সংসার সমরাঙ্গন পর্ব-১৩+১৪

0
1

#সংসার_সমরাঙ্গন (১৩)
রূপন্তি রাহমান (ছদ্মনাম)

এখনই বিয়ে করতে প্রস্তুত নয় মুনিরা। নিজের পড়াশোনা শেষ করতে চায় সে। মাহমুদ পুনরায় বিয়ের কথা তুলতেই সে রেগেমেগে দরজা আটকে রুমে বসে রইলো।

দরজার কড়া নাড়ে সুমনা। প্রথমবারে সাড়া দিলেও দ্বিতীয়বারে সাড়া দেয় সে।

‘আপা তুই ভাইয়াকে বুঝা। আমি এখনই বিয়ে করবো না। আমি আরো পড়াশোনা করতে চাই। ভাইয়াকে বল ওর বউয়ের কথা শুনে আমাকে জোর না করতে।’

‘তুই আগে দরজা খোল। তোর সাথে আমার দরকারী কথা আছে।’

কেঁদেকুটে একাকার মুনিরা। ফোলা ফোলা চোখ আর নাকের ডগা লাল। ফুঁপিয়ে উঠছে বাদে বাদে।দরজা খোলেই লুটিয়ে পড়ে সুমনার বুকে।

‘আপা আমি এখন বিয়ে করতে চাই না। পড়তে চাই আমি।’

মুনিরাকে টেনে নিয়ে খাটের ওপর বসায় সুমনা। আদর করে চোখের পানি মুছে দেয় সে। বড়বোন মানেই মায়ের আরেকটা ছায়া।

‘ছেলেটা সম্পর্কে মাহমুদ আমায় বলেছে। কোনো বাজে অভ্যাস নেই। প্রতিষ্ঠিত ছেলে। ভালো জায়গায় উঁচু পোস্টে কর্মরত আছে। সবসময় কি এতো ভালো সম্বন্ধ পাওয়া যায়?’

‘আমি বিয়ে করবো না। ভাবি আমায় সহ্য করতে পারে না। তাইতো খারাপ কথা রটিয়ে আমায় বিদায় করতে চাইছে। ভাবি ওর মাথা টা পুরো খেয়ে ফেলেছে।’

‘তনয়া তো বলল ও ভুল করেছে। ক্ষমাও চাইলো। তাহলে? সব সময় সবদিক মিলিয়ে ভালো সম্বন্ধ পাওয়া যায় না। ভালো ছেলে মিলানোও দুষ্কর।’

‘তুই আমার হয়ে ওদের কিছু বলতে এসেছিস নাকি ওদের হয়ে ওকালতি করতে এসেছিস? ভাবি তোর মাথাটাও চিবিয়ে খেয়েছে তাই না?’

সুমনা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। মুনিরা কে বুঝাতে বুঝাতে ক্লান্ত সে। তারপরও হাল ছাড়লো না। আবারও অব্যর্থ চেষ্টা চালায় সে।

‘আমি কারো হয়ে ওকালতি করছি না। শুধু তোকে ভালো টা বুঝানোর চেষ্টা করছি। নিজের ভালো টা বুঝতে শিখ। তাছাড়াও তুই রাজি না হলে কিন্তু সবাই ধরে নিবে তোর সম্পর্ক আছে। এটাই চাইছিস তুই?’

‘আমি পড়াশোনা করতে চাইছি। আর কিচ্ছু না। কেন বুঝতে পারছো না তোমরা?’ -চিৎকার করে উঠে মুনিরা।

পিঠে মাথায় হাত বুলিয়ে দেয় সুমনা। মুনিরার মতো তার রেগে গেলে চলবে না। তাকে বুঝাতে হবে ঠান্ডা মাথায়।

‘ওরা তো তোকে পড়াশোনা করাবে। শিক্ষিত ছেলের বউও তো শিক্ষিতই হবে। ছেলেও দেখতে মাশা-আল্লাহ। মাহমুদ ছবি পাঠিয়েছে আমায়। একটা বার দেখ তুই।’

মোবাইল থেকে ছবি খানা বের করে মুনিরার সামনে রাখে সুমনা। পুনরায় বলল,

‘সবকিছু ঠিকঠাক আছে। তুই ওদের সামনে যা একটা বার। তোর ভালো না লাগলে আমি নিজে সমস্তটা সামলাবো। আর তাছাড়াও পাত্রপক্ষের সামনে গেলেই কি বিয়ে হয়ে যায়?’

