#সংসার_সমরাঙ্গন (০৬)
রূপন্তি রাহমান (ছদ্মনাম)
টেবিলে সবার জায়গা হবে না। তাই ফ্লোরে মাদুর পাতা হলো। বারবার রান্নাঘর থেকে সব এনে হাঁপিয়ে উঠলো তনয়া। আবারও উঠে দাঁড়াতে মাহমুদ প্রশ্ন করলো,
‘রান্নাঘরে আর কিছু আছে?’
তনয়া মাথা নেড়ে সম্মতি জানাতেই মাহমুদ নিজে রান্নাঘর থেকে বাকি সব নিয়ে এলো। এতোক্ষণ চুপচাপ সব কিছু লক্ষ্য করছিল সোহেল। সব আনা শেষ হতেই তনয়া ডাকলো,
‘ভাইয়া, খাবার রেডি। চলে আসুন।’
সোহেল এসে বসলো। তারপর ধীরে ধীরে বাকিরাও চলে আসে।
‘তনয়া, তুমিও বসে পড়ো।’
তনয়া মুচকি হাসলো। ক্লান্তি তার মুখে স্পষ্ট।
‘আপনারা খান, আমি বেড়ে দিচ্ছি।’
মাহমুদ খানিক দূরে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে মেহেরুন্নেসা বললেন,
‘ওখানে দাঁড়িয়ে আছিস কেন? বসে পড়।’
‘তোমরা খেয়ে নাও আম্মা। আমি আর তনয়া পরে খাবো।’
‘তনয়া না হয় পরে খেয়ে নিবে। তুই বসে পড়। সবাই একসাথে বসে খাই। একসাথে বসে তো আর খাওয়ার সুযোগ হয় না।’
‘ভাইয়া, পোলাও দিবো না সাদা ভাত?’
সোহেল তনয়া প্রশ্নের জবাব দিলো না। তনয়ার হাত থেকে চামচ নিয়ে নিলো।
‘আম্মা তনয়া কি এই বাসার বাইরের কেউ?’
‘তা হতে যাবে কেন?’
সুযোগ পেয়ে সোহেল প্রতিবাদী গলায় জবাব দেয়,
‘তা যদি না হয় তবে ছেলেকে সবার সাথে বসতে বললেন। ছেলের বউকে বললেন না কেন? সবার মধ্যে কি ও পড়ে না? নাকি সবার সাথে বসে খাওয়ার যোগ্যতা ওর নেই? আপনার ঘরের বউ সারাদিন গাধার খাটুনি খাটলো। সবাইকে একত্রে করলো। তাকে বলছেন পরে খাওয়ার জন্য?’
মেহেরুন্নেসা এক মুহূর্তের জন্য থতমত খেয়ে গেলেন। মেয়ের জামাইয়ের কথার জালে এমনভাবে আটকে পড়লেন যে কী জবাব দেবেন বুঝে উঠতে পারলেন না। খানিকটা ঘাবড়ে গিয়ে অস্পষ্টভাবে আঁক-বাঁক করে কিছু বলার চেষ্টা করলেন,
‘তেমন কিছু না বাবা। ও বসে পড়লে তোমাদের কে বেড়ে দিবে?’
সোহেল নিজ হাতে প্লেটে পোলাও আর মুরগির রোস্ট নিলো।
‘যারটা সে নিয়ে খাবে, আম্মা। তনয়া আর মাহমুদ বসে যাও।’
সবার সাথে তনয়া আর মাহমুদও বসে পড়লো। যে যার মতো নিয়ে খাচ্ছে আর বাক্যালাপ করছে। সাহসাই সোহেল প্রশ্ন করে,
‘তনয়া কি আর চাকরি বাকরি করবে না?’
