সেই মেয়েটা চন্দ্রাবতী
পর্ব ২৩
ধনুর কাছে তুর্য এসেছে শুনে মৃদুলা ঘরময় ওকে খুঁজতে থাকে। মৃদুলার বিশ্বাস, তুর্য আজও ওকে পছন্দ করে। শুধুমাত্র চন্দ্রা আর বাবার উপর রাগ থেকে তুর্য ওর সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করেছে। দাদি তো সবসময় মৃদুলার পক্ষে আছে। চন্দ্রার বিয়ে হয়ে গেলে সবকিছু আবার সহজ হয়ে যাবে। ফুপুকে দাদি ম্যানেজ করবে। ফিরোজ সরকারকে জুয়েনা।মানুষ কত সহজে পিছুটান ফেলে সামনে এগিয়ে যায়, ঐ যে মুভ অন করা বলে। অথচ মৃদুলা তো এখনো সেই সময়ে আটকে আছে। বাবার চোখে তুর্যের কোনো যোগ্যতাই নেই। চাকরি বাকরি করে না, পারিবারিক ব্যবসা দেখে। অথচ বাবা এটা বোঝে না, চাকরি করার চেয়ে ব্যবসা করা বড়ো যোগ্যতা। সবাই চাকুরিজীবি হতে পড়ালেখা করে না। বাবার ব্যবসা, তুর্য না দেখলে কে দেখবে?
দাদা দাদির রুমে গিয়ে তুর্যকে পায়নি মৃদুলা। তবে কি তুর্য চলে গেল? কী ভেবে পায়ে পায়ে ছাদে ওঠে আসে। তুর্য আর মাহতাবকে কথা বলতে দেখে সিঁড়ি ঘরেই দাঁড়িয়ে যায়। এই কথাগুলো চন্দ্রা বহুবার মৃদুলাকে বলার চেষ্টা করেছে। কিন্তু মৃদুলা কানে নেয়নি। কেননা তুর্য যা বলেছে, তার বাইরে আর কোনো সত্য তার কাছে ছিল না।
“আপনি কে? চন্দ্রার সাথে আপনার কী সম্পর্ক যে তার কথার উপর ভিত্তি করে আমাকে জাজ করছেন।”
“কেউ না। কিন্তু এই কয়দিনে এতটুকু বুঝেছি, তিনি সুযোগ নেওয়ার মতো মেয়েও না। সুযোগ নেওয়ার মতো মেয়ে হলে আমাকে ফাঁসাত। আমি সিনিয়রদের কাছে শুনেছি এমন অনেক ঘটনা ঘটে যেখানে অবিবাহিত অফিসারদের ট্রাপে ফেলে বিয়ে করার ঘটনা ঘটে। সেদিন এখানে যে পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল, এনারা তেমন মানুষ হলে আমাকে বাধ্য করতে পারতেন। চন্দ্রা যদি ওনার সম্মান বাঁচানোর দোহাই দিয়ে আমাকে বিয়ের চাপ দিতো, বা ফিরোজ আঙ্কেল যদি মেয়ের সম্মান বাঁচাতে আমাকে অনুরোধ করতেন, আমার পেছনে ফেরার পথ থাকতো না। অথচ পুরো ঘটনায় যথেষ্ট বদনাম হওয়ার পরও চন্দ্রা আমাকে একবারও জড়ানোর চেষ্টা করেনি। বারবারই বলে গিয়েছে আমার সাথে তার কোনো সম্পর্ক নেই। না ফিরোজ আঙ্কেল আমাকে কোনো ইমোশনাল ট্রাপে ফেলার চেষ্টা করেছেন। সেই মেয়ের আপনাকে নিয়ে মিথ্যা বলার প্রয়োজন নেই। একসময় মৃদুলাও বিষয়টা বুঝতে পারবে। হয়তো সেদিন জুয়েনা আন্টিও বড়ো মেয়ের উপর মনের কষ্ট ভুলে যাবেন। কিন্তু আপনি নিজে কোনোদিন শান্তি পাবেন না। কেননা সত্য আপনি নিজে ঠিকই জানেন। না চন্দ্রা না মৃদুলা, কারও সাথেই আপনি সিরিয়াস ছিলেন না। এতদিন পর যদি মৃদুলার কাছে ফিরেও আসেন, সেজন্যই যে আপনি এরচেয়ে বেটার পাননি, আর পাবেনও না তা আপনার জানা। আই উইশ মৃদুলা বিষয়টা বুঝতে পারতো। আর আপনাকে নিজেই রিজেক্ট করতো।”