________________

সকলের চাপের মুখে শেষ পর্যন্ত রাজি হয় মুনিরা। তবে স্পষ্ট শর্ত জুড়ে দেয়—পাত্রকে দেখার পর যদি মনে না ধরে, তবে সেখানেই সমাপ্তি টানতে হবে সবকিছু। কোনো প্রকার জোরজবরদস্তি কিংবা বাড়তি আলোচনা সে মেনে নেবে না।

পরদিন সন্ধ্যায় দুজনের সাক্ষাৎ- এর বন্দোবস্ত হয়। শামিম একাই আসবে। মুনিরাকে দেখবে। তবে কোনো আনুষ্ঠানিকতা থাকবে না। এটি নিছকই এক পরিচয়ের সুযোগ, যেখানে কেউ কারও প্রতি দায়বদ্ধ থাকবে না। যদি দু’পক্ষেরই মন সায় দেয়, তবে তবেই পরিবারের বড়রা পরবর্তী সিদ্ধান্ত নিয়ে এগোবে। অন্যথায়, এই অধ্যায়ের সমাপ্তি এখানেই।

দুইদিন হয় সবার থেকে দূরত্ব বজায় রেখে চলছে তনয়া। গুটিয়ে নিয়েছে নিজেকে। বিশেষ করে খালেকুজ্জামানের মুখোমুখি হতে চায় না সে। কেউ কিছু জিজ্ঞেস করলে হা হু উত্তর দিয়ে হাফ ছেড়ে বাঁচে সে। কাজের সময়টা বাদ দিয়ে বাকি সময়টা সে নিজেকে ঘরবন্দী করে রাখে। যেন কেউ কিছু বলতে না পারে।

মেহমান যেহেতু আসবে নীরবে ঘরদুয়ার পরিষ্কার করার কাজে লেগে পড়ে তনয়া। নিজের মতো করে করতে থাকে সবকিছু। সারাদিন ঘরদুয়ার পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করে ক্লান্ত হয় সে। ঘরের প্রতিটা কোণা এখন ঝকঝকে তকতকে। একা হাতে সবকিছু করতে গিয়ে সারাদিনে দুদণ্ড জিরোবার ফুরসত পায়নি সে। গোসল সেরে কোনো রকম দুমুঠো খেয়ে আবারও লেগে পড়ে কাজে।

সাক্ষাৎ-এর পরিসর ছোট হলেও আয়োজনের পরিসর ছোট নয়। ভারী খাবারের আয়োজন না করলেও নাস্তার আয়োজন চলছে। ঠাঁই পেয়েছে নানারকম ভাজাপোড়া।

প্রচন্ড শীতেও ঘেমে-নেয়ে একাকার তনয়া। দুই চুলোয় তেলের কড়াই বসানো। সমান তালে চলছে ভাজাপোড়ার কাজ। একা একা সামলে উঠতে না পারলেও কারো কাছে সাহায্য চাওয়ার ইচ্ছেটুকু তার নেই।

সিঙারা, চিকেন নাগেটস, ফিশবল, সমুচা আরো কয়েক পদ আইটেম ভেজে রাখা হয়েছে। বেশিরভাগ আইটেম রাতেই ফ্রোজেন করে রেখেছিলো সে। আজ যেন চাপে পড়তে না হয়। একপাশে পায়েশ বসিয়ে অন্য চুলোয় দ্রুত হাতে পুলিপিঠা বানাচ্ছে তনয়া। ছাঁচ থাকায় এই যাত্রায় রক্ষা পেয়েছে সে। একটু আরামও হয়েছে তার। কষ্ট করে আর বেলতে হচ্ছে না।

মুনিরা কে নিয়ে এতোক্ষণ ব্যস্ত ছিলো সুমনা। রান্নাঘরের দিকটায় আসার সময় করে উঠতে পারেনি। সময় ঘনিয়ে আসতেই সে এলো। এতো এতো আইটেম দেখে চক্ষু চড়াক গাছ।

‘এতোকিছু কখন করলে তুমি?’

এক পলক তনয়ার সুমনার দিকে তাকিয়ে আবারও নিজের কাজে মন দেয় তনয়া। নিস্তেজ গলায় জবাব দেয়- ‘এখনই’

‘এতোকিছু করেছো কেন শুধু শুধু? শুধু তো ছেলে আসবে।’

হাত থেমে যায় তনয়ার। বড় করে একটা নিঃশ্বাস ফেলল।

‘যেন কেউ বলতে না পারে ননদকে হিংসা করে আয়োজনে কমতি রেখেছি।’

পাল্টা জবাব দিতে গিয়ে থেমে যায় সুমনা। ডাইনিং এ মিষ্টির প্যাকেট নিয়ে এসে মাত্রই দাঁড়িয়েছে মাহমুদ। মাহমুদ কে দেখে নিজেকে সংযত রাখলো সে। আবারও চলে যায় মুনিরার কাছে।

‘কতদূর হলো তনয়া? শামিম প্রায় চলে এসেছে। মিনিট দশেক হয়তো লাগবে।’

‘এইতো হয়ে এসেছে। মিষ্টি এনেছো তুমি?’

