#এমন_একদিন_সেদিন
#মুমুর্ষিরা_শাহরীন
পর্ব-৫৪
১০৮.
একপ্রকার জোরজবরদস্তি করে পাঁজাকোলে পরের দিন বিকালে দুষ্টুকে গাড়িতে তুলতে হয়েছে। সেই সকাল থেকে অনুরোধ, অনুনয় করতে করতে প্রচ্ছদের মেজাজ চিড়বিড়িয়ে তুঙ্গে উঠেছে। এতো অবাধ্য মেয়েটা! হক মঞ্জিলের সামনে এসে গাড়ি পৌছালে মিনিট দুই গড়ালেও যখন দুষ্টু নামলো না প্রচ্ছদ চোখ ছোট ছোট করে বললো,
‘বসে আছো কেনো? নামো।’
দুষ্টু গাল ফুলিয়ে জবাব দেয়,
‘নামবো না। গাড়ি ঘুরান। আমার বাসায় যাবো। আপনার বাসায় যাবো না আমি।’
প্রচ্ছদ আর একটা বাক্যও এই বেয়াদব মেয়ের সাথে ব্যয় করলো না। হনহন করে গাড়ি থেকে নেমে যেই দুষ্টুকে আবার কোলে নিতে যাবে দুষ্টু চোখ বড় বড় করে চেঁচিয়ে উঠলো,
‘নামছি। নামছি। ভেতরে কত মানুষ রয়েছে! বেহায়া লোক!’
‘বউয়ের জন্য একটু বেহায়া হলে ক্ষতি নেই। একটা মাত্র বউ আমার!’
প্রচ্ছদ ঠোঁট প্রসারিত করে হাসলো। তখন তাকে এতো সুদর্শন দেখালো যে দুষ্টু সেই চমৎকার মুখপানে তাকিয়ে একটু আগের নিশ্রিত বাক্যের মাঝখানে থমকে রইলো। প্রচ্ছদ ইদানীং প্রকাশ্যে এভাবে কেনো কথা বলে? আগে তবুও লুকিয়ে, আড়ালে রাখতে চাইতো। জিজ্ঞেস করলে অস্বীকার করতো। কিন্তু এখন? দিন যত ঘনিয়ে আসছে প্রচ্ছদের খবরদারি তত বেড়ে যাচ্ছে। দুষ্টুকে ওর জটিল জিম্মার জালে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে নিচ্ছে।
‘যখন থেকে শুনেছেন আমার ব্রেকাপ হয়েছে তখন থেকে আপনার অভিভাবকত্ব বেড়ে গেছে। এতো তদারকি করছেন। কি মতলব আপনার?’
প্রচ্ছদ দুষ্টুর কানে ফিসফিস করে বলল,
‘দেখছি, মহারানীর কাছে যদি একটু চান্স পাওয়া যায়। যদি মহারানীর মূল্যবান, কোহিনূর সমতুল্য চোখদুটো এই নগণ্যের উপর এসে পরে; তবে-ই তো এই অধমের জীবন সার্থক হবে।’
দুষ্টু অদ্ভুত চোখে তাকালো। কি আশ্চর্য! ছেলেটা রাগলো না কেনো? উফফফ….! হাত দুটো বাড়িয়ে প্রচ্ছদের গলাটা টিপে দিতে ইচ্ছে করছে। যেনো কিছুই হয়নি এমন অবুঝের ভান ধরে প্রচ্ছদ জিজ্ঞেস করলো,
‘হাটতে কষ্ট হচ্ছে, মহারানী? কোলে নেবো? একটা হুইল চেয়ার আনি? বা গাড়ি’টা ভুম করে চালিয়ে দেওয়াল, দরজা ভেঙে ড্রয়িং রুম অবধি নিয়ে যাই? এছাড়া অন্য কোনো পন্থা আছে? বলুন?’
প্রচ্ছদের আরক্তবদন প্রশ্ন। দুষ্টু চোখ পাকিয়ে চেয়ে রইল মিনিট চারেক। প্রচ্ছদ বন্ধ ওই লাল ঠোঁটে মুচকি হেসে বলে,
‘আপনার জন্য সূর্য ছুঁতে রাজি। আপনি চাইলে তো মেঘও এনে দিতে পারি।’
দুষ্টু উত্তর দিলো না। প্রচ্ছদের বুকের বা’পাশে মৃদু ধাক্কা দিয়ে ধুপধাপ ভেতরের দিকে চলে গেলো। পেছন থেকে প্রচ্ছদ চিল্লিয়ে উঠলো, ‘তবে হেটেই যাবেন?’ এরপর উচ্চস্বরে হেসে উঠলো।
ড্রয়িং রুমে অর্জন টিভি দেখছিলো। ইরা ওকে চা এগিয়ে দিতেই হাত ধরে ওকে পাশে বসালো। দুষ্টু গিয়ে ইরাকে জড়িয়ে ধরে গালে বড় করে চুমু খেলো। সদরদরজা দিয়ে তখনি প্রচ্ছদকে ঢুকতে দেখে ইরা ঠাট্টা করে বলল,
‘ও বাবা! মহাপাজি রাজা অবশেষে তার রানীর মান ভাঙাতে পারলো? খুব অল্প সময়ে অভিমান ভেঙে গেলো তো!’
