#সংসার_সমরাঙ্গন (১১)
রূপন্তি রাহমান (ছদ্মনাম)
‘এত ভণিতা করার কী আছে? সোজা সাপটা বললেই তো পারো, তুমি এই শাড়িটা মুনিরাকে দিতে চাইছো না।’—মুখ বাঁকিয়ে বললেন মেহেরুন্নেসা।
তনয়া গভীর নিঃশ্বাস ফেলল।
‘শাড়ি দেওয়া-নেওয়ার বিষয় পরে আসে। প্রথমত, ও একজন প্রাপ্তবয়স্ক মেয়ে। ওর বোঝা উচিত, একজন স্বামী যখন তার স্ত্রীর জন্য কিছু আনে, তখন তৃতীয় ব্যক্তি হয়ে সেটার দিকে হাত বাড়ানো অনুচিত। সেটা এক টাকার হোক বা লাখ টাকার।’
সে এক মুহূর্ত থামল। চোখ ঘুরিয়ে তাকাল খালেকুজ্জামানের দিকে। তিনি নির্বিকার, যেন এ প্রসঙ্গে তার কিছুই বলার নেই। চায়ের কাপ হাতে নিয়ে অন্যমনস্ক ভঙ্গিতে চুমুক দিচ্ছেন। তনয়া আবার বলতে শুরু করল—
‘একজন ভাই হয়ে বোনের জন্য কিছু আনা আর একজন স্বামী হয়ে স্ত্রীর জন্য কিছু আনার মধ্যে অনেক পার্থক্য আছে। সেটা বোঝার মতো বয়স তোমার হয়েছে বলেই মনে করি’
মুনিরা হঠাৎ শাড়ির প্যাকেটটা ছুঁড়ে ফেলে দিলো। তার চোখে আগুনের ফুলকি, কণ্ঠে ক্রোধের ঝাঁঝ।
‘এটা সামান্য একটা শাড়ি। লাখ টাকার গয়না তো নয়। এমন একটা ভাব করছেন আমি কি না কি নিয়ে নিচ্ছি।’
তনয়া ধীরগতিতে প্যাকেটটা তুলে নিলো, যেন কোনো অমূল্য ধন হাতে পেয়েছে। মৃদু হেসে বলল—
‘এটার দাম এক টাকা হলেও আমার কাছে মহামূল্যবান। কারণ, আমার স্বামী আমার জন্য এনেছে।’
এই বলে সে উঠে দাঁড়াল। পা বাড়াল নিজের কক্ষের দিকে। তবে দরজার কাছে গিয়েই পেছন ফিরে আবার বলল—
‘আমার জন্য আনা শাড়িটা আমিই বরং নিয়ে গেলাম। কাল না হয় তোমার ভাই তোমার জন্য হাজার-বারোশো টাকার মধ্যে সেম ডিজাইনের একটা নিয়ে আসবে। ইয়ে মানে আম্মা তো এটাই বলেছিলো। তাই না আম্মা?’
তার কণ্ঠে বিদ্রুপের ছোঁয়া ছিল স্পষ্ট।
মেহেরুন্নেসার মুখ অগ্নিশর্মা হয়ে উঠলো।
‘এই মেয়ে দুই দিন হলো বউ হয়ে এসেছে। আর এখনই মা বোনের চেয়ে বড় হয়ে গেলো? সাহস পায় কোথায় এমন কথা বলার? জন্ম দিলাম আমি আর আমারই মূল্য নাই?’
— মেহেরুন্নেসার কণ্ঠের তেজ যেন জ্বলন্ত শিখায় পরিণত হলো। ক্রোধে কাঁপছিলেন তিনি।
‘তুমি কি সবসময় এমন চুপ করেই থাকবা মাহমুদের আব্বা? আমার না হয় তোমার কাছে কোনো দাম নাই। মুনিরা তো তোমার সন্তান। এতগুলো কথা বলে গেলো তুমি টুঁ শব্দও করলে না।’
‘বিয়ের পর পুরুষ মানুষের সবচেয়ে কাছের হয় বউ। মা আর ভাইবোন হয়ে যায় পর। আগে বউ তারপর বাকি সবাই। বহুবছর আগে তুমি ই এই কথাটা বলেছিলে না?’ —চশমার ফাঁকে ভ্রু উঁচিয়ে প্রশ্নটা করলেন খালেকুজ্জামান।
তিনি থতমত খেয়ে গেলেন। দ্রুতই নিজেকে সামলে নিয়ে বললেন,
‘হ্যা বলেছি। বউ ভালো হলে বউকেই প্রাধান্য দিতে হবে।’
খালেকুজ্জামান ঠোঁটের কোণে হাসি টেনে বললেন,
‘ওহ্! তুমি তাহলে বলতে চাচ্ছো তুমি ভালো বউ ছিলে? তাই বাধ্য হয়ে আমায় তোমার কথা শুনতে হতো? তাহলে তো ঠিকই আছে। মাহমুদের কাছেও হয়তো তার বউ ভালো। তাই নয় কি মাহমুদ?’
