সেই মেয়েটা চন্দ্রাবতী
পর্ব ২৯
চন্দ্রা জানালা খুলে দেয়
“তুমি! তুমি এখানে কী করছ?”
“আমার সাথে এখানে আসার রাস্তার শত্রুতা আছে মনে হয়। যখনই বের হই হয় ট্রেন লেট হয়, বাসের অবস্থা ভয়ানক। আজ গাড়ি নিয়ে বের হলাম, কাছাকাছি এসে চাকা পাংচার। সন্ধ্যা ছয়টার জায়গায় তাই রাত বারোটাই বাজলো। এত রাতে এই লাইব্রেরি রুমে আলো জ্বালিয়ে খুটখাট শব্দ আর কে করবে? তাই দরজা না খটখটিয়ে জানালাতেই এলাম।”
“কিন্তু তুমি এখানে কেন? মানে… ”
“ঢুকতে দিবেন না?”
“মাহতাব, বাড়িতে অনেক মানুষ। আমার তিন ফুপু এসেছেন। বাড়ির মহল অনেকদিন পর স্বাভাবিক। দাদা দাদি সবাই খুশি অনেকদিন পর। মা, মৃদুলার সাথে আমার সব ঠিক হয়েছে…”
“আমার উপস্থিতি সব নষ্ট করবে চন্দ্রা? আমি তোমার ক্ষতি চাই না।”
মাহতাবের মুখে আরেকবার স্পষ্ট চন্দ্রা ডাক শুনে অদ্ভুত শিহরণ হয় চন্দ্রার। মাহতাব তাকে তুমি করে বলতে শুরু করেছে! অথচ এই অনুভূতির প্রকাশ ঘটে চন্দ্রার চোখের পানিতে। কী আশ্চর্য! চোখের আচরণ এমন উদ্ভট কেন? আনন্দেও পানি ঝরে, দুঃখেও পানি ঝরে, কখনো কখনো এমন কারণ ছাড়াও ঝরে।
“কাঁদছ কেন? আমার উপস্থিতি তোমার ক্ষতি করলে আমি চলে যাব। যাওয়ার আগে একটা কথা বলি, তোমাকে ভীষণ সুন্দর লাগছে চন্দ্রা। একদম হলুদ পরীর মতো। পরীর ঠোঁটে হাসি মানায়, চোখে কান্না না।”
হলুদ রঙ ওর চাপা গায়ের রঙে ফুটেনি, এই কথাটা বেশ কবার শুনলেও হলুদ পরী লাগছে, এই কথাটা প্রথম শুনলো। কাঁচা হলুদ রঙ চন্দ্রার খুব প্রিয়। অথচ শ্যামল বর্ণে হলুদ ফুটে না, এই কথাটা এত শুনেছে যে এই প্রিয় রঙটা পরলে মনে অস্বস্তি লাগে। অথচ মাহতাব কী মুগ্ধ চোখে বলছে পরীর মতো লাগছে। মাহতাব জানালার গ্রিলে হাত দিয়ে ধরে ছিল। হাতের বাঁধন আলগা করে নেমে যেতে গেলে চন্দ্রা হাতটা চেপে ধরে।
“মাহতাব, তোমার আজ এ সময় এখানে থাকার কথা না। তুমি কেন এসেছ তা জিজ্ঞেস করতেও ভয় লাগে। কিছু কথা উচ্চারণ না হওয়াই ভালো।”
মাহতাব চন্দ্রার অন্য হাতটা দিয়ে চন্দ্রার হাত চেপে ধরে।
