কাঞ্চনবেলা পর্ব-০৭

0
2

#কাঞ্চনবেলা
#তোনিমা_খান
#পর্বঃ০৭

ফাল্গুন সর্বদা রঙ নিয়ে আসে না; কখনো কখনো হাজারো রঙের বেশেও সে হাজির হয় বিবর্ণ ধূসর রাঙা হয়ে। অস্তমিত সূর্যের লালচে আলো মন্থর গতিতে দিগন্তে মিলিয়ে যাচ্ছে। সেই আধো আধো তমসায় ধীরে ধীরে মিলিয়ে গেলো সফেদ পাঞ্জাবীতে আবৃত সুঠামদেহী পুরুষটিও। একটিবার পিছু ফিরে তাকানোর সাহস হলো না! ক্ষিপ্র গতিতে হাঁটতে হাঁটতেই একটাসময় দ্রুতগামী পা দু’টো গতি হারালো। চারিদিকে উল্লাস নতুনত্বের! দূরপাল্লায় উদাসীন দৃষ্টি তাক করা। সমীরনে তখন ভেসে বেড়ায় একটি উদাসীন ধিমি কণ্ঠ,
“জানি দ্বিতীয় বার আর কখনো আমাদের দেখা হবে না;
বাতাবরণে আর কখনো হেলিয়ট্রপ ফুলের সুঘ্রাণ ভাসবে না;
আর কখনো টানা টানা ঐ স্বচ্ছ টলমলে চোখে অযাচিত আবদারের দেখা পাবো না;
জানি ঐ চোখগুলোতে আর কখনো নিজের জন্য প্রতীক্ষা দেখতে পাবো না;
আর কখনো স্টিলের ঐ বেঞ্চির এক প্রান্তে কেউ পা দোলাতে দোলাতে আমার অপেক্ষায় থাকবে না;
জানি আর কখনো সুখ খুঁজতে কেউ ছোট্ট এক আদুরে ফ্যাকাসে খরগোশের ন্যায় আমার গা ঘেষে বসবে না;
কিন্তু এতো জানার মাঝেও কখন যে আমি আপনাকে এতোটা নিখুঁতভাবে জেনে গেলাম সেটা তো অজানা’ই থেকে গেলো, কাঞ্চনবালা! এর শাস্তি হিসেবে এই যন্ত্রনাদ্বায়ক বিরহ যন্ত্রনা আমার প্রাপ্য!”

ধীরস্থির বেঞ্চিতে বসা মেয়েটির জীবন থেকে সোনালী কাঞ্চনবেলা মিলিয়ে গেলো। সদ্য পরিস্ফুটিত মনটিতে প্রেমের ছোঁয়া মিলিয়ে যেতে লাগলো। সমীরনে বিষাদ ছুঁয়েছে; তানপুরাতে আর সুর উঠলো না, হারমোনিয়ামে আর আঙুল চললো না, কণ্ঠ সুর তুলতে ব্যর্থ হলো।
কর্নকুহরে আর শ্রুতিমধুর শব্দতুলে নারীটির মোহনীয় কণ্ঠ প্রবেশ করলো না….করলো না নাকি করতে দিলো না। সবার সব অধিকার থাকে না। ভালোবাসাতেও অধিকার প্রয়োজন। যেই অধিকার ঐ সাধারণ একজন মধ্যবিত্ত ব্যাংকারের নেই…তাই তো তার ভালোবাসতে নিষেধ।
“অসামার্থ্য বোঝে না মন, চায় কেবল মায়া
নিজের যা, তাতেই কেনো শান্তি খোঁজে না মন?
দীপ্ত জিনিসেই কেনো জ্বলে তার মন?”
*****
স্কুল গেট সংলগ্ন খালি জায়গাটিতে বকুল গাছের ছায়ায় ছোট্ট একটি ছেলে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে। নোমান লম্বা লম্বা কদম ফেলে গেট দিয়ে ঢুকছিলো। স্কুলের ভেতর ঢুকতে গেলে তার গতিরোধ হলো অদূরে দাঁড়িয়ে থাকা ছেলেটিকে দেখে। পরিচিত আদল দেখতেই সে মৃদু হেসে এগিয়ে যায়। মিহি স্বরে জিজ্ঞাসা করে,
–“হেই ক্যাপ্টেন! স্কুল শেষ? এখানে দাঁড়িয়ে কি করছো? বাসায় যাবে না?”