তীর তার দিকে মোড় ঘুরায় থতমত খেয়ে যায় মাহমুদ। মেহেরুন্নেসার রাগের উত্তাপ আরো বেড়ে গেলো।
মাহমুদ দীর্ঘশ্বাস ফেলল। মাথা নিচু করলো একটু।
‘বউ বলে তার হয়ে প্রতিবাদ করি না। তোমরা বলো আমি বউকে কিছু বলি না। সারাদিন অফিস করে বাসায় আসি রিল্যাক্স করার জন্য। কিন্তু কতটুকু করতে পারি? একটু মিলমিশ করে থাকলে কি হয় আম্মা? কিছু থেকে কিছু হলেই ঝ*গ*ড়া। এমন চলতে থাকলে,,,,,,,
‘ঝগড়া আমি করি? তোর বউ যে চ্যাটাং চ্যাটাং করে সেগুলো তোর চোখে পড়ে না? আমি কিছু বললেই তো তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠে। আমার কথা মাটিতে পড়ার আগেই তো তার উত্তর রেডি থাকে।’
‘অনেক কিছুই দেখি আম্মা। অনেক কিছুই বুঝি। এটাও বুঝি আজকের এই পরিস্থিতির জন্য অনেকাংশে আমি দায়ী।’
মাহমুদ চলে গেলো। সাথে সাথে উঠে দাঁড়ালেন খালেকুজ্জামানও।
‘রিটায়ারমেন্টের পর অনেক আরাম করেছি। এখন ছোটখাটো একটা কাজের ব্যবস্থা করতে হবে। নয়তো কোনো একদিন দেখা যাবে আমার কানের পোকাগুলো কানের ভেতর ম*রেই কঙ্কাল হয়ে গিয়েছে, আর আমি কিছুই শুনতে পাচ্ছি না।’
______________
মাহমুদের আনা শাড়িটা গায়ে জড়িয়ে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে আছে তনয়া। অদ্ভুত তার চোখের চাহনি। মাহমুদ দরজাটা হালকা চাপিয়ে তনয়াকে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরে।
‘শাড়িটায় দারুণ লাগবে তোমায়। রংটা যেন তোমার গায়ে এসেই পূর্ণতা পেয়েছে।’
প্রশংসা শুনেও নিশ্চুপ থাকে তনয়া। গম্ভীরতা নিতে পারে না মাহমুদ। নিজের দিকে ফিরায় তনয়াকে।
‘এখনো রেগে আছো?’
তনয়া তৎক্ষনাৎ দৃষ্টি নামিয়ে নেয়। মাহমুদের চোখে চোখ রাখতে চাইলো না সে। চিবুকে আঙুল ঠেকিয়ে মুখ উঁচু করে মাহমুদ। উষ্ম ঠোঁটের স্পর্শ এঁকে দেয় কপালে। ভেজা চোখজোড়া মাহমুদ অসহায় মুখের দিকে নিবদ্ধ করে তনয়া।
‘কি করলে অভিমান কমবে?’
তনয়া সপ্রাণ কেঁদে উঠে। নীরব যন্ত্রণার প্রতিধ্বনি হয়ে মুহুর্তেই ঝরে পড়ে নয়নের নীড়। নেতিয়ে পড়লো মাহমুদের বুকে। নোনাজলে ভিজে যায় বুকপকেট।
‘এতকিছুর পরেও কেন অভিমান করে থাকতে পারি না? কেন এই গভীর স্পর্শের কাছে আমার সমস্ত রাগ অভিমান ফিকে যায়? কেন উলোটপালোট হয়ে যাই আমি?’
‘ভালোবাসো যে তাই।’ বাহুডোরে আবদ্ধ করে বলে মাহমুদ।
সহসাই মাহমুদের স্বর নরম হয়ে উঠলো-
‘আর জ্বর এসেছিলো?’
তনয়া অসম্মতি জানাতেই সে পুনরায় জিজ্ঞেস করে,
‘শরীর দূর্বল লাগে?’
‘হুম।’
‘রান্না করবে কে?’
