#অন্তহীন_সন্ধ্যা
#পর্ব ১১
#মাকামে_মারিয়া
বিষন্ন অস্থিরতায় দিন কাটছে জুহাইরার।।কিসের জন্য এই অস্থিরতা সে নিজেও জানে না। সেদিন রাতের সেই বিশ্রী স্বপ্ন দেখার পর মনটা আরো বেশি বিষিয়ে আছে। এরকম স্বপ্ন দেখার মানে কি হতে পারে?
ভাবান্তর মন নিয়েই রান্নাঘরে কাজ করছিলো সে। হঠাৎ পিছন থেকে জামিয়া এসে শাড়ির আঁচল টেনে দিলো। “জুহাপু বাবা বললো কালকে নাকি ঈদ! আমাকে মেহেদী দিয়ে দিবে না??
জুহাইরা জামিয়ার দিকে তাকিয়ে মুচকি হেঁসে বলল ” হুম মনি! আপু কাজটা শেষ করেই তোমাকে মেহেদী দিয়ে দিবো ঠিক আছে?
জামিয়া খুশিতে নাচতে নাচতে রান্না ঘর ছাড়লো। জুহাইরার অশান্ত মনে কিছুটা শান্তির বাতাস বয়ে গেলো। নিজের কারণে কাউকে খুশি হতে দেখলে ভিষন ভালো লাগে।
বড় সংসার হওয়াতে কাজ যেন একটু বেশিই করতে হয়। প্রায় কাজই জুহাইরাকে করতে হয়। সে বাড়ির বউ। কাজ গুলো সব তার দায়িত্বেই থাকে। এর মধ্যে কারো মন চাইলে হাত দেয়। তা না হলে সব সে একাই করে। এখন বাড়িতে মেহমান কাজের চাপ আরও বেড়ে গিয়েছে।
আজ বাদে কাল ঈদ। প্রতিটা মানুষের খুশির দিন। সবার হাসি হাসি মুখ দেখলে এমনিতেই মন ভালো হয়ে যায়। বাড়ির পুরুষ লোকগুলো সব বাহিরে। মহিলারা সবাই মিলে আড্ডা জুড়ে দিলো। জুহাইরা সবার হাসি হাসি মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে, আবার নিজেও হাসে কিন্তু কোথায় যেন একটা শূন্যতা রয়ে যায়। কিসের এই শূন্যতা??
ভাবতেই মোবাইলে স্ক্রিনে আম্মা দিয়ে সেভ করা নাম্বার থেকে কল আসলো। জুহাইরা সমাবেশ থেকে আস্তে করে সরে আসলো।
” আম্মা ভালো আছেন?
ওপাশ থেকে শান্ত কন্ঠে জুহাইরার মা লিলি বেগম বললেন ” হু মা ভালো আছি। তোর কি অবস্থা?
“আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি আম্মা। ছোটোয়, লায়লা, ভাবি আর বাচ্চারা ওরা ভালো আছে তো?
লিলি বেগম কিছুটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে হাহুতাশ নিয়ে কিছু বলতে যাবে ওমনি একটা হাত মোবাইল টা কেউ কেড়ে নিলো।
” হু সবাই ভালো আছে। সবার কথা জিজ্ঞেস করলি বাপের কথা তো জিজ্ঞেস করলি না রে মা?
