সেই মেয়েটা চন্দ্রাবতী পর্ব-১২

0
15

সেই মেয়েটা চন্দ্রাবতী
পর্ব ১২

ছুটির আলস্য ছড়িয়ে পড়েছ সরকার বাড়িতে। শুক্রবার ছুটিরদিন বলে নয় শুধু পরীক্ষা শেষ হওয়ায় চন্দ্রের স্কুল ছুটি, ফিরোজ সাহেব আর মৃদুলারও আপাততঃ শীতকালীন বন্ধ। আজ সকালের খাবারটা সবাই আয়েশ করে রোদে বসে করবে। ছাদের এককোনায় চুলা নিয়ে আসা হয়েছে। এই চুলাটা লাকড়িতে জ্বলে। এদিকসেদিক বহন করা যায়। দুটো চুলায় একযোগে খোলাজালি পিঠা বানানো হচ্ছে। হাঁসের মাংস রান্না হয়েছে, আর আছে খেজুরের রস থেকে করা পাতলা ঝোলা গুড়। জুয়েনার সহকারী খালা এক থালা নারকেল কুঁচি করে দিয়েছে। রস দিয়ে রাতের বেলাতেই পায়েশ বানানো হয়েছিল। সকালে ঠান্ডা ঠান্ডা সেই পায়েশও খাওয়া হবে। এত চমৎকার আয়োজন দেখে মাহতাবের ভালো লাগে। এই বাড়ির সদস্যদের ভেতর মতো পার্থক্য আছে, দ্বন্দ্বও আছে। মাহতাব বাইরের মানুষ হয়েও তা স্পষ্ট বুঝতে পারে। তবু তারা একই ছাদের নিচে পরস্পরকে সহ্য করে বাস করে যাচ্ছে এই বিষয়টা মাহতাবের অবাক লাগে, ভালোও লাগে। অবাক লাগে কারণ মাহতাব যে পরিবেশ থেকে এসেছে সেখানে এখন মতের মিল না হলে একসাথে থাকাটা উৎসাহী করা হয় না, টক্সিক পরিবেশ বলা হয়। ভালো লাগে কারণ মনে হয় এতে পরিবারটা তো অন্ততঃ বজায় থাকে।

আজ মাহতাবকেও নাস্তায় ওদের সাথে শরিক হতে বলা হয়েছে। মাহতাব আসলে ধনু একটা পিঁড়ি আর জলচৌকি এগিয়ে দেয়। পিড়িতে বসে জলচৌকিতে খাবার রেখে খেতে হবে। পিঁড়ি বেশ নিচু। মাহতাব পা ভাঁজ করে বসতে স্বচ্ছন্দ বোধ করে না।

“এই জন্য লুঙ্গি পরতে বলি। তোমারে না লুঙ্গি এনে দিলাম। ধনুর সাহায্য নিয়াও তো শিইখা ফেলতে পারতা। তোমরা ইয়াং পোলাপান কিছু শেখার আগ্রহ নাই।”

“এটা অনেক নিচু। লুঙ্গি পরলেও আমি বসতে পারব না। আমি উঁচুটাতে বসে হাতে নিয়ে খাই।”

“উচু নিচু কী আবার? এইটারে বলে পিঁড়া আর এইটারে চৌকি। তুমি তো বাবা ব্যাসিক জিনিস জানো না। চাকরি পাইলা কেমনে? শুধু চাকরি পাইলেই তো হইলো না। জীবনে চলতে সব জানা লাগে।”

নাহার বেগম গরম গরম পিঠা হাঁসের ঝোলে ডুবাতে ডুবাতে বলেন,

“তোর মাইয়া চাকরি করতে পারলে সে পারব না ক্যান? তোমার মাইয়া এত জাইন্না, বই পইড়া কী হইছে? দুই টাকার চাকরি কইরা, দশ টাকার ভাব। লাভ নাই কদিন বাধে মানুষও তোরে বলবো, মাইয়ার চাকরি থাকলে কী হইছে, আইবুড়া বাড়িত বইয়া আছে। জীবন চলবো কেমনে?”

