সেই মেয়েটা চন্দ্রাবতী
পর্ব ৪
“দাদাজান, তিনি তোমার কেমন বন্ধু?”
“স্কুলে পড়ছি একসাথে। মাঝে বহুবছর যোগাযোগ আছিল না। আমি পারিবারিক ব্যবসায় ঢুকলাম। আমার আব্বা ঢাকায় দোকান নিলেন। চলে আসলাম ঢাকা। বিয়াশাদী করলাম ঢাকায়। আস্তে আস্তে দেশের বাড়ির সাথে যোগাযোগ গেল কইম্মে।”
“তাহলে?”
“অনেকদিন বাদে আরেক বন্ধুর মাধ্যমে খুঁজে পাইলাম। তোমাদের জাদুর কৌটার বদৌলতে।”
“মোবাইল?”
ওয়াহিদুজ্জামান সাহেব নাতির কথায় হাসেন।
“নারে বেটা। ফেসবুক। ঐ খানে স্কুল, কলেজের দলটল আছে। মেলা পুরানা মানুষ খুঁজে পাইলাম।”
“দাদাজান, আপনি জানেন আমি কেন যাচ্ছি। আপনার বন্ধুর সাথে…”
“যাও দাদাভাই। অনেক সময় আলো বাতাস বদলালে মন বদলে। আগের দিনে শরীরের অসুখ সারাতে ডাক্তারসাব বায়ু বদল করতে বলতেন। মনের অসুখও বায়ু বদলালে সারে জানি। বাকি তুমি কিছু ভাইব না। আমি ততটুকুই জানাইছি, যা জানা দরকার। বেদরকারি কথা তোমার দাদাজানও বলে না।”
***
মাহাতাবের ধারণা ছিল না উপকূল ট্রেনের অবস্থা এত খারাপ হতে পারে। একটু নিরিবিলি যাওয়ার জন্য কেবিনের টিকেট কাটতে চেয়েছিল। কিন্তু উপকূলে কেবিন পায়নি। এসি বগি স্নিগ্ধার টিকেট কেটেছে। ভৈরব পার না হতে এত লোক উঠেছে যে বাইরে তো বটেই, ভেতরেও ঢুকে বসে আছে। ছিটকিনি লাগানোর উপায় নেই। মহিলাদের জোর করে বেরও করা যায় না। অনেকে বিরক্ত হয়ে রাগারাগি করলেও, কিছু মহিলাদের সাথে বাচ্চা থাকায় মাহাতাব আর নিষেধ করে না। বরং নিজেই এককোনায় গুটিসুটি মেরে বসে জায়গা করে দেয়। সাথে পথে পথে ভিক্ষুক, হিজরা, হকারদের অত্যাচার তো আছেই।
পাঁচ ঘন্টার এই যাত্রাপথ যখন দেড় ঘন্টার ক্রসিং এ পড়ে মাহাতাবের বিরক্তি তখন চরমে ওঠার কথা। অথচ মাহতাবের ভালো লাগছে। আখাউড়া রেল ক্রসিং এ লেট হবে জানতে পেরে অনেকেই ট্রেন থেকে নেমেছেন। মাহতাবও নামে। আশেপাশে হাঁটাহাটি করে। হকারদের আনাগোনা বেড়ে গিয়েছে। মাহতাব সাথে করে খাবার আনেনি। বক্সে করে খাবার নেওয়ার কথা দাদা বলে দিলেও মাহতাব শেষ মুহুর্তে আর ব্যাগে ঢুকায়নি। এমন নয় যে ট্রেনজার্নি এই প্রথম। তবে এ ধরনের জার্নি অবশ্যই প্রথম। দুপুর তিনটা দশের ট্রেন ছিল। খাবার খেয়েই বের হয়েছে ট্রেনে নাস্তা পাবে জানা ছিল। তাই মাথাও ঘামায়নি। চলন্ত অবস্থায় ট্রেনের কামরায় এত মানুষের সামনে নাস্তা করতে তার ইচ্ছে করছিল না। অথচ চারদিকে সবাই কিছু না কিছু খেয়েই যাচ্ছিল। চানাচুর, ফল মাখা, আচার, চাটনি, ডিম সেদ্ধ… মনে হচ্ছিল সবাই কতকাল ধরে ক্ষুধার্ত। তাই যা সামনে পাচ্ছে তাই খাচ্ছে।
মাহাতাবের তখন কিছু খেতে ইচ্ছে না হলেও, এখন প্রচন্ড ক্ষুধা পেয়েছে। একটা ছেলে বনরুটি, চা বিক্রি করছে। খিদের চোটে চা দিয়ে তাই খেয়ে নেয়। এরপর এদিক সেদিক হেঁটে ছবি তোলে। শীতের একটা ঠান্ডা বাতাস বয়ে চলেছে। শীত শীত লাগলেও ট্রেনের কামরায় ফিরে যায় না মাহতাব। বরং দাঁড়িয়ে মানুষ দেখে। সময়টা তার খারাপ যায় না। বিদায় নেওয়ার সময় তার মা বলেছিল,
“তুমি যদি একসপ্তাহ টিকে যায় ওখানে। তোমাকে আমি মেনে নেব।”
“এই কথা তো মামাও বলেছিল। চাকরি পেয়ে দেখালে মেনে নিবেন। এখন আশা করি মেনে নিয়েছেন। তুমিও আশা করি মেনে নিবে। চাকরিটা আমি করে দেখাব।”
