সংসার সমরাঙ্গন পর্ব-২৫+২৬

0
1

#সংসার_সমরাঙ্গন (২৫)
রূপন্তি রাহমান (ছদ্মনাম)

‘কি করতে চাইছিস তুই?’—নাজমা বেগম কড়া গলায় প্রশ্ন ছুড়ে দিয়ে তনয়ার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকালেন।

তনয়া মুখ নিচু করে, থমথমে গলায় বলল,
‘হাসপাতালে যেতে চাই।’

নাজমা বেগমের কণ্ঠ যেন আগুনে জ্বালানি পড়ল,
‘কিসের টানে যাবি সেখানে?’

‘দায়িত্বের টানে।’ সংক্ষেপে জবাব তনয়ার।

‘তোর প্রতি সহনশীল হওয়াটা কি তাদের দায়িত্ব ছিল না? নয় মাস পেটে নিয়ে, একা হাতে মানুষ করে তোলার কোনো দাম ছিল না তাদের কাছে?’—চিৎকার করে ওঠেন তিনি।

তনয়া যেন মানসিকভাবে প্রস্তুত ছিল এসব কথার জন্য। তার মুখে একরকম স্থিরতা, নির্লিপ্ত চাহনি। কিন্তু পাশে দাঁড়িয়ে থাকা রূপা শিউরে ওঠে। ভয় ভরা চোখে তাকায় শ্বাশুড়ি নামক রণমূর্তি সেই নারীর দিকে।

‘আমাকে দায়িত্ব শেখাতে আসিস না।’—শান্ত কিন্তু কঠোর স্বরে বলল নাজমা বেগম।

‘বয়স এমনি এমনি বাড়েনি, আর চুলেও হাওয়ায় পাকা ধরেনি।’

নাজমা বেগমের গলা কেঁপে ওঠে। মুখটা কেমন নিস্তেজ হয়ে আসে। চোখ ভিজে যায় মুহূর্তেই।
পলক পড়তেই দু’ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ে গাল বেয়ে, ছুঁয়ে যায় চিবুক।

‘সে যেমন সন্তান পেটে নিয়ে কষ্ট সহ্য করেছে, আমিও করেছি।’-কাঁপা গলায় বললেন তিনি।

‘প্রসব যন্ত্রণা কেবল সে টের পায়নি, আমিও পেয়েছি। কেবল সে-ই নয়, আমিও আমার সন্তানকে বুকে জড়িয়ে নির্ঘুম রাত কাটিয়েছি। আমার সন্তান ফেলনা কিছু নয়। তার সন্তান যদি তার কাছে হিরে হয়, তবে আমারটাও ঠিক ততটাই দামি।’

একটু থেমে শ্বাস নেন তিনি। কণ্ঠে একরাশ অভিমান ও যন্ত্রণার গন্ধ।

‘আমি আমার মেয়েকে তার ঘরে পাঠিয়েছিলাম বউ করে, বলির পাঠা করে নয়। তাই বলে সে যা খুশি তা করবে? আর এখন? সেবার নাম করে আবার ফোন করেছে।’

‘ভুল ভাবছো। ওরা আমাকে যাওয়ার কথা বা গিয়ে সেবা করার কথা কিচ্ছু বলেনি। শুধু বলেছে,,,

নাজমা বেগম থামিয়ে দিলেন মেয়েকে। গলায় ঝরল দীর্ঘ অভিজ্ঞতার তিক্ত সুর,

‘তুমি আমার পেটে হয়েছো। আমি তোমার পেটে হইনি। কে কিসের জন্য আর কেন বলেছে—সবই বুঝি। ঘরের বউয়ের কানে এসব খবর আসে সেবার জন্যই।’

তনয়া এবার একটু এগিয়ে এসে মায়ের চোখের দিকে তাকিয়ে বলল,

‘বউ হয়ে আমি আমার দায়িত্ব অবহেলা করতে পারি না মা।’

নাজমা বেগম যেন আরও তেতে উঠলেন। চোখে আগুন, কণ্ঠে ক্ষোভের ঝড়। তনয়ার কথার প্রতিউত্তরে যেন দীর্ঘদিনের চেপে রাখা যন্ত্রণার বাঁধ ভেঙে গেল।

‘খবরদার তনয়া, তুই আমার সামনে দায়িত্বের বুলি আওড়াবি না! যখন কানে আসবে—মেয়ে শ্বশুরবাড়িতে ভালো ছিল না। ভালো থাকেনি কখনো। তখন এসব দায়িত্বের বুলি মুখ দিয়ে আসবে না। মা হওনি। আগে মা হও তখন বুঝবে আমার কষ্ট।’

ঘরে নিস্তব্ধতা নেমে এসেছে। তনয়ার মুখে অবিচল দায়িত্ববোধ আর নাজমা বেগমের ক্ষোভ—দুটো মিলে বাতাস ভারী করে তুলেছে। এমন সময় কোণায় দাঁড়িয়ে থাকা রূপা ধীরে ধীরে এগিয়ে এল। কণ্ঠে জড়তা, চোখে একরাশ উদ্বেগ।

‘আপুকে যেতে দিন না আম্মা। আন্টির অবস্থা সত্যিই খুব খারাপ।’ সে ভয়ে ভয়ে বলল।

নাজমা বেগম ঘুরে তাকালেন তার দিকে। মুখটায় তীব্র বিরক্তি। চোখে যেন আগুনের লেলিহান শিখা। দাঁত চেপে, গলা নিচু রেখে কিন্তু তীক্ষ্ণ সুরে বললেন,

‘আপুর সাগরেদ আপনি চুপ থাকেন। আজকাল আপনার আপু আপনার মাঝেও জ্ঞান বিতরণ করা শুরু করছে?’

এক মুহূর্তেই রূপা গুটিয়ে গেল। মাথা নিচু করে সরে দাঁড়াল। তনয়া চোখের ইশারায় রূপাকে চুপ থাকতে বলে।

হঠাৎই মাকে জড়িয়ে ধরল তনয়া। নাজমা বেগমের দৃঢ় শরীরের গাঁথুনিতে মুখটা চাপা দিয়ে মাথা রাখল তার নরম বাহুতে। যেন শৈশবের মতোই আবার একবার আশ্রয় চাইল সেই চেনা গন্ধের মাঝে। কণ্ঠটা খাদে নামিয়ে। থেমে থেমে বলল,

‘আমার সাথে তারা অনেক খারাপ করেছে মা।
তারা কখনো ছিল না সহনশীল, না দেখিয়েছে বিন্দুমাত্র সহানুভূতি। কিন্তু আমিও যদি তাদের মতোই আচরণ করি, তাহলে আমার আর তাদের মধ্যে পার্থক্যটা থাকবে কোথায়? এই শিক্ষা তো তুমি আমাকে দাওনি। তারা আমার প্রতি দায়িত্বশীল না হতে পারে। কিন্তু আমি পারবো না দায়িত্বজ্ঞানহীন হতে।’

একটু থেমে আবার বলল সে। কণ্ঠে এক অসহায় দৃঢ়তা,

‘আমার স্বামীর এখন যেরকম দিশেহারা অবস্থা, এই মুহূর্তে আমার এমন দূরে থাকা কতটা যৌক্তিক?
তার পাশে দাঁড়ানো কি আমার উচিত নয় মা?
এই পরিস্থিতিতে তো ওর আমাকে খুব প্রয়োজন।
তুমি কি বলছো—আমি যেন তার পাশে না থাকি? আমি কখনো তোমার জামাইয়ের চোখে চোখ রাখতে পারবো তো?’