দোদুল্যমান দেহ নিয়ে বুব্বো দূর্বল আঁখি তুলে তাকায় নোমানের দিকে। শরীরের উপর জোর খাটিয়ে মৃদু হেসে জবাব দেয়,
–“যাবো বন্ধু, মাম্মা নিতে আসবে।”

নোমানের ললাটে ভাঁজ পড়লো সর্বদা স্ট্রং চঞ্চল বুদ্ধিমান বাচ্চাটির এহেন দূর্বল কণ্ঠে। সে হাঁটু গেড়ে বসে। বুব্বোর কাঁধে হাত রেখে নম্র কণ্ঠে শুধায়,
–“ক্যাপ্টেন, এমন দেখাচ্ছে কেনো, শরীর খারাপ লাগছে?”

বুব্বো নিভু নিভু চোখে মাথা নাড়লো। বলল,
–“আমার অনেক খারাপ লাগছে বন্ধু। দাঁড়িয়ে থাকতে পারছি না। মাম্মা এখনো আসছে না কেনো বলো তো?”

নোমানের মুখশ্রী থেকে হরহামেশার ন্যায় রসিকতার প্রলেপ সরে গেলো। সে চিন্তিত লোচনে ছেলেটির কপালে হাত রাখলে উত্তপ্ত চর্মে অনুভব হয় ছেলেটির গা কাঁপিয়ে জ্বর এসেছে। সে বিলম্বহীন দু’হাত বাড়িয়ে দিলো বুব্বোর দিকে। বলল,
–“ক্যাপ্টেন, তোমার অল্প একটু জ্বর এসেছে, ভালো হয়ে যাবে চিন্তা করো না। তোমার মাম্মা এখনি এসে পড়বে। আপাতত আমার কাছে এসো।”

বুব্বো কিয়ৎকাল সময় নিলো। মাম্মা প্রতিদিন পই পই করে বলে দেয় কারোর দেয়া কিছু খাবে না, কোলেও উঠবে না, ডাকলেও যাবে না। কিন্তু শরীর যে সায় দিচ্ছে না। সে দূর্বল কণ্ঠে বলল,
–“মাম্মা বকা দেবে বন্ধু।”

নোমান আজ আর সম্মান করতে পারলো না মায়ের বাধ্যগত ছেলেটির শিক্ষাকে। সে জোরপূর্বক বুব্বোকে কোলে তুলে নিলো। মাথাটা কাঁধে চেপে বলল,
–“দুঃখিত, ক্যাপ্টেন! আপনাকে এভাবে রাখতে তো আমি পারবো না। আপনি বরং এখানে শুয়ে থাকুন, আপনার মাম্মা আসলে বাসায় চলে যাবেন।”

বুব্বোর ঢলে পড়া দেহ একটু আরাম পেল। সে দ্বিরুক্তি জানায় না বরং গলা জড়িয়ে ধরে শুয়ে থাকে। নোমানের ঘাড় গলা ভিজে উঠলো ছেলেটির উত্তপ্ত শরীরের আঁচে। ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়লো নোমান। ঘাড় ঘুরিয়ে ছেলেটির দিকে তাকালে অসহায়ত্ব অনুভব হয়। ছেলেটি ঘুমিয়ে পড়েছে। সে অদূরে একটা গাছের নিচে বাঁধাই করা শানের উপর বসলো বুব্বোকে কোলে নিয়ে। বুব্বোর ব্যাগ ঘেঁটে পানির বোতলটা বের করে নিজের রুমাল ভেজালো। অতঃপর সেটি বুব্বোর মাথায় রাখলো। বেশ কিছুক্ষণ সময় নিয়ে নোমান জলপট্টি দিলো। কিন্তু কাজ হচ্ছে না। ছেলেটার মা ও আসছে না। সে বুব্বোকে কোলে নিয়ে অপেক্ষা করতে লাগলো সেখানে দাঁড়িয়ে।

ততক্ষণে স্কুলের বাচ্চারা সবাই বেরিয়ে আসে। ভিড়ের মাঝে কেউ ছুটে এসে নোমানের পা জড়িয়ে ধরতেই, নোমান তাকায় ভাতিজির দিকে। ছয় বছরের নিশু হাসিমুখে তাকিয়ে আছে চাচার দিকে। চাচার কোলে অপরিচিত কাউকে দেখে শুধায়,
–“ছোট পাপা, তোমার কোলে এটা কে?”

