অন্তহীন সন্ধ্যা পর্ব-১৫+১৬+১৭

0
2
অন্তহীন_সন্ধ্যা #সূচনা_পর্ব #মাকামে_মারিয়া

#অন্তহীন_সন্ধ্যা
#পর্ব ১৫
#মাকামে_মারিয়া

ছাদের কার্নিশ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে তিন্নি। গালে কাঁচা হলুদ ভাটা লেপ্টে রাখা। একটু পর পর একতলা বাড়ির ছাঁদ থেকে উঁকি মেরে নিচের রাস্তায় তাকায়।মনে হচ্ছে যেন কারো অপেক্ষায় প্রহর গুনছে। চোখে মুখে তাড়না। হঠাৎ পিছন থেকে কেউই একজন ডেকে উঠলো। প্রচন্ড অবিশ্বাস্য নিয়ে পিছনে তাকিয়েই তিন্নি গাল ভরে হেঁসে দিয়ে বললো ” একি! তুমি এখানে? আমিতো বার বার রাস্তায় দেখছিলাম তুমি আসছো কি না? আমার চোখ ফাঁকি দিয়ে ছাঁদে চলে আসলে কি ভাবে??

সাদাসিধা কিন্তু মিষ্টি দেখতে মেয়ে লায়লার মুখের হাসিও প্রশস্ত হলো। বেশ আয়েশ করেই বললো ” তুমি হয়তো একটু বেখেয়ালি হয়েছিল ঠিক তখনই আমরা বাড়িতে ঢুকে পড়েছি।

তিন্নি মেনে নিলো,হতেই পারে অপেক্ষা করতে করতে বেখেয়ালি হয়ে গিয়েছিল। সেসব মেনে নিয়েই লায়লার ফর্সা ফকফকা হাতটা ধরে টেনে নিয়ে বসিয়ে দিলো।।বিরবির করে বললো ” তোমার হাত ফাঁকা থাকবে এটা মানা যায় না, আমি মেহেদী দিয়ে দিচ্ছি।

লায়লা বাধ্য মেয়ের মতো চুপটি করে মেনে নেয়। তিন্নি কি ভিষন সুন্দর আর মিষ্টি করে কথা বলে। এতে লায়লার বেশ ভালো লাগে। স্কুলে হাতেগোনা কয়েকজন ছাড়া বাকিরা তো পাত্তাও দেয় না।।তাদের আবার গ্যাং বড়! সব বড়লোকী ব্যাপার স্যাপার। সেখানে লায়লার কোনো পাত্তা নেই। আর সঙ্গে কটুকথা তো আছেই। সুযোগ পেলেই সমবয়সী মেয়েগুলো কথা শুনিয়ে দেয়। সেদিক থেকে দেখতে গেলে তিন্নি শহুরে মেয়ে, দেখতে শুনতে স্মার্ট। তবে মনটা পরিষ্কার ঠিক এ কারণেই তো মানুষের সাথে ভেদাভেদ সৃষ্টি করে না, আর না করে বৈষম্য।

আনমনে মেহেদী আর্ট করতে করতেই তিন্নি শান্ত কন্ঠে জানতে চাইলো ” লায়লা তোমার ভাই আসে নাই?

লায়লাও স্বাভাবিক ভঙ্গিতে জবাব দিলো ” ভাইয়া আসতে চেয়েছিলো কিন্তু ওর তো পরিক্ষা। আসবে কি ভাবে? এ জন্য আম্মা বারণ করলো।

তিন্নি আর কিছু বললো না। লায়লার দিকে তাকিয়ে হাসার চেষ্টা করলো।।

জুহাইরা মহা ব্যস্ত, বাড়ির একটা মাত্র বউ। সকল কাজকর্মের দখল মেয়েটার উপর দিয়ে যায়। সেই সকাল থেকে বিয়ে বাড়ির সমস্ত দেখাশোনা সে করে যাচ্ছে।

জামিয়া হাসি হাসি মুখে সবাইকে বলে বেড়াচ্ছে আজকে আমার আব্বুর বিয়ে। মেয়ের মুখে এমন কথায় সবাই হাসলেও বদিউরের অস্বস্তি লাগছে। ছোট একটা মেয়ে, তাকে তো বাঁধাও দেওয়া যায় না। বাঁধা দিলেই প্রশ্নের ঝুড়ি নিয়ে বসবে। এ বয়সে জানতে চাওয়ার প্রবল আগ্রহ থাকে বাচ্চাদের। ওরা একটা বিষয়বস্ত নিয়ে হাজারখানেক প্রশ্ন করে ফেলে।

ফুলমিতকে এ বাড়িতে নিয়ে আসা হয়েছে। আপন পর বলতে মেয়েটার তেমন কেউই নেই। তাই খালার সাথে তাকে নিয়ে আসা হয়েছে। বিয়ে এখানেই হবে। গায়ে গাঢ় হলুদ রঙের শাড়ি আর ব্রাউন কালার ব্লাউজে অত্যাথিক সুন্দর লাগছে ফুলমতিকে। জুহাইরা কাজের ফাঁকে একবার চোখ পড়তেই মুগ্ধ হলো। ইচ্ছে করছিলো কিছু সময় তাকিয়ে দেখতে।।সুন্দর মানুষদের দেখতে সবারই ভালো লাগে। কিন্তু পারলো না, তাকে মুখে মিষ্টি হাসি নিয়ে দৌড়াতে হচ্ছে এদিক সেদিক।

বদিউর তখনও ফুলমতিকে দেখেনি তাই সিদ্ধান্ত হলো দুজনকে একসাথে হলুদ লাগানো হবে। রাফসান তাহসিন মিলে বদিউরকে ছাঁদে নিয়ে আসলো। মুখের মধ্যে বিরাট হাসি নিয়ে তাহসিন বলতে থাকলো ” কাকার বিয়ে খাচ্ছি! কি কপাল মাইরি!

