#সংসার_সমরাঙ্গন (২৯)
রূপন্তি রাহমান (ছদ্মনাম)
নিঃশব্দ ঘরে মুনিরার কান্না আর বুকফাটা চিৎকার মিশে এক বিভীষিকাময় আর্তনাদে রূপ নিয়েছে। প্রতিটি অশ্রুবিন্দু যেন অনুতাপে জ্বলে ওঠা আত্মচিৎকার। আর গলা ছিঁড়ে বেরিয়ে আসা শব্দগুলো যেন সমস্ত অপরাধবোধের দহন বহন করছে। দেয়াল জুড়ে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে সেই বুকচেরা আর্তনাদ। আর প্রতিটা ইট যেন তার মায়ের মৃত্যুর নীরব সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
মুনিরা শক্ত করে বুকে চেপে ধরেছে মেহেরুন্নেসার একখানা পুরোনো শাড়ি। দলা পাকানো সেই শাড়ি কাঁপা হাতে আঁকড়ে আছে সে। শাড়ির ভাঁজে এখনো মায়ের গন্ধ। কিন্তু মানুষটা আর নেই। আর না কোনোদিন ফিরবে। আর এই না ফেরার একমাত্র কারণ সে নিজে। একটি মাত্র ভুল সিদ্ধান্ত গ্রহণের ভার সইতে না পেরে পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছেন তার মা। এই দুঃসহ যন্ত্রণা বুকে নিয়ে তাকে বাঁচতে হবে আজীবন।
‘মা গো মা সারাজীবনের অপরাধী বানিয়ে তুমি কেন চোখ বুঁজলে? আমায় যে ক্ষমা চাওয়ার সুযোগটাও দিলে না।’
‘তনয়া একে বলে দাও এটা কোনো নাট্যমঞ্চ না। এসব কুমিরের কান্না যেন এখানে না কাঁদে।’ খালেকুজ্জামানের চোখে কাঠিন্যভাব।
‘আব্বা,,,,
হাতের ইশারায় তনয়াকে থামিয়ে দেন তিনি।
‘আমায় নয়ছয় বুঝ দিতে এসো না। আমি বাচ্চা নই। মেহেরুন্নেসা যদি পাহাড় সমান পাপও করে সে আমার স্ত্রী আমার সন্তানদের মা এটা ধ্রুব সত্যি। বলতে পারো সে অন্যরকম কিন্তু কখনো আমার প্রতি বিন্দু পরিমাণ অবহেলা করেনি। এতোগুলো বছর সংসার করার আচমকা মানুষটা নেই। খেতে বসলে তার চেয়ারটা খালি থাকে, ঘুমোতে গেলে বিছানার একপাশ ফাঁকা থাকে। কয়েক মাস যাওয়ার পরও আমি এসব মানতে পারি না। তোমরা আছো ঠিকই তারপরও আমি একা।’
সমস্ত রাগ অভিমান নিংড়ে দেওয়ার আগেই খালেকুজ্জামানের পা জড়িয়ে ধরে মুনিরা।
‘আমি অনেক বড় ভুল করে ফেলেছি। আমায় মাফ করে দিন।’
দুই পা পিছিয়ে গেলেন তিনি।
‘রাগ করে কতক্ষণ থাকবেন আব্বা? আম্মা কি ফিরে আসবে? বয়স কম,,,,,
তনয়ার মুখের কথা কেড়ে নিলেন খালেকুজ্জামান।
‘বয়স কম? তুমি এই কথা বলছো? বয়স কম হলে এতোবড় সিদ্ধান্ত নিতে পারতো? হয়তো তার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য আমরা অযোগ্য ছিলাম। তাইতো আমার সম্মান আর তার মায়ের জীবনকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে ঘর ছেড়েছিল।’
খানিক এগিয়ে আবারও খালেকুজ্জামানের পা জড়িয়ে ধরে।
‘আব্বা,,,,,
‘কিসের আব্বা আব্বা করছো তুমি? তোমার ভাবির চোখে ধরা পড়ে যাওয়ার পর স্বীকার করলে না কেন ওই ছেলের সাথে তোমার সম্পর্ক আছে। তাহলে আমরা তার সাথেই তোমার বিয়ে দিতাম। মেহেরুন্নেসাও বেঁচে থাকতো আর আমার সম্মানও। আর ক্ষমা? ক্ষমা করেছি বলেই বাসায় ঢুকতে পেরেছো। নয়তো,,,,
তিনি রুম ত্যাগ করার জন্য পা বাড়ালেন। যাওয়ার আগে বলেন,
‘ তোমায় আমি ক্ষমা করেছি ঠিকই তবে সন্তানের জন্য বাবার চোখে যে মায়া থাকে সেই মায়া আর আমার নেই।’
মুনিরা মেঝেতেই লুটিয়ে পড়ে। হৃদয় এফোড় ওফোড় করা চিৎকারে পুরো রুম কেঁপে উঠলো। কতক্ষণ সেভাবেই পড়ে রইলো নিঃশব্দে। কেবল নীরব কান্নায় দুলে দুলে উঠছিল তার পিঠ।
কয়েক মুহুর্ত কেটে যাওয়ার পর উঠে দাঁড়ায় মুনিরা। মাহমুদের দিকে তাকাতেই মুখ ফিরিয়ে নিলো সে। তাই আর যাওয়ার সাহস পেল না। এগিয়ে গেলো তনয়ার দিকে।
‘তোমার সাথে অনেক বেয়াদবি করেছি, খারাপ ব্যবহার করেছি আমায় তুমি আমায় তুমি,,,,
ফোঁপাতে ফোপাঁতে তনয়ার বুকে নিস্তেজ হয়ে পড়লো। মাহমুদ চলে যাওয়ার জন্য উদ্যত হতেই মাহমুদের হাতটা খপ করে ধরে ফেলে তনয়া। চোখের ইশারায় বলে এখানে থাকার জন্য।
মাহমুদের হাত ছেড়ে মুনিরার মুখটা হাতের আঁজলে নিলো। চোখের পানি মুছে দিয়ে চোখের ইশারায় মাহমুদের কাছে যেতে বলে। একটুখানি ভরসা পেতেই বিলম্ব করে না মুনিরা। আঁকড়ে ধরে ভাইয়ের বুক।
___________________
‘তোমার সাথে এতোদিন যোগাযোগ করা যায়নি কেন?’