বহুপরিচিত বাবার সেই কন্ঠে অভিমানের স্বর শুনেই জুহাইরার মন কেঁদে উঠলো। তড়িঘড়ি করে আওড়ালো
” এখুনি তো বলতাম আব্বা! আমি তো জানি আপনি আম্মার পাশেই আছেন।
অভাবের সংসার, কিছুটা কষ্ট করেই বাচ্চাদের জন্য ঈদের কেনাকাটা করেছে। জুহাইরার বড় ভাইটা মারা গিয়েছে সড়ক দুর্ঘটনায়। ভাইটা থাকলে বোধহয় সংসারে এতো অভাব থাকতো না। ছোট ভাইটা এখনো স্কুলের গন্ডিতেই
এক হাতের কামাই সুলাইমান মিয়ার। এ দিয়েই তো সংসারের সব খরচা চলে, সাথে পুত্রের বউ আর দুটো নাতনিকেও পালতে হয়।
এদিকে জুহাইরা থাকে উচ্চ মধ্যবিত্ত পরিবারের সদস্যদের সাথে। এই ঈদে সবাই কতো কতো কেনাকাটা করলো। সব জুহাইরার চোখের সামনে। দেখতে বেশ ভালোই লাগে কিন্তু যখনই বাপের বাড়ির লোকদের কথা মনে আসে তখন আর এ বাড়ির ভালো ভালো খাবার গলা দিয়ে নামে না, পেটে হজম হয় না।
উনারা খারাপ নয়, কমবেশি সবাই জুহাইরাকে ঈদের কেনাকাটাতে শরীক করেছে। শশুর সাহেব একটা শাড়ি কিনে দিয়েছে, নতুন মেহমান ঢাকা থেকে আসার সময় সুন্দর একটা ড্রেসও এনেছে তার জন্য। কিন্তু বাড়িতে নিজের ছোট বোনটা কি কেনাকাটা করলো সেসব ভেবেই মন খারাপ হয়।দাদি শাশুড়ী হাতে দুই হাজার টাকা গুঁজে দিয়ে বলেছে কিছু কিনে নিতে। এতে জুহাইরা বেশ খুশি হয়েছে কারণ টাকাটা দিয়ে সে নিজের জন্য কিছু নিবে না। এটা কাজে লাগাতে পারবে। ভাগ্যিস টাকা দিয়েছে। ভিষন যত্ন করে টাকাটা হাত ব্যাগে রেখে দিলো।
আকাশে চিকন রশ্মির মতো চাঁদ দেখা গিয়েছে। খুশির চাঁদ। সবার চোখে মুখে চিকচিকে আনন্দের রেখা। তাহসিনের বোন তিন্নি এসে জুহাইরার পাশে বসলো, সাথে জামিয়াও। দুজনের আবদার মেহেদী পড়িয়ে দেওয়া। জুহাইরা হাসি মুখে তাদের আবদার পূর্ণ করার প্রতিজ্ঞা বদ্ধ হলো।
হুট করেই মনে পড়ে গেলো আগেকার সেই ঈদের গল্প গুলো। আহা সেই চিরচেনা আনন্দময় গল্প গুলো এখন কেবল অতীত। সন্ধ্যা থেকে শুরু করে রাতের এগারোটা পর্যন্ত গ্রামের সব ছেলেপুলেদের মেহেদী লাগিয়ে দেওয়ার পর ক্লান্ত শরীর নিয়ে নিজের হাতটাও একটু রাঙা করতে ভুলতো না মেয়েটা। তারপর মেহেদী দেওয়া হাত নিয়ে ঘুমিয়ে পড়তো বেঘোরে। সকালে ঈদের আনন্দ আর মেহেদী দেওয়া হাতের রং কেমন হয়েছে সেসব অনুভূতির কথা আদোও ব্যাখা করা যায় না
এগুলো এখন কেবল অতীত। প্রথম বারের মতো নিজ বাড়ি ছেড়ে অন্য বাড়িতে ঈদ করতে কেমন কান্না কান্না পাচ্ছে। কিন্তু কিছু করার নেই। এটাই প্রকৃতির নিয়ম। আজ যেই বাড়িটা নতুন নতুন লাগছে একটা সময় পর সেটাই নিজের বাড়ি বলে গন্য হবে, কিন্তু মেয়েদের আদোও কোনো বাড়ি হয়??