তনয়া মায়ের মুখটা নিজের দিকে ফিরিয়ে আনল। চোখে তখন কান্নার টলমল জল, গলা কাঁপছে।

‘অনেক বছর পর আমি যখন শ্বাশুড়ি হবো আয়নায় নিজের মুখোমুখি হওয়ার আগেই মাথা নোয়াতে চাই না আমি। নিজের প্রতিবিম্বের দিকে তাকিয়ে যেন ভাবতে না হয় আমার কিছু কাজ ভুল ছিল।’

তনয়া থামে। টলমল করতে থাকা চোখজোড়ার পানি পলক ফেলার আগেই গড়িয়ে পড়ে।

‘একদিন বাঁচি বা একশো বছর, আজ যদি মাহমুদের মায়ের কিছু হয়ে যায় যে ক’টা দিন বাঁচবো নিজের কাছেই নিজে অপরাধী হয়ে যাবো। আমি বিবেকের কাঠগড়ায় আসামী হতে চাই না মা। তারা ভুল করেছে। তার অপরাধ করেছে। তাদের মতো করে আমিও অপরাধী হতে চাই না। অন্তত সেই জায়গা থেকে নির্দোষ থাকতে চাই। অন্তর্দহনে পুড়তে চাই না আজীবন।’

____________

ভোরের কুয়াশা ভেদ করে আলো যখন ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়ছিল চারদিকে, ঠিক তখনই হাসপাতালের নিস্তব্ধ করিডোরে পা রাখল তনয়া। তার সঙ্গে ছিলেন নাজমা বেগম, মুখে উদ্বেগের ছায়া আর চোখে একরাশ ক্লান্তি। রাতভর অনিদ্রার ক্লান্তিতে ভেঙে পড়া মাহমুদ সামনের চেয়ারে হেলান দিয়ে কখন যে চোখ বুজে ফেলেছিল, তা বুঝতেই পারেনি। হঠাৎ তনয়ার উপস্থিতি যেন নিঃশব্দ ঝড়ের মতো এসে আঘাত করল তাকে—চমকে উঠে চোখ মেলল সে। বিস্ময় ফুটে উঠল দৃষ্টিতে।

তনয়া পাশে গিয়ে বসতেই কৃতজ্ঞতায় নুয়ে পড়ে মাহমুদ।

‘আমার আম্মা ভালো নেই তনয়া। আজ তিনদিন হয়ে গেলো অবস্থার কোনো উন্নতি নেই। কোনো অভিযোগ রেখো না আম্মার প্রতি।’

তনয়া আইসিইউর সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। নিষ্পলক চোখে তাকিয়ে থাকে মেহেরুন্নেসার নিথর দেহটার দিকে। কোনো দম্ভ নেই। নেই কোনো তেজ। প্রান পাখি টা দেহে আছে কেবল এই যা।

‘ডাক্তার আর কিছু বলেনি।’

‘শুধু দোয়া করতে বলেছে।’

নাজমা বেগমের দিকে তাকায় মাহমুদ। নিস্তেজ গলায় বলল,

‘কেমন আছেন আম্মা?’

‘ভালো আছি বাবা।’

এটা বলে তিনি তনয়াকে ডাকলেন। তনয়া কাছে এলো। টিফিন ক্যারিয়ারের দিকে ইশারা করতেই সে মাহমুদের দিকে তাকায়।

‘রাতে মনে হয় কিছু খাওনি।’

মাহমুদ ম্লান হাসে।

‘খেয়েছি।’

‘মিথ্যে বলে কি লাভ? আমার কাছে মিথ্যে বলে তো সেই ধরাই পড়ে যাও।’

ঠোঁট কামড়ে ধরে মাহমুদ। ফুলে উঠে নাকের ডগা।ফাঁকা ঢোক গিলে বলে,

‘আম্মাকে ওমন দেখলে গলা দিয়ে খাবার নামে না।’

‘তুমি না খেয়ে থাকলে আম্মা সুস্থ হয়ে যাবে?’

এক চামচ খিচুড়ি মাহমুদের মুখের সামনে ধরে তনয়া।

চামচের দিকে ইশারা করে।

‘তাহাজ্জুদ পড়তে ওঠে আর ঘুমোয়নি মা। তোমার জন্য রান্না করেছে।’

নাজমা বেগমের দিকে তাকায় মাহমুদ। তিনি মৃদু হাসেন।

‘খেয়ে নাও বাবা। এভাবে না খেয়ে থাকলে তো তুমিও অসুস্থ হয়ে যাবে। আর চিন্তা করো না বেয়ান ঠিক আগের মতো সুস্থ হয়ে যাবে।’

কয়েক চামচ খাওয়ার পর থেমে যায় মাহমুদ।

‘তোমাকে কল করে জানানোর সাহস আমার হয়নি। তোমার সাথে যা হয়েছে তারপরে জানানো মানে,,,,,

মাঝপথে মাহমুদ কে থামিয়ে দেয় তনয়া।

‘এক কথা বার বার বলা বন্ধ করো তো। নিস্তেজ হয়ে পড়া থাকা মানুষটার প্রতি কোনো অভিযোগ নেই আমার। শুধু চাই তিনি ভালো হয়ে যাকে।’

কিছুক্ষন চুপ থেকে পুনরায় বলে,

‘মুনিরার খবর পেয়েছো কিছু?’

‘ফোন দিয়েছিলাম ওর নম্বরে। ফোন বন্ধ।’

‘যে ছেলেটার কথা বলেছিলাম?’

‘ওদের বাসায়ও কয়েকজন কে পাঠিয়েছিলাম। ওখানে নাকি তালা দেওয়া।’

‘ফোন নম্বর কালেক্ট করোনি?’

‘করেছি। সেটাও বন্ধ। আমার বোনটা অবুঝ। বয়স হলেও এখনো অনেক কিছু বুঝে না। আম্মার এই অবস্থা। ওর কোনো খোঁজ পাচ্ছি না। যাইহোক ও যেন সুস্থ থাকে এই দোয়াই করি। আর আপার সামনে তো মুনিরা নাম নেওয়াই যাচ্ছে না।’

‘শামীমদের কি বলেছো?’

‘মিথ্যে ছাড়া আর কি বলবো? ওতো দূরে বিয়ে দেবো না বলেছি।’

‘ওরা মেনে নিলো?’

‘আমরা মেয়ে বিয়ে না দিলে ওরা কি করবে? আর বিয়ে দেওয়ার জন্য তো মেয়ে লাগবে নাকি?’

