এমন একদিন সেদিন পর্ব-৫৯ এবং শেষ পর্ব

0
2

#এমন_একদিন_সেদিন
#মুমুর্ষিরা_শাহরীন
পর্ব-৫৯ (শেষ)
১১৭.
দুষ্টু ছিলো চঞ্চলা বন খঞ্জন পাখির ন্যায়! মুক্ত আকাশে যার বিচরণ ঘটতো অহর্নিশ! ছটফটে! ডানপিটে! অধৈর্য্য! আর? আর দুঃসাহসী! আর? বেপরোয়া এক বেয়াদব মেয়ে! আরো আছে? হ্যাঁ, অবুঝ ছিলো সে! আর? আর….. আর একজন সুখি পাখি! এই চঞ্চলা, ব্যাকুল পাখি’টা এমন শান্ত-শিষ্ট আর বুঝদার হয়ে গেলো কি করে? হঠাৎ করে ডানা ঝাপটা’তে ভুলে গেলো। সোনার খাচায় নিজেকে বন্দী করলো! শেষমেশ অভিমানে, আক্রোশে ডানা জোড়া ছেটে’ই ফেললো। ডানার বদলে গায়ে মাখলো এক নতুন তকমা। প্রচ্ছদের অর্ধাঙ্গিনী! এ যেন আরেক নতুন আগুন ডানা। তারও ছাটা’র সময় এসে পরলো। সেই কাঙ্ক্ষিত সময়! তিনটে মাস চোখের পলক ফেলতে না ফেলতেই কেনো চলে গেলো? দুষ্টু ফাঁপরে পরলো। এদিক সেদিক তাকিয়ে, চোখ মুখ হাত দিয়ে ডলে, পানি ছিটিয়ে বুকের হাসফাঁস মেটাতে চাইলো। কিন্তু এতো সহজে কি তা মিটতে চায়? শেকড় যে গেঁথে গেছে অনেক দূর অবধি! যেখানে যাওয়ার পথ দুর্গম। প্রগাঢ়!

শীতের সকালে তখন বাজে ভোর সাড়ে ছয়’টা। সকাল দশটায় ওদের কোর্টে যেতে হবে! প্রচ্ছদ কাল রাতে বাড়ি ফিরেনি। গত পাঁচদিন দুষ্টুর সাথে কোনো রকম বাক্য বিনিময় করেনি। সে কি আর দুষ্টুকে আটকাতে চায় না? দুষ্টুর বুক’টায় কি যেনো একটা কামড়ে ধরলো৷ হাড়কাঁপানো শীতের মাঝেও কেবলমাত্র প্রস্ফুটিত ভোরে সে ঠান্ডা পানিতে গোসল করলো। তবুও শরীরের জ্বালা মিটলো না। অসহ্য জ্বালা! হাজার মগ, বালতি পানি দিয়েও যে জ্বালা মেটানো সম্ভব না। আদতে তো এ জ্বালা অন্তরের। বুঝদার দুষ্টু তা বুঝেও বুঝতে চায় না। গোসল শেষে বেরিয়ে জানালা ঘেঁষা সাইট টেবিল’টার উপর এক কাপ ধোঁয়া উঠানো কফির মগ দেখতে পেলো। ভ্রু কুঁচকে খানিকক্ষণ চেয়ে থেকে হাত বাড়াতেই দেখলো মগের নিচে একখানা চিরকুট,

‘স্তব্ধ রাতের নিঝুম বৃষ্টি’তে সাগরপাড়ে সবুজ ঝর্ণা দেখার এক যুগ ইচ্ছে ছিলো। ইচ্ছেগুলো অতৃপ্ততায় মরে গেলো। অথচ তুমি তা একবার চেয়ে দেখলে না! খোঁজ করলে না! আমায় একটু খানি সুখের স্পর্শ দিয়ে পুরোদস্তুর দুঃখী করে চলে গেলে।’

অভিযোগের চিরকুট’খানা পড়তেই অম্বু’তে তপ্ত হলো ঈষৎ লাল চোখ দু’টি। দুষ্টু খুব সন্তর্পণে কাগজের এলোমেলো, অসুন্দর লেখার উপর ঠোঁট ছুয়ালো! প্রচ্ছদের চিঠি! কখন এলো সে? দুষ্টুর গোসলে যাওয়ার সুযোগ লুফে নিয়েছে? কেনো? সে কি দুষ্টুর মোকাবেলা করতে ভয় পাচ্ছে? ভেতর থেকে তক্ষুণি কে যেন প্রচ্ছদের ন্যায় স্বরে হুশিয়ারি দিয়ে উঠলো,