রাফসানও হাসে তাহসিনের কথায়! কাকা ভাতিজা প্রায় বন্ধুর মতোই। তাদের মধ্যে বিশেষ তফাৎ নেই। ছাঁদে আসতেই বদিউরের চেহারা মলিন হয়ে আসলো। পুরনো স্মৃতিরা জেগে উঠলো। প্রথম বারের সেই অনুভূতি, অবশ্য সে সময় ছাঁদ ছিল রঙ বেরঙের ফুল দিয়ে সাজানো। আর আনন্দ মুখরিত পরিবেশ। যেটার এক ভাগও এখন নেই। সবাই যে খুশি না ব্যাপার টা তা নয়। প্রথম বারের মতো আর দ্বিতীয় কোনো কিছু হয় না। আর এখন আত্মীয়স্বজনও তেমন নেই।

কোহিনূর বেগমের দেবর বউ হবে বলে কথা। তাই উনি আর পাড়ার কিছু কাকীরা মিলে ফুলমতিকে ছাঁদে নিয়ে আসলো। ফুলমতির আগমন ঘটতেই বদিউরের মনে চিনচিন ব্যাথা অনুভব করতে থাকলো। ছেলেটা তখনও ভাবছে সিদ্ধান্ত নেওয়া টা উচিত হয়েছে তো?? এই অসহায় মেয়েটাকে না আবার অসুখী করে ফেলি। পৃথিবীতে সুখের বড়ই অভাব,তাই নিজের কারনে কেউই অসুখী হবে সেটা ভাবতে পারে না সে। বিয়ে করতে একপ্রকার ভয় হচ্ছে, মেয়েটাকে ঠিকঠাক মর্যাদা দিতে পারবে কি না সেই ভয়।

দুজনকে পাশাপাশি বসিয়ে কোহিনূর বদিউরের ঘাড় ঘুরিয়ে দিয়ে বললো ” নেও দেখে নেও তোমার দ্বিতীয় ফুলকে। এখনো তো দেখোনি। তোমার রাজ কপাল ভাই! দুটোই ফুল জুটেছে কপালে। আমাদের ছেলেদের কপাল কি আর তত ভালো!

রাফসানের হৃদয় নাড়া নিলো মায়ের কথায়। মা কি কোনো ভাবে জুহাইরাকে মিন করলো?! অথচ জুহাইরার সাথে সবার সম্পর্ক ভালো, মেয়েটা সবার জন্য প্রানপণ দিয়ে করে। বিয়েতেও কারো অমত ছিল না। কিন্তু দিন শেষে সুন্দরী কাউকে দেখলেই মায়েদের, পাড়ার কাকী মায়েদের হাহুতাশ করতে ভুল হয় না। তখন যেন সমস্ত গুন গুলো মাটি চাপা দিয়ে দেয় আর রুপকে মাথায় তুলে রাখে। রাফসানের মন খারাপ হলো। একটু করে সরে আসলো সেখান থেকে। যেতে যেতে কানে বাজলো তাহসিন বলছে ” কাকী চিন্তা করবেন না, আপনাদের ছেলে, মানে আমিও একটা আস্ত ফুলই আনবো ঘরে।

তাহসিনের কথায় সবাই হাসে। বদিউরকে জোর করা হয় ফুলমতিকে একটু দেখতে।।বিয়ের আগে দেখাদেখি করা নেক বরং।বদিউর আড়চোখে ফুলমতির দিকে তাকালো, মেয়েটা তখন জড়সড় ভাবে বসে আছে, চোখ নিচের দিকে নিবদ্ধ। তাকেও বলা হলো বদিউরকে দেখতে। কিন্তু সে তাকালো না। বদিউর একবার তাকিয়েই বিরবির করে মাশাআল্লাহ জপলো। এমন সৌন্দর্যের তারিফ না করলে পাপ হবে যে। মনে মনে ভাবলো ” আচ্ছা মেয়েটা আমাকে দেখছে না কেনো? তাহলে কি উনার বিয়েতে মত নেই? জোর করে বিয়ে দেওয়া হচ্ছে না তো??

বদিউরের ভাবনা থামিয়ে দিয়েই একটা হাত তার গালে হলুদ ঢলে দিলো। পর পর কয়েকটা হাত পালাক্রমে দুজনকে হলুদ লাগিয়ে রাঙিয়ে দিতে লাগলো।

কিছুটা পোড়া মন নিয়ে রুমে আসলো রাফসান। এ রুম সে রুম করেও জুহাইরাকে না পেয়ে দাদীর রুমে গিয়ে দেখলো বেশ ব্যস্ত ভঙ্গিতে শ্যামলা বানুর মুখে ঔষধ আর পানি হাতে এগিয়ে দিচ্ছে। রাফসান ডাকলো” জুহা?

জুহাইরা ব্যস্ত চোখে পিছন ফিরে তাকিয়ে মুচকি হেঁসে ঘামে ভেজা মুখটা মুছে প্রতিত্তোর করলো “হুম? আপনি ছাদে যান নাই?

জুহাইরার প্রশ্নের উত্তর করলো না সে। উল্টো নিজে প্রশ্ন করলো ” কি করছো??

” এই তো দাদীকে ঔষধ দিলাম। একটু দেরি হয়ে গেলো আমার খেয়ালও ছিল না।

রাফসানের ইচ্ছে করছে মেয়েটাকে টেনে বের করিয়ে নিয়ে যেতে এখান থেকে। এদের জন্য এতো করে অথচ উনিশ বিশ হলেই এরা কথা শুনাতে পিচপা হয় না। কিন্তু দাদীর সামনে সেসব সম্ভব নয় তাই স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বললো ” আচ্ছা শেষ হয়েছে? হলে এসো।

জুহাইরা ঔষধ বক্স গুছিয়ে রেখেই রাফসানের পিছনে হাঁটলো। রাফসান নিজেদের রুমে এসে দরজা লক করে দিলো। বাড়িতে এখন মানুষজন আছে হঠাৎ দরজা বন্ধ করে দিবে কেন রাফসান? কিছু হলো নাকি? এটা ভেবেই জুহাইরা চিন্তিত হলো। কিন্তু তার চিন্তাকে খুব বেশি সময় বাড়তে দিলো না। আলমারি খুলে কলাপাতা কালার একটা শাড়ি বের করলো, সাথে চুড়ি,খোঁপা, ক্লিপ, লিপস্টিক ইত্যাদি ইত্যাদি সব কিছু রাফসান বের করলো। জুহাইরাকে ইশারা করলো ফ্রেশ হয়ে আসতে। গুরুগম্ভীর রাফসানের মুখের উপর এখন কিছু জিজ্ঞেস করা যাবে না সেটা জুহা জানে। তাই তো কিছু জিজ্ঞেস না করে ফ্রেশ হতে গেলো।

ওয়াশরুম থেকে বের হতেই রাফসান জুহাইরাকে কাছে টেনে নিয়ে খাটে বসিয়ে দিলো। গায়ের ওড়না ফেলে দিয়ে হাতে ব্লাউজ ধরিয়ে দিয়ে বললো ” কুইক পড়ো এটা।

জুহাইরা ভেবাচেকা খেলো কিছুটা। ব্লাউজ হাতে নিয়ে বোকা চাহনিতে প্রশ্ন করলো” পড়বো?

