এমন একদিন সেদিন পর্ব-৪৬

0
2

#এমন_একদিন_সেদিন
#মুমুর্ষিরা_শাহরীন
পর্ব-৪৬
৯৮.
শীতের দুপুরে বার্তাহীন বৃষ্টি নামলো। দিনভর ঝুম বৃষ্টি হলো! শুষ্ক আবহাওয়া বর্ষনের আবরণে সিক্ত হলো। ওরা সবাই ভিজলো! নিঝুম শব্দে মুখরিত হলো আকাশ, জমিন, পাতাল! ভেজা শরীরে নিজের জন্য বরাদ্দকৃত ঘরটায় যেতে না যেতেই প্রযুক্তর দেখা মিলল। শ্রেয়সী ঠকঠক করে কাঁপতে কাঁপতে ভ্রু কুচকে তাকালো। কাল রাতে যদিও তাদের একসাথে থাকা হয়নি কিন্তু ঘরটা তাদের দুজনের জন্যেই ছেড়ে দেওয়া হয়েছিলো।

সিক্ত শ্রেয়সীকে দেখে প্রযুক্ত বেশ কিছু মূহুর্তের জন্য স্তব্ধ হয়ে গেলো। ধীর পায়ে এগিয়ে গেলো মন্ত্রমুগ্ধের ন্যায়। শ্রেয়সী পেছালো। এক পা! দু’পা! কয়েক পা! এরপর খপ করে তার হাত’টা ধরে ফেলা হলো। সে চমকে উঠলো। অপ্রস্তুত হেসে বলল,

‘কি কাণ্ড দেখুন! ভরা শীতে বৃষ্টি!’

প্রযুক্ত উত্তর দিলো না। শ্রেয়সী আবারও বোকার মতো হেসে বলল,

‘জানেন, টিয়া মেয়েটার সাথে থেকে স্বস্তি আছে। একটা কথাও বলে না। চুপ মেরে এক কাৎ হয়ে শুয়ে ঘুমিয়ে যায়। আজ রাতেও আমি টিয়ার সাথে থাকবো, ঠিকাছে?’

‘নাহ। ঠিক নেই।’

শ্রেয়সী বোকা বনে গেলো। অবুঝের ন্যায় ঠোঁট নাড়িয়ে বলল, ‘হ্যাঁ?’

প্রযুক্ত ওর ভেজা মসৃণ, পাতলা কোমড় জড়িয়ে ধরে। ঠোঁট চেপে চেপে ধীর কণ্ঠে বলে,

‘আজ আমরা আলাদা থাকবো না।’

শ্রেয়সী অবাক হয়ে চেয়ে রইলো। প্রযুক্ত বলল,

‘বিয়ে করেছি কি নীড়ের সাথে থাকার জন্য?’

শ্রেয়সী পাত্তাহীন কণ্ঠে বলে উঠলো,

‘আহ! ছাড়ুন তো! চেঞ্জ করে আসুন। ঠান্ডা লেগে যাবে। সাথে আমাকেও চেঞ্জ করতে দিন।’

‘আমি করিয়ে দেবো।’

প্রযুক্তর নেশালো কণ্ঠ। শ্রেয়সী বিস্ফোরিত চোখে তাকালো। অতঃপর এক ঝটকায় প্রযুক্তর হাত কোমড় থেকে সরিয়ে দিলো। প্রযুক্ত আবার গেলো। পেছন থেকে জড়িয়ে ধরলো। ভেজা ঘাড়ে তপ্ত নিঃশ্বাসে শ্রেয়সীর শ্বাস ভারী হয়ে উঠলো। প্রযুক্ত কাধে নাক ঘষে কেমন বাচ্চামো গলায় বলে উঠলো,

‘কেনো এমন করছেন?’

শ্রেয়সী কাঁপা কাঁপা স্বরে ভীত চোখে চেয়ে বলল,

‘এমন’টা কথা ছিলো না৷ আমাদের কথা ছিলো পারিবারিক ভাবে বিয়ে হওয়ার পর আমরা একসাথে থাকবো। আপনি ভুলে গেছেন?’

‘না, ভুলি নি।’

‘তবে?’

‘তবে কি?’

‘সরুন প্লিজ! নিজের কথার খেলাপ করছেন।’

প্রযুক্ত আগের মতোই বলল, ‘করছি না।’

‘করছেন।’

‘না। আমি এমন কোনো কথা আপনাকে দেইনি।’

‘আপনি আমাকে ছাড়ুন। আপনি নিজের মধ্যে নেই। হুশে আসুন। প্লিজ… এটা কিন্তু ঠিক না!’

