#কাঞ্চনবেলা
#তোনিমা_খান
#পর্বঃ১৭
বুব্বো’র ঘুমানোর প্রিয় জায়গা মামু’র বুক হওয়ায় সাধনাকে প্রায়শই একাই ঘুমাতে হয়। মাঝেমধ্যে সে মায়ের কাছে ঘুমায় আবার কখনো নিজের ঘরে। কয়েকদিন যাবৎ মায়ের শরীর ঠিক নেই। প্রচন্ড মাথা ব্যথায় কাবু হয়ে থাকে। তাই রাতে মায়ের ঘুমে ব্যাঘাত না ঘটে এর জন্য সাধনা আর বুব্বো একদমই এড়িয়ে চলে শুনিতার ঘর। আজ ও সাধনা নিজের ঘরে শুয়ে ছিলো। কিন্তু তার নিদ্রা চ্ছেদ ঘটলো নোকিয়া বাটন ফোনটির তীব্র শব্দাঘাতে। সাধনা ঘুম জড়ানো ঝাঁপসা দৃষ্টিতে ধড়ফড়িয়ে উঠে বসলো সেই শব্দে। ভীত মাতৃত্বে ভরপুর অন্তঃস্থলে কু ডেকে উঠলো, ছেলে ঠিক আছে তো! অস্ফুট স্বরে বুব্বোকে ডেকে উঠলো সে। চারিদিকে এলোমেলো দৃষ্টি ফেলে তাকালে অন্ধকার ঘর ব্যতীত আর কিছুই চোখে পড়লো না। সাধনার ঘুম জড়ানো নিশ্চল মস্তিষ্ক সচল হয়। বুকে হাত চেপে শ্বাস প্রশ্বাসের গতি স্বাভাবিক করার প্রয়াস করে। সে তো জানে, বুব্বো যতক্ষণ তার মামুর বুকে আছে ততক্ষণ পর্যন্ত তার কিচ্ছুটি হতে পারে না। তার ভাবনার মাঝেই বাটন ফোনটি আবারো বেজে উঠলো। সে দ্রুত ফোনটা হাতে নিতেই ললাটে বলিরেখার সৃষ্টি হলো। অভদ্র লোকের নাম্বার এটা! সে ঘড়ির দিকে তাকায়। বাজে রাত তিনটা পঁয়তাল্লিশ। চারটা মিসড কল। এতো রাতে এই লোক তাকে কেনো ফোন করেছে? অন্তঃস্থলে এহেন বিরক্তি সৃষ্টিকারী প্রশ্ন নিয়েই সাধনা ফোনটা রিসিভ করলো। তবে রোজকার মতো রসিকতায় পরিপূর্ণ কণ্ঠ নয় ভেসে আসলো গম্ভীর কণ্ঠ।
–“হ্যালো! সিনিয়র ম্যাডাম শুনছেন?”
বেশ গম্ভীর কণ্ঠে সাধনা কপাল কুঁচকে নেয়। থমথমে মুখে বলল,
–“জি শুনছি। আপনি এতো রাতে ফোন দিয়েছেন কেনো?”
–“সেটা বলার জন্য ই ফোন দিয়েছি।”, নোমানের কণ্ঠে হালকা বিদ্রুপের ছোঁয়া সাধনা ঠিক ধরতে পারলো না। সে কর্কশ স্বরে বলল,
–“যা বলার জলদি বলুন। আপনার এই রাত বিরাতে ফোন করাটা আমায় প্রচুর বিরক্ত এবং বিব্রত করে।”
নোমানের মাঝে চাপা আক্রোশ উদয় হলো। সে শানিত কণ্ঠে বলল,
–“আর আপনার ভাই যে আমার বোনটাকে দিনরাত কাঁদিয়ে যাচ্ছে, তাতে আমার বিরক্ত নয় রাগ হচ্ছে।”
সাধনা কপাল কুঁচকে নেয় কথোপকথনের মাঝে ভাইয়ের নাম যুক্ত হতেই। সে তড়িৎ গতিতে শুধায়,
–“কি বললেন, আমার ভাই? মানে স্বরূপ? আপনার বোনকে দিনরাত কাঁদাচ্ছে, মানে কি? এই আপনি এই মাঝরাতে নেশাটেশা করে আমায় ফোন দেননি তো? দেখুন এমন হলে আমি আপনাকে দেখে নেবো।”
নোমান দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
–“আমার চেহারায় দেখার মতো কিছু নেই ম্যাডাম, সপ্তাহ দুইয়ের না ছাঁটা দাঁড়ি গুলো ছাড়া। কিন্তু আমার বোনটার চেহারার দিকে তাকানো যাচ্ছে না।”
–“কে আপনার বোন? কি হয়েছে তার? আর আমার ভাই’ই বা কি করেছে?”, সাধনার কৌতুহলে ভরপুর কণ্ঠে নোমান ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেললো। লম্বা দম ফেলে নিজেকে শান্ত করে। নৈরার কথামতো স্বরূপ কখনো তার ভালোবাসাকে স্বীকৃতি দেয়নি কিন্তু ছুড়েও ফেলেনি। কেউ জানেও না সবজি কেনার নামে এই দুই সত্ত্বা কতো গুলো চমৎকার কাঞ্চনবেলা নিজেদের নাম করে নিয়েছে। সে নম্র কণ্ঠে সাধনাকে বুঝিয়ে বলল,
–” নৈরা, আমার বোন; নৈরা মাহমুদ। আপনার ভাইকে আমার বোন ভালোবাসে। আমার বোনের ধারণা, আপনার ভাই ও তাকে ভালোবাসে। কিন্তু সে তার কাঁধে থাকা দায়িত্ব আর লোনের বোঝার কারণে তা স্বীকার করতে চাইছে না। আর না চাইছে আমার বোনকে তার জীবনের সাথে জড়াতে।”
সাধনা বাকরুদ্ধ হয়ে গেলো নোমানের কথার প্রেক্ষিতে। ক্ষনিকের জন্য সে কথা, অনুভূতি সব হারিয়ে ফেললো।
আজ বহুবছর যাবৎ সে আর মা স্বরূপকে জীবনে আগানোর জন্য জোর করছে। কিন্তু প্রতিবার ই স্বরূপ প্রচন্ড অনাগ্রহের সাথে এই বিষয় এড়িয়ে যায়। আজ পর্যন্ত স্বরূপ কোন মেয়ে দেখতে রাজি হয়নি আর না ইচ্ছে প্রকাশ করেছে। বিয়ে, জীবনসঙ্গীর ব্যপারে কেনো এতো অনাগ্রহ, এর জবাব আজ পর্যন্ত কখনো দেয়নি স্বরূপ। তবে কি এটাই সেই সুপ্ত কারণ? সে থমকানো স্বরে শুধায়,
–“আপনি কি বলছেন, আমায় সবটা একটু খুলে বলবেন?”
