অন্তহীন সন্ধ্যা পর্ব-০৭

0
12
অন্তহীন_সন্ধ্যা #সূচনা_পর্ব #মাকামে_মারিয়া

#অন্তহীন_সন্ধ্যা
#পর্ব ০৭
#মাকামে_মারিয়া

আচ্ছা আপনাকেই কেনো পরিশ্রম করে টাকা টা পরিশোধ করতে হবে? আপনি না হয় কারো থেকে নিয়ে নেন আপাতত।

” তোমার দেখি ভিষন তাড়া জুহা! সতীনের সংসার করতে ভালো লাগছে না?

রাফসানের কথায় জুহা বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়ে গেলো। কথাটা ওভাবে বলতে চায়নি সে। সবার অবস্থা এবং বিরক্ত দেখেই মুখ থেকে আনমনে কথাটা বেড়িয়ে গেলো। আর এদিকে ফারিনেরও যা তা অবস্থা! সে যে শশুর বাড়িতে আছে এটা মনে হয় ভুলেই বসে আছে। নাহ আছে কোনো দায়িত্বের মধ্যে আর না আছে কোনো কিছু নিয়ে মাথা ব্যাথা। শুধুমাত্র তাকে তার মতো করে চলতে দিলেই এনাফ। এটা কি রকম অত্যাচার সেটাই বুঝতে পারলো না জুহাইরা। তাই তো মুখ ফসকে কথাটা বেড়িয়েই গেলো।
রাফসানের প্লেটে আরেকটু ভাত দিয়ে নিজের খাবারে মনোযোগ দিলো সে। মাঝে মাঝে মুখ খোলাই অন্যায়। কি থেকে কি বলা হয়ে যায়।

” রাগ করলে নাকি?

মুখের খাবার চিবাতে চিবাতে দ্রুত মাথা নাড়িয়ে না বোধক বুঝালো জুহাইরা। রাগ কেন করবে? উল্টো আরো ভয় পেয়েছে এটা ভেবে যে খারাপ কিছু বলে ফেললো কি না। রাফসান না আবার ভুল বুঝে। যতই হোক ফারিন তো এখনো উনার স্ত্রী।

বাড়ির সবার খাওয়াই ততক্ষণে শেষ হয়ে গিয়েছিল। রাফসান দোকান থেকে একটু দেরি করেই ফিরেছে বলে দুজনের খাওয়ায় দেরি হলো। খাওয়া প্রায় শেষ হয়ে আসতেই বাহির থেকে ব্যস্ত আর ক্লান্ত পায়ে এলোমেলো ভাবে প্রবেশ করলো ফারিন।

খাবার টেবিলে জুহাইরা আর রাফসান তখন খাচ্ছিলো। ফারিন এক নজর তাদের দিকে তাকিয়ে মুখ ভেঙ্গছি মেরে হাসার চেষ্টা করলো। ফারিনের দিকেই তাকিয়ে ছিল জুহাইরা যার কারনে ফারিনের মুখের অঙ্গ ভঙ্গি চোখে পড়লো। ফারিন সব সময় চোখের সামনে পড়ে না তবে যখনই পড়ে নাক মুখের অবস্থা এমন করে যেন জুহাইরা আর রাফসান দুজনেই নোংরা কোনো কিছু। তাতে জুহাইরার মন সামান্য খারাপ হয়। কিছুটা কষ্টও পায়। কিন্তু সে তার বিপরীতে যথাসম্ভব মুখে হাসি রাখার চেষ্টা করে।

জুহাইরার মলিন মুখটা রাফসানের চোখে এড়ালো না। পরিস্থিতি বুঝতে পেরেই প্লেটের শেষ লোকমাটা জুহাইরার মুখের সামনে ধরলো সে। এতে মেয়েটা আরো বেশি অস্বস্তিতে পড়লো, ড্যাব ড্যাবে চোখে রাফসানের দিকে তাকিয়ে থাকতেই রাফসান মৃদু ধমকে উঠলো ” কি হয়েছে? নিচ্ছো না কেন?

” আমার খাওয়া হয়ে গিয়েছে তো। আমার পেট খালি নেই।

” এটা খেলে আহামরি কিছু হয়ে যাবে না। এটা আদর, যত্ন! এগুলো সবার পেটে হজম হয় না। কারো কারো বদহজম হয়। তুমিও কি সেই দলের নাকি?

