সেই মেয়েটা চন্দ্রাবতী পর্ব-২৫+২৬

0
9

সেই মেয়েটা চন্দ্রাবতী
পর্ব ২৫

“মেহের আসতেছে দাদাভাই?”

মাহতাব চুপ করে থাকে। ওয়াহিদউল্লাহ সাহেব বুঝতে পারেন, নাতনি এবারও আসবে না। চোখের কোল ঘেঁষে জল গড়িয়ে পড়ে।

“দাদাভাই কাঁদবে না। আমি তো আছি। তুমি সুস্থ হও, তোমাকে আমার বাসায় নিয়ে যাব। এখানে একা থেকে তুমি আরও অসুস্থ হয়ে যাচ্ছ।”

“সেখানেও তো একাই থাকব দাদাভাই।”

“থাকবে না। আমি ব্যবস্থা করব। গ্রামে তোমার ভালো লাগবে। এলাকায় ঘোরাঘুরি করবে। দীঘির পাড়ে খোলা বাতাসে বসবে। তোমার বন্ধু রহমত সরকার একদম ফিট জানো। আমি বুঝলাম কেন। তিনি খোলা আলো হাওয়া পান, হাঁটাহাঁটি করার জন্য জায়গা পান। তুমি এই চারদেয়ালে থেকে আলো বাতাসের অভাবে শেষ হয়ে যাচ্ছ। চলো তোমার বন্ধু এমনিতেও দাওয়াত দিয়েছেন, ওনার বড়ো নাতনির বিয়ে। বিয়ে খাব চলো।”

***

“মাহতাব, তুমি নাকি তোমার দাদাকে নিয়ে গ্রামে শিফট হচ্ছ!”

“তোমাকে কে বললো? আচ্ছা সখিনা? বাসার কাজ ফেলে কান খাড়া করে এসব শোনে? তুমি আবার কাজের লোকের কথায় এত প্রভাবিত কবে হতে শুরু করলে! যাই হোক, হ্যাঁ নিয়ে যাব। দাদা ভাই এখানে একা হয়ে গিয়েছেন। তুমি সারাদিন বাইরে থাকো।”

“ওনার দেখাশোনা করার জন্য লোক আছে।”

“লোক সেবাযত্ন করবে আম্মু। ভালোবাসা দিতে পারবে না। তুমি কবে বুঝবে মানুষ দেখাশোনার অভাবে মারা যায় না। মানুষ মারা যায় ভালোবাসার অভাবে। যে অভাবে আমার বাবা মারা গিয়েছিল। যে অভাবে আমি মারা যাচ্ছিলাম।”

“তাই যদি হতো তবে সবার আগে আমি মারা যেতাম মাহতাব। দেখ আমি তো বেঁচে আছি।”

“কারণ তুমি স্বার্থপর। সারাজীবন তুমি শুধু নিজেকে ভালোবেসেছ।”

“তোমার তাই মনে হয়?”

“হ্যাঁ। আর আপুকেও তুমি তেমনই বানিয়েছ। তুমি কেন পড়ে আছ এদেশে? তুমি আর আপু দুজনই বাইরে চলে যাও। আমার তোমাদের কাউকে প্রয়োজন নেই।”

***

“তুই আম্মুকে কী বলেছিস?”

“কী বলেছি?”

“তুই আম্মুকে স্বার্থপর বলেছিস?”

“ভুল বললাম? তুমিও তো তাই।”

“হ্যাঁ ভুল বলেছিস। তুই ভীষণ ইমোশনাল, আব্বুর নেউটা ছিলি। এই কারণে আম্মু তোকে সত্য থেকে আগলে রাখলো। আর দাদাভাই, এখনো কী সুন্দর চুপ করে আছেন।”

“কী সত্য।”

“সে কথা তুই দাদাকে জিজ্ঞেস কর।”

“তুমি বল। দাদাভাই অসুস্থ মানুষ। তাকে আমি কোনো চাপ দেব না।”

“আর আম্মুকে দিতে পারবি? বাহ।”

“আমি তাই বলেছি যা সত্য।”

“সত্য জানতে চাস? তবে শোন। এতদিন বলিনি কারণ আমি তোকে সব মিথ্যা থেকে দূরে রাখতে চেয়েছি। আম্মু চেয়েছিল বাবার প্রতি তোর যে আবেগ তাতে ধাক্কা না আসুক। সত্যিটা হচ্ছে আব্বু আম্মুর বিয়েটাই ভুল ছিল। তবু এই ভুল থেকে জন্ম নেওয়া আমাদের দু’জনকে আগলে রেখে আম্মু সেই ভুলকে টেনে নিয়ে গিয়েছেন। তবু শেষ রক্ষা হয়নি।”

