অন্তহীন সন্ধ্যা পর্ব-০৯

0
3
অন্তহীন_সন্ধ্যা #সূচনা_পর্ব #মাকামে_মারিয়া

#অন্তহীন_সন্ধ্যা
#পর্ব ০৯ ( দ্বিতীয় খণ্ডাংশ)
#মাকামে_মারিয়া

কিশোরী বয়সে প্রেমের বৃষ্টির ছিটাঁ প্রায় সবার গায়েই পড়ে। প্রতিটা রমনীগণকে ঘিরেই একটা প্রেম প্রেম মৌমাছি ঘুরে বেড়ায়। যদিও সে সময়টাতে কোনো রমনীই ঠিকঠাক প্রেমের সংজ্ঞা জানে না। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সেই সংজ্ঞা মুখস্থ হতে থাকে।

বৈশাখ মাসের কুচকুচে অন্ধকার হয়ে ঝড়বৃষ্টির মধ্যে স্কুল থেকে ফিরছিলো সদ্য অষ্টম শ্রেণিতে পড়া জুহাইরা। সকালে স্কুলে যাওয়ার সময়েই আকাশের অবস্থা ততটা ভালো ছিল না বৃষ্টি বৃষ্টি ভাব। যতই ঝড়বৃষ্টি হোক সে এসব মাথায় করেই ক্লাসে উপস্থিত হয়। বাবাকে দুইবার বলা হয়েছে একটা ছাতা কিনে দেওয়ার জন্য কিন্তু বাবা কিনে আনলো না। এটার মানেও জুহাইরার জানা, বাবার পকেটে টাকা থাকলে উনাকে দুইবার বলা লাগতো না।

প্রচন্ড তান্ডবে জুহাইরা আর এক পা-ও এগুতে পারছে না। কাঁধের ব্যাগ বুকে চেপে ধরে বোরকা টেনে একটা দোকানের সামনে দাঁড়ালো। সচারাচর দোকান গুলোতে খুব মানুষের ভিড় থাকে যেকারণে এখানে দাঁড়ানোর কোনো সুযোগ থাকে না তবে আজকে ভাগ্য ভালো দোকানটা বন্ধ। এদিকে আকাশের গুড়ুম গুড়ুম ডাক, আর প্রচন্ড বাতাসের সাথে বৃষ্টির ছিটেফোঁটা গায়ে লাগতেই শরীর শিহরণ দিয়ে ওঠলো সাথে কিছুটা ভয়ও। যত মুখস্থ দোয়া ছিল ইতিমধ্যেই মনে মনে সবগুলো পড়া শেষ জুহাইরার।

একা একা ভিষন ভয় লাগছে। এদিকে বাবা মা নিশ্চয়ই বাড়িতে বসে চিন্তা করছে। এইটুকু মেয়েটা কি করবে বুঝতে পারছিলো না। হুট করেই পিছন থেকে কেউই একজন শান্ত কন্ঠে আওড়ালো ” এই ঝড়বৃষ্টিতে তুমি এখানে একা একা কি করছো? ভয় লাগছে না??

কারো কন্ঠস্বর শুনতে পেয়ে মেয়েটা মৃদু কেঁপে উঠলো। এই মূহুর্তে এখানে কোনো পুরুষলোক ওর সাথে দাঁড়িয়ে আছে ভাবতেই চোখ খিঁচে দাঁড়িয়ে রইলো পিছন ফিরে তাকাতে ভয় করলো কিন্তু মানুষটা আসলেই মানুষ নাকি জ্বীন ভূত সেটা জানার জন্য হলেও তাকাতে ইচ্ছে করলো।

” তুমি জ্বীন-ভূত নাকি কথা বলছো না যে?

জুহাইরার কপট রাগ হলো। কই সে নিজে ভেবে মরছে জ্বীন-ভূতের সাথে দাঁড়িয়ে আছে কি না, আর এখন এই মানুষ তাকেই জ্বীন-ভূত বলছে? ব্যাগটা আরও একটু বুকে চেপে ধরে কিছু বলতে নিবে ওমনি খেয়াল করলো কিছুটা দূরে মাথায় আধভাঙ্গা একটা ছাতা নিয়ে চিন্তিত ভঙ্গিতে জুহাইরার বাবা সুলাইমান সামনে এগুছে। বাবাকে দেখেই বুকের উপর থেকে একটা পাথর নেমে গেলো যেন। অনেকটা সাহস নিয়েই পিছনে থাকা মানুষটাকে পিছনে রেখেই সামনে বাবার দিকে দ্রুত হাঁটা ধরলো জুহাইরা।

সুলাইমান মিয়ার বহুত আদরের বড় মেয়ে জুহাইরা। মেয়েকে বৃষ্টিতে ভিজে অবস্থায় পেয়েই আধভাঙ্গা ছাতাটা মাথার উপর দিয়ে চিন্তিত কন্ঠে বললো ” কত করে বলি মা এই বৃষ্টির দিন স্কুল যাইতে হইবো না। টিচাররা কি আহে পড়ানোর জন্যে?

