#ওঁগো_বঁধু
পর্ব ২
#জান্নাতুল_মাওয়া_লিজা
ছেলের বাসর ঘরে গোপন সিসিটিভি ক্যামেরা কোন বাবা দেয়?
কিন্তু রাফসানের বাবা রায়হান মাহমুদ দিয়েছেন!
কারন, আজকে এই বাসর রাতে যে তার ছেলে একটা অঘটন ঘটাতে পারে তার পূর্বাভাস তিনি আগেই পেয়েছিলেন। কর্মজীবনে রায়হান মাহমুদ তালুকদারও একজন সেনা অফিসার ছিলেন, বর্তমানে তিনি অবসর গ্রহণ করেছেন। বাস্তব জীবনে প্রচন্ড সৎ, বুদ্ধিমান, বাস্তববাদী ও দূরদর্শী তিনি।
ছেলেকে বাসর ঘরে ঢুকিয়ে দিয়ে নিজের ঘরে বসে গোপনে তিনি দেখে যাচ্ছেন স্বীয় পুত্রের কার্যকলাপ।
জীবনে কোনোদিন বাবার কথার অবাধ্য না হলেও এই বিয়ে যে মন থেকে রাফসান মানতে পারেনি তা তিনি স্পষ্ট বুঝতে পেরেছিলেন। কিন্তু মৃত্যুপথযাত্রী সন্তানকে বাঁচাতে যেকোনো বাবাকে যেকোনো শর্ত দিলে সেই বাবা তা মেবে নিবেই নিবে। বাবারা এমনি হয়। রাফসানের মা ও মেনে নিয়েছিলেন। পরিবারের অন্যান্য সবাই মেনে নিয়েছিলো শাহের আলী প্রদত্ত শর্তাবলি।
বস্তুত:পক্ষে এখন রাফসানের মেন্টালিটি দেখে এই ঘটা করে নেওয়া সিদ্ধান্তকে সবাই ভুল বলে স্বীকার করে নিচ্ছে। রাফসানের মেন্টালিটি যে ঠিক নেই তা তিনি বেশ কয়েকদিন যাবৎই পর্যবেক্ষণ করছিলেন রায়হান তালুকদার সহ পরিবারের অন্যান্যরা।
ডক্টরও বলেছিলেন,
– “এত বড় একটা অপারেশনের পর পেসেন্ট মেন্টালি অনেক স্ট্রেসড থাকবে, এটাই স্বাভাবিক। সে অনেই রুঢ় থাকবে, ইরিটেটিং থাকবে এবং রাগ ও জেদ বেশি হবে। ক্রমাগত হাই পাওয়ারের ঔষধ খাওয়ার সাইড ইফেক্ট এটা। আপনাদের সবার সচেতন দৃষ্টি রাখতে হবে পেসেন্ট এর উপর। তাকে রাগ করতে দেওয়া যাবে না, হাইপার হতে দেওয়া যাবে না, বেশি এক্সাইটমেন্ট হলে তার নার্ভাস সিস্টেম ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। ”
মাসখানেক আগের ঘটনা এটা। রায়হান সাহেব ও তার পরিবার যখন ডাক্তারের কথাগুলো মনোযোগ দিয়ে শুনছিলেন তখনি রাফসান প্রথমবারের মতো রাগটা করে। পাশের রুম হতে একটা কাঁচের গ্লাস ভাঙ্গার শব্দে সবাই দৌড়ে যায়। সে বিছানায় বসেই গর্জে যাচ্ছে,
– “এভরিবডি নোস আই হেইট এপল জুস!”
বলেই রাফসান রাগে ফোঁসাচ্ছিলো। চোখগুলো লাল হয়ে আছে। রাফসানকে আপেলের জুস দেওয়ায় সে গ্লাস টাই ভেঙ্গে ফেলেছে। কারন সে অরেঞ্জ জুস খেতে চেয়েছিলো।
রাফসানের মা শায়লা এসব দেখে রায়হান মাহমুদের দিকে ক্রুঢ় দৃষ্টিতে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করেছিলেন ,
-“সামান্য অরেঞ্জ জুসের পরিবর্তে যে ছেলে আপেলের জুসকে কনসিডার করতে পারে না, সে কিভাবে রানুর মতো ভিখারির মেয়েকে নিজের বউ হিসেবে কনসিডার করবে?”
এ প্রশ্নের উত্তরে রায়হান মাহমুদের দ্বীর্ঘশ্বাস ফেলা ছাড়া আর কিছু বলার ছিলো না। মুহূর্তেই তিনি গভীর চিন্তায় তলিয়ে গেলেন!
.
.
