#সংসার_সমরাঙ্গন (১৮)
রূপন্তি রাহমান (ছদ্মনাম)
আজ মাহমুদের ভেতরে এক অদ্ভুত শূন্যতা। রাত গভীর, ঘর নিঃশব্দ—শুধু জানালা দিয়ে আসা হালকা বাতাস পর্দা দুলিয়ে দিচ্ছে। টেবিলের ওপরে রাখা সিগারেটের প্যাকেটটার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে সে। আজ সে সাহস করেছে, বহুদিনের দ্বিধা কাটিয়ে প্রথমবার বাবার নিষেধের দেয়াল ডিঙিয়েছে। কিন্তু এই বিজয়েও কোনো আনন্দ নেই, বরং যেন হারানোর গ্লানি জড়িয়ে আছে তার চারপাশে।
একটা সিগারেট ঠোঁটে চেপে আগুন ধরায় মাহমুদ। ধোঁয়ার কুণ্ডলী ধীরে ধীরে মিলিয়ে যায় শূন্যে। সে জানে, এই রাতের নিঃসঙ্গতা কেউ ভাগ করে নেবে না। রাত এভাবেই কেটে যাবে। সে সিগারেটে টান দেয়, আরও গভীরভাবে, যেন হারিয়ে যাওয়া সময়ের কাছে ফিরে যেতে চায়, ফিরে পেতে চায় সেই হারিয়ে যাওয়া মুখ। কিন্তু বাস্তবতা ততক্ষণে নিঃশেষ হওয়া সিগারেটের ছাইয়ের মতো
দশম বারের মতো তনয়ার নম্বরে ফোন লাগায় মাহমুদ। এবারেও রিং হয়ে কে’টে গেলো। মাহমুদ থামলো না। নতুন আরো একটা সিগারেট ধরিয়ে এলোমেলো আঙ্গুল চালিয়ে মেসেজ করলো,
‘ঠিকঠাক পৌঁছেছো? বেশি কিছু বলার দরকার নেই জাস্ট ইয়েস ওর নো বললেই হবে।’
ঠোঁটে পোড়া সিগারেট চেপে অপেক্ষার করে তনয়ার উত্তরের। কয়েক মুহুর্ত কেটে যাওয়ার পরও উত্তর এলো না। মাহমুদ অধৈর্য্য হয়ে পড়ে। আবারও ডায়াল করে তনয়ার নম্বরে। সাথে সাথে ভেসে এলো মেয়েলি কন্ঠস্বর-
‘দ্য নাম্বার ইউ হ্যাভ ডায়াল্ড ইজ কারেন্টলি সুইচড অফ। প্লিজ ট্রাই এগেইন লেটার।’
মোবাইল বিছানার উপর ছুঁড়ে মা*রে সে। হাতে অবশিষ্ট সিগারেট পায়ে মাড়িয়ে বিছানায় ধপাস করে শুয়ে পড়ে সেও।
চোখ বুঁজে বিড়বিড় করে আওড়ায়,
‘আমার কৃতকর্মের শাস্তি এভাবে দিও না তনয়া। দম বন্ধ হয়ে আসে আমার। তোমার নিঃসঙ্গতার নীরব প্রতিধ্বনিতে আমি হারিয়ে যাবো। যেমন অস্তগামী সূর্যের আলো শেষ বিকেলের আকাশে লুটিয়ে পড়ে।
____________________
প্রকট কড়া নাড়ার শব্দে ধড়ফড়িয়ে উঠে বসে মাহমুদ। খালেকুজ্জামান সজোরে দরজা ধাক্কাচ্ছেন। বার বার ডেকেও যখন মাহমুদের সাড়াশব্দ পেলেন না তখন তিনি আরো তেতে উঠলেন। হুঙ্কার দিয়ে বলেন,
‘তোমার রুম থেকে সিগারেটের গন্ধ আসছে কেন? তুমি সিগারেট খাচ্ছো? তুমি, তুমি আমার বাসায় বসে বসে সিগারেট খাচ্ছো? এই সাহস তোমায় কে দিলো? দেবদাস হতে চাইলে বাসার বাইরে যাও।’
মাহমুদ দরজা খুলেই হুমড়ি খেয়ে পড়লো খালেকুজ্জামানের পায়ের কাছে। যেন তার পায়ের কাছেই লুটিয়ে পড়েছে সমগ্র পৃথিবী। এমন দৃশ্যের জন্য প্রস্তুত ছিলেন না তিনি। চমকে উঠে দু’কদম পিছিয়ে গেলেন।