” কি যে বলেন আব্বা! টিচার রা আসেই। এটা তাদের দায়িত্ব। আমাদেরও দায়িত্ব ক্লাসে উপস্থিত থাকা।

দোকানের সামনে দাড়িয়ে থাকা ছেলেটার দিকে নজর যেতেই সুলাইমান মেয়েকে একটু আড়াল করে ছেলেটার দিকে ভালো করে তাকালো। অতঃপর ভালো মন্দ কিছু না বলেই মেয়েকে নিয়ে হাঁটা ধরলো। কাঁদায় চিপচিপে রাস্তায় জুহাইরা ব্যাগ ধরবে নাকি বোরকা বুঝে উঠতে পারছিলো না।।সুলাইমান মেয়ের অস্বস্তি বুঝে ব্যাগটা নিজের হাতে নিলো। মিনমিনে কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো ” পোলাডা তোরে কিছু কইছে মা?

জুহাইরা বুঝলো সেখানে আসলেই একটা মানুষ ছিল। বাবাও সেই মানুষটাকে খেয়াল করছে অথচ সে ফিরেও তাকায়নি ভয়ে। বাবার প্রশ্নে সহজ সরল উক্তিতে বললো ” না তো আব্বা! তেমন কিছু বলে নাই”। কিন্তু কে উনি?

” এনি হলেন গিয়া সরকার বাড়ির মেঝে ছেলে মুজিবুর রহমানের বড় ছেলে। ভিষণ বড়লোকি মানুষ ওরা। পোলাডা মনে হয় ঢাকায় পড়ালেহা করে।

জুহাইরা আর কিছু বললো না। এই ছেলের ব্যাপারে আগে কখনো শুনে নাই। কিন্তু ঢাকায় পড়াশোনা করে কথাটা শুনেই কেমন ভালো লাগলো। কেউই পড়াশোনা করছে এগুলো শুনলেই মেয়েটার আগ্রহ বাড়ে। নিজেরও অনেক শখ পড়াশোনা করবে বহুদূর অব্দি কিন্তু বাবার যেই অবস্থা তাতে কতটা কি হবে সে জানে না তাও আশা রাখতে তো আর মানা নেই।

ঠিক চার দিন পর আবারও দেখা হলো রাস্তায় সেই ছেলেটার সাথে। যদিও জুহাইরা তাকে চিনে না কারণ তাকে দেখেনি তার সম্পর্কে কিছু জানেও না। সেদিনের আকাশ ফকফকা। নীলচে আকাশে রোদের ঝিলিক রাস্তাঘাটের পানি শুকিয়ে গিয়েছে অনেকটা, দিনটাও বড্ড মিষ্টি।

ছেলেটার নাম তাহসিন সরকার। দেখতে শুনতে ভিষন স্মার্ট। গায়ে কালো রংয়ের শার্ট। ফর্সা শরীরে বেশ মানিয়েছে তাকে। জুহাইরার সাথে তার বান্ধবী নিতু ছিল। দুজনে হেঁটে যাওয়ার সময় তাহসিনের চোখে পড়লো। সেদিনের সেই একই রংয়ে বোরকা হিজাব গায়ে পড়া থাকায় চিনতে বিশেষ অসুবিধা হলো না। নিচের দিকে তাকিয়ে হেঁটে চলে যাওয়া মেয়ে দুটোকে পিছন ডাকলো তাহসিন।

থামতে না চেয়েও থামলো দুজন। এই প্রথম তাহসিনের দিকে নজর গেলো জুহাইরার যদিও তখনও জানতো না এই সেই ছেলে। তাহসিন একটু এগিয়ে এসে কোমরে হাত রেখে নীতুর দিকে তাকিয়ে বললো ” তোমার বান্ধবী কি বোবা?

নীতু অসহায় দৃষ্টি তাকিয়ে কেবল মাথা নাড়ালো দু’দিকে। যার অর্থ তার বান্ধবী বোবা নয়।
গ্রামের সহজ সরল মেয়েগুলো কিছু সময় মুখচোরা স্বভাবের হয়। মুখে মুখ লাগিয়ে কথা বলতে পারে না। আর ওরা তো তখনও ছোট্ট। তাহসিন নিজেও তখন এসএসসি পরিক্ষার্থী। বিশেষ প্রয়োজনে ঢাকা থেকে গ্রামের বাড়িতে এসেছে সে।

তাহসিন ফের জুহাইরার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো ” ওই দিন তবে আমার কথা শুনেও না শুনার ভান করেছো?

