#ওঁগো_বঁধু
পর্ব ৬
#জান্নাতুল_মাওয়া_লিজা
স্থান স্বল্পতা সম্পন্ন ঢাকা নগরীর সৌখিন ও সৌন্দর্য পিপাসু মানুষজন বাড়ির সামনে পেছনে বাগান করার স্থান পায় না। তবে অনেকেই ছাদ ও ব্যালকনি গুলোকেই বাগান বানিয়ে সুসজ্জিত রাখে। নানা ধরনের ফুলগাছ, পত্রবাহার কিংবা ক্যাকটাস তারা সযত্নে সাজিয়ে রাখে সেখানে। আর নিজেদের খুশির জন্য আকাশে উড়া পাখিকে খাঁচায় বন্দী রেখে সৌন্দর্য বর্ধন করার প্রচেষ্টা করে। রানুর নিজের জন্য বরাদ্দকৃত কক্ষের ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে দেখতে লাগলো সেই ব্যলকনি। নাম না জানা বহু সুন্দর সুন্দর ক্যাকটাস। হয়তো অনেক দাম হবে এগুলোর। আর একজোড়া লাভ বার্ড; রানু জানে না এগুলোর নাম লাভবার্ড। অর্ধশিক্ষিত রানু এসব জীবনেও দেখে নি। দুটি পাখি দেখতে প্রায় একই ধরনের, তবে একটি স্ত্রী পাখি, অন্যটি পুরুষ। তাদের দুজনের কত প্রেম, কত মিল মহব্বত। কিছু সময় পর পরই একে অপরকে চুম্বনে ভরিয়ে দিচ্ছে। একজন মুখে করে আরেকজনকে খাইয়ে দিচ্ছে। ইশ! কত ভালোবাসা তাদের! তাদেরকে আকাশে উড়িয়ে দিতে পারলে তারা উড়ে উড়ে একে অপরকে ভালোবাসতে পারতো! রানুর ভীষণই হিংসে হলো লাভ বার্ড যুগলের প্রতি। রানু আর রাফসান কোনোদিনই লাভ বার্ড হতে পারবেনা! এত সুদর্শন ও গুণি মানুষের সাথে কিভাবে তার মতো অসুন্দরী, অশিক্ষিত ও গুণহীনের যুগলমিল হয়? এ সম্ভব নয়। রানু ভাবতে লাগলো, ” রানুরা রাফসানকে কেবল দূর হতেই ভালোবাসতে পারে, তবে তা বাস্তবে সফল হতে পারে না কখনো, কারন রাফসানরা কোনোদিনই রানুকে ভালোবাসতে পারে না।
এসব ভাবতেই রানুর দুচোখ পুনরায় অশ্রুপ্লাবিত হলো।
এমন সময় রানুকে ডাকতে এলো বাড়ির কাজের বুয়া কল্পনা। সে শুদ্ধ বাংলায় বললো,
” ভাবি, আপনাকে স্যার দ্রুত রেডি হতে বলেছেন, সে নিজেই আপনাকে নিয়ে ঘুরতে যাবে। ”
রানু ভাবতে লাগলো, এ বাড়ির কাজের বুয়াও হয়তো শিক্ষিত। কত সুন্দর পরিপাটি তার কাপড় চোপড়, বেশ ভূষা ! শ্বসুর মশাই নিজেকে ছোটো মনে করতে মানা করলেও, নিজেকে অনেক ছোটো বোধ হলো তার।
রানু বুঝতে পারলো ননদীনি তটিনি তার সাথে যাবে না। হয়তো পরে কোনো বাহানা বানিয়ে নিয়েছে। এটা স্বাভাবিক। শুধু রাফসান নয়, বরং তার গোটা পরিবারই তাকে মানতে পারছে না, শুধু রায়হান মাহমুদ বাদে। কেউ তাকে পছন্দ করবে না এটাই স্বাভাবিক।
রানু তার পড়নের জামদানী শাড়ীটা পালটে আরেকটা শাড়ী পড়ে নিলো। তার আলমিরা ভর্তি নতুন নতুন শাড়ী আর গহনা। আলমিরা খুলে রানু যেনো গোলক ধাঁধায় পড়ে গেলো। সবগুলো শাড়িই এত সুন্দর! তবে তার গায়ের অনুজ্জ্বল শ্যামলা বর্ণের সাথে কোন রং যায়, সে সম্পর্কে তার কোনো জ্ঞানই নেই। তবে কমলা তার প্রিয় রং। তাই কমলা রংয়ের একটা সফট সিল্ক শাড়ী পড়ে নিলো । ঠিকমতো শাড়ীও যে সে পড়তে পারে না। কোনো ক্রমে বিশ পঁচিশটা কুঁচি দিয়ে পেটিকোটের ভেতরে শক্ত গাঁথুনি দিয়ে নিলো, কিন্তু নিচের দিকে যে অসমান আর অসমন্তরাল হয়ে আছে সেদিকে তার খেয়াল নেই। বরাবরের মতো লম্বা আঁচল বের করে মাথায় ঘোমটা টেনে নিলো। বস্তিতে থাকাকালীন সে সুতি থ্রি পিস পরিধান করতো। সিল্ক, কাতান, জর্জেট, শাটিন ইত্যাদি সম্পর্কে তার ধারণা নেই বললেই চলে। আর প্রসাধনি সম্পর্কে তার নূনতম জ্ঞানও নেই। শুধু তেল, স্নো, পাউডার, আলতা আর লিপস্টিক চেনে সে। বিয়ের দিন তাকে বড় পার্লার থেকে মেয়ে এনে সাজানো হয়। কিন্তু সে বুঝতে পারছিলো না, তাকে কি করা হচ্ছে! এত কিছু কেনো মাখছে তাকে?
