সেই মেয়েটা চন্দ্রাবতী পর্ব-০৩

0
2

সেই মেয়েটা চন্দ্রাবতী
পর্ব ৩

“দাদাজান, আমি কোয়াটারে থাকতে পারব। আপনি ওনাদের না করে দেন প্লিজ। এভাবে অপরিচিত কারও বাসায় গিয়ে তাদের বিব্রত করতে চাই না। নিজেও বিব্রত হতে চাই না। নিজের মতো থাকব। এজন্যই তো ওখানে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।”

“ওইখানেও তুমি নিজের মতো থাকতে পারবা দাদাভাই। তোমারে নিরিবিলি রুম দিবে। খাবার ওরা দিয়া যাবে। তোমার খাওয়া খাদ্যের সমস্যা হবে না। নাইলে রান্ধন বাড়নের কিছু পার না তুমি। বুয়া পাওয়া মফস্বলে এত সহজ না দাদা ভাই। ফ্রি তো থাকবা না। ভাড়া, খাওয়া বাবদ বিশ হাজার দেব বলছি।”

“তোমার বন্ধু রাজি হলেন?”

“হইব না ক্যান দাদাভাই। নবাবি আর নাই। বনেদি ধনী আছিল এক সময়। এখন পেনশান আর বাড়িটাই সম্বল। যেই সময় সে অবসরে যায়, সেই সময় সরকারি চাকরির বেতন আছিল কম। পেনশনও কম। একটাই ছেলে সরকারি কলেজের শিক্ষক। দিন দুনিয়ার ব্যাপারে উদাসীন শুনলাম।”

“বৈষয়িক না হলেই বুঝি উদাসীন তোমাদের ভাষায়?”

“আমার ভাষা না দাদাভাই। আমার কোনো কিছু বলার ভাষা নাই। মানুষের ছেলে মেয়ে নিয়া কিছু বলারও নাই। রহমত সরকারের কথা অনুযায়ী বললাম। যাই হোক সে বাইপাস করছে গতবছর। মেলা খরচা পাতি হইছে। সাংসারিক খরচ বাড়ছে। বনেদি বাড়ি, ভাড়া দেওয়ার উপায় নাই। কাচারিতে ঘর কইরা ভাড়া দিলে নাকি সম্মান যাবে গা। বিল্ডিং তোলার টাকা নাই। জায়গা বেচবে না। এই সময় মাসে মাসে বিশ হাজার পাওয়া ওর জন্য খারাপ না। টাকাটা দিতে বললো তার হাতে। সেই বাড়ির কর্তা।”

“এর চাইতে কোয়ার্টারে থাকি। পরে সময় সুযোগ করে দরকার হলে আমি শহরে বাসা ভাড়া নিয়ে নিলাম।”

“দাদাভাই, শহর আর মফস্বল এক না। তুমি সারা জীবন শহরে বড় হইছ। মফস্বলের জীবন নিয়া তোমার কোনো ধারনা নাই। মফস্বলের শহর এলাকাও আমাদের ঢাকা শহরের গ্রাম থেকে অনুন্নত। দেখ টিকতে পারো কিনা।”

“টিকতে পারব না?”

“তাই তো দেখতে বললাম দাদাভাই। দেখ পার কিনা।”

***

“আপনের বন্ধুর নাতি এই বাসায় বেড়াইতে আসব?”

“বেড়াতে আসব কই বললাম? থাকব বললাম। নাহার, তুমি আ বললে অজগর বুইঝা নেওয়া মানুষ। বাংলায় বললাম থাকব এখানে।”

“ভাড়া দিবেন তাইলে?”

“সেইটা কখন বললাম? তুমি তোমার ছেলের বৌরে বলবা নিয়ম করে তিনবেলা তার খাওয়ার আয়োজন রাখতে। আয়োজন বলতে রাজভোজ বুঝাই নাই। সে যুগ আর সামর্থ্য আর নাই। তোমার ছেলেরও সেই যোগ্যতা নাই। আমি না থাকলে আর এই বাড়িঘর করা না থাকলে তোমার মাস্টার পুত্র এই দুর্মূল্যের বাজারে টিকতে পারত না। বাংলা সাহিত্য ভালোবাসাবাসি কইরা পেটে ভাত কোনোমতে জুটলেও আর কিছু জুটা লাগত না।”

“এসব আমারে ক্যান বলেন? আমি মুক্ষসুক্ষ মানুষ। এসবের কী বুঝি। আপনে ছেলেরে অফিসার বানাইলেন না ক্যান?”

“শিক্ষিত জাতি পাইতি শিক্ষিত মা লাগে।”

“জি। আমি কম শিক্ষিত, কিন্তু ছেলে মাস্টার হইছে। আপনের ছেলের বৌ মাস্টার্স পাশ। তার এক মাইয়া শিক্ষিত নাচ নেওয়ালি হইতেছে। আরেক মাইয়া আইবুড়া হইয়া এখন বই পুড়ুনির রঙ্গ করে।আগানেবাগানে বইয়া ছবি আঁকে। পুকুরের পানিতে পা ডুবাইয়া বই পড়ে।”