***
“আপু।”
“হুম।”
“তুর্য ভাই এসেছিল জানিস? দাদি খুব খুশি।”
চন্দ্রা ভাবলেশহীন ভাবে রঙতুলির আঁচড় দেয়। যে পরিবারে সে বৌ হয়ে যাচ্ছে। সে পরিবারের আর্থিক অবস্থা ভালো। কিন্তু হাত ভর্তি চুড়ি নিয়ে ছেলের বৌয়ের খুন্তি নাড়তে দেখতেই তারা অভ্যস্ত। বই পড়া, ছবি আঁকা এসব শখ যে সেখানে ভ্রুকুটি সৃষ্টি করবে তা চন্দ্রার বোঝা হয়ে গিয়েছে। স্কুলের চাকুরি চন্দ্রার ভালোবাসার জায়গা। ভদ্রলোক বলেছেন বিষয়টা তিনি দেখবেন। স্কুল শিক্ষিকার চাকরি সম্মানের চোখে দেখা হয় সবজায়গায়। তাই চাকরি হয়তো ছাড়তে হবে না।
মৃদুলা কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলে,
“মাহতাব ভাই চলে গিয়েছেন। আর হয়তো দেখা হবে না। শুনেছি ঈদের পর নতুন বাসায় উঠবেন।”
চন্দ্রার তুলির আঁচড় থেমে যায় একমুহূর্তের জন্য। বিষয়টা মৃদুলা খেয়াল করে।
“আপু, সেদিন কী হয়েছিল? আবার আমাকে বলবে?”
“বলেছি তো। কিছু হয়নি। আমার ভুল হয়েছিল। কান্নারত অবস্থায় মাহতাবের কাঁধে মাথা দিয়ে ফেলেছিলাম। আর কিছুই না। মাহতাব কোনো অন্যায় সুযোগ নেয়নি।”
“আর তুর্য?”
চন্দ্রা ঘুরে বসে।
“মৃদুলা,আমি জানি তুই আমাকে অপছন্দ করিস। এর দোষ আমি তোকে দেই না। এই বিষ তোর মনে একদিনে প্রবেশ করেনি। বছরের পর বছর ধরে দাদি প্রবেশ করিয়েছেন। আমি যদি তোকে বলতে পারতাম দাদি কেন করেছেন এমন। হয়তো তুই বুঝতে পারতি। কিন্তু… বাদ দে। তুই তুর্যকে পেয়ে খুশি থাকলে আমার দোয়া থাকবে সবসময়। তুই না চাইলে বিয়ের পর আমি এ বাড়িতে আসবও না। তোর যেন বিন্দুমাত্র অস্বস্তি না লাগে আমি তাই চেষ্টা করবো। তবু বলি কিছু মানুষের স্বভাব পরিবর্তন হয় না।”
“তুমি তো অনেক বোঝো তাই না? আমিও বুঝি কিন্তু একটু দেরি হয়। দাদির তোমার প্রতি বিদ্বেষের কারণ তোমার রঙ। যে রঙ দাদিকে তার অতীতে নিয়ে যায়।”
চন্দ্রা থ হয়ে বসে থাকে। মৃদুলা আবার বলে, তুমি এ কথাটা কবে থেকে জানো? চন্দ্রা চুপ করে থাকে কিছুক্ষণ। তারপর বলে,
“বাবা আমাকে ওনার কাছে নিয়ে গিয়েছিল। জানিস ওনার চেহারার সাথে আমার চেহারার আশ্চর্য মিল। দু’জনেরই চিবুকের কাছে এই মস্ত বড়ো তিল। মৃত্যুসয্যায় ছিলেন। বাবা ওনার দেখাশোনা করতেন আড়াল থেকে। মারা যাওয়ার আগে পরিচয় দিয়ে সামনে এসেছিলেন। তিনি আমাকে খুব আদর করলেন। এর কিছুক্ষণ পরই মারা যান।”
“তিনি কে?”