নোমান হেসে বলল,
–“এটা সেই ক্রিকেটার মা—যেই ক্রিকেটার আমার ইয়ে উড়িয়ে দিচ্ছিলো।”

নিশু মুখে হাত দিয়ে ফিক করে হেসে উঠলো। নোমান ও হাসলো। তার ভবঘুরে জীবনের ছোট্ট আরেক সঙ্গী এই ভাতিজি। বড্ডো কাছের! প্রত্যেক দিন পুরোটা দিনের কর্মকাণ্ড তার কাছে ব্যক্ত করে নোমান।

–“একটা বাচ্চার সাথে কিভাবে কথা বলতে সেই নূন্যতম জ্ঞানটুকুও দেখছি নেই আপনার।”

কারোর তীব্র নিন্দা যুক্ত কটুক্তিতে নোমান কপাল কুঁচকে পিছু ফিরে তাকায়। দৃষ্টি নিবদ্ধ হয় বয়স আর অভিজ্ঞতায় অভিজ্ঞ এবং পরিপূর্ণ এক নারী অবয়ব। ক্ষয়িষ্ণু আলোয় নতুন দিনের স্বপ্ন দেখতে ভুলে যাওয়া এক বিধবা! যার বাহ্যিক অবয়বের সর্বত্র বিধবার শোক স্মৃতিচারণ করে চলেছে। কালো পাড়ের সাথে ধূসর রঙা জমিনের শাড়ি পরিহিতা এক স্বল্প পরিচিত আদল দেখতেই তার ভ্রু টানটান হয়ে গেলো। সেদিনকার বোকামো নয় বরং না জেনে কারোর উপর জঘন্য আরোপ লাগানোর কিঞ্চিৎ অপরাধবোধ কাজ করলো। সে কপাল কুঁচকে খানিক নিরুদ্বেগ শান্ত স্বরে বলল,
–“আপনার ছেলে আমার এল ই ডি বাল্ব উড়িয়ে দিচ্ছিলো সেটাই বলছিলাম।”

কথোপকথনে ছেলে যুক্ত হতেই সাধনা কপাল কুঁচকে নিলো। দাঁত খিচে শুধায়,
–“এল ই ডি বাল্ব মানে? কি করেছে বিভোর?”

নোমান হতবাক কণ্ঠে বলল,
–“এল ই ডি বাল্ব মানে জানেন না? আরে আমার বংশের বাতি।”

–“ছিঃ…বাচ্চাদের সাথে কেনো আপনি তো বড়োদের সাথেও কিভাবে কথা বলতে হয় তা জানেন না।” , সাধনা ধিক্কার জানিয়ে বলল। নোমান কপাল কুঁচকে নির্লিপ্ত কণ্ঠে বলল,
–“হ্যালো ম্যাডাম! এটাকে যদি আপনি ছিঃ বলেন তবে আমি কি বলবো আমার *** আপনার ছেলে বল ছুঁড়ে মেরেছে? সেটা ভালো শোনাতো নিশ্চয়ই?”

সাধনা দাঁত খিচে জড়সড় হয়ে দাঁড়ায় লোকটার লাগাম ছাড়া কথাবার্তায়। বলল,
–“আপনি চরম অভদ্র, বেয়াদব একটা লোক। পরিবার থেকে নূন্যতম শিক্ষা টুকু দেয়া হয়নি দেখছি। বাচ্চা বয়স্ক কোনকিছু মান্য করেন না। বয়সে আমি বড়ো হবো আপনার থেকে, সমীহ করে চলবেন।”