এক গ্লাস পানি এগিয়ে দিয়ে প্রশ্ন করে তনয়া। প্রতিত্তোরে ম্লান হাসে মুনিরা। আত্মোপলব্ধির সকল ভার যেন সেই হাসিতেই লুটিয়ে পড়ছে।
‘আমার কর্মফল হয়তো এমন ছিলো যে আম্মার মুখ শেষ বারের মতো না দেখা।’
তনয়া মুনিরার কাঁধে হাত রাখতেই সে লম্বা একটা শ্বাস ফেলে।
‘সপ্তাহ খানেক আগে থেকেই আমাদের প্ল্যানিং ছিলো আমরা পালিয়ে যাবো। তাই ফারুক ওয়ার্কশপের কাজটা ছেড়ে সব গোছগাছ করতে থাকে। আমারও পরিস্থিতি অনূকূলে আসতেই গয়না আর টাকা পয়সা নিয়ে বেরিয়ে গেলাম। গিয়ে উঠলাম ওদের বাড়িতে। সেখানে ওর মা আর দুইবোন ছিলো। আমাকে যেন ট্রেস করা না যায় সেজন্য ঢাকা থাকা অবস্থায়ই সিম খুলে ফেলি।’
এতটুকু বলেই থামে মুনিরা। পানির গ্লাসটা মুহূর্তেই খালি করে দম নিলো। পুনরায় বলা শুরু করলো,
‘শ্বশুরের এক টুকরো বসত ভিটা ছাড়া আর কিছুই নেই। শ্বাশুড়িও অন্যের জমিতে কাজ করে কোনোরকম জীবন পার করে। মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে। আমি তো এমন পরিবেশে বড় হয়নি। তারপরও এক টুকরো শান্তি ছিলো যাকে ভালোবাসি সেই মানুষটা এখন আমার। একটু ভালো থাকা আশায় গয়না, টাকা আর মোবাইল তার হাতে তুলে দিলাম। গয়না আর মোবাইল বিক্রি করে সেই টাকায় একটা দোকান ভাড়া নিলো। ঠিক মতো দাঁড়াতেই পারল না। লসের পর লসে সব শেষ। পুঁজি যা ছিল এক টাকাও নেই। সিদ্ধান্ত নিলাম ঢাকা আসবো দুজন। এতো অভাবে তো দিনাতিপাত করা যায় না। এখন ফারুকের মা বোনরাও পাগল হয়ে গেছে ঢাকায় আসার জন্য। এতো বুঝানোর পর বুঝলোই না শহরে কত খরচ। ভেবেছে হয়তো তাদের ফেলে ভালো চলবো ভালো ভালো খাবার খাবো আমরা।’
‘কতদিন হলো ঢাকায় এসেছো?’
‘ফারুক আরো আগেই এসেছে। নিজের কাজ জোগার করে একটা বাসা ঠিক করে আমাদেরও নিয়ে এসেছে এক সপ্তাহ আগে। পড়াশোনা তো আর হবে না এখন একটা গার্মেন্টসে চাকরি নেওয়ার চেষ্টা করছি। একটু যেন ভালোভাবে চলতে পারি।’
আঁতকে উঠলো তনয়া।
‘তুমি গার্মেন্টসে চাকরি করবে? তুমি কোনোরকম অনার্সটা কমপ্লিট করো। তোমার পড়াশোনা ভার আমি বহন করবো।’
তপ্ত শ্বাস ফেলে মুনিরা।
‘এই জীবনটা তো আমি স্বেচ্ছায় বরণ করেছি। এটা আমার নসীবে ছিল। আর তাছাড়া আমি পড়াশোনা করলে ভাববে তাদের ছেলে সংসারে টাকা না দিয়ে আমার পিছনে টাকা উড়াচ্ছে।’
‘তোমার পড়াশোনার দায়িত্ব আমি নেবো বললাম তো।’
‘তোমার কিসের ঠেকা? যার হাত ধরে পালিয়ে গেলাম সে তো কোনোদিন বলেনি। সে তো জানতো আমি কেমন পরিবারের সন্তান। আমি বাস্তবতা মেনে নিয়েছি।’
মুনিরার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো তনয়া।
‘অনেক টাকার গয়না আমি নিয়েছি। এবং সেগুলো তাদের পিছনেই খরচ হয়েছে। এরপরও তুমি যদি আগ বাড়িয়ে আমার পড়াশোনার খরচ বহন করতে চাও তাহলে ওরা আরো চাইবে। এমনটা হউক আমি চাইনা। একটা সিদ্ধান্তের জন্য আম্মাকে হারিয়েছি। আমার সিদ্ধান্তের জের তোমরা আরো বহন করো আমি সেটা চাই না।’
মুনিরার দিকে এতোক্ষণে পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকায় তনয়া। গায়ে ধূসর ময়লা একটা থ্রিপিস। নখে ময়লা। চুলগুলো রুক্ষ। শুকিয়ে গলার হাড় ভেসে ওঠেছে। ঠিক কতটা কষ্ট এই ক’মাসে করেছে সবটাই তার চেহেরায় ভাস্যমান।
‘তোমার স্বামী তোমার দিকে ঠিক মতো তাকায় না? কি হাল হয়েছে তোমার। তুমি নিজে আয়নায় দেখেছো নিজেকে?’
