অন্তহীন সন্ধ্যা পর্ব-০২

0
12
অন্তহীন_সন্ধ্যা #সূচনা_পর্ব #মাকামে_মারিয়া

#অন্তহীন_সন্ধ্যা
#পর্ব ০২
#মাকামে_মারিয়া

সময় এখন বেলা বারোটা উনিশ। সূর্যের তাপ ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে মুক্ত দানার মতো চকচকে। ইতিমধ্যেই পশুপাখি সহ সমস্ত মানুষের আনাগোনা আর দৈনন্দিন নিত্যপ্রয়োজনীয় কাজকর্ম শুরু হয়ে গিয়েছে। পাখিরা আহারের খুঁজে উড়ছে, ঘরের বউঝিরা নিজেদের কাজে ব্যস্ত, কোথাও কেউ থেমে নেই।

কিন্তু ফারিন তখনও কাঁথা মুড়িয়ে ঘুমাচ্ছে। রাতভর সোশ্যাল মিডিয়ায় আড্ডায় মেতে থেকে ভোররাতে ঘুমাতে যায় সে। বিয়ের প্রথম রাতেই যখন রাফসান ফারিনের এমন কান্ড দেখেছিলো ভেবেছে পুরনো অভ্যাস ধীরে ধীরে ঠিক হয়ে যাবে কিন্তু না রাফসানকে হতাশ করে দিয়ে ফারিন আরো বেশি বিগড়ে গেলো যেন। তাকে ভালো মন্দ কোনো কিছুই বলা যেতো না, বললেই তেড়ে উঠতো। এরপর থেকে রাফসান আর ফারিনের সাথে কথা এগোয় না। যতটা সম্ভব ফারিনকে তার মতো চলতে দেয়, এতে ফারিনও খুশি। সে চায় নিজের মতো করে চলতে।

বেলা করে ঘুম থেকে উঠে পেটে কিছু দিয়েই ফের মোবাইল নিয়ে বসবে, ইচ্ছে মতো আড্ডা ফাড্ডা দিয়ে গোসল সেরে আবারও একই কাহিনি। মাঝে মাঝেই বন্ধু বান্ধবের সাথে হুটহাট বের হয়ে যায়, কারো থেকে কোনো প্রকার অনুমতি নেওয়ার প্রয়োজন মনে করে না। প্রথম প্রথম বাড়ির লোক এসব দেখে কথা শুনাতো কিন্তু কার কথা কে শুনে? ফারিন এসব কানেও নিতো না। তার আচরণ এমন যে আমি যেমন এমনই থাকবো, তোমাদের ঘাড়ে বসে খাবো বিরক্ত হয়ে একদিন তোমরাই আমাকে বিদায় দিবে।
সে যে এ বাড়ির বউ এটা বুঝার উপায় নেই। নিজ ইচ্ছে মতো সে তার কাজকর্ম চালিয়ে যায়। তার উপর কারো নোটিশ করা চলে না।

____________

গায়ে মেরুন রঙের শাড়ি, কপাল অব্দি ঘোমটা দেওয়া, চুল হাত খোঁপা করা, চোখে মুখে অস্বস্তি কিন্তু হাসার চেষ্টা করা মেয়েটাই জুহাইরা। নতুন শশুর বাড়িতে আসার পর থেকে তাকে শুধু অন্যের মুখের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে চলতে হচ্ছে। সব পরিস্থিতিতে কেবল অন্যের মুখের দিকে তাকায়, এই বুঝি কেউ চোখের ইশারায় বুঝালো এটা করো, ওটা করো। বসতে দেও, সালাম দেও, হাসো।

ক্লান্ত শরীর নিয়ে একটু যে শুয়ে বসে থাকবে সেটার সুযোগ নেই। এই একজন আসে তো একটু পর আরেকজন আসে বউ দেখতে। সবাইকে হাসিমুখে সালাম কালাম করতে হয়।

সেই ভোর সকালে রাফসান ঘুম থেকে উঠে কাজে বেড়িয়েছিল। জুহাইরা ঘুম থেকে উঠে তার চেহারা দেখে নাই। বড় ভাবির থেকে জানতে পেরেছে সে তার কাজে চলে গিয়েছে। জুহাইরার মন একটু ভারি হলো। কি এমন কাজ তার যে এতো তাড়া! একবার বলেও যেতে পারতো না কি!