“আমি যে বলব বলে এতদূর এলাম। না হলে এখানে ফিরে আসার কোনো কারণ ছিল না। আমার নিজেকে যা প্রমাণ করার ছিল আমি করেছি৷ আমি চাইলেই এ চাকরি এখন ছেড়ে দিতে পারি। আর্থিক প্রয়োজন আমার নেই চন্দ্রা। যে মানসিক প্রয়োজন ছিল, তার প্রয়োজনীয়তা ফুরিয়েছে। তুমি ছাড়া এই শহরে থাকলে সে আমার জন্য অন্য রকম শাস্তি হবে।”
“খুব ভালো। আমি তোমার জন্য খুব খুশি। বহুদিন পর তুমি আন্টির কাছে ফিরে গিয়েছ। তোমার সম্পর্কগুলো সহজ হয়েছে। পারিজাতের সাথে তুমি দেশের বাইরে একটা সুন্দর জীবন কাটাতে পারবে।”
“আমি তো আমাদের জীবনের গল্প শুরু করতে ছুটে এসেছি। সব স্মৃতি পেছনে ফেলে। তোমার কাছ থেকে দূরে গিয়ে আমি বুঝেছি চন্দ্রা, যে শান্তির খোঁজে একদিন আমি ঘর ছেড়েছি, সে শান্তি তোমার কাছে ছাড়া আর কোথাও নেই। কারও কাছে নেই। আমি তোমাকে নিতে এসেছি।”
“এসব আর বলে না। কাল আমার বিয়ে। আমার জন্য এমনিতেই বাড়ির অনেক বদনাম হয়েছে।”
“আমি পালাতে বলছি না। তুমি শফিক সাহেবকে জানিয়ে দাও তুমি বিয়েটা করছ না। আমি আম্মু, দাদাভাইকে নিয়ে আসব।”
“আমি তোমার চেয়ে বয়সে বড়ো মাহতাব।”
“তো?”
“তো এটা মানায় না।”
“কেন না? বয়সে বড়ো ছেলের সাথে অহরহ বিয়ে হচ্ছে। তোমার হবু বর তোমার চেয়ে দশ বারো বছরের বড়ো।”
“সেটা সমাজে মেনে নেয়। সংস্কার মেনে নেয়।”
“আমার পরিবার এমন নয়। আমি এসব মানি না। তুমি আমাকে দেয়ালের এপাশে না রেখে ভেতরে আসতে দাও। আর না হয় তুমি এ দেয়াল ডিঙিয়ে চলে আসো। দেখবে এইটুকুই সাহস করতে হয়।”
“যাও মাহতাব। আমি এখন জানালা লাগাব।”
চন্দ্রা হাতটা ছেড়ে দেয়। মাহতাব নিজে নিজেই আওড়ায়,
“যে কান্নাগুলো আড়াল করে ঝরে পড়তে দিচ্ছ চন্দ্রা, তার স্থান তো আমার বুকে হতে পারতো। তোমার শাড়ির হলুদ রঙে আমার নামে লেখা থাকতে পারতো, সে শাড়ির আঁচলে মুখ ডুবিয়ে আমি তোমার ঘ্রাণ নিতে পারতাম। মাঝে বাঁধা হয়ে আছে শুধু একটা দরজা। দরজাটা খোলা তোমার হাতে চন্দ্রা। দরজাটা খুললেই আমি তোমার হতে পারি, তুমি আমার হতে পারো। অথচ তুমি জানালা বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নিলে। তবু জেনে রাখ আমি কোথাও যাচ্ছি না। আশেপাশেই আছি। সাহস কর খুট খুলে বের হলেই আমার নাগাল পাবে।”
(চলবে)
সেই মেয়েটা চন্দ্রাবতী
পর্ব ৩০