” তো কি বললাম??

” আপনি আড়ালে যান।

রাফসান বিরক্তিতে চোখ মুখ খিঁচে বললো ” ঢং করবে না তো! আসছে আমাকে আড়ালে যেতে বলতে।

রাফসান ভিষন সিরিয়াস সেটা বুঝতে বাকি রইলো না জুহাইরার। ব্লাউজ পড়া শেষ করতেই রাফসান এগিয়ে এসে শাড়ির কুঁচি ধরলো, শাড়ি পড়িয়ে দিলো। চুল আঁচড়িয়ে খোঁপা করে দিলো, ঠোঁটে লিপস্টিক লাগিয়ে দেওয়ার আগে আলতো চুৃমু খেলো। জুহাইরা কেবল চুপটি করে লোকটার কাজকর্ম দেখছে। লিপস্টিক দিলো, চোখে মোটা করে লেপ্টে কাজল একে দিলো। সাজগুজ শেষ করে জুহাইরাকে সামনে এনে সোজা দাঁড় করিয়ে দিয়ে বললো ” নড়াচড়া করবে না। দেখতে দেও আমায়।

জুহাইরা বিস্ময় খেলো, এমন পাগলাটে রাফসানকে আগে আবিষ্কার করেনি তো। রাফসান জানপ্রাণ দিয়ে জুহাইরাকে দেখলো, মিষ্টি হাসি মাখা মুখের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতেই আচমকা জড়িয়ে ধরলো। জুহাইরা আরও বেশি বিস্মিত হলো। বেশ খানিকটা সময় চুপচাপ জড়িয়ে রেখে ফিসফিসিয়ে বললো ” আমার বিবি পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি সুন্দরী! যেই সৌন্দর্যের ব্যাখা আমি রাফসান নিজেও দিতে জানি না। জুহাইরার ঠোঁটের কোণে এবার হাসির রেখা দেখা দিলো। দুহাত প্রশস্ত করে রাফসানকে আগলে নিলো।

বেশ সাজুগুজু করে ছাঁদে চলে আসলো জুহাইরা। ভিষন শখের এই সাজ। প্রিয় মানুষ নিজের হাতে সাজিয়ে দিয়েছে এটা কি আর এই সেই সাজ! ছাঁদে আসতেই দেখলো হলুদ মাখামাখি চলছে। হাসি হাসি মুখ করে জুহাইরা এগিয়ে আসলো।

দূর থেকে তাহসিন আড়চোখে জুহাইরার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলো। তার সেই হাসির কোনো মানে নেই। হাতে একদলা হলুদ নিয়ে জুহাইরার দিকে এগিয়ে এসেই গালে লেপ্টে দিলো। কিছু বুঝে উঠার আগেই তাহসিন মুখ টিপে হেঁসে স্থান ত্যাগ করলো। জুহাইরা ঠায় দাঁড়িয়ে আছে। কি থেকে কি হয়ে গেলো, আর তার এমন বিশ্রী হাসি, গালে হাত দেওয়া সব কিছু মিলিয়ে মেয়েটার হাসি হাসি মুখটা মলিন হয়ে আসলো। ঘৃনায় শরীর রিরি করছে। ইচ্ছে করছিলো ঠাটিয়ে দুটো থাপ্পড় বসিয়ে দিতে গালে। কিন্তু সেই ইচ্ছেরা মনের কুঠরীতে কবরস্থ হলো। পরিস্থিতি হাতের বাহিরে, সুন্দর মনটা মিনিটেই নষ্ট হয়ে গেলো মেয়েটার। মনে হচ্ছে রাগে দুঃখে চোখ ফেটে পানি জড়বে।

চলবে…………….

#অন্তহীন_সন্ধ্যা
#পর্ব ১৬
#মাকামে_মারিয়া

বাড়িতে বিয়ে বিয়ে আমেজটা কমই বলা চলে। তবে নতুন একজন মানুষ যুক্ত হয়েছে পরিবারে সেটা টের পাওয়া যাচ্ছে। ছোট্ট জামিয়াকে খুব করে বুঝানো হলো এটা তোমার আম্মু। কিন্তু কি জানি কি হলো মেয়েটার, সে মানতে নারাজ। তবে এতোটুকু মানতেছে যে এটা নতুন বউ, তাও আমার আব্বুর বউ। মেয়েটা ছোট্ট, তাই তার সাথে কোনো প্রকার জোরজবরদস্তি করা হলো না। জোরজবরদস্তি করে কোনো প্রকার অধিকার চাপিয়ে না দেওয়া টাই উত্তম। সময়ের সাথে সাথে অনেক কিছুই জীবনের সাথে মিশে যায়।

আশেপাশের মানুষজন নতুন বউ দেখতে আসছে। সবার মুখে মিষ্টি হাসি। তবে একটু আকটু কানাঘুঁষা চলেই এটা নিয়ে যে সরকার বাড়ির পুরুষ লোকদের একাধিক বিয়ে করার একটা রীতি আছে।

নতুন বউ দেখতে এসে কেউই কেউই জুহাইরাকেও দেখে যাচ্ছে। নতুন বউ দেখে জুহাইরাকে দেখলে তাদের চোখে মুখে কিছুটা অসন্তুষ্ট দেখা যায়, যতই হোক মানুষ সৌন্দর্যের পূজারী। রুমের মধ্যে বসে লায়লার মাথায় বিলি কেটে দিতে ব্যস্ত জুহাইরা। পাশেই বসে আছে তিন্নি। মাঝে মাঝে এটা ওটা বলেই হাসাহাসি করছে ওরা।একটু দূরে জামিয়া খেলছে। গতরাতে সবাই মিলে এতো জোর করেও বদিউর আর ফুলমতির সাথে ঘুমানোর জন্য পাঠাতে পারলো না মেয়েটাকে। যদিও বড়রা বললো না থাকাই ভালো কিন্তু বদিউর মানতে নারাজ ছিল। সে মেয়েকে আলাদা করতে চায় না। বিয়ে করেছে বলে মেয়েকে আলাদা কেন করে দিবে? সেই ছোট থেকে মেয়েটাকে কাছ ছাড়া করেনি আর আজ কি না বিয়ে করলো বলে মেয়েকে রুম থেকে বিদায় করে দিবে? প্রচন্ড রাগ দেখালো এ নিয়ে। ফুলমতি স্বামীর এমন রাগ দেখে নিজে উঠে এসেই জামিয়াকে বললো ” চলো আম্মা, আমি তোমাকে ঘুম পাড়িয়ে দেই?