মাহমুদ ধীরগতিতে মাথা তুললো। তার ফাঁপা, দিশেহারা চোখের দিকে তাকাতেই খালেকুজ্জামানের বুকের ভেতর কেমন এক শূন্যতা নেমে এলো। মুহূর্তেই রক্ত শীতল হয়ে গেলো। এই মাহমুদ? এভাবে বিধ্বস্ত? কয়েক ঘন্টার ব্যবধানে একি হাল তার ছেলের? নিজের চোখকেও যেন বিশ্বাস হচ্ছে না।
‘আব্বা তনয়া আমার ফোন ধরছে না।’
সিগারেটের বোটকা গন্ধ নাকে আসতেই মুখ ঘুরিয়ে নিলেন খালেকুজ্জামান।
‘আব্বা ও কি আমায় সত্যি সত্যি ছেড়ে দেবে? আমার যে দমবন্ধ লাগে ভাবলেই।’
‘আগে ভাবোনি এমন একটা দিন আসতে পারে? সহ্যের একটা সীমা থাকে। মেয়েটা সেই সীমা অনেক আগেই পার করে ফেলেছে। প্রথম থেকে মেয়েটার ঢাল হয়ে দাঁড়ালে আজকের দিনটা আসতো না। পাগলামি করো না। তোমার সাথে এসব যায় না। ‘
মাহমুদ উদ্ভ্রান্তের মতো বসে রইলো। চোখ দুটি ফাঁকা দৃষ্টিতে স্থির। যেন সামনে যা আছে তা দেখেও দেখছে না। কপালের মাঝে ভাঁজ পড়েছে। ঠোঁটদুটো শুকিয়ে এসেছে। কিন্তু সে টেরও পাচ্ছে না।
তার আঙুলগুলো কাঁপছে অজান্তেই, অথচ শরীর একেবারে নিস্তব্ধ।
একটা ভারী শ্বাস ফেললো সে। বুকের ভেতর কী যেন জমাট বেঁধে আছে, অথচ তা উগরে দিতে পারছে না। ঠোঁট ফাঁক হলো। যেন কিছু বলবে। কিন্তু কোনো শব্দ বেরোল না।
‘তপুর বউ ফোন দিয়েছিলো আমায়। তনয়া ও বাসাতেই আছে।’
কাতর চোখে মাহমুদ এক পলক তাকায় খালেকুজ্জামানের দিকে। তিনি ফের বললেন,
‘আজকেই শেষ বারের মতো বলছি এই বাসায় থাকতে হলে এসব ছাইপাঁশ খাওয়া যাবে না। এসব খাওয়ার জন্য আমি রক্ত পানি করে তোমাদের বড় করিনি। আর খেতে হলে সারাজীবনের জন্য এ বাসা ছেড়ে যাও। দরজা খোলা আছে।’
_____________________
সময় গড়ানোর সাথে সাথে তনয়ার হাতের ক্ষতও ধীরে ধীরে শুকোতে শুরু করেছে। নাজমা বেগম সাবধানে তার হাত ধরে রাখলেন, যেন অল্পও ব্যথা না পায়। ক্ষতের চারপাশে নরম হাতে মলম লাগিয়ে দিচ্ছেন, আর সাথে সাথেই মুখ দিয়ে ফুঁ দিচ্ছেন, যেন একটুও জ্বালা না করে।
তনয়া চুপচাপ মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকে মায়ের দিকে। কপালে গভীর ভাঁজ, চোখেমুখে অদৃশ্য এক যন্ত্রণার ছাপ। যেন ব্যথাটা তার নিজের নয়, মায়ের। যেন এই ক্ষত শুধু হাতেই নয়, বরং কোথাও আরও গভীরে লেগেছে, যেখানে মা সবচেয়ে বেশি অনুভব করতে পারেন।
নাজমা বেগম আবারও ফুঁ দেন, আরও একটু যত্ন নিয়ে। তনয়া বুঝতে পারে, মায়ের এই নিঃশব্দ স্নেহই সবচেয়ে আশ্রয়দায়ক, সবচেয়ে মমতার।
নাজমা বেগম মেয়ের তাকিয়ে ঠোঁট প্রসারিত করলেন।
‘তোকে একটা প্রশ্ন করি?’