সাধনা খানিক শাসিয়ে বলল কথাগুলো। নোমান ভ্রু উঁচিয়ে নিলো সাধনার কথায়। ভদ্রমহিলার চোখেমুখে ভরপুর ঘৃণা তার জন্য। সে জানে এই ঘৃণা বিতৃষ্ণা আজকের নয় বরং সেদিনকার ঘটনার জের ধরেই। সে কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল,
–“তো ম্যাডাম, আপনি নাহয় ভদ্রতা আদব কায়দা শিখিয়ে দিন। বয়সে বড়ো হয়েছেন কিসের জন্য! যেনো ছোটদের সঠিক শিক্ষা দিতে পারেন; নচেৎ তাদের ঘৃণা করার জন্য।”

–“এটা আমার দায়িত্ব নয়, আপনার পরিবারের দায়িত্ব। যার উপযুক্ত সময় অনেক আগেই পার হয়ে গিয়েছে। এখন এই বয়সে এসে শিষ্ঠাচার শিখতে আসাটাও একটা ফাজলামো।”, সাধনা আত্মসংযমের সাথে বলল।

নোমান কপাল কুঁচকে নেয়। বলে,
–“ম্যাডাম বয়সের পার্থক্য তো তখন মহত্ত্ব পূর্ণ হয় যখন সেটা আদোতে সঠিক কাজে আসে। আপনি শিষ্ঠাচারের জ্ঞান দিলেন অথচ শিষ্টাচার শেখার আগ্রহটাকে ফাজলামো বলে দিলেন। বয়সের সাথে এহেন অপরিপক্বতা কি মানানসই? আপনি শিষ্টাচার শিখিয়ে দেখুন আমি শিখে নেবো গড়গড় করে।”

সাধনার ব্যক্তিত্বে বেশ আঘাত লাগলো খানিক গাম্ভীর্যের সাথে শুধায়,
–“যখন শেখার বয়স ছিল তখন কি করেছিলেন?”

–“বোতলে প্রাকৃতিক গরম পানি ভরে টিচারের বাগানের ফুল গাছে পানি দিতাম। পেট মোটা টিচার সারাদিন শুধু বলতো এটা করবে না,ওটা করবে না শুধু বই পড়বে। শৈশব উপভোগ করবো নাকি তার কথা মেনে চলবো বলুন? তাই তো তখন ওগুলো শিখি নি।”, বলেই গা দুলিয়ে হাসলো নোমান। প্রাকৃতিক গরম পানি শুনতেই সাধনা দাঁতে দাঁত চাপলো। বলল,
–“অভদ্র লোক!”

নোমান তাতেও হাসলো। বলল,
–“এখন আর শৈশবের যাতনা নেই ম্যাডাম। আপনি চাইলে ভদ্রতা শেখাতে পারেন; আমি মনোযোগ সহকারে শিখবো।”

সাধনা আর ভ্রুক্ষেপ করে না তার কথার। থমথমে মুখে জিজ্ঞাসা করে,
–“আমার ছেলে আপনার কাছে কি করছে?”

নোমানের ধ্যান ফিরলো এখন। সে হড়বড়িয়ে বলল,
–“আপনি এতো দেরি করে আসলেন কেনো? ছেলেটা অসুস্থ, গা পুড়ে যাচ্ছে জ্বরে। আপনার অপেক্ষা করছিল দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে। কিন্তু দাঁড়িয়ে থাকতে পারছিল না তাই আমি কোলে নিয়েছি।”

সাধনার মুখশ্রী আ’ত’ঙ্ক জর্জরিত হয়ে পড়লো। সে দ্রুত বুব্বোকে হাত বাড়িয়ে নিজের কোলে নিয়ে নিলো। চিন্তিত কণ্ঠে শুধায়,
–“বুব্বো? আব্বু, শুনতে পাচ্ছো? মাম্মা এসে পড়েছি, আব্বু। খুব কষ্ট হচ্ছে তোমার? হঠাৎ এতো জ্বর আসলো কি করে?”

