#কাঞ্চনবেলা
#তোনিমা_খান
#সূচনা_পর্ব
১.
বাতাবরণ আগমনী ফাল্গুনের বার্তা প্রেরণ করছে। বসন্তের সুর আর সঙ্গীতময় আবেশের সেই বসন্ত বীণা দোল খাচ্ছে সমীরন জুড়ে। সমীরনে উষ্ণতার আভাস আর বকুল ফুলের মিষ্টি সুগন্ধ!
ফাগুনঝড়া রঙিন সৌন্দর্যে কংক্রিটের পথ সেজে উঠেছে আগুনরঙা পলাশপ্রিয়ার অনুরাগে।
সেই সৌন্দর্য কখনো পিষ্ট হচ্ছে—শহুরে পথে চলন্ত কালো ধোঁয়া নির্গতকারী গাড়ির পিষ্টনে; তো কখনো পিষ্ট হচ্ছে পথচারীর পদতলে। তবুও প্রকৃতির অপার্থিব সৌন্দর্য ম্লান করার ক্ষমতা কি এই ঠুনকো ধরিত্রী বাসীর রয়েছ? নেই তো!
কাঞ্চনফুলে সেজে থাকা পথধার এবং শান্ত, সোনালী আলোয় ভরা কাঞ্চনবেলা। ঝরা পাতা গাছগুলোয় সদ্য গজানো মঞ্জুরিগুলো কচি কচি নতুন পাতায় সেজে উঠছে। সোনালী আলোয় স্নানরত সেই নতুন পাতাগুলো। সাঁঝ বেলার তীর্যক সোনালী রশ্মিতে স্পষ্ট “বিরঙ্গনা” নামক সাইনবোর্ডটি। যেটি উজ্জ্বল এবং দৃষ্টি আকর্ষণীয় হয়ে আছে। ব্যস্ত নগরীর সকলের কাছে “বিরঙ্গনা” নামক এই ক্লাবটি প্রচলিত অর্থবহন করে না। এটি স্পষ্ট শহুরে কোলাহল ভেদ করে ভেসে আসা সমস্বরে সুরেলা কণ্ঠে গান, হারমোনিয়ামের সুর এবং ঘুঙুরের ধ্বনিতে। ক্লাবটি নারী সংগঠনের একটি ছোট্ট অংশ। যেখানে নারীদের সুপ্ত প্রতিভাগুলোকে তাদের শক্তিতে রূপান্তরিত করতে সাহায্য করে। যে সঙ্গীতে আগ্রহী সে গান শেখে এবং চর্চা করে। যে নৃত্যে আগ্রহী সে নতুন নতুন মুদ্রায় লতানো দেহে বাঁক তোলে। যে ছবি আঁকায় আগ্রহী সে রঙতুলির ছোঁয়ায় দিয়ে সাদা মলিন ক্যানভাস পেপার রঙে রঙে সাজিয়ে তোলে। যে এক ছাঁটা সমান্তরাল বস্ত্রকে সুঁই সুতোর দ্বারা নতুন রূপ দিয়ে মানুষের অঙ্গে সাজানোর উপযোগী করে তুলতে আগ্রহী, তাকে সেই প্রশিক্ষণ দেয়া হয়—যেনো সে নিজ নিজ প্রতিভায় বলীয়ান হয়ে ওঠে। তবে সুকুমারপ্রবন মানুষগুলোকে এখানে রোজ বিকেলে ভীড় জমাতে দেখা যায় এক কাপ চা, ছোলা মাখা, মুড়ি মাখা এর সাথে। আবার কখনো কখনো নয়া দম্পতি কিংবা প্রেমিক জুগলকেও দেখা যায় সুরে সুরে মাতোয়ারা এই রঙিন পরিবেশের সুযোগ নিতে। এহেন মোহনীয় পরিবেশে যে অনুভূতি গুলো প্রগাঢ় হয়!