‘হুম’ মিষ্টির প্যাকেট নিয়ে রান্নাঘরের দিকে গেলো সে।

‘বলছি শুনো না, টেবিলের উপর ছোট ছোট নাস্তার প্লেটগুলো রাখা আছে সেগুলো একটু নিয়ে আসো না।’

মাহমুদ সেগুলো নিয়ে আসতেই তনয়া একে একে সবকিছু সাজাতে লাগলো। এইদিকে এতোটাই ডুবে গেলো ওইদিকে কড়াইয়ে যে পুলিপিঠা বেমালুম ভুলে গেলো।

পোড়া গন্ধ নাকে আসতেই হুড়মুড় করে গেলো ওদিকটায়। মেহেরুন্নেসাও রুম থেকে দৌড়ে এলো পোড়া গন্ধ পেয়ে।

‘জ্বালিয়ে পুড়িয়ে একদম শেষ করে দাও সবকিছু। মন থেকে কিছু করতে না চাইলে করতে যাও কেন? আমার মেয়ে যেহেতু আমি সবটা বুঝে নিতাম। আমরা কেউ জোর করেছি এসব করতে?’

তাড়াহুড়ো করে পিঠা গুলো তুলতে গিয়ে কড়াইয়ের সাথে হাত লেগে ফুটন্ত তেল এসে পড়ে তনয়ার হাতে।

হাতে ফুটন্ত তেল পড়তেই সে যেন এক মুহূর্তের জন্য শূন্য হয়ে গেল। প্রচণ্ড জ্বালা, তীব্র ব্যথায় পুরো শরীর কেঁপে উঠলো। মনে হলো, আগুনের শিখা সরাসরি তার ত্বককে গ্রাস করছে। জ্বালাপোড়া অনুভূত হতেই সাথে সাথে এক গগনবিদারী চিৎকার দিয়ে ওঠে সে।

‘ও মা গো!’

চোখ দিয়ে আপনা-আপনি পানি ঝরতে লাগলো। তনয়ার আর্তনাদ এতটাই প্রখর ছিলো সকলে রান্নাঘরের দিকে ছুটলো। মাহমুদ এসে আগলে নিলো তাকে। কল ছেড়ে তনয়ার হাতে পানি দিতে লাগলো অনবরত।

ব্যথার তীব্রতায় সে হাতটা ঝটকা দিয়ে সরিয়ে নিতে চাইলেও পারলো না। একটা অসহ্য ঝাঁকুনি ছড়িয়ে পড়লো সারা বাহুতে। চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি পড়ছে, কিন্তু সেটা কষ্টের না, নিছক যন্ত্রণা সহ্য করতে না পারার ফল।

গরম তেলের দাহ এখনো চামড়ার গভীরে ছড়িয়ে যাচ্ছে, যেন কেউ ধারালো কিছু দিয়ে টানতে টানতে খুঁচিয়ে দিচ্ছে পোড়া অংশটুকু।

মাহমুদের ঠান্ডা পানি দিয়ে ব্যথা কিছুটা কমানোর চেষ্টা করলেও, ক্ষতস্থান যেন জ্বলজ্বল করে জ্বলে উঠছে আরো বেশি। হাতের চামড়া লাল হয়ে ফুলে উঠছে ধীরে ধীরে। তনয়া ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে, তবুও চিৎকার চেপে রাখতে পারছে না। শব্দ গুলো কাঁপা কাঁপা হয়ে বের হচ্ছে—

“উফ… সহ্য করতে পারছি না!”

‘টুথপেষ্ট লাগিয়ে দে তাড়াতাড়ি। জ্বালাপোড়া কমবে।’

‘পোড়া জায়গায় এসব লাগানো নিষেধ আব্বা।’

‘তাহলে আমি ফার্মেসী থেকে গিয়ে মলম নিয়ে আসি।’

_____________

পোড়া জায়গায় বেশ যত্ন নিয়ে মলম দিয়ে দিচ্ছে মাহমুদ। কাঁদতে কাঁদতে তনয়ার চোখমুখ ফুলে উঠেছে। ক্ষতস্থানে যখনই আঙুলের স্পর্শ লাগছে তনয়া তখনই আর্তনাদ করে উঠছে।

‘ভালো হয়ে যাবে মা। কেঁদো না। এতো তাড়াহুড়োর কি আছে? দেরি হলে হতো। এখন যে কষ্ট পাচ্ছো?’