“তোমার মেধা নিয়ে তো আমাদের কখনোই সন্দেহ ছিল না। তবে এ কথা তুমি অস্বীকার করতে পারো না যে তুমি ফোকাসড না। এখনো এই চাকরি পাওয়া, করতে যাওয়া তোমার সেই খামখেয়ালিরই অংশ। বাড়ির বাইরে পা রাখলে বুঝবে জীবন কেমন। তোমার দাদার আস্কারা না থাকলে এত সাহস পেতে না।”
“সিদ্ধান্ত আমার ছিল আম্মু। দাদাজান শুধু সাহস দিচ্ছেন। যা তোমরা করবে না শুধু এইটা প্রমাণের জন্য যে তোমরা ছাড়া আমি কিছু না।”
***
“এতক্ষণে তো পৌঁছে যাওয়ার কথা রহমত। ওর ফোনও বন্ধ পাইতেছি। আমার তো চিন্তা হইতেছে।”
“ওয়াহিদ, তোমার নাতি তো ছোটো মানুষ না। এত চিন্তা কইরো না। উপকূলের সার্ভিস ভালো না। সেখানেও দেরি হইতে পারে। ট্রেন প্রায় লেট করে। সাড়ে আটটা বললেও মাঝেমধ্যেই রাতের সাড়ে দশটা এগারোটা বাজে। শোনো আজ রাতের মধ্যে না আসলে আমি খোঁজ নিব। ছেলেমানুষ নিয়ে ভয় পাওয়ার কী আছে।”
“আরে ও কোনদিনও গ্রামের দিকে একা যায় নাই। ঢাকার বাইরে কোথাও বেড়াতে গেলেও বেড়ানোর জায়গায় গিয়েছে।”
“তোমার কথা শুনে তো মনে হচ্ছে নাতিকে বহু আহ্লাদে বড়ো করেছ। শোনো মধ্যবিত্ত ঘরের ছেলেদের এত আহ্লাদ করে বড় করতে হয় না। দুনিয়া বড়ো কঠিন জায়গা। সব শেখাতে হয়। গ্রাজুয়েশন করা ছেলে, একা চলতে পারবে না কেন? অবশ্যই পারবে। তুমি অযথা চিন্তা কইরো না তো। তোমার নাতি পৌঁছালে আমি তোমারে জানাব। সকাল পর্যন্ত অপেক্ষা কর। আর ছেলের বাপ মাকেও টেনশন করতে নিষেধ কর।”
রহমত সরকার আস্বস্ত করলেও ওয়াহিদুজ্জামান সাহেব চিন্তা মুক্ত হতে পারেন না। সবকিছু থেকে দূরে গিয়ে নিজেকে খুঁজে পাওয়ার জন্য মাহতাব যখন ঢাকা ছেড়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়, অনেকটা সবার বিরুদ্ধে গিয়ে তিনি মাহতাবের পাশে দাঁড়িয়েছেন। চেয়েছেন নাতি পরিচিত মহল থেকে একা থেকে জীবনটাকে দেখুক। কিন্তু পাশাপাশি এই ভয়ও ছিল, একদম অচেনা পরিবেশে মানিয়ে নেওয়া মাহতাবের জন্য কতটা সহজ হবে। মাহতাব পারবে কিনা। কোনো বিপদ আপদ হলে তিনি নিজেও তো দায়ী হয়ে থাকবেন। পঁচিশ বছরের যুবক ছেলে নিজের জীবনের সিদ্ধান্ত নিজেই নিতে পারার কথা, নিজের খেয়াল নিজেই রাখতে পারার কথা। কিন্তু সবার জন্য এই সমীকরণ ঠিক নয়।
***
লাইব্রেরির একপাশে নিজের আঁকাআঁকির জিনিসগুলো গুছিয়ে রাখতে রাখতে গান শোনে। নিজেও গুণগুণ করে গান গাইতে থাকে চন্দ্র। রাত সাড়ে এগারোটা বাজে। মফস্বলে রাত সাড়ে এগারোটা ভালোই রাত। আশেপাশের অনেক বাসায় আলো নিভে গিয়েছে। শীতের দিন বলে জানালা বন্ধ।
“ঠক ঠক ঠক”
চন্দ্রের মনে হয় রাস্তার ধারের জানালাটা ধরে কেউ খটখট শব্দ করছ। চোর নয়তো? শীতে চোরের উপদ্রব বাড়ে। ঠান্ডায় কাতর মানুষ লেপ জড়িয়ে ঘুমায়, আর চোর সে সুযোগে ঘর হাপিশ করে। কিন্তু এই কামরায় লাইট জ্বলছে। হালকা সুরে গান বাজছে। নিজেও গাইছে। এ রুমে চোর গুঁতোগুঁতি করার কথা না।
“কেউ আছেন ভেতরে? শব্দ শুনলাম। ভয় পাবেন না। আমি মানুষ। ভূত না। এটা সরকার বাড়ি না?”
চন্দ্র সাবধানে জানালার একটা পাল্লা খোলে। পুরোনো দিনের জানালা। ক্যাচক্যাচ শব্দ করে একটা পাল্লা খোলে।
“জি সরকার বাড়ি। আপনি কি মাহতাব জামান?”
জানালার ওপাশে একটা উৎসুক চেহারা দেখে মাহতাব। স্নিগ্ধ, সুন্দর একটা মুখ। চোখ, নাক, মুখের গড়ন বিশেষ কিছু নয়, আটপৌরে সাধারণ চেহারা, শ্যামল বরণ। কিন্তু চেহারায় ভীষণ মায়া।
“আপনি আমার কথা জানেন? জি আমিই মাহতাব জামান। ঢাকা থেকে এসেছি। দরজা খুলে দিবেন প্লিজ। ঠান্ডায় জমে যাচ্ছি।”
(চলবে)