জামিয়া ফুলমতিকে কোনো রকম জবাব না দিয়ে পাশে থাকা কোহিনূর বেগমের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো ” বড় আম্মু নতুন বউকে আমি কি বলে ডাকবো?

” আম্মু বলে ডাকবে।

কোহিনূরের জবাব পেয়ে ফের ফুলমতির দিকে তাকিয়ে কিছু একটা ভাবলো তারপর শান্ত কন্ঠে অতি স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বললো ” ফুলি মা আমি আজকে জুহাপুর সাথে ঘুমাবো।

ফুলমতি দাঁড়িয়ে রইলো। বদিউর মেয়ের দিকে তাকিয়ে রইলো অসহায় দৃষ্টিতে। মেয়ে বুঝে না বাবার হৃদয়ের কষ্ট। বুঝবে কি করে? সে যে পৃথিবীর নিয়মকানুন আর জটিলতা সম্পর্কে এখনো বুঝেই না। সে তো খুব সাধারণ ভাবেই বাবার সাথে থাকতে বারন করে দিলো কিন্তু বাবার কাছে এ সিদ্ধান্ত বড়ই কঠোর মনে হতে লাগলো।

জুহা যখন বুকে জরিয়ে জামিয়াকে ঘুম পাড়িয়ে দিচ্ছিলো তখন জিজ্ঞেস করলো ” জামু তুমি নতুন আম্মুর সাথে থাকলে না যে??

বন্ধ করে রাখা চোখ দুটো খুলে জুহাইরার মুখের দিকে তাকিয়ে বরাবরের মতোই শান্ত কন্ঠে বললো ” দাদীই তো বললো আব্বুর সাথে যেন এখন আর না থাকি! বললো আমি বড় হয়ে যাচ্ছি, মেয়েরা বড় হলে একা একা থাকতে হয়। এখন তোমার সাথে থাকবো তারপর খুব বড় হলে একাই থাকবো।

একা না হতেই একটা মেয়ের ভবিষ্যৎ একা করে দিতে কেবল আমাদের আপন মানুষরাই পারে। আমরা কেউই কখনো আদোও একা থাকার স্বপ্ন দেখি?? দেখি না, তাও প্রায় একা হয়েই যেতে হয় অথচ একটা ছোট্ট ফুল বড়ই হবে একা থাকার স্বপ্ন নিয়ে।

____________

” আম্মা লায়লা ঠিকঠাক বাড়ি গিয়েছে তো?

” হু আইছে ভালা করেই। তুই কি করতেছিস? ঠিকঠাক খাওয়া দাওয়া করিস মা।

জুহাইরা হাসলো। ” কেনো আম্মা তোমার মেয়ে কি বললো যে আমি খাই দাই না?

” না তা কইবো কেন! তয় কইলো মাইয়াডারে যে বিয়া করলো অনেক সুন্দরী বলে?

জুহাইরা প্রফুল্ল মুখে হাসি হাসি হয়ে জানালো মেয়েটা সত্যি সুন্দর। কিন্তু লিলি বেগমের কন্ঠে অস্বস্তি বুঝা গেলো। যেন তিনি ব্যাপারটা ঠিকঠাক নিতে পারলো না।

” কি হয়েছে আম্মা?

” কি আর হইবো! একটু সাবধানে থাকিস! সুন্দরীদের বড়ই অহংকার থাকে। দেখা যাবে অহংকারে মাটিতে পা পড়বো না। আর তোরেও কম খোঁটা শুনতে হইবো না, ছোট্ট কাল থাইকা এই কালা চামড়া নিয়া তো কম কথা হজম করতে হইলো না। সেই একই কপাল এখনো রইলো।

মায়ের কথায় জুহাইরার হৃদয় কেঁপে উঠল। হুট করে ফোনটা কেটে দিয়ে বসে পড়লো। আম্মা এ ভাবে বলতে পারলো? খুব বেশি দরকার ছিল এ ভাবে বলার??

জুহাইরার চোখ মুখ রক্তিম হয়ে গেলো অপমানে। কিন্তু বুঝতে পারলো মায়ের কথায় ভুল কিছু ছিল না। সত্যিই তাকে ছোট কাল থেকে কথা শুনে আসতে হয়েছে। এখনো যে কম শুনে তাও কিন্তু নয়।

বোনটা ঠিকঠাক বাড়ি গিয়েছে কি না জানতেই ফুরফুরে মন নিয়ে কল দিয়েছিলো মায়ের কাছে কিন্তু মায়ের কথায় মনটা বিষন্ন হয়ে গেলো। বাহিরে ভারী বর্ষন হচ্ছে। রিমিঝিম বৃষ্টির শব্দে কান বন্ধ হয়ে আসে। মন খারাপ নিয়ে কাঁথা টেনে গুটি মেরে শুয়ে পড়লো জানালার পাশে। চোখ দুটো বন্ধ করতেই হিমেল বাতাসে আর বৃষ্টির ছিটা মুখে পড়তেই সম্পূর্ণ শরীর ও মন শিহরিত হয়ে গেলো।

ড্রয়িং এ নতুন বউ নিয়ে আড্ডায় বসেছে বাড়ির সব মহিলারা,এমন সময় জুহাইরাকে ডেকে পাঠালো তিন্নিকে দিয়ে। তিন্নি এসে জানালো ” ভাবি তোমাকে ডাকছে।