‘আমি চোখে চোখ রাখলে তোমার যাওয়ার ইচ্ছে’টা ডিকলাইন করতে হবে, দুষ্টু। আমি তোমার ইচ্ছে গুলোকে প্রাধান্য দিচ্ছি। প্রজাপতি জোরে চেপে ধরলে মরে যায়। তুমি আমার জীবনের খুব সুন্দর একটি প্রজাপতি। আমি তোমাকে জোরে চেপে ধরতে চাই না। আকড়ে ধরতে চাই।’

কেনো? কেনো জোরে চেপে ধরতে চায় না? একবার দুষ্টুর অমতে জোর করে বিয়ে করবে আরেকবার দুষ্টুর মত প্রাধান্য দিয়ে তাকে ছেড়েও দিবে। সব বুঝি ওই লোকের মন মর্জি মতো চলবে? দুষ্টু আচম্বিত একটা কলম তুলে নিলো হাতে। চিরকুটের অপরপাশে লিখলো,

‘যার চিত্তে আমার সম্পদ,
তার প্রণয় উপন্যাসে আমার প্রিয় প্রচ্ছদ।’

‘প্রিয়? প্রচ্ছদ তোর প্রিয়? প্রিয় হলে তাদের ছেড়ে চলে যেতে হয়?’ দুষ্টু মাথা নাড়িয়ে অবাধ্য, দুশমন মন’কে উত্তর করলো,

‘উহুম! প্রিয়দের ভালো রাখতে ছেড়ে দিতে হয়।’

উত্তরটা দিয়েই দুষ্টু কাগজটা দুমড়ে মুচড়ে জানালা দিয়ে ফেলে দিলো। সেসময় নিচে দাঁড়িয়ে তার প্রিয় সুদর্শন পুরুষ’টি বেখেয়ালি তাকে দেখে যাচ্ছিলো। কাগজ’টা পরতেই সে লুফে নিলো!

,

প্রচ্ছদ দুষ্টুকে কোর্টে নিয়ে গেলো না। তার দেখা দুষ্টু তখনো পায়নি। সে কোর্টে গেলো শ্রেয়সী, প্রযুক্তর সাথে। কোর্টে ঢুকতেই দুষ্টু অপ্রকৃতস্থের ন্যায় এদিক সেদিক তাকিয়ে প্রযুক্তকে জিজ্ঞেস করলো,

‘উনি কোথায়?’

প্রযুক্ত গুরুগম্ভীর স্বরে উত্তর দিলো,

‘আছে আশেপাশেই। তুমি সাইন করো। এরপর ও এসে সাইন করে তিন শব্দ বলে দিবে।’

দুষ্টুর আত্মা ধক করে উঠলো। তিন শব্দ মানে? তালাক? ভরাট চোখে কাগজ হাতে নিয়ে দেখলো সব আবছা! কোথায় সাইন করবে ও? দুষ্টু কলম ধরলো। তার মনে হলো এক ভয়ংকর দানব ধরলো সে! দুষ্টু-প্রচ্ছদের সম্পর্ক ভাঙার দানব। সাইন করতে গেলেই ঝাপসা চোখ দুটো থেকে টপটপ করে পানি পরলো কাগজের উপর। যার উপরে বড় বড় করে স্পষ্ট অক্ষরে লেখা ‘Divorce Paper.’ দুষ্টু সহসা থেমে গেলো। উদ্ভ্রান্তের সদৃশ এদিক সেদিক তাকিয়ে প্রচ্ছদ’কে ডাকলো। ডাকতে ডাকতে উকিলের চেম্বার ছেড়ে বেরিয়ে এলো। লম্বা করিডোরের শেষ সীমান্তেও প্রচ্ছদের হদিশ মিললো না। পুরো কোর্ট পাড়ায় খুঁজলো! তালাস করতে করতে একসময় দেখলো অদূরে পুরোনো বট গাছের সাথে সে হেলে দাঁড়িয়ে আছে। দুষ্টু এলোমেলো পায়ে দৌড়ে সেদিকে গেলো। জুতোজোড়া খুলে পরলো এদিক সেদিক!

প্রচ্ছদ ভূতগ্রস্তের ন্যায় তাকিয়ে থাকলো দৌড়ে সামনে এসে দাঁড়ানো দুষ্টুর দিকে। পিলে চমকে উঠলো ও। মিনিট কতক্ষণ পর শক্ত করে ওর বাহু চেপে ধরলো। দুষ্টু হাপ ধরা গলায় রুদ্ধশ্বাসে থেমে থেমে বলে,

‘সেদিন আমাকে জড়িয়ে ধরতে চেয়েছিলেন না? আজ ধরবেন?’