দ্রুত চুলগুলো তেল দিয়ে আঁচড়ে, ঠোঁট ভর্তি লিপস্টিক দিয়ে, হাতভর্তি চুড়ি পড়ে, সে নিচে এলো।
এসেই সে অবাক। রাফসানও এসেছে। পরনে কালো ট্রাউজার ও কালো টি শার্ট। কানে হেডফোন গোঁজা। মনের ভেতরে পুষে রাখা শোকের বহি:প্রকাশই তার এ কালো গেইট আপ নাকি? রানু খেয়াল করলো, বিয়ের শেরওয়ানী খোলার পর থেকে রাফসান শুধু কালো পোশাকই পড়ছে। রাফসানের দৃষ্টি নিচের দিকে আবদ্ধ। সে একবারের জন্যও রানুর দিকে বা কারো দিকেও তাকালো না। সে যেনো কোনোকিছু না দেখবে, না শুনবে! সে যেনো ডুবে আছে অন্য কোনো ভাবনার বিশাল সাগরের গহীনে।
রানু বুঝতে পারলো, নিশ্চয়ই শ্বসুর আব্বা তাকে অনেক বুঝিয়ে সুঝিয়ে এনেছে।
তবে রাফসানের মুখে বিষন্নতার কালো ছায়া দেখে রানুর বুকটা ধুকপুক করে উঠলো।
রাফসানের দুই বোন মেহরোজ ও তটিনি সেখানে ছিলো। রানুকে দেখেই দুই বোনই কৌতুকের হাসি হাসলো। রায়হান মাহমুদ আবার দেখে না ফেলে, তাই করতলে নিজেদের মুখ তারা লুকালো, লুকিয়ে ফিশফাশ করতে লাগলো। তবে যাকে দেখানোর সে ঠিকই দেখলো, তার প্রতি চলা এ কৌতুক।
মেহরোজ তটিনিকে ফিশফিশ করে বললো,
” হাউ ক্রিঞ্জি ইজ শি! জু তে ছেড়ে দিলে এক বিরল প্রজাতীর প্রাণির খেতাব সে পেতে পারতো!
এভাবে কে শাড়ী পড়ে? আর লিপস্টিক দেখ?”
তটিনি একটা দ্বীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,
“হায় মিসফরচুন! এই বিরল প্রাণিকে বাবা আমাদের বাড়িতে তুলে এনেছে!”
রায়হান মাহমুদ টের পেলেন যে, তার মেয়েরা কিছু ফিশফিশ করে বলছে। অন্য কোনো কিছু কানে না গেলেও ‘বিরল প্রাণি’ শব্দটা সে স্পষ্ট শুনতে পেলো। সে বুঝতে পারলো রানুর সাজগোজ নিয়ে তার দু কণ্যার মধ্যে কানাঘোষা শুরু হয়েছে।
রায়হান মাহমুদ সটান চোখে মেহরোজের দিকে চাইলেন। মেহরোজ কেঁপে উঠলো বাবার এ চাহুনীতে। তারপর অলঙ্ঘণিয় আদেশের স্বরে রায়হান মাহমুদ বললেন,
” মেহরোজ, গো এন্ড বি রেডি হার , হারি আপ!”