‘ছুটি নিয়েছো?’

মাহমুদ মাথা দুলায়।

কথার মাঝেই ডাক্তার এসে দাঁড়ালেন। মাহমুদের দিকে তাকিয়ে এক গাল হেসে ঢুকে গেলেন আইসিইউ-তে। মাহমুদ তাড়াতাড়ি দরজার কাছে গিয়ে দাঁড়ায়, পেছনে পেছনে তনয়া।

ডাক্তার মেহেরুন্নেসাকে পর্যবেক্ষণ করেন—প্রেশার মাপেন, হৃদস্পন্দন শুনে নেন স্টেথোস্কোপে। তারপর হালকা একটা প্রশান্তির হাসি ফুটে ওঠে তাঁর মুখে।

বাইরে বেরিয়ে এসে বলেন, ‘ভালো খবর আছে। পেশেন্ট আগের চেয়ে অনেকটা বেটার। রেসপন্স করছে।’

ঠিক তখনই এক নার্স এসে জানান, ‘পেশেন্টের সেন্স ফিরে এসেছে, ডাক্তার।’

মাহমুদের বুক থেকে যেন এক পাহাড় সরে যায়। চোখ ছলছল করে ওঠে।

‘আমি একটু আম্মার সাথে দেখা করতে পারবো?’

‘অবশ্যই। তবে নয়েজ করা যাবে না।’

‘না না, আমি খুব শান্ত থাকব।’

মাহমুদ নিঃশব্দে আইসিইউ-তে ঢোকে। মেহেরুন্নেসার চোখদুটি আধা খোলা, পিটপিট করছে। ‘আম্মা’ বলে ডাকতেই তিনি তাকানোর চেষ্টা করেন। ছেলেকে দেখে ঠোঁটের কোণে এক অতি মৃদু হাসি ফুটে ওঠে।

কাঁদতে গিয়েও নিজেকে সামলায় মাহমুদ।

‘তুমি আবার আগের মতো হয়ে যাবে, আম্মা। আমরা সবাই আছি তোমার পাশে।’

মেহেরুন্নেসা ডান হাত তুলতে চাইলেন, কিন্তু ব্যর্থ হলেন। একপাশ এখনো নিস্তেজ।

‘নড়াচড়া করো না আম্মা।’ বলে মাহমুদ এগিয়ে আসে আরও একটু।

মেহেরুন্নেসা ঠোঁট নাড়িয়ে কিছু বলতে চাইলেন।

‘কিছু বলবে?’

তিনি পলক ফেলেন।

‘আপার কথা জানতে চাও?’

কোনো সাড়া নেই।

‘আব্বা?’

এবারও নিরুত্তর।

‘তনয়া?’

মেহেরুন্নেসা ধীরে পলক ফেলেন, সম্মতির ইশারায়।

‘ও এসেছে আম্মা। ভেতরে পাঠাবো?’

আবারও পলক ফেলে সায় জানান তিনি।

_________________________

মেহেরুন্নেসা তনয়ার সঙ্গে দেখা করতে চান—মাহমুদ কথাটা জানাতেই তনয়ার দৃষ্টি চলে যায় নাজমা বেগমের দিকে। তিনি হালকা করে হাসেন। মৌন সম্মতির ইঙ্গিত দেন।

তনয়া আর দেরি করে না। নিঃশব্দে পা বাড়ায়, ধীরে ধীরে আইসিইউর দরজার দিকে এগিয়ে যায়। একটুখানি থেমে নিঃশ্বাস নেয়, তারপর হালকাভাবে দরজাটা ঠেলে ভেতরে ঢুকে পড়ে।

নিশুতি কেবিনে তনয়া পা রাখতেই মেহেরুন্নেসার দৃষ্টির আড়মোড়া ভেঙে ধীরে ধীরে ঘুরে এল তার দিকে। তনয়া একটুকু হেসে এগিয়ে যায়, বিছানার পাশে দাঁড়ায়।

মেহেরুন্নেসার ঠোঁটের কোণে আবছা এক হাসি ফুটে ওঠে, কিন্তু চোখ জলে ভরে ওঠে মুহূর্তেই। কোটর বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ার আগেই তনয়ার আঙুল তা আলতো করে মুছে দেয়।

‘আপনি কাঁদছেন কেন? কাঁদলে তো শরীর আরও খারাপ হবে।’ শান্ত কণ্ঠে বলে সে।

মেহেরুন্নেসা ঠোঁট নাড়িয়ে কোনোভাবে উচ্চারণ করেন, ‘মাফ’ শব্দটা যেন ভেঙে পড়া এক দীর্ঘশ্বাস। এরপর আর কিছুই বেরোয় না মুখ থেকে।

‘মাফ করে দেবো?’—তনয়ার প্রশ্নে ক্ষীণভাবে মাথা নাড়েন তিনি।

‘আমি অত কিছু মনে রাখিনি। আপনি বরং তাড়াতাড়ি ভালো হয়ে উঠুন।’

মেহেরুন্নেসার চোখে অপরাধবোধের ছায়া গাঢ় হয়। সেই চোখেই ধরা পড়ে একরাশ কৃতজ্ঞতা। কিছু বলতে চান, বলতে পারেন না। যত কিছু জমে আছে বুকের ভিতর, অপারগতায় তা আর বের হয় না শব্দ হয়ে।

তনয়া শুধু পাশে থাকে—অভিমান ভুলে, ক্ষোভ পেরিয়ে।

অন্যদিকে মাহমুদ যেন উচ্ছ্বাসে ফেটে পড়ে। তিনদিনের জমে থাকা যন্ত্রণা, নির্ঘুম রাতের ক্লান্তি আর দুশ্চিন্তার ঘনঘটা—সব যেন হাওয়ায় মিলিয়ে যায় এক নিমিষে।

‘আম্মা, আমি নিশ্চিত তনয়ার জন্যই মা সাড়া দিয়েছেন। না হলে তিনদিন হয়ে গেল, কোনো উন্নতি ছিল না। তনয়া আসতেই মা চোখ মেলে তাকালেন, হাসলেন। সবটাই তনয়ার জন্য।’

শিশুসুলভ সেই বিশ্বাস আর আবেগঘন কণ্ঠে মাহমুদের কথা শুনে নাজমা বেগম কিছুক্ষণ নির্বাক থাকেন। এত সহজেই কীভাবে ছেলেটা সব কৃতিত্ব তনয়ার কাঁধে তুলে দিল। এমন সরল ভাবনায় তিনি অবাক না হয়ে পারেন না। মনের এক কোণে কোথায় যেন একটা নরম স্পর্শ লাগে।

এতসব ভাবনার মাঝে আবারও কানে আসে মাহমুদের উচ্ছ্বাস ভরা কন্ঠ,

‘আপা কোথায় তুই? তাড়াতাড়ি আব্বা কে নিয়ে আয়। আম্মা চোখ খুলেছে। তনয়া আসাতে আম্মা সাড়া দিয়েছে।’