কলিং বেল বেজে ওঠে। তনয়া কাতরাতে কাতরাতে বলে,

‘তিনি বোধ হয় চলে এসেছেন। তোমরা আপ্যায়নের ব্যবস্থা করে ফেলো।’

সকলের মন নরম হলেও মেহেরুন্নেসার মন নরম হলো না তনয়ার অবস্থা দেখে। মুখ ভেঙচান তিনি। বিড়বিড় করে আওড়ালেন,

‘আর যেন কোনো কাজে হাত দিতে না হয় তাইতো এসব নাটক। সবই বুঝি। বয়স তো আর হাওয়ায় বাড়েনি।’

কথাখানি স্পষ্ট সকলেই শুনতে পেলো। সুমনা অবাক চোখে তার মায়ের দিকে তাকালো। এতটা পাষণ্ড হতে তার মাকে সে কখনো দেখেনি। তনয়ার তখনকার বলা কথার মমার্থ সে এখন বুঝতে পারলো। যে রাগ সে মনে চাপা দিয়েছিলো সে রাগ রূপ নেয় সহানুভূতিতে।

খালেকুজ্জামান চোখ গরম করে তাকালেন মেহেরুন্নেসার দিকে। চাপা স্বরে ধমকে উঠলেন তিনি,

‘মেয়েটার হাত পুড়ে গেলো কতখানি। এসব তোমার নাটক মনে হয়? একটু মানুষ হও। মানুষের মতো আচরণ করো।’

মেহেরুন্নেসার কথায় মনটা বিষিয়ে ওঠে তনয়ার। হাতের যন্ত্রণার থেকেও কথার আঘাতের যন্ত্রণা যেন প্রবল হয়ে উঠলো। ক্ষতের দিকে চেয়ে আপনমনে বলে উঠে,

‘হাত সুন্দর রাখতে গেলে ভালো বউ হওয়া যায় না। ভালো বউ হতে গেলে হাতের নমনীয়তা থাকে না। আমি আমার ক্যারিয়ার বিসর্জন দিলাম। হাতের নমনীয়তাও হারালাম। তারপরও ভালো বউ হতে পারলাম না।’

#চলবে

#সংসার_সমরাঙ্গন (১৪)
রূপন্তি রাহমান (ছদ্মনাম)

ঝলসে যাওয়া হাত নিয়েই ওঠে চলে যায় তনয়া। বিষাক্ত মানুষগুলোর সাথে থেকে মনের যন্ত্রণা বাড়ানোর বিন্দুমাত্র ইচ্ছে তার নেই। হাতের যন্ত্রণা কিছুক্ষণ পরেই সেরে যাবে কিন্তু মনের যন্ত্রণার ভার বয়ে বেড়াতে হবে আজীবন।

‘ভালো সন্তান হতে গিয়ে ভালো স্বামী হতে পারলাম না। বউয়ের চোখে তো অপরাধী। নিজের চোখেও নিজে অপরাধী আমি। আমি যে স্বয়ং আল্লাহর কাঠগড়ার আসামী।’

‘বউয়ের কথায় ওঠবস করা মানুষ তুই। ভালো স্বামীদের তালিকা করলে তো এক নম্বরে তোর নাম থাকবে।’

কথা পিঠে বাড়ায় না মাহমুদ। পুনরায় কলিং বেল বাজতেই সে সদর দরজার দিকে এগিয়ে গেলো।

‘তোমার সমস্যা কি জানো আম্মা? সময় এবং পরিস্থিতি কিছুই তুমি বুঝতে চাও না। বেখাপ্পা একটা বলে বসো। সারাদিন মেয়েটার খাটুনির পর তোমার এই কথাগুলো বলা সেজেছে তনয়াকে?’

‘খেয়েছে! তোর মাথাটাও চিবিয়ে খেয়েছে!’