চন্দ্রা আস্তে আস্তে উপরে উঠে আসে। মাহতাব কি সত্যি বাইরে আছে কিনা জানালা খুলে দেখার সাহস হয় না। মাহতাবকে চন্দ্রা কষ্ট দিতে চায় না। তবু এখান থেকে ওকে না ফিরিয়েও উপায় ছিল না। মাহতাবের জন্য এই ভালো। এই কষ্ট সাময়িক। ও আবেগি ছেলে। ছটফটে, অস্থির মনের। চন্দ্রার প্রতি করুণাকে ভালবাসা ভেবে ভুল করছে। অচিরেই এই ভুল ভাঙবে। চন্দ্রা চাঁদের মতো সুন্দরী কেউ না, নিতান্তই সহজ সাধারণ দেখতে। বয়সও ঊনিশ কুড়ি না যে কমবয়সী মেয়ের প্রতি একটা অনুভূতি গড়ে উঠবে মাহতাবের। সে মৃদুলা হলেও এই আবেগটাকে প্রশ্রয় দেওয়ার সাহস করতো। কিন্তু সে চন্দ্রা। বরং এখনই এই বিষয়টার রাশ না টানলে সামনে আরও বেশি কষ্ট পেতে হবে। যতটা ঝড়ের মতো এসে মাহতাব ওর হাত চাইছে, ততটাই হাল ছেড়ে দিয়ে হাত ছেড়েও দিতে পারে। তখন চন্দ্রা নিজেকে সামলাবে কী করে? বিষয়টাকে মাহতাবের অনিয়ন্ত্রিত মনের আবেগ ছাড়া আর কিছু ভাবতে চায় না চন্দ্রা। মাহতাবের মা নিশ্চয়ই নিজের ভাইয়ের মেয়েকে বাদ দিয়ে চন্দ্রাকে পছন্দ করবেন না। পারিজাতের ছবি দেখেছে চন্দ্রা। কী ভীষণ সুন্দর, শহুরে ছাপ চলনে বলনে। পারিজাতকে বাদ দিয়ে ছেলের চেয়ে বয়সে বড়ো একটা মেয়েকে বৌ বানানোর ইচ্ছে ওনার না হওয়ারই কথা। বরং দেখা যাবে এর জন্য বাবা আর মাকে আবার কিছু কথা শুনতে হবে। যথেষ্ট অপমান, অপদস্ত ইতোমধ্যে তাদের হতে হয়েছে, আর দরকার নেই।
“কোথায় ছিলে আপু?”
“ঘুমাসনি?”
“ঘুম এসেছিল। হুট করে ভেঙে গেল। দেখি তুমি রুমে নাই।”
“লাইব্রেরিতে ছিলাম। কিছু জিনিস গুছিয়ে রাখলাম।”
“চিন্তা করো না। তোমার বই, ছবি আঁকার জিনিস আমি গুছিয়ে রাখব। তোমার ঠান্ডা লেগেছে? গলা কেমন ফ্যাসফ্যাসে শোনা যায়।”
বলতে বলতে মৃদুলা উঠে আসে। মৃদু আলোতে বোনের চোখের পানি নজর এড়ায় না।
“তুমি কাঁদছিলে? কী হয়েছে?”
“কিছু না। আজ এ বাড়িতে শেষ দিন। তাই একটু…”
দরজায় শব্দ হয়। জুয়েনা ঢুকেন রুমে।
“মা! ঘুমাওনি এখনো? রাত জাগলে তোমার মাথা ব্যথা করে।”
জুয়েনা এসে মেয়ের পাশে বসেন।
“চন্দ্রা, তুই বিয়ে করতে না চাইলে এখনো বল। কত মানুষের বিয়ের আসরের বিয়ে ভাঙে। হলুদ হয়েছে তো কী হয়েছে।”
“এসব কেন বলছ?”