‘আমার দিকে তাকালে যে পরিবারের দিকে তাকাতে পারবে না। আর আমার নিজেরই বা সময় কোথায় নিজেকে দেখার? সমস্ত কাজ সামলে একটু বিশ্রামের সময়ই তো পাই না।’
‘তোমার ননদরা কাজে সাহায্য করে না?’
‘আমি তোমায় কোনো কাজে সাহায্য করেছিলাম?’
মুনিরার ছলছল চোখের দিকে তনয়া তাকিয়ে থাকে কয়েক সেকেন্ড। পরিস্থিতি মানুষকে কতটা বদলে দেয়।
‘যেখানে আমি তোমাকে সাহায্য করিনি সেখানে আমার ননদেরা কাজে সাহায্য করবে সে ভাবনা তো বিলাসিতা। আফটারঅল সবই তো আমার কর্মফল।
আচমকা বেজে ওঠে কলিংবেল। রুম থেকে বেরিয়ে আসে মাহমুদ।
‘আপা এসেছে।’
‘আপা এসেছে মানে? তুমি আপাকে মুনিরা আসার খবর দিয়েছো?’ তনয়ার চোখে একরাশ ভয় আর আতঙ্ক।
‘আমি কিছুই আপাকে বলিনি। আমাকে একটু আগেই ফোন করে বলল আসছে।’
‘তুমি নিষেধ করতে পারলে না? এখন এসে মুনিরাকে দেখলে হয়তো মে*রেই ফেলবে।’
‘আজ হউক বা কাল দুজনকে মুখোমুখি হতেই হতো।’
তনয়া দিশা হারিয়ে ফেলে। অঘটন ঘটুক এটা সে চায় না।
‘মুনিরা তুমি বরং এক কাজ করো আমার রুমে চলে যাও। আপা তাহলে বুঝবে না। আর আব্বাকে আমি বলে দেবো তোমার আসার কথা যেন না বলে।’
মুনিরা ফিচেল হাসে। ম্লান গলায় বলে,
‘এতোটা আতঙ্কিত হওয়ার দরকার নেই। সবার মুখোমুখি হওয়ার মনমানসিকতা নিয়েই আজ আমি এসেছি। যেখানে আম্মাই নেই সেখানে কাকে ভয় পাবো?’
মাহমুদ গিয়ে দরজা খুলে দিতেই সুমনা ভেতরে ঢুকে। কোনোদিকে না তাকিয়েই ডাইনিং টেবিলের সামনে দাঁড়ায়। ব্যাগ থেকে ছোট্ট একটা কাঁচের বয়াম বের করে টেবিলের উপর রাখে।
‘অফিসে নাকি কলিগের থেকে গরুর মাংসের আচার খেয়েছে। তার কাছে এতোই ভালো লেগেছে কলিগের থেকে রেসিপি জেনে সাথে করে গরুর মাংসও নিয়ে এসেছে। পারবো না বলাতে জেদ ধরেছে আচার বানিয়ে না দিলে ভাত খাবে না। কি আর করার! ইউটিউব ঘেঁটেঘুটে বানালাম। ভাবলাম তোমাদের জন্যও নিয়ে যাই। একটু চেখে দেখো তো কেমন হয়েছে।’
তনয়ার দিকে ঘুরতেই সুমনার চোখ রক্তবর্ণ হয়ে উঠলো। নিশব্দ মুহূর্ত ভেঙে আচমকা যেন আগুন জ্বলে উঠলো ঘরে। চোখদুটি যেন দাউদাউ করে জ্বলছে। নাসিকায় আগুনের শ্বাস। গাল লাল হয়ে উঠেছে রক্তচাপে। কাঁপতে থাকা ঠোঁটের কোণে জমেছে ক্ষোভ আর ঘৃণা। দাঁত কিড়মিড় করে সে।
‘ একে বাসায় ঢুকানোর সাহস কে করেছে?’