জুহাইরা কোনো কিছু না ভেবেই জবাব দিলো ” আমার ভালো লাগছো না তিন্নি! আমি পরে যাচ্ছি। তোমরা আড্ডা দেও।

তিন্নিকে মূলত পাঠানো হয়েছিলো যেন জুহাইরাকে ডেকে আনে এই বলে যে জুহাইরা এসে যেন এই বৃষ্টির দিনে একটু গরম গরম চা বানিয়ে খাওয়ায়। কিন্তু তিন্নি শুধু ডাক দিয়েছে, চায়ের কথা বলেনি। বললে হয়তো জুহাইরা ক্লান্ত মন নিয়েও উঠে যেতে বাধ্য হতো।

সেই যে শুয়ে ঘুমিয়ে গেলো মেয়েটা, এরপর জাগলো রাফসানের ডাকে। রাত তখন দশটা। রাফসানের ডাক পেতেই ধড়ফড়িয়ে উঠে পড়লো। ভয়ে বুকটা কাপছে। এতো সময় অব্দি ঘুমালো অথচ কেউই ডাকলো না পর্যন্ত? নিশ্চয়ই ভিষন রাগে ক্ষুব্ধ হয়ে ডাকেনি। রাফসান জানতে চাইলো শরীর ঠিক আছে কি না? জুহা অস্বস্তি ভরাট কন্ঠে জানালো ” শরীর ঠিক আছে তবে একটু মাথা ধরেছিলো আর বাহিরে বৃষ্টিও ছিল বিধায় বিকেলে ঘুমিয়ে গিয়েছিলাম।।আর জাগতে পারিনি কেউই ডাকলোও না।

” এটা তো ভালো কথা! ডাকলে তোমার ঘুমের ডিস্টার্ব হতে পারতো। এটা হয়নি।

রাফসানের কন্ঠে সহজ সরল কথা।পুরুষ লোক আলাভোলা হয় কি না! তাদের আবার মহিলাদের মতো এতো প্যাচ গোছ থাকে না। তাই জুহাইরাও আর কিছু না বললে ব্যস্ত পায়ে কিচেনে ছুটলো।

কিচেনে গিয়েই দেখলো ফুলি তরকারি গরম দিচ্ছে। সৌজন্যমূলক হেঁসে বললো ” আসলে ঘুমিয়ে গিয়েছিলাম টের পাইনি দেন আমি করে দিচ্ছি। আপনারা বসুন খেতে।

ফুলি নতুন বউ সে বড়দের ইশারায় চলে।।নিশ্চয়ই বড় কেউ তাকে এগুলো করতে বলছে, অথচ এতোই ক্ষুব্ধ যে জুহাইরাকে ডাকতে পারেনি। কথা গুলো ভাবছিলো জুহাইরা, ভাবনার মাঝেই শ্যামলা বানু চটে গিয়ে বললো ” এখন আসলি কোথা থেকে রে?? ওই বেলায় যে ডাকলুম আসলি না তো। এখন ফুলিরেই দে কাজটা করতে। ওই মাইয়া সব কাজেই পটু।

জুহাইরা কথাটা গায়ে মাখলো না। মুরব্বিরা কতো কথাই বলবে সেসব গায়ে মেখে বসে থাকলে হবে?? আর সব পুরুষ লোক এখন খেতে বসেছে এই অবস্থায় তো আরও ঝামেলা করার মানে হয় না। যদিও জুহাইরা মনে মনে নিজেকে গালি দিচ্ছে আজকেই যে কেনো ঘুমাতে হলো।

ফুলি দাঁড়িয়ে থাকলেও এবার একটু এগিয়ে আসলো। জুহাইরার হাত থেকে কাজটা সে নিতে চাইলো। জুহাইরা তখনও গভীর মনোযোগ দিয়ে কাজ করছে তাই স্বাভাবিক ভঙ্গিতে ইশারা করে বুঝালো অন্য টা করতে। তাকে এই কাজটাই কেন করতে হবে?? হাতে হাতে অন্য টা করলেই হলো। কিন্তু না সে তো ইশারায় চলে, শ্যামলা বানু নিজে তাকে ইশারা করেছে। শাশুড়ির বিরুদ্ধে যাওয়ার সাহস আছে নাকি?

এর মধ্যেই দুজনের মধ্যে নীরব ও হালকা একটা রেসারেসি হয়ে গেলো। টেবিলে বসা ছিল সবাই সেখান থেকে চেয়ার টেনে উঠে দাঁড়ালো রাফসান। কিছুটা উচ্চ স্বরে মায়ের দিকে তাকিয়ে বললো ” আম্মা আপনিও তাকিয়ে তাকিয়ে সবটা দেখবেন??? হজম হচ্ছে আপনার?? মেয়েটা না হয় একটু ঘুমিয়েছিলো তাই বলে এ ভাবে ক্ষুব্ধ হওয়ার কোনো মানে দেখছি না তো আমি। শাশুড়ির ভয়ে সারাজীবন নিজে চুপচাপ সব সহ্য করে এসেছেন বলে কি এখন এই মেয়েটাকেও সহ্য করতে হবে? আপনি একজন মেয়ে হয়ে নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন এমন পরিস্থিতিতে কেমন লাগতে পারে?

জুহাইরা থেমে গেলো। ভয়ে মেয়েটার হাটু কাঁপছে। সে চায় না কোনো কিছু নিয়ে ঝামেলা হোক কিন্তু ঝামেলা তো হয়েই গেলো।কোহিনূর বেগম কাচুমাচু হয়ে বসে আছে। বুঝাই যাচ্ছে নিজ শাশুড়ির জন্য পুত্রবধূর পক্ষ নিয়ে কথা বলতে তিনি আড়ষ্ট বোধ করছেন। বরাবরের মতোই তিনি শাশুড়িকে মান্য করে চলে।

রাফসান দাদীর দিকে তাকিয়ে বললো ” দাদী আমরা সন্তানরা না আপনাদের থেকেই শিখি সব কিছু। এই যে আপনি মেয়েটাকে ইশারায় জুহার বিরুদ্ধে লাগাচ্ছেন সামান্য রাগ থেকে, কেন সে তখন ডাকে সাড়া দেয়নি। এতে কিন্তু সংসারে অশান্তিটা আপনিই ডেকে আনছে। নতুন মেয়েটা কিন্তু এসেই এগুলো করতো না, আপনি বড় এবং তার শাশুড়ি যে কারণে সে আপনার ইশারায় চলতে বাধ্য। আপনি যেমন শিক্ষা দিবেন সে তেমনটাই করবে তাই দয়া করে সময় আছে শুধরে যাবেন আশা করি।