বিকাল পাঁচটা বিশ। বিরঙ্গনা নামক দোতালা পুরাতন দালানটির পাশে দাঁড়িয়ে আছে চার তলা বিশিষ্ট সৌখিনতার ছোঁয়ায় থাকা একটি দালান। যেখানে বিশাল এক সাইনবোর্ডে লেখা “পূবালী ব্যাংক লিমিটেড”। সেখান থেকে একে একে পরিপাটি, রুচিসম্পন্ন পোশাকে আবৃত কিছু ব্যাংক কর্মকর্তা সারাদিনের দীর্ঘ কর্মব্যস্ততার সমাপ্তি ঘটিয়ে নিচে নামলো। চোখেমুখে তাদের ক্লান্তি! কলিগদের বিদায় সম্ভাষণ জানিয়ে, নির্মলপ্রাণ ব্যাক্তিত্বধারী সুগঠিত দেহাবয়বের পুরুষ ধীরপায়ে এগিয়ে গিয়ে দাঁড়ায় কাঞ্চন ফুল গাছটির নিচে। সুকুমারপ্রবন হওয়ায় প্রতিদিনের কর্মসূচি শেষে এখানে পনেরো মিনিট সময় কাটানো অভ্যাস। ডার্ক ব্লু রঙা প্যান্টের সাথে স্কাই ব্লু রঙা ইন করা শার্টটির জায়গায় জায়গায় ছোপ ছোপ ঘামে ভেজার দাগ। গলার টাই ঢিলে করে, গলায় ঝুলিয়ে রাখা কার্ডটি খুলে ফেললো। কার্ডটিতে জ্বলজ্বল করছে একটি নাম “স্বরূপ ইব্রাহীম”। সেটি পকেটে ঢুকিয়ে রেখে, দু’হাতের আঙুলের ডগায় বুকের কাছের শার্টটি ধরে একটা ঝাড়া দিলে চিটচিটে ভেজা ভাব থেকে একটু রেহাই পাওয়া গেলো। ভেতরের ইনার টিশার্ট টাও ভিজে উঠেছে। সারাদিন শীততপ নিয়ন্ত্রিত কক্ষে থাকার অভ্যাস; তাই বের হতেই ঘেমে উঠেছে। এমনিতেও খুলনা শহরের তাপমাত্রা মাত্রারিক্ত! ক্ষণকাল বাদ সে পা বাড়ায় নিজের বাম পাশে থাকা একটি ছোট্ট ইজি বাইক স্ট্যান্ডের লম্বা বেঞ্চির দিকে। ওখানটাতেই পনেরো মিনিট কাটানোর অভ্যাস! বেঞ্চির এক কিনারায় বসে পিঠ এলিয়ে দিতেই চাপা প্রশান্তির নিঃশ্বাস ফেললো ব্যাক্তিটি। কর্নকুহরে শ্রুতিমধুর শব্দতুলে তখন বেজে চলেছে সমস্বরে সুরেলা কণ্ঠে বসন্তের গান। পুরুষালী ওষ্ঠকোনা অলসগতিতে বেঁকে যায়। বদ্ধ নেত্রে অনুভব করতে লাগলো,
“বাতাসে বহিছে প্রেম, নয়নে লাগিল নেশা
কারা যে ডাকিল পিছে
বসন্ত এসে গেছে
মধুর অমৃতবাণী, বেলা গেল সহজেই
মরমে উঠিল বাজি
বসন্ত এসে গেছে
থাক তব ভুবনের, ধুলি মাখা চরণে
মাথা নত করে রব;
বসন্ত এসে গেছে
বসন্ত এসে গেছে
কগলের নব নীল মনের গোপনে
বাজে ওই বাজে ওই বাজে ওই
পলাশের নেশা মাখি চলেছি দুজনে
বাসনার রঙ-এ মিশি শ্যামলে-স্বপনে
কুহু কুহু শোনা যায় কোকিলের কুহুতান
বসন্ত এসে গেছে
বসন্ত এসে গেছে।”
বিরঙ্গনা ক্লাবটি থেকে সদ্য বের হওয়া মেয়েটির যত্নের ছোঁয়ায় উজ্জ্বল ফর্সা বদনে বিন্দু বিন্দু মুক্তোদানার ন্যায় জ্বলজ্বল করছে শ্বেদ জল। দেহের সম্মুখে অবহেলায় ছড়িয়ে থাকা সুতির ওড়নাটি নিয়ে মেয়েটি বড্ডো অনাদরে ঘামগুলো মুছে ফেললো। দীর্ঘক্ষণ গান গাওয়ায়, গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে আছে। কাঁধে চেপে রাখা টোট ব্যাগটি নিয়ে পা বাড়ায় বিরঙ্গনার সম্মুখ ফুটপাতের দিকে। বিরঙ্গনার ঠিক বা পাশে থাকা ছোট্ট স্ট্যান্ডে পেতে রাখা বেঞ্চি তার গন্তব্য। গন্তব্যটি বড্ডো মোহনীয়। বাগানবিলাস গাছের লালচে গোলাপী ছায়ায় থাকা স্টিলের ঐ বেঞ্চটি, অতি স্বল্প সময়েই নৈরার মন জয় করে নেয়া এক ক্ষমতাধর ধাতব পাত। সেখানে গিয়ে পা ঝুলিয়ে বসতেই পাতলা গোলাপী রঙা ওষ্ঠদ্বয় বিস্তৃত হয়ে গেলো। সম্মুখে ব্যস্ত নগরী, পাশে থাকা চায়ের দোকানের টুং টাং আওয়াজ এবং সঙ্গ দেয়ার মতো কয়েক দল কলেজ পড়ুয়া মেয়ে ছেলে আর বসন্তের ফুলে ফুলে রঙিন ছোঁয়ায় সুগন্ধিমাখা সমীরন। অপেক্ষাটা দারুণ উপভোগ্য হবে বলে মনে হলো নৈরার। অপেক্ষা বলতে একটি যান্ত্রিক পরিবহনের।
ছোলা মাখা ওয়ালা নিজের তৈজসপত্র নিয়ে বেঞ্চটির কাছে এসে দাঁড়াতেই, নৈরা চকচকে দৃষ্টি তাক করে তার পানে। বয়স্ক ছোলা মাখা ওয়ালা তাকে দেখে শুধায়,
–“দেবো আম্মা?”
নৈরা চঞ্চল কণ্ঠে শুধায়,
–“কতো করে চাচা?”
