#অন্তহীন_সন্ধ্যা
#পর্ব ০৪
#মাকামে_মারিয়া
কই বললেন না তো ফারিন আপুর সাথে আপনার সমস্যা টা কি?
রাতের আধারে উঠোনে পাটি বিছিয়ে বসে আছে রাফসান আর জুহাইরা। জুহাইরার প্রশ্নে দূর আকাশে তাকিয়ে থাকা রাফসান এবার চোখ ঘুরিয়ে মেয়েটার দিকে তাকালো। বড্ড মায়াবতী লাগছে। চাঁদের আলোয় কেমন মোহনীয় লাগছে চেহারাটা। রাফসান একবার তাকিয়েই চোখ ফিরিয়ে নিলো। স্মিথ হেঁসে আবারও আকাশের দিকে তাকিয়ে ছোট্ট নিশ্বাস ফেলে বললো ” আপাতত সমস্যা সে ডিভোর্স চায়, আর ডিভোর্স দিতে হবে এটাই।
” ডিভোর্স কেন চায় তার পিছনে কারণ রয়েছে, আর সে চাইলে আপনি ডিভোর্স কেন দিচ্ছেন না সেটারও কারণ আছে।
জুহাইরার সহজ সরল প্রশ্ন। রাফসানও সহজ ভাবেই বললো ” হ্যাঁ কারণ তো আছেই।
” হুম তো কারণ টা বলেন?
” দশ লক্ষ্য টাকা লাগবে। আছে তোমার কাছে খুচরো?
রাফসান সিরিয়াস কথাতেও খোঁচা মারলো কিছুটা। জুহাইরা বোকা চাহনিতে জানতে চাইলো দশ লক্ষ টাকা কিন্তু কেনো?
” বিয়ের সময় কাবিনের টাকা দশ লক্ষ ধরা হয়েছিল। যদিও বিয়ের প্রথম রাতেই মোহরনার টাকা স্ত্রীর হাতে তুলে দিয়ে স্ত্রীর কাছে যেতে হয়। কিন্তু আমি তো স্ত্রীর কাছে যাওয়ারই সুযোগ পেলাম না। হুহ্! অবশ্য যাওয়ার সুযোগ পেলেও ওতো টাকা আমি দিতে পারতাম না। আব্বা হয়তো চালিয়ে দিতো। এখন তাকে ডিভোর্স দিলে দশ লক্ষ টাকা সহ দিতে হবে। তা না হলে সে স্ত্রীর ভূমিকাও পালন করবে না আর বাড়ি থেকে বেরও হবে না। আসলে এটা ওদের এক ধরনের চাল, তুমি এসব বুঝবে না। তোমার ঢিলা মাথায় এসব ঢুকবে না।
জুহাইরা চুপ করে রইলো। কি বলবে? এরপর ঠিক কোনটা জানতে চাইলে বিষয়টা ক্লিয়ার হবে?
রাফসান হাতে দুটো বাদাম নিয়ে ফু দিয়ে জুহাইরার সামনে দিয়ে বললো ” কি প্রশ্ন করবে সেটাই ভাবছো তাই তো?
জুহাইরা চোর ধরা পড়ে যাওয়ার মতো মুখটা ছোট্ট করে জানতে চাইলো ” আপনি কি ভাবে বুঝলেন?
” তোমার চোখের দিকে তাকালেই বুঝতে পারি বোকা মনটা তে কি চলছে!