রাফসান আর এক মূহুর্তও দাঁড়ালো না। টেবিল ছেড়ে চলে গেলো। জুহাইরার বুক ধড়ফড় করছে, না জানি আবার কে কি শুনিয়ে দেয়। কিন্তু কেউই কিছু বললো না। বদিউর চোখের ইশারায় খাবার আনতে বুঝালো আর রাফসানের বাবা গম্ভীর কণ্ঠে মায়ের উদ্দেশ্যে বললো ” আম্মা আপনি গুরুজন! সেই স্থানে থাকুন! আপনাকে ঠিক কতোটা মান্য করে বলে কুহু এই পর্যন্ত আপনার মুখে মুখে তর্ক করে নাই। কিন্তু সবাই কি সব কিছু সহ্য করবে? বিশেষ করে পুরুষ লোক বাহির থেকে ক্লান্ত শরীর নিয়ে এসে এসব সহ্য করতে পারে না মা।

শ্যামলা বানু চুপসে গেলো। বুঝতে পারছে অতিরিক্ত অনুরাগের কারণে নিজেই ছোট হলো সবার কাছে। জুহাইরার প্রতি রাগ দেখাতে গিয়ে কথাও শুনতে হলো। আমাদের সমাজে এমন কিছু গুরুজন থাকে যাদের কারণেই মূলত সংসারে অশান্তি সৃষ্টি হয়। তারা ঠিক থাকলেই অনেক কিছু ঠিক থাকতো এবং থাকে।

চলবে…………..

#অন্তহীন_সন্ধ্যা
#পর্ব ১৭
#মাকামে_মারিয়া

চারপাশ সবুজে ঘেরা, ইয়া লম্বা লম্বা সুপারি গাছের মাঝখানেই সচ্ছ পানির বড় পুকুর। ঘাটে বসে বড়শি ফেলে মাছ ধরার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে হালকা পাতলা ধরনের এক ছেলে। নাম তার কিশোর, যদিও জুহাইরা সহ বাড়ির সবাই ছোট বলেই ডাকে। শুধুমাত্র সুলাইমান মিয়া কিশোর নামে ডাকে। বহুক্ষণের চেষ্টায় দুটো সরপুঁটি, একটা মাঝারি সাইজের সিলভার কার্প মাছ ধরতে পেরেই বিজয়ের হাসি হাসলো ছেলেটা। ঠিক জুহাইরার মতোই মিষ্টি হাসি তার। গায়ের রং শ্যামলা কিন্তু হাসলে এতো মিষ্টি লাগে! মন চায় যেন গাল টেনে দিতে। মাছগুলো নিয়ে হাড়ি সহ ওঠতে যাবে ওমনি পিছন ফিরে এক রমনীকে দেখতে পেয়ে ভূত দেখার মতো চকমে উঠলো।

পাকা ঘাটের সিড়িতে গালে হাত রেখে, ঠোঁটের কোণে মিষ্টি হাসি ঝুলিয়ে কিশোরের দিকে তাকিয়ে আছে তিন্নি। কিন্তু মেয়েটা আসলো কখন? আর এখানেই আসলো কেনো?? কিশোর বরাবরই কম কথা বলা মানুষ। এখন কি বলা উচিৎ সেটাও বুঝতে পারছে না বেচারা। একটু অস্বস্তি নিয়ে হালকা ঠোঁট নাড়িয়ে জিজ্ঞেস করলো ” আপনি?? কখন আসছে..

কথাটা সম্পূর্ণ হতে দিলো না তিন্নি, ফট করেই ভিষণ অধিকার বোধ দেখিয়ে বললো ” বলেছি না আমাকে আপনি করে বলতে হবে না। আমি তো আপনার ছোট। মাত্রই ক্লাস নাইনে। আর আপনি তো ইন্টার ফাস্ট ইয়ার। নতুন নতুন কলেজ এ পা দিয়েছে কিশোর।

ছেলেটা এতো ব্যাখাতে যেতে পছন্দ করে না। কিন্তু জানে যে এই মেয়েটা অনেক বেশিই কথা বলে। সেদিন আপুর সাথেই প্রথম এ বাড়িতে এসেছিলো। এরপর থেকেই সামনে পেলেই বকবক করতে থাকে। এখন আবার আসলো কি জন্য কে জানে?? আপুও আসছে??

শেষ প্রশ্নটা তিন্নিকে শুনিয়েই করলো। তিন্নি বিরবির করলো ” কি বললাম আর সে কি বলে! এনিওয়ে আপনার আপু আসে নাই। আমি একা আসতে পারি না বুঝি??

” আমরা তো পাশের গ্রামেই থাকি। মাঝে বড়বাজার আমাদের আর আপুর বাড়ির ব্যবধান তাই একা না আসতে পারার কথা নয়।

তিন্নি আর-ও অনেক কিছু বলতে নিবে ওমনি কিশোর সৌজন্যমূলক হেঁসে ইশারায় বাড়িতে যাওয়ার জন্য বুঝিয়ে স্থান ত্যাগ করলো। তিন্নির রাগ লাগলো কিন্তু এটা সেই রাগ নয়, এ যেন তুলার মতো নরম রাগ যে রাগে ভালোবাসা বাড়ায়।

উঠানে পিড়ি বিছিয়ে স্বাচ্ছন্দ্যে বসে পড়লো তিন্নি, পাশেই দাঁতকপাটি খুলে হাসি হাসি মুখে ছাই-মাটি দিয়ে মাছ কাটতে লাগলো লিলি বেগম। তিন্নির পাশে লায়লা ইতি বিথিও বসে আছে। কিশোর এ স্থানে নেই। সে এখানে থাকার পাত্র নয়। চুপচাপ আর নিরিবিলি প্রকৃতির মানুষ সে।