জুহাইরা স্মিথ হেঁসে লোকমাটা মুখে নিলো। ফারিন ততক্ষণে খট খটে পায়ে রুমে ঢুকে গিয়েছে। সে যেতেই যেন জুহাইরার বুক থেকে পাথর নামলো। এই মেয়েটার সামনে জুহাইরা যেন জমে যায়, প্রচন্ড অস্বস্তি কাজ করে।

ফারিন রুমে ঢুকে যেমন ঠাস করে দরজা টা আটকিয়েছিলো, এখন সেম ভাবেই প্রচন্ড আওয়াজে দরজা খুলে জুহাইরাকে সামনে পেয়েই কর্কশ গলায় বললো ” এই মেয়ে আমার খাওয়ার পানি শেষ। পানি দিয়ে যাও তো।

রাফসান টেবিল ছেড়ে উঠতে উঠতেই বললো ” দরকার নাই।রুমে আসো। তুমি ওর চাকর নাকি? যে ভাবে হুকুম করে গেলো।

জুহাইরা ইতস্ততবোধ নিয়ে চোরা চোখে রাফসানের দিকে তাকিয়ে বললো ” কি যে বলেন না! কাউকে পানি দিবো এটা তো ভালো কাজ! উনি যেমন উনার সাথে তেমন হলে উনি আর আমার মধ্যে পার্থক্য কি!
কাজের খালা হয়তো পানি দিতে ভুলে গিয়েছে আজকে। আপনি রুমে যান আমি পানি দিয়ে আসছি।

” খুব তো হাদিস শুনালে। স্বামীর কথা ছাড়া এক পা ও যে নড়া যায় না এই হাদিস পড়ো নাই কখনও?

রাফসানের কথায় জুহাইরা জগে পানি নিতে নিতে মুচকি হেঁসে বললো ” জি জনাব! এমন হাদিস শুনি নাই তা নয়। এটা মানুষের মুখের হাদিস। কিন্তু হাদিসের ভাষায় সরাসরি এমন কিছু বলা হয়নি। কিন্তু হ্যাঁ কিছু হাদিস তো রয়েছেই সেখানে স্বামী স্ত্রীর দায়িত্ব, স্ত্রীর অনুমতি, অধিকার নিয়ে কথা বলা হয়েছে। এই ছোট বিষয়ে আমরা ওদিকে না যাই বরং।

রাফসান ঠায় দাঁড়িয়ে থেকে জুহাইরার কথা শুনতেছে। আজকাল খোঁচা মারতে ভালো লাগে, খুঁচা মারলেই চুপচাপ থাকা জুহাইরা কি সুন্দর করে এক নাগাড়ে বিরতিহীনভাবে কথা বলতেই থাকে। রাফসান বেশ এনজয় করে ব্যাপারটা।

এদিকে জুহাইরা পানি ভর্তি জগটা রাফসানের হাতে ধরিয়ে দিলো। রাফসান তো হতভম্ব! জুহাইরা স্মিথ হেঁসে রাফসানের বাহুতে হালকা হাত দিয়ে বললো ” রাসুলুল্লাহ (সাঃ) বলছেন ” যখন কোনো পুরুষ তার স্ত্রীকে খাদ্য প্রদান করে এবং তার মুখে তুলে দেয়, এটি তার জন্য সদকা হবে।

খাবার তো আমার মুখে তুলে দিলেন, এবার পানিটা ফারিন আপুকে দিয়ে আসুন এতে আপনি ডাবল সওয়াব পাবেন। কথাগুলো বলেই জুহাইরা হাসলো কিন্তু রাফসানের রাগ লাগছে। মনে মনে ভাবছে মেয়েটার সাথে হাদিস নিয়ে কথা বলাই ভুল হয়েছে। না জানি এখন কতো কতো হাদিসের ভেতর ঢুকিয়ে দিবে তাকে।

রাফসান যেতে রাজি হচ্ছে না। জুহাইরা আবদারই করলো যেতে। রাফসান জানালো এমন অনেক আদর যত্ন সে ফারিনকে করতে চেয়েছে। কিন্তু ফারিন সব সময় তাকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে এসেছে। আমি একজন পুরুষ মানুষ হয়ে ফারিনের এসব তুচ্ছতাচ্ছিল্য অনেক সহ্য করেছি জুহা! তুমি আমাকে আর জোর করবে না প্লিজ। তোমার দেওয়ার হলে দিয়ে আসো আর না হয় আমি গেলাম।

জুহাইরা নাছোড়বান্দা। সে রাফসানের হাত চেপে ধরলো। চোখে চোখ রাখলো। ঠোঁটের কোনে মিষ্টি হাসি ঝুলিয়ে বললো ” আচ্ছা আমার জন্য না হয় করলেন। মনে করুন এটা আমাকে খুশি করার জন্য করা হচ্ছে। এবার নিশ্চয়ই করবেন?