নোমান মুখ বিকৃত করে দেখলো অতিশয় নরম মনের এক মা’কে। এখুনি কেঁদে দেবে এমন ভাবখানা। ঘুমন্ত ছেলেকে জিজ্ঞাসা করছে তার কষ্ট হচ্ছে কি-না। সে বলল,
–“এখানে দাঁড়িয়ে সময় নষ্ট না করে ওকে বাড়িতে নিয়ে যান। কিছু খাইয়ে ওষুধ খাইয়ে দিন। ভালো না হলে ডাক্তারের পরামর্শ নিন দ্রুত।”

সাধনা ব্যতিব্যস্ত হয়ে ছেলেকে নিয়ে হাঁটা ধরলো। নোমান নিজের হাতের দিকে একবার তাকিয়ে পিছু ডাকলো সাধনাকে।
–“এই যে ম্যাডাম! শুনছেন?”

সাধনা পা থামিয়ে পিছু ফিরে তাকায়। নোমান দুই পা এগিয়ে গিয়ে হাতের স্কুল ব্যাগটা এগিয়ে দিল। সাধনা থমথমে মুখে সেটি নিয়ে আবার হাঁটা শুরু করবে তার আগেই নোমান ফের ডেকে উঠলো। বলল,
–“সেদিনের জন্য দুঃখিত!”

সাধনার দেহ থমকালো। কর্নকুহরে ফের তিক্ততা সৃষ্টি করে বাজতে লাগলো ভুলতে চাওয়া সেই শ্রুতিকটু শব্দগুলো। টলমলে আঁখি তুলে তাকায় নোমানের শান্ত মুখশ্রীর দিকে। বলে,
–“আপনার এই একটা দুঃখিত বলাতে আমার চরিত্র থেকে দাগ কি মুছে যাবে? আপনি কি মুছে ফেলতে পারবেন সেদিনকার অনুভব করা সেই বিদঘুটে অনুভুতি? আপনার জবাব না হলে, আর কখনো এমন দুঃখিত নামক ঠুনকো শব্দ নিয়ে মানুষের আঘাতে নুন ছিটাতে আসবেন না। এতে জ্বলন কমে না বরং আরো বাড়ে।”

দৃঢ় কণ্ঠে বলেই সাধনা গটগট করে চলে গেলো সেখান থেকে। নোমান ফোঁস করে উষ্ণ নিঃশ্বাস ফেললো ভাতিজির অবুঝ দৃষ্টির দিকে তাকিয়ে উদাসীন কণ্ঠে বলল,
–“বুঝলে নিশু , ছোট পাপা মনে হয় কাউকে অনেক কষ্ট দিয়ে ফেলেছি। এখন কি হবে?”

নিশু কাঁধ ঝাঁকিয়ে ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে বলল,
–“কি আবার হবে? তুমি তার পিছু ছাড়বে না যতক্ষণ পর্যন্ত না তার কষ্টকে সুখে পরিণত করতে পারছো। বুঝেছো? ব্যাড পিপলদের আল্লাহ কখনো ভালোবাসে না। তুমি ঐ আন্টির থেকে স্যরি একসেপ্ট করিয়েই দম নিবে, তাহলেই হবে আমার সাহসী ছোট পাপা!”
নিশু বেশ আঙ্গিভঙ্গি করে বলল। মুহুর্তেই নোমানের মুখে হাসি ফুটে উঠলো। সে উচ্ছ্বসিত হয়ে বলল,
–“এর জন্যই তো বলি আমার নিশু বেস্ট! ছোট পাপার সব চিন্তা দূর করার জন্য নিশুপিশু একাই যথেষ্ট! ওকে, নিশুপিশু ডান। এবার আমাদের লক্ষ্য হলো ঐ তেতোমুখী সিনিয়র ম্যাডামের থেকে স্যরি একসেপ্ট করানো।”