দুষ্টু ইরাকে ছেড়ে এক ভ্রু উঁচু করে তাকালো। প্রচ্ছদ নিশ্চয়ই এসব বলেছে। দুষ্টু প্রচ্ছদের দিকে এক ভয়ংকর চাহনি ফেলে দু’তলার ডানদিকে নিজের ঘর’টার দিকে গটগট করে হেটে চলে গেলো। অর্জন ওদের দিকে একবার তাকিয়ে আরেকবার ইরার দিকে তাকালো। ইরা ওর কাধে মাথা এলিয়ে দিয়েছে। পেট’টা হালকা বেড়েছে। হাত দিলে বুঝা যায়। ইরার স্নিগ্ধ চেহারা’টায় কেমন একটা মা মা ভাব ফুটে উঠেছে। মাঝে মাঝে অর্জনের মনে হয়, এই মিষ্টি মেয়েটা যদি ওর জীবনে না আসতো ওর জীবনের অর্ধেক মর্ম অজানা রয়ে যেত। দৃষ্টির সাথে বিয়ে ভেঙে যাওয়া’টাকে ও ব্লেসিংস হিসেবে দেখে! মা একপ্রকার জোর করেই দৃষ্টির সাথে ওর বিয়ে ঠিক করেছিলো। দৃষ্টিকে কোনোকালেই ওর পছন্দ ছিলো না। প্রযুক্ত প্রচ্ছদের বন্ধু হওয়ার সুবাধে ইরা’কে ওরা আগে থেকে চিনতো। ভালোও লাগতো। বিয়ে’টা ভেঙে যাওয়ার প্রায় তিন চার মাস পর ‘ইরা’কে পছন্দ করে’ একথা অর্জন বাড়িতে জানায়। ঘরোয়া আয়োজনেই তাদের বিয়ে হয়। সেই অতিমাত্রার স্বল্প পরিচিত হাতে গুনা পাঁচ-ছয় বার দেখা হওয়া মেয়েটা’ই আজ তাদের ঘরের মুকুট! অর্জন ইরার মাথায় চুমু খেলো। ইরা চোখ বন্ধ করে মুচকি হাসলো। এযুগে এসে ওর মতো ধৈর্য্যশীল, নম্র, ভদ্র, বাধ্য মেয়ে পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার! অর্জন নিশ্চয়ই জীবনে কোনো মারাত্মক ভালো কাজ করেছে যার বিনিময়ে এমন চমৎকার একজন জীবনসঙ্গীনী আল্লাহ তাকে উপহার দিয়েছেন।
১০৯.
হক মঞ্জিলের রান্নাঘরে তখন বাড়ির তিন বউয়ের কর্তৃত্ব চলছে। হাতে হাতে আমোদে প্রমোদে কাজ এগুচ্ছে। নীরার এতো পরিবর্তন দেখে দুষ্টু যারপরনাই অবাক হয়েছে তো বটেই সেইসাথে তাদের মাঝে যে এক অদৃশ্য তর্কাতর্কির যুদ্ধ চলতো তাও প্রকৃতির কৌশলে থেমে গেছে। নীরা আজকাল আকাশ, সাজিদ এবং এই গোটা সংসার’টাকেই চোখে হারায়। রাতারাতি মানুষ’টার এতো পরিবর্তন কম বেশি সবারই চোখে লেগেছে।
দুষ্টু তেলে পেঁয়াজ ছেড়ে নীরার উদ্দেশ্যে বলে উঠলো,
‘আমি ছোটবেলায় কি বলতাম জানো? আমি একজন ভালো মেয়ে হতে চাই, ভালো স্ত্রী হতে চাই, ভালো মা হতে চাই, ভালো বউমা হতে চাই, ভালো স্টুডেন্ট হতে চাই, ভালো বন্ধু হতে চাই। সব ভালো হতে চাই।’
ইরা, নীরা মনোযোগ দিয়ে শুনলো। বুক চিরে তাদের বড় একটা নিশ্বাস বেরিয়ে এলো। তবে মুখে কিছু বললো না তখনো।
‘আফসোস! আজপর্যন্ত কোনোটাই হয়ে উঠতে পারলাম না। এতো বাজে একটা মানুষ আমি!’
দুষ্টু কাতরতায় জর্জরিত হয়ে উঠলো। ইরা একটা উঁচু মোড়ার উপর বসলো। অনেকক্ষণ বাদে বলল,
‘থেকে যা না! আমাদের কি তোর পছন্দ নয়?’
দুষ্টু মিষ্টি করে হাসলো। রান্নায় মনোযোগ দিয়ে বলে উঠলো,
‘তোমার দেবর’টাকে পছন্দ নয় গো।’
নীরা অভিযোগ করে বলে, ‘কত সুন্দর দেবর আমার! এই রাজ্যে খুঁজলে ওমন আর একটাও পাবে? রাজ কপাল তোমার!’
দুষ্টু অমায়িক হাসলো। উত্তর দিলো না।
আজ শুক্রবার! ছুটির দিন বিধায় প্রযুক্ত, নীড় এবং টিয়াকে আসতে বলা হলো। ওরা এলো বিকেল করে। সবাই বসে গল্প করছিলো। হক মঞ্জিলের ড্রয়িং রুম তখন একেকজনের কলধ্বনিতে উচ্ছ্বসিত। আকাশ খুব করে কাঁদছিলো বলে ওকে নিয়ে নীরা উপরে গিয়েছে। ইরাও সবার সাথে গল্পে মশগুল। বাধ্য হয়ে ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে সেই দুষ্টু’কেই আবার নীড়ের সামনে হাজির হতে হলো। নাস্তা টেবিলে রেখে যেই দৌড়ে চলে যাবে ওমনি খুব সন্তর্পণে প্রচ্ছদ ওর হাত’টা চেপে ধরে ওর পাশে বসার জন্য ইশারা করলো। দুষ্টু চোখ ছোট ছোট করে তাকায়। প্রচ্ছদ ঈষৎ হাসে তবুও হাত ছাড়ে না। বাধ্য হয়ে দুষ্টু ওর পাশে বসলো। একদম গা ঘেঁষে। নীড় তখন বেশ উৎফুল্ল। এ কয়দিনের টিয়ার কর্মকাণ্ড সবার মাঝে ব্যাখ্যায় রত সে। সকলে হেসেই খুন। এদিকে টিয়ার হাসি পাচ্ছে না সামনে বসা প্রযুক্ত’কে দেখে। তবুও তার উন্নতি হয়েছে। নিজেকে ধাতস্থ করে স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করছে সে। দুষ্টু সব শুনলো। বাড়ির বড়রা একে একে নিজেদের ঘরে চলে গেলো। নীরা আকাশ’কে নিয়ে আবার নিচে নামলো। সাজিদের পাশে বসলো। প্রচ্ছদ দুষ্টুর দিকে এক কাপ চা এগিয়ে দিলো। দুষ্টু চোখ মুখ খিচে নিচুস্বরে বলে উঠলো,
‘আমি চা খাই না আপনি জানেন না?’