রহমত সরকার স্ত্রীকে ধমকে ওঠেন,

“সব কথার ভেতর তোমার বা হাত না ঢুকাইলে হয় না।”

“এটা আপনের ছেলেরে বলেন। অইন্যেরে জ্ঞান না দিয়া নিজের ঘরে দেখে না ক্যান।”

মাহতাব তাড়াতাড়ি পা ভাঁজ করে পিঁড়িতে বসে পড়ে। ফিরোজ সরকার উঠে যেতে চাইলে চন্দ্র হাত ধরে বসিয়ে দেয়।

“দাদি ঠিক বলছে। বাবা, তুমি শুধু শুধু অন্যের ভুল ধরতে যেও না।”

“হুম। এতে নিজের ঘরের পাপ প্রকাশ পেয়ে যায়।”

“মৃদুলা!”

জুয়েনা চোখ ইশারায় ফিরোজ সরকারকে আর কিছু বলতে না করেন। যে হাসিখুশি মুখে সকাল শুরু হয়েছিল, তা আর থাকে না। বাকিটা সময় সবাই চুপচাপ খাওয়া শেষ করে। মাহতাব তখন পায়েস খায়নি। জুয়েনা পরে ধনুকে দিয়ে পাঠিয়ে দিয়েছিল। খাওয়া শেষে বাটি নিয়ে নামার সময় খেয়াল করে চন্দ্র এই ঠান্ডা বাতাসে দোলনায় বসে পুকুরের ঠান্ডা পানিতে পা দিয়ে মৃদু দোল খাচ্ছে।

“জায়গাটা খুব সুন্দর। এমন সুন্দর জায়গায় বসে সুখের কথা ভাবতে হয়। দুঃখবোধের কান্না জমা থাকুক।”

চমকে উঠে চোখের পানি মুছে ফেলে চন্দ্র।

“তুমি দেখলে আমি কাঁদছি। তাও হুট করে আওয়াজ না দিয়ে আসা ঠিক হয়নি।”

“স্যরি। কাছে আসার আগে চোখের পানিটা দেখতে পাইনি। আসলে আপনাকে সবসময় খুব পরিপাটি, গোছানো, দৃঢ় মনে হয়েছে। একাকী বসে যে ভেঙে পড়বেন। বুঝতে পারিনি। আমি দুঃখিত। বিব্রত করতে চাইনি।”

“জানি। কেননা তুমি আর আমি কিছুটা রকম দুঃখবোধে আক্রান্ত। অথবা আমাদের কষ্টের প্রকাশটা একই রকম।”

“মানে?”

“তুমি কী ছটফটে, হাসিখুশি। মনে হয় তোমার জীবনে কোনো দুঃখ নাই। কিন্তু একা থাকলে আমার মতো তোমাকেও দুঃখরা ঘিরে ধরে। তাই না? পার্থক্য হলো মেয়ে বলে আমি দুঃখের আয়োজনের ভেতরই বাস করি। বের হতে পারি নাই এই বলয় থেকে। আর তুমি পালিয়ে আসছ।”

“বসতে পারি?”

চন্দ্র সরে গিয়ে মাহতাবকে দোলনায় বসার জায়গা করে দেয়।

“আপনার কথাটা সত্যি। আমি অনেকটা পালিয়েই এসেছি। কারণটা বলতে চাই না।”