–“ইয়েসসস!”, নিশু চাচার সাথে হাই ফাইভ করে বলল। অতঃপর দু’জনে হাসতে হাসতে বাড়ি ফিরলো।
নোমান বত্রিশ বছর বয়সী একজন পরিপূর্ণ পুরুষ। তবে তার ব্যক্তিত্ব খানিক ভিন্ন ধারার। ধরাবাঁধা জীবনে সে অনাগ্রহী। পড়াশুনা শেষ করে বাবা ব্যবসায় হাত বাটানো দিনশেষে পকেট ভারী করার দায়িত্ব বাবার থাকে। এবং এভাবেই তার ভবঘুরে, হাস্যরসাত্মক , স্বাধীন জীবনযাত্রা অব্যাহত রয়েছে। এই ভবঘুরে জীবনে বহুবার দায়িত্বের কাঠগড়ায় নিজেকে দাঁড় করাতে গিয়েছিল কিন্তু পেরে ওঠেনি। কখনো মনের সাথে পেরে ওঠেনি তো কখনো পরিস্থিতি পেরে উঠতে দেয়নি। এর জন্যই এখনো সে অবিবাহিত! কারোর মাঝে আগ্রহ সে খুঁজে পায় না। মোটকথা জীবনসঙ্গীর মাঝেও চমৎকার ভিন্ন কিছু খুঁজে বেড়ানো এক অদ্ভুত ব্যক্তিবধারী মানুষ সে।
*****
সেদিনের পর থেকে প্রত্যাহিক নিয়মকে ভঙ্গ করে রাত সাড়ে নয়টা থেকে সাড়ে দশটা—এই সময়টুকু চায়ের দোকানের সামনের বেঞ্চি নামক জড়বস্তু দু’টি জনমানবহীন হয়ে পড়ে থাকে। কেউ আসে না; আসে না সাদামাটা একটা লুঙ্গি আর টিশার্ট পড়া ঐ লোকটা আর না তার বন্ধুরা। এখন আর বিরঙ্গনার সম্মুখের ছোট্ট স্ট্যান্ডের স্টিলের বেঞ্চিটিতে সুকুমার প্রবন মানুষটিকে দশ মিনিট বসতে দেখা যায় না। প্রায় ঘন্টা যাবৎ মানবশূন্য বেঞ্চির অপরপাশে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে অপেক্ষা করা টলটলে স্বচ্ছ নেত্রের অধিকারীর নেত্র সিক্ত হয় প্রত্যাহিক। কিন্তু সেই সিক্ত নেত্রকে গুরুত্ব দেয়ার মতো কেউ থাকে না। উজ্জ্বল আলোয় আলোকিত একাকী কাঞ্চনবেলা মনে করিয়ে দেয় ভালোবাসা হয়তো ভুল! ভুল নাহলে কেউ এভাবে ভুলের শাস্তি দেয়?

বেঞ্চির এক কিনারায় বসে আছে একটি ছিমছাম গড়নের মেয়ে। দৃশ্যখানা হরহামেশা দেখার মতো একটা সাধারণ দৃশ্য। অনবরত দুলতে থাকা দুটি পা বোঝায় অস্থিরতা, কোলের মাঝে কচলাতে থাকা দুটি হাত মেয়েটির রাজ্যের চিন্তার বহিঃপ্রকাশ করছে; আর বারবার ঘাড় ঘুরিয়ে সরু সিঁড়ির দিকে তাকানো চঞ্চল নেত্র জানান দেয় কারোর মুখদর্শনের জন্য তৃষ্ণার্ত নারীটির তনু মন। রেস্টরুম সংলগ্ন বারান্দার গ্লাসটির অপরপ্রান্তে থাকা দুটি উদাসীন নেত্র দেখলো সেই অস্থিরতা আর অপেক্ষা। কানে ফোন ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা স্বরূপ ম্লান বদনটির ভর ছেঁড়ে দাঁড়িয়ে আছে। ভেবেছিল এযাত্রায় নারীটির মন দুঃখি করার অপরাধে আজন্ম বিরহ যন্ত্রনা বরন করতে হবে কিন্তু নারীটি যে অবুঝ!
–“স্যার শুনছেন?”