অভিমানের রেশ কাটতে না কাটতেই রাফসান দুপুর তিনটের দিকে বাসায় এসে উপস্থিত হলো। হাতে ব্যাগপত্র, মুখাবয়ে ক্লান্তি। মানুষটার ক্লান্ত মুখ দেখে জুহাইরার নরম মনে জমে থাকা অভিমান গুলো ডানা জাপ্টিয়ে উড়ে গেলো।মাথার কাপড় টেনে ঘোমটাটা আরো বড় করলো। নতজানু হয়ে জগ থেকে এক গ্লাস পানি এনে রাফসানের সামনে ধরলো। হাতের দিকে খেয়াল করে দেখলো মৃদু কাঁপছে। ইশ হাত কেনো কাঁপছে! খুব করে চাইলো মৃদু কাঁপুনি টা যেন বন্ধ হয়ে যায়। লোকটা কি না কি ভেবে নিবে দেখে ফেললে!

রাফসান গায়ের শার্টের বোতাম খুলতে খুলতে জুহাইরার দেওয়া গ্লাসটা হাতে নিয়ে নিঃশব্দে তিন চুমুকে পানি শেষ করে গ্লাসটা জুহাইরার হাতেই দিলো। রাফসান হাতের কাঁপুনি খেয়াল করেনি ভেবেই একটু স্বস্তি নিয়ে জুহাইরা যেই উল্টো হাঁটতে শুরু করবে ওমনি রাফসান দায়সারা ভাবে বলে উঠলো ” এতো কাঁপা কাঁপি কিসের জন্য? আমাকে দেখতে কি বাঘ লাগে নাকি সিংহ??

” দেখতে তো লাগে গরুর মতো! আস্ত মহিশ!

জুহাইরা মনে মনে দাঁত কামড়ে কথাটা ভাবলেও সম্মুখে এই কথা বলার সাহস তার হলো না। অবশ্য এটা সাহসের মধ্যেও পড়ে না। এমনটা বলতে গেলে তো বেয়াদবি হয়ে যায়। যতই হোক স্বামী তো। কিন্তু তার কাঁপুনি টা স্বাভাবিকই। কখনো কোনো পুরুষের সান্নিধ্যে না যাওয়া নারীর জন্য তো অবশ্যই একটু কঠিন সময় এটা। জুহাইরাও যথেষ্ট ভদ্র মেয়ে, বিয়ের আগে কখনো কারো সান্নিধ্যে যায়নি সে। প্রথম পুরুষের সাথে একটু আকটু লজ্জা থাকবে এটা তো স্বাভাবিকই। লজ্জাই নারীর সৌন্দর্য।

খাওয়া দাওয়া হয়েছে?

রাফসানের প্রশ্নে জুহাইরা একটু নড়েচড়ে বসলো। গলা পরিষ্কার করে মিনমিনে কন্ঠে বললো ” আম্মা তো বললো এই বাড়ির নিয়ম স্বামী ছাড়া স্ত্রীরা খেতে পারে না। স্বামী আসলে এক সাথে খেতে হয়।

রাফসান উচ্চ স্বরে হাসতে লাগলো। এতো হাসি মনে হয় রাফসান বহুদিন পর হাসছে। জুহাইরা বোকা বনে গেলো। কি এমন বললাম যে এ ভাবে কেবলার মতো হাসতে হবে?? নিয়ম টাই তো বললাম! সব পুরুষলোক যেহেতু বাড়িতে থেকে কাজ করে তা-ই তো স্ত্রীদের উপর দায়িত্ব পড়েছে স্বামীসহ খেতে। এই নিয়ম অবশ্য শ্যামলা বানুর করা নিয়ম।

হাসছেন যে? হাসির কথা বলছি?

ভাগ্যিস হাসালে! জানো তো বহুদিন পর মন থেকে হাসি হাসলো। ধন্যবাদ তোমাকে!