তার গলা ভরাট৷ ফাটল ধরা স্বরে যেন ঘরের বাতাস কেঁপে ওঠে। বুকটা হাঁপাতে হাঁপাতে উঠে পড়ে। হাতের আঙুল মুষ্ঠিবদ্ধ হয়ে আছে। যেকোনো সময়েই সে ঝাঁপিয়ে পড়বে মুনিরার উপর।
সে তেড়ে আসে মুনিরার দিকে। প্রতিটা পা যেন তীব্র ঘৃণার প্রতিচ্ছবি। কিন্তু মাঝপথে সামনে দাঁড়িয়ে পড়ে তনয়া। বাঁধা দেয়ার ভঙ্গিতে হাত দুটো সামনে মেলে ধরে। যেন একটা দেওয়াল গড়ে তুলেছে।
পেছন থেকে এগিয়ে আসে মাহমুদ। তবু থেমে যায় না সুমনা। শরীর কাঁপতে থাকে তার। গলার স্বর বেড়ে যায় কয়েক গুণ।
‘এই জানোয়ার কে বাসায় ঢুকিয়েছিস তোরা? কোন সাহসে আম্মার খু* নী * কে এই চৌকাঠ পেরোতে দিলি?’
তার গলার ভেতরটা কাঁপছে। আবেগ, ঘৃণা আর দুঃখ মিলিয়ে যেন বিস্ফোরিত হতে চায়। হাত কাঁপছে। বুক ওঠানামা করছে উত্তেজনায়।
ঘরের এক কোণায় নিজেকে আড়াল করে নিস্তব্ধ বসে আছে মুনিরা। তার সারা শরীরটা যেন গুটিয়ে গিয়েছে অপরাধবোধের আচ্ছাদনে। মাথা নিচু। বিবর্ণ মুখটা। ঠোঁট কাঁপছে, কিন্তু কোনো শব্দ নেই। চোখদুটো থরথর করে কাঁপছে জলের ভারে। বোনের দিকে চোখ তুলে তাকানোর সাহস হচ্ছে না।তার শরীরজুড়ে কেবল ক্লান্তি আর ভেঙে পড়া আত্মার ছাপ।
এই ঘৃণার ঝড়ের মাঝেও তনয়ার মুখে চাপা এক দৃঢ়তা। চোখে অশ্রু জমলেও কণ্ঠে অদ্ভুত একটা শান্ত সুর। যা সুমনার তাণ্ডবের পাশে এক ব্যতিক্রমী বিরোধ তৈরি করে।
‘কি করবেন? মে*রে ফেলবেন?’
‘হ্যাঁ, মে*রেই ফেলবো।’
চেঁচামেচিতে নিজের রুম থেকে বেরিয়ে আসেন খালেকুজ্জামান।
‘বাঁধা দিও না ভাবি। আমাকে বরং আপা মে*রেই ফেলুক।’
অপরাধের ভারে নুয়ে পড়েছে তার গলা। তিরতির করে কাঁপছে তার কণ্ঠনালী। হাত দু’টো মেলে ধরে সামনে। আপন মনে বিড়বিড় করে,
‘দূরে থেকেও এই অদৃশ্য হাতে আম্মাকে আমি খু*ন করেছি। আমার যে মৃত্যুই শ্রেয়।’
তনয়ার দৃষ্টি মুনিরার দিকে। সুমনা সুযোগ পেতেই সোজা গিয়ে মুনিরার গলা চে*পে ধরে। এতোটাই শক্ত করে ধরে মুনিরার জিভ বের হয়ে দম বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়।
তনয়া, মাহমুদ চেষ্টা করেও ছাড়াতে পারে না। খালেকুজ্জামান নিজ জায়গায় ঠায় দাঁড়িয়ে রইলেন।
‘আপা মে*রে ফেলবি নাকি?’ ছাড় ওকে।’
সময়ের সাথে সাথে আরো শক্ত হয় আঙ্গুলের বাঁধন। হয়তো এখনই প্রাণপাখি উড়াল দিবে। কিন্তু নিজেকে বাঁচানোর বিন্দুমাত্র চেষ্টা করে না মুনিরা।
তনয়া গায়ের জোরে ধাক্কা মারে সুমনাকে। ছিটকে দূরে গিয়ে পড়ে সুমনা। দু’কদম পিছিয়ে যায় মাহমুদও। সুমনা দাঁত কিড়মিড় করে হাঁপাচ্ছে। হাঁপাচ্ছে তনয়াও।
‘এক তরফা মুনিরাকে দোষ দিচ্ছেন কেন? আপনারা দোষী না?’
এক গ্লাস পানি এনে তনয়া মুনিরার হাতে দিলো। এক ঢোক খেয়ে আর খেতে পারল না সে। গলায় চার চার আট আঙুলের ছাপ বসে গেছে। চোখজোড়া টকটকে লাল। পানি টলমল করছে।
তনয়া গিয়ে শ্বশুরের সামনে দাঁড়ায়। প্রথমবারে মতো চোখে চোখ রেখে আঙুল উঁচিয়ে জোর গলায় বলে,
‘আম্মার মৃ*ত্যু-র জন্য মুনিরা যতটা দায়ী তারচেয়ে বেশি দায়ী আপনারা।’
বলে সকলের দিকে আঙুল ঘুরায় তনয়া।
‘দোষ কেবল মুনিরার না। দোষ আপনাদেরও আছে। আমি সেদিন যখন ইঙ্গিত দিয়েছিলাম কী করেছিলেন আপনারা? সেদিন অন্তত আমার কথাটার সত্যতা যাচাই করতেন। তবে আজকের দিনটা আসতোই না। কোন ছেলেমেয়ে প্রেমে ধরা পড়ার পর স্বীকার করে নিজের প্রেমের কথা? অস্বীকার করে তো গা বাঁচাতে চাইবেই। আর পালিয়ে যাওয়া পর্যন্ত সেই সুযোগটা আপনারা করে দিয়েছেন। উল্টো প্রত্যেকটা মানুষ আমায় শুনিয়েছেন। আজকের পরিস্থিতি কী আপনাদের তৈরি নয়? তবে আজ কেন দোষের ভাগীদার কেবল একজন?’