বহু প্রজাতির বর্ণিল ফুলে সজ্জিত বাসর ঘরের একমাত্র বিছানায় রানু বসা। ইতিমধ্যেই রাফসান রানুর ঘোমটা হ্যাঁচকা টানে খুলে ফেলেছে। রাফসান রানুর ঘোমটা খুলেই ওর সজল চোখের দিকে দৃষ্টিপাত করলো। ক্রোধ যেনো টগবগে ফুটন্ত জলের ন্যায় ফুটছে তার। সে টলতে টলতে চিৎকার করে বললো,
-” এই ভিখারির মেয়ে! এসব কান্নাকাটিতে লাভ হবে না, আমি এই বিয়ে মানি না, মানবোনা, দরজা খোলা আছে, আপনি স্ব- ইচ্ছায় চলে যেতে পারেন। স্ব ইচ্ছায় গেলে মানে মানে যাবেন আর যদি না যান তাহলে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করে দিবো। তাও যদি না যান তাহলে মে*রে খু*ন করে দিবো। আর তারপর আমি নিজেই…
এসব চিৎকার শুনে রানু ভীত হয়ে কাঁপতে কাঁপতে ফুলশয্যা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো বের হয়ে যাওয়ার জন্য। শংকায় ও উদ্বেগে ওর হাত পা ঠকঠক করে কাঁপছে। মুখ দিয়ে অস্ফূট ধ্বণি জাতীয় কিছু বের হতে গিয়েও আটকে গেলো।
আঠারো, ঊনিশ বছরের এক অশিক্ষিত গোমূর্খ যুবতির কাছে তার স্বামিই সব। এসব মেয়ের সামান্য বুদ্ধি হওয়ার পর থেকেই স্বামি সংসারের কল্পজাল বুনে, রঙ্গিন রঙ্গিন স্বপ্ন সাজায়। রানুও তাই সাজিয়েছে। জন্মের পর থেকে ঠিকমতো খেতে পড়তে পারেনি কোনোদিন। তবুও একটা ভালো স্বামী ও শ্বসুর বাড়ির স্বপ্ন দেখেছে। যত অত্যাচার করাই হোক না কেনো এসব মেয়ে স্বামির ভিটা আঁকড়ে পড়ে থাকে। তাই রাফসান এসব বললেও তার চলে যাওয়ার মতো সাহস হলো না। আবার ঠাঁই বসে কাঁদতে থাকলো। একবার এক বাসায় কাজ করতে গিয়ে চোরের অপবাদ পেয়েছিলো। মিথ্যে চুরির দায়ে ফেঁসে যাচ্ছিলো, তবুও সেখান থেকেই পালায়নি রানু। কারন সে জানতো তার কোনো অপরাধ নেই। গ্রামের মানুষ গর্ভপাত করার মিথ্যে অপবাদ দিয়েছিলো, তবুও সেখান থেকেও পালায়নি ও। কারন জানতো গ্রামের মানুষ মিথ্যে রটনা রটাচ্ছে। আর এখন স্বামি এসব বললেই সে কোথায় যাবে? তাছাড়া শ্বসুরের বারন আছে। রায়হান মাহমুদ বিয়ের আগে রানুকে বলে দিয়েছিলো, প্রথম দিকে রাফসানকে যা ইচ্ছে তা ই যেনো বলতে দেয়, কোনো প্রতিবাদ নয়। ধীরে ধীরে ঠিকই মন গলে যাবে, মন বাঁধাও পড়বে সময়ের পরিক্রমায়। পুরুষ মানুষ নারীদের রুপের চেয়ে ধৈর্য্যে বেশি আকৃষ্ট হয়। এসব রায়হান নিজ জবানে রানুকে বুঝিয়ে শুনিয়েই পাঠিয়েছে।
.
.
রানুকে বিয়ে করতে হবে একথা শোনার সময় কোনো প্রতিক্রিয়া না করলেও, কয়েক দিন পর রাফসান এমন ভাব করছিলো যেনো এই বিয়ে ওর উপর চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। হসপিটাল থেকে বাড়ি ফেরার পরই এক নি:স্বাসে রাফসান বাবাকে জিজ্ঞেস করেছিলো,
– বাবা, আমার ডোনার কে ছিলো? আমি নাকি ম’রে যাচ্ছিলাম? বারো দিন আই সি ইউ তে ছিলাম? আর আমার রেয়ার ব্লাড গ্রুপের এতো এতো ব্লাডই বা কে দিলো? আর তাদের তুমি কি দিয়েছো?
প্রত্তুত্তরে রায়হান মাহমুদ ছেলের মাথায় হাত রেখে আস্তে করে বলেছিলেন,
-” বাবা রাফসান, তোমাকে কে কি বলেছে, তা জানি না, তবে মনে রেখো জন্ম, মৃত্যু আর বিয়ে সব উপরালার হুকুমে হয়ে থাকে। আর তোমার পাঁজরের হাড় দিয়ে যাকে বানানো হয়েছে সে ই তোমার স্ত্রী, তোমার কিডনি ডোনার রানুকে আমি তোমার বউ করে ঘরে আনতে চাই, তুমি যখন মৃত্যুর সাথে লড়ছিলে, তখন আমি রানুর বাবাকে কথা দিয়েছিলাম যে, রানুকে তোমার বউ করে ঘরে আনবো”
তারপর আর পিতৃভক্ত রাফসান কোনো প্রশ্ন করেনি তার পিতাকে। শুধু অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে কি যেনো ভেবে একটা দ্বীর্ঘশ্বাস ফেলে বাবাকে বলেছিলো,
-” তুমি যা ভালো বুঝো তাই ই হবে…”
তবে রাফসান যে রানুকে এত সহজে স্ত্রী হিসেবে মেনে নিবে না তা তিনি রাফসানের চেহারা দেখেই রায়হান সাহেব আঁচ করতে পেরেছিলেন। কারন কথাগুলো শুনেই রাফসানের মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গিয়েছিলো। এমনকি ক্রোধের বশে রাফসান যে আগ্রাসী বা আত্নঘাতীও হয়ে যেতে পারে তাও তিনি ধারণা করেছিলেন। বিশেষ করে বিয়ের পরবর্তী প্রথম কয়েক রাত তাকে ছেলের বাসর ঘরেই দৃষ্টি নিবদ্ধ রাখতে হবে। তাই গোপন ক্যামেরা সেট করেছেন তিনি। ব্যাপারটা লজ্জার হলেও নিরাপত্তার স্বার্থে তাকে এই কাজটি করতে হচ্ছে।
.
