কাঞ্চনবেলা পর্ব-১৩

0
19

#কাঞ্চনবেলা
#তোনিমা_খান
#পর্বঃ১৩

দায়িত্বের মারপ্যাঁচে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে থাকা এক সহজসরল সত্ত্বা স্বরূপ। এবং বরাবরের মতোই বৈপরীত্য আচরণের দ্বারা নির্মলপ্রাণ ব্যাক্তিত্বধারী পুরুষটি হেরে যায় জটিল এই মারপ্যাঁচের কাছে। দায়িত্বের কাছে হেরে যায় তার সহজ সরল সত্ত্বাটি। ঠিক যেভাবে আজ ও হেরে গেলো স্বরূপের ছোট ছোট সুখ গুলো। এই যে চায়ের দোকানে বসে, এক কাপ চায়ের সাথে এক ঘন্টা সময় কাটানো ও আজ স্বরূপের কাছে স্বার্থপরতা মনে হলো।

সদর দরজাটি খুলে যেতেই স্বরূপ ঘরে ঢুকতে ঢুকতে বোনের উদ্দেশ্যে উদ্বিগ্ন কণ্ঠে শুধায়,
–“আম্মার শরীরের কি অবস্থা আপা? ওষুধ শেষ হয়ে গিয়েছে তা তুই আমায় আগে বলবি না? শেষ হয়ে যাওয়ার পর বলার অভ্যাস তোদের কবে যাবে?”

সাধনা শান্ত দৃষ্টিতে তাকায় অত্যাধিক পরিমাণে উদ্বিগ্নতায় বিবর্ণ হয়ে যাওয়া ভাইয়ের মুখপানে। বাড়িয়ে দেয়া ওষুধের প্যাকেটটি হাতে নিয়ে মৃদু আশ্বস্ত করে বলল,
–“এতো চিন্তার কিছু নেই স্বরূপ। হঠাৎ করেই প্রেশারের কারণে মাথাব্যথাটা বেড়ে গিয়েছিল। এখন কমেছে একটু। ওষুধ ছিল একটা, খেয়েই ঘুমিয়েছে।”

স্বরূপ ভরহীন দেহে ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলল। চায়ের দোকানে বসেছিল তখন আপা ফোন করে জানায় মায়ের শরীর খারাপ করছে, ওষুধ ও শেষ। সে নিশ্চিন্তের নিঃশ্বাস নিয়ে, বলল,
–“আমার তো সবসময় মনে থাকে না সবকিছু। তুই ওষুধ শেষ হওয়ার আগেই আমায় বলবি।”

সাধনা হেসে মাথা নাড়লো। বোনকে পাশ কাটিয়ে স্বরূপ পা বাড়াতে নিলে সাধনা ভাইকে পিছু ডাকলো।তার দৃষ্টি ভাইয়ের হাতে থাকা কন্টেইনারটির দিকে। জিজ্ঞাসা করে,
–“ওটাতে কি এনেছিস?”

স্বরূপ পা থামায়। বোনের দৃষ্টি অনুসরণ করে তাকায় নিজের হাতে থাকা কন্টেইনারটির দিকে। ম্লান হেসে উদাসীন কণ্ঠে বিড়বিড় করে বলে,
–“কারোর পাগলামি!”

–“কি?”

ফের বোনের প্রশ্নে স্বরূপ চঞ্চল দৃষ্টি ফেলে কন্টেইনারটি বোনের দিকে এগিয়ে দিলো। বলল,
–“এতে চিংড়ি মাছ আছে, নে।”

–“চিংড়ি মাছ কোত্থেকে আনলি? আবার এই বাটিতে করে? কিনে এনেছিস?”, সাধনার অবুঝ কণ্ঠে স্বরূপকে অপ্রস্তুত হতে দেখাগেলো। সে বোনের প্রশ্ন উপেক্ষা করে মিহি স্বরে বলল,
–“চিংড়ি মাছ দিয়ে ব্রকলি খেতে অনেক মজা লাগে, আপা। রান্না করবি এখন?”
সাধনা খুশি হয় ভাইয়ের আবদারে। স্বরূপ কিছু আবদার করলে তার খুব ভালো লাগে। তার ভাইটা যে একদম প্রবাহিত স্বচ্ছ পানির মতো! উদ্দেশ্য, বেরঙ, শখ- আহ্লাদ হীন জীবনযাপন তার। নিজের জন্য কোন চাহিদা তার নেই। বড়ো হয়েছে পর থেকে একেরপর এক বিরূপ পরিস্থিতি কখনো তাকে নিজের জন্য কিছু চাহিদা গড়ার সুযোগ ই তো দেয়নি। এমনকি এই চাহিদা খাবারের ক্ষেত্রেও তৈরি হয়নি! তাকে যদি ভাতের সাথে এক মরিচ পোড়াও দেয়া হয় সে নিরবে, অভিযোগহীন খেয়ে উঠে যাবে। সে তৎক্ষণাৎ মাথা নেড়ে উচ্ছ্বসিত হয়ে বলল,
–“খেতে ইচ্ছে করছে? আমায় পনেরো মিনিট সময় দে আমি রান্না করে আনছি।”

–“তাড়া নেই আস্তেধীরে রান্না কর। সন্ধ্যায়’ই তো খেলাম ভাত। খিদে নেই।”