তনয়া গিয়ে সুমনার মুখোমুখি দাঁড়ায়। প্রচন্ড ক্ষোভ নিয়ে বলে,
‘আজ বড্ড রাগ দেখাচ্ছেন। তেজ দেখাচ্ছেন। সেদিন দেখাতে পারলেন না? সেদিন রাগ দেখিয়ে সত্যটা মুখ থেকে বের করতে পারলেন না? তখন তো আগলে নিয়েছিলেন।’
মাহমুদকে উদ্দেশ্য করে বলে,
‘বোন পালিয়ে যাওয়ার পর ছেলের বাসা খুঁজে বের করলে, ফোন নম্বর জোগার করলে। পালিয়ে যাওয়ার আগে খুঁজে বের করতে পারলে না? চোর পালালে বুদ্ধি বাড়ে সেটার প্রমাণ দিলে নাকি?’
ড্রয়িংরুমে পিনপতন নীরবতা নীরবতা। কেবল নিঃশ্বাস, কান্না আর ফোঁপানোর শব্দ কানে আসছে।
মুনিরার হেলে পড়া মাথা নিজের বুকে নিলো তনয়া। আলতো করে চুলে বিলি কেটে দেয়।
‘আপনি নিজের স্ত্রীকে হারিয়েছেন। সন্তানের মাকে হারিয়েছেন। মুনিরা বুঝি মাকে হারায়নি? এক হয়ে সবাই মেয়েটাকে ব্লেম দিচ্ছেন। সেই অপরাধবোধের ভার সইতে না পেরে কাল যদি সে অনাঙ্ক্ষিত একটা ঘটনা ঘটিয়ে বসে তখন কি করবেন? সন্তানের মায়ের সাথে সন্তানকেও হারিয়ে ফেলবেন। সেটা ভেবেছেন কি একবারও?’ গলা ধরে আসে তনয়ার। কন্ঠনালী কাঁপছে তার।
‘যা হারানোর তা তো হারিয়ে ফেলেছেনই। আর যা আছে আপনার সেগুলোকে আঁকড়ে ধরুন। আগলে নিন। পৃথিবীর সব মিথ্যা। একমাত্র মৃত্যুই সত্য। সকলের মৃত্যু নিশ্চিত। এটা ধ্রুব সত্য। এই সত্য থেকে কেউ মুখ ফিরিয়ে নিতে পারবে না। হয়তো আল্লাহ তাআ’লা আম্মার মৃ*ত্যু এভাবেই লিখেছেন। আম্মার আয়ু এতটুকুই ছিলো।’
ভেঁজা চোখে মুনিরার দিকে তাকিয়ে থাকে তনয়া। মেয়েটা কাঁদছে কিন্তু গলা দিয়ে কোনো শব্দ বের হচ্ছে না।
‘আব্বা! আব্বা! মনে রাগ পুষে রাখলে আম্মা তো ফিরবে না।’
মাহমুদের দিকে তাকিয়ে চেঁচিয়ে উঠে তনয়া।
‘দাঁড়িয়ে দেখছো কি? আব্বা এখানে নিয়ে আসো।’
মাহমুদের যেতে হয়নি। খালেকুজ্জামান নিজে এগিয়ে এসে মেয়ের মাথায় হাত রাখলেন। আরো ভেঙে পড়ে মুনিরা। আশ্রয় খুঁজে নেয় বাবার বুকে।
সোফার এককোণে বসে হাতে কপাল ঠেকিয়ে অঝোরে কাঁদছে সুমনা। কান্নায় কোনো শব্দ নেই। আছে কেবল চাপা ধ্বনি আর বুকফাটা হাহাকার। ভেতরের গভীর ক্ষতগুলো যেন হঠাৎ করেই জেগে উঠেছে। আগুন হয়ে ছড়িয়ে পড়ছে অন্তরজুড়ে। স্মৃতির নিঃশ্বাসে দগ্ধ হচ্ছে মন।
মাহমুদ সুমনার পাশে বসে। শান্ত স্বরে ডাকে,
‘আপা!’
সুমনা মাথা তুলে এক পলক তাকিয়ে ভাইয়ের বাহু জড়িয়ে ধরে।
‘আম্মার কথা মনে পড়ছে। এতো তাড়াতাড়ি কেন চলে গেলো আম্মা?’