–“বিশ, ত্রিশ, চল্লিশ, পঞ্চাশ যতো টাকার তুমি চাও।”
–“আচ্ছা, ত্রিশ টাকার দিন।”, নৈরা মৃদু হেসে বলল। ছোলা মাখা ওয়ালা ছোলা মাখিয়ে তার হাতে দিলে সে ব্যাগ থেকে টাকা বের করে বাড়িয়ে দেয়। ছোলা ওয়ালা অসহায় দৃষ্টিতে তাকায় এক হাজার টাকার নোটটির দিকে। বলে,
–“আম্মা, এতো টাকার খুচরা তো নাই।”
নৈরার মুখ মলিন হয়ে গেলো। সে মিহি স্বরে বলল,
–“কিন্তু আমার কাছে তো এটা ব্যতীত আর নেই চাচা।”
–“একটু খোঁজ করে দেখো আম্মা পাও কি-না।”
নৈরা ব্যাগ হাতাতে লাগলো। আরো দুইটা এক হাজার টাকার নোট দেখে সে হতাশার নিঃশ্বাস ফেললো। এগুলো তার হাত খরচের টাকা। বাবা বের হওয়ার সময় সবসময় এমনি নোট ধরিয়ে দেয়। যেগুলো অবহেলায় তার ব্যাগে পড়ে থাকে। কখনো ভাঙার প্রয়োজন পড়ে না। সে অনাহুত দৃষ্টিতে তাকালো ছোলা ওয়ালার দিকে। ছোলা ওয়ালা টাকাটা তার হাতে ফিরিয়ে দিয়ে বলল,
–“ঐ স্যার’রে বলো আম্মা। সে তো মনে হয় ব্যাংকার, তার কাছে খুচরা পাবা।”
নৈরা এতক্ষণে নিজের বাম দিকে চোখ রাখলো। ফোনের দিকে তাকিয়ে থাকা একটি গুরুগম্ভীর উজ্জ্বল শ্যামলা মুখ নজরে আসলো। নিজের উদ্দেশ্যে কিছু কথোপকথন ঠিকরে আসতেই স্বরূপ চোখ তুলে তাকায় নিজের ডান পাশে। দুটি অনাহুত দৃষ্টিতে দৃষ্টি মিলে গেলে সে সন্তপর্ণে দৃষ্টি সরিয়ে নিলো। ছোলা ওয়ালার দিকে তাকিয়ে শুধায়,
–“জি, আমায় কিছু বলছেন?”
ছোলা ওয়ালা বলল,
–“সে ছোলা কিনছে স্যার। কিন্তু এক হাজার নোট ভাঙতি নেই তার কাছে। আপনার কাছে কি আছে?”
ততক্ষণে নিজের দিকে এগিয়ে আসা একটি মেয়েলি হাত তার দিকে এক হাজার টাকার একটি নোট বাড়িয়ে দিয়েছে। সে টাকাটির দিকে এক পলক তাকিয়ে পকেট থেকে মানিব্যাগটা বের করলো। সেখানে কয়েকপল দেখে বলল,
–“দুঃখিত! আমার কাছে এক হাজার টাকা খুচরা হবে না।”
–“কিন্তু আপনি একজন ব্যাংকার।”, নিজের উদ্দেশ্যে প্রশ্নটি শুনতেই স্বরূপ দৃষ্টি ফেললো নারী কণ্ঠটির উৎসের পানে। মৃদু হেসে বলল,
–“আমি একজন ব্যাংক কর্মকর্তা! কিন্তু ব্যাংকের সব টাকাগুলো তো আমার নয়। আপনি চিন্তা করবেন না। আমার কাছে ত্রিশ টাকা খুচরা আছে আমি দিয়ে দিচ্ছি আপনার বিল।”
নৈরা লজ্জায় জড়োসড়ো হয়ে গেলো অস্বস্তিকর পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়ে। এমন পরিস্থিতিতে সে কখনো পরেনি। এর জন্যই বলে, যে যা না পারে তা করা উচিৎ নয়। কেনো সে ছোলা খেতে গেলো! বাবাকে বললেই তো বাবা পাঠিয়ে দিতো। নিজেকে বকতে লাগলো নৈরা। মিনমিনে কণ্ঠে বলল,
–“না না আপনি কেনো দেবেন! কোন প্রয়োজন নেই। চাচা আপনি বরং আপনার ছোলাগুলো নিয়ে নিন। আমি খাবো না।”
–“ঐ ছোলা আবার নিলে ওগুলো পানসে হয়ে যাবে আম্মা। কেউ খেতে চাইবে না। আমার লস হবে।”
নৈরা কিছু বলতে যাবে তার আগেই স্বরূপ ছোলা ওয়ালার হাতে ত্রিশ টাকা ধরিয়ে দিলো। লোকটা ধন্যবাদ জানিয়ে তৈজসপত্র নিয়ে অদূরে ঘাঁটি স্থাপন করলো। ছোলা হাতে নৈরা অসহায় দৃষ্টিতে তাকায় স্বরূপের দিকে। বলে,
–“আমি আপনার টাকা ফেরত দেবো কি করে?”