ঈদের আগের রাত হওয়াতে দোকানে বেশ ভিড়। আর এই কারনেই আজকে রাতে বাসায় ফিরতে সবারই একটু দেরি হবে। আড্ডা শেষ করে সবাই যার যার মতো রুমে অবস্থান করছে। তবে কর্তাগন বাড়িতে আসলে আবার সবাই একত্রে হবে সে যত রাতই হোক না কেন! এমনটাই হয়ে আসছে বরাবর।
জুহাইরা ক্লান্ত শরীর নিয়ে বিছানা শুয়ে পড়লো। আরামে চোখ বন্ধ হয়ে আসলো। মনে হচ্ছে এখুনি ঘুমের দেশে তলিয়ে যাবে। কিন্তু ঘুমালে তো হবে না। মানুষ একটা আছে তার জন্য অপেক্ষা করতে হবে যে। জুহাইরা নিশ্বাস টেনে চোখ বন্ধ করলো ওমনি হুট করে সারাদিনের ব্যস্ততার পর তাহসিনকে মনে পড়লো। লোকটা কেমন অদ্ভুত আর রহস্যময় লাগে। ঠিকঠাক বুঝাও যায় না তাকে।
জুহাইরা ভেবে পায় না তাহসিন এমন সহজ সরল, আর কোনো কিছু হয়নি এমন ভাবে কি করে থাকে?? তাহলে কি সে সব ভুলে গিয়েছে? যাক ভুলে গিয়ে থাকলে সেটা মন্দ নয়। জুহাইরাও চায় না এসব মনে রাখতে।
______________
হাতের মধ্যে শিরশির অনুভূতি হচ্ছে। গভীর ঘুমে থাকায় চোখ মেলে তাকাতেও কষ্ট হচ্ছে। চোখ খুলতে চাচ্ছে কিন্তু পারছে না। হঠাৎ ঘড়ির কাটার শব্দ শুনে ঘুমটা অনেকটাই হালকা হয়ে আসলো জুহাইরা চোখ খুলে নড়ে উঠতেই একটা কন্ঠস্বর থামিয়ে দেওয়ার ধমকিতে বললো ” উমম নড়ে না। নষ্ট হয়ে যাবে।
পরিচিত কন্ঠস্বর। ভয় পাওয়ার কিছু নেই কিন্তু তাও জুহাইরা অস্বস্তিতে পড়লো কারন ঘড়ির কাটার সময় তখন দুটো বাজে। সে ঘুমিয়ে আছে অথচ জেগে থেকে অপেক্ষা করার কথা ছিল।
রাফসানের দিকে তাকিয়ে তার কর্মকান্ড দেখে অবাক না হয়ে পারলো না জুহাইরা। অবাক নয়নে একবার নিজের হাতে আরেকবার রাফসানের দিকে তাকিয়ে হেঁসে দিয়ে বললো ” আপনি দেখি অনেক কাজের! লক্ষী ছেলে! মেহেদী দিতেও পারেন।
রাফসান জুহাইরার হাতে মেহেদী আঁকতে ব্যস্ত। সে মেহেদী দিতে পারে না। কিন্তু বাড়ি এসে ঘুমন্ত জুহাইরাকে চোখে পড়তেই মায়া লাগলো ভিষন। বুঝতে পেরেছে সে ক্লান্ত আর তাই তো বাড়ির মানুষের কাছে কোনো রকম বাহানা দিয়ে বাঁচিয়ে রেখেছে। ঘুম থেকে ডাকেনি। কিন্তু দোকান থেকে আসার সময় যে সে তার বিবির জন্য মেহেদী নিয়ে এসেছিলো এখন এটা কি করবে?? বিবি তো ঘুমাচ্ছে! ঘুম থেকেও জাগানো উচিত হবে না।
কোনো রকম উপায় বুদ্ধি না পেয়ে রাফসান নিজেই আধাঘন্টা যাবৎ আঁকাআকি করে দিয়েছে। জুহাইরা হেঁসে কুটিকুটি। রাফসান সেই হাসিতে আবারও মুগ্ধ। হাতের দিকে তাকিয়ে জুহাইরাকে বললো ” হাতটাকে বাদ করে দিলাম আর আপনি এতো খুশি হয়েছেন যে নাগাদার হাসছেন? আমি তো ভেবেছি আমার মাথা না ফাটিয়ে দেন। ব্যাপারটা কি বলেন তো বিবি?
জুহাইরা নাক ফুলিয়ে বললো ” ওহ আচ্ছা! আমি বুঝি কিছু হলেই আপনার মাথা ফাটিয়ে দেই?