তনয়াও এসে তার পাশে বসে। কোমল হাত খানা রাখে সুমনার মাথায়।
‘বিশাল এক ঝড় বয়ে গেছে ভেবে সবটা ভুলে যান।’
‘কিভাবে ভুলবো বলতে পারো? আম্মা তো নেই। আর আসবেও না। চোখ বুঝলেই যে কেবল আম্মার মুখটা ভাসে। একটা ভুল সিদ্ধান্ত ও নিজে মা হারা হলো আর আমাদেরও মা হারা করলো।’
তনয়ার বুক গলিয়ে নির্গত হয় দীর্ঘশ্বাস। দীর্ঘশ্বাসের সাথে যদি সমস্ত হাহাকার উগলে দেওয়া যেত হয়তো ভালো থাকতো সকলেই।
‘বুকে হাত রেখে বলুন তো দিনে একটা বারও বোনের জন্য চিন্তা হয়নি? একটা বারও কি ভাবেননি বোন ভালো আছে কিনা? যত যাই বলুন দিনশেষে আপনারা তো বোন। এক মায়ের পেট থেকেই বের হয়েছেন। তাছাড়াও শেষ সময়েও কিন্তু আম্মা মুনিরার কথা ভেবেছেন।’
তনয়া খানিক চুপ রইলো। সুমনাও নিশ্চুপ। কোনো প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছে না। তাই তনয়া শেষ চেষ্টা করে।
‘আপা মুনিরার দিকে তাকান একটাবার। ছয়মাস আগের মুনিরার মাঝে আকাশ আর পাতালের পার্থক্য। ওকে দেখে কি মনে হচ্ছে না সে তার কর্মফল ভোগ করছে?’
সুমনা তাকিয়ে রইলো মুনিরার দিকে।
‘যান আপা। ক্ষমা করে দিন।’
‘হয়তো এটাই আমাদের নিয়তি ছিলো। সব ভুলে যা আপা।’
সুমনা দেরি করে না উঠে গিয়ে আগলে নেয় মুনিরাকে। এই সময়টার অপেক্ষায় হয়তো সে একটু আগে মৃ*ত্যুসম যন্ত্রণা ভোগ করেছে মুনিরা। দুইহাতে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরে বোনকে। কান্নার বেগ বাড়ে। সেই সাথে বাড়ে কান্নার শব্দও।
‘আমায় ক্ষমা করে দে আপা। আমি বুঝিনি এমনটা যে হয়ে যাবে। নিজেকে যে আম্মার খু*নি মনে হয়।’
দুইবোন যেন পাল্লা দিয়ে কাঁদছে। মাহমুদকে চিমটি কাটে তনয়া।
‘ওদিকে বোনদের বন্ধন অটুট হয়ে যাচ্ছে। সে খেয়াল আছে তোমার?’
মাহমুদ কথার মানে বুঝল না।
‘বোনের বন্ধনের কাছে ভাইয়ের বন্ধন হেরে যাচ্ছে। বোকা এখানে বসে না থেকে ওখানে যাও। বোনদের সাথে ভাতৃত্বের বন্ধন অটুট রাখো।’
মাহমুদ গেল। দুইবোনকে আলাদা করে মাঝখানে বসে পড়ল। দুই বাহুতে জড়িয়ে নিলো দুজনকে। কিছু সময় অতিবাহিত হওয়ার পর তিনজনই উঠে গিয়ে খালেকুজ্জামানের চারিদিকে ঘিরে বসে। দূর থেকে মেকি রাগ দেখায় তনয়া।
‘বাহ্!বাহ্! আমে দুধে মিশে গেল। এইদিকে আঁটি হয়ে নিচে গড়াগড়ি খাচ্ছি আমি।’
তনয়ার কথার জবাব দেন খালেকুজ্জামান।
‘তুমি তো মা আঁটি নও। ডালপালা দিয়ে আগলে রাখা সেই আমের গাছটাই যে তুমি।’
__________________
নয়মাসের উঁচু পেট নিয়ে বসে আছে তনয়া। একটা ড্রাগন ফল কে’টে এনে তনয়ার হাতে ধরিয়ে দেন খালেকুজ্জামান। তনয়া নাক সিটকে কিছু বলতে যাবে এর আগে খালেকুজ্জামানের মুখের দিকে তাকিয়ে দমে যায় তনয়া। মিনমিন করে বলে,
‘খাচ্ছি তো।’
খালেকুজ্জামান চলে গেলেন। লেগে পড়লেন দেয়ালের ঝুল ঝারার জন্য। ওইদিকে মাহমুদ ফ্লোর মুছায় ব্যস্ত। দুইদিন পর নতুন অতিথি আসবে। সেজন্যই ঘরকে নতুন করে সাজানোর কাজে ব্যস্ত বাবা ছেলে।
মাহমুদ ঘর মুছতে মুছতে সেখানে এলো যেখানে খালেকুজ্জামান দেয়ালের ঝুল ঝারছেন। পরিষ্কার জায়গায় ঝুল পড়তেই তেলেবেগুনে জ্বলে উঠে মাহমুদ।
‘তোমাকে দিয়ে কোনো কাজ হয় না আব্বা। কাজ তো করো না। শুধু কাজ বাড়াও। দেখছো আমি ফ্লোর মুছছি তারপরও চলে এলে ঝুল ঝারতে।’
খালেকুজ্জামান চেয়ার থেকে নামলেন। আরো দ্বিগুন গলা উঁচিয়ে বলেন,
‘তুই কি কানা? আমি এখানে কাজ করছি তুই এখানে আসলি কেন?’