বলে স্বরূপ মায়ের ঘরের দিকে পা বাড়ায়। চাপিয়ে রাখা দরজা খুলে নিঃশব্দে উঁকি দিতেই অন্ধকারাচ্ছন্ন নিরব ঘরটি দেখে সে ভারী নিঃশ্বাস ফেললো। নিঃশ্বব্দে ভেতরে এগিয়ে গিয়ে হাঁটু ভাঁজ করে মায়ের পাশে বিছানায় বসলো। নির্মল নেত্রে ঘুমন্ত মাকে কিয়ৎকাল দেখতে দেখতে ধীরস্থির মায়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগলো। বয়স হওয়ায় নানাবিধ রোগ বাসা বাঁধে দেহে। প্রেশারের কারণে মায়ের এই অসুস্থতা আরো তীব্রতর হয়। তাদের বংশের ধারা এই উচ্চ রক্তচাপ। তার বাবাও এই কারণেই অকালে স্ট্রোক করে মারা যায়। সে ভয় পায় ঘুণপোকার বেশে থাকা এই ছোট ছোট শারীরিক সমস্যা গুলোকে। কখন না আবার তার বেঁচে থাকার স্বল্পকিছু এই কারণ কেড়ে নেয়! দিনশেষে সে তো বাঁচে এই মানুষগুলোর জন্য। এই মানুষগুলো কে অন্তভাগে সুস্থ সবল, হাসিখুশি দেখার জন্য সে সকল ক্লেশ, পরিশ্রম হাসিমুখে সহ্য করে নেবে। মায়ের ঢিলে হওয়া চামড়ার ভাঁজ দেখতে দেখতেই স্বরূপের স্থবির চিত্ত মৃদু হকচকালো পকেটের ফোনটি ভাইব্রেট করে উঠতেই। পকেট থেকে ফোনটি বের করতেই ভেসে উঠলো একটি স্নিগ্ধ উপাধি “কাঞ্চনবালা”। হ্যাঁ কাঞ্চনবালা, দায়িত্ব-কর্তব্য ছাপিয়েও তার সাদামাটা জীবনটিতে কেউ দুর্ধর্ষ রাজত্ব চালায়। বোকাসোকা রাজত্ব! যে কি-না তার বেরঙ দুনিয়াটাকে রঙিন করার দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছে। মলিন মুখটিতে গোধূলির আকাশে ক্ষীণ চাঁদের আলোর ন্যায় স্বয়ংক্রিয়ভাবে এক টুকরো স্মিত হাসি ফুটে উঠলো। মায়ের দিকে এক পলক তাকিয়ে ফোন হাতে বেরিয়ে আসে স্বরূপ। বাজতে থাকা ফোনটিকে শান্ত করে কানে ঠেকালে ভেসে আসে ছটফটে চঞ্চল কণ্ঠ।
–“স্বরূপ! স্বরূপ!”

স্বরূপ মৃদু হেসে মেয়েটিকে অনুকরণ করে একই রকম ছটফটে চঞ্চল কণ্ঠে জবাব দিলো,
–“বলুন! বলুন!”

নৈরা ফোনের দিকে তাকিয়ে কপাল কুঁচকে নিলো। লোকটা তাকে অনুকরণ করছে ভাবতেই সে নিজের চঞ্চলতা গলাধঃকরণ করে নিলো। মিইয়ে যাওয়া কণ্ঠে শুধায়,
–“আপনি এতো তাড়াতাড়ি চলে গেলেন কেনো?”

স্বরূপ হাসি বন্ধ করে মিহি স্বরে বলল,
–“আম্মার ওষুধের প্রয়োজন ছিল তাই।”

–“ওহ্।”

–“হুম।”

নৈরা বিরক্ত হয় স্বরূপের এমন ছোট আর মেপে মেপে দেয়া জবাবে। সে বোকাসোকা কণ্ঠে শুধায়,
–“আপনি সবসময় এমন মেপে মেপে কথা বলেন কেনো?”

স্বরূপ নিজের ঘরের দিকে যেতে যেতে নিঃশব্দে হাসলো। বলল,
–“মেপে মেপে কোথায় কথা বললাম? আপনি যা জিজ্ঞাসা করেছেন তার যথার্থ উত্তর তো দিলাম।”

–“সেটাই তো! আমি যেটুকু জিজ্ঞাসা করি সবসময় শুধু সেটুকুর ই জবাব দেন কেনো?”

–“আপনার সাথে বাড়তি কি কথা বলবো কাঞ্চনবালা? প্রেমালাপ নাকি বন্ধু সুলভ হাসি ঠাট্টা? দুটোর একটাও করার মতো সম্পর্ক আমাদের মাঝে নেই।”
সাধারণ ভাবে বলা কঠিন কথাটিতে অপরপ্রান্ত একদম নিশ্চুপ হয়ে গেলো। নৈরার উজ্জ্বল দৃষ্টিদ্বয় টলটল করে উঠলো অনতিবিলম্বে। উদাসীন দৃষ্টি হাতে থাকা আলু বুখারার ছোট্ট জারটির দিকে। অন্তঃস্থলে প্রশ্ন জাগে বিগত তিন মাসেও সে তাদের সম্পর্কটাকে একটা নাম দিতে পারলো না? নাকি লোকটি দিতে চায় না?