নোমান তাকে সব খুলে বললো। যতোটুকু বোন বলেছে, যতোটুকু সে জানে সবটা। সাধনা ফের চমকালো নুহাশ মাহমুদের নাম শুনে। শহরের সবচেয়ে স্বনামধন্য বিত্তশালী ব্যক্তির মেয়ে নৈরা! সে অস্ফুট স্বরে বিড়বিড় করে,
–“নুহাশ মাহমুদ।”
সাধনার ঘোর ভাঙলো অপরপ্রান্ত থেকে নোমানের অধৈর্য্য কণ্ঠ ভেসে আসায়। নোমান ব্যস্ত কণ্ঠে বলল,
–“দেখুন, আপনি একটু আপনার ভাইকে বোঝান। আপনার আপনার ভাইকে বলুন এসব লোন টোন সারাজীবন থাকবে না। দুরবস্থা আজ আছে কাল থাকবে না। তাই বলে কি দুরবসস্থার কথা চিন্তা করে বর্তমান’টাকে নষ্ট করবে? আমি জানি টাকা কখনো সকল সুখ স্বাচ্ছন্দ্যের কারণ হতে পারে না। আর তার লোন’টা শেষ হলেই তো সব সমস্যা’র সমাধান হয়ে যাবে। আগামীকাল নৈরা’কে দেখতে আসবে। কিন্তু ও স্বরূপ ব্যতীত আর কারোর সামনে দাঁড়াতে নারাজ। আর ভাই হিসেবে ওর সকল আবদার পুরণ করা আমার দায়িত্ব। আমি ওকে কথা দিয়েছি ও স্বরূপ ব্যতীত আর কারোর সামনে দাঁড়াবে না। আগামীকাল যেকোনো মূল্যে আপনি আপনার ভাইকে রাজি করিয়ে, আপনার পরিবার সমেত নৈরার হাত চাইতে আসবেন। আমরা অপেক্ষা করবো।”
সাধনা তখনো স্তম্ভিত হয়ে বসে আছে। নোমান তাকে নিরুত্তর দেখে ফের ডেকে ওঠে,
–“হ্যালো! সিনিয়র ম্যাডাম?”
সাধনা’র চোখের সামনে ভাসছে ভাইয়ের অক্লান্ত পরিশ্রমের পর থেকে যাওয়া উদাসীন একাকী জীবন। মা বোন যতোই থাকুক না কেনো একজন জীবনসঙ্গীর অভাব যে বিশাল অপূর্ণতা। এই অপূর্ণতা কেউ পূরণ করতে পারে না একজন ভালোবাসার মানুষ ব্যতীত। মুহুর্তেই ভাইয়ের বেরঙ জীবনটাকে রঙিন করার পথ পেয়ে যাওয়া সাধনার দৃষ্টি চকচক করে উঠলো। দেহ সাড়ম্বর হয়। ঝিমিয়ে পড়া দেহে আনন্দের উচ্ছ্বাস বয়ে চলে দূর্বার গতিতে। সাধনা স্থবিরতা ভাঙলো। একটা মেয়ে হওয়ায় আরেকটা মেয়ের সুখ স্বাচ্ছন্দ্যের চাহিদা বুঝতে তার অসুবিধা হয় না। একমাত্র ভাইয়ের সুখের জন্য সেও স্বার্থপর হতে পারে না। সেও আগে একজন নারী হয়ে আরেকজন নারীর সুন্দর জীবনের কথাটাই আগে ভাবলো। সে নোমানের উদ্দেশ্যে শুধায়,
–“নৈরা কি এই টানাপোড়েনের জীবনে নিজেকে মানিয়ে নিতে পারবে? ও যেই জীবন যাপনে অভ্যস্ত সেটা হয়তো এই মুহূর্তে আমরা ওকে দিতে পারবো না কিন্তু একটু সময় দিলে হয়তো এর থেকে বেশি কিছু দিতে পারবো।”
নোমানের নির্ঘুম ক্লান্ত দেহ উদাসীন চিত্তে বিছানায় লুটিয়ে গেলো। সিলিং এর দিকে স্থির দৃষ্টি রেখে নোমান
মৃদু হাসলো। স্মৃতিচারণ করে বিগত তিনমাসে বোনের করা এক একটা অদ্ভুত মোহনীয় কজের মিষ্টি কিছু চিত্র। সে মৃদু হেসে বলতে লাগলো,