‘আপাতত ইচ্ছে নেই।’
‘আমার মাঝে মাঝে তোমার জন্য ভীষণ আফসোস হয়। মানুষ যা পায় না তা তুমি পায়ে ঠেলে ফেলে এসেছো। চাকরিটা না ছাড়লেও পারতে।’
খুব সন্তর্পণে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল তনয়া। নিষ্প্রাণ গলায় জবাব দিলো,
‘সংসার আর চাকরি দুইটা একসাথে আমি সামলাতে পারতাম না।’
সোহেল আঁড়চোখে মাহমুদের দিকে তাকালো। চাহনি ছিলো তীক্ষ্ণ আর সূঁচালো।
‘মেয়েদের পায়ের তলার মাটি শক্ত হওয়া ভীষণ প্রয়োজন। এটা মেয়েদের খুঁটি। কেউ দু’টো কথা বলার আগে,,,,,
চোখ ঘুরিয়ে মেহেরুন্নেসার দিকে তাকাতেই দেখলো তিনি অদ্ভুত দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে আছে। তাই কথা ঘুরিয়ে নেয় সে।
‘আমি তো বাবা মেয়ে বিয়ে দেওয়ার আগেই সব কাটছাঁট করে নিবো। মেয়েকে পড়াশোনা করিয়ে বিয়ে দিবো। সে চাকরিও করবে সংসারও করবে।’
চুপচাপ সব শুনলেন খালেকুজ্জামান। সোহেলের কথার সাথে তাল মিলান তিনিও।
‘কত করে বললাম চাকরিটা ছেড়ো না। ওটা তোমার পরিচয়। আমার কথা শুনলোই না।’
‘তুমি চুপ করো। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত ও চাকরি করলে সংসার দেখবে কে?’ খানিক উঁচু গলায় বলেন মেহেরুন্নেসা।
এক কথায় দুই কথায় হাজার কথা হবে। শেষে বেঁধে যাবে ঝগড়া। মেয়ের জামাইয়ের সামনে এমন অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটুক তা খালেকুজ্জামান কোনোমতেই চান না। তাই চুপ করে রইলেন।
‘এটা ভুল কথা আম্মা। একটা কাজের লোক রাখলেই হতো। সবাই নিজের কোয়ালিফিকেশন কাজে লাগাতে পারে না। আর তনয়া পেয়েও,,,,
এতটুকু বলেই থেমে যায় সোহেল।
‘আমাকে তো কখনো চাকরি বাকরির কথা বলোনি।’
সুমনার দিকে সরু চোখে তাকায় সোহেল। দৃষ্টি স্থির রেখে নিস্তেজ গলায় প্রশ্ন করলো,
‘এই কথাটা বুকে হাত রেখে বলতে পারবে আবার?’
সুমনা চুপ হয়ে যায়। মাথা নুইয়ে ফেলে মুহুর্তেই।
‘তোমার এইচএসসির পর আমাদের বিয়ে হয়। এরপর অনার্স আর মাস্টার্স আমার জোরাজোরিতে শেষ করেছো। তোমার পরীক্ষার দিনগুলোতে তোমার থেকে বেশি আমি রাত জেগেছি। ইফাদ পেটে আসার পরের দিনগুলো তুমি ভুলে গিয়েছো?’
‘এই থামো থামো। পুরোনো সব কথা বাদ৷ খাওয়ার পাতে এতো বলতে নেই।’
দুজনকে থামার জন্য বলে উঠেন মেহেরুন্নেসা।
সকলে একেবারেই চুপ। কেবল বাটি আর চামচের টুংটাং শব্দ শোনা যাচ্ছে। এই নীরবতার মাঝেই যেন বাজি ফাটালো নিশি।
‘খালামনি তুমি বাসায় কোনো কাজ করো না? সারাদিন বসে বসে খাও? আমিতো বাসায় আম্মুকে অনেক সাহায্য করি। তাই না আম্মু?’
বিষম খায় মুনিরা। সুমনা একবার এর দিকে তাকাচ্ছে তো আরেকবার ওর দিকে। শেষে ধমকে ওঠেন,
‘চুপচাপ খাও। প্লেটের ভাত তো একটাও নড়েনি।’
মুখ কালো করে খাওয়ায় মনোযোগ দেয় নিশি। তখনি নিশির মাথায় হাত রাখে সোহেল।
‘ওগুলো বিবেকের ব্যাপার সেপার, মা। অলসতায় দিন যাপন করলে বিবেক অকেজো হয়ে মাথা থেকে আস্তে আস্তে নিচে নেমে যায়। তোমার ছোট্ট মাথায় এসব ঢুকবে না।’
ফুঁস করে উঠলো মুনিরা।
‘দুলাভাই কী আমায় ইনডিরেক্ট কিছু বললেন?’
মুনিরার দিকে ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে তাকায় সোহেল। রগড় গলায় জবাব দিলো,
‘না তো শালীকা। আমি ডিরেক্ট তোমায় বলছি। যার হয় না নয়ে, তার হয় না নব্বইতে।’
________________
মোটা চাদর গায়ে জড়িয়ে বারান্দায় বসে আছে সুমনা। ঘুম নেই চোখে। ঘুম কেন আসছে না তা জানা নেই তার। বুকের ভেতরটা কেবল হাহাকার করছে। কি যেন নেই এমন অনুভব করছে সে। কান্না দলাপাকিয়ে আটকে আছে গলায়।
‘আপা, কফি।’
সুমনা চমকে উঠে। আবছা আলোয় তনয়াকে পা থেকে মাথা পর্যন্ত পর্যবেক্ষণ করে বার কয়েক। তনয়ার মধ্যে কয়েক বছর আগের নিজের প্রতিচ্ছবিই যেন দেখতে সুমনা।
‘ঘুমাওনি এখনো?’