“বলা লাগবে না। দুঃখের একটা আলাদা বৈশিষ্ট্য আছে জানো। সুখের মতো দুঃখ ভাগ করা যায় না বললেই চলে। সুখটা আমাদের চোখমুখ উপচে পড়ে। না চাইলেও আমরা চারদিকে তা ছড়িয়ে দেই। বিলিয়ে দেওয়াতেই সুখের আনন্দ। অপরদিকে দুঃখটা আসলে একান্ত নিজের। আমাকে কী কষ্ট দিচ্ছে, তা হুট করে আরেকজনকে বোঝানো সহজ না। ধরো একটা মেয়ে গোলাপ খুব ভালোবাসে। শখের গোলাপ গাছের চারার অনেক যত্ন করে। হুট করে একদিন গাছটা মারা গেল। এই দুঃখে তার মন পুড়ে গিয়েছে, গলা দিয়ে খাওয়া নামে না, রাতে ঘুম আসে না। কিন্তু এই দুঃখটাই যখন সে আরেকজনকে বলে হালকা হতে যাবে, সে অনুভবই করতে পারবে না। বলবে, আরেকটা গাছ এনে লাগালেই হয়। সে বুঝবেই না যে মেয়েটার কষ্ট হচ্ছে মায়ার জন্য, চারার জন্য না।”

“আপনার কথা অনেক ভারী। শিক্ষক বাবার শিক্ষক মেয়ে বলো বোধহয়। বই পড়েন অনেক বোঝা যায়। অনেক বই পড়লে একসময় মানুষ নাকি বইয়ের ভাষাতেই কথা বলতে থাকে। আমি চাকুরির পরীক্ষার জন্য যা পড়ার পড়েছি। এর বাইরে সাহিত্য জ্ঞান নেই। সহজ ভাষায় বলি, কিছু ঘটনা শেয়ার না করতে চাওয়ার কারণ শুধু এটা নয় যে পাশের মানুষটা বুঝবে না। কারণ হলো, ঘটনাটা হয়তো খুব লজ্জার, অপমানের অথবা গোপন। কারণ যাই হোক সেই ঘটনা কষ্ট দেয়। চাইলেও ভোলা যায় না, বলা শব্দও খুঁজে পাওয়া যায় না।”

“দুঃখ বোঝাতে শব্দেরা কবে দরকার হলো?
এ যে অনুভূতি। বুক পেতে শুধু নেবে বলো।
সহস্র শতাব্দী কাল ধরে আমরা দুঃখ ফেরি করে ফিরি।
বিনামূল্যেও তো কেউ ভাগ নিতে নয় রাজি।
সম্পর্ক শুরুর আগেই সবাই সুখের ভাগ চায়।
দুঃখ সে তো ডুকরে মরছে তাই তো হায়।
কিনতে চাওয়া তো দূর
দুঃখ নিয়ে দর কষাকষিতেও কেউ নাই।”

চন্দ্র হঠাৎ খেয়াল করলো তার মন খারাপ ভাবটা চলে গিয়েছে। দুঃখ কেনাবেচার প্রয়োজন হয়নি। পাশে কেউ মন থেকে যত্ন নিয়ে বসে থাকলেও বোধহয় দুঃখ দ্রবীভূত হয়।

“একটা কথা জিজ্ঞেস করি?”

“হুম। যদিও আন্দাজ করতে পারছি কী। না আমি পালিত মেয়ে না। বাবা মারই মেয়ে।”

“তাহলে আপনার দাদি এমন করেন কেন? মানে ওনাকে আপনার সাথে একটু বেশিই রুক্ষ লাগে।”

“আমার তিন ফুপু আছেন। তাদের কাউকে এ বাড়িতে এখনো আসতে দেখেছ?”

“না।”

“দাদাজান এই বাড়ি ওনার মৃত্যুর পর বাবাকে দিবে বলেছেন।”

“মেয়েদের?”

“অন্য জায়গায় জমি দিয়েছেন।”

“এই জন্য তিনি তার স্বামীর সাথে রাগ হতে পারেন। কিন্তু আপনার উপর ঝাড়ছেন কেন?”

“আমার দাদার মেয়েদের প্রতি টান নেই। আমার বাবা আবার মেয়ে অন্তঃপ্রাণ।”

“তো?”

“তো কিছু না। আজ এইটুকুই। বাকিটা আরেকদিন।”

(চলবে)