স্বরূপ মানিব্যাগ পকেটে ঢোকাতে ঢোকাতে স্মিত হেসে বলল,
–“ত্রিশ টাকার ব্যপার। চিন্তা করবেন না। ত্রিশ টাকার জন্য আমি পথে বসে যাবো না। আপনি নিশ্চিন্তে খান।”
বলেই স্বরূপ আবার ফোন ঘাঁটতে লাগলো। নৈরা আর কিছু বললো না। নিরবে বসে ছোলা খেতে লাগলো। খেতে খেতে আড়চোখে পর্যবেক্ষণ করে দুই হাত দূরে অবস্থানরত লোকটিকে। দ্বিধাগ্রস্ত মন নিয়ে ছোলাটা স্বরূপের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল,
–“আপনি একটু নিলে আমি খুশি হবো।”
স্বরূপ চোখ তুলে তাকায় মেয়েটির পানে। পরপরই এগিয়ে দেয়া ছোলার দিকে। বলল,
–“ধন্যবাদ, কিন্তু প্রয়োজন নেই। আপনি খান।”
বলেই স্বরূপ আবার দৃষ্টি নত করে। নৈরা তাকিয়ে রইল ছোলাটির দিকে। কিছু মাথায় আসতেই ফের বলল,
–“আপনি হয়তো আমার এঁটো কার্ড দেখে খেতে চাইছেন না। আমি দুঃখিত! আপনি কার্ডটির উল্টোদিক থেকে খেতে পারেন। না খেলে আমার খারাপ লাগবে। আমি আপনার টাকার খাবার খাচ্ছি, আপনাকে না দিয়ে।”
স্বরূপ ফোঁস করে এক নিঃশ্বাস ফেলে তাকায় অতি নম্র মেয়েটির দিকে। মেয়েটিকে সে চেনে। সে কেনো পুরো শহরের সবাই মোটামুটি চেনে। শহরের স্বনামধন্য এবং তথাকথিত বিত্তশালী এক পরিবারের মেয়ে। অর্থবিত্তের দিক থেকে বহুল পরিচিত। মেয়েটির বাবা চাচা, পূর্বপুরুষ সবাই ইঁটের ভাটার ব্যবসা করে আসছে। কথায় আছে মাটি বেঁচার টাকা মাটিতেই যায়। কিন্তু এই বাক্যটি পুরোপুরি মিথ্যা মাহমুদ পরিবারের জন্য। কারণ তাদের মাটি বেঁচা টাকা মাটিতে নয় তাদের আকাশ ছুঁতে সাহায্য করেছে। তন্মধ্যে মেয়েটির বাবা নুহাশ মাহমুদ বেশি প্রতিষ্ঠিত।
তবে এতো বিত্তশালী পরিবারের মেয়ে হওয়ায় স্বরূপ মেয়েটিকে চেনে না। বরং চেনে তার অতি সাদামাটা চলাফেরার কারণে। সে যেই আবাসিক এলাকায় থাকে সেই এলাকায় ঢুকতেই দু’টো সাত তলা বিশিষ্ট বিশাল বিশাল বাড়ি বাঁধে। যেটা একটা তার বাবার এবং আরেকটা তার চাচার। এই যে মেয়েটির পরিবারের এক একজনকে দেখলে বোঝা যাবে তারা এই শহরের নামীদামী কেউ। কিন্তু মেয়েটিকে দেখলে ঘুনাক্ষরেও কেউ টেন পাবে না মেয়েটি নুহাশ মাহমুদের মেয়ে। চলাফেরায় এতোটাই উদাসীনতা। সাধারণ একটা সুতির থ্রি পিস সাথে ঢিলেঢালা বেনুনী করা মেয়েটির সাজ সরঞ্জাম বিহীন মুখপানে এক পলক তাকিয়ে স্বরূপ বলল,
–“আমি বাহিরের খাবার খাই না। বাহিরের খাবার বলতে ঐ এক কাপ চা’ই খাওয়া হয়। এর ব্যতীত অন্য কিছু না। আপনি ত্রিশ টাকার জন্য এতো চিন্তা করবেন না।”
–“কেনো বাহিরের খাবার খেলে কি হয়?”, মেয়েটির অবুঝ কণ্ঠে স্বরূপ মৃদু হাসলো। দূর থেকে এতোদিন না বুঝলেও আজ বুঝলো মেয়েটির অন্তর আর বাহির দুটোই সিদেসাধা, সহজসরল। অতিরঞ্জিত, রঙচঙে কোন কিছু নেই। সে কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল,