” নাহহ! আসলে তেমন নয়, তাও আর কি!!
জুহাইরা চোখের সামনে নিজের মেহেদী রাঙা হাতটা ঘুরিয়ে দেখতে দেখতে মুগ্ধ কন্ঠে বললো ” এই মেহেদী তে আপনি আঁকা উকি দেখছেন, আর আমি ভালোবাসা, মায়া মমতা দেখছি। এবার বলুন তো আপনার দেখাটা বেশি দামী নাকি আমার দেখাটা বেশি দামী?
” নিসন্দেহে আমার বিবি যা দেখছে সেটাই দামী।
এক মুঠো সুখকর মূহুর্ত। জুহাইরা হাতটা সযত্নে সরিয়ে রেখে রাফসানকে কাছে আসতে ইশারা করলো। রাফসান কিছুটা এগিয়ে আসলো জুহাইরার দিকে। দুজনের ঠোঁটে মিষ্টি হাসি, চোখে চোখ, সর্বাঙ্গে মুগ্ধতা। রাফসানকে কাছে ডেকে জুহাইরা নিজের হাতটা সরিয়ে রেখে রাফসানের কানে কানে ফিসফিস করে বললো ” ঈদ মোবারক আমার সোয়ামী “! পাওনা রইলাম আমার সালামি।
কথাটা শেষ করে এসেই রাফসানের কপালে ছোট্ট করে চুমু খেলো। রাফসান থেমে গেলো। কি ভিষন যত্ন করে ভালোবাসতে জানে মেয়েটা। মুগ্ধতা ঘেরা নিশিযাপন
হয়ে বসে রইলো দুজনে। জুহাইরার খোলা চুলগুলো শক্ত হাতের মুঠোতে নিয়ে কোনো রকম পেচিয়ে খোপা করে দিলো রাফসান। তারপর সেও কানে কানে বললো ” আমার প্রিয়তমা বিবি আমি-ই হতে চাই তোমার জীবনের শ্রেষ্ঠ সালামি।
চলবে…………….
#অন্তহীন_সন্ধ্যা
#পর্ব ১২
#মাকামে_মারিয়া
মেয়েটা চোখের পানি লুকিয়ে ফুপিয়ে কাঁদছে। বড় হয়ে গেলে কিংবা কিছু কিছু পরিস্থিতিতে কাঁদতেও হয় লুকিয়ে। চোখের পানি মুছে লাগেজ গুছিয়ে নিচ্ছে। সুলাইমান মিয়া সেই ঘন্টা খানেক আগেই এসেছে এ বাড়িতে। উদ্দেশ্য মেয়েকে নিয়ে যাবে। কিন্তু মেয়ের মান হয়েছে বেশ। ঈদের পরের দিন, আবার নতুন বিবাহিত দম্পতি। সে বাবার সাথে কেন বাবার বাড়িতে যাবে? তাকে তো তার স্বামী নিয়ে যাওয়ার কথা। কিন্তু স্বামী কি নিয়ে যাচ্ছে??
রাফসান দোকানের কাজে বেশ ব্যস্ত। ঈদের সিজন, দোকানে এতো ভিড় সে বাড়িতে আসার সময়টুকু পায় না। এদিকে জুহাইরাও সেই রমজানের আগে বাবার বাড়িতে গিয়েছিল বেড়াতে। আর যাওয়া হয়নি, মেয়েটার মন ছটফট করে একটু নিজ বাড়ি থেকে ঘুরে আসতে। তাই তো ঈদের পর দিনই রাফসান তার শশুর সুলাইমানকে ফোন দিয়ে বলেছে যেন জুহাইরাকে এসে নিয়ে যায়। তাছাড়া বাড়িতে নতুন মেহমানদেরও দাওয়াত করতে হবে জুহাইরার বাবার বাড়িতে। নতুন বলতে শশুর শাশুড়ী কাকা দাদীরাই।
মেঝো কাকা আতিকুর রহমান আর তার স্ত্রী যাবে না বলে জানিয়ে দিয়েছে। তারা একদিন পরেই আবার ঢাকায় রওনা হবে। তবে তাহসিন আর তার বোন তিন্নিকে রেখে যাবে। তারা দুজন আরো কয়েকদিন বেড়িয়ে তারপর যাবে সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
জুহাইরা এখন বাবার সাথে নিজ বাড়িতে যাবে তার দুই দিন বাদেই শশুর বাড়ির সবাই গিয়ে ঈদের নিমন্ত্রণ রক্ষা করবে এবং জুহাইরাকে নিয়ে আসবে। কিন্তু জুহাইরার মন মানছে না। মনে মনে ভিষন অভিমান হচ্ছে রাফসানের প্রতি। কি রকম স্বার্থপর লোকটা। সে কি না আমাকে একাই চলে যেতে বললো?? সে কি আদোও জানে বাপের বাড়িতে নতুন জামাই সঙ্গে না নিয়ে গেলে কতো মানুষের কতো পিন মারা কথা সহ্য করতে হয়?? মানুষ তো ভেবে বসে থাকে জামাইয়ের সঙ্গে সম্পর্ক ভালো কি না! আরো কতো কি!