–“জানেন, আমার বোকা বোনটা আপনার ভাইকে ভীষণ ভালোবাসে। সে তার স্বরুপের সাথে গোটা এক কঠিন পথ পাড়ি দেয়ার জন্য নিজেকে একটু একটু গড়েছে বিগত তিন মাসে। তার আলমারিতে রাজ্যের দামী দামী পোশাক ছেঁড়ে সে শুধুমাত্র দুইটা শাড়ি ঘুরিয়ে ফিরিয়ে পড়ে। ঠিক যেমনটা আপনার ভাই দু’টো শার্ট ঘুরিয়ে ফিরিয়ে পড়ে, সাদা আর স্কাই ব্লু রঙের—তেমন। তার খাবারের তালিকায় থাকে দুই ধরণের সবজি। খুব বিরল তাকে মাংস ছুঁতে দেখা যায়।
সে এখন একটু আধটু রান্নাও পারে। লুকিয়ে লুকিয়ে রান্না করে সে। আমার বোকা বোনটার সকল উৎফুল্লতা, চঞ্চলতা, হাসির কারণ আপনার ভাই, আপনার ভাই জড়িত সবকিছু। তার হাসিটুকু মলিন হতে দেখতে আমি পারবো না, আর না মলিন হতে দেবো। তার কঠিন পথ সহজ করার জন্য তার ভাইজান সবসময় ছিল আর থাকবে। আপনারা কাল ঠিক সময়মতো চলে আসবেন কিন্তু।”
অভদ্র লোকটার সাথে স্বল্প পরিচয়ের এই সময়টাতে, এই প্রথমবার সাধনার একটুও বিরক্তি আসলো না নোমানের কথা শুনে। বরং মুগ্ধ হয় অর্থবিত্তের মাঝে থাকা সাদাসিধে দুই ভাই বোনের কথা শুনে। সে শুধায়,
–“আপনার বাবা মানবে?”
–“সবার আগে আমার বোনের খুশি। মানা না মানা সবটা পরে দেখে নেবো। আগে আপনি আপনার অনুভূতি চোরা ভাইকে নিয়ে আমার বোনের সামনে হাজির হন।”, নোমানের ত্যাড়া কণ্ঠ।
সাধনা জোর পায় নোমানের ত্যাড়া কণ্ঠে। হঠাৎ তার মাঝেও প্রফুল্লতা জেঁকে বসলো। সে স্বভাবসুলভ কঠোর ভঙ্গিমা থেকে বের হয়ে চঞ্চল কণ্ঠে বলল,
–“গেলে কিন্তু, একদম আপনার বোনকে আমার ভাইয়ের বউ করে নিয়ে আসবো।”
–“নিয়ে যান, তাতে যদি আমার বোনটা যদি কান্না ভুলে একটু হাসে তবে আমি তাতেই খুশি।”, নোমানের মলিন কণ্ঠ। দৃষ্টি ইতিমধ্যেই টলটল করছে বোনের বিদায়ের কথা শুনে। সাধনা মৃদু হাসলো নোমানের নিভে যাওয়া কণ্ঠে। অনুভব করতে পারলো চঞ্চল, অভদ্র ভবঘুরে এই ব্যক্তিত্বের আড়ালে এক চমৎকার ভ্রাতৃত্বের সত্ত্বা লুকিয়ে আছে। সে মৃদু হেসে বলল,
–“অভদ্র লোকের মাঝে দেখছি এক দূর্বল মনের ভাই লুকিয়ে আছে!”
নোমান মুখ বিকৃত করে নেয় সাধনার বিদ্রুপে। বেশ ঝাঁঝালো কণ্ঠে বলল,
–“অভদ্র শুধু আপনিই মনে করেন সিনিয়র ম্যাডাম। তাও বিনা দোষে। নয়তো আমার এল ই ডি বাল্বের নাড়ি নক্ষত্র নাড়িয়ে দেয়ার পরেও আমি কি সুন্দর নিশ্চিন্তে জীবন কাটাচ্ছি। আপনাদের মা ছেলের থেকে জরিমানা না নিয়ে, আপনাদের পেছনে স্যরির জন্য হন্য হয়ে ঘুরেছি। আপনার তো আমার নামে দশ টাকা ভিক্ষুককে দান করা উচিৎ একটা ভদ্র ছেলের সাথে আপনার পালা পড়েছে। নয়তো আমার জায়গায় অন্য কেউ থাকলে, এতোদিনে বাবা না হতে পারার শঙ্কায় আপনাদের মা ছেলেকে জরিমানা বাবদ ঘরে তুলে আনতো!”