‘আমার বৈবাহিক জীবন সংক্রান্ত হলে না। অন্যকোনো ব্যাপারে হলে করতে পারো।’
নাজমা বেগম চুপ হয়ে গেলেন। মনোযোগ দিলেন আবারও হাতের দিকে।
‘কিছু বলছো না যে?’
মলিন হাসলেন তিনি। চোখজোড়ায় যেন আকাশসম দুঃখ ভেসে ওঠেছে।
‘নিষেধ তো করেই দিলি। আর কি বলবো?’
তনয়া কথা বাড়ায় না।
‘তুই বুদ্ধিমতী আমি জানি। বুঝেশুনে আর ভেবেচিন্তে চলিস। নিজের সংসারের ব্যাপারে আমায় কিছু বলবি মানলাম। কিন্তু আমি তো মা। আমি টেনশন হয় না?’
‘টেনশন করবে বলেই তো কখনো বলি না আর বলতে চাইও না।’
‘এখন কি কম টেনশন করছি?’
‘জানি না।’ তপ্ত শ্বাস ফেলে জবাব দেয় তনয়া।
‘তোর বাবা মারা যাওয়ার তোদের আঁকড়ে ধরে বেঁচে আছি। তোরা ওহ্! শব্দ করলেও আমার কলিজায় লাগে। সেখানে পোড়া হাত নিয়ে হুট করেই রাতে এসে উঠলি। নিষেধ করে দিলি কিছু যেন জিজ্ঞেস না করি। কেন? আমার কি অধিকার নেই জিজ্ঞেস করার? যখন তোর সন্তানও পোড়া হাত রাত-বিরেতে বাড়ি ওঠবে তখন বুঝবি কেমন লাগে।’
‘ওমন কথা বলো না মা। আমার মতো কপাল যেন আমার সন্তানের না হয়।’
‘ওরা তোকে অত্যাচার করে?’ -ভ্রুকুটি করে প্রশ্ন করলেন তিনি।
তনয়া চকিত হয়। আড়াল করতে চায় কিছু কথা। শারীরিক যন্ত্রণা না দিলেও মানসিক যন্ত্রণা জর্জরিত সে।
‘আমার কাছে তুই কিছু লুকাবি না। তোর কি মাহমুদের কথা কাটাকাটি হয়েছে নাকি বাকিদের সাথে? আমায় সত্যি বল। নয়তো আমি এখনই মাহমুদকে ফোন করবো।’
‘তুমি কাউকে ফোন করবেনা মা। ভেবে নাও মাহমুদ নামের কেউ কখনো তোমার মেয়ের জীবনে ছিলো না। আর আমায় কেউ অত্যাচার করেনি। শুধু জেনে রাখো তোমার মেয়ে কেবল শান্তি চায়। একটু শান্তির ঘুম চায়। কিছু জিজ্ঞেস করো না। তোমার মেয়ে তো তোমার কাছেই আছে। তুমি একটু আদর করো তাতেই হবে।’
তনয়া গুটিশুটি হয়ে মায়ের কোলে মাথা রাখলো।
‘একটু হাত বুলিয়ে দাও না।’
নাজমা খানিক হেসে মেয়ের মাথায় হাত রাখলেন। স্নেহমাখা হাতের স্পর্শ এঁকে দেন চুলের ভাঁজে ভাঁজে।
‘মা?’
‘হুম।’
‘ধরো আমি একটা বড় সিদ্ধান্ত নিলাম। তুমি আমার পাশে থাকবে?’
‘পাশে থাকা পরে মা। আগে দেখবো তোর নেওয়া সিদ্ধান্ত ঠিক নাকি ভুল।’
নীরব হয়ে যায় তনয়া।
‘আজকে কি নাস্তা বানাবো আম্মা?’