নাহার সুলতানার উপর চরম রাগ উঠলেও নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করেন রহমত সরকার। বিশ্বাস হয় না এক সময় এই নাহার সুলতানার মতো নিরীহ মহিলা কেউ ছিল না। স্বামী, শাশুড়ি সবার ভয়ে তটস্থ থাকতেন। রহমত সরকারের ধমক দেওয়া লাগতো না। গম্ভীর কণ্ঠে নাম উচ্চারণই যথেষ্ট ছিল। এখন নাহার সুলতানা ওনার সাথে এই স্বরে কথা বলে যেন রহমত সরকারের সাথে রসিকতা করছে। ডাক্তার ওনাকে রাগতে নিষেধ করেছেন। নিজের রাগকে যত নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করেন, নাহার সুলতানা তাচ্ছিল্য করে তা যেন আরও উস্কে দিতে বদ্ধপরিকর। এই মহিলার স্বামীবিয়োগের ভয়ও যেন নেই।

“তুমি আমারে রাগাইতেছ। নাচনেওয়ালি কী কথা? নিজের নাতনিরে এই নামে কেউ ডাকে? আসলেই তুমি অশিক্ষিত মূর্খ মহিলা।”

“জি আমি তো স্বীকার যাই আমি অশিক্ষিত মূর্খ মহিলা। তয় এই শব্দ আমি শিখছি শিক্ষিত লোকের কাছে। আমার ছোটো মাইয়া যখন স্কুলের নবীন বরণে নাচ দিলো, তখন এই বৈঠকখানায় বইসা আমার শ্বশুর কইলেন, ‘নাহার সুলতানা, তিন তিনটা মাইয়া পয়দা করছ। এগুলারে কি বিয়া না দিয়ে নাচনেওয়ালি বানাইবা? একটা ছেলে জন্ম দিঋ বইলা সংসার টিক্কা আছে। মাইয়া নাচনেওয়ালি বানাইবার খায়েশ হইলে নাতি রাইখা দিয়া তোমারে তিন মাইয়া সহ বাপের বাড়ি পাঠানের ব্যবস্থা করুম। সেদিন দেখছিলাম শিক্ষিত কেউ এই শব্দ নিয়ে আপত্তি করে নাই। যুগ বদলাইছে তাইলে। ভালা লাগলো, মেয়ের জন্য আপত্তি না করলেও নাতনির জন্য আপত্তি করছেন। যাইহোক আপনার বন্ধুর নাতি আইবো, তারে তিনবেলা দুইটা খাওয়ানো অবশ্যই উচিত। এইটা এ বাড়ীর রেওয়াজ। সরকার বাড়ির রশি জ্বইলা গেছে, কিন্তু বাত্তি তো নিবে নাই। ত্যাল অন্য কেউ দেক, সমস্যা কী। বাত্তি জ্বলতে হবে। আপনার ছেলের বৌরে আমি বইলা দিব। তয় আমি বললে খুব একটা কাজ হইব বইলা মনে হয় না। আপনের মাস্টার্স পাশ ছেলের বউ মনে করে এ বাড়িতে তার মতো শিক্ষিত মানুষ খালি আপনে আছেন। অফিসার হিসাবে অবসরে গেছেন। ঠিক তার আব্বার মত। একজন অফিসারের কন্যা একজন অফিসারের আদেশ ছাড়া কথা শুনতে চায় না। আমি মুখ্য মানুষ, আমার পোলা কম বেতনের কলেজে মাস্টার। আমগো কথা শোনার প্রয়োজন সে বোধ করে না। এই আদেশগুলো আপনিই তারে দিলে ভালো হয়।”

***

“আপু ছাদে নাকি কোন ছেলে থাকবে?”

“তাইতো শুনলাম।”

“তুমি এখন ছবি আঁকবে কোথায়?

“কোথায় আর। লাইব্রেরিতে, পুকুর পাড়ে। তাছাড়া ছবি আঁকার জন্য তো জায়গা গুরুত্বপূর্ণ কিছু না। এক জায়গায় বসে আঁকলেই হয়। বেশিরভাগ আর্টিস্টরা খোলা জায়গায়, রাস্তার পাশে বসে ছবি আঁকে। ফিল হয় ভালো।”

“কী ফিল হয়? এটা কি প্রাকৃতিক কর্ম যে রাস্তার পাশে করলে ফিল আসবে।”

বলেই গা দুলিয়ে হাসে মৃদুলা। বোনের সস্তা রসিকতার জন্য চন্দ্রের বিরক্ত লাগার কথা। কিন্তু সহজ স্বাভাবিক মুখ করে রাখে। মৃদুলা নিজেই হাসি বন্ধ করে।

“তোমাকে তো বললাম একটা পেজ খুলে দেই। আঁকা ছবি শেয়ার করবে। ভালো করে বুস্ট করলে হয়তো কিছু বিক্রিও হয়ে যাবে। তোমার ক্যানভাস এর দাম, রং তুলির দাম তো উঠবে।”

“তুই মনে হয় মার কথা জানিস না! আমার সবকিছুরই এখন মার চরম অপছন্দের।”

“কারণ টা মিটিয়ে ফেললেই হয়। একসময় তো তুমি আম্মুর চরম আদরের কন্যাও ছিলে।”

“এখনো আছি। এই রাগ, ক্ষোভ সাময়িক।”

মৃদুলা উঠে চলে যায়। চন্দ্র আটকায় না। বোনের প্রতি তার রাগ করার শত কারণ আছে। তবু ভালোবাসার একটা কারণই যথেষ্ট। আর তা হলো এটা জানা যে মৃদুলা তার বোন।

(চলবে)