সাধনা এতক্ষণ প্রফুল্ল চিত্তে শুনলেও আর নিতে পারলো না উশৃঙ্খল কথাবার্তা। সে চোয়াল শক্ত করে বলল,
–“আপনি কথায় কথায় বখাটেদের মতো তুলে নেয়ার কথা বলেন কেনো? একটু নরম স্বরে কথা বলেছি দেখে মাথায় উঠে গিয়েছেন? সাহস থাকলে জরিমানা নিতে আসবেন, ঠ্যাং ভেঙে হাতে ধরিয়ে দেবো। সেই ভাঙা ঠ্যাং নিয়ে একদম পুলিশের কাছে রেখে আসবো।”
–“হবু বেয়াইকে হুমকি?”, নোমান ভ্রু নাচিয়ে শুধায়।
সাধনা নাক সিঁটকায় এহেন সম্বোধনে। তীব্র প্রতিবাদের সাথে বলে,
–“দেখুন সম্পর্ক যেটাই হোক না কেনো! বয়সে আপনার থেকে বড়ো তাই সমীহ করে চলবেন। এইসব বেয়াই-বেয়ান ওয়ালা রসিকতা পূর্ণ সম্পর্ক টানবেন না। এগুলো আমার পছন্দ নয়।”
–“আচ্ছা বেয়ান, টানবো না রসিকতাপূর্ণ এই বেয়াই-বেয়ান সম্পর্ক। আমি সর্বদা আপনাকে সমীহ করে চলবো, বেয়ান।”, নোমান দাঁত কেলিয়ে বলল।
অপরপ্রান্ত থেকে খট করে ফোনটা কেটে গেলো। নোমান গা দুলিয়ে হাসলো। আবারো ফোন দেয় সদ্য কেটে যাওয়া নাম্বারটিতে। রিসিভ হলো সাথে সাথেই। সাধনা ঝাঁঝালো কণ্ঠে শুধায়,
–“আবার কি?”
সাধনা ভেবেছিল এবারো হয়তো নোমান কোন অভদ্রতা করবে। কিন্তু তাকে ভুল প্রমাণিত করে নোমান গম্ভীর কৌতুহলী গলায় শুধায়,
–“কাল ঠিক সময়মতো আসবেন তো? আমি কিন্তু কথা দিয়েছি আমার নুরুকে। সে তার স্বরূপের সামনে ব্যতীত আর কারোর সামনে দাঁড়াবে না।”
সাধনার রাগ দমে যায়। সে নোমানের উদ্বেগকে শান্ত করতে আশ্বস্তের সুরে বলল,
–“আপনার নুরুকে, আমার ভাই ব্যতীত আর অন্য কারোর সামনে দাঁড়াতে দেবো না আমি—কথা দিলাম।”
নোমানের মুখের হাসি প্রগাঢ় হয়। মাথার ওপর থেকে মস্তবড় এক চিন্তার বোঝা নেমে যেতেই সে ফোন কেটে চোখ বন্ধ করলো। বোনের হাসি ধরে রাখা এক ভাইয়ের জন্য মস্তবড় দায়িত্ব যে!
*****
“সাথে করে শুধু লাল টুকটুকে বেনারসী আনলেই হবে।” কর্নকুহর দাপিয়ে বেড়াচ্ছে শুধু একটা আবদার একটা। আপাতদৃষ্টিতে এটা বড্ডো ঠুনকো এক আবদার মনে হলেও স্বরূপ নামক দায়িত্বের কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে থাকা অসহায় মানুষটার কাছে এটা বিশাল এক কঠিন আবদার। পুরোটা রাত তাড়া করে বেড়িয়েছে মেয়েটির অযাচিত আবদার গুলো। চোখ বন্ধ করতে পারেনি স্বরূপ। এক মুহুর্তের জন্য ও পারেনি। বুক সহ মাথার উপর যেনো কেউ শত বস্তার ভারী বোঝা উঠিয়ে দিয়েছে। চারিদিকে কেনো এতো অসহায়ত্বের হাহাকার? সে তো বিগত এই তিনমাস কোন প্রত্যাশা বিহীন ই নারীটিকে নিজের সবজি কেনার সঙ্গী করেছিল—তবে কেনো এতো বুক পুড়ছে? কেনো দম বন্ধ হয়ে আসছে? কেনো বাতাবরণ আগমনী শুন্য পৃথিবীর বার্তা প্রেরণ করছে? নারীটির অনুপস্থিতি তার পৃথিবী শুন্য হয়ে যাবে কেনো? তার এই দায়িত্বের পৃথিবীতে তো কভু নারীটির অস্তিত্ব ই ছিল না। তবে, কেনো এতো অস্থিরতা? অস্থির অন্তঃস্থলের টানাপোড়েন স্পষ্ট আঁখি জুড়ে। সিলিং এর দিকে স্থির আঁখি দ্বয়ের কার্নিশ আরেকদফা সিক্ত হয় নোনাজলে। স্বরূপের নিজের মনের সাথে একাকী নিরব যুদ্ধের সমাপ্ত ঘটলো দায়িত্বের ঘন্টা বাজতেই। সে চকিতে ঘাড় কাত করে তাকায় ঘড়ির পানে। এলার্ম বাজছে, সাতটা ত্রিশ বাজে। উঠতে হবে তাকে। সে ধীরস্থির বুব্বোকে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে উঠে বসলো। ভারী দেহ আর ভারী অন্তঃস্থল নিয়ে কিয়ৎকাল বিছানায় দুই হাত চেপে নত মস্তকে চুপটি করে বসে রইল। মনে সাধ জাগে মাকে গিয়ে বলবে, কেউ তার থেকে কতোটা আদুরে আবদারের সাথে শুধুমাত্র একটা লাল টুকটুকে বেনারসী চায়? পরিবর্তে গোটা এক আদুরে সত্ত্বাকে তার নামে করে দেবে। তথাকথিত দায়িত্বের গড়া এই দুনিয়াটাকে সুখে পরিপূর্ণ করে দেবে।
মেয়েটির অযাচিত আবদারের মতো স্বরূপের মনেও অযাচিত সাধগুলো বেশ প্রকট আকার ধারণ করলো। সে হাত মুখ ধুঁয়ে এগিয়ে যায় রান্নাঘরের দিকে। মা তো ফজরের সময় ঘুম থেকে ওঠে। উঠে রান্না করে। তবে আজ ব্যতিক্রম হলো। মা নেই রান্নাঘরে। ললাটে কয়েকটা বলিরেখা নিয়ে স্বরূপ পা বাড়ায় মায়ের ঘরের দিকে। চাপিয়ে রাখা দরজা খুলতেই তার ললাটের ভাঁজ আরো দৃঢ় হলো। মা কাত ফিরে শুয়ে আছে। মাকে সে কখনো এতো বেলা করে ঘুমাতে দেখেনি। সে জোর কদমে এগিয়ে যায়। ঘুমন্ত মায়ের পাশে গিয়ে বসে মাথায় হাত রাখে। উদ্বিগ্ন কণ্ঠে ডেকে ওঠে,
–“আম্মা?”