প্রচ্ছদ চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে পুনরায় বাড়িয়ে দিলো দুষ্টুর দিকে। ঈষৎ সুর করে গলা নিচুস্তরে নামিয়ে ওর কানে কানে গাইলো,
‘আমি দিয়েছি চুমুক তাতে,
এবার যদি প্রেম ফিরে আসে।’
দুষ্টু চোখ পাঁকিয়ে তাকায়। প্রচ্ছদ ঠোঁট প্রসারিত করে হাসে। ওদের সবকিছুই নীড় দেখছিলো। কিছু দেখার ইচ্ছে ছিলো না তবুও বেহায়া চোখ দুটো সেদিকে’ই ভিড়ছিলো। কেনো এমন হয়? অন্তঃকরণে যে ঝড় বয়। ড্রয়িং রুমের সাথে লাগোয়া বিশাল থাই গ্লাসের বাইরের সাদা আকাশের দিকে চোখ ফেলল সে। কেমন বিমূঢ় কাতর চিৎকারে ভেতর’টা চাপা মনস্তাপে ফিসফিস করে বলে উঠলো,
‘ও কেনো আমার হলো না?’
চলবে❤️
#এমন_একদিন_সেদিন
#মুমুর্ষিরা_শাহরীন
পর্ব-৫৫
১১০.
টিয়ার সাথে নীড়ের সম্পর্কের যে খুব বেশি উন্নতি ঘটেনি তা খুব সন্তর্পণে লক্ষ্য করেছে দুষ্টু। তবে খুব শীঘ্রই যে এই সম্পর্কের শ্রীবৃদ্ধি ঘটবে তার অভিপ্রেত দেখতে পাচ্ছে। টিয়ার প্রতি নীড় যথেচ্ছাচারী যত্নশীল! তাদের মধ্যে এই এতো বন্ধুত্বপূর্ণ সদভাব, পরস্পরের প্রতি উদ্যমশীলতা দেখে দুষ্টুর কি কোথাও একফোঁটা মচকালো? তার বুকের কোনো অংশের এক ইঞ্চিও কি পুড়লো? যেমন’টা রাত-দিন পুড়ে প্রচ্ছদের আর নীড়ের?
উত্তর’টা না বোধ হয়! প্রকৃতপক্ষে অন্তরের দহন ঘটানোর জন্য যে পারিপার্শ্বিক ব্যবস্থা থাকার প্রয়োজন পড়ে দুষ্টুর চারিপাশে সেই পরিবেশটুকু নেই। সারাক্ষণ প্রচ্ছদ আঠার মতো তার সাথে লেপ্টে থাকছে। প্রয়োজন ছাড়া আর এক সেকেন্ডের জন্যেও বাইরে থাকছে না। দুষ্টুর ওতোসব ভাবার ফুরসত কোথায়? অবশ্য সে ওসব ভাবতেও চায় না। অধিকন্তু তার অষ্টপ্রহরের অধিকাংশ সময় কাটছে প্রচ্ছদ’কে অনুধাবন করতে করতে।
এসব ভাবতে ভাবতেই দুষ্টু হিজাব বাঁধছিলো। প্রচ্ছদের মুখ’টাতে বরাবরের মতোন তমিস্র ঘন মেঘ জমেছে। আজ তারা কোর্টে যাবে। প্রেগন্যান্সির রিপোর্ট সহ আনুষঙ্গিক কিছু কাগজ দেওয়ার জন্যই মূলত যাবে। দুষ্টু রেডি হয়ে নিচে নেমে এলো৷ কাল রাতে নীড় টিয়া এ বাড়িতেই থেকে গেছে। নিচে নামতেই নীড়ের চোখে চোখ পরলো। নীড়ের শরীর বেয়ে একটা দুটো শীতল স্রোতের ধারা নেমে গেলো। দুষ্টু আলগোছে চোখ সরিয়ে নেয়। ড্রইংরুমে এসে দাড়াতেই অতর্কিতে নীড় দুষ্টুর উদ্দেশ্যে বলল,
‘আরেকবার ভেবে দেখো।’
দুষ্টু আচম্বিতে চাইলো! কি আশ্চর্য! সবার এই এক কথা! ‘আরেকবার ভেবে দেখো’। আরেকবার কি ভেবে দেখবে সে? এটা তো আজ নতুন চর্চার বিষয় নয়। বিয়ের শুরু থেকেই এটা বলে কয়ে চলে আসছে। এই শেষ মূহুর্তে এসে সবাই এমন ভান করছে কেনো?
‘আমার জন্য নিজের জীবন’টা নষ্ট করো না।’
দুষ্টু ভ্রু টান টান করে তাকালো, ‘সরি?’
পরক্ষণেই আবার শুধালো, ‘তোমার জন্য মানে? তোমার কি মনে হয় তোমার কাছে ফিরবো বলে আমি ডিভোর্স দিচ্ছি? নাকি তোমাকে এখনো ভালোবাসি?’
নীড় এক অনিমেষে চেয়ে বলল,
‘কোনোটাই না। এককালে কখনো আমায় ভালোবেসেছিলে বলে ডিভোর্স দিচ্ছো।’
ড্রইংরুমের আশেপাশে একবার সতর্ক দৃষ্টি ফেলে দুষ্টু নিচুস্বরে বলল,
‘তোমার ভাবনায় ভুল আছে, নীড়। নিজের বিবেকের অস্বস্থিময় দংশন সইতে পারছি না বলেই দিচ্ছি।’
নীড় বড় করে শ্বাস ফেলে নিজেকে প্রশমিত করলো। করুণ চোখে চেয়ে বলল,
‘দেখো, আমি না পারি কিন্তু মুভ অন করার চেষ্টা তো করছি। শুধুমাত্র তোমার কথায়! তুমি প্লিজ এসব বাদ দেও। আমার ভাই’টা কেনো কষ্ট পাবে? কেনো শুধু শুধু ডিভোর্স দেবে? একটু চেষ্টা..