মাথা উঁচিয়ে মাহমুদের মুখের দিকে তাকায় তনয়া। বিদ্রুপের স্বরে জবাব দেয়-
‘আমি ছাড়া আর কে? আমি তো এখন দিব্যি সুস্থ। তাই না?’
কপালে লেপ্টে থাকা চুলগুলো কানের পিছনে গুঁজে মাহমুদ বলে-
‘কতটা সুস্থ তা চোখমুখই বলে দিচ্ছে। তোমার রান্না করতে হবে না?’
‘গতরাতের মতো আজ রাতেও অভুক্ত থাকার জন্য?’
মাহমুদ আক্ষেপের নিঃশ্বাস ফেলে। অপরাধীর ন্যায় বলে,
‘কালরাতের ঘটনার জন্য তোমার কাছে হাজার বার মাফ চাইলেও আমার কম মনে হবে। কালরাতের ব্যাপারটা তো আর ফিরিয়ে আনতে পারবোনা। তবে কথা দিচ্ছি, এই ঘটনা আর কখনো রিপিট হবে না। রাতের জন্য বাহির থেকে খাবার নিয়ে আসবো আমি।’
তনয়া উত্তর করলো না। আবারও মিশে যায় মাহমুদের বুকের সাথে। খানিক চুপ থেকে দ্বিধান্বিত হয়ে বলে-
‘অনেকদিন হয় তোমায় একটা কথা বলবো ভাবছিলাম। কিন্তু তুমি কিভাবে নিবে,,,
‘এতো সংকোচ করছো কেন? বলেই ফেলো না।’
‘ইয়ে মানে আসলে মুনিরা একটা ছেলের সাথে প্রেম করছে।’
এক ঝটকায় তনয়াকে হাতের বাঁধন থেকে ছেড়ে দেয় মাহমুদ।
‘কি বলছো তুমি?’
‘বাসস্টপেজের কাছে যে ওয়ার্কশপটা আছে? ওইখানে কাজ করে। তুমি দেখলে চিনবে। লম্বা চওড়া করে ছেলেটা।’
মাহমুদ পিছুতে পিছুতে বিছানায় ধপ করে বসে পড়ে। বাকরুদ্ধ সে।
‘মুনিরা হয়তো ঘাড়ত্যাড়ামি করে। কিন্তু ও এইরকম না। তোমার কোথাও ভুল হচ্ছে।’
মাহমুদের পাশে গিয়ে বসে তনয়া। কাঁধে হাত রাখে।
‘ঠিক এজন্যই আমি এতোদিন বলিনি। আমি জানতাম তোমরা কেউ বিশ্বাস করবে না।’
মাহমুদ গভীরভাবে নিশ্বাস ফেলল। যেন অন্তরের হতাশা তার শ্বাসে মিশে যাচ্ছে।
‘তাহলে তুমি নিশ্চিত!’
‘উপর তলার ভাবি আমায় একদিন বলেছিলো। ওদেরকে নাকি পার্কে একসাথে দেখেছে। আমি তেমন আমলে নেয়নি। কিন্তু যেদিন মেসেঞ্জারে ওকে চ্যাট করতে দেখলাম সেদিন আমি অবাক হয়েছি।’
মাহমুদ একেবারে গম্ভীর হয়ে যায়।
‘তুমিই বলো ওই ছেলের সাথে কি কথা থাকতে পারে? না ওই ছেলে পড়াশোনা করে। করলে হয়তো বুঝতাম পড়াশোনার খাতিরে যোগাযোগ করে। কিন্তু,,
‘রুচির এতোটা অধঃপতন হয়েছে আমার বোনের?’
‘পড়াশোনা না করলে কি হবে দেখতে তো বেশ। তাই হয়তো।’
‘তনয়া ওই ছেলেকে আমি মাঝে মাঝে রাস্তায় সিগারেট খেতে দেখি।’
‘তুমি চিনতে পেরেছো ছেলেটাকে?’