জুহাইরার চোখে মুখে প্রশ্নের আভার ছায়া। বোকা বোকা চাহনি। মুখের দিকে তাকালেই মায়া ধরে যায়। রাফসান একমুহূর্ত সেই মায়াময় চেহারার দিকে তাকিয়েই ফেঁসে গেলো। তাই হাসি বন্ধ করে একটু গম্ভীর হওয়ার চেষ্টা করে বললো ” নিশ্চয়ই দাদী এই নিয়মটা তোমাকে বলছে! ব্যাপার না দাদী আরো অনেক নিয়ম বলবে, সবাইকেই বলে কিন্তু কেউই মানে না।

জুহাইরা বুঝলো এই তাহলে হাসির কারন। যাকগে সবাই মানে না বলে যে সেও মানবে না ব্যাপারটা একদমই তা নয়। জুহাইরা মনে মনে পণ করলো সে সর্ব্বোচ্চ চেষ্টা করবে নিয়মকানুন কিছু মানতে। যতই হোক গুরুজনের দেওয়া নিয়ম।

জুহাইরা নতুন বউ তাই কোহিনূর বেগম ছেলে আর বউকে খাবার বেড়ে দিলো। সাথে যারা এখনো খাওয়ার বাকি ছিল তারাও বসলো খেতে। জুহাইরা অবশ্য হাতে হাতে সাহায্য করার চেষ্টা করেছিলো কিন্তু কোহিনূর বেগম একেবারে নাকচ করে জানিয়ে দিলো পরের নাইয়রে আসলে তখন থেকে কাজের উপরেই থাকতে হবে। তাই এবার একটু শুয়ে বসে খাও!

শাশুড়ী কথাটা কোন ভঙ্গিতে বলছে সেটা বুঝার জন্য জুহাইরা তার মুখ পানে তাকিয়ে রইলো। কিন্তু কিছু বুঝে উঠতে পারলো না। কারণ এই মহিলা এমন এক ব্যক্তি যে কি না সুখে দুঃখে সব সময় মুখের একই ভাবভঙ্গি নিয়ে চলে। তাই তাকে বুঝা একটু কঠিনই হবে বলে নোট করে নিলো জুহাইরা।

সন্ধ্যার অন্ধকার এতোক্ষণে ছড়িয়ে ছিটিয়ে গিয়েছে। মাগরিবের আজান পড়েছে প্রায় আধাঘন্টা হবে। রাফসান সহ বাড়িতে যে-ই পুরুষ লোক গুলো ছিল সবাই মসজিদে গিয়েছে নামাজ পড়তে। কোহিনূর বেগম, শ্যামলা বানু, বাড়ির বাকি সদস্যরা যার যার রুমে অবস্থান করছে। কেউ নামাজ পড়ছে তো কেউ ফাঁকি দিচ্ছে। তবে নিয়ম হলো মাগরিবের সময় সহ সকল নামাজের ওয়াক্তের সময় সবাই যার যার ঘরে অবস্থান করবে। কে নামাজ পড়লো, আর কে পড়লো না সেটা কোনো ব্যক্তির কাছে জবাবদিহি করতে হবে না তবে ঘরে অবস্থান করতেই হবে।

জুহাইরাও রুমে বসে আছে। কেবল নামাজ শেষ করে উঠে বসলো। দক্ষিণের জানালা দিয়ে মৃদু ঠান্ডা বাতাস আসছে। সে রুমে একা, জানালা দিয়ে বাহিরে তাকালেই কেমন কুটকুটে অন্ধকার। একটু ভয়ও লাগে কি না। বড় বাড়িটার দক্ষিণে সব বাগান, এদিকে অন্য কোনো ঘর নেই তাই জায়গা টা একটু নিস্তব্ধ আর এই কারনেই ভয় লাগে।

জুহাইরা একধ্যানে বাহিরে তাকিয়ে থেকে যেই পিছন ফিরলো ওমনি শক্ত পোক্ত কোনো কিছুর সাথে ধাক্কা খেয়ে প্রচন্ড ভয় পেলো। এতোক্ষণ বাহিরের অন্ধকার মনে ভয় বাঁধলেও এখন মনে হলো ভূত-টূত মনে হয় ঘরেরই চলে আসলো আর সে ভূতের সাথেই ধাক্কা খেলো। ভয়ে চোখ বন্ধ করে নিয়ে রাফসানের পাঞ্জাবি খামচে ধরলো৷

আমাকে ভূত মনে হয়?