“বাবার আসল মা। দরিদ্র অসহায় এতিম মহিলা ছিলেন। স্বামী পরিত্যক্তা। দাদাজানের গ্রামের বাড়িতে কাজ করতেন। দাদা জমাজমি দেখতে যেতেন। আর…”
“বাবা ঐ মহিলার সন্তান ছিলেন? দাদার অবৈধ সন্তান?”
“দাদির শুধু মেয়ে হচ্ছিল। বংশ রক্ষার জন্য ছেলে প্রয়োজন ছিল। বাবাকে গ্রহণ করে দাদি এই বাড়িতে নিজের স্থান ধরে রেখেছেন। এছাড়া তিনি করতেনই বা কী? তিনটি মেয়ের জন্মের পর চতুর্থ বার ওনাকে বাড়ি পাঠিয়ে দেওয়া হয়। দাদির বাবার বাড়ির অবস্থা এমন ছিল না যে তারা তিনটি নাতনি সহ মেয়েকে রেখে দিবেন। দাদার দেওয়া সমাধানই মন মতো হয়। দাদির বাড়ির মানুষেরাও দাদিকে এসব চেপে গিয়ে দাদাকে গ্রহণ করার পরামর্শ দেন। দাদি এ বাড়িতে ফিরে আসেন পুত্র সন্তানকে কোলে নিয়ে।”
“দাদির কী হয়েছিল?”
“মৃত সন্তান হয়েছিল। দাদার প্রতারণার কথা জানতে পেরে মাথা ঘুরে পড়ে গিয়েছিলেন। বাচ্চা পেটের ভেতর আঘাতেই নষ্ট হয়ে যায়। ভালোই হয় দাদার জন্য। আরেকটা মেয়ের বাবা ওনাকে হতে হয়নি। বরং সে জায়গায় নিজের… তবে তিনি দাদিকে কথা দিয়েছিলেন ঐ মহিলার সাথে কোনো যোগাযোগ রাখবেন না। রাখেনওনি আর। একালীন কিছু টাকা পয়সা দিয়ে বিদায় দিয়েছিলেন। কোনো এক লোকের সাথে বিয়ে দিয়ে পারও করে দিয়েছিলেন। সেখানে আর সন্তানাদি হয়নি।”
“বাবা কখন জানতে পারলেন?”
“মায়ের ভালোবাসা এমন একটা জিনিস যা অনুভব করার জন্য সন্তান হৃদয় যথেষ্ট। তোর কি মনে হয় না তিন কন্যার পর আরাধ্য ছেলের জন্মের পর বাবার প্রতি দাদির যে ভালোবাসা থাকার কথা, তা কোনোদিনও ছিল না? দাদা ভালোবাসতেন, কারণ যতই হোক, তার রক্ত। দাদি শুধু লালন-পালন করেছেন। বাধ্য হয়ে, মুখ বুঝে। এত বছর পর যখন আর সংসার রক্ষার বাধ্য বাধকতা নাই। দাদি প্রায়ই বিদ্রোহী হয়ে যান। প্রতিমুহূর্তে ওনার মনে হয় দাদা ওনাকে, ওনাদের মেয়েদের ঠকিয়েছেন। আর দাদারও ধারণা দাদি বাবাকে ঘৃণা করেন। তাই বাবার জন্য এই বাড়িটা জীবিত থাকতেই লিখে দিলেন। তবে কী জানিস দাদি মানুষটা আসলে খারাপ না। আমার চেহারা, গায়ের রঙ দেখলেই প্রতিমুহূর্তে স্বামীর প্রতারণার কথা ওনার মনে পড়ে। আর আমাকে বাবা ভীষণ ভালোবাসে। তাই আমাকে আঘাত করে দাদি বাবাকে কষ্ট দেয়। বাবাকে কষ্ট দিলে দাদাও আঘাত পায়। এ ওনার অদ্ভুত প্রতিশোধ।”
মৃদুলা এসে বোনকে জড়িয়ে ধরে।
“আমি এত বোকা কেন আপু? আমি কেন কিছু
টের পাই না? এজন্য দাদির মনটা এতটা তিক্ততায় ভরা। শুরুতে মাকে আঘাত করে বাবাকে কষ্ট দিতো। আর এখন তোমাকে দিয়ে।”
“কিন্তু তুই এসব কিভাবে জানলি?”