–“নৈরা? আর কিছু বলবেন?”, মিহি স্বরে ডেকে ওঠে স্বরূপ। নৈরা টলমলে চোখ মুছে গম্ভীর শক্ত কণ্ঠে বলল,
–“আমি আপনাকে ব্রকলির রেসিপি বলতে ফোন দিয়েছিলাম। কিন্তু আপনি বোধহয় বিরক্ত হচ্ছেন, দু্ঃখিত!”

স্বরূপ মৃদু হাসলো মেয়েটির রাগান্বিত স্বরে। শান্ত স্বরে বলল–“যা বিরক্ত করার করেই দিয়েছেন কাঞ্চনবালা! এখন দয়াকরে রেসিপিটা বলে দিলে একটু উপকার হতো। আমি নিশ্চিত কাঞ্চনবালা কারোর উপকার করতে কার্পণ্য করবে না। কাঞ্চনবালা তো বিশাল উদার মনের মানুষ, তাই না?”

নৈরার অভিমান তরতর করে বেড়ে গেলো লোকটার প্রহসনের কণ্ঠে। সে ক্ষেপে গিয়ে বলল,
–“হ্যাঁ হ্যাঁ আমি অনেক উদার, বিশাল মনের মানুষ। আপনার মতো কিপ্টে, নির্দয় কঠোর না যে কথাও মেপে মেপে বলে। তাই তো এখনো আপনার সাথে কথা বলছি। কিন্তু আর কখনো বলবো না। রেসিপি বলার পরেই আমি ফোন কেটে দেবো আর কখনো ফোন দেবো না।”

স্বরূপ গা দুলিয়ে হাসলো মেয়েটির ক্ষিপ্ত কণ্ঠে। নৈরা সত্যি সত্যি ব্রকলির রেসিপি বলেই ফোনটা কেটে দিলো। স্বরূপ হাসতে হাসতে নিজের ঘর থেকে বের হলো। বের হতেই দুটি ছোট ছোট হাত ক্ষিপ্র বেগে তার পা দু’টো জড়িয়ে ধরলো। বুব্বো তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করে বলল,
–“মামু, সাড়ে দশটা বাজে মাম্মা এখনো আমায় বই পড়াতে চায়। তুমিই বলো ছোট বাচ্চারা কি এতো রাত পর্যন্ত বই পড়ে?”
স্বরূপ মৃদু হেসে একহাতে ভাগ্নেকে কোলে তুলে নেয়। সাধনা লম্বা লম্বা কদম ফেলে এগিয়ে আসে ভাইয়ের কাছে। অসন্তোষের সাথে বলে,
–“স্বরূপ ওকে নামা কোল থেকে। কাল ওর পরীক্ষা রয়েছে। অথচ সব পড়া এখনো কমপ্লিট করতে পারেনি। পরীক্ষার সময় রাত আর দিন আছে? যতক্ষণ না পড়া শেষ হচ্ছে ততক্ষণ বই পড়তে হবে।”

মায়ের কথায় বুব্বো আর্তনাদ করে উঠলো,
–“মামুউউউ!”

স্বরূপ হেসে শান্ত দৃষ্টিতে তাকায় বোনের দিকে। ইশারায় আশ্বস্ত করে সে দেখছে। সাধনা রাগ দমন করে নিলো। স্বরূপ ভাগ্নেকে কোলে নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে বলল,
–“আচ্ছা আর পড়তে হবে না। চলো আমরা এখন রান্না করি মাম্মার সাথে। তোমার মাম্মা আমাদের জন্য ব্রকলি রান্না করবে তারপর আমরা মজা মজা করে খাবো।”
পড়া বাদে বুব্বো এই মুহূর্তে সবকিছুতে আগ্রহী। স্বরূপ বোনের পিছু পিছু রান্নাঘরে গিয়ে ঢুকলো। সাধনা ব্রকলি ধুতে ধুতে বলল,
–“তুই এখানে কি করছিস? যা গিয়ে বস আমি রান্না করে আনছি।”

স্বরূপ কাঁচুমাচু করতে লাগলো। মিনমিনে স্বরে বলল,
–“তোকে সাহায্য করি।”

–“প্রয়োজন নেই।”, সাধনার ব্যস্ত কণ্ঠ। স্বরূপ মাথা চুলকাতে লাগলো। এখন বোনকে রেসিপি বলবে কি করে! গাইগুই করে স্বরূপ বড়ো সাহস করে রেসিপি বলল বোনকে। অতঃপর আলাভোলা হেসে বলল,
–“এভাবে রান্না কর আপা।”

কেটে রাখা ব্রকলির ঝুড়ি হাতে সাধনা সরু চোখে ভাইকে পর্যবেক্ষণ করছে। কণ্ঠে পর্যবেক্ষণের রেশ নিয়ে শুধায়,
–“এই রেসিপি কোত্থেকে শিখলি? এভাবে রান্না না করলে খাওয়া যাবে না?”

স্বরূপ বোকার মতো হাসলো বোনের প্রশ্নে। বিব্রতকর পরিস্থিতি আর নিতে পারলো না স্বরূপ। লজ্জায় মাথা হেট হয়ে যাবে যদি বড়ো বোনের সামনে আর কোন লজ্জাজনক পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়। মেয়েটির পাল্লায় পড়ে এমনিতেই যথেষ্ট বাড়াবাড়ি করে ফেলেছে সে। আর না। সে বলল,
–“খাওয়া যাবে না কেনো! অবশ্যই যাবে। তুই রান্না কর, আমি খাবো।”

বলেই সে এখন কেটে পড়তে উদ্বত হলো। সাধনা অবুঝপানে তাকিয়ে রইল হম্বিতম্বি করে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে যাওয়া ভাইয়ের দিকে।

সাধনার রান্না শেষ হতেই স্বরূপ বুব্বোকে কোলে করে প্লেট হাতে হাজির হয় বোনের কাছে। সাধনা হেসে ফেললো প্লেটহাতে ভাইকে দেখে। আদুরে গলায় শুধায়,
–“তুই আজ এমন বোকা বোকা আচরণ করছিস কেনো স্বরূপ? ব্রকলি তোর এতো পছন্দ? আগে তো কখনো বলিসনি?”