রাফসান হাল ছেড়ে দিলো। বুঝলো এই মেয়ে ফারিনের লাইট ভার্সন। ফারিনও যেমন নিজে যা বলে তাই করে, এই মেয়েও সেম। তবে পার্থক্য হলো দুজনের চাওয়া পাওয়া ভিন্ন, দুজনের দৃষ্টি ভঙ্গিও ভিন্ন।

” তুমি দেখি বড়টার মতোই ত্যাদড় রানী!

রাফসানের মুখের মিষ্টি খোঁচা মারা কথা শুনে জুহাইরা আরো একটু হেঁসে বললো ” আমরা দুজনেই তো আপনার বুকের বা পাঁজরের হাড্ডি! একটু আকটু মিল তো থাকবেই।

রাফসান এবার আর গোমড়া মুখ করে থাকতে পারলো না। না চাইতেও হেঁসেই দিলো। বড্ড লক্ষী আর বুদ্ধিমতী কিশোরী জুহাইরার প্রেমে পড়ে বার বার। জগটা হাতে নিয়ে জুহাইরার নাক টেনে নিয়েই হাঁটা ধরলো ফারিনের রুমে দিকে। এদিকে বুকের ভেতর টিপটিপ করছে। কেননা ফারিন সব সময়ের মতো এখনো যদি খারাপ বিহেভিয়ার করে। আগে এগুলো সহ্য করলেও এখন আর সহ্য হয় না। খুব হার্ট হয় সে। ইগোতেও লাগে।

জুহাইরা স্বামীর যাওয়ার পানে পিছন থেকে তাকিয়ে রইলো। আর মনে মনে দোয়া পড়তে লাগলো যেন ফারিন বাজে বিহেভিয়ার না করে। ফারিন যে খিটখিটে মেজাজের এটা জুহাইরা নিজেও জানে।

দরজায় টুকা দিতেই ফারিন ফট করে দরজা খুলে দিলো। গায়ে এলোমেলো টি-শার্ট! কখনো ওড়না পড়েছে কি না সন্দেহ। রাফসান চোখ সরিয়ে নিলো। যে কোনো নন মাহরামকে এড়িয়ে যাচ্ছে।

ফারিন এক সেকেন্ড তাকালো রাফসানের দিকে। সে হয়তো ভাবেনি রাফসান আসবে কারণ সে নিজেও মানে একটু অতিরিক্ত মিচ বিহেভিয়ার করা হয়েছে লোকটার সাথে। পিছনে জুহাইরাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বুঝলো রাফসানকে হয়তো সে পাঠিয়েছে। ফারিন ভালো মন্দ কিছু বললো না। জগটা নিয়ে দরজা আটকিয়ে দিলো।

রাফসান বড় করে নিশ্বাস নিয়ে জুহাইরার কাছে আসলো। যেন বাঘের গুহা থেকে প্রান নিয়ে ফিরে এসেছে। জুহাইরা মিষ্টি করে হাসলো।

” এবার খুশি তো ম্যাডাম?

” জি খুশি! ভালো কাজ করতে পারলে দেহ মন দুটোই চাঙা থাকে।

“হু সবাই তো আপনার মতো দিলদরিয়া না।

” আমি কোনো নদনদী সমুদ্র না, আমি হইলাম খাল বিল।

অতঃপর দুজনেই হেঁসে কুটিকুটি হলো। রাফসানের মনে হলো সে বহুদিন পর মন খুলে হাসতে পারছে। সব হাসিই কিন্তু মন থেকে আসে না। মাঝে মাঝে আমরা কেবল হাসার জন্যও হেসে থাকি। সঙ্গী যদি স্বস্তি না দিবে তবে সেই সঙ্গীর সাথে থেকে সুখ আশা করাও বোকামি। ভালো একজন সঙ্গী আমাদের জীবনে উপসংহার অব্দি থাকুক!

চলবে…………