রাফসান একধ্যনে জুহাইরার চোখের দিকে তাকিয়ে কথাটা বললো। এদিকে বিরাট লজ্জা পেলো জুহাইরা। এমন ছোট ছোট কথায় এতো লজ্জা সে তো জানা ছিল না। মেয়েটা লজ্জা পেয়ে হাত পা আরেকটু গুটিয়ে বসলো। ডান হাতের সাহায্যে ওড়না টা টেনে মাথার ঘোমটা বড় করলো। কিন্তু সেটা স্থায়ী হলো না। রাফসান পরম যত্নে মেয়েটার মাথা থেকে ওড়না টা সরিয়ে দিলো। হাত খোপাঁটাও খুলে দিলো এক নিমিষেই। জুহাইরা আরো বেশি লজ্জা পেতে লাগলো। লজ্জায় শ্যামবর্ণ মুখটা ধূসর হতে লাগলো। বাহিরের মৃদু বাতাসে জুহাইরার কপালে থাকা চুলগুলো উড়তে লাগলো। ঠোঁটে আটকে রাখা লজ্জামাখা হাসি। রাফসান তাকিয়ে না থেকে পারলো না। মৃদু স্বরে জুহাইরাকে ডেকে বললো ” তোমার লজ্জা আমার সবচেয়ে বেশি পছন্দের জুহা “।
জুহাইরা বহু কষ্টে রাফসানের দিকে মুখ করতেই দেখলো সে অন্য দিকে তাকিয়ে আছে। একটু স্বাভাবিক হয়ে জুহাইরা কিছুটা শাসানোর ভঙ্গিতে বললো ” এটা কি আপনাদের বড়লোকি ছাঁদ পেয়েছেন যে এ ভাবে চুল টুল ছেড়ে মাঝ উঠোনে বসে থাকবো? এটা গ্রাম মশাই, এ ভাবে চুল ছেড়ে রাতবিরেতে বসে থাকলে জ্বীন-ভূতে ধরবে এসে।
” বললেই হলো? কে কাকে ধরবে দেখো নিবো। আমি থাকতে আমার বউকে অন্য কেউ ধরবে!
জুহাইরা আবারও হাসলো। এবার আর কথা বাড়ালো না। খুলা চুল রেখেই ওড়না টেনে ঘোমটা দিয়ে বললো ” আচ্ছা একটা কথা বলি কিছু মনে করবেন না তো?
” কিছু মনে করার মতো কথা বলবা আর আমি কিছু মনে করতে পারবো না? এটা তো অন্যায়!
জুহাইরা নাক ফুলালো। অন্য দিকে তাকিয়ে আওড়ালো ” থাক! বলবো না তবে।
” আরেহহ মেয়ে বলো!
” বলবো?
” সিউর!
” আসলে আমি যতটুকু জানি আপনারা তো উচ্চ-মধ্যবিত্ত। দশ লক্ষ টাকা শোধ করে দেওয়া টা কি খুব কঠিন? না মানে ফারিন আপুর কথায় বুঝলাম যে আপনারা মোহরানা পরিশোধ করে দিলেই উনি চলে যাবে।
রাফসান চুপ করে রইলো। আকাশের দিকে তাকিয়ে রইলো কিছুটা সময়। মাথাটা ধরেছে মনে হচ্ছে। মুখ দিয়ে কোনো শব্দ বের করতে ইচ্ছে করছে না। হুট করে মনটা কেমন বিষাদে ছেয়ে গেলো। আশেপাশের সব কিছু বিরক্ত লাগছে। তখনই জুহাইরার দিকে তাকিয়ে মনে হলো না এখন এমন বিরক্তিকর ভাব দেখালে অন্যায় হবে। হঠাৎই সে জুহাইরার হাতটা টেনে নিজের মাথায় রেখে দিয়ে ফিসফিস করে বললো ” মাথা ধরেছে জুহা,একটু মাথায় হাত বুলিয়ে দেও তো!
ছোট করে ” আচ্ছা ‘ বলেই জুহাইরা রাফসানের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগলো। হাত ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে মাঝে মাঝে কপালেও একটু টিপে দিচ্ছে। রাফসান আরামে চোখ বন্ধ করে রাখলো। এমন যন্ত্রণাময় সময়ে জুহাইরার স্পর্শ মলমের ন্যায় কাজ করছে।
বেশ কিছু সময় এ ভাবে চললো। জুহাইরা হাত চালিয়ে যাচ্ছে। হাতটা হালকা ব্যথা হয়ে গেলো অথচ রাফসান তো থামতেই বলছে। কি যে করি! ভাবতে না ভাবতেই রাফসান জুহাইরার হাতটা টেনে নিজের কাছে নিয়ে আসলো। মিনমিনে কন্ঠে বললো ” আর লাগবে না জুহা থামো।
জুহাইরা থেমে গিয়েছে কিন্তু রাফসান তো হাত ছাড়ছে না। তাকে কি বলবে হাতটা ছেড়ে দিতে? নাকি নিজেই ছেড়ে দিবে? এটা করলে আবার রাগ করবে না তো? জুহাইরার ভাবনার মধ্যেই রাফসান বললো ” গান বলো তো একটা?
