#সংসার সমরাঙ্গন (০৭)
রূপন্তি রাহমান (ছদ্মনাম)
সকাল হতেই চলে যাওয়ার জন্য তোড়জোড় শুরু করে সোহেল। তাড়া দিতে থাকে সুমনাকে। বাচ্চাদেরও বলেন তাড়াতাড়ি তৈরী হতে।
নিশির চুল আঁচড়ে দিচ্ছে সুমনা। পাশেই বিচার আর অভিযোগের ঝুড়ি নিয়ে বসেছেন মেহেরুন্নেসা। তনয়ার নামে অনর্গল বলেই যাচ্ছেন।
‘কাল তোদের নাম করে খাসির মাংশও এনেছে বাজার থেকে। আমি নিজ চোখে দেখেছি। কই রান্না তো করলো না। তোদের নাম করে এনে পরে রান্না করে মায়ের জন্য নিয়ে যাবে। আমি বুঝি না ওসব চালাকি।’
খাবারের লোভনীয় গন্ধ নাকে আসতেই ছুটে রান্না ঘরের দিকে যায় নিশি। সুমনা তপ্ত শ্বাস ফেলে মেহেরুন্নেসার দিকে তাকায়।
‘আমার শ্বাশুড়ি আর তোমার মধ্যে এতো মিল পাচ্ছি কেন আম্মা?’
মেহেরুন্নেসা চকিত হলেন। অবাক চোখে তাকিয়ে রইলেন সুমনার মুখটার দিকে।
_____________
সবাই আসার আগেই এক প্লেট বিরিয়ানি নিয়ে বসে পড়েছে নিশি। তনয়া বাকি প্লেটগুলো সাজাতে সাজাতে উপস্থিত হয় সোহেল।
‘সকাল সকাল কাচ্চি? এতো আয়োজন করলে কখন?’
সোহেল প্রশ্নে মৃদু হাসে তনয়া।
‘রাতেই টুকটাক গুছিয়ে রেখেছিলাম। আর ভোর হতেই রান্না শুরু করলাম।’
‘তাই বলে সকাল সকাল বিরিয়ানি খাবো তনয়া? পেটে গ্যাস হবে তো।’
‘গ্যাস হলেই তো ভালো। সেগুলো সিলিন্ডার ভর্তি করে বাজার চড়া দামে বিক্রি করা যাবে।’
ফ্রিজ থেকে ঠান্ডা বোরহানির বোতল বের করে টেবিলের উপর রাখে মাহমুদ।
‘এক আধদিন খেলে গ্যাস হবে না সোহেল ভাই।’
‘ওরেব্বাস! আবার বোরহানিও?’
‘বোরহানি আপনার শালা বানিয়েছে। বোরহানি ছাড়া নাকি কাচ্চি অসম্পূর্ণ।’
তখনই রুম থেকে বের হয়ে আসেন মেহেরুন্নেসা আর সুমনা। কথাটা শোনামাত্রই তিনি তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠেন। দু-চার কথা শুনানোর প্রস্তুতি নিতেই খেয়ালে আসে সোহেলকে। তিনি দমে যান। কিন্তু দমে যায়নি রোষানল। দাঁতে দাঁত পিষে চাপা স্বরে সুমনাকে ফিসফিস করে বলেন,
‘দেখলি তো নিজের চোখে? কিভাবে আমার ছেলেটাকে ঘরের কাজে খাটায়। কাল থেকে খাটাচ্ছে। রান্নাঘরের কাজ করার জন্য আমি আমার ছেলেটাকে বড় করেছি? আমার ছেলে কি কামলা?’
মেহেরুন্নেসার কথায় সুমনা তেমন প্রতিক্রিয়া দেখালো না। দু’কদম এগিয়ে চেয়ার টেনে বসে খাওয়ার জন্য। তনয়া সুমনা আর সোহেলের প্লেটে বিরিয়ানি বেড়ে দেয়।
‘ইফাদ কোথায় আপা?’
‘ওয়াশরুমে হয়তো। বাপের মতো একবার ঢুকলে আর বের হতে চায় না।’
‘আমি ওয়াশরুমে গেলে আর বের হই না নাকি তুমি বের হও না?’
‘নিজের দোষ একদম আমার উপর চাপাবে না। আচার-আচরণ, স্বভাব থেকে শুরু করে সবকিছু তোমার পেয়েছে ছেলেটা। একটাও যদি আমার গুণ পেতো মনটাকে বুঝাতে পারতাম।’
‘তাও ভালো আমার স্বভাব পেয়েছে। অন্তত ন্যায়-অন্যায় বোধটা তো থাকবে।’
সুমনা অগ্নি চোখে তাকাতেই সোহেল তোয়াক্কা করলো না। আপনমনে খেতে লাগলো সে।
‘আম্মা আপনিও বসে যান না। গরম গরম খেয়ে নিন।’
মাহমুদকে বলে,
‘আব্বা আর মুনিরাকেও ডেকে আনো। ঠান্ডা হয়ে গেলে আর ভালো লাগবে না।’
মাহমুদ মিনিট দুয়েক পরে আবার ফিরে আসে।
‘আব্বা পরে খাবে। আর মুনিরা আসবে এখনি।’
‘তুমিও বসে যাও।’
‘পরে খাবো।
‘অফিস যাবে তো আবার।’
‘তিনদিনের ছুটি নিয়েছি।’
‘ওহ্!’