শ্রেয়সী কণ্ঠ কান্নার ন্যায় কেঁপে উঠল। প্রযুক্ত মুখ তুলে চাইলো। পেছন থেকে হাত দুটো আলগা করে দিলো। ছাড়া পেতেই শ্রেয়সী দু’কদম এগিয়ে গেলো। প্রযুক্ত মিনিট দুয়েক সময় নিলো৷ এরপর শ্রেয়সীর দু’কাধে হাত রেখে ওকে পেছন দিকে ফিরিয়ে সিরিয়াস ভঙ্গিতে বলল,

‘ আপনি তো আমার প্রেমিকা নন।’

শ্রেয়সী তাকায়। ঠান্ডা গলায় বলে,

‘প্রযুক্ত আমি মেন্টালি প্রিপায়ার্ড না। আই নিড সাম টাইম। ইউ হেভ টু আন্ডারস্ট্যান্ড।’

‘শ্রেয়সী শুনুন…’

প্রযুক্তকে মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে শ্রেয়সী বলল অনুতপ্ত হয়ে,

‘আমি জানি, আমি আপনার হক নষ্ট করছি। আপনার অধিকার থেকে বঞ্চিত করছি। আপনি আমাকে মাফ করুন। একটা মাস অন্তত ধৈর্য্য ধরুন। প্লিজ…..।’

প্রযুক্তর উত্তর নেই। শূন্যের কোন কোঠায় যেনো তাকিয়ে থাকে এক দৃষ্টিতে। শ্রেয়সী এগিয়ে এলো। শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো। ভেজা কালো শার্টের উপর হালকা চঞ্চুর স্পর্শ দিয়ে নত মুখে বলল,

‘রাগ করে থাকবেন না আমার উপর। আমি আপনাকে ভালোবাসি। অনেক বাজে ভাবে ভালোবাসি। এতোটা ভালো কবে বাসলাম? টের পেয়েছিলেন?’

প্রযুক্ত হালকা হাসলো। শ্রেয়সীর মাথার উপর হাত রেখে বলল,

‘আমি আপনাকে আমাদের ভালোবাসা থেকেও বেশি ভালোবাসি। আপনি টের পেয়েছিলেন? পাননি! আমিও পায়নি! আদতে টের পাওয়া যায় না! যদি যেতো তবে ভালোবাসাও মাপা যেতো।’

শ্রেয়সী আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো। প্রযুক্ত চাপা গলায় বলল,

‘ভেজা কাপড় ছেড়ে আসুন, জলদি।’

৯৯.
টিনের ঘরের মাটির মেঝেতে শীতল পাটি বিছিয়ে গোল করে বসে আছে সবাই। দরজা গলিয়ে ঝুম বৃষ্টি নিঝুম, শান্ত দৃষ্টিতে অবলোকন করে যাচ্ছিলো দুষ্টু। প্রচ্ছদ বার দুয়েক ডাকলো। তবুও নজর ফিরলো না। উত্তর এলো না।

‘দুষ্টু..’

কণ্ঠ খানিকটা উঁচুতে তুলে আরেকবার ডাকতেই দুষ্টু বিরক্ত নিয়ে বলল, ‘মরেছে।’

প্রচ্ছদ ভ্রু কুচকালো। দুষ্টুর দিকে মাথা খানিকটা হেলিয়ে কন্ঠ খাদে নামিয়ে সতর্কে বলল,

‘সত্যি নাকি?’

‘হ্যাঁ, কবর দিবেন? এতো কথা বলেন কেনো আপনি? বাচাল!’

‘হোয়াট?’ প্রচ্ছদের কণ্ঠে অবাকতা ঝরে ঝরে পরে। কাট কাট গলায় শুধায়,

‘আমি বেশি কথা বলি? সিরিয়াসলি?’

দুষ্টু অন্যদিকে তাকালো,

‘বিরক্ত করবেন না। আমার মন ভালো না।’

নীড় বোধহয় শুনলো। নাকি এতোক্ষণ গোপনে খুব মনোযোগে ওদের-ই শুনে যাচ্ছিলো! ও বলল আকস্মিক,

‘ভাবীর বোধহয় বৃষ্টি দেখে মন খারাপ হয়েছে। এই মন খারাপের সময়ে আমার একটা গান শুনলে মন ভালো হলেও হতে পারে। কি ভাবী শুনবেন নাকি?’