অভিমানী মন নিয়ে লাগেজ গুছিয়ে ধপ করে বিছানায় বসে পড়লো। রাগে ফেটে পড়ছে সে। ভিষন শান্তশিষ্ট মেয়েটারও আজ ভারি রাগ হচ্ছে কিন্তু রাগ ঝাড়বে কার সাথে? রাফসান অবশ্য তিন চার বার কল দিয়ে রেখেছে কিন্তু জুহাইরা রাগে রিসিভ করেনি।
” মন খারাপ হইতেছে রে মা?
বাবার কথায় জুহাইরার ধ্যান ভাঙলো। মনে মনে জবাব দিলো ” তো মন খারাপ হবে না আব্বা? আপনিই বলেন উনার কি উচিৎ ছিল না আমার সাথে যাওয়ার? মানুষ আমাকে এখন কি কি বলবে জানেন?? এমনিতেই কতো কথা আমাকে শুনতে হয়েছে স্বামীর দ্বিতীয় স্ত্রী বলে। একটু সুযোগ পেলেই মানুষ কথা শুনিয়ে দেয়।
মনে মনে কথাগুলো চিবিয়ে খাচ্ছে জুহাইরা কিন্তু মুখ ফুটে সেসব বলতে পারলো না কেবল মাথা নাড়িয়ে বাবাকে বুঝালো মন খারাপ নয়। আর মন খারাপই বা হয় কি ভাবে? বাবার বাড়িতে যাওয়ার সময় প্রতিটা মেয়ের আনন্দ লাগে, জুহাইরারও লাগছে কিন্তু খারাপ তো লাগছে রাফসানের জন্য।
এমতাবস্থায় হুট করেই রুমে ঢুকলো কোহিনূর বেগম। জুহাইরার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো ” গোছগাছ হয়েছে?
তড়িঘড়ি করে জুহাইরা নিজেকে স্বাভাবিক করেই আঁচল টেনে মুখটা মুছে বললো ” জি আম্মা শেষ!
” সাবধানে থেকো! এলাকাটাও ভালো না আর বাড়িও তো কেমন জঙ্গলে!
