#সংসার_সমরাঙ্গন (২৮)
রূপন্তি রাহমান (ছদ্মনাম)
মেহেরুন্নেসার মৃত্যুর ছয় মাস পেরিয়ে গেছে। সময় থেমে থাকেনি। প্রতিদিনের জীবনযাত্রা চলেছে আপন নিয়মে। বাইরে থেকে সবকিছু স্বাভাবিক মনে হলেও আপনজন হারানোর যে গভীর ক্ষত, তার রক্তক্ষরণ এখনো থামেনি। নিঃশব্দে, অদৃশ্য যন্ত্রনায় প্রতিদিনই কাঁপে সকলের অন্তর।
এরই মধ্যে মাস খানেক হলো তনয়া একটি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে গেস্ট টিচার হিসেবে যোগ দিয়েছে। স্কুলটি তাদের বাসার কাছেই। তবুও প্রথমে সে দ্বিধাগ্রস্ত ছিল। শিক্ষকতা করবে কি না বুঝে উঠতে পারছিল না। জীবনের এক অস্থির অধ্যায়ে নিজেকে নতুন কোনো দায়িত্বে জড়ানো তার জন্য সহজ ছিল না। তবে মাহমুদ আর খালেকুজ্জামান অনেকটা জোর করেই তাকে রাজি করায়। তারা চায়নি তনয়ার মেধা ও শিক্ষা অকাজে নষ্ট হোক।
মাহমুদের শারীরিক চিকিৎসা প্রায় শেষ পর্যায়ে। ধীরে ধীরে সবাই নিজ নিজ জীবনে ব্যস্ত হয়ে উঠছে। কিন্তু এতকিছুর পর এতগুলো মাস পেরিয়ে যাওয়ার পরও মুনিরার কোনো খোঁজ মেলেনি।
ছুটির দিন আজ। তনয়ার হাতে কিছুটা ফুরসত। স্কুলে নেওয়া ক্লাস টেস্টের খাতা হাতে নিয়ে বসেছে সে। সাদাকালো খাতার পাতায় ছেলেমেয়েগুলোর ভুল-ভাল উত্তর দেখে মিটিমিটি হাসে সে।
আজ রান্নাঘরে ঢুকেছে খালেকুজ্জামান আর মাহমুদ নিজেরাই। দুজনেই স্বেচ্ছায় রান্নার দায়িত্ব নিয়েছে আজ। খানিক পরপর বাপ-বেটার চেচামেচি শোনা যায়। তেল মশলা বেশি হলো না কম হলো এসব নিয়ে। তনয়া ঠোঁট চেপে হাসে। মাঝে মাঝে ভাবতেই অবাক লাগে তার এই মানুষগুলোর সঙ্গে জীবন এত সহজভাবে এগিয়ে যাবে তা কি কোনোদিন কল্পনা করতে পেরেছিল?
ভাবনার মাঝেই বিকট শব্দে তার ফোন বেজে ওঠে। মোবাইল স্ক্রিনে “মা” নাম টা দেখেই বিস্তর হাসলো সে।
‘হ্যাঁ, মা বলো।’
তনয়া মোবাইলটা কানে ধরে জানালার ধারে এসে দাঁড়ায়। বাইরের আকাশে রোদ আর মেঘের লুকোচুরি চলছে। ঘরের ভেতরে হালকা মশলার গন্ধ। দূর থেকে ভেসে আসা বাপ-ছেলের কথাবার্তা সব মিলিয়ে এক শান্ত আর ভ্যাপসা দুপুর।
ওপাশ থেকে নাজমা বেগমের গলা ভেসে আসে।
‘কি করছিস তুই?’
‘পরীক্ষা নিয়েছিলাম। সেই খাতাগুলো দেখছি।’
তনয়ার কণ্ঠে ক্লান্তির হালকা ছায়া।
‘ক’টা দিন এসে থেকে যা না মা। বাবুর নাম রাখার পর যে গেলি তারপর আর তো এলি না।’
নাজমা বেগমের কণ্ঠে অভিমানের মৃদু ছোঁয়া।
‘এখন কি আর সেই সময় আছে মা?’ দীর্ঘশ্বাস ফেলল সে।
‘বড্ড সংসারী হয়ে গেছিস তাই না?’