“বাবা বললেন।”
“বাবা!”
(চলবে)
সেই মেয়েটা চন্দ্রাবতী
পর্ব ২৪
“বাবা, কেন বললো এসব কথা?”
“বাবা না বললে বুঝতেই পারতাম না, তোমাকে বাবা বেশি ভালোবাসে বলে যে আজন্ম অভিযোগ আমার ছিল, তা আসলে ভুল। বাবা তোমার মাঝে নিজের আসল মায়ের ছায়া পান। সেই মমতাও এই আদরের কারণ নয়। দাদির অযথা আক্রোশ, গায়ের রঙ নিয়ে আক্রমণ থেকে তোমার যে মনের কষ্টগুলো জন্ম নিতো। তা দূর করতে কারও মায়ার স্পর্শ প্রয়োজন ছিল। এতে আমার ভালোবাসায় ঘাটতি হয়নি। কিন্তু মনে হিংসা ঠিকই হয়েছে। সেই হিংসা থেকে মাকে শুধু আমার করে ফেলতে চাইলাম। তোমার প্রতি মায়ের বিরক্তি জন্মালে নিজের জয় ভাবলাম। কিন্তু বিশ্বাস কর আপু, আমি কখনোই মনে শান্তি পাই নাই। হয়তো এইজন্যই যে আমি তোমার সাথে অন্যায় করেছি। বাবা আমাকে বোঝালেন, তোমার জন্য বাবার মায়ার চাদর বিছিয়ে দেওয়ায় তো আমার আদর তো কম হয়নি। অথচ আমি সবসময় ভেবেছি তুমি আমার আদরে ভাগ বসাচ্ছ, বাবা তোমাকে মাথায় করে রাখে, মা আগলে রাখে। যাকে আমি ভালোবাসি, তাকেও তুমি নিতে চাইছ। সত্যি বলতে আমার মনে হতো আমার সৌন্দর্যকে তুমি হিংসে কর। আমার সবকিছুই তুমি তাই নিয়ে নিতে চাও। অথচ তুমি না, আমিই চেয়েছি তোমার কাছে কিছুই না থাকুক।”
“তুর্য ভাইয়ের প্রতি আমার কোনো অনুভূতি নাই। তুই নিশ্চিন্ত থাক।”
“আর মাহতাব ভাইয়ের প্রতি?”
“তার প্রতিও নাই। তার প্রতি কেন থাকবে?”
চন্দ্রা তাড়াতাড়ি রঙ তুলি গুটিয়ে উঠে দাঁড়ায়।
“মাহতাব ভাইয়ের কিন্তু আছে। আমি স্পষ্ট টের পেয়েছি। সে যখন তুর্য ভাইয়ের কাছে তোমাকে নিয়ে বলছিল। মনে হচ্ছিল…”
“কী মনে হচ্ছিল? কিছুই না। কিন্তু তুর্য ভাই, মাহতাবের সাথে কথা বলতে গেল কেন?”