নীড়ের মুখের কথা কেড়ে নিয়ে দুষ্টু চাপাস্বরে বলল,
‘তোমার জন্য! তোমাকে আর কখনো দেখতে চাই না বলেই চলে যেতে চাইছি। আমার অস্বস্থি হয় তোমায় দেখলে। দম বন্ধ হয়ে আসে। তুমি কেনো এ বাড়িতে আসো? কেনো আমার চোখের সামনে ঘুরঘুর করো? তোমাকে আমার সহ্য হয় না।’
দুষ্টু থামে। নীড় চেয়ে আছে দুষ্টুর বলার অপেক্ষায়,
‘আর বাকি রইলো আমার কথায় মুভ অন করার চেষ্টা করছো? ভ্রান্ত ধারণা পুষে নিজেকে সান্ত্বনা দিও না। গেট আ লাইফ। টিয়ার মোহে জড়িয়ে পরছো তুমি। ওই যে বলে না, ‘আউট অফ সাইড আউট অফ মাইন্ড।’ আমিও চাই তুমি তোমার সম্বিৎ ফিরে পাও। ইউ নো, আই এম আ কুল মাইন্ডেড স্ট্রং ওমেন। আই ওন্ট স্টপ ফর এনি অফ ইউ। ইউ গাইজ আর জাস্ট বুলশিট।’
দুষ্টু চলে গেলো হনহন করে পায়ের শব্দ তুলে। পেছনে ফেলে গেলো নিবৃত্ত অসহায় এক যুবক’কে। সাথে তাকে দিয়ে গেলো এক তুষারস্তূপ নিদারুণ নিগ্রহতা!
,
প্রচ্ছদ ক্ষীপ্রকর্মা হাতে গাড়ি চালাচ্ছিলো। তাকে দেখে না বুঝা যাচ্ছে ব্যথিত, না বুঝা যাচ্ছে সে রুষ্ট। বাইরে থেকে অনুদ্ধত, অটল সে! শুধু তার গুরু-গম্ভীর ভারিক্কি’টাই উপলব্ধি করা যাচ্ছে। দুষ্টুর ভালো লাগলো না প্রচ্ছদের ওমন মুখ ভার। সে এতোক্ষণের নিস্তব্ধতা ভাঙলো কেমন অপ্রতুল ক্ষীণ স্বরে,
‘জানেন?’
প্রচ্ছদ কোনো উত্তর করলো না। কিন্তু পরক্ষণেই তার বুকে তুফান তুলে দৈবাৎ এই পাষাণ, রহস্য-রমনী বলে উঠলো,
‘প্রাক্তনকে ভালোবাসার মাঝে অস্বস্থি আর বর্তমানকে ভালোবাসার মাঝে গোপন প্রশান্তি।’
প্রচ্ছদ সজোরে ব্রেক কষলো। অনেকক্ষণ বোবা অবাক চোখে চেয়ে রইলো। তারপর কি জানি কি হলো গাড়ি স্টার্ট করতে করতে প্রচ্ছদের ঠোঁটের কোনায় যেনো সাত-রঙা হাসির ঝলকানি খেলে গেলো। সেদিকে তাকিয়ে দুষ্টু ব্যথাতুর নয়নে বলল,
‘আমার জীবনে প্রশান্তি’টুকু এলো না। শুধু অস্বস্থি-ই পেয়ে যাচ্ছি।’
তাতে প্রচ্ছদের হাসির চমক’টা এক বিন্দু পরিমাণ কমলো না। তাল মিলিয়ে বেড়ে চললো। মনের গোপনেরও গোপন সিন্দুক থেকে কে যেনো জনসম্মুখে দুষ্টুর গালে তপ্ত এক চুমু বসিয়ে চিৎকার করে বলে উঠতে চাইলো,
‘পেয়ে যেতে কতক্ষণ? এক সেকেন্ডের খেলা সব।’
কিন্তু মুখে বললো, ‘শুধু অস্বস্থি’টুকুকে আর ভালোবাসবেন না।’
‘বাসবো না?’
‘না।’
‘ঠিকাছে। আমি বাসি না।
,
কোর্ট থেকে বেরিয়েও প্রচ্ছদ হাসি-খুশি। এদিকে দুষ্টু প্রতিক্রিয়াহীন। গাড়ির কাছ’টায় এসে প্রচ্ছদ’কে ওমন মুচকি মুচকি হাসতে দেখে দুষ্টু ভ্রু নাচিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
‘ব্যাপার কি?’
‘কোনো ব্যাপার নেই। সব খতম।’
দুষ্টু গাড়ির দরজার সাথে হেলান দিয়ে বুকে আড়াআড়ি হাত বেঁধে চোখ ছোট ছোট করে মৃদু ধমক দিয়ে উঠলো,
‘মুচকি মুচকি হাসছেন কেনো বারবার?’
প্রচ্ছদ চোখ পাঁকিয়ে তাকায়। তাকে ধমক দেওয়া হচ্ছে?
‘তোমার মুখ দিয়ে হেসেছি নাকি? তুমিতো দিন দিন রসকষহীন হয়ে যাচ্ছো। তোমার নামের দফারফা করে দিচ্ছো। মানাচ্ছে না তোমাকে।’
দুষ্টু চোখ মুখ কুচকে ব্যঙ্গ করে উত্তর করলো, ‘আর আপনার রসকষ দিন দিন বেড়ে যাচ্ছে।’
প্রচ্ছদ ঠোঁট কামড়ে দুষ্টুর উপর ঝুঁকে এলো। দুষ্টু গাড়ির সাথে লেপ্টে আশেপাশে চোখ বুলিয়ে ইতস্তত স্বরে বলল,
‘কি করছেন? এটা পাবলিক প্লেস! দ্রুত সরে দাড়ান।’
প্রচ্ছদ ফিসফিস করে বলে,
‘তোমার কি মনে হচ্ছে? আমি কি করতে পারি?’
দুষ্ট তোঁতলিয়ে উঠে। জিহ্বার গোড়ায় শব্দ গুলো আটকে আটকে এলো,
‘কি করবেন? সরে দাড়ান! ভালো হচ্ছে না কিন্তু! এটাকে হ্যারাস করা বলে।’
শেষের দিকে যেনো দুষ্টু কেঁদেই দিবে। প্রচ্ছদ ঠোঁট বাঁকিয়ে সুন্দর করে হাসলো। দুষ্টুর মুখের উপর ফুঁ দিয়ে ওর চোখের পাতা বন্ধ করে আরেকটু ঝুঁকে বলে উঠলো,
‘তুমি কি জানো শেষ মূহুর্তে এসে তোমার এই বিচ্ছিরি ডিভোর্স দেওয়া’টা হয়ে উঠবে না? দিতেই পারবে না তুমি!’