–“অভ্যাস নেই।”
–“কেনো অভ্যাস নেই?”, বড্ডো অযাচিত প্রশ্নটির উত্তর ও অতি স্বাভাবিক ভাবেই পেলো মেয়েটি। কোন বিরক্তি কিংবা বিরূপ আচরণের স্বীকার হতে হলো না। স্বরূপ মৃদু হেসে বলল,
–“হয়তো অভ্যাস গড়ার মতো প্রশ্রয় পাইনি।”
–“আপনি অনেক কঠিন কথা বলেন।”, মেয়েটি কেমন নাক মুখ কুঁচকে বলল। নিরুদ্বেগ, অবুঝ আদল চোখেমুখে। স্বরূপ শিড়ঁদাড়া সোজা করে বসে। ঘাড় কাত করে বলল,
–“এমনভাবে বলছেন যেনো আপনি আমার অনেক কথা শুনেছেন।”
–“মাত্র ই না একটা কঠিন জবাব দিলেন। আমি তার অর্থ বুঝিনি। তাই মনে হয়েছে আপনি কঠিনভাবে কথা বলেন।”, নৈরা ছোলা খেতে খেতে বলল। নির্ভেজাল কণ্ঠে স্বরূপ মৃদু হাসলো। বলল,
–“আপনার বোঝার মতো পরিস্থিতি হয়ে ওঠেনি হয়তো।”
মেয়েটি আবারো অবুঝ পানে তাকালো। তবে কিছু বললো না। স্বরূপ এতোটুকু বুঝতে পারে মেয়েটি এই কঠিন দুনিয়ার, কঠিন সবকিছু থেকে আড়ালেই রয়েছে। যার জীবনে কোন সমস্যা, কাঠিন্যতা নেই আছে শুধু সরলতা হোক সেটা জীবন কিংবা ব্যক্তিত্ব কিংবা চালচলন। বেশ কিছুক্ষণ যাবৎ মাকে ফোনে পাচ্ছে না স্বরূপ। মা ফোন রিসিভ করতেই স্বরূপ জিজ্ঞাসা করে,
–“কোথায় থাকো আম্মা? কি কি সব্জি আনতে হবে; যা যা লাগে নাম বলো তাড়াতাড়ি। বাজার করে নিয়ে আসছি।”
অপরপ্রান্ত থেকে কি বলল শোনাগেলো না। স্বল্প কথোপথনের সমাপ্তি সেখানেই ঘটলো। নৈরার গাড়ি এসে থামলে , নৈরা ধীরস্থির তাতে উঠে বসলো। জানালা থেকে মুখ বের করে শেষবারের মতো স্বরূপের আদ্যোপান্ত দেখলো। ড্রাইভার বিনীত কণ্ঠে বলল,
–“নৈরা আম্মা, ছোট সাহেবকে ইটের ভাটায় দিয়ে আসতে গিয়েছিলাম। তাই দেরি হয়ে গিয়েছে।”
–“সমস্যা নেই কাকু। আমি বিরক্ত হইনি।”, নৈরা হেসে বলল। বয়স্ক ড্রাইভার লোকটি আবার বলল,
–“দেরির কথা বাসায় বইলো না হ্যাঁ?”
–“বলবো না, কাকু।”, নৈরা মিষ্টি হেসে বলল।
*****
শহরের বুকে খোলা মাঠ যেনো বিরল এক ব্যপার বর্তমানে। এক টুকরো খালি জায়গা দেখলে প্রোমোটার, খদ্দর সহ দালাল’রা হুমড়ি খেয়ে পড়ে সেটির উপর। সাউথ সেন্টার রোডের ব্যস্ত জনবসতির মাঝে এক টুকরো খালি জায়গা দেখা যেতো এতোদিন। যেটা অচিরেই নিজের বিদীর্ণ মাধুর্যতা হারাতে বসেছে।
–“কিরে বুব্বো! শুনেছিস এই জায়গা নাকি বিক্রি হয়ে গিয়েছে। বড়ো দালান উঠবে এখানে। আমরা আর খেলতে পারবো না এখানে।”
শক্ত হাতে আঁকড়ে ধরা ব্যাটটা শিথিল হয়ে গেলো। পাঁচ বছরের বিভোর নাম ছেলেটি হতবাক চোখে তাকায় বয়সে বছর দুয়েক বড়ো খেলার সঙ্গীর দিকে। অবাক হয়ে শুধায়,
–“কি বলছো?”
–“হ্যাঁ রে! মা বলেছে।”
–“তাহলে কি আমরা আর খেলতে পারবো না?”