জুহাইরা বোকা স্বরে বললো ” আমি তো গান গাইতে পারি না।
জানতাম এটাই বলবা। তুমি আসলে কিছুই পারো না। গাধী একটা! চুপ করে বসো আমি গান শুনাচ্ছি। জুহাইরাও চুপটি করে রাফসানের দিকে অধীর আগ্রহে তাকিয়ে রইলো গান শুনবে বলে।
আকাশের বুক চিঁড়ে
যদি ঝরে জল
বুঝে নিবো অভিমানে তুমি কেঁদেছো।
সরবোরে যদি ফুটে রক্ত কমল
অনুভবে বুঝে নিবো মান ভেঙ্গেছো।
মাঝ রাতে চাঁদ যদি আলো না বিলায়
ভেবে নিবো আজ তুমি চাঁদ দেখোনি।
আকাশের নীল যদি আধারে মিলায়
বুঝে নিবো তারে তুমি মনে রাখোনি।
রুপালি বিজলী যদি নিরব থাকে
কেঁদো না, ভেবো শুধু আমিতো আছি।
স্বপ্নলোকে তে যদি ময়ূরী ডাকে
বুঝে নিও আমিও আছি কাছাকাছি।
মাঝ রাতে চাঁদ যদি আলো না বিলায়
ভেবে নিবো আজ তুমি চাঁদ দেখোনি।
রাফসান এলোমেলো কন্ঠে গানটা শেষ করতেই জুহাইরা প্রফুল্ল মুখে জানালো বেশ গেয়েছেন। জুহাইরার প্রশংসায় সে আলাদা করে কিছু না বলে ঘড়িতে সময় দেখে বললো ” আর কতক্ষণ খোলা আকাশের নিচে থাকবে? রাত তো প্রায় শেষ হতে চললো। ঘরে যাওয়া দরকার নয় কি?
জুহাইরা হাইঁ তুলতে তুলতে শান্ত কন্ঠে জানালো
” মন্দ লাগছে না তো।
রাফসানকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই আবার বললো ” আচ্ছা টাকার ব্যাপারটা তো ক্লিয়ার করেন নাই।
রাফসান বুঝলো মেয়েটা পেট থেকে কথা বের করেই ছাড়বে। তাই আর না ঘুরিয়ে বললো ” ক্লিয়ার এ কি হলো জুহা?? তাকে তার পাওনা মিটিয়ে দিতে হবে। আমার কাছে ওতো টাকা নেই, তবে কয়েকমাস যাবৎ বেশ পরিশ্রম করতেছি কিছু টাকা জমানোর জন্য। প্রায় লাখ খানেক জমানো হয়েছে।
জুহাইরা অবাক না হয়ে পারলো না। টাকার অভাব কি না রাফসানের? টাকার জন্য সে অতিরিক্ত পরিশ্রম করে যাচ্ছে? সে অবাক নয়নে তাকিয়ে জানতে চাইলো ” আপনার টাকার অভাব?
রাফসান হাসলো। হেঁসে বললো ” হুম অভাবই তো! আমার মতো একটা যুবক দশ লক্ষ টাকা হাতে নিয়ে বসে থাকে নাকি?
” যেকেউ আপনাকে টাকা দিয়ে সাহায্য করতে পারে সেটা কি আপনি ভুলে যাচ্ছেন?
” কেনো জুহা? আমি অন্যের থেকে টাকা নিবো কেন? আব্বা তো কবেই বলেছেন উনার থেকে টাকা নিতে। কিন্তু আমি নিবো না। আমার নিজের টাকা দিয়ে ফারিনের টাকা শোধ করতে চাই, নিজের পরিশ্রমের টাকা দিয়ে। অন্য কারো থেকে নিয়ে নয়।
জুহাইরা চুপ করে রইলো। রাফসান ফের বলতে শুরু করলো ” তোমাকে বলেছিলাম না সে কেবল আমার তিন কবুল বলা স্ত্রী! এটা কেন বলেছি সেটা তুমি দিনকে দিন বুঝতে পারবে জুহা।
জুহাইরা ছোট করে ‘ আচ্ছা বলে সম্মতি জানিয়ে চুপ করে রইলো। রাফসানের চোখে মুখে বিষাদ। দেখে মনে হচ্ছে শক্ত পোক্ত মনটায় কেউ ভিষন আঘাতে থেতলে দিয়েছে। চেহারা তো হলো মনের আয়না। চেহারায় ফুটে উঠে মনের সব চিত্র।
চলবে………….