স্বরূপ লাজুক হেসে বলল,
–“সঙ্গদোষ!”

–“হ্যাঁ?”

–“কিছু না। তাড়াতাড়ি দে খিদে পেয়েছে।”,স্বরূপ তাড়াতাড়ি করে ব্রকলি নিয়ে টেবিলে বসলো। অতঃপর মামু ভাগ্নে ভীষণ উৎসুকতা আর আগ্রহ নিয়ে ব্রকলি দিয়ে মজা করে ভাত খেলো। খেয়েদেয়ে মামু ভাগ্নে তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলে এক গাল হাসলো। বুব্বো খেয়েদেয়ে প্রশংসা করে বলল,
–“মামু এই সবজিটা খেতে ভালো। এরপরে আরো আনবে বুঝলে!”

স্বরূপ একমত না হয়ে পারলো না। সে হেসে বোকা মেয়েটির বোকামি অনুসরণ করে বলল,
–“বিশ টাকায় দিলে একবার কেনো রোজ আনবো।”

বুব্বো বুঝলো না মামুর কথা। তেমনি স্বরূপ ও বুঝলো না বোকা মেয়েটি তাকে একটু ব্রকলি খাওয়ানোর জন্য কতোটা চালাকি করেছে। মাঝেমাঝে কিছু কিছু জিনিস অজানাই সুন্দর হয়! যেমন, স্বরূপ নৈরা নামক দুই সাদামাটা ব্যক্তিত্বধারী মানুষের এই সুপ্ত ভালোবাসার অজানা রূপটাই তাদের সৌন্দর্য। তবে কি আজন্ম এই অজানা রূপটাই তাদের ভালোবাসার সৌন্দর্য হয়ে থেকে যাবে? এহেন প্রশ্ন তখন বাতাবরণে বারংবার প্রতিধ্বনিত হতে লাগলো।
*****
একজন পুরুষ যখন বাবা হয় তখন তার জীবনটা ঠিক তার সন্তানের ভালো থাকা কেন্দ্রীক হয়ে ওঠে। ঐ জীবনে নিজের জন্য আর কিছু থাকে না। যেটুকু থাকে সেটুকু সবটা—একদম সবটা তার সন্তানের জন্য। নুহাশ মাহমুদ এই কাতারে পড়া একজন চমৎকার বাবা। যার কাছে পৃথিবীর সকল কিছুর উর্ধ্বে গিয়ে তার সন্তানের ভালোথাকা মূখ্য।

“আপনার এই ভালোথাকায় আমি আপনার বোকামো গুলোকেও কখনো বাঁধা হতে দেবো না, আম্মা।”, নুহাশ মাহমুদ উদাসীন কণ্ঠে বিড়বিড় করলো। বাবা অফিস রুমে বসা নিরাদ নিগুঢ় চোখে পর্যবেক্ষণ করছে বাবাকে। মস্তিষ্কে চলা উচাটন সামলে উদ্বিগ্ন কণ্ঠে শুধায়,
–“তবে কি করতে চাইছো এখন? তোমায় আমি আগেই বলেছিলাম নুরু সহজ সরল! একা একা বাইরে ছাড়া ঠিক হবে না। কিন্তু তুমি শোননি। সবসময় প্রশ্রয় দিয়েছো। রোজ রোজ একা একা বিরঙ্গনায় ছেড়ে রেখেছো। আজ দেখলে কিভাবে ঝামেলায় জড়িয়ে গেলো? ঐ ছেলে নিশ্চয়ই ওর ব্রেইন ওয়াশ করিয়ে নিয়েছে!”

নুহাশ মাহমুদ গম্ভীর মুখটি তুলে তাকায় ছেলের দিকে। গমগমে স্বরে বলল,
–“তাকে সঠিক পথে আনার দায়িত্ব আমার। সেটা আমি যেভাবেই হোক না কেনো করে ছাড়বো।”

নিরাদ বিরক্তি ভরা নিঃশ্বাস ফেলে তাচ্ছিল্য করে বলল,
–“তবে এর জন্যই তোমার বোকা মেয়ের এতো পরিবর্তন। তিনবেলা খাবারে সে কখনো মাংস ছুঁয়ে দেখে না বাবা। সপ্তাহে একদিন মাংস খায়, ঐ দু’টো শাড়ি ঘুরিয়ে ফিরিয়ে পড়ে। সে হতদরিদ্র পরিবারের বউ হওয়ার জন্য নিজেকে এভাবে প্রস্তুত করছে। মানুষ কতোটা বোকা আবেগী হলে এমন কাজ করে, আমি নুরুকে না দেখলে বুঝতেই পারতাম না।”