_____________
এখনই বের হয়ে যাবে সুমনা সহ বাকিরা। তনয়া দৌড়ে এলো হাতে আরএফএল এর ফুড কন্টেইনার। হাঁপাতে হাঁপাতে বলে,
‘এই বিরিয়ানির বক্সটা নিয়ে যান আপা। নিশির খুব পছন্দ।’
এক পলক তাকালো মেহেরুন্নেসার দিকে। তারপর একটু হাসলো।
‘তাই খাসির মাংশটা আলাদা করে রেখেছিলাম।’
সুমনা চোখ ঘুরিয়ে সবাই কে দেখলো। সকলে থাকলেও নেই কেবল খালেকুজ্জামান। সুমনা চলে যাচ্ছে আর খালেকুজ্জামান থাকবেন না এমনটা কখনো হয়নি। গেইট অব্দি মেয়ের পিছন পিছন যান তিনি। বুকটা ধক করে উঠে তার। মনে পড়ে যায় তনয়ার বলা রাতের কথাগুলো। ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় জানান দিচ্ছে তার বাবা তার থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে। তার ব্যবহারে দূরে সরে যাচ্ছে একটু একটু করে। গলা ধরে আসে তার।
‘তনয়া আব্বাকে ডাকো।’
তনয়া ব্যতিব্যস্ত স্বরে প্রশ্ন করে,
‘কিছু হয়েছে আপা?’
‘তুমি আব্বাকে ডাকো দয়া করে।’
সুমনার চোখ ছলছল করছে। কথাগুলো থেমে থেমে যাচ্ছে তার। সোহেল এগিয়ে আসে। চিন্তিত গলায় প্রশ্ন করে,
‘কি হয়েছে সুমনা?’
চিৎকার করে উঠলো সে।
‘তোমরা কেউ কি আমার কথা শুনতে পাচ্ছো না? আব্বাকে ডাকো কেউ।’
তনয়া তড়িঘড়ি করে ডাকার জন্য যেতেই দেখলো খালেকুজ্জামান এদিকেই আসছেন। তনয়া থেমে গেলো।
‘ওইতো আব্বা আসছে।’
সকলের দৃষ্টি গিয়ে পড়লো খালেকুজ্জামানের দিকে। তিনি ঘটনা বুঝতে পারলেন না। ভ্রুকুটি করে তাকিয়ে রইলেন। সুমনা বিলম্ব করে না ছুটে গিয়ে খালেকুজ্জামানের বুকে লুটিয়ে পড়ে। পিতৃ স্পর্শে সে আরো দূর্বল হয়ে যায়। বুক ভেঙে আসে। অশ্রু কণা গড়িয়ে ভিজে যায় খালেকুজ্জামানের পাঞ্জাবি।
‘আব্বা আমারে মাফ করে দেন আব্বা। আমি আর আপনার সাথে এমন ব্যবহার করবো না আব্বা। আমি ভুল করছি আব্বা। আপনার সুমুরে আপনি মাফ করে দেন।’
বলতে বলতে খালেকুজ্জামানের পা দু’খানা জড়িয়ে ধরে সুমনা। উপস্থিত সকলেই হতবাক। শুধু তনয়া ছাড়া। সকলের অগোচরে তার ঠোঁটের কোণায় ভেসে ওঠে বিজয়ের হাসি।
‘কিছু হয়েছিলো এখানে? সুমনা এসব বলছে কেন?’
সোহেলের কথায় সবাই চুপ থাকলেও তনয়া ব্যাপারটা সুন্দর করে সামলে নেয়।
‘বাবা এবং মেয়ের মধ্যে আমরা সকলে তৃতীয় চতুর্থ আর পঞ্চম ব্যক্তি। বরং উপলব্ধি টা উপলব্ধি করুন দুলাভাই।’
সোহেল চুপ হয়ে যায়। সুমনা পুনরায় আহাজারি শুরু করে,
‘আব্বা আপনার ছোট্ট সুমু না বুঝে কথাগুলো বলে ফেলছে। ও আব্বা, আব্বা।’
‘সুমনা কি শুরু করলি? সোহেল কি ভাববে?’