মাছ কেটেকুটে ধুয়ে এনে লবণ হলুদ মাখিয়ে গরম তেলে বেজে নিলো। ধোঁয়া উঠা গরম ভাতে মাছ ভাজা সাথে লাল মরিচ ভাজা আর আমের ডাল দিয়ে ভাত খেতে বসলো তিন্নি। সে একা নয় সাথে কিশোর লিলি পিচ্চি মেয়ে গুলো আর সুলাইমান মিয়াও আছে। তিনি মাত্রই কাজ থেকে ক্লান্ত শরীর নিয়ে ফিরলেন। বাড়িতে মেহমান দেখেই আঁতকে উঠলেন, ভাবলেন এ যে শহুরে মেহমান তাকে তো অপ্যায়ন করতে হবে। কিন্তু সেগুলোর কিছুই করতে হলো না। তিন্নি পরম যত্নে আম মাখা ডাল আর ভাজা মাছ দিয়ে ভাত খেয়ে তৃপ্তির ঢেঁকুর তুললো। খেতে খেতে অবশ্য সুলাইমান অস্বস্তি ভরাট কন্ঠে শুধালো ” মা এগুলা দিয়া খাইতে তোমার সমস্যা হইয়া যাইতেছে না?

তিন্নি বিরাট হেঁসে বললো ” নাহ আঙ্কেল! এতো তরতাজা খাবার চাইলেই পাওয়া যায় নাকি? কথাটা বলেই কিশোরের দিকে তাকালো। বেচারা কিশোরকে দেখে মনে হচ্ছে শশুর বাড়ির জামাই, নিচু হতে হতে পারছে না প্লেটের সাথে লেগে যায়। কিশোরের এমন অবস্থা দেখলে তিন্নির ভিষন মজা লাগে। ছোট মেয়েটা জানে না এই মজা লাগার মানে কি! এটার অর্থও তার জানা নেই। শুধু জানে সে আর্কষিত, মায়া কাজ না করুক মোহ কাজ করছে, নিষিদ্ধ মন বারবার এই অনুভূতির শিকার হতে চায়। মন চায় আবেগকে প্রশ্রয় দিতে। বয়সটাই তো আবেগকে প্রশ্রয় দেওয়ার।

সূর্য ডুবুডুবু অবস্থায় সরকার বাড়িতে এসে উপস্থিত হলো তিন্নি। চোখে মুখে অন্য রকম ছায়া। কখনো চকচকে আবার কখনো হতাশা। জুহাইরার সামনে পড়তেই জুহাইরা চিন্তিত কন্ঠে বললো ” তিন্নি তোমাকে বাড়ির সবাই খুঁজতেছে। তুমি কই ছিলে?

মেয়েটা হাহু করে হেঁসে উঠলো। যেন বিরাট হাসির কোনো কিছু হয়েছে। এই হাসলো তো এই থেমে গেলো। জুহাইরা মেয়েটার মুখ পানে তাকিয়ে বুঝার চেষ্টা করলো হয়েছে টা কি! তবে কিছু বুঝুক আর না বুঝুক এটা বুঝেছে যে বয়সের দোষ। এই বয়সের মেয়েরা হলো রঙিন ফড়িং। এরা রঙ বেরঙের ফুলে ফুলে উড়ে বেড়াতে আনন্দ পায়। ভালো মন্দ বুঝার মতো মন কিংবা মস্তিষ্ক কোনো টাই এখন নেই তাদের।

জুহাইরার হাত ধরে টেনে নিয়ে গেলো তার রুমে। নিজের রুমেই তিন্নি তাকে এ ভাবে টেনে নিয়ে আসতেছে কেন সেটাই তো বুঝতে পারছে না। খাটে বসিয়ে দিয়ে ব্যাগ থেকে একটা ছোট বক্স জুহাইরার হাতে ধরিয়ে দিলো। দিয়েই সেই আগের মতো খিলখিলিয়ে হাসতে লাগলো। জুহাইরা বক্সটা নেড়েচেড়ে বুঝে গেলো এটা তার মায়ের বাড়ির বক্স, সাথে মায়ের হাতের ছুঁয়া, মায়ের গন্ধ পাচ্ছিলো। কি আছে এতে?? খুলেই দেখলো আমের আচার। নিশ্চয়ই মা আচার করেছিলো সেটা থেকেই জুহাইরাকে দিয়ে দিলো। খুশিতে জুহাইরার চোখ চিকচিক করতে লাগলো। এই আমের আচার মেয়েটার খুব পছন্দ, আগে গাছে আম ধরতেই গাছতলা থেকে কচি আম কুড়িয়ে এনে মায়ের কাছে আবদার করতো আচার করে দিতে। মা তখন শান্তনা দিয়ে বলতো তেল চিনি খরচ করে বানাবো তাই ভালো আম আর বড় আম হলে বানিয়ে দিবো। এগুলো দিয়ে করলে সবই নষ্ট। মায়ের কথা বেশ মেনে নিতো জুহাইরা।

খুব খুশিতে জুহাইরা ভুলেই গেলো তিন্নিকে জিজ্ঞেস করতে যে সে এটা আনলো কি ভাবে?? মনে হতেই খপ করে তিন্নিকে ধরে জিজ্ঞেস করলো ” তোমাকে আম্মা পেলো কই? আর তুমিই বা আম্মাকে পেলে কই?

তিন্নি হাত মুচড়ে দুষ্ট হেঁসে বললো ” আরেহহ আগামীকাল ঢাকা চলে যাচ্ছি তো তাই লায়লার থেকে বিদায় নিতে গিয়েছিলাম। জানোই তো ভাবি লায়লা আমার কতো ভালো বন্ধু হয়ে গিয়েছে। লায়লা অনেক মিষ্টি জানো তো! ভাবির চেয়ে ভালো ভাবীর বোন।

কথাটা বলেই হাসতে লাগলো। জুহাইরারও ভালো লাগলো তিন্নির কথায়। মেয়েটা কতোই না বিনয়ী।

সমস্ত কাজ কাম শেষ করে জুহাইরা রুমে আসলো। রাফসান তখন বিছানায় হাঁটুতে ল্যাবটপ রেখে কাজ করছে। জুহাইরা হাত মুখ ধুয়েমুছে এসেই আয়েশ করে বসলো সামনে আচারের বাটি রেখে। মজা করে আচার মুখে তুলতেই রাফসান এগিয়ে এসে চোখ বড় বড় করে তাকালো। চোখ মুখে বিস্ময় নিয়ে জিজ্ঞেস করলো ” একি!! এতোবড় খবর টা আমাকে দিলে না??