নুহাশ মাহমুদ জবাব দিলেন না। চোখেমুখে রাজ্যের আক্রোশ, বিতৃষ্ণা, বিরক্তি। অন্তঃস্থলে একরোখা এক জেদি প্রশ্ন জেঁকে বসেছে, তার সন্তানটিকে ভবিষ্যতে খাবার নিয়ে ও সংকটে পড়তে হবে এটা কি কোন বাবা সহ্য করতে পারবে? জবাব ও আসে একরোখা জেদি, না কখনো না। বাবা হিসেবে সে একদম সঠিক চিন্তাই করছে। একটা সন্তান পৃথিবীতে আনে যেনো তাকে একটা সুন্দর, স্বচ্ছল, পরিপূর্ণ হাসিখুশি সমৃদ্ধ জীবন দেয়ার জন্য। নাকি যেচে কুয়োয় ঠেলে দেয়ার জন্য। বাবা হিসেবে তার চিন্তা একদম সঠিক! নিজের মধ্যে চলা দ্বিধাদ্বন্দ্বে জিতে যেতেই নুহাশ মাহমুদ বিরতিহীন ফোন হাতে নিলো। ডায়ালপ্যাড ঘেঁটে কাউকে ফোন দিলো। মিনিটের মাঝেই অপরপাশে রিসিভ হলো কলটি। নুহাশ মাহমুদ সালাম দিয়ে বিরতিহীন স্ট্রেটকাট বিনম্র কণ্ঠে বলে উঠলেন,
–“জুলফিকার ভাইজান, আপনি আর আপনার পরিবার নৈরা’কে দেখতে চেয়েছিলেন। আমি নৈরাকে দেখাতে রাজি। আপানদের কখন সময় হয় আমায় জানাবেন।”

নিরাদ ঈষৎ চমকালো বাবার এহেন অপ্রত্যাশিত কথায়। চমকালো ফোনের অপরপ্রান্তে থাকা বয়স্ক লোকটিও। যে কি-না আজ পর্যন্ত মেয়েকে এক ঝলক দেখতে দেয়ার ই অনুমতি দেয়নি। একমাত্র ছেলের জন্য তার মেয়ের হাত চাইলে বিয়ের সর্বদা হেসে উড়িয়ে দিতো। সে হুট করেই অপ্রত্যাশিত কথাটি হজম করতে পারলো না। বয়স্ক লোকটি গলা খাঁকারি দিয়ে বলল,
–“নুহাশ, হঠাৎ এমন কথা বলছো যে! তুমি তো মেয়ের বিয়ের কথা চিন্তাতেও আনতে চাইছিলে না।”

–“মেয়ের বাবা যখন হয়েছি তখন না চাইতেও এটা আমার চিন্তার বিষয় ভাইজান। শুধু সময়টা আগে পড়ে। তবে আপনার মতো কাছের আর মাটির মানুষ তো সবসময় পাশে পাবো না। আর আমি জানি আপনি আমার মেয়েকে আমার থেকেও যত্নে রাখবেন। যেটা আমার জন্য যথেষ্ট।”

ভদ্রলোকের শঙ্কা দূর হতেই সে উল্লাসে মেতে উঠলো। সে এক পায়ে রাজি। স্বল্প কথোপকথনের সমাপ্তি ঘটিয়ে নুহাশ মাহমুদ ফোন রাখলেন। নিরাদ উদ্বিগ্ন কণ্ঠে শুধায়,
–“তুমি নুরুকে জোরপূর্বক বিয়ে দেবে?”

–“জোরপূর্বক না! নিজের ইচ্ছায়।”

–“মানে? ও ঐ ব্যাংকারকে ভালোবেসে অন্যকে কেনো বিয়ে করবে?”, নিরাদের অবুঝ কণ্ঠে নুহাশ মাহমুদ গভীর চিন্তায় মগ্ন থেকে বললেন,
–“ব্যাংকার ই যদি না থাকে, তবে জোর করার প্রশ্নই তো আসে না।”

–“আমি তোমার কথা কিছু বুঝতে পারছি না।”

–“তোমার বোঝার প্রয়োজন নেই।”, একরোখা কণ্ঠে বলেই নুহাশ মাহমুদ বেরিয়ে গেলেন অফিস রুম থেকে।

রাত বাড়তে লাগলো। পি.সির সামনে বসে কর্মরত হস্তদ্বয় বারংবার সেলফোনটি হাতে নিয়েও আবার রেখে দিচ্ছে। অনভ্যস্ততাকে আঁকড়ে ধরেই বহুবার সাহস করে মেয়েটিকে ফোন দিতে গিয়েছিল কিন্তু পেরে ওঠেনি। প্রয়োজন ব্যতীত মেয়েটিকে স্বরূপ কখনো ফোন দেয়নি। অন্তঃস্থলে ভয় জেঁকে বসে তার একটা আগা বাড়ানো পদক্ষেপ মেয়েটিকে দাঁড় করিয়ে দেবে কোন এক কঠিন পরিস্থিতির সামনে। সহজ একটি সত্ত্বাকে নিজের কারণে পৃথিবীর বুকে কঠিন পরিস্থিতিতে পড়তে দেয়ার মতো স্বার্থপরতা স্বরূপ কখনো করতে পারবে না। ভেবেছিল ফোন করে জানাবে সে ব্রকলি দিয়ে কতোটা মজা করে ভাত খেয়েছে। মেয়েটি নিশ্চয়ই খুব খুশি হতো! কিন্তু সাময়িক একটু খুশি করে পরিবর্তে চিরদিনের দুঃখী করার তো কোন মানে হয় না! মেয়েটি মোটেই দুঃখের হকদার নয়। নিজের সাথে দ্বন্দ্বে হেরে যেতেই স্বরূপের আড়ম্বরপূর্ণ দেহ আড়ম্বরহীন হয়ে পড়লো। ফোনটির দিকে এক পলক উদাসীন দৃষ্টি নিক্ষেপ করে দূরে সরিয়ে রাখলো। লম্বা নিঃশ্বাস ফেলে কাজে মনোযোগী হলো। বুকে তখন চার হাত পয়ে জাপ্টে ধরে শুয়ে আছে বুব্বো। আধো গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন সে। ছোট্ট মাথাটিতে হাত বুলাতে বুলাতে স্বরূপ বিড়বিড় করে বলল,
–“আপনার অভিমান দীর্ঘ হোক কাঞ্চনবালা। আর কখনো ফোন করবেন না। পথটুকু এই পর্যন্ত ই হোক।”