যদিও মহিলা জুহাইরাকে ভালো উপদেশ দিয়েছে কিন্তু তাও তো কেমন হেয় করে বললো কথাগুলো। জুহাইরার খারাপ লাগলেও মুখের হাসি সরে না। সামনে বাপ বসে আছে। এখানে মন খারাপ করা যায় নাকি? আর শশুর বাড়ির লোকদের ভালো কথাগুলোও কেমন কটুক্তি করে বলার মতো হয়। এই পরিস্থিতি সামলে নিতে না নিতেই হাতে লাঠি খুটে খুটে রুমে প্রবেশ করলো শ্যামলা বানু।
” কিরে মাইয়া? মুখ ওমন কইরা রাখছোছ ক্যান?? বাপের বাড়ি যাবি হাসিখুশি হইয়া যা যাতে মানুষ কইতে পারে তোরে আমরা সুখে রাখছি। মুখ যদি ওমনে কইরা রাখোস তাইলে তো মনে করবো আমরা ভাত কাপড়ের অভাব দেই তোরে।
জুহাইরা এবার সত্যি সত্যি হাসলো। কারণ শ্যামলা বানু মুরব্বি মানুষ, উনার কথাবার্তার ধরন সব সময় এমন। তাই জুহাইরা উনার কোনো কথায় আর কষ্ট পায় না বরং মায়াই লাগে। মাঝে মাঝে বেশ মায়াও করে জুহাইরাকে। তাহলে যে মায়া করতে পারে সে শাসন করতে পারবে না কেন? অবশ্যই পারবে। আর তার দুই একটা কটুবাক্য হজম করে নিলেই বা কি এমন হয়ে যাবে? মাঝে মাঝে হজম করতে জানতে হয় এতে সম্পর্ক জোড়ালো হয়।
তাই তো জুহাইরা শ্যামলা বানুর বাহু আঁকড়ে ধরে হেঁসে বললো ” ইশশ কি ভাবে যে বলেন দাদী!! আপনাকে ছেড়ে যাচ্ছি মুখ তো ওমন থাকবেই। কষ্ট হয় না বুঝি?
” হয়েছে হয়েছে! বেলা থাকতে বাইর হইয়া যা। রাস্তা ঘাটে সন্ধ্যা যেন না হইয়া যায়। বাপের বাড়িত যাইয়া পাড়া বেড়াইস না আবার। বিয়ার বছর একটু সাবধানে থাকতে হয়।
জুহাইরার সত্যি সত্যি আবার মায়া হলো। কি ভিষন যত্নে রাখলে মানুষ এ ভাবে বলতে পারে আর খেয়াল রাখতে পারে? মানুষটাকে একটু আলতো করে জরিয়ে ধরে বললো ” আমার তো ছুটি কম দাদী! খুব জলদিই চলে আসবো। আপনি কিন্তু ঠিকঠাক ঔষধ গুলো খাবেন। আর রহিমা খালাকে বলবেন তেল মালিশ করে দিবে।
সব প্রস্তুতি শেষ। জুহাইরা বোরকা হিজাব পড়ে রেডি। রুম থেকে বাবা মেয়ে সাথে দাদী শাশুড়ী, আর শাশুড়ী বের হলো। ড্রয়িং জুড়ে বসে ছিল তাহসিন তিন্নি আর জামিয়া। জুহাইরাকে রেডি হয়ে বের হতে দেখেই জামিয়া দৌড়ে এসে জিজ্ঞেস করলো ” জুহাপু কোথায় যাচ্ছো তুমি??
জামিয়া ঘুমিয়ে ছিল, ভেবেছিলো ঘুমে রেখেই চলে যাবে। দেখলে আবার কান্নাকাটি করবে। এ মেয়ে জুহাইরাকে চোখে হারায়। মাঝে মাঝে রাতেও ওদের সাথে ঘুমাতে চায়, ঘুমিয়ে গেলে বদিউর এসে নিয়ে যায়। তার আবার মেয়ে ছাড়া ঘুম আসে না।
এখন তাকে কি ভাবে সামলায়?? তিন্নি ভিষন ভাবে বুঝিয়ে বললো ” জামু নিন্নি আপুর সাথে থাকো। আমরা পরে যাবো তো জুহাপুর বাসায়!
কিন্তু কে শুনে কার কথা?? জামিয়া তার নিন্নি আপুর সাথেও থাকতে রাজি না। সে জুহাপুর সাথেই বেড়াতে যাবে। ব্যাগপত্র রেখে জুহাইরা জামিয়াকে নিয়ে গেলো রেডি করাতে। তিন্নি বাসায় একা থাকবে?? তাই বেশ জোর করেই তিন্নিকে রাজি করানো হলো সাথে যেতে। দুইটা মানুষ জুহাইরার সাথে যাচ্ছে ব্যাপারটাতে জুহাইরার বেশ ভালো লাগছে আবার অস্বস্তিও একটু লাগছে। শহুরে মেয়ে ওখানে কি ভাবে থাকবে?? ভালো লাগবে তো?? কাঁচা মাটির ঘরে যদি মানিয়ে নিতে না পারে?