সুমনা চোখ রাঙানি দেয়। চাপা স্বরে ধমকে উঠলো সে।

‘বাজে বকা বন্ধ করে আপ্যায়নের ব্যবস্থা করো।’

‘ব্যবস্থা তো করতে হবেই। একজন তো আপ্যায়ন করতে হবে বলে হাত পুড়িয়ে বসে আছে। সবই বুঝি। চুলে তো এমনি পাক ধরেনি।’

সুমনা আরো কিছু বলবে তার আগেই দরজা খুলে দেয় মাহমুদ। সেই শব্দে দুজনেই দ্রুত পায়ে ভেতরে চলে গেলো। এখনই হাতে হাতে সবটা গুছিয়ে ফেলতে হবে। নয়তো সামলাতে পারবে না।

______________

‘তোমার কথা ভীষণ মনে পড়ছে আম্মা।’

ফোস্কা পড়া হাতের দিকে চেয়ে কথাখানি বলে তনয়া। কানে তার মোবাইল ঠেকানো। চোখ দিয়ে অঝোর ধারা বইছে। গলায় ভারী কষ্টের সুর।

হাতের ফোস্কা ব্যথায় জ্বলে ওঠে। জ্বলার তীব্রতায় চোখ কুঁচকে বন্ধ করে নেয় সে। ভেসে আসে ফোনের ওপাশ থেকে পরিচিত স্নেহমাখা কন্ঠস্বর।

‘হাতের বেশখানিকটা জায়গায় তো তেল পড়েছে রে মা।’

তনয়া নীরব থাকে। নাজমা বেগম পুনরায় বলেন,

‘ক’টা দিন এসে থেকে যা না। সেই যে গেলি আর এলি না।’

‘যাবো মা যাবো। কতদিন হয়ে গেলো তোমার কোলে মাথা রেখে ঘুমাই না। তোমার কাছে গিয়ে একটু শান্তির ঘুম ঘুমাতে চাই।’

দরজা ঠেলে রুমে ঢুকে মাহমুদ। তনয়া কে কাঁদতে দেখে দ্রুত পায়ে এগিয়ে এলো।

‘কান্না করছো কেন? হাত বেশি জ্বলছে?’

মাহমুদ হাতটা ধরতে গেলে তনয়া হাত সরিয়ে ফেলে। তখনই টান পড়ে হাতে। ব্যথায় চোখ মুখ কুঁচকে ফেলল সে।

‘পরে কথা বলবো মা। এখন রাখছি।’

‘মায়ের সাথে কথা বলছিলে?’

‘যার সাথেই সেটা তোমাকে বলার প্রয়োজন মনে করছি না।’

মাহমুদ চুপসে যায় একদম। মলিন হয় তার মুখ।

‘ রাগ করেছো নাকি অভিমান?’

মাহমুদের দিকে তাকিয়ে তাচ্ছিল্য হাসে তনয়া।

‘যার প্রতি অনুভূতি থাকে মানুষ তার উপরই রাগ আর অভিমান করে। তোমার প্রতি আমার সমস্ত অনুভূতি আজ মৃ*ত প্রায়। তাই কিছু বলতে পারছি না।’

মাহমুদ চমকে উঠে। হতবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে তনয়ার চোখের দিকে। সেই চেনা চোখজোড়া আজ যেন একেবারে শূন্য। কোনো প্রেম নেই। কোনো আবেগ নেই। এক নিঃসঙ্গ সাগরের মতো গভীর, অথচ অনুভূতিহীন।

একসময় যে চোখের ঝলক তার হৃদয় কাঁপিয়ে দিত। আজ সেখানে শুধুই শীতল নির্লিপ্ততা। মাহমুদের ভেতরটা কেমন যেন হিমশীতল হয়ে আসে। এতটা শূন্যতা কি সত্যিই সম্ভব? এর জন্য কি কেবল সে দায়ী? কতগুলো প্রশ্ন তার মাথায় ঘুরপাক খায়।

‘ভালোবাসা বুঝি ধীরে ধীরে ঘৃণায় রূপ নিচ্ছে?’

‘সেই প্রশ্নটা আমাকে না করে বরং নিজের বিবেককেই করো না।’

মাহমুদ তপ্ত শ্বাস ফেলে।

‘বিবেকের কাঠগড়ায় ফাঁ*সি*র আসামি আমি। বিবেককে প্রশ্ন করার সাহস আমার নেই।’

‘মাহমুদ আমি না হাঁপিয়ে ওঠেছি। যে বিশ্বাস আর ভরসা নিয়ে তোমার হাতটা আমি ধরে ছিলাম। সে বিশ্বাসের মর্যাদা তুমি রাখতে পারোনি। রক্ষা করতে পারোনি সম্পর্কের সমতা। কারণে অকারণে কেউ না কেউ আমায় হেনস্তা করেছে। মানসিক অত্যাচার করেছে। সেই রোষানল থেকে আমায় বাঁচাতে পারোনি তুমি।’

