি খুলতে। দুষ্টুর সামনে সে খালি গা হয়না বললেই চলে। তবে দুষ্টু আকস্মিক বাক্যে স্তব্ধ হয়ে গেলো। কানে কানে বারি খেলো কথাগুলো। ছন্দপতন ঘটলো ভাবনায় সাজানো পরবর্তী কল্পনা গুলো। এক অতলান্ত ঐন্দ্রজালিক গভীরতায় যেন ক্রমশ আটকা পড়ার পায়তারা খুঁজতে ব্যর্থ চেষ্টা করছে তার হৃদ-সিন্দুক!

৯০.
দুপুর দিকে শীতল হাওয়ার হালকা রোদ্দুর মাথায় নিয়ে হক বাড়িতে প্রবেশ করলো ওরা। চারিপাশে তখন আরামদায়ক আবহাওয়ার এলোমেলো দল। দুষ্টু ছোটাছুটি করছে ইরার জন্য দুধ নিয়ে যাওয়ার উদ্দেশ্যে। কিয়ৎক্ষণ পূর্বে ইরা মাথা ঘুরে পরে গেছে৷ অর্জন জানে না এখনো। তবে জানলে আর কারো রক্ষা নেই।

দুপুরের জাকজমকপূর্ণ, আভিজাত্যের ন্যায় জামাই আদর করার শেষে সিড়িন হক বললেন মৃদু হেসে,

‘শোনো নীড়, দুষ্টু প্রচ্ছদ পরশু সকালে গ্রামের বাড়ি যাবে। তুমি এবং টিয়াও গিয়ে ঘুরে এসো।’

দুষ্টু চমকালো, থমকালো। যা থেকে ক্রমশ দূরে যাওয়ার চেষ্টার সে ব্যস্ত, তা কেনো বারবার সুতো টেনে টেনে তার দ্বারপ্রান্ত অবধি চলে আসছে? হায় আল্লাহ! নীড় বিস্ময় নিয়ে তাকায়। প্রচ্ছদের দাদার বাড়ি তার নানু বাড়ি। সে বলে,

‘এখন গিয়ে কি করবো? পরে একসময় যাবোনি।’

ইফতার হক বলেন,

‘যাও না, তোমার নানা-নানুর কবর জিয়ারত করে এসো। অনেকদিন তো হলো যাও না।’

নীড় আর কথা বলল না৷ বড় মামার মুখের উপর সে কথা বলে কিঞ্চিৎ। এ উক্তি খুব বিরল। কিন্তু যাওয়ায় জন্য তার মোটেও ইচ্ছে নেই। চোখের সামনে দুষ্টু-প্রচ্ছদের প্রেমের রঙ্গনীলা সে সহ্য করবে কীভাবে? হ্যাঁ?

সে একপলক দুষ্টুর দিকে তাকিয়ে মাথা নিচু করলো। প্রচ্ছদ ধীর পায়ে মায়ের কাছাকাছি গিয়ে ফিসফিস করে বলল,

‘আম্মু, প্রযুক্তকেও সঙ্গে নেবো।’

প্রচ্ছদের সকল আবদার তার মায়ের কাছে। অর্জনের থেকে প্রচ্ছদের চাওয়াগুলো বেশি এবং তা কষ্টসাধ্য। সে যা চায় তা এনে দিতে হবে অন্যথায়….! ভীষণ সৎ, সত্য, সহৃদয় হওয়া সত্ত্বেও ছোট ছেলের কোনো অহেতুক, অনৈতিক প্রস্তাবেও সিড়িন হক না করতে পারে না। ছেলের জীবনের সবথেকে বড় আবদার’টি সে পূরণ করেছে আরো বহু আগে। তার জন্য মাঝেমাঝে তার কষ্ট হয়, আপসোস হয় পরক্ষণেই আবার ছেলের জন্য মায়া হয়। সে প্রচ্ছদের কথার উত্তর না দিয়ে বলল,

‘প্রযুক্তও যাবে। বড় বউমা তো অসুস্থ তাই অর্জন আর সে যেতে পারবে না। নীরা সাজিদ কি যেতে চাও?’

সাজিদ বলার আগেই নীরা এক বাক্যে না করে দিলো। সাজিদ মিনিট দুয়েক দাঁত চেপে তাকিয়ে থেকে হনহন করে ঘরে চলে গেলো। প্রচ্ছদ অগোচরে একটু দূরে দুষ্টুর কাছে এলো। কণ্ঠ খাদে নামিয়ে বলল,

‘ফিরে এসে রিপোর্ট নিয়ে কোর্টে যেতে হবে কিন্তু। নাকি আরও বাহানা আছে?’

দুষ্টু ভ্রু কুচকায়। প্রচ্ছদের দিকে কিছুক্ষণ রাগী দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে গমগম আওয়াজে বলে,

‘আপনার কি মনে হয় আমি আপনার কাছে থাকার জন্য এরকম করছি?’

প্রচ্ছদ মাথা ঝাঁকিয়ে বলে, ‘অবশ্যই।’

‘দুষ্টু বেক্কল বনে গেলো, ‘আশ্চর্য!’

‘তুমি যা ভাবছো তা তো কোর্ট বুঝবে না, দুষ্টু।’ প্রচ্ছদ ঠোঁট টিপে।

দুষ্টু রেগে বলে, ‘চলুন। এখনি যাবো।’

‘নাহ, থাক। দরকার নেই। বাড়ি থেকে ঘুরে আসার পর।’

দুষ্টু ক্রোধ নিয়ে তাকায়। তাকিয়েই থাকে। কিছুক্ষণ! অনেকক্ষণ! এদিকে, তাদের দিক থেকে চোখ সরিয়ে ফেলেও অনিচ্ছাবশত তাদের দিকেই তাকিয়ে থাকে নীড়। দুষ্টু অকস্মাৎ বরফের চেয়েও ঠান্ডা, কঠিন এবং ধীর গতিতে প্রশ্ন করে,

‘আপনি আমায় ভালোবাসেন না?’

হঠাৎ এমন প্রশ্নে প্রচ্ছদ কথা হারিয়ে ফেলে। এরপর দৃঢ় কণ্ঠে বলে, ‘না।’

দুষ্টুর কপালে ভাঁজ পড়লো অবাকতার। নিজের ভাবনার প্রতি সন্দেহ। সে অন্যমনস্ক চিন্তিত স্বরে আস্তে করে বলে, ‘বাসেন না?’

‘না’ বলে প্রচ্ছদ দ্রুত পায়ে চলে যায়। দুষ্টু সেদিকে তাকিয়ে থেকে অনেকক্ষণ বাদে গোপন দীর্ঘশ্বাসে মুচকি হাসে,

‘বাসেন কিন্তু স্বীকার করবেন না। আপনার এই দৃঢ়তার জন্যই আমরা আমাদের পথ ধরবো। পৌছাবো! না আপনি স্বীকার করে মায়া বাড়িয়ে আমায় আটকে রাখবেন, আর না আমার মন আপনার মায়ার জ্বালে প্রবেশ করার ফুরসৎ পাবে! ধন্যবাদ আপনাকে। কক্ষনো স্বীকার করবেন না। পারলে আমায় ভালোবাসবেন না!’

চলবে