আরো একটা দীর্ঘশ্বাস যেন ভেসে আসে ফোনের ওপাশ থেকে।
তনয়া ফিচেল করে হেসে ফেলে। জানালার বাইরে দৃষ্টি ফেলে বলে,
‘ভালো হউক বা মন্দ সে বিচারে যাবো না। কিন্তু সংসারের কর্তী তো তিনিই ছিলেন। সেই মানুষটাই নেই। শূন্যতা কাজ করে। আমি থাকলে বাবা-ছেলে দুজন একটু হাসিখুশি থাকে। ওদের একা রেখে কোথাও যেতে আমার সাহস হয় না।’
ওপাশে কিছুক্ষণ নীরবতা। তারপর ভেসে আসে মায়ের ভারী কণ্ঠ—
‘তোদের দুই ভাইবোনের সিদ্ধান্ত নিয়ে আমি কখনো কিছু বলিনি। জানি, তোরা সবসময় ভেবেচিন্তেই সিদ্ধান্ত নিস। সেদিন তুই যদি আমাকে না বোঝাতি, হাসপাতালে না যেতি তবে তোর সঙ্গে সঙ্গে আমিও আমার কাছে অপরাধী হয়ে যেতাম। বিবেকটা কুঁড়ে কুঁড়ে খেতো আমাকে। অপরাধবোধ নিয়ে বাঁচতে হতো।’
‘বাদ দাও এসব কথা। তোমার নাতি এখন কী করছে বলো।’
‘তোর বাবাজান আমাকে আর রূপাকে দৌড়ের উপর রেখেছে। মেয়েটা সবে গোসল করে এলো। কোলে নেওয়া মাত্রই বাথরুম করে দিলো। রূপা আবার গেল কাপড় বদলাতে।’
তনয়া এবার খিলখিল করে হেসে ওঠে।
‘অলস সময় কাটানোর দিন শেষ মা। এবার একটু দৌড়ের ওপরে থাকো।’
‘তনয়া! তনয়া! এইদিকে এসো। আমাদের রান্না শেষ। একটু চেখে দেখো তো কেমন হয়েছে।’
হাঁক ছেড়ে ডাকছেন খালেকুজ্জামান।
‘তোমার সাথে পরে কথা বলছি মা। এখন রাখছি।’
নাজমা বেগমের সাথে কথা শেষ করে তনয়া ডাইনিং টেবিলের কাছে যায়। খালেকুজ্জামান ছোট্ট একটা বাটিতে অল্প পরিমাণে মাংশ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন।
‘দেখো তো সব ঠিকঠাক আছে কিনা।’
তনয়া একটু তরকারি মুখে দিয়ে চোখমুখ বিকৃত করে ফেলে।
‘মজা হয়নি? লবন বেশি হয়েছে বুঝি?’
চোখ বুঁজেই মাথা ঝাকায় তনয়া। ধারণা সত্যি হওয়াতেই তেতে উঠলেন খালেকুজ্জামান।
‘সব তোর জন্য। কতবার করে বললাম লবন বেশি দিবি না। তারপরও লবনের পুরো কৌটা উল্টে দিয়েছে। অকর্মা জন্ম দিছি একটা। কোনো কাজ ঠিক করে করতে পারে না।’
‘তুমি পারো? তুমি এতো পারলে নিজে লবন দিলে না কেন? ওইদিকে নিজে যে ডালে পুরো হলুদের কৌটা ঢেলে দিয়েছো সে বেলায়? তুমি অকর্মা বলেই তো আমিও অকর্মা হয়েছি।’
বাবা- ছেলের ঝগড়া দেখে কপাল চাপড়ায় তনয়া।
খালেকুজ্জামান দাঁতে দাঁত পিষে বলেন,
‘বাপের মুখে মুখে তর্ক!’ বলে ছেলের দিকে তেড়ে যেতে নিয়েও থেমে যান তিনি। মুখটা ম্লান হয়ে আসে। চোখেমুখে ভর করে অসহায়ত্ব।
ব্যাপারটা নজর এড়ায় না তনয়ার। উৎকন্ঠা নিয়ে জিজ্ঞেস করে,
‘কি হয়েছে আব্বা?’