মাহমুদের মাথা নিচু হয়ে যায়। একরাশ হতাশা আর অপরাধবোধ যেন ওকে চেপে ধরে। কথাগুলো এখনো কানে বাজছে। বুকের ভেতর গভীর এক শূন্যতা সৃষ্টি করছে। সে বুঝতে পারে, তার কোনো কথা বা ব্যাখ্যাই এই মুহূর্তে অর্থহীন।

অনুশোচনার ভারে নুয়ে পড়া মাহমুদ কে দেখে ভীষণ মায়া হয় তনয়ার। এই মানুষটাকে সে ভালোবাসে। ভীষণ ভালোবাসে। এই ভালোবাসার জেরেই চুপচাপ থাকে সে। অভিমান একটু হালকা হতেই প্রসঙ্গ বদলাতে চায় তনয়া।

‘পাত্র কি চলে গিয়েছে?’

এপাশ ওপাশ মাথা দুলায় মাহমুদ।

‘মুনিরার সাথে আলাদা কথা বলছে।’

‘ওহ্!’

‘তোমার কথা জিজ্ঞেস করছিলো। বলে দিয়েছি তুমি অসুস্থ।’

‘ওহ!’

এরপর মাহমুদ আপনা-আপনি বলতে থাকে-

‘ শামিমের বাবা মা ওমরা করতে যাবেন। যদি ওদের দুজনের অসম্মতি না থাকে আমরাও সবকিছু ঠিকঠাক পাই হয়তো ওমরাহ তে যাওয়ার আগেই আক্‌দ করে যাবেন। সেখান থেকে ফিরে এসে ধীরে সুস্থে রিসিপশন হবে।’

এই প্রসঙ্গে তনয়া কথা বললো না। কি থেকে কি বলে ফেলবে আর কে শুনে নিবে পরে বাঁধবে লঙ্কাকান্ড। এর থেকে ভালো চুপ থাকা।

‘আব্বা যে মলম টা নিয়ে এসেছেন সেটা দিয়ে দেই?’

‘তার প্রয়োজন নেই। আমি দিয়েছি।’

‘তবুও একটু দিয়ে দেই?’

‘মাহমুদের চোখে চোখ রাখে তনয়া। এই চোখে অনুশোচনা, প্রেম আর আবেগ থাকলেও নেই প্রতিবাদের ভাষা।

‘চার দেয়ালের ভেতরে যে প্রেম টুকু দেখাও, চার দেয়ালের বাইরে প্রথম থেকেই যদি একটু প্রতিবাদ করতে তবে আজকের এই পরিস্থিতি তৈরি হতো না।’

‘হয়তোবা!’

মাহমুদ মলম নিয়ে এলো। মানা করা সত্বেও বেশ যত্ন করে আলতো হাতে ফোস্কা পড়া জায়গায় লাগিয়ে দেয়।

‘মায়ের দোয়া যেভাবে ঝড়ের গতিতে কবুল হয়। বদদোয়াও তেমন। আম্মা একটু অন্যরকম। ভেবেছিলাম প্রথম প্রথম তাই হয়তো তোমাকে মেনে আম্মার কষ্ট হচ্ছে। তাই বকাঝকা করে। একটু সময় দিলে সব ঠিক হয়ে যাবে। তোমার প্রতি মায়া জন্মাবে। সেই মুহুর্তে প্রতিবাদ থাক সামান্য কিছু বললেও হয়তো আরো ঘেঁটে যাবে সবকিছু। তোমার প্রতি বিরূপ একটা,,,,,

‘আমি ক’টাদিন একটু মায়ের কাছে যেতে চাই।’ -মাহমুদ কে থামিয়ে কথাখানি বলে তনয়া। মাহমুদের এই এক অজুহাত বার বার শুনতে শুনতে ভীষণ ক্লান্ত সে।

‘যেও তবে হাত খানা ভালো হওয়ার পরে।’

‘কেন?’

‘কেউ যেন বলতে না পারে অসুস্থ হয়েছো বলে বাপের বাড়ি পাঠিয়েছি তোমায়।’

‘এখানেই বা কেন থাকবো? পোড়া হাত নিয়ে রান্নাবান্না করে খাওয়ানোর পর কথা শোনার জন্য?’

‘এই হাত নিয়ে এক গ্লাস পানিও তুমি ঢেলে খাবে না। রান্না তো অনেক দূরের কথা।’

‘তোমার মা আর বোন কথা বানে আমায় পিষ্ট করার জন্য?’