একবারে চোখ খুললো না শুনিতা। স্বরূপ আরো কয়েকবার জোর গলায় ডাকলো। মিনিট এক বাদ মা আধো আধো নয়ন খুলে তাকালো। স্বরূপ নিশ্চিন্তের নিঃশ্বাস ফেলে মায়ের মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে শুধায়,
–“আম্মা, শরীর খারাপ লাগছে কি?”
অসহনীয় মস্তিষ্কের প্রদাহ সামলে শুনিতা না খুলতে পারা চোখ দুটি খুললো। মলিন হেসে ছেলের হাতটা মুঠোবন্দী করে গালে ঠেকায়। জড়ানো কণ্ঠে বলল,
–“আব্বা, মাথাটা প্রচুর ব্যথা করছে। শরীরের সাথে পেরেই উঠছি না। আজ উঠতে পারিনি, রান্নাও করতে পারিনি। তোর দেরি হয়ে যাচ্ছে কি? সাধনাকে একটু বল না দু’টো রুটি আর ডিম ভেজে দিতে।”
–“তুমি আমার খাবারের চিন্তা বাদ দাও। এখনো অনেক সময় আছে। কিন্তু তোমার শরীর হঠাৎ এতো খারাপ করলো কেনো? রাতে ওষুধ খেয়েছিলে?”, স্বরূপের উদ্বিগ্ন কণ্ঠে শুনিতা বদ্ধ নেত্রে মিহি স্বরে বলল,
–“খেয়েছিলাম আব্বা। কিন্তু রাত থেকেই মাথা ব্যথাটা বেড়েছে। চোখ খুলতে পারছি না। তুই চিন্তা করিস না। একটু ঘুমালেই হয়তো ঠিক হয়ে যাবে। সাধনাকে বল নাস্তা বানাতে, তাহলে খাবার খেয়ে তাড়াতাড়ি ওষুধ খেয়ে নেবো। দেখবি মাথা ব্যথা ঠিক হয়ে যাবে। আমি ততক্ষণে একটু ঘুমাই!”
মায়ের শেষের কথাটায় খানিকটা অনুনয় ছিল। স্বরূপ দেখলো মা কিছুতেই চোখ খুলে রাখতে পারছে না। এমন মাথা ব্যথা প্রায়শই মায়ের হয়। বলতে আসা কথা গুলোকে সন্তর্পণে গলাধঃকরণ করে নিয়ে, সে মাকে ঘুমাতে দিয়ে দরজা চাপিয়ে বেরিয়ে আসলো। বের হয়েই হাঁক ছেড়ে বোনকে ডাকে,
–“আপা! আপা! একটু নাস্তা বানা না। আম্মার খেয়ে ওষুধ খেতে হবে। শরীরটা হঠাৎ আবার খারাপ করলো কেনো আম্মার?”
সাধনা গামছায় হাত মুছতে মুছতে নিজের ঘর থেকে বের হলো। বের হতেই ভাইকে দেখে গম্ভীর মুখে বলল,
–“উঠেছিস? টেবিলে নাস্তা রাখা। আম্মার শরীরটা রাত থেকেই ভালো না, তাকে আমি খাইয়ে দিচ্ছি।”
স্বরূপ বোনের দিকে তাকিয়ে শুধায়,
–“হ্যাঁ , তাহলে তুই গিয়ে আম্মাকে একটু খাবার খাইয়ে দিয়ে ওষুধ খাইয়ে দে। ওষুধ খেলে হয়তো ভালো লাগবে। আর কিছু লাগলেও আমায় বল। প্রেশারের ওষুধ, তেঁতুল সব আছে?”
–“সব আছে।”, সাধনা থমথমে মুখে বলে মায়ের জন্য নাস্তা নিয়ে গেলো। স্বরূপ খেয়াল করলো বোনের থমথমে মুখটি। কিছু জিজ্ঞেস করবে তার আগেই সাধনা চলে যায়। সেও তপ্ত শ্বাস ফেলে নিজের হাতের কাজগুলো গুছিয়ে নিতে লাগলো। ধুয়ে রাখা শার্টটি প্রেস করতে হবে। সে শার্ট প্যান্ট প্রেস করে বুব্বোকে ঘুম থেকে টেনে তুললো। ঘুম থেকে ওঠার পরে বুব্বোর আধা ঘন্টা ঝিমানোর অভ্যাস। সে ঝিমিয়ে পড়ে আছে মামুর কাঁধে। স্বরূপ তার হাত মুখ ধুইয়ে এনে সোফায় বসিয়ে দিয়েছে। সে সেখানেও চিৎ হয়ে শুয়ে পড়েছে দেখে স্বরূপ ডানে বামে মাথা নাড়লো। এগুলো স্কুল বাঙ্ক দেয়ার বাহানা!