চট করে চোখ মেলে তাকায় তনয়া। চোখের সামনে মাতৃত্বের আলোয় দীপ্ত এক তরুণী। দুধে-আলতা গায়ের রং, গোলগাল মুখশ্রী, গভীর প্রশান্তিতে ডুবে থাকা চোখজোড়া। আট মাসের গর্ভসঞ্চার তার অস্তিত্বে এক অভূতপূর্ব জ্যোতি ছড়িয়ে দিয়েছে।
গায়ে হালকা হলুদ রঙের ম্যাক্সি, যার নিচে স্ফীত পেট স্পষ্ট। কপাল অব্দি টানা ঘোমটার আড়ালে মুখের রেখাগুলো মায়াময়। নাকে ছোট্ট নাকফুল, আলোয় ক্ষীণ স্বর্ণাভ ঝলক তুলে যেন মুখের কোমলতা আরও বাড়িয়ে তুলেছে। হাতে সোনালি রঙের চিকন চুড়ি, যা তার সামান্য নড়াচড়ায় টুংটাং শব্দ তোলে—এক গভীর শান্তির সঙ্গীত যেন। তার চলনে এক ধরনের ধীর স্থিরতা। যেন মাতৃত্বের ভার বুকের গভীরে ধারণ করে ধীরে ধীরে জীবনের দিকে এগিয়ে চলেছেন।
হলুদ রং তনয়ার ভীষণ অপছন্দের। এই রঙটা তার চোখে যেন কাঁটার মতো বিঁধে আসে। অথচ আজ… আজ যেন সবকিছু অন্যরকম লাগছে। সেই হলুদ আলো হয়ে উঠেছে কোমল, মৃদু উজ্জ্বল, এক রহস্যময় দ্যুতি যা কেমন করে যেন তনয়ার চোখ সরতে দিচ্ছে না। হলুদ রংটা যেন মেয়েটার গায়ে লেপ্টে গিয়ে পূর্ণতা পেয়েছে। মেয়ে? না, না বউ। লজ্জাবতী লতার ন্যায় নুয়ে থাকা বউ। যার চোখে সবসময়ই লেপ্টে থাকে ভয়। তনয়া মুগ্ধ হয়ে দেখে।
‘আজ ঝাল ঝাল কিছু বানাও না মা।’
‘ঝাল কি খাবি?’
‘কিমা পরোটা। বেশি করে ঝাল দিয়ে।’
‘গরুর গোশত আছে না ফ্রিজে?’
বাধ্য মেয়ের মতো মাথা নেড়ে সম্মতি জানায় রূপা।
‘তাহলে গরুর গোশত দিয়ে কিমা পরোটা বানিয়ে ফেলো।’
রূপা আবারও বাধ্য মেয়ের মতো নাড়ে।
‘ও কেন রান্না করবে?’
প্রস্থান করতে গিয়েও থেমে যায় রূপা।
‘ঘরের বউ রূপা। ও রান্না করবে না তো কে করবে?’
চট করে উঠে বসে তনয়া। কঠিন গলায় বলল,
‘তুমি করবে।’
‘এতোদিন তো আমি করলাম। আর কত? আমি বাবা আর পারবোনা।’
‘ভাবির এই অবস্থায়ও তুমি বলবে রান্না করতে?’
‘আমি না থাকলে কি করতো?’
‘তুমি না থাকলে কি করতো সেটা পরের কথা। মাথায় রেখো মা মেয়েটা যাকে পেটে বয়ে বেড়াচ্ছে সে আমাদের। আমাদের অস্তিত্বকে বয়ে বেড়াবে আবার গায়ে গতরেও খাটবে? কেন আম্মা? মেয়েটার কিসের এতো ঠেকা?’
‘যা বুঝিস না তা নিয়ে কথা বলিস না। এখন হাঁটাচলা আর কাজের মধ্যে থাকলে ওরই ভালো।’
তনয়া কথা বাড়িয়ে তর্ক করতে চাইলো না মায়ের সাথে। বিছানা ছেড়ে নামলো সে।
‘তোমার কিছু করতে হবে না ভাবি। আমি করবো সব। দাঁড়িয়ে থেকে আমায় শুধু দেখিয়ে দাও কোথায় কি আছে।’
তনয়ার কথাটা তেমন পছন্দ হয়না নাজমা বেগমের। মুখটা কালো করে ফেললেন।
‘এতোদিন পরে এসে তুই রাঁধবি কেন? তাও পোড়া হাত নিয়ে।’
‘এর থেকে বেশি অসুস্থতা নিয়েও হেঁশেল সামলেছি মা।’ মনে মনে আওড়ালো সে। নিজেকে সামলে নিয়ে বলল,
‘নিজের মেয়ের জন্য যতটা মায়া দেখাতে পারো পরের মেয়ের জন্য দেখাতো পারো না কেন আম্মা?’