___________________

নিঃশ্বাস ফেলারও সময় নেই যেন, হন্তদন্ত হয়ে দৌড়ে আইসিইউর সামনে এসে দাঁড়ায় সুমনা। পেছনে অনেকটা দূরে হাঁপাতে হাঁপাতে এগোচ্ছেন খালেকুজ্জামান।
সুমনা থামতেই হঠাৎ করেই তনয়াকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে। তনয়া চমকে ওঠে—এমন আচরণ একেবারেই অপ্রত্যাশিত। কিছু বুঝে ওঠার আগেই তার কাঁধে টুপটাপ গড়িয়ে পড়ে উষ্ণ জল।
আটকাতে গিয়েও থেমে যায় তনয়া। কাঁদুক! কাঁদলে মন হালকা হয়।

কিছুক্ষণ পর সুমনা আস্তে করে বলে,

‘আমি জানতাম তুমি আসবে।’

তনয়াকে ছেড়ে দিয়ে তাকায়। চোখেমুখে কৃতজ্ঞতার গভীর ছাপ।

একজন নার্স ভেতরে ঢুকতে যাচ্ছিল, ঠিক তখনই সুমনা হঠাৎই এগিয়ে এসে পথ আটকে দাঁড়ায়। গলায় অনুরোধের কাঁপা সুর, চোখে অস্থিরতা।

‘আমি কি… আমি কি আম্মার সাথে একটু দেখা করতে পারবো?’

নার্স একঝলক তার দিকে তাকায়। ব্যস্ত আর দায়িত্বশীল ভঙ্গিতে বলে,

‘দেখুন, পেশেন্ট কেবল রেসপন্ড করেছে। পুরোপুরি স্টেবল নয় এখনও। এভাবে বারবার দেখা করতে দিলে ওনার অবস্থার অবনতি হতে পারে। একটু সময় দিন, আমরা নিজে থেকেই জানাবো।’

সুমনা নড়াচড়া করে না। দাঁড়িয়ে থাকে নিঃশব্দে, যেন কথা বুঝলেও মেনে নিতে মন চাইছে না। সে ভাঙা গলায় আবারও অনুরোধ করে,

‘এক মিনিটের জন্য দিন… আমি একটা কথাও বলবো না। শুধু দেখেই চলে আসবো।’

তনয়া পাশে দাঁড়িয়ে আরও এগিয়ে এল। কণ্ঠে অনুরোধ, চোখে দৃঢ়তা।

‘উনাকে এক মিনিটের জন্য দেখা করতে দিন, দয়া করে। যেই পরিস্থিতির উপর দিয়ে গেছেন একটু দেখা না করলে পেশেন্টের পাশাপাশি উনিও অসুস্থ হয়ে পড়বেন।’

নার্স কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল। যেন কী ভেবে দেখছে। তারপর দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বলল,

‘আচ্ছা… ঠিক আছে। এক মিনিটের বেশি কিন্তু নয়। আর হ্যাঁ, ডাক্তার অনুমতি না দেওয়া পর্যন্ত এরপর কেউ ভেতরে ঢুকতে পারবে না।’

সুমনার চোখে জল চিকচিক করে ওঠে।

খালেকুজ্জামান এসে দাঁড়িয়েছেন মিনিট দেড়েক হয়। খালেকুজ্জামানকে দেখে তনয়া কিছু একটা ভেবে আবারও বলে,

‘একসাথে দুজন এলাউ করেন?

‘না, ম্যাম। দুজন নট এলাউড।’

তনয়া একটু থেমে বলল,

‘তাহলে আপা বের হলে? আব্বাকে একটু যেতে দিবেন আম্মার কাছে?’

নার্স একবার তনয়ার দিকে তাকাল, তারপর ফাইলের পৃষ্ঠা ওলটাতে ওলটাতে বলল,

‘স্যরি ম্যাম। অনুরোধ করেছেন বলে একজনকে এলাউ করেছি। এখন আর কাউকে পারবো না।’

খালেকুজ্জামান চমকে তাকালেন তনয়ার দিকে। কণ্ঠে কিছু বলতে চেয়েও থেমে গেলেন।
তনয়া নরম গলায় আবার বলল,

“পরে? উনি বের হলে?”

নার্স এবার একটু মাথা নোয়াল। গলায় একটু সহানুভূতির ছায়া।

‘রোগীর অবস্থা যদি স্টেবল থাকে, পরে ভিজিটিং টাইমে একজন যেতে পারবেন। এখন নয়। আমাদের কে তো পেশেন্টের কন্ডিশন আগে বিবেচনা করতে হয়। আশা করি বুঝতে পেরেছেন।’

‘থাক তনয়া, আমি না হয় পরে ভিজিটিং আওয়ারে যাবো। এখন বরং সুমনা যাক।’

তনয়া মনটা খচখচ করে। কেন যেন মনে হলো খালেকুজ্জামান একটু দেখা করলে ভালো ছিল। মেহেরুন্নেসার শারীরিক অবস্থার কথা ভেবে দমে গেল সে।

_____________________

সুমনা যায় মেহেরুন্নেসার সঙ্গে দেখা করতে। করিডোরে অপেক্ষমাণ খালেকুজ্জামান, তনয়া আর নাজমা বেগম। মাহমুদ কথা বলছিল অফিস থেকে আসা এক জরুরি ফোনে, কথা বলতে বলতে ধীরে ধীরে সে বেরিয়ে যায় বাইরে।

তনয়া এগিয়ে এসে বলল,
‘শুনেছি, আপনি নাকি নিষেধ করেছিলেন যেন আম্মার অসুস্থতার খবর আমাকে না দেওয়া হয়?’

খালেকুজ্জামান কিছুক্ষণ নিচের দিকে চেয়ে রইলেন। তারপর ধীরে ধীরে চোখ তুলে তাকালেন তনয়ার দিকে।

‘তোমার যেন মনে না হয় শুধু সেবা করানোর জন্যই খবর দেওয়া হয়েছে।’

তনয়া তৎক্ষণাৎ তার মায়ের মুখের দিকে তাকাল। নাজমা বেগম চোখ নামিয়ে ফেললেন। তনয়ার গলায় ভেসে উঠল নরম কণ্ঠস্বরের অনুশোচনা।

‘সেদিনের কথাগুলোর জন্য কি আমার উপর রাগ করে আছেন?’

এক ম্লান হাসি ছড়িয়ে পড়ল খালেকুজ্জামানের ঠোঁটে। তিনি হাত রাখলেন তনয়ার মাথার ওপর।

‘রাগ করিনি মা। তোমার কথায় তো মিথ্যে কিছু ছিল না। বরং তোমার জায়গায় আমি থাকলে হয়তো আরও কঠোর কিছু বলে ফেলতাম।’

আরও কিছু বলার আগেই পাশের কর্নার ঘুরে এসে হাজির হলো সোহেল।

‘আরে তনয়া! কখন এলে?’

‘সকালে।’

সোহেল নাজমা বেগমের দিকে তাকিয়ে সালাম করল,
‘আসসালামু আলাইকুম আন্টি। কেমন আছেন?’