এগিয়ে আসে মাহমুদও।
‘আমার কথায় কি কষ্ট পেয়েছো আব্বা? আমি তো মজা করে বলেছি।’
তিনি ফিচেল হেসে দৃষ্টিপাত করেন সেই চেয়ারটায় যেখানে মেহেরুন্নেসা বসতেন।
‘আজকের এই মুহুর্তটা তো অন্যরকমও হতো পারতো। ওই চেয়ারটায় মাহমুদের মা বসেও মিটিমিটি হাসতে পারতো আমাদের কান্ড দেখে।’
‘এই কয়দিনের আয়ু নিয়েই এসেছিলেন আম্মা।’
তনয়ার বুকটা হঠাৎ ভারী হয়ে ওঠে। কিছু কিছু যন্ত্রণাকে ছুঁয়া যায় না। পাশে বসে নীরবে ভাগ করে নেওয়া যায় না। কেবল দূর থেকে সান্ত্বনাই দেওয়া যায়।
জীবনসঙ্গী হারানো মানে শুধু একজন মানুষকে হারানো নয়। একসাথে কাটানো সমস্ত মুহূর্ত, অভ্যেস, নির্ভরতা, তর্ক, ভালোবাসা সব কিছুর এক এক করে নিঃশেষ হয়ে যাওয়া। যার হারায় কেবল সেই বুঝে এই যন্ত্রণা।
‘হয়তো!’ বলেই তিনি এমন এক দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন যে এই দীর্ঘশ্বাসের সাথে জমে থাকা ভেতরকার যন্ত্রণা বের দিতে পারলে শান্তি পেতেন।
আকস্মিক কলিংবেলের শব্দে তনয়ার কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়ে।
‘এই অসময়ে আবার কে এলো? দাঁড়ান আমি দেখছি।’
বলে সে ধীরে ধীরে এগিয়ে গেল দরজার দিকে।
দরজার কাছে পৌঁছাতেই কানে আসে অস্পষ্ট এক কান্নার গুঞ্জন। আধো গলায় কেউ যেন হাহাকার করছে। বুকের ভেতরটা কেঁপে ওঠে তনয়ার। এক অজানা আশঙ্কায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে সে। লুকিং গ্লাসে চোখ রাখলেও ধরা দেয় না কেউ। দরজার ও-পাশটা যেন নিঃসঙ্গ ও শূন্য।
‘আব্বা বাইরে থেকে কান্নার আওয়াজ আসছে। কিন্তু কাউকে দেখা যাচ্ছে না।’
মাহমুদ এগিয়ে যেতে নিলেই বাঁধা দেন খালেকুজ্জামান। তিনিও চিন্তিত স্বরে বলেন,
‘দাঁড়া আমি দেখছি কে এলো।’
তিনি দরজা খুলতেই থমকে গেলেন।
দেয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে মুনিরা। ভেজা চোখ, অগোছালো চুল, কাঁপতে থাকা কাঁধ। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে সে। মুহুর্তটা যেন থেমে যায়।
তিনি চোখ মেলে তাকিয়ে থাকেন। মুনিরা ফিরে এসেছে বিশ্বাস হয় না তার। হাজার খুঁজেও যার সন্ধান পাওয়া যায়নি সে নিজে এসে দরজায় দাঁড়িয়েছে।
তিনি কিছু বলার আগেই মুনিরা এগিয়ে আসে। আর সে নিজেকে আর ধরে রাখতে পারে না।
ধপ করে লুটিয়ে পড়ে বাবার বুকে। তার অশ্রু ভিজিয়ে দেয় খালেকুজ্জামানের সাদা স্যান্ডো গেঞ্জি। তিনি তবুও স্থির দাঁড়িয়ে থাকেন। চাপা অভিমান আর রাগ বাঁধা হয়ে দাঁড়ায় মেয়েকে আগলে নিতে।
‘আমাকে মাফ করে দাও আব্বা।’
#চলবে