***

“দাদাভাই, তোমার বাবার বিয়েটা আমার ইচ্ছায় হয়। আমার খুব শখ ছিল ছেলেকে অভিজাত পরিবারে বিয়ে দিব। কিন্তু ছেলে যে আমার দোকানের ক্যাশিয়ারের মেয়েকে পছন্দ করতো তা জানতাম না। তোমার আম্মুরে আমি একটা বিয়ার অনুষ্ঠানে দেখি। শিক্ষিত, সুন্দর মেয়ে। একমাত্র ছেলের বৌ হিসেবে খুব পছন্দ হয়। জীবনে ব্যবসা বাণিজ্য করে টাকা আয় করছি, অভাব ছিল পারিবারিক আভিজাত্যের। তোমার আব্বু পড়ালেখায় খুব একটা আগ্রহী ছিল না। পড়ালেখা মাঝপথে রেখে ব্যবসায় ঢুকে গেল। পরবর্তী বংশধর শিক্ষিত করতে, একটা শিক্ষিত মেয়ের বিকল্প নাই তাই ভাবছি।”

“এখন কী মনে হয় না ভুল করেছেন? আব্বুকে তার পছন্দে সঙ্গী বাছতে দিলে ভালো হতো।”

“তোমার মা ভুল পছন্দ ছিল না দাদাভাই। ভুল আমার ছেলে ছিল। সে আমাকে বলে নাই যে তার অন্য পছন্দ আছে। সে আমার পছন্দে তোমার আম্মুকে বিয়ে করলো। অথচ অন্য সম্পর্ক থেকে বেরও হয় নাই। এটাই সবচেয়ে বড়ো সত্য দাদাভাই। একসময় সে তার ভুল বুঝেছে। অনেক টাকাপয়সা খরচ করে সেখান থেকে বেরও হয়ে এসেছে। কিন্তু ততদিনে তোমার মায়ের মনটা শুকনো খটখটা হয়ে গিয়েছিল দাদাভাই। এই সম্পর্ক ভেঙেই যেত হয়তো। তোমার মামা, নানা বাড়ির মানুষ যদি তখন শক্ত হাতে তোমার আম্মুরে নিয়া যাইত, আমি আটকাতে পারতাম না। কিন্তু তোমার নানা বৃদ্ধ হয়ে গিয়েছিলেন, ওনার সামাজিক মর্যাদা থাকলেও মানসিক, শারীরিক সেই শক্তি ছিল না। সে সুযোগটা আমি নিলাম। তোমাদের বাহানায় তোমার মারে আমাদের সংসারে রেখে দিলাম। অন্যায় তোমার মায়ের সাথে হইছে দাদাভাই। সে লোককে কী করে ভালোবাসা যায়। একসময় তোমার বাবা অনেক আর্থিক ক্ষতির শিকার হইছে। ধোঁকা খাইছে। তারপর নিজেরে শুধরাইছে। সংসারটা টিকছে ঠিকই। কিন্তু তার প্রাণ নাই হইয়া গিয়েছে। মেহেরের উঠতি বয়সের ঘটনা। সে তার বাবারে তাই কোনোদিন মাফ করতে পারে নাই। তুমি ছোটো ছিলা। তোমার বাড়ন্ত বয়সে তোমার বাবা সংসারী হইলেন ঠিকই কিন্তু সংসারের সুর যে ততদিনে কাইটা গেলো দাদাভাই। বাবার জন্য তোমার ভালোবাসা দেইখা মনে শান্তি পাই। কিন্তু মায়ের জন্য মনে রাগ রাইখো না। তোমার মা নিজের মনের অসুখ দূরে রাইখা নিজেরে ব্যস্ত রাখছে। আমার সাথে কোনোদিন বেয়াদবি করে না। তোমার মনে কখনো বিষ ঢুকায় নাই। তুমি তারে ভুল বুইঝো না। আমার তোমারে আরও আগেই এসব বলা উচিত ছিল। আমিই ছেলের সত্য লুকাইছি। মনে হইতো তুমি তারে সম্মান কর, সেই সম্মান নষ্ট না করি।”

***

“হ্যালো, মাহতাব। কিছু হয়েছে?”