নাজমা বেগম একগাল হাসি ছড়িয়ে বললেন,
‘ওয়ালাইকুমুস সালাম। আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি। তুমি কেমন?’

‘এই তো, আল্লাহর রহমতে মোটামুটি আছি।’

‘বাচ্চারা কোথায়?’

‘স্কুলে দিয়ে এসেছি দুজনকেই।’

‘আজ অফিস যাবে না?’ জানতে চাইলেন খালেকুজ্জামান।
‘তোমার তো অফিসের জন্যই তৈরী হয়েছিলে।’

সোহেল হালকা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
‘মনটা ভালো নেই, আব্বা। ভেতরে ভেতরে কেমন অস্থির অস্থির লাগছে। ফোন করে বলে দিয়েছি, আজ যাচ্ছি না।’

খালেকুজ্জামান উৎকণ্ঠা নিয়ে জিজ্ঞেস করলেন,
‘তোমার শরীর খারাপ নাকি?’

‘না না, তেমন কিছু না।’

এমন সময় আইসিইউর দরজা খুলে বেরিয়ে এল সুমনা। তার চোখে জল টলমল করছে।

সোহেল উদ্বিগ্ন গলায় প্রশ্ন করল,
‘আম্মা কেমন আছেন এখন?’

সুমনা একটুখানি থেমে, চোখ মুছে বলল,
‘ভালো নাকি খারাপ, জানি না সোহেল। তবে এতটুকুই জানি—আম্মা চোখ খুলেছে। এতেই আমার ভেতরের যন্ত্রণাটা একটু কমেছে।’

_________________

মেহেরুন্নেসার অবস্থার ধীরে ধীরে উন্নতি হচ্ছে। এই ছোট্ট আশার আলোই যেন স্বস্তির সুবাতাস হয়ে এসেছে সবার জীবনে। তিনদিনের টান টান উদ্বেগ, উদ্বিগ্নতা—সব যেন একটু একটু করে গলে যাচ্ছে। মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়েছে হালকা হাসির রেখা, ক্লান্তির ফাঁকেও দেখা দিচ্ছে প্রশান্তির ছায়া।

আইসিইউর সামনের করিডোরে সবাই একত্র হয়েছে। এমন সময় চেক-আপের জন্য একজন ডাক্তার চলে এলেন। দরজার কাছে এত মানুষ দেখে থমকে দাঁড়ালেন তিনি। চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে গলায় বিরক্তির সুর টেনে বললেন—

‘এখানে এত মানুষ এলাউ করল কে?’

মাহমুদ নরম গলায় জবাব দেয়,
‘আম্মাকে দেখতে এসেছে সবাই। এখনই চলে যাবে, স্যার।’

ডাক্তার আরেকবার তাকিয়ে বললেন,
‘দয়া করে এখানে এত ভিড় করবেন না। দুজনের বেশি এখানে অনুমতি নেই।’

এই কথাটি বলেই তিনি ভেতরে চলে গেলেন।

তনয়া সুমনার দিকে তাকিয়ে শান্ত গলায় বলল,
‘আপা, অনেক ধকল গেছে আপনার ওপর দিয়ে। বরং আপনি আব্বাকে নিয়ে বাসায় চলে যান। গিয়ে একটু বিশ্রাম নিন। বিকেলের দিকে আপনি এলেই হবে, আমি এখানে থেকে যাচ্ছি।’

সুমনা ইতস্তত করে। চোখে স্পষ্ট অনিচ্ছার ছাপ।

‘এই তো সবে বাড়ি থেকে এলাম… আমি বরং থাকি এখানেই।’

মাহমুদ সহমত জানিয়ে বলল,
‘তনয়া ঠিক বলেছে, আপা। এখানে সবাই থাকা ঠিক না। তুমি বরং আব্বাকে নিয়ে যাও। বিকেলে এসে আবার দেখো মায়ের অবস্থা।’

সোহেলও সায় দিল,
‘চলো, আমি তোমাদের বাড়ি পৌঁছে দিই। স্কুল ছুটির পর বাচ্চারাও বাড়িতে থাকবে, তোমার যাওয়া দরকার।’

অবশেষে সুমনা চুপচাপ উঠে দাঁড়াল। বাইরে গিয়ে একবার মেহেরুন্নেসার দিকে এক দৃষ্টিতে চেয়ে রইল। চোখে একটা ভার লেগেই আছে। খানিক পরে সে ধীরে ধীরে হেঁটে চলে গেল বাসার উদ্দেশ্যে।

ওদের সঙ্গে সঙ্গেই নাজমা বেগম বললেন,
‘আমারও এবার যাওয়া উচিত। রূপাটাকে একা ফেলে রেখেছি। এই অবস্থায় কে জানে কখন কী হয়।’

মাহমুদ এগিয়ে এসে বলল,
‘চলুন আম্মা, আপনাকে আমি এগিয়ে দিই।’

তনয়ার দিকে ফিরে আবার বলল,
‘তুমি বরং এখানেই থেকো। আম্মাকে সিএনজিতে উঠিয়ে আসছি আমি।’

_________________

হাসপাতালের করিডোরে এখন কেবল তনয়া আর মাহমুদ। চারপাশের কোলাহল থেমে গিয়ে যেন এক অদ্ভুত নীরবতা ঘিরে ধরেছে তাদের।

তনয়ার একটি হাত আলতো করে নিজের আঁজলে তুলে নেয় মাহমুদ। কণ্ঠে কৃতজ্ঞতার মৃদু সুর,

‘দিন কে দিন যে তোমার কাছে আমার ঋণের বোজা ভাড়ি হচ্ছে। এই ঋণ কীভাবে শোধ করতো বলো তো?’

তনয়া শান্ত গলায় বলে,

‘আপাতত শোধ করতে হবে না কিছুই। তুমি বরং আমার কাঁধে মাথা রাখো। চোখ-মুখের কী অবস্থা করেছো দেখেছো? একটু ঘুমাও।’

মাহমুদ নিঃসীম এক হাসি ছড়িয়ে দেয় ঠোঁটে,
‘আবারও ঋণ বাড়িয়ে দিলে।’

মাহমুদের কথায় হেসে ওঠে তনয়া। মাহমুদ অপলক চোখে তাকিয়ে থাকে সেই হাসির দিকে। যেন বহুদিনের কাঙ্ক্ষিত প্রশান্তি হঠাৎ করেই তার কাছে ধরা দিয়েছে, কোনো পূর্বঘোষণা ছাড়াই।

‘রাগ, অভিমান—সব এখনো আছে?’ জানতে চায় সে।

তনয়া ধীরে মাথা নাড়ে।

‘কমেনি বুঝি?’—মাহমুদের কণ্ঠে যেন একটু অপরাধবোধের ছায়া।

তনয়া মুখ ঘুরিয়ে বলে,

‘ সিকেয় তুলে রেখেছি আপাতত। আম্মা পুরোপুরি সুস্থ হয়ে উঠলে আবার কন্টিনিউ করব রাগটা।’

