সেই মেয়েটা চন্দ্রাবতী পর্ব-১১

0
7

সেই মেয়েটা চন্দ্রাবতী
পর্ব ১১

“এই তোমার অফিস?”

“হ্যাঁ।”

“ছোটো না?”

“ছোটোই তো হবে। এখানে লোকবল কম। আমাদের কাজ তদারকি করার জন্য জেলা কার্যালয় আছে। সরকারি অফিস বলে একটু মলিন এই আর কী।”

চন্দ্র হেসে দেয়।

“মলিন? কোনো একদিন সরকারি স্কুলে গিয়ে দেইখো। এই অফিস তখন ফাইভ স্টার লাগবে। আচ্ছা যাই।”

রিকশাওয়ালা ভাইকে রিকশা টান দিতে বলে চন্দ্র।

“খুব তাড়া না থাকলে ফাইভ স্টারের এককাপ চা খেয়ে যান। আজ চা খাওয়া তো হয়নি।”

“আরেকদিন।”

“আরেকদিন আর হবে না। রোজ রোজ কি আর একসাথে আসা হবে?”

চন্দ্র একটু ভেবে রিকশা থেকে নামে। রিকশা ভাড়াটা জোর করে মাহতাবই দিয়ে দেয়। চন্দ্রকে রুমে বসিয়ে পিওনকে পাঠায় চা সিঙ্গারা আনতে।

“সিঙ্গারা খাব না।”

“আরে খান। মার্বেল সাইজ সিঙ্গারা বানায় এখানে। টপাটপ দু তিনটি একসাথে মুখে দেওয়া যায়। কাঁচামরিচ দিয়ে সেই মজা।”

মাহতাবের কথা বলার ভঙ্গিতে মজা পায় চন্দ্র। ছেলেটা অদ্ভুত। খুব হাসিখুশি, চঞ্চল, এলোমেলো স্বভাবের। মনে হবে এর জীবনে কোনো চিন্তা নেই। অথচ চন্দ্র ওর অন্য রূপও খেয়াল করেছে। ছাদে কাপড় আনতে গিয়ে, এটা সেটা তুলতে গিয়ে দেখেছে ছাদের এককোনায় দাঁড়ানো, নিজের ভাবনায় লীন মাহতাবকেও। যাকে সেসময় মাহতাবকে ভীষণ বিষণ্ণ লাগে। পারিবারিক বিষয় ইচ্ছে করে এড়িয়ে যায়। রহমত সরকার বা ফিরোজ সরকারও মাহতাবের কাছ থেকে খুব বেশি তথ্য বের করতে পারেনি। অথচ এমন চঞ্চল স্বভাবের মানুষদের জিজ্ঞেস করতে হয় না। নিজ থেকেই নিজেকে নিয়ে প্রচুর কথা বলে।

***

“চা-টা ভালো না?”

“হ্যাঁ আসলেই ভালো। একটা সত্যি কথা বলবো আমার না অবাক লাগতেছে।”

“কী?”

“এই যে তোমাকে আমাদের এখানে মানিয়ে যেতে দেখে।”

“মানে?”

“মানে আমাদের যে সকল আত্মীয় স্বজন ঢাকায় থাকে, বা বিদেশে থাকে। তারা ফেসবুকে খুব গ্রামের কথা মনে করে। ফুল, পাখি, নদী সব তাদের মনে পড়ে। অথচ গ্রামে আসলেই শুরু করে নাক শিটকানি। সব কাঁদামাটি লাগে। অথচ আমাদের বাড়ি কিন্তু বিল্ডিং। তাও তাদের ভালো লাগে না, কারণ পুরানা বাড়ি। এখানে ভালো কফির দোকান নাই, এখানে ভালো সিনেমা হল নাই, ভালো নাকি মার্কেট নাই। সব তাদের নাই মনে হয়। দুই চারদিন ঘুরতে নাকি তাদের ভালো লাগে। এরপর আর লাগে না।”

“তাহলে আমাকে দেখে অবাক লাগে কেন? আমি তো এসব একবারও বলি নাই।”

“সেজন্যই তো। তুমি বলো নাই। কিন্তু খেয়াল করেছি।”

“কী?”

“তুমি এখানে ভালো নাই। প্রথমে প্রথমে তোমাকে দেখে আমার মনে হইছে তোমার যা অবস্থা তুমি এক সপ্তাহের ভেতর ঢাকা চলে যাবা। পরে মনে হয় চাকরির মায়ায় থেকে গেলা।”

“চাকরি অবশ্যই কারণ। তবে একদম ভালো না লাগলে শুধু সেটার মায়ায় এখানে আটকে থাকতাম না।

“তুমি পুরাপুরি শহরে বড় হওয়া ছেলে এবং কাজ করে অভ্যস্ত না সেটা খুব ভালোভাবেই বোঝা যায়। এমন মানুষ সাধারণত গ্রামে লম্বা সময় থাকতে পারে না। গ্রাম তাদের ভালো লাগে না। যতই বলো দুই চার দিন বেড়ানো আর নিয়মিত থাকা, দুইটার মধ্যে তো পার্থক্য আছে।”