দুষ্টু চমকে প্রচ্ছদের দিকে তাকালো। শিরদাঁড়া বেয়ে হিমশীতল প্রভঞ্জন বয়ে গেলো। বিদ্যুৎ স্পৃষ্টের ন্যায় ঝাপসা চোখ দুটো আটকে গেলো প্রচ্ছদের ওমন সুন্দর হাসিখানার দিকে। বক্ষস্থল তার কেঁপে উঠলো। হঠাৎই যেন প্রচ্ছদ’কে চিনে উঠতে পারলো না চিত্ত। কে এই অতি সুন্দর মানব? যে কথার মারপ্যাঁচে আজকাল দুষ্টুকে হারিয়ে নিজে জিতে নিচ্ছে সব। লুফে নিতে চাইছে দুষ্টু নামক অবাধ্য দুহিতা’কে। কে এই মনোহর মনুষ্য ছা? নাকি কোনো রাজার ছা? রাজপুত্র বুঝি? এক নিবিষ্টতার হিয়ার ভেতর প্রচ্ছদের ওই সুন্দর মুখখানা গেঁথে কে যেন সুনিপুণ কন্ঠে সহসা বলে উঠলো প্রবল সম্বোধনে এক নিঃশ্বাসে,
‘মনুষ্য ছা নয়.. রাজার ছা নয়..ভিনদেশী নয়
সে ছিলো যে এক দুষ্টু বইয়ের মিষ্টি প্রচ্ছদওয়ালা,
ডুগডুগি নাম দিয়েছিলো যার রাগী টুকাইওয়ালা।’
১১১.
তারপর কেটে গেলো পনেরো দিন। এই পনেরো দিনে অনেক কিছু বদলালো। দুষ্টুদের আলাদা হওয়ার দিন ঘনিয়ে এলো। এই তো আর মাত্র তোরো-চৌদ্দ দিন! তারপর আর চাইলেও কখনো এ মানুষ’টার সাথে এক হওয়া যাবে না। এক খাটে শুয়া যাবে না। প্রচ্ছদ দুষ্টুকে জ্বালাবে না। নানান ইঙ্গিতে নিজের ভালোবাসা ব্যক্ত করতে পারবে না। দুষ্টুকে ওর বিবেক নামক সাপ’টা আর পীড়া দিবে না। নতুন ভোরের নতুন আলোয় সব নিত্য নতুন ভাবে শুরু হবে। শ্রেয়সী-প্রযুক্ত একে অপরের প্রাণভোমরা হয়ে রবে। নীড়-টিয়াও হয়তো হাতে হাত রেখে জীবনের বাকি ষাট’টা বছর পার করে একসাথে বুড়ো হবে। প্রচ্ছদ হয়তো আবার বিয়ে করবে। তারও বাচ্চা হবে। সংসার হবে। হবে না কিছু শুধু দুষ্টুর। দুষ্টুর শ্বাস-প্রশ্বাস ফুসফুসের মাঝেই আটকে গেলো। চোখ ধাঁধিয়ে কান্না পাচ্ছে তার। এর-ই মাঝে শুনলো সিড়িন হক তাকে ডেকেছেন। দুষ্টু চমকালো না। থমকালো না। শুধু নীরব অশ্রুজল চোখে কল্পনা করে গেলো নিজের নিঃসঙ্গ ভবিষ্যত। কানে একাকী বাজলো প্রচ্ছদের বলা কথাটা,
‘তুমি আমাকে ছাড়া থাকবে কীভাবে?’
আবার চোখ ছাপিয়ে মোটা জলের ধারা গাল বেয়ে পরে বুকের সাথে মিশে গেলো। সে নিজেকে বাইরে থেকে যতটা স্ট্রং দেখাচ্ছে ততটা থাকতে পারছে না। সে দু’হাত দিয়ে চোখ মুখ চেপে আর্তচিৎকার করে উঠলো। বিয়ের শুরুর দিকে প্রেমিকের জন্য দুষ্টুর যারপরনাই কান্নাকাটি দেখে প্রচ্ছদ একদিন তার নিজস্ব রাশভারী স্বরে বলেছিলো,
‘যে জিনিসটা তুমি তীব্র ভাবে চাইবে তা তুমি কখনো পাবে না। এটাই প্রকৃতির অঘোষিত নিয়ম! তাকে মেনে নিতে শিখো!’
চলবে❤️
#এমন_একদিন_সেদিন
#মুমুর্ষিরা_শাহরীন
পর্ব-৫৬
মিনিট দশেক পেরিয়েছে সিড়িন হক দুষ্টুর দিকে তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে আছেন। দুষ্টু স্থবির ফ্লোরের দিকে চেয়ে আনমনে বিছানায় আঁকিবুঁকি করছে। সিড়িন হক উঠে দরজা বন্ধ করে দিয়ে এসে আবার বিছানায় বসলেন। তাতে দুষ্টুর মাঝে কোনো হেলদোল দেখা গেলো না।
‘কেঁদেছো তুমি?’
দুষ্টু একবার নিষ্প্রাণ চোখ দুটো মেলে তাকায়। তারপর ধীরে ধীরে মাথা নাড়িয়ে না করে। সিড়িন হক সূক্ষ্ম দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। যেকোনো কিছু এক নিমিষে চট করে বুঝে ফেলায় ভীষণ পারদর্শী তিনি। এই যেমন, টিয়া যে প্রযুক্ত’র প্রেমে পা পিছলে পরেছে তা তিনি টের পেয়েছিলেন আরো বহু আগে। ইচ্ছে করলেই টিয়ার সাথে প্রযুক্তর বিয়েটা দিতে পারতেন। কিন্তু তিনি মনে করেন তার সেই অধিকার নেই। যদ্যপি যাদের মেয়ে তারা নিজেরাই নীড়’কে পছন্দ করেছে তদোপরান্ত টিয়াও নাকচ করেনি। প্রযুক্তর প্রতি নিজের অনুভূতি সবার সামনে ব্যক্ত করেনি। প্রকাশ করলে তিনি একবার যেচে ভেবে দেখতেন।
‘আমার কাছে এসো।’
দুষ্টু সিড়িন হকের পায়ের কাছ’টায় বসেছিলো। কোনো বাক্য ব্যয় না করে বাধ্য মেয়ের মতো সে সিড়িন হকের মাথার পাশে বসলো। সিড়িন হক আধশোয়া হয়ে রয়েছেন। সে অবস্থায় তিনি দুষ্টুর মাথা বুকে জড়িয়ে নিলেন। দুষ্টু যেনো জানতো… যেনো বহুবার সিড়িন হক’কে জড়িয়ে ধরা হয়েছে এমন ভাবে আকড়ে ধরে আদুরে বিড়াল ছানার ন্যায় পরে রইলো।
‘আমার ছেলে’টা আমার থেকে তোমাকে চেয়ে নিয়েছিলো, দুষ্টু। আমার পায়ে পর্যন্ত ধরেছিলো, জানো?’