তনয়া এপাশ মাথা দুলায়। সুমনা কফির কাপটা হাতে নিলো। শীত শীত রাতে হাতে গরম কফির কাপ। সুমনা কফিতে চুমুক দিয়ে আবেশে চোখ বুঁজে নিলো। উষ্ণতা বাড়িয়ে দেওয়ার জন্য এই এক কাপ কফিরই যেন প্রয়োজন ছিলো তার।
‘সবাই কি ঘুম?’
‘হুম।’
বারান্দায় কোণায় থাকা আরেকটা টুল এনে বসে তনয়া। দুজনেই সমানতালে রাতের নিস্তব্ধতা কে উপভোগ করছে। সহসাই তনয়া বলে বসে,
‘সকালের ব্যবহারের জন্য আমি ক্ষমাপ্রার্থী আপা।’
সুমনা একেবারে স্থির হয়ে যায়। পাল্টে যায় মুখের ভাবভঙ্গিও।
‘আমি যে এতিম জানেন তো?’
সুমনার তরফ থেকে কোনো উত্তর এলো না।
‘একজন সন্তানের জীবনে বাবা কতটা জুড়ে থাকে বাবাকে হারানোর পরে খুব করে টের পাই আমি। বাবা থাকাকালীন যারা চোখে তুলে তাকাতো না। বাবা মা*রা যাওয়ার পর তারাই নিকৃষ্ট রূপ দেখিয়েছে। এই বাসায় আসার পর আব্বা আমাকে যতটুকু স্নেহ করেন, সাপোর্ট করেন আমার বাবাও হয়তো তাই করতো। সকালে যখন আব্বাকে কথাগুলো বললেন আমার না সহ্য হয়নি। তাই না চাইতেও,,,
তনয়ার চোখ ভিজে ওঠে। বুক ভেঙে আসে। চোখ বুঁজে নিতেই ভেসে ওঠে সাদা কাপড়ে মুড়ানো তার বাবার শেষ যাত্রার প্রতিচ্ছবি। ফুঁপিয়ে উঠলো সে।
‘ক্লাস সেভেনে বার্ষিক পরীক্ষার শেষে বাসায় এসে দেখি আমার বাবা চলে গেছেন বহুদূর। যেখান থেকে আর ফিরে আসা যায় না। মাঝে মাঝে বাবাকে বড্ড দেখতে ইচ্ছে করে। একটু ছুঁতে ইচ্ছে করে। তার বুকে মাথা রেখে একটু আহ্লাদী হতে ইচ্ছে করে। কিন্তু সেই ভাগ্য আমার নেই। মাঝে মাঝে বাবার গায়ের গন্ধ পাই। আমার ভেতরটা দুমড়েমুচড়ে যায়। এই শূন্যতা কখনো পূরণ হওয়ার নয়।’
তনয়া নিজেকে সামলাতে পারলো না। ভেতরে ভেতরে জমা থাকা সব ব্যথা আর চাপা কষ্ট বেরিয়ে এলো জল হয়ে। ঠোঁট চেপে ধরে সে।
‘আজ আব্বাকে দু’টো কড়া কথা শুনিয়ে গেলেন। দুইদিন পর যদি দেখেন আব্বা আর নাই। তখন?’
সুমনা চমকে উঠে। বিস্মিত চোখে তাকালো তনয়ার দিকে। তনয়া ফিচেল হাসল।
‘ক্ষমা করতে পারবেন নিজেকে? গভীর রাতে গুমরে গুমরে কাঁদবেন। আব্বাকে ছোঁয়ার তৃষ্ণা আপনার বেড়ে যাবে। মন থেকে মাফ চাওয়ার জন্য উদগ্রীব হয়ে থাকবেন। কিন্তু সেই সুযোগ আর পাবেন না। শূন্যতা আর অপরাধবোধে হাহাকার করবেন। একবার চোখ বুঁজুন আর অনুভব করুন। বাবা নাই তো কিচ্ছু নাই।’
শীতের হিমেল হাওয়ায় কফি ঠান্ডা হয়ে গিয়েছে অনেকক্ষণ। হতচেতন হয়ে বসে আছে সুমনা। তার মুখে রাঁ নেই। নিশুতি রাতে কেবল তার শ্বাস প্রশ্বাসের নিনাদটুকুই কর্ণগোচর হচ্ছে। বুকের ভেতর হাহাকার করা আর কান্না দলা পাকিয়ে থাকার কারণ উপলব্ধি সে এতক্ষণে করতে পারলো। অবুজ মানবীর ন্যায় তনয়ার কথামতো চোখ বুঁজে নিলো। হটাৎ করে কানে বাজে, ‘কে? আমার সুমু?’