‘সেটা বরং আমাকেই বুঝে নিতে দাও।’

__________________

‘তোর সত্যিই এই বিয়েতে অমত নেই তো?’ -তনয়ার মুখে ভাতের লোকমা তুলে দিয়ে মুনিরাকে প্রশ্নটা করে মাহমুদ।

মুনিরা এপাশ ওপাশ মাথা দুলিয়ে ‘না’ বলল।

‘তুই খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে বার বার একই প্রশ্ন কেন করছিস মেয়েটাকে?’ -নাক মুখ কুঁচকে প্রশ্ন করলেন মেহেরুন্নেসা।

‘যেন অমত থাকলে বলে দেয়। সংসারটা ও সারাজীবনের জন্য করবে। এক দু’দিনের জন্য নয়।’

‘কারন এটা নাকি তোর বউয়ের কথাটা প্রমাণ করার জন্য?’

‘এখানে আমাকে টানছেন কেন আম্মা? আমি তো বলেই দিয়েছি আমার ভুল ছিলো। ক্ষমাও চেয়েছি। আর কত কথা শুনাবেন?’

‘বলি কি আর সাধে!’ বলেই তিনি তনয়াকে পা থেকে মাথা পর্যন্ত আঁড়চোখে দেখেন। ভেংচি কেটে মনোযোগ দেন খাওয়ায়। বিড়বিড় করে আবারও আওড়ালেন,

‘হাত তো আমরা পুড়েছি। এতো ঢং তো কেউ করেনি। বউয়ের কাপড়ও ধুয়ে দেয়।’

কথাখানি কেউ শুনতে পেলো না। শুনলে হয়তো তনয়াই তেলেবেগুনে জ্বলে উঠতো।

‘সাধে বলেন না। তবে কেন বলেন আম্মা?’

‘আমি বলেই দিয়েছি ভাবি আব্বা আর ভাইয়া যা বলবে তাই হবে। ওদের সিদ্ধান্তই আমার সিদ্ধান্ত। তাহলে ভাইয়া বার বার কেন একই প্রশ্ন করে?’

‘সেটা তোমার ভাইয়াকে জিজ্ঞেস করো। বার বার সবকিছুতে আমাকে টানা হয় কেন?’

‘টানার মতো কাজ করেছিলে তাই টানা হয়।’

‘ শুনেন আম্মা, আমার চোখে যেটা লেগেছিলো সেটাই আমি বলেছিলাম। আমার শিক্ষা হয়েছে। মাফও চেয়েছি। ভালো চাইতে গিয়ে খারাপ হয়েছি। এখন তো আমায় কেউ খারাপেও পাবে না।’

‘এতো ভালো তো তোমায় কেউ চাইতে বলেনি।’

‘আহ্‌! চুপ করবে তোমরা? খেতে বসেও কি একটু শান্তি পাবো না?’

তনয়া চুপ হয়ে গেলো। মেহেরুন্নেসাও বিড়বিড় করতে করতে মনোযোগ দেন খাওয়ায়।

‘তোমার হাতের কি অবস্থা তনয়া? তিনদিন তো হলো। একটু কি ভালোর পথে?’

খালেকুজ্জামানের প্রতি তনয়ার অভিমানটা একটু বেশি। হয়তো তিনি বাবার মতো স্নেহ করেন বলে।

‘হাতের ফোস্কাটা ফুলে উঠেছে আব্বা। কাল ওকে নিয়ে ডাক্তারের কাছে যাবো। হাফ ডে করে চলে আসবো বাসায়।’

খালেকুজ্জামান তাকালেন তনয়ার দিকে। নিচের দিকে তাকিয়ে আছে সে। তিনি তপ্ত শ্বাস ফেলেন।

‘আরো আগেই নিয়ে যাওয়া দরকার ছিলো তোর।’

‘যেতে চেয়েছিলাম। তনয়াই তো গেলো না। এমনিই নাকি ভালো হয়ে যাবে।’

‘কাটাছেঁড়া আর পোড়া নিয়ে বসে থাকতে নেই। কাল দ্রুত ডাক্তারের কাছে চলে যেও।’

__________

পরদিন ডাক্তারের কাছ থেকে ফেরার পথে একটা লেখায় চোখ আটকে তনয়ার। তাড়াতাড়ি ব্যাগ থেকে মোবাইল বের ছবি তুলে নিলো সেটার। বাসায় ঢুকে বোরকাটাও খুলল না সে। হাতের ব্যাগটা রেখেই পা বাড়ালো খালেকুজ্জামানের রুমের দিকে।

‘কোথায় যাচ্ছো?’