নাজমা বেগম জবাব দিতে পারলেন না।
‘নিজের সন্তানের জন্য যতটা কোমল তোমরা। পরের সন্তানের জন্য ততটাই কঠিন। আসার পর থেকেই দেখছি সব। মা বাবা কি মেয়ে বিয়ে দেয় কেবল সংসারে এসে কলুর বলদের মতো খাটার জন্য?’
‘ওর সংসার। ও করবে না তো কে করবে?’
‘আর তোমার সংসার না?’
‘তো আমি এখনো কাজ করবো?’
‘আমি করছি সব। আপনারা ঝগড়া করবেন না।’
‘এই তুমি চুপ থাকো।’ ধমকে উঠলো তনয়া। লম্বা শ্বাস ফেলে ফের বলল,
‘সব সহ্য করে কেন? যেটা অন্যায় মনে হবে জবাব দিতে পারো না?’
‘তুই তোর ভাইয়ের বউকে শিখিয়ে দিচ্ছিস আমার সাথে ঝগড়া করার জন্য?’
‘হ্যাঁ, দিচ্ছি। ভাইয়ের মায়ের যদি তার ছেলের আট মাসের অন্তর্সত্ত্বা বউয়ের কষ্ট চোখে না লাগে তো কি করবো?’
রাগে ফোঁস ফোঁস করতে করতে মুখ ঘুরিয়ে নিলেন নাজমা বেগম।
‘আম্মা কে কিছু বলবেন না আপু। আমার তেমন কষ্ট হয় না। তাছাড়া এটা আমার সংসার। আমি না করলে কে করবে বলুন? আম্মার তো বয়স হয়েছে।’
‘তোমার সংসার তুমি করবে। ঠিক আছে। তবে পরিবেশ পরিস্থিতির উপরও অনেক কিছু নির্ভর করে। শ্বাশুড়ির জাত একটাও ভালো না। নিয়ম বানিয়ে রেখেছে এদের শ্বাশুড়ি এদের উপর অ*ত্যা*চার করেছে তাই এরাও এদের ছেলের বউয়ের উপর অ*ত্যা*চার করবে।’
‘আমি অ*ত্যা*চার করি?’
‘এটা শারীরিক অ*ত্যা*চার না হলেও মানসিক অ*ত্যা*চা*র। ভাবির এখন রেস্টের প্রয়োজন।’
নাজমা বেগম কটমট দৃষ্টিতে তাকালেন। তনয়া তোয়াক্কা করলো না সেই দৃষ্টির।
‘অন্য একজনের আদরের সন্তানের সাথে যেই ব্যবহারটা তুমি করো, তোমার আদরের সন্তানও তার শ্বশুরবাড়িতে সেই ব্যবহারটাই ফেরত পায়। সৃষ্টিকর্তা কোনো শূন্যস্থানই অপূর্ণ রাখে না।’
#চলবে
#সংসার_সমরাঙ্গন (১৯)
রূপন্তি রাহমান (ছদ্মনাম)
‘আম্মার সাথে ওভাবে না বললেও পারতেন আপু। আম্মার তো বয়স হয়েছে। কষ্ট পেলে বদদোয়া লেগে যাবে।’
তনয়ার দৃষ্টিতে যেন আগুন ঝরছিল। ক্ষোভ, অভিমান আর ব্যথার মিলিত শিখা। সেই তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রূপার বুকের ভেতর কাঁপন ধরিয়ে দেয়। এক মুহূর্তের জন্য মনে হয় পুরো ঘরটায় আগুন লেগে গেছে। বাতাস ভারী হয়ে উঠেছে তনয়ার নির্বাক তিরস্কারে। রূপা চেষ্টা করেও সেই দৃষ্টি সামলাতে পারে না। চোখ নামিয়ে নেয় আপনিই। যেন চোখ তুলে তাকালেই পুড়ে ছাই হয়ে যাবে। তনয়ার অনলশিখা তাকে গিলে ফেলবে সম্পূর্ণ।
মাংস কিমা করায় মনোযোগ দেয় তনয়া।
‘আমায় দিন আমি কিমা করে দিচ্ছি।’