_______________
বাড়িতে আসার পরেই আনন্দরা যেন উপচে পড়ছে। এদিক সেদিক করতে করতেই সন্ধ্যা নেমে গেলো। কতো কতো পরিচিত মুখের সাথে দেখা হলো। কারো হাসির আড়ালে হিংসাত্মক মনোভাবটাও বুঝতে বাকি রইলো না জুহাইরার।
ভাইয়ের মেয়ে দুটোর সাথে সেই ভাব জমে গিয়েছে জামিয়ার। সে তো মহাখুশি। এদিকে জুহাইরার বোন লায়লা। যার বয়স কেবল চৌদ্দ। দেখতে শুনতে ভিষন মিষ্টি। গায়ের রং ফকফকা। জুহাইরা আর লায়লা যেন দিন রাতের পার্থক্য। কেউই প্রথম দেখায় তাদের বোন মানতে রাজি হয় না। তবে কন্ঠস্বরের কিছুটা মিল রয়েছে। আর রক্তের অদ্ভুত এক মিল তো আছেই। এই লায়লার সঙ্গেই তিন্নির বেশ ভাব জমেছে। দুজনেই সমবয়সী। জুহাইরা ভেবেছিলো তিন্নি এ পরিবেশে মানিয়ে দিতে পারবে কি না! কিন্তু মেয়েটাকে দেখে মনে হচ্ছে বেশ উপভোগ করছে সব কিছু। অন্যের আনন্দ দেখলে নিজেরই শান্তি লাগে।
সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত। জুহাইরা শাড়ি ছেড়ে সালোয়ার কামিজ গায়ে দিলো।এখানে এসেই সাথে সাথেই শাড়ি খুলে ফেলতে চেয়েছিলো কিন্তু লিলি বেগম না করলেন। জুহাইরাও বুঝে না মায়েরা জানি কেমন করে! বললো সবাই দেখতে আসবে তোকে এখনই শাড়ি চুড়ি খুলতে হবে না।” ব্যস আর কি?
নিজেকে এখন একটু হালকা লাগছে। বাহিরে তিরতিরে বাতাস। বাচ্চা মেয়েগুলো বসে জাম্পেশ আড্ডা দিচ্ছে। জুহাইরা বাহির হলো না। সবাই বার বার বারন করে দিয়েছে রাতবিরেতে বাহিরে না যেতে। তাই তো ঘরের কোনে চেয়ার পেতে বসে বাহিরে তাকিয়ে আছে। সব আনন্দের মাঝে রাফসানের উপর রাগ অভিমান এমনকি রাফসানকেও ভুলে বসে ছিল মেয়েটা। হুট করেই রাফসানকে মনে পড়লো আর অভিমানি পাখিরা ডানা ঝাপটে উঠলো।
ফোনটা হাতে নিয়ে দেখলো সেই যে দুপুরে বাড়ি থাকতেই কল দিয়েছিলো এরপর আর একটা কল মেসেজও করেনি। ঠিকঠাক পৌঁছালো কি না এটাও জানতে চাইলো না??
এতো রাগের মধ্যে আরো আগুন ঢেলে দেওয়ার মতো হলো। জুহাইরার অভিমান আরো বেড়ে গেলো। কই ভেবেছিলো ফোনটা হাতে নিয়ে হয়তো দেখবে কল মেসেজ কিছু এসেছে। কিন্তু না সেসব কিছু নেই।
রাত নয়টা। জুহাইরা ভারি মন নিয়ে সবাইকে রাতের খাবারের জন্য তাড়া দিলো। সবাই তাদের আড্ডা ভেঙে আসতে আসতে সাড়ে নয়টা বাজলো। সবাইকে খাবার দিয়ে জুহাইরা পাশে চুপটি করে গালে হাত রেখে বসে রইলো। মাথা ফাঁকা, চিন্তা ভাবনা কিছু নেই। কিন্তু দেখে মনে হবে কতো কি চিন্তা করছে। লিলি বেগম মেয়েকে তাড়া দিয়ে বললো ” কিরে তুই খাইতে বসতেছিস না কেনো?