কিন্তু বিধিবাম! কিসের দীর্ঘ অভিমান? ঠিক রাত এগারোটা চল্লিশ মিনিটে স্বরূপের মোবাইলের ফাটা স্ক্রিনটি নির্লজ্জের মতো জ্বলে উঠলো। ভেসে উঠলো “কাঞ্চনবালা” নামটি। কাজে নিমগ্ন স্বরূপ কাজ করতে করতে ব্যস্ত দৃষ্টিতে সেদিকে তাকাতেই তার দৃষ্টি স্থির হলো। সে ডানে বামে মাথা নেড়ে ফোনটি রিসিভ করে কানে ঠেকাতেই ভেসে আসলো একটি চরম হাস্যকর কণ্ঠ।
–“দেখুন, আমি মোটেই আপনাকে ফোন করতে চাইনি। আমার কোন ইচ্ছে নেই আপনার মতো পানসে, কিপ্টে, হাদাভোদা মানুষের সাথে কথা বলার। আমি শুধু এটা জানতে ফোন দিয়েছি যে ব্রকলি খেতে কেমন? ভালো লেগেছে কি? আপা কি ঠিকমতো রান্না করতে পেরেছিল?”
স্বরূপ মনে মনে ভেবে নিয়েছিল মেয়েটিকে দু’টো কড়া কথা বলবে। কিন্তু বরাবরই মেয়েটির সাথে তার ব্যক্তিত্ব দ্বিচারিতা করতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে। এবারেও ব্যতিক্রম হলো না। নাছোড়বান্দা মেয়েটির বোকা কণ্ঠে করা চালাকিতে স্বরূপের থমথমে গম্ভীর মুখশ্রী ভেদ করে উচ্চস্বরে হাসি বেরিয়ে আসলো। নৈরা ঠোঁটে ঠোঁট চাপলো অনাকাঙ্ক্ষিত হাসির আওয়াজে। হাঁটুতে থুতনি ঠেকিয়ে সে কপাল কুঁচকে বসে রইল।
স্বরূপ হেসে যাচ্ছে তো হেসেই যাচ্ছে। সে আর সহ্য করতে না পেরে খেকিয়ে উঠলো।

–“কি হলো পাগলের মতো হাসছেন কেনো?”

স্বরূপ হাসি থামায়। বলে,
–“কাঞ্চনবালা, আপনি কি জানেন আপনি ভীষণ মিষ্টি একটা মেয়ে!”

নৈরার মুখে লাজুক হাসি ফুটে উঠলো। রাগ, অভিমান সবকিছুর সমাপ্ত সেখানেই ঘটে। মিহি স্বরে শুধায়,
–“ব্রকলি খেতে কেমন লাগলো?”

স্বরূপ কাঁধে ফোন চেপে কিবোর্ডে হাত চালাতে চালাতে ধিমি কণ্ঠে জবাব দেয়,
–“ভীষণ সুস্বাদু! আমি আর বুব্বো তৃপ্তি সহকারে ভাত খেয়েছি।”

নৈরা গাল ভরে হাসলো। সেবার স্বরূপ কথা বাড়ালো। তথাকথিত বাড়তি কথা! জিজ্ঞাসা করে,
–“কি করছেন? রাতের খাবার খেয়েছেন?”

আলু বুখারার জার হাতে নৈরা নিজের আশেপাশে তাকালো। থার্মোমিটার, ওষুধ, জলপট্টির বাটি, আধখাওয়া স্যুপের বাটি সব ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। তার গা কাঁপিয়ে জ্বর এসেছে। বৃষ্টির ফোঁটা গায়ে লাগলেই তার জ্বর আসে। মা মাত্রই জলপট্টি দিয়ে তার ঘর থেকে বের হয়েছে। এর জন্যই এতক্ষণ ফোন দিতে পারেনি। সে বলল,
–“খেয়েছি। এখন বসে বসে আপনার দেয়া আলু বুখারা খাচ্ছি।”

মেলা থেকে ছোট্ট একটা আলু বুখারার জার কিনে দিয়েছিল স্বরূপ। বাড়ি এসেছে থেকে নৈরা সেটাই খেয়ে যাচ্ছে। স্বরূপ মৃদু হেসে বলল,
–“আপনার পছন্দ, অভ্যাস সব উদ্ভট।”

নৈরা কপাল কুঁচকে নেয় তার কথায়। বলে,
–“আপনিও তবে উদ্ভট।”

স্বরূপ কথাখানার মানে বুঝতে পারলেও অবুঝ কণ্ঠে শুধায়,
–“আমি কিভাবে উদ্ভট হলাম? আমি মোটেই উদ্ভট না।”

–“আমার পছন্দ উদ্ভট হলে আপনিও তো আমার পছন্দ!”,নৈরার চঞ্চল কণ্ঠে স্বরূপ হেসে ফেলে। পেটের কথা শুনতে বেশ আনন্দ! সে শুধায়,
–“আমি আপনার পছন্দ?”