–“কি জানি! ছাদে বসে খেলতে হবে।”, ছেলেটি বলল। অপর আরেকটি ছেলে বলে উঠলো,
–“আরে এতো কথা বলিস না তো! যা হবার দেখা যাবে। এই বুব্বো মার।”
বুব্বোর শিথিল হওয়া হাতটি দৃঢ় হলো। একরাশ অনিশ্চিত বেদনা নিয়ে আবার ব্যাটিং করতে লাগলো। কিছুক্ষণ বাদ অদূরে দেখতে পেলো কয়েকজন মানুষ জায়গাটির আশেপাশে ঘুরে ঘুরে দেখছে। বুব্বো কৌতুহলী নয়নে তাকায় সেদিকে। একটা ছেলে বলে উঠলো,
–” ঐ তো ওনারা মানে নোমান ভাইয়েরা এই জায়গাটা কিনে নিয়েছে।”
–“আরে তোদের তা দিয়ে কাজ কি? তোরা ম্যাচটা সন্ধ্যার আগে তোল না!”, বারো বছরের একটি ছেলে চেঁচিয়ে উঠলো। সকলে আবার খেলতে শুরু করলো। ম্যাচের সবাই দশ বছরের উর্ধ্বে। কিন্তু বুব্বো মাত্র পাঁচ বছরের একটি বাচ্চা ছেলে। তবুও সে এই বড়োদের ম্যাচে জায়গা পায় তার দূর্দান্ত ব্যাটিং এর করণে। পরবর্তী দ্রুতগামী বলটি তেড়ে আসতেই বুব্বো নিজের স্থানে এসে দাঁড়ায়। ব্যাটটা শক্ত হাতে আঁকড়ে ধরে সর্বোচ্চ শক্তি দিয়ে স্পর্শ করে বলটি। ওমনি সকলে চিৎকার করে উঠলো ছক্কা বলে! কিন্তু ততক্ষণে আরেক দূর্ঘটনা ঘটে গেলো। ছক্কা টা হলো ঠিক কিন্তু অজান্তেই কারোর বাতিঘর উড়িয়ে দিয়েছে বুব্বো। অদূরে পর্যবেক্ষণ করা লোকগুলোর মাঝে নোমান নামক ব্যক্তিটি নিজের সবচেয়ে সেন্সিটিভ জায়গাটি আঁকড়ে ধরে ব্যথাতুর শব্দ করে উঠলো। রোধ হয়ে আসা কণ্ঠে বলে উঠলো,
–“রিদওয়ানরে আমার সুইচ অফ হয়ে গেলো। এ জীবনে আর আমার বাবা ডাক বুঝি শোনা হলো না।”
নোমান আর্তনাদ করে উঠলো। অত্যাধিক পরিমাণে ব্যথায় সে রীতিমতো পিলারে হাত চাপড়াচ্ছে। রিদওয়ান, শাফাক বন্ধুকে আঁকড়ে ধরে ধমকে উঠলো,
–“ঐ থাম! এমন গুরুতর মুহুর্তেও তোর ফাজলামো আসে কি করে?”
–“তুই আমার ফাজলামোর কথা ছাড়। কোন শালায় বল মেরেছে ওটাকে ধরে আন জলদি।”
–“ওসব বাদ দে আগে ডাক্তারের কাছে চল দেখি কিছু হয়েছে নাকি।”
বাচ্চাদের মধ্যে আ’ত’ঙ্ক ছড়িয়ে পড়ল। সকলে বিবর্ণ বলল মুখ নিয়ে দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে ছুটতে লাগলো।একজন স্থবির বিভোরকে দেখে চেঁচিয়ে বললো,
–“আরে এই বুব্বো তোর আজ খবর আছে, পালাচ্ছিস না কেনো?”
বিভোর কপাল কুঁচকে নেয়। ধীরপায়ে এগিয়ে যায় নোমানের দিকে। গিয়ে বলল,
–“আঙ্কেল আমি কি তোমার ইয়েতে ব্যথা দিয়েছি? যদি দিয়ে থাকি তবে স্যরি। আর যদি না’ও দিয়ে থাকি তবুও স্যরি। আমি ইচ্ছে করে করিনি। আমি জানি ওটা সেন্সিটিভ জায়গা। আঘাত পেলে খুব ব্যথা হয়। আমিও একবার ব্যথা পেয়েছিলাম সাইকেল চালানো শিখতে গিয়ে। এক সপ্তাহ দুই পা ছড়িয়ে শুয়ে ছিলাম।”
নোমান ব্যথা ভুলে অবাক চোখে তাকায় ছোট্ট একটা বাচ্চা ছেলের দিকে। অবাকের রেশ ধরে শুধায়,
–“বলটা তুমি মেরেছো?”
–“হ্যাঁ আঙ্কেল!”
নোমান হতবাক চিত্তে হাঁটু গেঁড়ে বসে। বিভোরের বাঁশের কঞ্চির ন্যায় হাত দু’টো ধরে দেখতে দেখতে অবাক কণ্ঠে শুধায়,
–“এইটুকুন হাত দিয়ে অতো জোরে হিট করেছো? আমাকে বোকা পেয়েছো? কার দোষ ঢাকতে এসেছো? সত্যি করে বলো।”
বিভোরের মুখাবয়ব গম্ভীর হয়। গম্ভীর গলায় বলল,
–“ডোন্ট জাজ আ বুক বাই ইট’স কভার, আঙ্কেল। দেহ দেখে মনের জোর বোঝা যায় না। আর মামু বলে মনের জোর বড়ো জোর! আমার মনে যদি জোর থাকে তবে আমি পুরো পৃথিবী জয় করতে পারবো।”
নোমান, রিদওয়ান, শাফাক সহ উকিল দু’জন অবাক হয় বাচ্চাটির পরিপক্ক আচরণে। পরপরই হেসে ফেললো রিদওয়ান বলে,
–“কি চালাক ছেলে! দেখেছিস কি সুন্দর কথা বলে?”
–“হুঁ।” , নোমান হেসে বলল। বিভোরের হাত দু’টো ধরে বলল,
–“তুমি তো দেখছি খুব বুদ্ধিমান। কিন্তু আমি বেশি ব্যথা পাইনি। জিন্সের প্যান্ট দেখে বেঁচে গিয়েছি বুঝলে নয়তো আজ আমার বংশের বাতি নিভে যেতো!”