সুমনা চোখ মেলে তাকায়। মনের কোণে হারিয়ে যাওয়া ছোট্টোবেলার স্মৃতিগুলো হঠাৎ করেই জীবন্ত হয়ে ওঠে। খালেকুজ্জামানের কাঁধে চড়ে ঘুরে বেড়ানো, প্রতিকূল পরিস্থিতিতে শক্ত বুকে আগলে রাখা, অসুস্থতায় উদ্বেগে ছুটোছুটি করা—সবকিছু যেন এক ঝটকায় ফিরে আসে তার মনে। চোখ বুঁজে নিতেই আরও একবার ভেসে ওঠে সেই পরিচিত মুখখানা। খালেকুজ্জামানের অসহায়, দুঃখমাখা চোখের দৃষ্টি। যে কষ্ট তার কথার আ’*ঘা*তে তিনি পেয়েছিলেন।
সুমনা আবার চট করে চোখ খুলে তাকায়। বুকের ভেতর অপরাধবোধ ঢেউ তীব্র হয়ে ওঠে। দলা পাকানো কান্না যেন আর ধরে রাখা যায় না। গোপন যন্ত্রণা অশ্রু হয়ে গড়িয়ে পড়ে। চোখের পাতা ভেদ করে সেই বারিধারা চিবুকে এসে পৌঁছায়, আর আবছা আলোয় তার চকচকে ঝিলিক যেন সুমনার ভেতরের সমস্ত ব্যথার প্রতিচ্ছবি হয়ে ওঠে।
সেকেন্ডের কাঁটা যেন অদ্ভুত তাড়নায় পাল্লা দিয়ে দৌড়াচ্ছে। প্রতিটি মুহূর্তের সাথে সময় এগিয়ে যাচ্ছে, আর রাত ধীরে ধীরে আরো গভীর হয়ে উঠছে। চারপাশের নিস্তব্ধতা যেন আরো সুনশান হয়ে এলো। অন্ধকার ঘন হতে হতে যেন সময়ের ভার আরো প্রকট হয়ে উঠছে। আর রাতের নীরবতা যেন সমস্ত কিছু ঢেকে ফেলছে।
সুমনা ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হয়ে ওঠে। নির্জীবতা জেঁকে বসেছে । নিস্তব্ধ রজনীর অন্ধকার আকাশে তার চোখ স্থির হয়ে থাকে। যেখানে ছোট-বড় হাজারো তারকা জ্বলজ্বল করছে, কিন্তু তার চোখে সে আলোটুকুও যেন ম্লান হয়ে গেছে। প্রতিটি তারা যেন তার অন্তর্গত একাকীত্বের প্রতিফলন হয়ে তার সামনে উজ্জ্বল হয়ে ওঠে।
‘মাহমুদের মুখে আপনার শ্বাশুড়ির অনেক কথাই শুনেছি। আপনার পড়াশোনায় বাঁধা দেওয়া। কাজে ভুল ধরা। কারনে অকারণে আপনাকে বকাঝকা করা। বাধ্য হয়ে দুলাভাই তার থাকা খাওয়ার অসুবিধার অজুহাত দেখিয়ে আপনাকে শহরে নিয়ে এসেছে।’
পুরোনো কথা মনে করে দীর্ঘশ্বাস ফেলল সুমনা।
‘আমি যদি আপনার ভাইকে আলাদা সংসারের জন্য বলি সে কিন্তু আমাকে আলাদা একটা সংসার দিতে বাধ্য। ইসলাম সেটাই বলে।’
সুমনা চকিত চোখে তনয়ার আবছা মুখের দিকে তাকালো। তনয়া নিষ্প্রাণ ঠোঁট জোড়া প্রসারিত করে। মেঘমেদুর স্বরে আওড়ালো,
‘শ্বশুর বাড়িতে অন্যায় অবিচারের শিকার হওয়া বউটাও বাপের বাড়ি এলে খোলস বদলে ফেলে। এটাই কি তবে সমাজের রীতি?’
#চলবে