নৈরা চুপসে গেলো। আর জবাব দিলো না। স্বরূপ কথা ঘুরিয়ে জিজ্ঞাসা করে,
–” আলু বুখারা এভাবে শুধু শুধু কে খায়?”

–“আমি খাই।”, নৈরা ছোট্ট করে জবাব দেয়।

স্বরূপ আর কথা বাড়ায় না। বলল,
–“আচ্ছা খান। আর কিছু বলবেন নাকি রাখবো?”

–“আপনি কি ব্যস্ত?”

–” পি.সি তে বসেছি। কাজ করতে হবে।”, স্বরূপের শান্ত স্বরে নৈরা মাথা চুলকাতে লাগলো। মূলত সে অযুহাত খুঁজছে কথোপকথন দীর্ঘ করার। স্বরূপ তার নিরবতায় শুধায়,
–“কিছু বলবেন?”

নৈরা মাথা চুলকাতে চুলকাতে শুধায়,
–“বুব্বো কি করছে?”

–“ঘুমাচ্ছে।”

–“আপনার কাছে?”

–“আমার বুকে।”, স্বরূপ হেসে জবাব দেয়। নৈরা স্মিত হেসে বলল,
–“আপনি বলেছিলেন ওকে দেখাবেন।”

স্বরূপ কাজ করতে করতে বলল,
–“তা তো বলেছিলাম। কিন্তু কি করে দেখাবো?”

নৈরার মুখে হাসি ফুটে উঠলো। সে চটপটে কণ্ঠে বলল,
–“আমি আপনাকে হোয়াটসঅ্যাপে ভিডিও কল দিচ্ছি। আপনি রিসিভ করুন।”

বলেই নৈরা ফোনটা কেটে দিলো। স্বরূপ কপাল কুঁচকে তাকায় ফোনের দিকে। বিড়বিড় করে বলে,
–“লোভী কাঞ্চনবালা!”

সাথে সাথেই ফোনটি আবার বেজে উঠলো। স্বরূপ দ্বিধাগ্রস্ত অন্তঃস্থল নিয়ে রিসিভ করলো। কিন্তু নিজের মুখটি দেখালো না সোজা বুব্বোর দিকে ক্যামেরা ধরলো। জ্বরে ফোলা ফোলা মুখ নিয়ে নৈরা নিগুঢ় চোখে দেখলো প্রশস্ত বক্ষমাঝে ঘুমিয়ে থাকা আদুরে বাচ্চাটিকে। ঠোঁটের কোনে স্মিত হাসির রেখা। চার হাত পায়ে জড়িয়ে ধরে কি আরামে ঘুমিয়ে আছে! সে দেখতে দেখতেই আফসোসের সুরে বলে উঠলো,
–“ওর কতো ভাগ্য! আপনার বুকে আরাম করে ঘুমানোর সুযোগ পাচ্ছে।”

স্বরূপ ললাট কুঁচকে নেয় মেয়েটির কথায়। ক্যামেরা বুব্বোর দিকে স্থির রেখেই অবুঝ কণ্ঠে শুধায়,
–“এতে ভাগ্যের কি পেলেন?”

নৈরা হাঁটুতে মাথা ঠেকিয়ে উদাসীন দৃষ্টিতে তাকিয়ে মলিন হেসে বলল,
–“আমার কাছে তো এমন ভাগ্য স্বপ্নতুল্য।”

ভরপুর কৌতুহলভরা কণ্ঠে স্বরূপ ক্যামেরা নিজের দিকে করলো। মেয়েটির উদাসীন ফোলা ফোলা মুখপানে দৃষ্টি রেখে শুধায়,
–“কেমন ভাগ্য?”

নৈরা ম্লান হেসে অপ্রত্যাশিত এক কথা বলে ফেলল,
–“আপনার বুকে ঘুমানোর ভাগ্য! এ তো স্বপ্নতুল্য আমার কাছে।”

স্বরূপের বক্ষস্থল ধ্বক করে উঠলো উদাসীন সেই আফসোস ভরা কণ্ঠটিতে। অপ্রস্তুত হাঁসফাঁস করে উঠলো তার অন্তঃস্থল। স্বরূপ কি তখনো আন্দাজা করতে পারলো না বোকা নারীটি তার ধারণার উর্ধ্বে গিয়ে তাকে ভালোবেসে ফেলেছে? স্বরূপ এলোমেলো দৃষ্টি ফেলে চঞ্চল কণ্ঠে বলল,
–“আপনি কি অসুস্থ নৈরা? এমন লাগছে কেনো? আমি বরং রাখছি। রাত হয়েছে আপনি ঘুমান।”

মেয়েটিকে এড়িয়ে যাওয়ার তীব্র প্রচেষ্টায় মগ্ন স্বরূপ। নৈরার উত্তপ্ত দেহ জ্বরগ্রস্থ টলটলে আঁখি নিয়ে মৃদু হাসলো সেই এড়ানোর প্রচেষ্টা অনুধাবন করতে পেরে। তবুও অযাচিত আবদার করে বলল,
–“এভাবেই থাকি একটু? প্লিজ? আপনাকে বিরক্ত করবো না। আপনি কাজ করুন।”