দুষ্টুর পল্লব দুটো নিরব অভিগ্রস্তে টইটম্বুর হলো। সিড়িন হক আবার বললেন,
‘থেকে যাও, সোনা। আমার ছেলেটা মরে যাবে তোমাকে ছাড়া।’
দুষ্টু অম্বুর নেত্রে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইলো। এই কথাগুলো তাকে আগে কেউ কখনো এভাবে বলেনি। ডিভোর্সের কথা সেই শুরু থেকে সবাই জানছে। কেউ একটা টু শব্দ পর্যন্ত করেনি। অথচ এই শেষ মূহুর্তে এসে সবাই ওকে জনে জনে বেঁধে রাখতে চাইছে। এমনকি তার সামনে বসে থাকা সবার ভাষ্যমতে কঠিন, অনড়, বুক ফাটলেও মুখ না ফোঁটা এই মহিলা’টিও।
১১২.
চারিদিকে শুনশান নিরবিচ্ছিন্ন নিরবতা! কুয়াশার ঘন শ্বেতজাল। টিয়ার সাথে নীড়ের সম্পর্কের উন্নতি ঘটেছে বৈ অবনতি ঘটেনি। এই হাড়কাঁপানো শীতের মাঝে তাকে ঠিক ঠিক রোজ সকাল ৭ টায় ঘুম থেকে উঠতে হয়। পড়তে হয়। সে বেশ কিছু রান্নাও করতে শিখে গেছে। রান্না খারাপ হলেও বিনা অভিযোগে টিয়াকে এপ্রিশিয়েট করে খেয়ে নেয় নীড়। তাদের সকাল আর রাতের খাবার বানানোর রুটিন আলাদা। সপ্তাহের চারদিন নীড় ব্রেকফাস্ট এবং ডিনার রেডি করে। আজ নীড়ের ডেইট।
ঘড়ির কাটা সাড়ে ন’টার ঘরে গিয়ে ঠেকেছে। টিয়া হা করে মুখের ধোঁয়া ছাড়লো বাইরে৷ এরপর রুমে গিয়ে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে মুখ থেকে ধোঁয়া ছেড়ে ঝাপসা করলো আয়না। জলীয়বাষ্পে আঙ্গুল দিয়ে আঁকিবুঁকি করে লিখলো ‘বাজে নীড়, মাসুম টিয়া’। নীড় ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে বুকে হাত ভাঁজ করে সব দেখলো৷ বলল,
‘ওটা হবে পাজি এবং অবাধ্য টিয়া।’
টিয়া চোখ ছোট ছোট করে তাকিয়ে আবার বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ায়। বারান্দার পাশ ঘেঁষে উড়ে গেলো একটা ছোট্ট টিয়া পাখি। টিয়ার গায়ের উপর শাল জড়িয়ে দিয়ে পেছন থেকে নীড় মোহিত কন্ঠে শুধালো,
‘কার টিয়া পাখি বেশি সুন্দর? ‘
টিয়া ঠোঁট ফাঁক করে হাসলো। মুখ থেকে আবার ধোঁয়া ছেড়ে বলল,
‘অবশ্যই তোমার।’
নীড় ভ্রু কুচকে তাকায়,
‘তাই নাকি? তুমি আমার টিয়া পাখি?’
টিয়া যেনো লজ্জা পেলো। নাক লাল হয়ে উঠলো। ও যে দিনদিন নীড় নির্ভরশীল হয়ে পরছে তা সে গুণে গুণে টের পাচ্ছে। কিন্তু আদতে কিচ্ছু করার নেই। নীড়ের সান্নিধ্য তার ভালো লাগে। প্রযুক্ত’র কথা তেমন মনে পরছে না আজকাল। তবে যখন সামনাসামনি হয় টিয়ার বুক’টা অকারণেই খালি হয়ে যায়। হাসফাঁস লাগে। অস্বস্থি হয়। নিজেকে কেমন যেন অশুচি বলে বোধ হয়।
টিয়া না বুঝলেও বাকি সবাই বুঝবে সবার মতো ওর ভালোবাসা’টা অতো গভীর ছিলো না। তার মনে এমন ভালোবাসা জন্মেছিলো যা মিলিয়ে যেতে সময় নেয় না। চোখের আড়াল হলেই মনের আড়াল হয়ে যায়। একতরফা ভালোবাসা বলেই কিনা কে জানে! আবার হয়তো বয়সের তুলনায় ইমম্যাচিউর এর ফল।
টিয়া নীড়ের সাথে হেলে দাড়ালো। নীড়ের বুকের সাথে ওর মাথা ঠেকলো। এটা এমন কোনো বিষয় নয়। বিয়ের আগেও তাদের মধ্যে অনেক ভাব ছিলো। অদ্যাবধি ভাব’টা আরো গাঢ় হচ্ছে। আগে মনের ভাব ছিলো এখন ধীরে ধীরে স্পর্শের ভাব হচ্ছে।
‘ভালোবাসা কি খুব ক্ষণস্থায়ী, নীড় ভাইয়া?’
টিয়ার চুল ঠিক করে দিতে দিতে নীড় উত্তর দিলো,
‘উহুম! ভালোবাসা কখনো ক্ষণস্থায়ী হয় না। ভালোবাসা এমন শব্দ যার অর্থ প্রগাঢ়তা!’
‘তবে আমরা কেনো ভালোবাসা ভুলে যাই?’
‘ভুলে যাই না তো।’
‘তবে?’