“ভালোই হলো। তোমাকে নিয়ে খারাপ কথা বলতে গিয়েই তো নিজের আসল চেহারাটা প্রকাশ করলো। হয়তো আগেই প্রকাশিত ছিল। কিন্তু আয়নাটা তোমার হাতে ছিল বলে আমি অবিশ্বাস করেছি। সব তোমার বানানো কথা ভেবেছি। আজ আড়াল থেকে না শুনলে এই সত্যের আয়না আমার কাছে কখনোই উন্মোচন হতো না। না জেনে এতদিন তোমাকে কম দোষারোপ তো করি নাই। এমনকি মাহতাব ভাইয়ের কাছেও তোমাকে নিয়ে এলোমেলো কথা বলেছি। আমি তো দাদীর চেয়েও খারাপ।”
“তুই মোটেও খারাপ না। খারাপ হলে এসব বলতি? এখনো নিজের জায়গায় অটল থাকতি। আমিও পুরাপুরি ভালো না। মায়ের কাছে বাবার সত্য লুকিয়েছি। দাদি আমাকে কেন পছন্দ করে না, তা জানার আগে থেকেই দাদিকে অপছন্দ করেছি। একদিন দাদির দুধের ভেতর চুন মেশাতে গিয়েছিলাম। যেন খেয়ে মুখ পুড়ে যায়। আর আমাকে কালি কালি ডাকতে না পারে। সেদিন বাবার কাছে ধরা পড়ে যাই। আমার মনে যে দাদির উপর রাগ, ঘৃণা জন্ম নিয়েছে, বুঝতে পেরে বাবা আমার কাছে সত্যটা প্রকাশ করেছেন। বল ভালো হলে আমি এমন কাজ করতে যেতাম বল? সত্য জানার পরও আমি দাদিকে পছন্দ করতে পারি নাই। মাফ করতে পারি নাই। ওনার পছন্দ অপছন্দের গুরুত্ব আমি কখনোই দেই না। বাবা দেয়। সব জানার পরও দেয় আমি পারি না। আর শোন, একে তো মাহতাব আমার ছোটো। তাছাড়া আমার জন্য ওর কম সমস্যা হয়নি মৃদুলা। ওর চাকরির সমস্যা পর্যন্ত হলো। আমি বোকার মতো আবেগি হয়ে ওরে কম বিপদে ফেলি নাই। ও যাক। সেই ভালো।”
“উনি তোমাকে পছন্দ করেন।”
“করুণা করে। পছন্দ আর করুণার মধ্যে পার্থক্য আছে। আমাকে পছন্দ করার কোনো কারণ নাই।”
“তাই বলে তুমি শফিক সাহেবকে বিয়ে করবে?”
“সমস্যা কী? ভালো মানুষ। নম্র, ভদ্র, আয় রোজগার করা লোক। আমাকে পছন্দ করেছেন। লোকটার বয়স সামান্য বেশি। তাতে কী, মেয়ে হিসেবে আমারও বয়স হয়েছে।”
“সাতাশ কোনো বয়স হলো?”
“তাহলে পুরুষের জন্য সাইত্রিশ, আটত্রিশও কিছু না।”
“লোকটার মাথায় চুল কম। বয়স্ক লাগে।”
“আমিও কোনো মহা সুন্দরী না।”
“তুমি অনেক সুন্দর। তোমার মনটা কত সুন্দর একসময় আমিও ভাবতাম চামড়ার সৌন্দর্যই সুন্দর।”
“তাহলেও সেই লোক সুন্দর। ওনার মন মানসিকতাও ভালো। তুই অযথা এ নিয়ে আর কথা বলবি না। বিয়েটা হতে দে। তুই যে তুর্যের চক্কর থেকে বের হয়েছিস। আমি তাতেই খুশি।”
***
“মাহতাব, দাদাভাই। কতদিন পর দেখলাম তোমাকে।”
“দাদাজান, আপনার শরীর তো অনেক খারাপ করেছে। আপনি আমাকে ফোনে তো বুঝতেই দেননি। বিছানায় পড়ে গিয়েছেন রীতিমতো।”
“বয়স দাদাভাই। বয়স।”
“আম্মু এখনো বাসায় থাকে না?”