সুমনা কর্ণপাত করনি সে কথা। পা জড়িয়ে বসে রইলো ঠায়।
গমগমে পরিস্থিতি। সকলে উৎসুক হয়ে তাকিয়ে আছেন। মেয়ের জামাইয়ের সামনে মেহেরুন্নেসা কিছু বলতেও পারছেন আবার সহ্য করতেও পারছেন না। সুমনার এমন টলে পড়া কিছুতেই মেনে নিতে পারছেন না তিনি।
খালেকুজ্জামান মেয়েকে টেনে তুললেন। চোখের পানি মুছে দিলেন পরম মমতায়। যেমনটা সুমনা ছোটবেলায় ব্যথা পেলে করতেন।
‘কেউ ভুলের উর্ধে নয় রে মা। ভুল বুঝে শুধরে নেওয়াটাই বুদ্ধিমানের কাজ। কিন্তু আফসোস সবাই তা করে না। একটু অভিমান হয়েছিল। কিন্তু এখন সেটা আর নেই।
____________________
রাতের খাবার অনেকটাই বেঁচে গিয়েছে। দুপুরে তেমন কিছু রান্না করতে হয়নি তনয়ার। চুলোয় ভাত চাপিয়ে বাসার টুকটাক কাজগুলো সেরে নিলো সে।
গোসল আর নামাজ শেষ করে এলো ডাইনিংয়ে।মিনিট খানিকের মাথায় মসজিদ থেকে বাসায় আসে খালেকুজ্জামান আর মাহমুদ।
বেঁচে যাওয়া অল্প পরিমাণ বিরিয়ানির সবটাই তুলে দিলো মেহেরুন্নেসার প্লেটে। মাহমুদ কিছু একটা ভাবলো। এরপরই প্রশ্ন করে,
‘তুমি খেয়েছিলে বিরিয়ানি? সকালে তো খেতে দেখলাম না।’
মাহমুদের দিকে তাকিয়ে তনয়া ফিচেল হাসলো। কিঞ্চিৎ বিদ্রুপের স্বরে বলে,
‘এতো দামি মাংশ আর এতো দামের চাল দিয়ে রান্না করা বিরিয়ানি আমার গলা দিয়ে নামবে না।’
‘কি হয়েছে তনয়া?’
খালেকুজ্জামানের প্রশ্নে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল সে।
‘গতকাল বাজার করার সময় গরুর মাংশের সাথে খাসির মাংশও এনে ছিলাম। রাতে আর রান্না করিনি। আজকের জন্য রেখে দিয়েছিলাম।’
তনয়ার গলা ধরে আসে। তাকালো সে মেহেরুন্নেসার দিকে।
‘আম্মা আমার বাবা না থাকতে পারে তবে আমার একটা বড় ভাই আছে। সে যথেষ্ট উপার্জন করে। আমার মা মুখ দিয়ে কিছু বলার আগেই ভাইয়া এনে হাজির করে। আমার মা আপনার ছেলের ইনকাম বা আপনার বাসার রান্না খাওয়ার জন্য বসে নেই।’
_________________
ভাতঘুম দিয়েছে মাহমুদ। তনয়া পাশে এসে বসতেই মাহমুদ চোখ মেলে তাকায়। রাত থেকে মাথায় ঘুরতে থাকা একটা প্রশ্ন ঠোঁটের কাছে এনে আমতা আমতা শুরু করে।
‘কিছু বলবে তুমি?’
‘মানে আসলে একটা প্রশ্ন।’
‘একটু আগের ঘটনা নাকি অন্যকিছু?’
মাহমুদ ভনিতা করে না। সহজ সরল স্বাভাবিক গলায় প্রশ্ন করে,
‘আপা তোমায় এসে এতো কথা শুনালো। অপমান করলো। উল্টো তুমি আপা সহ সবাই কে সমাদর করলে কেন?’
‘উপলব্ধি করাতে।’ অনেকটা হেঁয়ালি করেই জবাব দেয় তনয়া।
মাহমুদ বুঝে উঠতে পারলো না তনয়ার কথা।জিজ্ঞাস্য দৃষ্টিতে তাকালো।
পাতলা কম্বলটা বুক অব্দি টেনে নেয় তনয়া। মাহমুদের কাছ ঘেঁষল আরো একটু। এক হাত জড়িয়ে বাহুতে মাথা রেখে ফিরতি প্রশ্ন করলো,
‘তোমার বোনদের আর কোনো ভাই আছে বা আব্বা আম্মার পরে তাদের এখানে একটু আশ্রয় পাওয়ার আর কোনো জায়গা আছে?’
মাহমুদ অসম্মতি জানিয়ে মাথায় নাড়ে।
‘আপা বুঝদার মানুষ। অনেককিছুই দেখেছে, সয়েছে। আমি আমার কর্মের মাধ্যমে শুধু এতটুকুই উপলব্ধি করাতে চেয়েছি এমন চলতে থাকলে এই যে স্বইচ্ছায় সম্মান আর সমাদর করছি তা হয়তো আর পাবে না। নিজ হাতে সেই জায়গাটুকু তারা নষ্ট করছে।’
‘ উপলব্ধি করতে পারলো কি?’
‘উপলব্ধি করতে পারলেই বেশ। নয়তো এপাড় ওপাড় দুইপাড়ই শেষ।’
#চলবে