‘নিজ ইচ্ছায় ভুলে থাকতে চাই। কিন্তু, আমাদের মনের কোনো এক কোনায় সারাজীবন ভালোবাসারা পিঁজরাপুলের আসামির ন্যায় জড়সড় হয়ে ঠিক পরে থাকে। কোনো একদিন এই ভুলে থাকতে চাওয়ার খেলায় বিরতি দিতে চাইলে আমরা তা বের করে দেখি। বিরতি শেষ হলে বুকপকেটে আবার যত্ন করে রেখে দেই।’
টিয়া মাথা উপুর করে বাচ্চামো অবুঝ চোখে চাইলো। নীড়ের ইচ্ছে করলো ওর নাকের ডগায় একটা চুমু দিতে। ভ্রু উঁচিয়ে ঠাট্টার সুরে বলল,
‘কিন্তু মেয়েদের ক্ষেত্রে কি হয় জানি না। প্রভাবলি তারা কখনো কাউকে জীবন দিয়ে ভালোবাসে না।’
টিয়া ভ্রু কুচকালো, ‘ভেরি লেইম।’
নীড় হাসে। অতঃপর কয়েক মিনিট সেভাবেই দাঁড়িয়ে থাকে দুজন। এরপর টিয়া হঠাৎ বলে উঠে,
‘আচ্ছা, আমি কি দেখতে সুন্দর না?’
‘তুমি দেখতে অনেক সুন্দর, টিয়া।’
‘তাহলে আমাকে কেউ কখনো ভালোবাসে না কেনো?’
‘কে বলেছে?’
‘আমি’
‘আমি বাসিতো! আরো ভালোবাসবো।’
কথাটা বলে নীড় স্বাভাবিক ভাবে খাবার রেডি বলে চলে গেলো। টিয়া ওর চরণস্থাপনের দিকে এক দৃষ্টিতে চেয়ে রইল। তাদের মাঝে স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক হয়তো কখনো সম্ভব নয়। কিন্তু তাদের মাঝে যে এক অদৃশ্য টান….. চিত্তের ঐক্য.. মিত্রত্ব .. এসবকিছু কি হাজার তপস্যা করেও পাওয়া যায়? তাদের সম্পর্ক’টা আসলে স্বামী-স্ত্রীর থেকেও অনেক বড় কোনো কিছু যার কোনো নাম-ধাম নেই।
১১৩.
‘ডিভোর্সের পর কোথায় যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিচ্ছো?’
দুষ্টু ভ্রু কুচকে উত্তর করলো,
‘আপনাকে বলবো কেনো?’
‘বললে কি হবে?’
‘বললে যদি সেখানে গিয়ে হাজির হন।’
প্রচ্ছদ দুষ্টুর কাছাকাছি এসে বসলো,
‘তাই যদি হবে তবে তুমি আমার থেকে কখনো ছাড়াই পেতে না।’
দুষ্টু চোখ উল্টে বিরক্তি নিয়ে বলে,
‘যখন তখন কাছে আসবেন না তো। দূরে যান!’
প্রচ্ছদ আরেকটু কাছে এলো। দুষ্টু বারান্দার দোলনা থেকে উঠে পড়তেই প্রচ্ছদ ওর হাত ধরে টেনে আবার বসিয়ে দিয়ে নিচুস্বরে বলল,
‘দূরত্ব ঘুচাচ্ছি দেখতে পারছো না?’
দুষ্টু হাত ছেড়ে উঠার জন্য মোচড়ামোচড়ি শুরু করলো,
‘শীত লাগছে। ঘরে যাবো। হাত ছাড়ুন।’
‘পালাই পালাই করছো কেনো? ক’দিন পর তো পালিয়েই যাবে।’
‘তো? তাই কি এখন আপনার সাথে ঘেঁষে বসে থাকতে হবে?’
প্রচ্ছদ ঠোঁটে আঙ্গুল ঘষে মুচকি মুচকি হেসে বললো,
‘তুমি কি জানো আমার প্রেমে পড়ে যাওয়ার ভয়ে তুমি পালাই পালাই করো সবসময়?’
দুষ্টু ঠোঁট বাকিয়ে পাত্তাহীন গলায় বলে,
‘মোটেও না। প্রেম এতো সস্তা না। ছাড়ুন!’
প্রচ্ছদ ছেড়ে দিলো। দুষ্টু ভেতরের দিকে যেতেই এই কুজ্ঝটিকাময় গগনতলে চেয়ে অসহায় কন্ঠে প্রচ্ছদ বলে উঠলো,
‘ওকে কেনো আমার করে দিচ্ছো না, মাবুদ?’
প্রশ্ন করে সে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। কোনো কিছু করেই কিছু হচ্ছে না। দুষ্টু এক পা টলছে না। এমন অনুভূতি শূন্য, পাষাণ মেয়ে আর দু’টি হয় না। প্রচ্ছদ যে কোন কুক্ষণে পা পিছলে এই মেয়ের উপর পরলো! উফফ!
মিনিট সাতেক পর গায়ে সাদা লং সোয়েটার এর উপর মোটা বাসন্তী শাল জড়িয়ে দু’কাপ কফি নিয়ে দুষ্টু বারান্দার দোলনায় এসে আবার বসলো। প্রচ্ছদ ভ্রু বাকিঁয়ে হাসলো। ভ্রু নাঁচিয়ে বলল,
‘কত্ত কেয়ার!’
দুষ্টু অতিষ্ঠ নয়নে তাকায়,
‘আপনি যে দিন দিন বেহায়া আর মহা ফাজিলে পরিণত হচ্ছেন তা কি জানেন? পাগল কোথাকার!’