“আমার মনে হচ্ছে তুই আমাদের দায়মুক্ত করতে এসব করছিস। কিন্তু আসলে তুই খুশি না। আমার নিজেকে অপরাধী লাগছে। তোর দাদির পাল্লায় পড়ে আমিও তোকে তাড়াতাড়ি বিয়ে করে নিতে চাপ দিলাম। তুইও সেই জেদে বিয়ে করে নিচ্ছিস।”
“শফিক সাহেব লোকটা অনেক ভালো মা।”
“তাকে খারাপ তো বলিনি। কিন্তু তার মা, বোন কাউকে আমার ভালো লাগে না। বিষাক্ত একটা শ্বশুর বাড়িতে আমি জীবন কাটিয়েছি। তোদের চোখেই দেখা সে জীবন। অনেক সময় স্বামীর ভালোবাসা যথেষ্ট হয় না। ভালো তোমাদের বাবাও আমাকে কম বাসে না। কিন্তু মা না স্ত্রী, এই দ্বন্দ থেকে বাঁচতে সে খুব কমই আমার ঢাল হতে পেরেছে। এর ভেতরও সে আমাকে আগলে রেখেছে ঠিকই কিন্তু আশেপাশের মানুষদের বিষাক্ততা ভালেবাসার রঙটাই মলিন করে দেয়। যাদের সাথে এক ছাদের নিচে বসবাস করতে হয়, তারা যদি প্রতিমুহূর্তে অযথাই কথার তীর ছোঁড়ে, শুধুমাত্র ছেলের পছন্দ বলে অপছন্দ করে, তখন তা মেনে চলা সহজ না। আমি নিজে এমন একটা জীবন কাটানোয় কখনোই চাই না আমার কোনো মেয়ের ভাগ্য এমন হোক।”
“দাদির বিষয়টা ভিন্ন ছিল। শফিক সাহেবের মা, বোন এতটা করার কথা না। আর তারা যদি ঘৃণা করেও থাকেন, আমি ধরে নোব আমার ভাগ্যটাই এমন। ভালোবাসার জন্য তৈরিই হয়নি।”
“আচ্ছা তোদের বাবা কই?”
“বাবা তো এখানে নাই।”
“আমি তো রুমে না পেয়ে ভাবলাম এখানে এলো বুঝি।”
“ছাদে মনে হয়। সে নিজের কষ্ট, চিন্তা কখনোই দেখাবে না, জানা কথা।”
জুয়েনা বা চন্দ্রা টের পাওয়ার আগেই ফিরোজ সাহেব আস্তে দরজার কাছ থেকে সরে যান। বাইরে মেঘ ডাকছে। চন্দ্রা উঠে গিয়ে জানালার কাছে দাঁড়ায়। সত্যি কি মাহতাব চলে না গিয়ে বাইরেই আছে? বৃষ্টি এলে কী অবস্থা হবে। ভিজবে তো। বাইরে গিয়ে দেখবে নাকি?
***
শফিক ছটফট করছে। চন্দ্রার বিষয়ে একটা উড়ো খবর এসেছে মা আর বোনের কাছে। যিনি জানিয়েছেন তিনি নিজের পরিচয় গোপন রেখেছেন। শুধু বলেছেন চন্দ্রাদের কাছের মানুষ, বানিয়ে মিথ্যা বলবেন না। তবু শফিক নিতান্ত ভদ্রলোক দেখে জানাচ্ছে যে চন্দ্রার অতীত অত ভালো না। শুরুতে ফুপাতো ভাইয়ের সাথে জড়ানোর চেষ্টা করেছিল, সেখানে সুবিধা করতে পারেনি। বিয়েও ভেঙেছে সে ঘটনায়। এরপর তাদের বাড়িতে থাকতে আসা কমবয়সী সরকারি কর্মকর্তার সাথে ঘনিষ্ঠ হওয়ার বদনাম রটেছে কিছুদিন আগে। আর কে না জানে, যা রটে, তা কিছু তো বটে। শফিক আগেই এসব শুনেছে, তাই বলেছে এসব নিয়ে ভাবতে না। বিয়ের সময় অনেকেই ইচ্ছে করে মন্দ কথা ছড়ায়। এরা এসব করে মজা পায়। কিন্তু আশ্চর্য বিষয় হচ্ছে এ বিষয় জানার পর বরং শফিকের ঘরের মানুষদের উৎফুল্ল দেখা যাচ্ছে। না, বিয়ে ভাঙবে বলে না। বরং ওনারা একটু হলেও আনন্দ পাচ্ছেন যে এবার চন্দ্রাকে জব্দ করার একটা হাতিয়ার পাওয়া গিয়েছে। এই দিয়ে চন্দ্রাকে নাস্তানাবুদ করা যাবে, যেন ওদের সামনে মুখই না খোলে
(চলবে)