প্রচ্ছদের শ্বাস গলায় আটকে গেলো। এক দৃষ্টিতে চেয়ে বলে উঠলো,

‘ধরলে কিন্তু আর ছাড়বো না।’

‘ছাড়লে আপনার খবর হয়ে যাবে না?’

প্রচ্ছদ হেসে দিলো। কেমন ছন্নছাড়া, স্বপ্নময়, তৃপ্ত সেই হাসি! পরিপূর্ণতা আর পরিতুষ্টির! যে হাসি দেখলেও মন ভরে উঠে! স্নিগ্ধতায় ছেয়ে যায় বুক। প্রচ্ছদ দুষ্টুকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো। যতো’টা শক্ত করে ধরলে নিজ অন্তরিন্দ্রিয়’র অন্তরীক্ষে লুকিয়ে ফেলা যায়। প্রশান্তিতে সে ফিসফিস করে বলল,

‘বলেছিলাম না শেষ পর্যন্ত আপনার আমাকে ডিভোর্স দেওয়া হয়ে উঠবে না।’

দুষ্টু প্রচ্ছদের বুকে মুখ ডুবালো। প্রচ্ছদ অক্টোপাসের ন্যায় আরো আষ্ঠেপৃষ্ঠে পেঁচিয়ে ধরলো। কত অপেক্ষার পর যে এ প্রাপ্তি’টুকু তা কেবল প্রচ্ছদ জানে! দশ বছর!

দুষ্টুও প্রচ্ছদের মতোন ফিসফিস করে জবাব দেয়,

‘চোরা বালিতে আটকা পরেছি যে! যতই হাত-পা ছুঁড়ছি আরো অতলে হারিয়ে যাচ্ছি।’

প্রচ্ছদ অনুমতি নেওয়া তো দূর এদিক সেদিক তাকালো না পর্যন্ত। দুষ্টুর সেই সুন্দর মুখ’টা আলতো হাতে ধরে…. ওই তিরতির করে কাঁপতে থাকা… ধরণীর বুকে প্রচ্ছদের জন্য দুষ্কর এক শুভ্রজবার ঠোঁট শুষে নিলো। দুষ্টু অতর্কিতে চমকে উঠলো। বিদ্যুৎ এর ঝলকে যেন সারা দেহ ঝলসে গেলো। খামচে ধরলো প্রচ্ছদের বুকের গেঞ্জি’টুকু, মাথার পেছনের চুলগুলো। এবার যেনো সত্যি-ই ডুবে গেলো সর্বগ্রাসী চোরা বালির গহীনে। সুখ মরণের পথে! মিনিট তিনেক বাদে দুষ্টু মৃদু ধাক্কা দিলো প্রচ্ছদের বুকে। প্রচ্ছদ নরম হয়ে সরলো। দুষ্টু চোখ পাকিয়ে তাকালো। ঠোঁট জ্বলছে! এই শীতের মৌসুমে প্রচ্ছদের ওই অপ্রস্তুত দানবীয় থাবায় অল্পতেই ঠোঁট কেটে লাল হয়ে উঠলো। প্রচ্ছদ মাথা চুলকে লজ্জায় হাসলো। এগিয়ে বুড়ো আঙ্গুল দিয়ে দুষ্টুর ঠোঁট মুছে দিয়ে বলল,

‘মাফ করবেন মহারানী! এই অদম আপনার ঠোঁট পর্যন্ত স্পর্শ ফেলেছে। এবার কি ঠোঁট দু’টো কাটার বন্দোবস্ত করবো?’

দুষ্টু চোখ দিয়েই প্রচ্ছদকে মেরে ফেলতে চাইলো। আদতে, উপরের ঠাঁট বজায় রেখে নিজের লজ্জা ঢাকতে চাইলো।

‘আমরা কিন্তু দেখে ফেলেছি।’

কথা’টা বলে প্রযুক্ত পান পাতার মতো লজ্জায় দু’হাত চোখের উপর রাখলো আবার সরালো বারকয়েক! যেন সে নতুন বউ! শ্রেয়সী দাঁত বের করে হাসলো। দুষ্টু লজ্জায় চিবুক বুকের সাথে মিশিয়ে নিলো। প্রচ্ছদ ভ্রু কুঁচকে বলল,

‘তো? আরো দেখবি?’