নীড়ের স্বাভাবিক কথা। ঠোঁটে দুষ্টু-মিষ্টি হাসি। এমন ভাবে কথাগুলো কানে লাগলো যেনো ভাবী-দেবরের কত জনমের দুষ্টুমির সুন্দর,স্বাভাবিক সম্পর্ক তাদের! দুষ্টু অবাক হলো। খানিকটা চমকালোও, বৃষ্টি দেখলে যে তার অযথাই মন খারাপ হয় তা কেউ না জানলেও নীড়, শ্রেয়সী খুব ভালো মতোই জানতো। সে ভ্রু উপরে তুলে পূর্ণদৃষ্টিতে তাকাতেই টের পেলো আদতে নীড়ের ঠোঁটে দুষ্টু-মিষ্টি হাসি না; কেমন যেনো… তুচ্ছতাচ্ছিল্য, বিদ্রুপাত্মক হাসি। যা কেবলই দুষ্টুর জন্য। কপালে ভাজ ফেলে দুষ্টুও নীড়ের অভিনয়ী কথাবার্তায় তাল মেলালো অনিচ্ছায়,

‘শোনাও।’

নীড়ের ক্রুর মিশ্রিত হাসি কি খানিকটা প্রসারিত হলো? নাকি মিলিয়ে গেলো? এতো ঠান্ডা, নিশ্চুপ, স্বাভাবিক গলার দুষ্টুকে হয়তো সে আশা করেনি। চমকিত, ভড়কে যাওয়া, ভীত দুষ্টুকে মনে মনে ভেবে রেখেছিলো সে।

“আমার সবটুকু বিশ্বাস,
যে দিয়েছে ভেঙ্গে
তাকে কৃতজ্ঞতা জানাই
সে দিয়েছে আমার, অন্ধ চোখে আলো
যার বিশালতার মাঝে, আমি একটুকু পাই নি ঠাঁই
তাকে কৃতজ্ঞতা জানাই

সে যে দিয়েছে আমায়, মহাশূন্যে আশ্রয়
আমার সব অপূর্ণতাই যেন হয়
আমার শূন্য পথের প্রতি, শ্রেয়তম আশীর্বাদ
যখন স্বর্গদ্বারে একা, দাঁড়াবো তার অপেক্ষায়
যেন আমার অভ্যর্থনা তাকে করে, অনুতপ্ত
জানি, তখনও সে আমার, হবে না তবুও
এ অপ্রাপ্তিটাই যেন আমায় করে পরিতৃপ্ত

আজ কোনো অনুভূতির
গভীরে যেতে চাই না আর কখনো
যেখানে,
নিঃশব্দ কান্নায় স্বরচিত হয় একান্ত শোক।
যা কিছু তার নির্দয় স্পর্শে দিয়েছে সৃষ্টি
নিভৃতে আমার প্রশান্ত কল্পনার ঘর, আর
যন্ত্রণার শিবিরে যে অবাদ্ধ কান্না দেয়

নির্ভুল সুরের জন্ম
তাকে আমার কাব্যে মেশাই
যেন হয় এক বিশুদ্ধ গান
আমার এই গানই আজ উৎসর্গ হোক
তার প্রতি আমার তীব্র ঘৃণা।

তবু স্বর্গদ্বারে একা থাকব তার অপেক্ষায়
যেন আমার অভ্যর্থনা তাকে করে অবনত
জানি তখনও কিছুই আমার হবে না তবুও
এ অপ্রাপ্তিটাই যেন আমায় করে পরিপূর্ণ!”

দুষ্টু চমকে উঠলো। সারা শরীর কাচ ভেঙে যাওয়ার মতোই ঝনঝন করে উঠলো। তার চোখে অবাকতা, ভীতি, অপারগতা, অপরাধবোধ। কানে বারংবার ভেজে উঠলো ওই একটা লাইন-ই,

‘তার প্রতি আমার তীব্র ঘৃণা।’

সে বিশ্বাস ভেঙেছে। একজন নয় দুইজন নয়… একে একে সবার বিশ্বাস সে ভেঙেছে.. ভাঙছে.. অনিচ্ছাবশত হয়তো ভবিষ্যতেও ভাঙবে। তার কোমল মুখখানা অসহায় হয়ে উঠলো। নীড়ের হৃদয় বোধ হয় তা দেখেই ক্ষান্ত হলো। শান্ত কণ্ঠে গান থামালো।