‘তোমার জন্যই তো।’
দুষ্টু মাথায় হাত দিয়ে বসলো। ভেতর ঘর থেকে সরু আলো এসে সরাসরি ওর মুখে পরছে। ভীষণ মায়াবী দেখালো ওকে! প্রচ্ছদ এক দৃষ্টিতে চেয়ে রইল কতক্ষণ। এরপর মৃদু হেসে ক্ষীণস্বরে দুষ্টুর কানে কানে বলল,
‘একটা ছন্দ শুনবেন? নতুন লিখেছি।’
দুষ্টুও ফিসফিস করে বলে, ‘শুনবো।’
‘যে গল্পের নাম দুষ্টু প্রচ্ছদ,
সে গল্পের মলাটে প্রেমের পরিচ্ছদ।’
দুষ্টু মুখে কফির গ্লাস ধরতে গিয়ে জড়ীভূত হয়ে গেলো। হাত দুটো থমকে গেলো। যেনো প্রচ্ছদের কোনো মন্দ যাদুবলে তার বোধবুদ্ধি সব লোপ পেয়ে সারা শরীর’ময় থরথর করে কেঁপে উঠলো। কান দুটোতে তালা লেগে গেলো। তবুও মিনিট তিনেক বাদে নিজেকে ধাতস্থ করে দুষ্টু নিজস্বরে বলল,
‘প্রেমের পরিচ্ছদের অধ্যায়’টা আর শুরু হবে না। গল্পে পরে রইবে শুধু বিচ্ছেদ।’
প্রচ্ছদের হৃদপিণ্ড কোন যেনো এক রাক্ষসী কামড়ে ধরলো। রক্তাক্ত করে… হৃদপিণ্ড বুক থেকে ছিন্নভিন্ন ভাবে বের করে নিয়ে কয়েকশো টুকরো করলো। প্রচ্ছদ আহত চোখে তাকিয়ে নিরুপায় হয়ে কেমনতর গলায় বলল,
‘তোমার এসব বলতে একটুও কষ্ট লাগে না, দুষ্টু?’
দুষ্টু দ্রুত ডানে বামে মাথা নেড়ে কফিতে ছিপ দেয়। প্রচ্ছদ নিঃশব্দে চেয়ে থাকে অনেকক্ষণ। কি দিয়ে গড়া এই রমণী? এতো বিষাক্ত কেনো? প্রচ্ছদের দেহের রন্ধ্রে রন্ধ্রে বিষ ঢুকিয়ে দিয়েছে। শ্বাস যাওয়ার অপেক্ষা কেবল। নিঃশ্বাস’টা বন্ধ হলেই কি এই সর্বশ্রেষ্ঠ নিষ্ঠুরতম যুবতী খুশি হবে?
‘তোমার প্রেমিকের কথা এখন আর মনে পরে না?’
এহেন প্রশ্নে দুষ্টু একবার চোখ তুলে চাইলো। প্রচ্ছদের চোখে সন্দেহ। তার চোখের তারায় এই সন্দেহ’টা কীসের? ওর সাথে ডিভোর্স হলে দুষ্টু প্রেমিকের কাছে ফিরে যেতে পারে এই সন্দেহ বুঝি? দুষ্টু বুঝলো! চোখ ছোট ছোট করে চেয়ে থেকে বলল,
‘আপনি যা ভাবছেন সম্পূর্ণ ভুল। আগেও বলেছি আমার একা জীবন কেটে যাবে। আর তাছাড়া ও বিয়ে করেছে।।’
প্রচ্ছদের ঠোঁটের আগায় উত্তর তৈরি করা ছিলো,
‘সে তো তুমিও করেছো।’
দুষ্টু চোরা চোখে একবার প্রচ্ছদ’কে দেখে নিয়ে বলে,
‘আপনাকে কিন্তু আগেও বলেছি এতোটা ব্যক্তিত্বহীন আমি নই। সুতরাং সন্দেহ করাটাও আপনার ব্যক্তিত্বের মাঝে পরছে না।’
প্রচ্ছদ অবিশ্বাস্য গলায় বলল,
‘ইউ আর সাচ আ রুথলেস গার্ল! তোমার কি আমাকেও একবার মনে পরবে না?’
দুষ্টু আর কথা বলতে পারছে না। এই মহামান্য, তথাকথিত দয়াশীল ব্যক্তি’টি কেনো খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে তার ভবিষ্যত স্বীকারোক্তি নিচ্ছে? দুষ্টু কফির গ্লাস টা শক্ত করে ধরে পূর্ণদৃষ্টিতে প্রচ্ছদের দিকে তাকালো। ওই নারীর তাকানো’ই যথেষ্ট প্রচ্ছদ’কে লণ্ডভণ্ড করে দিতে। দুষ্টু একদৃষ্টিতে কতক্ষণ মোহাবিষ্টের ন্যায় তাকিয়েই রইল। অতঃপর ঠোঁট দু’টো ঈষৎ ফাঁকা করে ফিসফিস করে বলল,
‘ওর জন্য আমার অন্তরে দহন হয় আর আপনার জন্য রক্তাক্ত। দুটোই আমার পক্ষে কষ্টদায়ক।’
প্রচ্ছদ দুষ্টুর চোখে আটকে দুষ্টুর ঠোঁটের কাছাকাছি এলো৷ গরম নিশ্বাস আঁচড়ে পরতেই দুষ্টু চোখ, মুখ আবেশে বন্ধ করে ফেলল,
‘দহন পানি দিয়ে নিভিয়ে দেওয়া যাবে। দহনে যেই ক্ষত হবে আমার স্পর্শে তাও আস্তে আস্তে সেরে যাবে। আর কিছু?’
দুষ্টু ধীরগতিতে চোখ খুললো,
‘ক্রমাগত রক্তাক্ত যে হচ্ছে? আর কিছুদিন পর তো আমার অন্তর’টা মরে যাবে।’
প্রচ্ছদও দুষ্টুর মতো ফিসফিস করে উত্তর করলো,
‘আমি আছি তো! তোমার জন্য আমার জীবন বাজি।’
চলবে❤️
আচ্ছা! এটা একটা মনস্তাত্ত্বিক টানাপোড়নের উপন্যাস। এই গল্প আপনার মন নিয়ে খেলা করবে। এই আপনার অমুক চরিত্রকে ভালো লাগবে আবার এই ভালো লাগবে না। এই মনে হবে আরে ওদের মাঝে তো সব ঠিক আবার এই মনে হবে ওদের মাঝে কিচ্ছু ঠিক নেই। এবং মোস্ট ইম্পোর্টেন্ড কথা হলো সব চরিত্রকে আপনার ভালো লাগবে না। বিশেষ করে দুষ্টু চরিত্র’টিকে। কারণ সে বোল্ড, স্ট্রং। ব্যস! এইটুকুই বলার ছিলো। হ্যাপি রিডিং ডিয়ার রিডার্স💚
আসসালামু আলাইকুম। আমার জন্য দোয়া করবেন এবং বেশি বেশি আমার লেখা নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা করবেন। ভালো-খারাপ তুলে ধরবেন।