সে প্লেট নিয়ে খেতে বসলো। সাধনা ততক্ষণে মায়ের ঘর থেকে বেরিয়ে আসে। থমথমে মুখে ভাইয়ের প্লেটে নিজের ভাগের ডিম ভাজির তুলে দিতেই স্বরূপ মাথা তুলে তাকায়। শুধায়,
–“তুই তোরটা আমার প্লেটে দিলি কেনো?”
–“আমার ডিম খেতে ভালো লাগে না।”, সাধনার থমথমে মুখে দেয়া জবাবে স্বরূপ কপাল কুঁচকে নিলো। এটা যে নিতান্তই বাহানা তা সে জানে। সে শুধায়,
–“তবে এই শুকনো রুটি খাবি কি দিয়ে?”
–“সেটা তোর ভাবতে হবে না।”, ফের বোনের একরোখা কণ্ঠে স্বরূপ বিরক্ত হয়ে প্লেট থেকে এক পিস ডিম ভাজি তুলে দিলো। একটা ডিম দিয়ে চার ভাগ করা হয়। কিন্তু সাধনা আবার জোরপূর্বক ডিম ভাজিটা ফিরিয়ে দিলো। স্বরূপ বিরক্ত হয়ে শুধায়,
–“সকাল সকাল এমন করছিস কেনো? শুকনো রুটি এভাবে শুধু খাওয়া যায়?”
সাধনা খেকিয়ে উঠলো,
–“শুধু কই খাচ্ছি, ঝোলা গুড় দিয়ে খাবো দেখছিস না?”
স্বরূপ এবার গিয়ে শান্ত হলো। বলল,
–“সেটা আগে বললেই হতো! এটা তাহলে বুব্বোর জন্য রাখ।”
সাধনা চেঁচিয়ে উঠলো সহসা,
–“থাপড়ে তোর দাঁত ফেলে দেবো, খেতে দিয়েছি চুপচাপ খাবি। এতো ঢং করছিস কেনো?”
–“আশ্চর্য তুই সকাল সকাল এমন চেঁচামেচি, রাগ করছিস কেনো?”, স্বরূপের আশ্চর্য কণ্ঠে সাধনা ফোঁস ফোঁস করে চেয়ারে বসল। স্বরূপ তাকিয়ে রইল তার দিকে। দৃষ্টিতে তার কৌতুহল। সাধনা থমথমে মুখে রুটি ছিঁড়ে মুখে দিতে দিতে শুধায়,
–“নৈরা কে?”
স্বরূপ সদ্যই এক টুকরো রুটি মুখে তুলেছিল কিন্তু বোনের প্রশ্নে সে খুক খুক করে কেঁশে উঠলো। চমকে তাকায় বোনের পানে। অবুঝ কণ্ঠে শুধায়,
–“কে?”
সাধনা ভাইয়ের চোখে চোখ রেখে ফের শুধায়
–“নৈরা কে?”
থতমত খেয়ে যাওয়া স্বরূপ নিজেকে দ্রুত সামলে নেয়।
সর্বদা স্পষ্টভাষী হওয়ায়, ছ্যাবলামো তার দ্বারা হলো না। নিরবে খেতে খেতে বলল,
–“নুহাশ মাহমুদের মেয়ে।”
–“সে তোর কি হয়?”
স্বরূপের বুঝতে বাকি রইলো না বোন কিছু আঁচ করতে পেরেছে। নিজের ভাবনায় নিজে ম্লান হাসলো স্বরূপ। এখানে আঁচ করতে পারার মতো কিছুই তো নেই। সে বড্ডো স্বাভাবিক ভাবেই জবাব দিলো,
–“কিছুই না, শুধু সবজি কেনার সঙ্গী।”
–“সবজি কেনার সঙ্গীকে কি আজীবন সবজি কেনার সঙ্গী ই বানিয়ে রাখবি, না-কি জীবনসঙ্গী ও করবি?”, সাধনার স্পষ্ট কণ্ঠে স্বরূপ চোখ তুলে তাকায়। শুধায়,
–“কি বলছিস?”
সাধনা নম্র কণ্ঠে শুধায়,
–“সবজি কেনার সঙ্গীকে ভালোবাসিস তা বলিসনি কেনো? এর জন্যই কি বিয়ে নিয়ে এতো অনাগ্রহ? যাকে জীবনসঙ্গী হিসেবে চাস সে সাধ্যের বাইরে, তাই আজীবন বিবাহ ব্যতীত থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলি?”
স্বরূপ বেশ অপ্রস্তুত হলো বোনের সাথে এহেন কথোপকথনে। সে মুখচোরা মিহি স্বরে বলল,
–“এমন কিছু না।”
–“মেয়েটাকে কেনো এতো কষ্ট দিচ্ছিস?”