.
রাফসানের বাবা রায়হান মাহমুদ এক কথার মানুষ। তার বাবা চাচারা শুণ্য থেকে কোটিপতি হয়েছিলেন এই এক কথার জোরেই। পুরাতন ঢাকায় ইসলামপুরে তাদের কাপড়ের ব্যবসা ছিলো। হোলসেলের পণ্যে কোনোদিন কোনো আউটডেটেড বা নষ্ট পণ্য ঢুকিয়ে দিতেন না। নির্দিষ্ট সময়ে পণ্য ডেলিভারি দিতেন। কারো আস্থাভাজন হলে তার আস্থা রাখতেন। রায়হান মাহমুদও একই স্বভাব পেয়েছেন। ব্যক্তিজীবনেও তিনি একই রকম। রাফসানকে আই সি ইউ তে রেখে তিনি যখন পাগলের মতো কিডনি ডোনার খুঁজছিলেন, তখন রুনার বাবা শাহের আলীকে পেয়ে তিনি যেনো আকাশের চাঁদ পেয়েছিলেন। রুনার ব্লাড গ্রুপ ও কিডনি টিস্যু ম্যাচ হলে ছেলেকে বাঁচাতে তিনি যেকোনো শর্ত মানতে রাজী ছিলেন।
রানুর বাবা শাহের আলী যখন বললেন,
-” স্যার, কিডনি খুঁজতেছেন নাকি? আমার মাইয়ারো বেলাড গুরুপ ও নেগেটিভ”
তখন রায়হান মাহমুদের হৃদপিন্ডের ভেতরটা নতুন আশায় ছলাৎ করে উঠেছিলো।
” আমার রাফসান বাঁচবে তাহলে? আবার চোখ মেলে পৃথিবীর আলো দেখবে? আমাকে বাবা বলে ডাকবে?” এসব বলতে বলতে ডুকরে কেঁদে উঠেছিলো সে। রানুর সাথে রাফসানের টিস্যু ম্যাচ হলে রায়হান মাহমুদের কাছে যদি শাহের আলী তার প্রাণ টাও চাইতো তাও তিনি খুশি খুশি দিয়ে দিতেন। প্রাণপ্রিয় ছেলেকে বাঁচাতে তিনি এতটাই মরিয়া হয়ে উঠেছিলেন যে, রানুকে তিনি শুধু ছেলের বউ বানালেই নয় সাথে সমস্ত সম্পত্তির উত্তরাধীকার বানাতেও টলতেন না। সেজন্যই শাহের আলীকে ফ্ল্যাট ও পঞ্চাশ লক্ষ টাকা প্রদান পূর্বক এতো ধূমধাম করে বিয়েটা সম্পন্ন করলেন তিনি। সারা জীবন ছেলে বাবার কথার অবাধ্য হয়নি, ভেবেছিলেন ছেলে বাবার সিদ্ধান্ত বিনা বাক্যব্যয়ে মেনে নিবে। কিন্তু ছেলে যে এরকম বেঁকে বসতে পারে তা তিনি বুঝতে পেরেছিলেন কোর্ট ম্যারেজের দিন। কাগজপত্রে সাইন করতে গিয়ে রাফসানের হাত কাঁপছিলো। চোখে জল টলমল করছিলো। কিন্তু ভাগ্য মানুষকে কোথা থেকে কোথায় নিয়ে যেতে পারে তা কেবল উপর ওয়ালাই জানেন।
.
.
এত সব শাসানির পরো রানু ঘর থেকে এক বিন্দু সরছে না দেখে কিছুক্ষণ পর রাফসান আবার রানুকে শাসানি দিলো, ক্রোধে উন্মত্ত হতে ফোঁসতে ফোঁসতে বললো,
– “এই! আগামীকাল সকাল পর্যন্ত আপনার সময় বেঁধে দিচ্ছি, সকালে ঘুম থেকে উঠে যেনো আমাদের এ বাড়িতে আপনার চিহ্ন না পাই, আর যদি পাই তাহলে আপনাকে টুকরা টুকরা করে কে’টে বুড়িগঙ্গায়….”
এটুকু বলেই রাফসান ফ্লোরে ধপাস করে পড়ে গেলো।
(চলবে)