‘আব্বার কাছে।’

‘অভিমান কমলো তবে? সে যাইহোক বোরকা তো খুলে যাও।’

‘বোরকা খোলার সময় নেই।’

দ্রুত পায়ে সে বেরিয়ে গেলো। টোকা দেয় খালেকুজ্জামানের রুমের দরজায়।

‘আব্বা আসবো?’

তনয়ার গলার আওয়াজে চমকালেন তিনি। সামলে নিয়ে নড়েচড়ে বসেন।

‘এসো।’

তনয়া ভেতরে ঢুকে। তনয়ার মুখের দিকে তাকিয়ে তিনি হাসলেন।

‘বাবার উপর থেকে অভিমানের পাহাড় সরলো তবে?’

অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে সে।

‘তেমন কিছুই না আব্বা।’

‘এমনি এমনি বুড়ো হয়ে যাইনি তনয়া। চোখ দেখলে সব বুঝি।’

‘সেদিনের প্রসঙ্গ নিয়ে আর কথা বলবো না পণ করেছি। তবে এতটুকু বলতে পারি আমি ভুল ছিলাম না।’

‘মুনিরার হাবভাবে এমন কিছুই চোখে পড়ছে না। ও তো বলল আমাদের মতামতই ওর মতামত।’

‘সেটা হলেই ভালো।’

‘আচ্ছা বাদ দাও সেসব কথা। কি বলতে এসেছো তুমি?’

তনয়া হাত মোচড়ামুচড়ি শুরু করে। কথাটা কিভাবে বলবে বুঝে উঠতে পারছে না।

‘ইতস্তত করছো কেন? যা বলার বলে ফেলো।’

‘আসলে আপনি কথাটা কিভাবে নিবেন।’

‘কিছুই মনে করবো না। তুমি বলো।’

‘গলির মাথায় একটা বড় সুপারশপ আছে না?’

‘হুম।’

‘ওটা বিক্রি হবে।’

‘তারপর?’

‘দোকানের মালামাল সহ পনেরো লাখ।’

‘এতো কম? জায়গা টা সহ?’

‘তা তো জানি না আব্বা। আমার কাছে মনে আপনাকে বলি। আপনি কথা বলে দেখেন না। আমি নাম্বার এনেছি। শপটার চাহিদা কিন্তু অনেক বেশি। আমরা যদি নিতে পারতাম।’

তারপর মিনমিন করে বলে, ‘সেদিন আপনি বলছিলেন না কিছু একটা করা দরকার ঘরে বসে না থেকে।’

খালেকুজ্জামান কিছু একটা ভাবলেন।

‘মন্দ বলোনি। বর্তমানে বাজারের যে অবস্থা। কিন্তু এতো টাকা কিভাবে ম্যানেজ করবো?’

‘আপনার ছেলে মাস শেষে আমায় হাত খরচের কিছু টাকা দেয়। মাঝে মাঝে ভাইয়াও পাঠায়। আবার বিয়ের আগের কিছু জমানো আছে। সব মিলিয়ে চার পাঁচ লাখ টাকা তো হবেই। আপনার ছেলে কে বললে হয়তো দিবে কিছু। কিন্তু সামনের মুনিরার বিয়ে ওকে টাকার কথা বলা যাবে না। আপনার পেনশনের থেকে কিছু টাকা নিয়ে যদি আমরা শপটা নেই?’

‘আমার পেনশনের টাকা? কিন্তু তনয়া আমি তো ওটা রেখেছি জমি কেনার জন্য। ভালো জমি পেলেই কিনবো বলে।’

‘মনে করেন ধার নিচ্ছি। শপটা নিয়ে দাঁড়াতে পারলেই প্রফিটের পুরো টাকা টা আপনার পেনশনের টাকায় আবার রেখে দিলাম।’

‘খারাপ বলোনি। তারপরও ভেবে দেখি।’

‘শপটা নিতে হবে এমনটা নয়। আমার কাছে মনে হলো এটা করলে ভালো হবে। আপনি মুরুব্বি মানুষ। আপনিও ভেবে দেখুন।’

তখনই কানে আসে মেহেরুন্নেসার গগনবিদারী চিৎকার।

‘হায় হায় রে কালনাগিনী ঘরে আনছে আমার ছেলে। তার নজর আমার স্বামীর পেনশনের টাকার উপর। আমার মেয়েটারে অপবাদ দিতে পারে নাই। এখন টাকার উপর হামলে পড়ছে।’

#চলবে