হুট করে মাহতাবের ফোন পেয়ে অবাক হয় চন্দ্র। আগামীকাল চন্দ্রার গায়ে হলুদ। এই বাড়িতে দিন ফুরিয়ে আসছে চন্দ্রার। শফিক লোকটা যথেষ্ট ভালো। চন্দ্রার প্রতি সম্মান রেখেই কথা বলেন। তবু গতকাল রাতে ফোনে মাহতাবের কথা ঠিকই তুললেন। আসলে মফস্বল এলাকায় গুজব ছড়াতে সময় লাগে না। শফিক যখন মাহতাবের বিষয়ে জানতে চায়, চন্দ্রার উচিত ছিল বিষয়টা হেসেই উড়িয়ে দেওয়া। কিন্তু চন্দ্রা তা পারলো কই! বিয়ের দিন যত ঘনিয়ে আসছে, তত আদিম অকৃত্রিম এক অনুভূতি চন্দ্রাকে গ্রাস করছে। তাই মাহতাবের সাথে তার কোনো সম্পর্ক নেই এই কথাটা মুখে আনা যত সহজ, মাহতাবের জন্য তার কোনো অনুভূতি নেই তা বলাটা ততটাই কঠিন। তবু নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করেছে। মাহতাবের সাথে যোগাযোগের বিন্দুমাত্র চেষ্টা করে না

সেই মেয়েটা চন্দ্রাবতী
পর্ব ২৬

“মাহতাব, বাসায় কিছু হয়েছে? না অফিসে? আমি জানি তুমি কিছু বলতে চাও।”

“আমি স্যরি বলতে চাই।”

“আটিকে? না আপুকে?”

মাহতাব একটু অবাকই হয়। চন্দ্রা বিষয়টা আন্দাজ করবে বুঝেনি।

“মাহতাব, অবাক হওয়ার কিছু নেই। আমি তো তোমাকে আগেও বলেছি, একসময় তুমি হয়তো বুঝতে পারবে আন্টির আচরণের কোনো না কোনো ব্যাখ্যা আছে। তিনি আঙ্কেলের প্রতি নির্মোহ ছিলেন। নারী হিসেবে আমি এইটুকু বুঝি, নিজের সবচেয়ে কাছের মানুষের প্রতি কখন কেউ নির্মোহ হয়ে যায়। কখন তার ভালো থাকা মন্দ থাকা কিছুই আর স্পর্শ করে না। আমার দাদিকে দেখ, দাদার প্রতি অনুভূতি শূন্য। কিন্তু তিনি হয়তো আন্টির মতো উচ্চশিক্ষিত, অভিজাত মহল থেকে না আসায় তার আচরণে ঠান্ডা ভাব কম। নিজের বিরক্তি স্পষ্ট বুঝিয়ে দেন। আর আন্টি তার উল্টো। যতদিন গিয়েছে নিজেকে ততটাই বরফ শীতল করে নিয়েছেন। তুমি তার শীতলতা দেখেছ, কারণটা দেখনি বলেই ভুল বুঝতেছিলা। আপু কারণটাও দেখেছেন। তাই তিনি বাবার চেয়ে মায়ের দুঃখ বেশি অনুধাবন করছেন। হয়তো সে জন্য তিনি বিয়ে বিমুখ হয়েছেন।”

“আসলে আমি কখনোই বুঝিনি যে আব্বুর এমন একটা অতীত…”

মাহতাব চুপ করে যায়। বাবাকে সে ভীষণ ভালোবাসে। এখনো মবের ক্ষোভের জায়গায় ভালোবাসা রয়ে গিয়েছে। বাবাকে নিয়ে খারাপ কথা বলতে মুখে বাঁধে।

“মাহতাব, তুমি আন্টির কাছে ক্ষমা চাওয়ার জন্য মনে হয় না আঙ্কেলকে ক্ষমা না করার দরকার আছে আর। তিনি তো সবকিছুর ঊর্ধ্বে এখন। মায়ের মন খুব নরম হয়। যতই শক্ত খোলস পড়ুক। আমার মা যখন আমার উপর প্রচন্ড রেগে ছিলেন, তখনও আমার খারাপ চান নাই। আমি বুঝি। আমাকে কষ্ট দিয়ে খোঁচা দিয়ে কথা বলে নিজেই আবার কষ্ট পেত।”

“আন্টির সাথে আপনার সম্পর্ক ঠিক হয়েছে?”

“হুম। মা, মৃদুলা সবার সাথে। এর জন্য কিছুটা কৃতিত্ব তোমারও প্রাপ্য। মাঝেমাঝে মনে হয় কিছু ঠিক করার জন্য কিছু এলোমেলো করতে হয়।”

“বিয়েটা তাহলে আর হচ্ছে না তাই না?”