“না থাকলেও সমস্যা নাই। দুটো কাজের মানুষ আছে।”
“আপন মানুষের যত্ন তো কাজের লোক দিয়ে হয় না।”
“যত্ন পাওয়ার মতো কোনো কাজও তো আমি করি নাই দাদাভাই।”
“আপনি বাড়ির বড়ো।”
“অনেক সময় বড়ো হইলেই সম্মান পাওয়ার যোগ্য হয় না দাদাভাই। মায়েরে ভুল বুইঝো না। তোমার মা মেয়ে খুবই ভালো।”
আজ দাদাজান বারবার মায়ের পক্ষ নেয়। মাহতাব বোঝে দাদার শরীরের সাথে মনও ভেঙে গিয়েছে। এমনিতেও দাদা, মাকে নিয়ে বদনাম করেন না। কিন্তু এভাবে পক্ষ নিয়ে দ্বন্দ্বও করেন না।
“তোমার বোনের সাথে, মায়ের সাথে রাগ রাইখো না দাদাভাই। মা, বোনের মতো আপন কে আছে বলো। তুমি আজ একবার বোনরে ফোন দিবা। এইটা আমার অনুরোধ। তারে দেশে আসার কথা বলবা। আমি বললে সে আসবে না। তুমি বললে আসবে। আমার মন বলতেছে সময় বেশি নাই। মরার আগে নাতনিটারে দেখতে চাই।”
***
“আপু, তুমি একবার দেশে আসো। দাদার শরীর ভালো না।”
“আমি বরং টিকেট পাঠাই। তুই আম্মুকে নিয়ে এখানে আয়। আমি তোদের পাকাপাকি ভাবে নিয়ে আসার কাজও শুরু করতে চাই।”
“আমি বললাম দাদার শরীর ভালো না।”
“তাই তো বললাম। দাদা না থাকলে তো দেশে আর কোনো পিছুটান থাকে না।”
“তুমি এভাবে বলতে পারো! দাদাজান মারা যাওয়ার অপেক্ষায় আছ?”
“আমি কিছুর অপেক্ষায় নেই। তাই বললাম যা স্বাভাবিক।”
“তোমার, আম্মুর, তোমাদের কি মনে হয় না, বড়ো অমানবিক কথা তোমরা সাধারণ ভাবে বলে ফেল?”
“হ্যাঁ ফেলি। কারণ আমরা এমন কিছু জানি যা তুই জানিস না। তোকে জানাতে চাই না, কারণ তুই তা নিতে পারবি না। সেজন্য তুই যত সহজে দাদার জন্য নরম হোস, আমি পারি না। আমার চোখে আমার আম্মুর মুখ ভাসে।”
“আর আব্বুর মুখ? আব্বুর মুখ ভাসে না? আব্বুও তোমাকে না দেখতে পেয়ে মারা গেলেন। দাদার এমন অবস্থায়ও আসবে না? এত কিসের অভিমান? যা মানুষের চেয়েও বড়ো।”
“আম্মু, আব্বুকে এড়িয়ে যেত, এই ধারণা থেকে তুই আম্মুর উপর অভিমান রাখিস নাই? সেই অভিমানের জোরে তুই ঢাকায় আম্মুকে ফেলে গ্রামল গিয়ে চাকরি করিস নাই?”
“করেছি। তবে আমি আম্মুকে ত্যাগ করিনি। তুমি আব্বু আর দাদাকে করেছ।”
“আমিও ত্যাগ করিনি।”
“তবে?”
“সেই উত্তর আমার কাছে নেই। আমি শুধু চাই তুই দেশের মায়া কাটিয়ে এখানে এসে সেটেল্ড হও। মামা পারিজাতের সাথে তোর বিয়ে দিতে এখনো রাজি। শুধু তুই বাইরে সেটেল্ড হ।”
“আমি তো রাজি না।”
“তুই পারিজাতকে বিয়ে করতে রাজি না।”
“নাহ। ঐ মোহ আমার অনেক আগেই ভঙ্গ হয়েছে।”
মাহতাবের এমন নিরাসক্ত কথায় বোন অবাকই হলেও মাহতাব সত্যিই বলেছে। মামাতো বোন পারিজাতের মোহ তার সত্যি ভঙ্গ হয়েছে।
(চলবে)