“আচ্ছা আগে বলেন এটা গ্রাম কী করে হলো? এটাতো জেলা শহর তাই না? গ্রাম তো আরও প্রত্যন্ত এলাকা। হ্যাঁ এটা ঠিক ঢাকার বাইরে বেশিরভাগ বিভাগীয় জেলাতেই পূর্ণাঙ্গ সুযোগ সুবিধা নেই বললেই চলে। তারপরও আমরা প্রস্তর যুগে তো পড়ে নেই। ইন্টারনেটও আছে। স্পিড একটু স্লো তবে কাজ চলে যায়। শপিংমল নাই তবে কেউ একজন আমাকে মসজিদ মার্কেট চিনিয়েছেন। চলার মতো কাপড়চোপড় পাওয়াই যায়। কাঁচা বাজার আছে, থানা সদর হাসপাতাল আছে, কিছু প্রাইভেট হাসপাতালও আছে। যদিও চিকিৎসা মান নিয়ে আমি কিছু বলতে চাই না। কিন্তু প্রাথমিক চিকিৎসা তো চলে। তবে একটা জিনিসের অভাব আমি বোধ করি। সেটা হলো বিনোদনের জায়গার অভাব। এই একটা বিষয়ে জেলাশহরগুলো অনেক পিছিয়ে আছে। ভালো একটা বিনোদনের জায়গা নেই। বিশেষ করে মহিলাদের বেড়ানোর জায়গা সীমিত। এর বাড়ি ওর বাড়ি ছাড়া। অল্প কয়দিনেই দেখলাম একা মহিলা চলাফেরা করতে দেখলে মানুষ কেমন চোখে জানি তাকায়। কমবয়সী ছেলেমেয়ে একসাথে হাঁটলে চোখ দিয়েই জাজমেন্টাল আচরণ করে। এই যেমন আপনি আমার সাথে বসে চা খাচ্ছেন আর আমার এমএলএস কয়েকবার উঁকি দিয়ে গেল। একটা কম বয়সী অফিসারের কেবিনে একটা সুন্দরী মেয়ে এসে চা খাচ্ছে এ নিয়ে তার মনে মনে একশো থিওরি অলরেডি বানানো হয়ে গেছে।”

“ভালো কথা বলেছ। এটা তো আমার মাথায় ছিল না। আসলে বিষয়টা জাজমেন্টাল হওয়ার না শুধু। মূলত অপ্রচলিত। আমাদের মফস্বল এলাকায় এগুলো মানুষ ভালো চোখে দেখে না। মানে শহরে কেউ কাউকে চেনে না। মেয়ে কার বাড়ির, ছেলে কার, এসব জানে না। সে কারণে কেউ হয়তো ওইভাবে করে চেনার চেষ্টাও করে না। কিন্তু এখানে বিষয়টা আলাদা। আমার বাবা কলেজের শিক্ষক, দাদা একজন সম্মানী মানুষ। ছোট এলাকা বলে আত্মীয় না হয়ে অনেকে ওনাদের চেনে। এ অবস্থায় বাকিদের ক্ষেত্রেও। আত্মীয় হলেই শুধু চিনবে তা না। মুখ চেনা থাকে অনেকেই। একই এলাকার মানুষ হিসেবেও চেনে। আবার লতায় পাতায় কেউ কেউ আত্মীয়ও বের হয়ে যায়। তাই সেক্ষেত্রে অবিবাহিত মনে হওয়া ছেলেমেয়েকে একসাথে দেখলে কথা বলে। মেয়েদের অপ্রয়োজনে ঘোরাঘুরি স্বেচ্ছাচারী আচরণ মনে করে। তাছাড়া এখনে ইভটিজিং হয় অনেক। তাই মেয়েরাও স্বচ্ছন্দ না রাতবিরেতে দরকার ছাড়া একা চলাফেরা করায়।”

“কিন্তু এটা তো ব্যক্তি স্বাধীনতা হস্তক্ষেপ করা। এডাল্ট মানুষ তার ব্যক্তিগত সিদ্ধান্তের মালিক। ধরেন আমাদের কথাই বলি। আমি আপনি তো কোনো খারাপ কাজ করছি না। একদম দিনের আলোয় মুখোমুখি বসে দুই কাপ চা খাচ্ছি। এটা দেখেও যদি কথা বানায় তাও তাদের মানসিকতার সমস্যা।”

“অবশ্যই কিন্তু সাথে এটাও মাথায় রাখতে হবে এইটা আমাদের সামাজিক অবস্থানের উপর নির্ভর করে। এখানকার সামাজিক অবস্থায় এসব স্বাভাবিক না। আচ্ছা আমি উঠি হ্যাঁ। আর বেশিক্ষণ বসলে ভালো দেখায় না। চা টা ভালো ছিল, সিঙ্গারাও। ধন্যবাদ।”

“এইরে আমি তো মনে হয় জাজমেন্টের কথা বলে আপনাকে বিব্রত করে ফেললাম। একটু আগে কী সুন্দর হাসি খুশি ছিলেন। এখন উঠে যেতে মরিয়া হয়ে গেলেন। কেউ কিছু বলবে না। বসেন তো। বললেও আমি বলব যে আপনি আমার বাড়িওয়ালা মেয়ে।”

“আগ বাড়িয়ে কিছু বলার দরকার নেই। আমার পরিচয় দেওয়ারই দরকার নেই। যত কথা ব্যাখ্যা করতে যাবে তাতে তাদের আগ্রহ হবে। উঠি।”

চন্দ্র একটু আগেও স্বাভাবিক ছিল। এখন কেমন অস্থির হয়ে বের হয়ে গেল। মনে হয় মানুষের কথা বানানোর আতংক ওকে হঠাৎ পেয়ে বসেছে। হুট করে চন্দ্র এতটা নার্ভাস হয়ে যাবে মাহতাব বোঝেনি। বুঝলে চন্দ্রকে এসব বলতো না।

(চলবে)