স্বরূপ নম্র কণ্ঠে বলল,
–“এভাবে থেকে কি করবেন নৈরা? রাত হয়েছে ঘুমিয়ে পড়ুন।”

–“আমার জ্বর এসেছে। ঘুম আসবে না। সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে আমায় একা একা বসে থাকতে ভালো লাগবে না। একটু থাকি আপনার সাথে, আপনি তো রাত জেগে কাজ করেন।”, মেয়েটির অনুনয় ভরা কণ্ঠ ফেরাতে পারলো না। বাধ্য হয়ে জ্বরগ্রস্থ মেয়েটির সঙ্গ দিলো নিরবে।

ধরনীর সকলে যখন গভীর নিদ্রাচ্ছন্ন তখন একজোড়া চোখ খুলে আছে জীবিকার টানে, মা বোনের সম্মান রক্ষার্থে। দীর্ঘক্ষণ একাগ্রচিত্তে কাজ করতে করতেই পুরুষালী দৃষ্টি জোড়া স্থির হয় নিজের ফাটা স্ক্রিনের উপর। দৃষ্টি থেকে কর্মক্লান্তি মিলিয়ে গেলো অনতিবিলম্বে। ঠোঁটের কোনা স্মিত বেঁকে যায় গালে হাত দাবিয়ে শুয়ে থাকা এক মায়াবী ঘুমপরীকে দেখে। কিবোর্ড থেকে হাত উঠিয়ে স্বরূপ ডেস্কের উপর কনুই ঠেকিয়ে নুইয়ে গেলো স্ক্রিনের দিকে। বুকের মাঝে তখন বুব্বো নেই। সে মামুর বিছানায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে ঘুমাচ্ছে।

ঘন পল্লব, মোটা কালো কুচকুচে আনপ্লাকড ভ্রুযুগল ঘুমের মাঝেও কুঁচকে আছে। শুভ্র বরফ খন্ডের ন্যায় মুখশ্রীতে ভেসে উঠেছে নীলচে শিরা উপশিরা গুলো। বরাবরের ন্যায় মেয়েটির ফ্যাকাসে সৌন্দর্যে স্বরূপ স্নিগ্ধতার খুঁজে বেড়াচ্ছিলো কিন্তু হঠাৎ করেই বদ্ধ নেত্রদুটি খুলে গেলো। মেয়েটির মাঝে ডুবে যাওয়া স্বরূপ আকস্মিক হকচকিয়ে সোজা হয়ে বসলো। দৃষ্টিতে দৃষ্টি মিলে যেতেই স্বরূপ খুক খুক করে কেঁশে উঠলো। অপ্রস্তুত এলোমেলো দৃষ্টি ফেলছে সে। নৈরা পিটপিট করে দেখছে অদ্ভুত আচরণ করা লোকটিকে। অতঃপর মিটিমিটি হেসে শুধায়,
–“আপনি কি করছিলেন? আমায় দেখছিলেন তাই না?”

স্বরূপ ঠিক বুঝে নিলো বোকা মেয়েটি চাটুকারিতা করছে তার সাথে। বরাবরের ন্যায় মেয়েটির চাটুকারিতায় পানি ঢেলে দিয়ে স্বরূপ চমৎকার হেসে ঘাড় দুলালো। বলল,
–“তা তো দেখছিলাম।”

নৈরা হৈ হৈ করে উঠলো,
–“দেখেছেন দেখেছেন আমি জানতাম, আপনি আমায় ই দেখছিলেন।”

স্বরূপ চমৎকার হেসে বলল,
–“একদম ঠিক জানতেন। আমি আসলে দেখছিলাম মানুষ হা করে ঘুমালে তাকে দেখতে কেমন লাগে।”

সহসা নৈরার হাসি হাসি মুখ নিভে গেলো। সে কপট থমথমে মুখে বলল,
–“আমি হা করে ঘুমাই না।”

স্বরূপ গা দুলিয়ে হাসলো। বলল,
–“তা তো এতক্ষন ধরে দেখলাম ই! আপনাকে দেখাচ্ছিলো কেমন জানেন? বলবো?”

নৈরা থমথমে মুখে বলল,
–“না, বলবেন না। আমি হা করে ঘুমাই না। আপনি মিথ্যা কথা বলছেন।”

–“ছবি করে রাখতে হতো। ভুল হয়ে গেলো। যাক গে শুনুন আপনাকে দেখাচ্ছিলো কেমন বলি?”, স্বরূপ আবারো মিটিমিটি হেসে বলল
নৈরা রাগে দুঃখে চিৎকার করে উঠে বলল,
–“না বলবেন না।”

–“না বলি, শুনুন। আপনাকে দেখতে ঠিক……স্বরূপ তার বাক্য শেষ করতে পারলো না তার আগেই ফোনটি কেটে গেলো। নিস্তব্ধ রজনীর নিরবতা ভেঙে স্বরূপ হো হো করে হেসে উঠলো মেয়েটিকে আজকের মতো জব্দ করতে পেরে। মেয়েটি তার জীবনে আসার পর থেকে দিনগুলোর অন্তভাগ এমনি মোহনীয় কাটে।

~চলবে~