“নাহ! বিয়ে হবে না কেন? আগামীকাল হলুদ। পরদিন বাদ যোহর বিয়ে।”

“সব ঠিক হলে বিয়ে কেন করছেন?”

“মায়ের সাথে, মৃদুলার সাথে সব ঠিক হওয়া না হওয়ার উপর তো বিয়ে নির্ভর করছিল না।”

“আমি তো ভেবেছি আপনি মৃদুলার জন্য নিজেকে সাক্রিফাইস করছেন।”

“এ কেমন আশ্চর্য কথা! মাহতাব আমি এখন রাখি। ভালোই হলো কথা হলো। আমার শ্বশুর বাড়ি একটু রক্ষণশীল পরিবার। হয়তো প্রয়োজন ছাড়া কথা বলা হবে না। আর প্রয়োজন কখনো হোক, তাও চাইব না। ভালো থেক। আমি বলব তুমি পারিজাতের সাথেও সব মিটমাট করে নাও।”

“আগে বলুন কথা না হবার কারণ কী?”

“তো বিয়ের পর আমি ফোন ব্যবহারে অনেকটাই…”

“অনেকটাই নিয়ন্ত্রিত হবেন? আশ্চর্য।”

“এখানে আশ্চর্যের কী আছে? আমার হ্যাসবেন্ড, শ্বশুর বাড়ির মানুষ পছন্দ না করলে তেমন কাজ থেকে বিরত থাকাই কী বুদ্ধিমানের হবে না?”

“আমার সাথে কথা বললে অপছন্দ করবে কোন?”

“মাহতাব, তুমি বিষয়টা অন্য ভাবে নিচ্ছ। তোমার কোনো প্রয়োজন হলে অবশ্যই কথা হবে। যেমন এখান থেকে যাওয়ার পর তুমি কি ফোন দিয়েছ? আমি দিয়েছি? প্রয়োজন ছিল না। মানসিক ভাবে তুমি আমাকে বুঝ, আমিও তোমাকে বুঝি। এই প্রয়োজনটা হলে আমি চেষ্টা করবো। তবে সেই প্রয়োজন আর না আসুক, তাই চাইব।”

‘”মানে আপনি আমাকে ইনডিরেক্টলি আর কল করতে না করছেন। আপনার হবু হ্যাসবেন্ডের পছন্দ হবে না। তিনি রাগ করবেন। একটা বুড়ো হাবড়া লোক, এ বয়সে বৌ পাচ্ছে তাতেই তার শুকরিয়া আদায় করে আপনাকে মাথায় করে রাখা উচিত। তার এত ভাব শর্ত তো মানায় না।”

“মাহতাব, তুমি কিন্তু এলোমেলো কথা বলছ। সে বুড়ো হাবড়া বলে, আমিও বুড়ী। আমারও তাকে মাথায় রাখা উচিত। সে যথেষ্ট ভালো মানুষ। ভালো আয় রোজগার করে। দায়িত্ববান।”

“সে বই পড়তে পছন্দ করে আপনার মতো? আপনি যে চমৎকার ছবি আঁকেন তা জানে? আপনার রুচি, মনন কোনো কিছু কি সেই পরিবারের মানুষদের সাথে মিলে?”

“বিয়ের পর মেয়েরা শ্বশুর বাড়ির ধাঁচে মানিয়ে যায়।”

“তা মনের বিরুদ্ধে হলেও?”

“মাহতাব, রাত যথেষ্ট হয়েছে। আমি রাখি। তাছাড়া আমার কল আসছে অনেকক্ষণ ধরে।”

“ভদ্রলোক কল দিয়েছেন নাকি? ওয়েটিং দেখলে বারবার কল দেওয়ার কী আছে? ম্যানারলেস।”

“আমার মনে হয় এখন ম্যানারলেস আচরণ তুমি করছ। শুধুমাত্র তোমার মানসিক অবস্থার কথা ভেবে আমি কিছু বলছি না। রাখলাম।”

মাহতাব জানে না চন্দ্রা ঠাস করে ফোন রেখে দেওয়ার পর ওর এত রাগ উঠছে কেন। জেলাস হওয়ার কোনো কারণ নেই। বরং চন্দ্রাই সঠিক। তবু ঠিক ভুলের ঊর্ধ্বে গিয়ে মন বিচলিত হয়ে যাচ্ছে।

(চলবে)