রাফসানের কন্ঠ শুনে জুহাইরা মাথা উঠিয়ে দেখলো রাফসান সামনে দাঁড়িয়ে। পড়নে পাঞ্জাবি, মাথায় টুপি। মাত্রই নামাজ শেষ করে এসেছে। কি স্নিগ্ধ লাগছে মানুষ টাকে অথচ আমি কি না ভূত ভেবে ভয় পেলাম ছিহ!!

এগুলো ভেবেই জুহাইরা লজ্জা পেলো সাথে অস্বস্তি তো আছেই। মনে মনে এটাও ভাবলো যে আপনাকে অনেক কিছুই মনে হয় রাফসান সাহেব! আপনাকে একেক সময় একেক মানব লাগে।কখনো ভূত-পেত্ন আবার কখনো মহামান্য রাজামশাই। আবার কখনো সিপাহি, কখনো বা ডাকত দলের নেতা।

সব সময়ের মতো মনে মনে কথা বলেই থেমে গেলো মেয়েটা। রাফসানের মুখোমুখি এখনো সে ভাবে কথা বলা হয়নি হয়েতো এখনো সহজ হতে পারেনি।

নামাজ শেষে সবাইকে ড্রয়িং এ জড়োসড়ো হয়ে বসতে হবে। তারপর হালকা নাস্তা করতে হবে। এরপর যার যার রাতের কাজে মনোনিবেশ করবে এমনটাই নিয়ম। তবে নিয়ম সবার জন্য হলেও ফারিন কখনো এই নিয়ম মানে নাই। সে আজ অব্দি কখনো সবার সাথে দুই মিনিট বসে কথাও বলেনি। সে সব নিয়মের উর্ধ্বে।

রাফসান জুহাইরাকে নিয়ে ড্রয়িং এ আসলো। ইতিমধ্যেই সবাই চলে এসেছে। সবার সামনে চা, কেউ বা চায়ের কাপে চুমুক দিচ্ছে। ওরা বুঝলো তাদের আসতে দেরি হয়েছে। জুহাইরা একটু এগিয়ে গিয়ে শাশুড়ী মাকে কিছু বলবে ভাবতেই শ্যামলা বানু বলে উঠলো ” শুনো বউ! এখনো তো নিয়মকানুন কিছুই আয়ত্তে আনতে পারো নাই, তয় তাড়াতাড়ি শিক্ষা নিও! বড় ছেমরি তো এসবের দ্বার ধারে না-ই এই জন্যেই তো নাতিরে আরো একবার বিয়া করাইতে হইলো! না হয় কি আর ওই দিনমজুরের বাড়িত যায় আমাগো বাড়ির পোলা বিয়া করতে!

” আহা আম্মা! নতুন তো মেয়েটা। ধীরে ধীরে বুঝে যাবে।

কোহিনূর বেগম এতোটুকু বলেই থেমে গেলেন এরপর নিজের কাজে মন দিলেন যেন আর কোনো কিছুই হয়নি। অথচ জুহাইরার বুকের মধ্যে ব্যাথারা টিপটিপ করছে। তার বাবাকে কি না শেষ মেষ দিনমজুর বলে গালি দিলো। এ ভাবে কটুকথা শুনতে হবে তাকে! জুহাইরার কান্না পেলো। হঠাৎই খেয়াল করলো একটা শীতল স্পর্শ তার হাতের উপর পড়লো। চোখ নাড়িয়ে দেখলো রাফসান ভরসার হাত রেখেছে মেয়েটার হাতে। প্রথম স্পর্শ! প্রথম স্পর্শ যদি হয় এতো স্নিগ্ধ আর ভরসার তাহলে আর কি বা লাগে? জুহাইরার হৃদয়ও শীতল হয়ে আসলো কিছুটা। চোখের কোণের জমাট বাঁধা পানিটা লুকিয়ে নিলো। মুখে হাসি টেনে সবার দিকে তাকানোর চেষ্টা করলো, বুঝাতে চাইলো আমি ভালো আছি, আমার ব্যাথা লাগেনি, আমরা ব্যাথা পাই না। আমরা মেয়ে আমাদের সব সহ্য করতে হয়। কষ্ট লুকিয়ে হাসতে হয়।

চলবে………………