–“তুমি কি আমায় ক্ষমা করে দিয়েছো? আমার মাম্মার কাছে নালিশ দেবে না তো?”, পুনরায় বিভোরের কথায় নোমান হেসে মাথা নাড়লো। ততক্ষণে একটি নারী কণ্ঠ প্রতিধ্বনিত হলো,
–“বুব্বোওও! বাসায় এসো, সন্ধ্যা হয়ে গিয়েছে।”
বুব্বো খোলা মাঠ সংলগ্ন জায়গাটির পাশে থাকা পাঁচ তলা দালানটির দিকে তাকায়। ঠিক তিন তলা বরাবর। হাঁক ছেড়ে বলল,
–“আসছি মাম্মা!”
পরপরই নোমানের উদ্দেশ্যে বলল,
–“আঙ্কেল, তুমি কি এই জায়গাটা কিনে নিয়েছো? দালান করবে? করো না প্লিজ। আমরা এখানে খেলা করি। এটা যদি না থাকে তবে আর কখনো আমরা খেলতে পারবো না। আমি তাহলে ক্রিকেট প্রাকটিস ও করতে পারবো না আর আমার বড়ো ক্রিকেটার হওয়ার স্বপ্ন ও পূরণ হবে না।”
নোমান প্রেক্ষিতে মৃদু হাসলো। এটা তার বাবার সদ্য কেনা জমি। এখানে তার তেমন কোন হস্তক্ষেপ নেই। তাই কোন জবাব দিতে পারলো না। বলল,
–“বাসায় যাও, সন্ধ্যা হয়ে গিয়েছে।”
বিভোর চলে গেলো।
কাজ শেষে বাড়ি ফিরতে হবে এই তাগিদটা পৃথিবীতে যার যার মাঝে রয়েছে—সে হলো পৃথিবীর অন্যতম এক ভাগ্যবান ব্যক্তি। ধরনীতে আমাদের প্রত্যেকের নীড়ে ফেরার তাগিদ হোক! কেননা এমন অনেক দূর্ভাগা রয়েছে যাদের ভাগ্যে এই নীড়ে ফেরার সুযোগটুকু থাকে না। একটা নীড় থাকে না। এমনকি রাতটা কোথায় যাপন করবে তার নিশ্চয়তা নেই। ঠিক এই জায়গা থেকেই স্বরূপ ভাগ্যবান। তার একটা নীড় রয়েছে, নীড়ে নিজস্ব মানুষ রয়েছে রয়েছে ফেরার তাগিদ। যেখানে তাদের তাড়িয়ে দেয়ার মতো অধিকার কারোর নেই।
নিস্তব্ধ রজনী নির্দেশ করছে রাত গভীর। ঘড়িতে বারোটা দশ। পিসির আলোয় আলোকিত রুমটি, লাগাতার কিবোর্ডে চালানো আঙুলগুলো শ্রুতিকটু শব্দ তুলে চলেছে একাধারে। প্রশস্ত বুকে লেপ্টে থাকা ছোট্ট দেহটি বিরক্তিতে গুঙিয়ে উঠলো। বুকে মুখ ঘষতে ঘষতে জড়ানো কণ্ঠে ডেকে উঠলো,
–“মামু?”
নিজ কর্মে নিমগ্ন স্বরূপ কাজ করতে করতে জবাব দেয়,
–“বলো।”
বিভোর আধো আধো ঘুম জড়ানো নয়ন মেলে তাকায় মামার গম্ভীর মুখপানে। বলে,
–“এতো শব্দ কেনো করছো, মামু? আমি যে ঘুমাচ্ছি তুমি কি তা দেখছো না? তুমি দিন দিন ম্যানারলেস হয়ে যাচ্ছো। কেউ ঘুমালে আওয়াজ করতে হয় না। এটা কি তুমি জানো না?”
স্বরূপ স্থির দৃষ্টি পিসির উপর রেখে জবাব দেয়,
–“এর জন্যই আমি তোমাকে বলেছিলাম মাম্মার কাছে ঘুমতে যাও। তাহলে শান্তিমতো ঘুমাতে পারবে।”
–” কিন্তু আমি তোমার সাথে ঘুমাতে পছন্দ করি। কতো বড় বুক, বিছানার দরকার হয় না। এখানেই ছড়িয়ে ছিটিয়ে ঘুমানো যায়।”
–” তবে তোমায় এমন শব্দের মাঝেই ঘুমাতে হবে। কিছু করার নেই। কিন্তু আমি যখন ঘুমাতে যাবো তখন যদি জেগে থাকা হয়, তবে আমি তোমায় সোজা ছাদে রেখে আসবো, বুব্বো।”
–“ইউ কান্ট ডু দিজ মামু।”
–“আই ক্যান বুব্বো।”
–“ইউ কান্ট মামু।”
–“আই অবিয়েসলি ক্যান, বুব্বো।”
–“ওকে, তুমি একটা আয়রনম্যান। আমি মেনে নিলাম। কিন্তু তোমার আমার উপর একটু দয়া হওয়া উচিৎ। আমার ঘুম পেয়েছে খুব। কিন্তু আমি ঘুমাতে পারছি না তোমার কারণে।”
–“তবে মাম্মার কাছে যাও।”
–“নো মামু। আমি তোমার কাছে ঘুমাতে ভালোবাসি।”
–“আগামীকাল সকালে আমার এই কাজ শেষ করে সাবমিট করতে হবে। কিন্তু তুমি আমায় ডিস্টার্ব করছো বুব্বো।”
–” বাট তুমি এতো কাজ কেনো করো?”