হাতে ফল। সোফায় আরাম করে বসে লাইভ বিগবস দেখছে তনয়া। আর মিটিমিটি হাসছে। আবার হৃদয় জুড়ে ছড়িয়ে একটু টুকরো প্রশান্তি। তাকে ঘিরে তার সন্তানকে ঘিরে সকলের কত আয়োজন। কাল আবার আসবে সুমনা। এক গাধা জিনিসপত্র নিয়ে। তার ভাবনার মাঝে কলিংবেল বাজে। উঠতে নিলেই খালেকুজ্জামান নিষেধ করেন। তিনি নিজে গিয়ে দরজা খুলে দিলেন।
এক হাতে টিফিনবাক্স আরেক হাতে শপিং ব্যাগ ভেতরে ঢুকে মুনিরা। ব্যাগে কি আছে ঠিক বোঝা যাচ্ছে না।
টিফিনবাক্স টেবিলের উপর রেখে ব্যাগ টা নিয়ে তনয়ার পাশে গিয়ে বসে সে। ব্যাগ থেকে ছোট ছোট কতগুলো নকশীকাঁথা বের করে। এগুলো আমার মায়ের জন্য।
‘আর যদি বাপ হয়?’
‘তাহলে কাঁথা গুলো ফিরিয়ে নিয়ে যাবো।’
বলে খিলখিল করে হাসে মুনিরা। যোগ দেয় তনয়াও।
‘আর ওইখানে কি এনেছো?’
‘একটা দেশি মোরগ ঝাল ঝাল করে ভুনা, গরুর টাটকা মাংস দেশি আলু দিয়ে ঝোল আর পোলাও।
‘এসব করতে গিয়েছো কেন তুমি? তোমার নিজেরই তো টানাটানির সংসার।’
‘আমার বুঝি তোমাকে কিছু দিতে ইচ্ছে করে না? আপা তোমাকে কত কি দিলো। আমি তো কিছুই দিলাম না।’
‘তুমি তো ছোটো। তুমি কি দিবে? আমরা না তোমায় দিবো।’
‘বেশি পকর পকর না করে চলো খাবে।’
‘এই তোমরা কি শুরু করলে? আমার পেটে জায়গা নেই। আমি খাবো না।’
‘আমাকে এখনই আবার চলে যেতে। আমার সামনে একটু খাও। আমি একটু মন ভরে দেখি।’
‘তোমাদের নিয়ে আর পারলাম না। চলো।’
মুনিরাকে ধরে তনয়া উঠে দাঁড়ায়। চেয়ার টেনে গিয়ে বসলো টেবিলে। রান্নাঘর থেকে একটা প্লেট আনে মুনিরা। পরম যত্নে প্লেট সাজিয়ে তনয়ার সামনে রাখল। আড়চোখে সব দেখে টিপ্পনী কাটে মাহমুদ।
‘কেউ মা হওয়ার সাথে সাথে আমিও বাপ হচ্ছিলাম। পেটে ধরেনি বলে আমার কোনো দাম নেই। এই দুনিয়া বড়ই নিষ্ঠুর।’
‘তুই চুপ থাক।’
মুনিরাকে ভেঙচি কেটে নিজের কাজে মন দেয় মাহমুদ।
তনয়া তৃপ্তি নিয়ে খাচ্ছে। মুনিরা আরো এক পিস মাংস তার প্লেটে দিলো।
‘মেয়ে হলে আমি একজোড়া নুপুর দিবো। সে যখন এলোমেলো পায়ে হাঁটা শিখবে তখন পড়িয়ে দিবে। আমি যখন মা বলে ডাকবো এসে এলোমেলো পায়ে হেঁটে ঝুমুর ঝুমুর শব্দ তোলে লুটিয়ে আমার কোলে।’৷ গলা ধরে আসে মুনিরার। চোখে টলমল করছে পানি।
‘তুমি ভালো আছো তো মুনিরা?’
চোখের পানি মুছে নিলো সে।
‘ভালো আছি। খুব ভালো আছি।’
ঠোঁট কামড়ে ধরে কান্না নিবারনের জন্য।
তনয়া কাঁধে হাত রাখতেই তার নীরব কান্নার বেগ বাড়ে।
‘নিজেকে বড্ড অসহায় মনে হয় ভাবি।’
‘কেন এতো কষ্ট করছো? কি হাল হয়েছে নিজের দেখেছো? ভাবির কথা শুনো। পুরো দুনিয়া যদি তোমার বিরুদ্ধে যায় আমি তোমার পাশে থাকবো।’
‘এমনটা হয় না।’
‘কেন হয় না?’
মুনিরা নীরব থাকে।
‘আম্মা বেঁচে থাকলে এমনটা কখনো হতে দিতো? সেই কবেই নিয়ে আসতো।’
‘বেঁচে নেই বলেই এখনো সেখানেই রয়ে গেলাম।’
‘আমরা বুঝি ফেলে দিবো তোমাকে?’