শ্রেয়সী দেখলো, দুষ্টু তখনো চেয়ে আছে ছলছল নয়নে। এতো… ঘৃণা নিয়ে নীড় গান’টা গাইলো যে শ্রেয়সী’র বুকটাও কেঁপে উঠেছিল। টিয়া খুব মনোযোগ দিয়ে শুনলো পুরো গান। শুনতে শুনতে তার গালে একটা মোটা জলের ধারা কখন ছাপ বসিয়ে গেছে টের-ই পেলো না। বেশ কিছুক্ষণ অপলক নীড়ের দিকে চেয়ে থাকলো। প্রযুক্তর দিকে একবার তাকাতে গিয়েও চাইলো না। দমে গেলো। মাথা নিচু করে পায়ের দিক চেয়ে রইল একমনে। একটুও মুখ উপরে তুললো না। যেনো তুললেই সবাই তাকে ভৎসর্না জানাবে। তার অসহায়ত্ব, অপারগতা, দূর্বলতা বুঝে ফেলে দারুণ ভাবে তাকে নিয়ে কটুক্তি করবে। নীড় এক হাত দিয়ে স্বভাবসুলত টিয়ার বাহু জড়িয়ে ধরে মিষ্টি হেসে বলল,

‘কাঁদছো কেনো?’

টিয়ার ছোট্ট উত্তর, ‘এমনি।’

নীড়ের খারাপ লাগলো। এই প্রথম! টিয়ার জন্য! বুক চিরে দীর্ঘশ্বাস বেরুলো। টিয়ার মাথা উঁচু করে যত্ন নিয়ে চোখ মুছিয়ে দিলো। একবার আড়চোখে দুষ্টুকে দেখে নিয়ে ওর মাথাটা আলতো করে ঘাড়ে রাখলো। খুব সন্তর্পণে দুষ্টুকে দেখিয়েই চুলে চুমু খাওয়া হলো। দুষ্টু দেখলোও। চোখ ফেরালো। এরমাঝে প্রযুক্ত আগ্রহ নিয়ে জিজ্ঞেস করলো,

‘তোমাদের বন্ধুত্বের কাহিনিগুলো শুনি, বলো।’

দুষ্টু চকিতেই উঠে দাড়ালো। একবার শ্রেয়সীর দিকে তাকিয়ে নিস্তেজ গলায় বলল,

‘সম্পর্ক-ই ফিকে হয়ে গেছে। কাহিনি আর কি শুনবেন ভাইয়া?’

প্রযুক্ত বুঝলো না এমন কণ্ঠে প্রশ্ন করলো, ‘মানে?’

‘বন্ধুত্বের রংগুলো মলিন হয়ে গেছে। এটাই কাহিনি!’

দুষ্টু হেসে ভেতরের ঘরে পা রাখলো। যাওয়ার সময় ওর চোখের কোনার পানিগুলো চিকচিক করে নীড়ের দিকে তাকিয়ে রইলো। নীড় হাসলো। নিশ্চুপ গলায় বলল,

‘আমার দ্বন্ধ হয়তো এখানেই শেষ! কিন্তু তোমার যন্ত্রণা অবশ্যই এখান থেকে শুরু!’

নীড়ের কথা শেষ হলো না। তার আগেই তার বুকেও দাউ দাউ করে আগুন জ্বললো যখন দেখলো প্রচ্ছদ উঠে চলে গেলো। গিয়ে ওদের ঘরের দরজাটা লাগিয়ে দিলো। শব্দ হলো। তাতে বুকের আগুনের তেজ বাড়লো! প্রযুক্তও শ্রেয়সীকে নিয়ে উঠে দাড়ালো। বৃষ্টি থেমে গেছে। তারা বাইরে গেলো। তখনো নীড় একদৃষ্টিতে বন্ধ দরজার দিকে চেয়ে। খানিকবাদে ভীষণ রাগে, যন্ত্রণায়, কষ্টে যখন বসা থেকে উঠতে চাইলো, দেখলো… ওর কাধে খুব আদুরে বিড়ালছানার ন্যায় নত মুখে ঘুমিয়ে আছে টিয়া। কী বিষন্ন মুখ তার! চোখের নিচ’টা কি দারুণ কালো! ঠোঁট দুটো ভীষণ শুষ্ক! মলিন মুখটা যেনো কত ব্যর্থতার বহর। কতশত কষ্টের অভিযোগ তাতে! নীড় চেয়ে থাকলো। কেউ কবে, কখনো কি জানতো হক বাড়ির এতো আদরের একমাত্র মেয়ের এহেন দুর্দশা? নীড় বোধহয় এই প্রথম খুটিয়ে খুটিয়ে টিয়াকে দেখলো। এরপর বিরবির করতে করতে কোলে তুলে নিয়ে গেলো নিজের ঘরের দিকে,

‘রাতে ঘুমায় না নাকি?’

চলবে❤️