তনয়া আবারও চোখ তুলে তাকাতেই রূপা সঙ্কুচিত হয়ে যায়। যেন চোখের দৃষ্টিতেই সে গুটিয়ে আসছে ধীরে ধীরে। তনয়ার চোখের আগুনের সামনে রূপার ভয়ার্ত মুখটা যেন নিষ্পাপ কোনো শিশুর মতো লাগছিল। অসহায়, দোষী না হয়েও অপরাধীর মতো।
তনয়া চাইলেও দৃষ্টি সরিয়ে নিতে পারলো না। রূপার গোলগাল মুখটায় এক ধরনের মায়া লেগে আছে। চেহারার প্রতিটি রেখায় যেন নরম করুণার ছাপ। রাগে-ক্ষোভে ফুঁসতে থাকা মনটাকে কিছুটা হলেও থমকে দেয় সেই মুখ। এক নিঃশ্বাসে পুরোটা দেখে নেয় সে। পায়ের আঙুল থেকে মাথার চুল পর্যন্ত। মনে মনে আওড়ায়, ‘ গাধাটা আস্তো একটা মায়ার সাগর নিয়ে এসেছে। একটু রাগও দেখাতে পারি না।’
এই সময়ে রূপার এমন আতঙ্কিত থাকা তার জন্য ক্ষতি। তনয়া নিজের ক্ষোভ সংযত করলো। স্বাভাবিক করার জন্য নিজেকে সামলে নিয়ে বলল,
‘মা যে তোমায় সারাক্ষণ দৌড়ের উপর রাখে তোমার খারাপ লাগে না?’
‘না।’
‘কেন?’
‘অনুগ্রহ করে মা বলে ডাকতে দেয় তাই বাকিসব আর গায়ে লাগে না।’
তনয়ার হাত মাঝপথেই থেমে যায়। মুহূর্তের জন্য যেন সবকিছু স্থির হয়ে যায় চারপাশে। স্তম্ভিত চোখে তাকাতেই দেখতে পায়, রূপার চোখ টলমল করছে জলকণায়, অথচ ঠোঁটের কোণে লেগে আছে এক চিলতে হাসি। হাসি আর কান্নার অদ্ভুত এক দ্বৈততা।
‘আম্মু মা-রা যাওয়ার পর আমি মনখোলে মা ডাকতে পারিনি। আমার দমবন্ধ লাগত। মনে হতো মা বলে ডাকতে না পারার হাহাকারে আমি হয়তো একদিন ম*রেই যাবো।’
‘বর্তমানে তোমার বাবার যে ওয়াইফ তাকে কি বলে ডাকো?’
‘আন্টি বলে। এতোবড় মেয়ের মা হওয়ার বয়স নাকি তার হয়নি।’
তনয়া তপ্ত শ্বাস ফেলে। মানুষ কত চাপা কষ্ট নিয়ে বেঁচে থাকে দিনের পর দিন। হাসির আড়ালে, কথার ফাঁকে, ব্যস্ততার ভিড়ে সেই যন্ত্রণা লুকিয়ে রাখে, যেন কিছুই হয়নি—যেন সব ঠিক আছে। অথচ বাস্তবতা ভিন্ন। কেউ জানতেও পারে না, একেকজন কতটা বেদনা নিয়ে প্রতিটা মুহূর্ত পার করে।
তনয়া অনুভব করলো রূপার চাপা যন্ত্রণা ছুঁয়াচে।যন্ত্রণার শীতল ছোঁয়া তার ভেতরেও শিহরণ জাগাচ্ছে। যেন এক অদৃশ্য অথচ গভীর বেদনার সুর ধীরে ধীরে তার হৃদয়ে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে। রূপার নির্বাক কষ্ট তাকেও গ্রাস করে ফেলছ।
মাতৃবিয়োগের শূন্যতা তনয়ার মনকেও আচ্ছন্ন করে ফেলল ক্রমশ।। পিতৃশোকের দগদগে ক্ষত আবারও নবীন হয়ে উঠলো। ঠিক যেন মৃত আগুনের নিচে লুকিয়ে থাকা উষ্ণ গনগনে ছাই নতুন করে জ্বলে উঠেছে। স্মৃতির পাতায় জমে থাকা কান্নার শব্দ আজ যেন সময়ের দেয়ালে ধাক্কা খেয়ে ফিরে আসছে, বুকের গভীরে তীব্র এক দীর্ঘশ্বাস হয়ে।
_____________________
‘এতোবড় কান্ড ঘটে গেলো আর তোমরা আমায় কিছু জানালে না?’