–“হুঁ… ওহ্ হ্যাঁ, শুনছি। আপনি বলুন।”

কারোর তলবে ধ্যানচ্যূত হলো স্বরূপ। ফোনের অপরাপাশ থেকে আওয়াজ ভেসে আসছে। সে অপ্রস্তুত কনভারসেশন শুরু করলো আবার। ঘড়িতে তখন পাঁচটা চল্লিশ। এখনো তাদের ডিউটি শেষ হয়নি। আজ আরো দেরি হবে অন্তত এই একটা দিক থেকে স্বস্তি! নয়তো প্রতিনিয়ত অপেক্ষারত নারীটিকে উপেক্ষা করতে বহু কসরত করতে হয়!
স্বরূপের বের হতে হতে আজান পড়ে গেলো। সহকর্মীদের বিদায় সম্ভাষণ জানিয়ে বের হয়ে লম্বা লম্বা পা ফেললো। খিদে পেয়েছে! এখন সন্ধ্যা বাজারে যাবে, বাজার করবে তারপর ঘরে ফিরবে। পকেটে ফোন বেজে উঠতেই কানে ফোন ঠেকায়। ডেকে ওঠে,
–“আম্মা!”

অপরপ্রান্ত থেকে ভেসে আসলো মায়ের চিন্তিত কণ্ঠ,–“স্বরূপ আব্বা, বুব্বোর যে গা কাঁপিয়ে জ্বর এসেছে। সকাল থেকেই জ্বর এসেছে, ভেবেছিলাম কমে যাবে কিন্তু এখনো কমছে না। তাই তোকে ফোন দিলাম একটু ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাবি না-কি?”

স্বরূপের মুখশ্রী বিবর্ণ হয়ে পড়লো। চিন্তিত কণ্ঠে বলে ওঠে,
–“আম্মা সকাল থেকে জ্বর আর তুমি এখন আমায় বলছো? কি করো তোমরা আম্মা আমি বুঝিনা।”

শুনিতা মিনমিনে স্বরে বলল,
–“ভেবেছিলাম ডাক্তার ছাড়াই ভালো হয়ে যাবে। তাই তোকে জানাইনি।”

স্বরূপ বিরক্ত মিশ্রিত নিঃশ্বাস ফেললো। শ্রান্ত কণ্ঠে বলল,
–“তোমরা আমার মাথার চিন্তা কমাতে গিয়ে দ্বিগুণ বাড়িয়ে দাও আম্মা। ওকে রেডি করে রাখো আমি এখনি আসছি।”

বলে ফোন কেটে দুই জোর কদমে এগিয়ে গেলেই তার পা দুটো থমকায়। চায়ের দোকানের মৃদু আলোয় স্পষ্ট মানবীর বিমর্ষ মুখটি। স্বরূপের দেহাবয়ব ম্লান হয়ে আসে অন্ধকার নেমে গেলেও মেয়েটিকে সেখানে বসে থাকতে। চঞ্চল এলোমেলো দৃষ্টিতে তাকাতে তাকাতেই নৈরার চোখদুটো চকচক করে উঠলো ঘর্মাক্ত চিরচেনা বহুল আকাঙ্ক্ষিত মানুষটিকে দেখতেই। তবে তার উজ্জ্বলতা মিলিয়ে গেলো স্বরূপের দ্রুত পথ বদলে নেয়া দেখতেই। নৈরা চুপটি করে বসে বসে দেখলো অতিদ্রুত উল্টো পথে হাঁটতে থাকা মানুষটিকে। বিগত একটা সপ্তাহ একটাবারের জন্য মুখ ও দেখতে পারেনি।আজ পন করেছিল না দেখা করে যাবে না তাতে যে কয়টা বাজুক! অথচ দেখো সামার্থ্যের বাইরে বলে বলে তার এতো এতো প্রতীক্ষার কোন মূল্য ই দিলো না কঠোর লোকটা। অনুমতিবিহীন গড়িয়ে পড়া অশ্রু গুলো ক্ষিপ্র হাতে মুছে ফেললো নৈরা। অদূরে দাঁড়িয়ে থাকা ড্রাইভার লোকটি তখন নিরবে দেখছে মেয়েটিকে। রাতের অন্ধকারে কখনো মেয়েটিকে একা ছাড়তে পারবে না তাতে যতো যাই হয়ে যাক না কেনো! নৈরা ব্যাগ হাতে উঠে দাঁড়ায়। গাড়ির কাছে গিয়ে দাঁড়াতেই ড্রাইভার চাচা ছুটে আসলো। নৈরা থমথমে মুখে বলল,
–“বাবাকে কিছু বলবেন না চাচা।”

ড্রাইভার বিনীত ভঙ্গিতে মাথা নাড়লো।

চলবে…