মাহমুদ হেসে ওঠে। সেই হাসিতে ক্লান্তি যেমন আছে, তেমনি আছে আশার ঝিলিকও।

‘তুমি ঘুমাও এবার, মাহমুদ। শরীরটাকে একটু বিশ্রাম দাও।’

শব্দহীনভাবে মাথা রাখে মাহমুদ তনয়ার কাঁধে। ভারী ক্লান্ত শরীর যেন একটু আশ্রয়ের সুযোগ পেয়েই আর পেছনে তাকায় না। চোখে এক অনন্ত ঘুম নামতে সময় নেয় না।

তনয়া তাকিয়ে থাকে সামনে—হাসপাতালের সাদা দেয়ালে, পলকা আলোর নিচে চকচক করতে থাকা ফ্লোরে, শূন্যতার দিকে। আচমকা চোখ পড়ে আইসিইউয়ের দরজার দিকে। এক নার্স দৌড়ে বেরিয়ে আসছে। চোখেমুখে উৎকন্ঠা তার। বুকটা মোচড় দিয়ে ওঠে তনয়ার।

কোনো কিছু না ভেবে হঠাৎ উঠে দাঁড়ায় তনয়া। মাহমুদের মাথা হেলে পড়ে, সে হকচকিয়ে উঠে বসে, হতভম্ব চোখে তাকিয়ে থাকে তনয়ার দিকে। তনয়ার আচরণ যেন তার ধরা-ছোঁয়ার বাইরের কিছু।

তনয়া আইসিইউর দরজার দিকে তাকিয়ে বলে ওঠে,

‘মাহমুদ, এসো তো এদিকে। আম্মা কেমন যেন করছে!’

সম্বিত ফেরে মাহমুদের। কোনো কথা না বলে সে ছুটে গিয়ে তনয়ার পাশে দাঁড়ায়।

ঠিক তখনই ডাক্তার হুড়মুড় করে ভেতরে ঢুকে পড়েন।

ছুটে এসে গম্ভীর কণ্ঠে বলে ওঠেন,

‘Code Blue!’

চারপাশে মুহূর্তেই শুরু হয় ছুটোছুটি। নার্স এসে মনিটরের তার চেক করে, আরেকজন বুকের উপর শুরু করে দ্রুত কম্প্রেশন। ডাক্তার গলা চড়িয়ে বলেন,
‘চিন আপ! অক্সিজেন বাড়াও! অ্যাড্রেনালিন রেডি করো। দ্রুত!’

সেই মুহূর্তে কেউ এসে ধরিয়ে দেয় ডিফিব্রিলেটরের প্যাড। ডাক্তার সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে বলেন,
‘Clear!’

একটা শক্তিশালী বৈদ্যুতিক ঝাঁকুনি ছড়িয়ে পড়ে মেহেরুন্নেসার নিথর শরীরে। বুক খানিকটা উপরে উঠে আবার পড়ে যায়। সবার দৃষ্টি আটকে থাকে মনিটরের স্ক্রিনে।

মাহমুদ ভেতরে তাকিয়ে দেখে—তার মা লড়ছে মৃত্যুর সঙ্গে, অথচ সাড়া দিচ্ছে না কোনো ডাকেই। সে ঠায় দাঁড়িয়ে আছে, দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে আসছে চোখে জমে থাকা জলে। তনয়ার শরীর আস্তে ধীরে ধীরে শীতল হয়ে আসছে। সময় যে ঘনিয়ে এসেছে তা আর বুঝতে বাকি রইলো না তার। চোখে জল, ঠোঁট কাঁপছে। খামছে ধরে মাহমুদের হাত।

‘দুলাভাই কে তাড়াতাড়ি ফোন করো তুমি।’

মাহমুদের মাঝে কোনো প্রতিক্রিয়া নেই। সমস্ত মনোযোগ কেবল মায়ের দিকে।

ডাক্তার আবারও বলেন,

‘Another shock—Clear!’

দ্বিতীয় শকে আর কোনো প্রতিক্রিয়া নেই।

‘One mg Atropine… push it now!’

একটি ইনজেকশন ঢুকে যায় শিরার গভীরে। কিন্তু সেই নিঃসঙ্গ মনিটর তখনও একটানা শব্দ তুলে চলেছে—সেই মৃত্যুর ঘোষণা দেওয়া হৃদয়বিদারক শব্দ।

ডাক্তার একবার তীব্র চাহনিতে সবকিছু পরখ করে নিয়ে, দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলেন।

চারপাশে নিস্তব্ধতা নেমে আসে। সমস্ত শব্দ যেন থেমে যায়। কেবল তনয়া দুলে ওঠে। তার ঠোঁট কাঁপে, কিন্তু শব্দ বেরোয় না। মাহমুদের হাতটা আরো শক্ত করে ধরে সে।

তীব্র অপরাধবোধ আর মেয়ের বিশ্বাস ভঙ্গের ভার আর বইতে পারলেন না। চোখ বুঁজেছেন চিরতরে। ইহজীবনের যুদ্ধ তার এখানেই সমাপ্ত।

#চলবে।

#সংসার_সমরাঙ্গন (২৬)
রূপন্তি রাহমান (ছদ্মনাম)

মায়ের মৃত্যুসংবাদ পেয়ে এক মুহূর্তের জন্য নিথর হয়ে যায় সুমনা। ক্রমশ হ্রাস পায় তার শরীরের শক্তি। আর কোনো শব্দ তার কানে যায় না। এইতো কিছুক্ষন আগেও মায়ের সাথে কথা বলে এলো। যার চিন্তায় তার এই অবস্থা কাঁপা কাঁপা স্বরে সেই মুনিরার কথা জিজ্ঞেস করলো। কয়েক মুহুর্তের ব্যবধানে তার মা আর নেই? আর ভাবতে পারে না সে। উন্মাদের মতো ছুটে বেরিয়ে যায় দিশাহীনভাবে। চোখ ছলছল, মুখে কেবল নিঃশব্দ আর্তনাদ। তার পিছু পিছু ছুটে সোহেল আর খালেকুজ্জামানও।

গাড়িতে উঠে সুমনা জানালার দিকে তাকিয়ে থাকে নিশ্চল, শূন্যদৃষ্টিতে। চোখ দিয়ে টলমল করে ঝরে পড়ছে জল, কিন্তু মুখটা পাথরের মতো শক্ত। বুকের ভেতরটা দপদপ করছে। বার বার কানে বাজছে একটা কথাই, ‘মা আর নেই।’ আজকের পর তার মায়ের সমস্ত অস্তিত্ব বিলীন হয়ে যাবে। ‘মা ছিল’ এই একটা বাক্যেই স্মৃতি আঁকতে হবে কেবল।

অবচেতন সুমনার নিঃসাড় দেহটা সোহেলের কাঁধে হেলে পড়ে আছে। হাসপাতালের করিডোরে কেবল পায়ের আওয়াজ, অক্সিজেন সিলিন্ডারের শব্দ আর আপনজন হারানোর তীব্র বিষাদ। আইসিইউ ঘরটার স্তব্ধতায় সব যেন এলোমেলো হয়ে গেছে।