মেহেরুন্নেসার দিকে প্রশ্ন ছুঁড়ে সুমনা। তিনি জবাব দিলেন না। সে দিকে খেয়াল নেই তার। অধির আগ্রহে তাকিয়ে আছেন মাহমুদের রুমের দিকে। ছেলে কখন রুম থেকে হবে আর তিনি একটু দেখবেন।
‘মুনিরা না বললে তো কিছু জানতেও পারতাম না।’
মেহেরুন্নেসার দৃষ্টি অনুসরণ করে সুমনাও সেদিকে চাইলো। রাগে ফেটে পড়লো সে।
‘তোমায় আমি কিছু জিজ্ঞেস করছি আম্মা।’
সুমনার চিৎকারে চমকে ওঠে মেহেরুন্নেসা। যেন দূর কোথাও হারিয়ে গিয়েছিল তার মন, এক গভীর শূন্যতার অতলে। হঠাৎ করেই বাস্তবতায় ফিরে এসে সে বুঝতে পারে, সুমনা অনেকক্ষণ ধরে কিছু বলছিল। কিন্তু কোনো শব্দই মেহেরুন্নেসার কানে ঠিকভাবে পৌঁছায়নি।
তার চাহনিতে একধরনের বিমূঢ়তা—অবাক, বিভ্রান্ত আর শূন্য দৃষ্টিতে সে সুমনার দিকে তাকিয়ে থাকে।
‘কিছু বলছিলি তুই? আচ্ছা দেখ না ছেলেটা প্রতিদিন অফিস থেকে এসে দরজা আটকে বসে থাকে। কিছু খায়ও না। মনে হয় কতদিন ছেলেটাকে প্রাণভরে দেখি না। তুই একটু ডেকে বল না বের হতে।’
মায়ের উপর রাগ করবে নাকি সহানুভূতি দেখাবে, বুঝে উঠতে পারে না সুমনা। আসার পর থেকেই দেখছে, সবকিছু কেমন যেন এলোমেলো হয়ে আছে।
বাড়ির পরিচিত পরিবেশে অচেনা একটা শূন্যতা ভর করেছে। প্রতিদিনের মতো সবকিছু ঠিক থাকলেও কোথায় যেন তাল কেটে গেছে। মায়ের চোখে ক্লান্তির ছাপ আরও গভীর হয়েছে, মুখের অভিব্যক্তি শুকনো আর অন্যমনস্ক। ঘরের আসবাবগুলো যথাস্থানে থাকলেও যেন প্রাণহীন লাগে। পুরো বাড়িটাই যেন একটা চাপা নিস্তব্ধতার মধ্যে ডুবে আছে।
সবচেয়ে বেশি পরিবর্তন এসেছে মাহমুদের মধ্যে। আগে হাসিখুশি, প্রাণবন্ত ছেলেটা এখন যেন কেবল নিজের মাঝে গুটিয়ে গেছে। অফিস থেকে ফিরে দরজা বন্ধ করে রাখছে, কারও সঙ্গে ঠিকভাবে কথা বলছে না, খাওয়ার সময় পর্যন্ত বের হয় না।
সুমনার ভেতরটা কেমন অস্থির হয়ে ওঠে। এই পরিবেশ, এই নীরবতা—সবকিছু তাকে অস্বস্তিতে ফেলে। কিন্তু সবচেয়ে বেশি কষ্ট দেয় মায়ের সেই দৃষ্টি, যেখানে হতাশা, উদ্বেগ আর নিরব আর্তনাদ একসঙ্গে মিশে আছে।
সে বোঝে, মায়ের মনে ঝড় বয়ে যাচ্ছে, কিন্তু প্রকাশ করতে পারছেন না।
মেহেরুন্নেসা চুপচাপ মাহমুদের দরজার দিকে তাকিয়ে থাকেন, যেন সে বের হবে, একটুও চোখের সামনে আসবে।
শার্টের হাতা গুটাতে গুটাতে রুম থেকে বের হয়ে এলো মাহমুদ।
মাহমুদ দরজা খুলে দাঁড়াতেই সুমনা হতভম্ব হয়ে যায়। এ যেন সেই মাহমুদ নয়, যাকে সে চেনে!