বলেই দুষ্টুর দিকে তাকালো। এরপর হতাশায় জর্জরিত কন্ঠে বলল,

‘থাক! আমার বউ’টা লজ্জা পাচ্ছে।’

দুষ্টুর কান দিয়ে ধোঁয়া বের হলো। দৌড়ে গাড়িতে গিয়ে বসলো। প্রচ্ছদ সেদিকে তাকিয়ে মোহিত হয়ে হাসলো। এই মেয়েটা তার! আজ থেকে…. হয়তো পরবর্তী ষাট বছরের জন্য একান্তই তার! কিংবা তারও বেশি বা তারও কম। প্রচ্ছদের দুষ্টু! আকাশের দিকে মুখ তুলে, মাটিতে পায়ের আলোড়ন ফেলে প্রচ্ছদ দুষ্টুর দিকে দৌড়ে গেলো বলতে বলতে,

‘মহারানী দুষ্টু, আরেকবার আমার তৃষ্ণার্ত বক্ষে আপনার মূল্যবান মস্তিষ্ক’টি রাখা যাবে?’

দুষ্টু গাড়ি থেকে মাথা বের করে চেঁচিয়ে বললো,

‘ওহে, অধম। মহারানী দুষ্টু, কোনো নির্লজ্জ ব্যক্তির বক্ষে দ্বিতীয়বার মস্তক রাখার মতো ভুল কাজ করবে না।’

প্রচ্ছদ পেছন দিকে চুল এলিয়ে দিয়ে সুন্দর করে হাসলো। তখন তাকে ভারী নিষ্পাপ, বিশুদ্ধ এবং আকর্ষণীয় দেখালো। সে দুষ্টুর সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। ঠোঁটের কাছে ঠোঁট এগিয়ে নিয়ে মৃদুস্বরে ধীর গলায় আওড়ালো,

‘কিছু ভুলের কোনো ন্যক্কার নেই। আমি আরেকবার ভুল করতে চাই। এই মুহূর্তেই আরেকবার তোমার ঠোঁটে ঠোঁট রাখতে চাই। আরেকবার তোমাকে শক্ত করে ঝাপটে ধরতে..

প্রচ্ছদের কথা শেষ হলো না। দুষ্টু ওর কলার চেপে গাড়ির জানালা দিয়ে প্রচ্ছদের মাথাটা ভেতরের দিকে আনলো। পরপর শুষ্ক দুটো চুমু দিয়ে বললো,

‘মহারানী কি এই অতি আকর্ষণীয় মানবকে খুশি করতে পারলো?’

তৎক্ষণাৎ প্রচ্ছদ কয়েক সেকেন্ডের জন্য দুষ্টুর ঠোঁট আঁকড়ে ধরলো। দুষ্টু হতভম্ব হয়ে হাল ছেড়ে দিয়ে প্রচ্ছদকে সরিয়ে দিতেই প্রচ্ছদ হেসে উঠলো। বলল,

‘এবার একটু পারলো বোধহয়।’
‘নির্লজ্জ।’
‘তুমি তো প্রথমে টানলে।’
‘বেহায়া।’
‘কি করবো? কন্ট্রোল থাকলো না তো!’
‘অশ্লীল।’
‘তোমার জন্য বারবার হতে চাই।’
‘যান, চোখের সামনে থেকে।’
‘না, জান। স্বামীর সাথে এভাবে কথা বলে না।’

দুষ্টু ভ্রু কুচকে ঠোঁট বাকিয়ে তাকালো। প্রচ্ছদ ওর গাল ধরে মুখটা আকাশের দিকে তুলে দিয়ে বললো,

‘একটা কবিতা শুনাই। আমার সাথে আকাশে দিকে তাকাও আর মন দিয়ে শুনো।’

“এমন একদিন সেদিন,
বাসনার ফুলঝুরি খুলেছিলাম যেদিন।

সে বলেছিলো, চল পাল্টাই,
চল হারিয়ে যাই,
দিকদিগন্ত ছুটে বেড়াই,
সুতো কাঁটা ঘুড়ি হয়ে যাই,
আষাঢ় ফাল্গুনে জ্যোৎস্না ছড়াই,
চাঁদের পিঠে বদ্ধ তালা ঘরে নেচে বেড়াই,
ইচ্ছেদের ডানায় প্রাণভোমরা এঁকে দিতে চাই।

সাগর পাড়ে সবুজ ঝর্ণা দেখার ইচ্ছে ছিলো পরশুদিন,
সেসব প্রার্থনা পুষিয়ে রেখেছিলাম দু’দিন,
তোমায় এসব বলেছিলাম যেদিন,
এমন একদিন ছিলো সেদিন।”

সমাপ্ত❤️

উফফ… টাটা বাই বাই দুষ্টু-প্রচ্ছদ।