খালেকুজ্জামান দাঁড়িয়ে আছেন নিঃশব্দে। তার চোখ দুটি যেন গভীর কোনো অতল থেকে উঠে আসা এক বিষণ্ন নীরবতা বহন করছে। সারা জীবনের সহচরী। শত বিরোধের মাঝেও যার পাশে থেকেছেন। তার এই বিদায় এতটা নিঃশব্দ হবে তা তিনি কল্পনাও করেননি। প্রানহীন মুখটার দিকে চেয়ে তার মনে হচ্ছিল মানুষটার সাথে তার আরো অনেক কথা বলা বাকি। অনেকটা পথ চলা বাকি।

মাথায় বাঁধা অক্সিজেন ক্যানুলা, বুকে লাগানো ইসিজি’র ইলেকট্রোড, আঙুলে লাগানো অক্সিমিটার এক এক করে সমস্ত যন্ত্র খুলে ফেলা হলো।

বিছানার পাশে স্তব্ধ হয়ে থাকা মনিটরের স্ক্রিনে আর কোনো কাঁপুনি নেই। একটানা সোজা লাইন। জীবন ও মৃত্যুর মাঝখানের যে রেখাটি এতদিন ধরে টলমল করছিল। তা এখন একটানা নিশ্চল। নার্স সেদিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। এসব দেখতে দেখতে অভ্যস্থ তারা। তবুও বুকের ভেতরটা খাঁ খাঁ করে। এইতো খানিক আগেও মানুষটার দেহে প্রাণ ছিল। তার নাম ছিল একটা। আর এখনই নামের সাথে যুক্ত হয়েছে আরেকটা নাম “লা*শ”।

স্ট্রেচারে করে মেহেরুন্নেসাকে বের করতেই পথ আগলে দাঁড়ান খালেকুজ্জামান। সাদা কাপড়টা সরিয়ে মেহেরুন্নেসার নিথর চোখেমুখে আলতো করে হাত ছুঁয়ালেন।

‘সবাই তোমাকে নিয়ে হাজারটা অভিযোগ জানানোর পরও আমি তোমার হাত ছাড়িনি। সহ্য করেছি। আগলে নিয়েছি। তবে আজ কেন আমায় ছেড়ে সারাজীবনের চলে গেলে, মেহের? এটা যে অন্যায়।’

খালেকুজ্জামান বহুবছর পরে মেহেরুন্নেসাকে মেহের বলে ডাকলেন। কিন্তু মেহেরুন্নেসা সেই পুরনো দিনের মতো লজ্জায় আড়ষ্ট হলেন না। এতো কাছ থেকে বলা ‘মেহের’ ডাকটা তার কান অব্দি পৌঁছায়নি। আর কোনোদিন পৌঁছাবেও না।

____________

একে একে আত্মীয়রা এসে উপস্থিত হচ্ছেন। শেষবারের মতো মেহেরুন্নেসাকে দেখতে। বয়োজ্যেষ্ঠ কেউ কেউ খালেকুজ্জামানকে সান্ত্বনা দিচ্ছেন। কেউ বা চুপচাপ পাশে বসে আছেন। সুমনার পাশে কয়েকজন মহিলা বসে আছেন। বারবার জ্ঞান হারাচ্ছে সে। মায়ের এমন অবস্থায় আতঙ্কে ভেঙে পড়েছে নিশি। মায়ের হাত ধরে ডুকরে ডুকরে কাঁদছে।
ভিড়ের মাঝেই কেউ কেউ মুনিরার খোঁজ করছেন। আবার সুমনার পরিস্থিতি দেখে তার দিকেই মনোযোগ ফিরিয়ে নিচ্ছেন।

ড্রয়িংরুমের মাঝখানে মেহেরুন্নেসার দেহ রাখা হয়েছে। ধবধবে সাদা চাদরে ঢাকা তার শরীর। সিঁড়ি বেয়ে ওপরে তোলার ব্যাপারে অনেকেই আপত্তি জানিয়েছিলেন। নিচেই রাখার পরামর্শ দিয়েছিলেন। কিন্তু খালেকুজ্জামান আর মাহমুদের ইচ্ছার কাছে হার মানতে হয়।

মসজিদ থেকে খাটিয়া এসে গেছে। শেষ গোসলের ব্যবস্থাও সম্পন্ন। এখন আবার মেহেরুন্নেসাকে নিচে নামাতে হবে গোসলের জন্য। বাদ আসর জানাজা।
একজন আত্মীয় সোহেলকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠলেন,
‘জামাইবাবা, গাড়ির ব্যবস্থা করলা? ভাবিকে তো এখানকার জানাজার পরে বাড়িতে নিতে হবে।’

সোহেল কিছু বলার আগেই খালেকুজ্জামান মুখ খুললেন,
‘মেহেরুন্নেসাকে এখানকার কবরস্থানে দাফন করা হবে।’

‘কিন্তু ভাই আমাদের তো পারিবারিক কবরস্থান আছে।’

‘এইখানে রাখলে আমি সকাল-বিকেল ওর কবর জিয়ারত করতে পারবো। বাড়িতে দাফন করলে সে সুযোগ হবে না।’

সোহেল নিঃশব্দে একপাশে সরে আসে। চারপাশের কান্না আর হাহাকারের ভিড়ে নিজেকে সামলে রাখতে চেষ্টা করে সে। মেহেরুন্নেসার আকস্মিক বিদায়ে তাকেও ভেতরে ভেতরে কাঁপিয়ে দিচ্ছে। তবুও পরিস্থিতি সামলাতে হবে। সে পকেট থেকে মোবাইলটা বের করে। গলায় জমে থাকা ভারটা গিলতে গিলতে ফোন করে মাহমুদের বন্ধু নোমানকে। বন্ধুর মায়ের মৃ*ত্যুর খবরে কেমন ছুটে চলে এসেছে। নোমান আর ইফাদকে কবরস্থানে পাঠিয়েছে। সব কিছু ঠিকঠাক আছে কি না দেখতে। জায়গা প্রস্তুত কিনা তা নিশ্চিত করতে। দায়িত্বের খাতিরে কথা কয়টা বললেও ফোন কেটে রাখার পর দাঁড়িয়ে থাকে কিছুক্ষণ নিস্তব্ধ, নিঃশব্দ। বুকের ভেতরটা ভার হয়ে আসে। কিন্তু চোখের জলটা সে বাইরে আসতে দেয় না। মুখে কঠোর এক ধরণের স্থিরতা নিয়ে ধীরে ধীরে ভেতরে ফিরে যায়।

________________

হাসপাতাল থেকে ফিরে সবচেয়ে নীরব রয়েছে মাহমুদ। যেন শোক নয়, কোনো অদৃশ্য ভার বুকের ওপর চেপে বসেছে। নিজের ঘরের বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে সে। রৌদ্রে ঝলমল আকাশের দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে। আকাশটা অদ্ভুতভাবে শান্ত। অথচ তার ভেতরটা যেন ঝড়বিক্ষুব্ধ।