–“টাকা ইনকাম করার জন্য।”
–“এতো টাকা ইনকাম কেনো করছো তুমি?”
–“মানসম্মানের সাথে বেঁচে থাকার জন্য।”
–“মান সম্মান ইজ হোয়াট মামু?”
–“বুব্বো, এটা মানসম্মান ইজ হোয়াট নয় বলো রেসপেক্ট ইজ হোয়াট। যা না পারো তা বলো কেনো?”
–“কারণ আমি পছন্দ করি যা না পারি তা বলতে। এভাবে করেই একদিন আমি সব শিখে যাবো। ঠিক আছে যাও আমি সঠিকটা বলছি, রেসপেক্ট ইজ হোয়াট?”
–“রেসপেক্ট বা সম্মান এমন একটা জিনিস যেটা এই পৃথিবীর এতো এতো মানুষের মাঝে মাথা উঁচু করে বাঁচতে সাহায্য করে। কেউ যেনো কখনো আমাদের সাথে খারাপ আচরণ কিংবা কটু কথা না বলতে পারে।”
–“আমার সাথে কেউ খারাপ আচরণ করলে তো আমি তার নাক ফাটিয়ে দেই। কই আমার তো টাকার প্রয়োজন পড়ে না? তবে তোমার কেনো এতো টাকার প্রয়োজন? তুমিও আমার মতো নাক ফাটিয়ে দেবে!”
–“বুব্বোওও! অনেক হয়েছে। তুমি আদরে আদরে বিগড়ে গিয়েছো। কারোর নাক ফাটানোর কথা তুমি চিন্তাও করো কিভাবে? সবাই কি বলবে বুব্বোর মামু আর তার মা বুব্বোকে এই শিক্ষা দিয়েছে? তুমি আমার কাছে ঘুমানোর যোগ্যতা হারিয়েছো। গেট আউট! এখনি এখান থেকে চলে যাও। যেদিন ভদ্র ছেলে হতে পারবে সেদিন মামুর বুকে ঘুমাতে আসবে।”, স্বরূপ রাগান্বিত স্বরে বলল।
–“তুমি আমার সাথে এমন করতে পারো না মামু। তুমি যদি আমার সাথে এমন করো তবে আমি কোথায় যাবো, বলো?”, বিভোর ঠোঁট ফুলিয়ে বলল।
–“আপাতত মাম্মার কাছে যাও তাতেই আমি উপকৃত হবো।”
–“নো মামু, তুমি না বলো, আমি তোমার জান? তবে এটা কি করে বলতে পারলে? আমি এই ব্যর্থ জীবন রেখে কি করবো এখন বলো।”
–“তুমি এতো পাকা পাকা কথা কোত্থেকে শিখেছো, বুব্বো?”
–“কোথাও থেকে না; আমি নিজেই জানি এগুলো। কারোর থেকে কেনো শিখতে হবে আমায়! আমার থেকে সবাই শিখবে।”
–“ঠু গুড , বুব্বো। এখন ঘুমাও। মামুর অনেক কাজ আছে, প্লিজ।”, স্বরূপ অনুনয় করে বলল।
–“ওকে, তবে আমি যা যা বলছি তা আমার সাথে সাথে বলো।”, দু’হাতে মামুর পিঠ জড়িয়ে বুকে মাথা ঠেকিয়ে বলল বিভোর। স্বরূপ ডানে বামে মাথা নেড়ে জবাব দেয়,
–“হুঁ।”
–“বলো বুব্বো আমার জান। আমি তোমায় খুব ভালোবাসি। তুমি সবসময় আমার বুকে ঘুমাবে। তুমি একদিন মস্ত বড়ো একজন ক্রিকেটার হবে। পৃথিবীর সব ব্যাট বলগুলো একদিন বুব্বোর হবে। একদিন বুব্বো পৃথিবীর সবার চেয়ে বেশি রান করবে। তারপর মামুকে অনেকগুলো বাইক কিনে দেবে। মামুকে আর মাম্মাকে আর কখনো কাজ করতে দেবে না। ”
আধো আধো স্বরে বলতে বলতেই বুব্বো ঘুমিয়ে পড়লো। স্বরূপ ছলছল নয়নে সেই সবকিছু তার সাথে সাথে বলল। তার একটা বাইক ছিল যেটা বিক্রি করে দিয়েছে খুব বেশি সময় হয়নি। সেটা বিভোরের পছন্দের ছিল খুব। সেটা বিক্রি করে দেয়ায় সে খুব কষ্ট পায়। তারপর থেকে সবসময় শুধু বলবে সে মামুকে বাইক কিনে দেবে। স্বরূপ চোখ রাখে চার হাত পায়ে বুকের সাথে লেগে ঘুমিয়ে থাকা বাচ্চা ছেলেটির দিকে। তার জান এটি। যে কি-না খুব দায়িত্বজ্ঞান সম্পন্ন। সব বোঝে আর প্রচুর জ্ঞান রাখে।
চলবে…