মাহমুদ মাথা দোলায়।
‘বড় আপাকে আব্বা তাড়াতাড়ি বিয়ে দিয়েছে। ভেবেছিলাম ওকে পড়াশোনা করাবো। অঘটন ঘটার আগেই প্রস্তাবটা নিয়ে ভাবতে হবে।’
‘কিসের প্রস্তাব?’ ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করে তনয়া।
তপ্ত শ্বাস ফেলে মাহমুদ জবাব দেয়-
‘রাতে খাওয়ার সময় বলবো।’
____________________
গার্লিক নান আর গ্রিলড চিকেন নিয়ে মাত্রই বাসায় ফিরেছে মাহমুদ। খাবারের প্যাকেট টেবিলের উপর রেখেই সোফায় গা এলিয়ে দেয় সে। প্রতিটা গিঁটে গিঁটে যেন ক্লান্তি বাসা বেঁধেছে।
নিজের রুমের দরজার দিকে দৃষ্টিপাত করে মাহমুদ। দরজা ভেতর থেকে আটকানো। অবিশ্রান্ত স্বরে তনয়াকে ডাকে সে।
‘তনয়া খাবার দিয়ে দাও। খিদে পেয়েছে খুব।’ বলেই চোখ বুঁজে রইলো।
তখনই দরজা খোলে রুম থেকে বের হয় তনয়া। গিয়ে দাঁড়ায় মাহমুদের সামনে। কারো উপস্থিতি টের পেয়ে চোখ মেলে তাকায় মাহমুদ। শাড়ি পরিহিত তনয়া কে দেখে চোখ বড় বড় হয়ে যায় তার। আপনা-আপনি ঠোঁটের কোণে ফোটে ওঠে এক চিলতে হাসি।
‘কেমন লাগছে আমায়?’
‘একদম আমার বউয়ের মতো।’
তনয়া ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে ফিক করে হেসে দেয়।
‘ফ্রেশ হয়ে এসো। খাবার দিচ্ছি।’
প্লেটে প্লেটে খাবার সাজায় তনয়া। হাঁক ছেড়ে ডাকলো সবাইকে-
‘মুনিরা খেতে এসো। আব্বা, আম্মা কোথায় আপনারা?’
খানিক বাদেই সকলে চলে এলো। তনয়ার গায়ে শাড়ি দেখেই মুখ বাঁকান মেহেরুন্নেসা।
‘ঢং দেখলে বাঁচি না।’
পিছনে দাঁড়িয়ে ছিলো মুনিরা। ফিসফিস করে বলল,
‘আম্মা দেখলে তোমার বউয়ের কান্ড? আমি শাড়িটা চেয়েছি বলেই শাড়িটা আজই পরেছে।’
‘সবই দেখছি। চুপ থাক। সুযোগে থাবা দিবো।’
_________
একমনে খাচ্ছে সবাই। খাওয়া প্রায় শেষের দিকে। নিরবতা ভাঙে মাহমুদ।
‘তোর কয়টা পরীক্ষা শেষ হলো মুনিরা?’
‘চারটা।’
‘বাকি আছে আর কয়টা?’
‘তিনটা।’
‘কেমন হচ্ছে পরীক্ষা?’
‘ভালো।’
‘ভালো হলেই ভালো। আব্বা একটা কথা ছিলো।’
‘কি কথা?’
‘আমার পাশের ডেস্কে যে ছেলেটা বসে তাকে আপনার মনে আছে না?’
‘ওই যে শ্যামলা করে ছেলেটা? কি যেন নাম শামিম না কি?’ খাওয়া থামিয়ে জিজ্ঞেস করেন খালেকুজ্জামান।
‘হুম।’
‘কেন কি হয়েছে?’
‘তার পরিবার মুনিরাকে ছেলের বউ করতে চেয়েছে।’
গলায় খাবার আটকে যায় মুনিরার। খকখক করে কাশতে শুরু করে সে। তনয়া তড়িঘড়ি করে গ্লাস এগিয়ে দিলো তাকে।
‘কবে?’ জানতে চাইলেন খালেকুজ্জামান।
‘প্রস্তাব অনেক আগেই দিয়েছে। মুনিরার পড়াশোনার কথা ভেবে এগুইনি। তবে এখন বিয়েটা নিয়ে ভাবতে হবে। ছেলেও যেহেতু ভালো হাতছাড়া করতে চাইছিনা। আবার আমার পরিচিতও।’
‘তোমার কাছে ভালো লাগলে এগুতে পারো। তবে একটু ভালো করে খোঁজ খবর নাও।’
দুজনের কথার মাঝে বিস্ফোরণ ঘটায় মুনিরা।
‘আমি বিয়ে করবো না।’
‘কেন?’ কপাল কুঁচকে জিজ্ঞেস করে মাহমুদ।
‘আমার তো এখনো অনার্স কমপ্লিট হয়নি। আমি পড়াশোনা করতে চাই। আমি বিয়ের জন্য প্রস্তুত না।’
‘পড়াশোনার জন্য বিয়ে করতে চাইছিস না? নাকি ওই ওয়ার্কশপে কাজ করা ছেলেটার জন্য?’
#চলবে