জুহাইরার কথা বাড়াতে ইচ্ছে করলো না। বাবা বলেছে রাস্তাঘাটে কোনো ছেলেপেলে কিছু বলতে আসলে যেন সে কিছু না বলে ঘাড় নিচু করে চলে আসে। জুহাইরা এবারও সেটাই করলো। নীতুর হাত ধরে চলে গেলো। তাহসিন অবাক না হয়ে পারলো না। এক কেমন মেয়ে!

________________

সময়টা এখন দুই হাজার পঁচিশ। চব্বিশ রমজান, ইংরেজি মাসের পঁচিশ তারিখ। বাড়িতে ভিষন কাজের চাপ। ঢাকা থেকে মেঝো কাকা সহ তার ফ্যামিলি আসবে গ্রামের বাড়িতে ঈদ করার জন্য। সবার মধ্যে এক চাপা উত্তেজনা কাজ করছে। বহুদিন পর তারা আসতে রাজি হলো বলে।

প্রচন্ড গরমে কাজ করতে করতে হাঁপিয়ে ওঠে জুহাইরা। মনটাও বেশ খারাপ। আশেপাশের মানুষ সহ শশুর বাড়ির কিছু লোক ভিষন কথা শুনিয়েছে বাপের বাড়ি থেকে তেমন কিছু আনতে পারেনি বলে।

বাবা অবশ্য এসেছিলো কিছু ফলমূল আর কাপড়চোপড় নিয়ে। নিজের সাধ্যমতো যা পেড়েছে এনেছে কিন্তু তাদের মনপুত হয়নি। সরাসরি সেটা না বললেও আচরণে প্রকাশ পেয়েছে। রাফসানের সাথেও এসব শেয়ার করতে পারছে না কারণ রাফসান আগে থেকেই বলে রেখেছে বাপের বাড়ি থেকে একটা সুতাও যেন না আসে। কিন্তু নিয়ম রক্ষার্থে তো আনতেই হয়।

সন্ধ্যা ছয়টা বেজে দুই মিনিট। সব কাজ কাম শেষ করে জুহাইরা দাদী শাশুড়ী, শাশুড়ী, জামিয়া সহ বাড়ির বড় কর্তা ছোট কর্তা এবং রাফসানও আজকে উপস্থিত বাড়িতে। সবাই মিলে ইফতার করা হবে। সাথে মেহমান দেরও আসার সময় হয়ে এসেছে বিধায় দোকান বন্ধ করে বাড়িতেই চলে এসেছে।

মসজিদের মাইকে মাগরিবের আজান পরবে পরবে ভাব ঠিক এমন সময় উপস্থিত হলো মুজিবুর রহমান ও তার স্ত্রী সাথে দুই ছেলে মেয়ে। সবাই তো ভিষন খুশি। সবাই সবার সাথে কুশলাদি করতে ব্যস্ত। শ্যামলা বানু জুহাইরাকে ডেকে পরিচয় করিয়ে দিলো ওদের সাথে। জুহাইরা বড় করে ঘোমটা টেনে এসে সালাম দিলো।

একটু দূরেই রাফসানের সাথে ভিষন আড্ডা জমিয়েছে তাহসিন। বেশ বড়সড় হয়ে গিয়েছে। সম্পূর্ণ যুবকই হয়ে গেলো। এখন অর্নাসে পড়ছে সে। পাশাপাশি বাবার ব্যবসায় হাত দিচ্ছে।

রাফসান জুহাইরাকে ডেকে নিয়ে আসলো তাহসিন আর তার বোন তিশার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার জন্য। অপরিচিত মানুষদেরকে দেখে হাফসাফ করতে থাকা জুহাইরা মুখে হাসি রাখার চেষ্টা করেই এগিয়ে আসলো। রাফসান ওদের পরিচয় করিয়ে দিতেই দুজনে একটু হকচকিয়ে গেলো।

জুহাইরার অবস্থা মাথায় হাত দেওয়ার মতো। বেচারি কাজকর্মে এতোই মগ্ন ছিল যে সেই কিশোর কালের তাহসিন এর কথা তার মাথাই ছিল না। যদিও দেখে ততটাও চেনা যায় না বেশ পরিবর্তন হয়েছে কি না!

কিন্তু তাহসিন জুহাইরাকে চিনতে পারলো কি না বুঝা যাচ্ছে না। সে বার কয়েক জুহাইরার দিকে তাকাচ্ছে আর কিছু মনে মনে ভাবছে। মনের ভাব তার চেহারায় ফুটে উঠেছে।

এদিকে জুহাইরা কেবল পালিয়ে বেড়াতে চাচ্ছে। কেবল মনে হচ্ছে রাফসানের কাছ থেকে কখনও এই ছেলের ব্যাাপরে শুনেনি কেন! একই বাড়িতে থেকে এখন আর ঠিক কতটাই বা পালিয়ে বেড়ানো যায়??

চলবে……