–“তুই এগুলো কি করে জানিস?”, স্বরূপের অবাক কণ্ঠে সাধনা নির্লিপ্ত কণ্ঠে বলল,
–“এটা আমার প্রশ্নের জবাব নয়, স্বরূপ। নৈরাকে এভাবে কষ্ট কেনো দিচ্ছিস? ও কি কখনো কোনকিছুতে অভিযোগ করেছে? বলেছে সে তোর সাথে এই জীবনযাপনে মানিয়ে নিতে পারবে না? বরং নিজেকে আরো একটু একটু করে তোর জন্য গড়ে তুলেছে। সেটা কিসের জন্য? দিনশেষে অন্য পুরুষ মানুষের সামনে দাঁড়ানোর জন্য?”
স্বরূপের খাওয়া থেমে যায়। সে চুপটি করে বসে রইল মাথা নুইয়ে। গম্ভীর তার মুখশ্রী। সাধনা আবার শুধায়,
–“কি হলো কথা বলছিস না কেনো?”
–“সে অবুঝ আপা। সে বাইরের দুনিয়া চেনে না আবেগ দিয়ে সবকিছু ভাবে। তাই ভাবছে এই জীবনটাও বোধহয় সহজ। কিন্তু সে জানে না এই জীবনটা কতোটা কঠিন। প্রতিনিয়ত কতোটা চিন্তা, অনিশ্চয়তার মধ্য দিয়ে আমাদের দিন কাটাতে হয়। এখন সে অবুঝ বলে কি আমিও অবুঝ হয়ে যাবো?”
–“কিন্তু নৈরার আবেগ, অবুঝ পনা, ভালোবাসা সবটা শুধু তুই জুড়ে। সে এই জীবনে তোকে ব্যতীত আর কাউকে জীবনসঙ্গী হিসেবে চায় না আর না মানতে পারবে। প্রতিটা মানুষের কাছে জীবনসঙ্গী এমন একটা জায়গা হয় যার কাছে স্বস্তি ভরসা ভালোবাসা খুঁজে পাওয়া যায়। নৈরার কাছে বিগত এই জীবনটাতে সবকিছু ছিল এবং আছে। তার যদি এখন কিছুর প্রয়োজন হয় সেটা একজন উত্তম জীবনসঙ্গীর ভালোবাসার। যেটা সে শুধু তোর থেকেই কামনা করে।”
স্বরূপ নিরাগ, নিস্তেজ দৃষ্টিতে তাকায় বোনের দিকে। শুধায়,
–“তুই এসব জানলি কি করে?”
সাধনা এবারেও জবাব দেয় না। নরম সুরে বলল,
–“মেয়েটা ভালো নেই স্বরূপ। যেই মেয়েটার বিগত তিনমাস যাবৎ তোর সাথে একটা কঠিন পথ পাড়ি দেয়ার জন্য নিজেকে গড়ছে, তাকে একটু তো সুযোগ দেয়া উচিৎ তাই না? আমরা সবাই তো আছি, আর মাত্র তিনটা বছর। তারপর লোন শেষ। আমরা আগের মতো স্বচ্ছল হয়ে যাবো। নৈরাকে কোনকিছুর কমতি অনুভব হতে দেবো না।”
বোনের এই ছোট্ট ছোট কথাগুলো কতোটা গভীরভাবে স্বরূপের বুকে আশার বাসা বাঁধছে তা কি জানে সাধনা? স্বরূপের অসহায় অন্তঃস্থল উন্মাদের মতো একটু আশার আলো খুঁজে বেড়াচ্ছে। বোনের কথাগুলো স্বরূপকে আরো সাহস জোগায়। তবুও দিনশেষে মূর্ছে যায় এক বাবার অনুনয়ের কাছে। স্বরূপ বোনের দিকে নির্নিমেষ তাকিয়ে বলল,
–“নৈরার বাবা কখনো চাইবে না আমার মতো একজনের কাছে তার মেয়ের হাত তুলে দিতে।”
ভাইয়ের কথায় মৃদু হাসলো সাধনা। বলল,
–“কেউ একজন বলেছে, চাওয়া না চাওয়া পরের ব্যপার। এখন শুধুমাত্র নৈরার মুখের হাসি ধরে রাখা মুখ্য। আর নৈরার মুখে হাসি তখন ই ফুটবে যখন তুই ওর বাড়িতে ওর হাত চাইতে হাজির হবি। আমি আর তোর কোন কথা শুনছি না। আজ ছুটি নিচ্ছিস তুই। কোথাও যাবি না, বাড়িতেই থাকবি।”
বলেই সাধনা হাত ধুয়ে ঘরে চলে গেলো। ফিরে আসে একটা গোলাকৃতির বক্স হাতে নিয়ে। স্বরূপ চুপটি করে তখনো বসে চেয়ারে। সে হা করে বোনের কার্যকলাপ দেখছে। সাধনা বক্সটি থেকে এক জোড়া বালা বের করে ভাইয়ের সামনে রাখলো। হাসিমুখে বলল,
–“বিকালে আমরা নৈরার বাড়িতে যাবো। এটা দিয়ে ওকে আপাতত তোর নামে করে আসবো।”
স্বরূপ অতিষ্ট হয়ে গেলো বোনের কান্ডে। বিতৃষ্ণা ভরা কণ্ঠে বলল,
–“তুই কথায় কথায় এটা বের করিস কেনো? তোকে কতোবার বলেছি দুলাভাইয়ের এই একটামাত্র স্মৃতি কখনো নষ্ট করার কথা মাথাতেও আনবি না।”