” উনি আসতে দেরি হবে তো। উনার সাথেই খাবো।
আনমনে কথাটা বলেই জুহাইরা স্বপ্ন ভাঙার মতো বিমোহিত হলো। চোখ ঘুরিয়ে আশেপাশে তাকিয়ে দেখলো উসখুস জনতা তার পানে তাকিয়ে আছে। জুহাইরা লজ্জা পেলো সাথে অস্বস্তিও। বাবার সামনে কি না কি বলে দিলো! সব সময় রাফসানের জন্য অপেক্ষা করতে করতে আজকেও আনমনেই অপেক্ষা করে বসে আছে মেয়েটা।
লিলি বেগম বুঝলো মেয়ে ঘোরের মধ্যে আছে। তাই কিছু না বলে প্লেটে ভাত বেড়ে জুহাইরার সামনে দিলো। কিন্তু সে খাবে বলে মনে হচ্ছে না। কিছুক্ষণ চুপ করে বসে থাকলো তারপর উঠে গেলো যেতে যেতে বলে গেলো ” আম্মা এখন ভাল লাগতেছে না। পরে খাবো। আপনি লায়লাকে দিয়ে আমার ঘরে পাঠিয়ে দেন খাবারটা।
লিলি বেগম নাকচ করলো না। ভাবলো মেয়ে বিবাহিত, ভালো না লাগার অনেক কারনই থাকতে পারে। তাই খাবার টা বরং পাঠিয়ে দেই যখন ভালো লাগবে খেয়ে নিবে।
ঘড়ির কাটায় তখন দশটার ঘন্টা টিংটিং করছে। জুহাইরা শুয়ে আছে উপুড় হয়ে কিন্তু চোখে ঘুম নেই। অথচ শশুর বাড়িতে শুতে শুতেই যেন ঘুম এসে চোখে হানা দেয়। এপিঠ ওপিঠ করতে করতেই দরজায় কড়াঘাত করলো কেউই। জুহাইরা ফট করে উঠে গেলো, যেন তার মধ্যে দরজা খোলার রাজ্যের তাড়া, সে অপেক্ষায় ছিল একটা করাঘাতের। সেকেন্ডের মধ্যে দরজা খুলেই দেখলো সামনে রাফসান দাঁড়িয়ে আছে। অপরিচিত গায়ের গন্ধ, পরিচিত মানুষ, সেই মিষ্টি হাসি চোখের সামনে এসব ভেসে ওঠতেই জুহাইরার মন খুশিতে নেচে ওঠলো।
রাফসান মুচকি হেঁসে জুহাইরাকে পাশ কেটে ভেতরে ঢুকে গেলেও জুহাইরা তখনও হা করে আছে। সে কল্পনা রাজ্যে বিরাজমান। সব কিছুই ঘোলাটে লাগছে। কিন্তু অপেক্ষা?? অপেক্ষা করাটা তো আদোও ভুল কিংবা স্বপ্ন ছিল না। জুহাইরার অবচেতন মন সত্যি সত্যি অপেক্ষা করছিলো আর ভাবছিলো রাফসান আসবে, সত্যিই আসবে।
দরজা আটকিয়ে পিছন ফিরতেই দেখলো রাফসান নেই। একি?! জুহাইরার মন অস্থির হয়ে উঠলো মাত্রই না দেখলো রাফসান হেঁসে হেঁসে ঘরে ঢুকছে তবে এখন কোথায়?? পাগলের মতো এদিক সেদিক করতে লাগলো। তবে কি এগুলো স্বপ্ন ছিল? রাফসান আসেনি? জুহাইরার অপেক্ষা তবে আরো দীর্ঘায়ু হবে? রাফসান এর মতো পুরুষদের জানা দরকার বুঝা দরকার যে জুহাইরাদের মতো মেয়েদের অপেক্ষা করতে কতোটা কষ্ট লাগে, বুকের ভেতর হাহাকার করে ওঠে। অপেক্ষারা আদোও সুখকর কি?
চলবে……………….