উসকোখুসকো চুল এলোমেলোভাবে কপালে লুটিয়ে আছে, যেন বহুদিন চিরুনির ছোঁয়া পায়নি। গালে খোঁচা খোঁচা দাড়ি, যা মুখের ক্লান্তিকে আরও গাঢ় করে তুলেছে। চোখের নিচে কালি পড়ে গেছে, লালচে চোখজোড়া নিদ্রাহীন রাতের সাক্ষ্য বহন করছে। একসময় প্রাণবন্ত দৃষ্টি ছিল যেখানে, সেখানে এখন শুধুই ফাঁকা শূন্যতা।
গায়ের শার্টটাও কুঁচকে গেছে, হাত দিয়ে চুল এলোমেলো করে সুমনার দিকে তাকায় সে—একটা অবসন্ন, বিষন্ন দৃষ্টি। মুখে কোনো অভিব্যক্তি নেই, যেন নিজের মধ্যেই ডুবে আছে।
‘কখন আসলি আপা?’
প্রশ্নখানা সুমনার কান অব্দি পৌঁছালো না। ভাইয়ের এমন অবনতিতে বুকটা দুমড়েমুচড়ে যাচ্ছে তার।
‘তোর এই হাল কেন?’
চোখ ঘুরিয়ে নিজেকে দেখে নেয় মাহমুদ।
‘কি হাল? ঠিকই তো আছি। মা তো তার ছেলের এমন পরিনতিই চাইছিলো।’
মাহমুদ কে দেখে যে হাসিটা মেহেরুন্নেসার ঠোঁটের কোণে ঝুলছিলো তা যেন মুহুর্তেই মিলিয়ে গেলো। তিনি ছুটে গেলেন মাহমুদের কাছে।
‘আমার কথা শোন বাবা। আমি এমনটা কখনো চায়নি। তুই তনয়াকে কল কর। আমি কথা বলবো। তারপরও তুই এভাবে থাকিস না। আমি মা তো সন্তানের অধোগতি দেখলে যে সহ্য করতে পারি না।’
‘ভাবিয়া করিও কাজ করিয়া ভাবিও না।’ বলে থামলো মাহমুদ। পুনরায় বলল,
‘কল দিয়ে কোনো লাভ নেই মা।আমার জীবনে যা ক্ষতি হওয়ার তা হয়ে গিয়েছে।’
‘কিচ্ছু ক্ষতি হয়নি বাবা। মেয়েরা রাগ করে একটু আধটু বলে। তুই একটা ফোন কর না। আমি কথা বলবো। দরকার হলে মাফও চাইবো।’
‘কিজন্য মা? ও আসবে আবার অশান্তি হবে আবার চলে যাবে। এইভাবেই চলবে। তারচেয়ে ভালো,,,,
‘আম্মা এতোকরে বলছে তুই একটা ফোন করতে পারছিস না? নাকি তোর বউ,,
মাঝপথে সুমনাকে থামিয়ে দিয়ে বলে,
‘তনয়ার দোষ ধরা তোদের অভ্যাসে পরিনত হয়েছে নাকি? যাওয়ার পর থেকে যোগাযোগ নেই আমার সাথে। বন্ধ করে রেখেছে মোবাইল।’
বলেই সদরদরজার দিকে পা বাড়ায় সে। সুমনা প্রশ্ন করে,
‘এতোরাতে কোথায় যাচ্ছিস তুই?’
মাহমুদ পিছু ফিরে তাকালো। ঠোঁটের কোণে ফিকে হাসি ফোটে উঠলো তার। এরপরে জবাব দিলো,
‘যেথায় মনের শান্তি মিলে।’
#চলবে