মাথা নাড়ে মুনিরা।
‘যত যাই বলো আম্মার মৃ*ত্যুর কারন যে আমি এটা অস্বীকার করতে পারবো না। আমার একটা ভুল সিদ্ধান্ত আম্মা,,,,
তীব্র যন্ত্রণায় গলা দিয়ে শব্দ বের হয় না মুনিরার। কিছুক্ষণ থম মে’রে থাকে। পুনরায় বলে,
‘যেই কর্ম করেছি সেই ফল ভোগ করবো না? এই জীবনটা তো আমি নিজেই বেছে নিয়েছি। এটা আমার প্রাপ্য। সবার মনে আঘাত দেওয়ার শাস্তি। আম্মার রুহের হায়। যতদিন বেঁচে থাকবো ততদিনের জন্য এই শাস্তি আমি স্বেচ্ছায় বরণ করে নিলাম।’
মুনিরার কথার মাঝেই চোখমুখ খিঁচে বন্ধ করে ফেলে তনয়া। হঠাৎই তলপেটটা যেন মোচড় দিয়ে উঠলো। একটা প্রচণ্ড টান। একটানা ব্যথা নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হয় তনয়ার। মুখটা কুঁচকে ওঠে। ঠোঁট কামড়ে ধরে সে। পেটের নিচে থেকে কোমরের ভেতর দিয়ে একটা তীব্র চাপ ছড়িয়ে পড়ে পিঠ অবধি। মনে হয় শরীরটা দুমড়ে-মুচড়ে যাচ্ছে ভেতর থেকে।
তার নিঃশ্বাস ছেঁড়ে আসে। কপাল ঘামে ভিজে উঠেছে। ব্যথার ঢেউ যেন থেমে থেমে এসে তাকে কাবু করে ফেলছে। চোখ খুলে তাকানোর শক্তিটুকুও নেই।
‘কি হয়েছে ভাবি?’
তনয়া ঠোঁটের কোণে অস্ফুট আর্তনাদ করে ওঠে।
‘তোমার ভাই আর আব্বাকে ডাকো। আমার বোধহয় প্রসব ব্যথা শুরু হয়েছে। আর পারছি না সহ্য করতে।’
পরিশিষ্টঃ
খালেকুজ্জামানের বুকের ওপর ঘুমিয়ে আছে ছোট্ট মুনিজা। গভীর ঘুমে তলিয়ে যাওয়া সেই ছোট মুখে যেন পৃথিবীর যাবতীয় শান্তির ছায়া লেগে আছে। তার ছোট্ট দুনিয়ার একাংশ জুড়ে কেবল খালেকুজ্জামান।
নিঃশর্ত ভালোবাসা, নিঃস্বার্থ স্পর্শ আর অসীম নির্ভরতার বন্ধন তাকে এমন করে বেঁধে রেখেছে যে নাতনিকে ফেলে কোথাও যাওয়ার কল্পনাটুকুও করতে পারেন না খালেকুজ্জামান। মুনিজা যেন তার ভালো থাকার কারন। ক্লান্ত প্রহরের একমাত্র প্রশান্তি।
নিঃশব্দ ঘরে, নিঃশব্দ এক মায়ার বন্ধনে জড়িয়ে রয়েছে দাদু-নাতনির দুটি প্রাণ।
তনয়া ঘুমন্ত মেয়েকে কোলে তুলে নিলো। নুপুরের ঝুম ঝুম শব্দে ঘুম হালকা হয়ে আসে খালেকুজ্জামানের। চোখ মেলে তাকান তিনি। তনয়াকে দেখে আবারও গভীর ঘুমে তলিয়ে যান।
তনয়া খুব সন্তর্পণে আলো নিভিয়ে খালেকুজ্জামানের কক্ষ ত্যাগ করে। নিজের রুমে গিয়ে মেয়েকে শুইয়ে দিলো খুব সাবধানে। ল্যাপটপে কাজ করছিলো মাহমুদ। দুজনকে দেখে ল্যাপটপ বন্ধ করে ফেলে। ঘুমন্ত মেয়ের কপালে চুমু এঁকে দেয়।
‘কি কপাল আমার! মেয়েও পাত্তা দেয় না। মেয়ের মাও পাত্তা দেয় না।’
তনয়া আলো নিভিয়ে মাহমুদের বুকে মাথা রাখে। মাহমুদ আলতো করে তনয়ার চুলের ভাঁজে বিলি কাটে।
‘পাত্তা না দিলে পাশের পুতুলটা দুনিয়ায় এলো কি করে? ওটা যে পাত্তা দেওয়ারই ফল।’
এক গাল হেসে তনয়া এলোমেলো চুলে চুমু আঁকে মাহমুদ।
‘আজ স্কুল থেকে ফিরে দেখি আব্বা সব রান্না রেডি করে রেখেছে। ঘরদুয়ারও গোছানো। কত করে বলি আমি সব সামলে নিবো। শুনেই না কথা।’
‘মুনিজা কে পেয়ে আব্বা আবারও আগের মতো প্রানবন্ত হয়ে গেছে।’
‘হয়তো। আজ আম্মা থাকলে অন্যরকম হতো তাই? সংসারটা ভরা থাকতো। আম্মা নেই কোথাও একটা তীব্র শূন্যতা।’
মাহমুদ তপ্ত শ্বাস ফেলে। নীরব থাকে সে। হয়তো মায়ের স্মৃতি মনে পড়েছে। তনয়া ফের বলে,
‘সংসার নামক সমরাঙ্গনে প্রতিটি দিনই এক অবিরাম যুদ্ধ। কখনো তা বাহিরের মানুষের সঙ্গে। আবার কখনো নিজের ভেতরের দ্বন্দ্বের বিরুদ্ধে। পালিয়ে যাওয়ার পথ নেই। আত্মসমর্পণও নয় কোনো সমাধান। এই যুদ্ধক্ষেত্রে টিকে থাকার নামই হয়তো জীবন। আর তাইতো সংসার সমরাঙ্গন।’
___________________সমাপ্ত__________________