জুহাইরা চোখ উল্টে তাকিয়ে আবারও খাওয়াও মনোযোগী হলো। রাফসান আর-ও গম্ভীর হয়ে বললো ” আমি কি এই খবর জানার অধিকার রাখি না?? এটা কি হচ্ছে জুহা?? বিরাট অন্যায় হলো তো!

জুহাইরা তখনও জানে না এই পুরুষ কিসের কথা বলছে। না জেনেই একটু আচার রাফসানের মুখের সামনে ধরে বললো ” হা করুন, খান। যে ভাবে তাকিয়ে আছেন পরে আমার আবার পেটে অসুখ করবে।

জুহাইরার হাতের সামনে থেকে মুখ সরিয়ে নিয়ে বললো ” খাবো না, তুমিই খাও! বাচ্চা তো তোমার একার!

” বাচ্চা?? বাচ্চা কোথা থেকে আসলো এখানে?? কার বাচ্চা? কোন বাচ্চা?

রাফসান চোখ মুখ খিঁচে বললো ” এই যে বসে বসে আচার গিলছো, এটা কেনো হু?? আর আমাকে নিউজটা দিলেও না। আমি অনেক রাগ করছি।

জুহাইরা বিস্ময় হলো এবার, আচার সরিয়ে রেখে বললো
” ভেবেছিলাম আপনি অনেক বুদ্ধিমান, কিন্তু এখন দেখছি মাথায় গুবর।

” শেটাপ! পঁচা কথা বলবা না জুহা।

” আরেহহহ মিস্টার! আচার খেলে বাচ্চা হয় সেটা আপনি কোথায় পেলেন?? এমন আজগুবি কথাবার্তা ব্যাটা মানুষ বলতে পারে??

রাফসান বুঝতে পারলো অতি উত্তেজনায় ভুলভাল বলে ফেলছে। কি বলে ফেলছে সেটা ভেবেই এখন লজ্জা লাগছে। তাই জুহাইরার সাথে আর না লেগে চুপ করে মুখটা অন্য দিকে দিয়ে বসে আছে।

জুহাইরা মুচকি হেঁসে পিছন থেকে রাফসানে গাড়ে চড়ে বসলো। রাফসান বোকা হয়েছে দেখতেই হাসি পাচ্ছে। ইচ্ছে করছে ফ্লোরে গড়াগড়ি করে হাসতে কিন্তু তা আর পারছে কই? রাফসান গাল ফুলিয়ে বসে আছে যে। তাই তার মান ভাঙাতে কানে কানে বললো ” আপনি দেখি রাগও করতে পারেন!

” অবশ্যই পারি।

” রাগ করতে কারণ লাগে মশাই! নিজেই ভুলভাল বলে নিজেই রাগে করে নাকি হুহ?

” ভুলভাল বলেছি?? আমার বুঝি ইচ্ছে করে না বাবা হতে??

জুহাইরা বিরাট লজ্জা পেলো। লজ্জায় মুখ লাল হয়ে আসলো। নিজেকে সামলিয়ে বললো ” সেটা কি আমার হাতে?? আল্লাহ তায়ালা খুশি হলেই তিনি তার বান্দাদের খুশি করান।

” আল্লাহকে খুশী করতে হবে কি ভাবে?

জুহাইরা দুষ্ট হাসি হেঁসে মজা করেই বললো ” ঘরের বউকে খুশী রাখলেই আল্লাহ আপনার উপর বেরাজ হবেন না।

” কেন আমার বউ কি খুশি না??

” এটা কখনো জিজ্ঞেস করেছেন? কখনো জানতে চেয়েছেন আমি খুশি কি না? আমার সমস্যা হয় কি না?? সমস্যা আছে কি না??

রাফসান থমকে গেলো। আসলেই সেভাবে তো কখনো জিজ্ঞেস করা হয় না। জুহাইরা ফের বললো ” যাইহোক এগুলো বললাম কারণ মাঝে মাঝে জিজ্ঞেস করলে মনের ভারী ভাবটা হালকা হয়, আমরা আরও যতই আনন্দে থাকি না কেন প্রতিটা প্রিয় মানুষের উচিৎ জিজ্ঞেস করে জেনে নেওয়া। মেয়েরা সব সময় সব কিছু প্রকাশ করে না। তাই তাদেরকে একটু জিজ্ঞেস করতে হয় কোনো রকম সমস্যা হচ্ছে কি না। এতে সমস্যা না হোক আর না হোক নিজেদের মধ্যে আন্তরিকতা বাড়ে।

রাফসান পরম যত্নে টেনে এনে জুহাইরাকে জরিয়ে ধরে। মনে মনে ভাবে কি ভিষন লক্ষী বউ পেয়েছে সে। এতো সুন্দর করে সব পরিস্থিতিতে বুঝায় তাকে। সে মুগ্ধ হয়ে যায়। জীবনে বুঝদার কাউকে পাওয়াও কঠিন হয়ে যায় অনেকের জন্য। রাফসান জুহাইরার কপালে ঠোঁটে মুখে আদর দেয়। লজ্জায় মিয়িয়ে যায় মেয়েটা। লজ্জাবতী জুহার লালরঙা মুখের দিকে তাকিয়ে রাফসান শান্ত কন্ঠে শুধায়

” ভালোবাসি মেঘবীণা।

জুহাইরা যেন আর-ও মিয়িয়ে যায়। লজ্জায় এবার কান গরম হয়ে যায়। রাফসান আবারও ভালোবাসার স্বরে বলে

“তোমায় আমি শুধু ভালোবাসি না,আমি তোমায় অনুভব করি, প্রতিটা নিঃশ্বাসে, প্রতিটা স্পর্শে, প্রতিটা ঘুমভাঙা সকাল আর নিঃসঙ্গ রাতে। তোমার শরীরের উষ্ণতা নয়, আমি তোমার আত্মার কাছে জড়িয়ে থাকতে চাই যেখানে কেবল আমি আর তুমি, কেউ নেই, কিছু নেই।

সকল লাজ লজ্জা ভেঙ্গে দিয়ে জুহাইরাও শান্ত কন্ঠে বলে

” আমার স্বপ্নপুরুষ আমিও আপনাকে ভালোবাসি।

চলবে……….