তনয়া সারা বাড়ি খুঁজে অবশেষে এসে দাঁড়ায় বারান্দায়। নিঃশব্দে এগিয়ে গিয়ে মাহমুদের কাঁধে হাত রাখে সে। চমকে ওঠে মাহমুদ। পিছন ফিরে তাকাতেই দেখে তনয়ার চোখ ফোলা, নাকের ডগা লাল হয়ে আছে কান্নায়। সে থেমে থেমে হেঁচকি তুলছে, চোখের জল থামছেই না।

মাহমুদ কয়েক মুহূর্ত চুপচাপ তনয়ার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। যেন চোখ দিয়ে অনুভব করছে তার অনুভব। তারপর হঠাৎ অব্যক্ত যন্ত্রণা ফুঁড়ে উঠে বুক চিরে বেরিয়ে আসে।

তনয়াকে জড়িয়ে ধরে এক গগনবিদারী চিৎকার করে ওঠে মাহমুদ,

‘তনয়া, আমার মা আর নেই! আজকের পর আমি আর কখনও আম্মাকে দেখতে পাবো না। আম্মা বলে ডাকলে আর কেউ সাড়া দিবে না। আমার বুকটা যে আগুনে পুড়ছে। দম নিতে পারছি না তনয়া। দম নিতে পারছি না!’

তনয়া আরও জোরে কেঁদে ওঠে। সূর্য হেলে পড়েছে।বারান্দায় ছায়া নামে আর সেই ছায়ার নিচে দুজন মানুষ দাঁড়িয়ে থাকে। একজনের বুক ফেটে চিৎকার, আরেকজনের চোখ বেয়ে নেমে আসে নীরব কান্না।

মাহমুদের কান্নার আওয়াজ ভেদ করে যেন দেয়াল কাঁপে। সেই আর্তনাদ শুনে ভেতর দিক থেকে ছুটে আসে সুমনা। হাঁটার ভঙ্গিতে অস্থিরতা। চুলগুলো এলোমেলো হয়ে গাল ছুঁয়ে আছে। পাড় ভাঙা নদীর মতো তার চেহারায় ছড়িয়ে আছে বিমূঢ়তা।

সুমনাকে দেখামাত্রই তনয়াকে ছেড়ে দাঁড়ায় মাহমুদ। সুমনা এক পা এক পা করে এগিয়ে আসে মাহমুদের কাছে। ফোপাঁতে ফোপাঁতে লুটিয়ে পড়ে ভাইয়ের বুকে। ছোটভাই হয়ে বড় বোনকে আগলে নিলো ছোট্ট পাখির ছানার মতো।

‘মাহমুদরে আম্মা তো আসবে না রে। কারে আম্মা বলে ডাকবো রে ভাই?’

এরপর কানে আসে শুধু বুক চিরে বেরিয়ে আসা এক অসহায় কান্নার শব্দ। যা নিঃশব্দ ঘরকেও কাঁপিয়ে তোলে। আর হৃদয়ে দাগ কেটে যায় নিঃশ্বাসের মতো নিঃশব্দে।

দুই ভাইবোনের কান্নায় ঘরের বাতাস ভারী হয়ে ওঠে। নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হয় যেন। সেই কান্না ছড়িয়ে পড়ে চারদিকে। দেয়াল, মেঝে, জানালার ফাঁক গলে বাইরে পর্যন্ত।

এক এক করে আত্মীয়রা এসে জমা হতে থাকে ঘরে। কারও মুখে কথা নেই, চোখেমুখে শোকের ছায়া। সবাই দাঁড়িয়ে থাকে নিঃশব্দে। যেন শোকের ভার ভাষাকে গিলে ফেলেছে।

পেছনের দিকে চুপচাপ এসে দাঁড়ান খালেকুজ্জামান। মুখে কোনো অভিব্যক্তি নেই, চোখে গভীর একটা শূন্যতা। চারপাশের কান্নার সুর যেন তাকেও গলিয়ে দিচ্ছে নিঃশব্দে। তিনি শুকনো গলায় বলেন,

‘এভাবে তোমরা দুই ভাইবোন কাঁদছো কেন? তোমাদের আম্মার রুহ কষ্ট পাবে তো।’

সকলের দৃষ্টি সেদিকেই। খালেকুজ্জামানকে দেখে সুমনা আরো ভেঙে পড়ে। মাহমুদের কাছ থেকে সরে গিয়ে বাবার বুকে মাথা রাখে। কষ্ট লাঘবের আশায়। কষ্ট কমে না, বরং বুকের ভেতরটা আরও ভারি হয়ে ওঠে। সুমনা এখন একেবারে ছোট শিশুর মতো ফোঁপাচ্ছে।

খালেকুজ্জামান চোখের ইশারায় মাহমুদকে ডাকেন। দুই হাতে জড়িয়ে নেন তার দুই সন্তানকে। খানিক বাদে টের পান তার পাঞ্জাবি ভিজে যাচ্ছে চোখের জলে। নিজেকে সামলে নিয়ে মৃদু স্বরে বলেন,

‘কাঁদছো কেন তোমরা? মা চলে গেছে তো কি হয়েছে? বাবা তো আছিই। এভাবে কাঁদলে তোমাদের আম্মার রুহ কষ্ট পাবে।’

এই সময় ভিড়ের মধ্য থেকে এক ভদ্রমহিলা সম্ভবত খালেকুজ্জামানের দূরসম্পর্কের বোন। জিজ্ঞেস করে ওঠেন,

‘সবাইকে তো দেখলাম ভাই। তোমার ছোট মেয়েটাকে দেখছি না যে?’

সুমনা মুখ খুলতে যায়। কিন্তু মাহমুদ তার হাত চেপে ধরে। চোখে ইশারা করে চুপ থাকতে বলে।
সুমনা দমে যায়। কিন্তু উপস্থিত সকলের কৌতূহল বেড়ে যায়। আসলেই মুনিরা কোথায়?

পরিস্থিতি সামাল দেন নাজমা বেগম।
সুমনার মাথায় স্নেহভরে হাত রেখে শান্ত স্বরে বলেন,

‘সবাইকে একদিন না একদিন যেতে হয়, মা। কেউ আগে কেউ পরে। চলোএখন মায়ের গোসলের ব্যবস্থা করতে হবে। বেশি দেরি করলে চলবে না।’

সুমনা শক্ত করে বাবার পাঞ্জাবি আঁকড়ে ধরে। চাপা স্বরে ডাকে,
‘আব্বা…’

খালেকুজ্জামান কিছুক্ষণ ঠায় দাঁড়িয়ে থাকেন।
এই বয়সে এসেও আজ তার মনে হয়, তিনি একেবারে শূন্য। অনুভূতিহীন।

মুনিরার প্রসঙ্গ আপাতত চাপা পড়ে যায়।

খালেকুজ্জামান নরম গলায় বলেন,

‘চলো মা, তোমার আম্মার শেষ বিদায়ের আয়োজন করো।’

#চলবে