–“নষ্ট করছি না স্বরূপ। যা আমার তা তোর। এটা দিয়ে আমরা নৈরাকে আনবো; আর কোন কথা নয়। খালি হাতে ঘরে বউ আনা যায় না।”
–“কখনো না। যা রেখে আয় এটা ঘরে।”,স্বরূপের জেদি কণ্ঠ।
সাধনা কঠোর দৃষ্টিতে তাকায় তার দিকে। বলল,
–“এটা আমি আমার ভাইয়ের বিয়ের জন্যই রেখেছিলাম স্বরূপ। আমি এই সোনাদানা দিয়ে কি করবো? বিধবা মানুষ! এসব রঙ ঢং করার বয়স আর ইচ্ছে কোনটাই আমার নেই। এটা নৈরাকে পড়িয়ে আমি তোর বউ করে আনবো। তোর যখন হবে তখন তুই আমাদের আবার বানিয়ে দিবি। লোনটা ছেড়ে গেলেই আমাদের আর পিছুটান থাকবে না। তখন তুই আমায়, নৈরাকে, মাকে যা ইচ্ছা তাই বানিয়ে দিতে পারবি।”, সাধনা ভাইয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল। স্বরূপের দেহ ম্লান হয়ে আসে বোনের ভরসা আর আশ্বাসে ভরপুর কণ্ঠে। মনে হয়, কোন কিছু অসম্ভব নয়। এই তো একটু ধৈর্য্য আর লড়াই তবেই তারা জিতে যাবে এই কঠিন জীবন। সে সাহস জুগিয়ে বলল,
–“একদিন আমরা সব সমস্যার সমাধান করে ফেলবো আপা। তখন আর আমাদের পিছু ফিরে তাকাতে হবে না।”
সাধনা হাসিমুখে ঘন ঘন মাথা নাড়লো। বলল,
–“হ্যাঁ , তাই তো বলছি। ভবিষ্যতের চিন্তা করে বর্তমান’টা নষ্ট করার কোন মানেই হয় না। এখন তাড়াতাড়ি খেয়ে নে। একটু পরে বাজারে যাবি ফল, মিষ্টি কিনে আনবি। সবচেয়ে ভালো দোকানের টা আনবি। বিকালে আমরা এগুলো সব নিয়ে নৈরাদের বাসায় যাবো।”
স্বরূপ মৃদু হাসলো বোনের প্রাণোচ্ছ্বল কণ্ঠে। সাধনা ব্যস্ত পায়ে নিজের ঘরের দিকে যাচ্ছিলো। আজ তার বড্ডো খুশির দিন। স্বরূপ তাকে পিছু ডাকলো। সাধনা উচ্ছ্বসিত বদন থামিয়ে পিছু ফিরে তাকায়। ভাইয়ের ইতস্ততা মাখা মুখটি দেখে শুধায়,
–“কি?”
স্বরূপ ইতস্ততা, জড়তা মিশ্রিত মিহি স্বরে বলল,
–“সে একটা লাল টুকটুকে বেনারসী চেয়েছিল আপা। সেটাও নিয়ে আসি?”
সাধনা মৃদু হাসলো ভাইয়ের মিনমিনে কণ্ঠে। চঞ্চল কণ্ঠে শুধায়,
–“আমিও আসি তোর সাথে?”
স্বরূপ হেসে ফেললো বোনের চঞ্চল কণ্ঠে। মাথা নেড়ে বলল,
–“তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে আয়।”
সাধনা দ্রুত কদমে ছুটলো। ভাই বোনের উচ্ছ্বাস দেখে মনে হচ্ছে তারা আজ দোকানদারকে বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে দোকান খুলিয়ে একটা লাল টুকটুকে বেনারসী কিনবে। শুকনো রুটি আর অপর্যাপ্ত পরিমাণে ডিম টুকুও আজ বড্ডো তৃপ্তি সহকারে খেলো স্বরূপ। ঐ যে, মনে প্রফুল্লতা, কারোর কঠিন আবদার পূরণ করতে পারার।
খাওয়া শেষে স্বরূপ ছুটে যায় পি.সি’র সামনে। অফিসে ছুটির আবেদন করে মেইল পাঠাবে। মেইল পাঠানোর আগে সে অন্য এক ফোল্ডারে ঢুকলো। ঢুকতেই ভেসে উঠলো কতো গুলো ফর্চুনেট-আনফর্চুনেট, খেয়ালি, বেখেয়ালিতে তোলা এক নারীর ভিন্ন ভিন্ন হাসিমাখা শুভ্র অবয়ব। অগোচরে ক্যামেরাবন্দি করা এই ছবিগুলো সর্বদা পি.সির বড়ো স্ক্রিনেই দেখে সে। নিজের ভাঙা ফোনটিতে কখনো দেখে না। এই শুভ্র বরফখন্ডের ন্যায় মুখটিতে সর্বদা হাসি আর উজ্জ্বলতা’ই মানায়, কোন ফাটল নয়। সে নির্নিমেষ দেখে সেই শুভ্র আদল। বিড়বিড় করে ডেকে ওঠে,
–“কাঞ্চনবালা? এবারেও আপনার অযাচিত আবদার গুলো গ্রহণযোগ্যতা পেয়ে গেলো। একটা লাল টুকটুকে বেনারসী আনবো আপনার জন্য। যেটা পড়লে আপনাকে একদম মিসেস স্বরূপ ইব্রাহীমের মতো লাগবে। অপেক্ষা করবেন তো?”
~চলবে~