মেহরোজ মিনমিনে স্বরে বাবাকে বললো,
” হোয়াই মি পাপা? আমার কাজ আছে, ইউ নো! আর সে তো তার মতো করে রেডি হয়েই এসেছে? আমি কি ওর চামচা? ”
চামচা শব্দটা উচ্চারনের সাথে সাথেই রায়হান মাহমুদ চোখ উত্তপ্ত করে বললেন,
” ইটস মাই অর্ডার! ”
মেহরোজ বাবার কড়া চোখের ভাষা বুঝতে পারলো, যা অগ্রাহ্য করার উপায় তার নেই। সে জানে এর পর কোনো কথা বললে কপালে খারাবি আছে। এত বড় হয়েও বাবার হাতের মা’রের ভয় তার মন থেকে বুযেনি। মেহরোজ নিজের জীবনে বাবার মতো স্ট্রিক্ট মানুষ সে জীবনেও দেখেনি।
কর্মজীবনে নিজের অধীনস্তদের সে যেমন দাপটবলে কাবু করে রাখতেন, পারিবারিক জীবনেও সে তেমনি। পরিবারের সবাই তার আদেশের দাস যেনো। তার নিজের মা বাবাও( রাফসানের দাদা-দাদী) তাদের ছেলের কথায় উঠে বসে। শুধু রাফসানের ছোটো ভাই রুহশান আর তার মা শায়লা তার নিয়ন্ত্রণের বাইরে। তাই মেহরোজ আর ঝামেলা না বাড়িয়ে রানুকে তাকে অনুসরন করতে বলে এগিয়ে চললো।
মেহরোজের নিজের কক্ষ হতে প্রায় বিশ মিনিট পর রানু একটা আসমানী, বেগুনী শেইডের থ্রিপিস পড়ে হালকা অর্ণামেন্ট ও সাজে বের হয়ে এলো।
এবার রানুকে দেখে রায়হান মাহমুদ সন্তুষ্টির হাসি দিলেন।
রায়হান মাহমুদের অনুসরনে সে লিফটে করে নিচে এলো, ড্রাইভার গাড়ি নিয়ে দাঁড়িয়েই ছিলো। রাফসানের মুখে টু শব্দও নেই। তার মনোযোগ তার হেডফোনেই নিবিষ্ট। তিনজনেই গাড়িতে উঠে বসলো। ঢাকা শহরের বিশেষ বিশেষ কয়েকটা সুন্দর জায়গা ঘুরিয়ে একটা ফাইভ স্টার রেস্টুরেন্টে এলো গাড়ি। রানু এতদিন ঢাকা শহরে বাস করলেও ঢাকার এ অংশটুকুর সৌন্দর্য সে কোনোদিন দেখেনি। সে শুধু দেখেছে কদর্য অংশ টুকু। ঘিঞ্জি বস্তি, অপরিস্কার, অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ, মশা, মাছি, তেলাপোকা, ছারপোকার উপদ্রব। খাবার ও পানির অভাব, মাথা গোঁজার ঠাঁই এর স্বল্পতা, রোদ, বৃষ্টি, ঝড় মাথায় করে বাস করা।
আর সে এখন যেখানে থাকছে আর ঘুরে বেড়াচ্ছে সেসব যেনো ভূ-স্বর্গ। শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত পরিবেশ, চোখ ধাঁধানো আলোকসজ্জা ও আড়ম্বরতা।
রানু এত বড় রেস্টুরেন্ট জীবনেও দেখেনি। আজ দেখার সুযোগ হলো। বিস্ময় ও কৌতুহল নিয়ে তাকিয়ে দেখতে লাগলো সে চারপাশ৷ বিরাট খাবার টেবিল ভর্তি করে খাবার এলো। এতসব আইটেম রানু বাবার জন্মে দেখেনি।
গোটা ভ্রমণ জুড়ে রাফসানের মুকে নূণতম হাসিও ছিলো না। এখনও নেই।
রানু খুব বিব্রত বোধ করলো। নিজেকে এই দুই ভদ্রলোকের সাথে বড়ই বেমানান মনে হচ্ছিলো তার।
.
.
মাহমুদ’স প্যালেসে দুই ননদ জলি মাহমুদ ও মলি মাহমুদের সাথে তাদের ভাবি শায়লা মাহমুদের কথোপকথন চলছে।
জলি মাহমুদের চোখে মুখে অপমানের গ্লানী। নিজের মেদ ভুঁড়ি সম্বলিত বিশাল দেহটাকে সে থিতু করে বিশাল এক বিনব্যাগে বসে আছে। সে তার ভাবিকে উদ্দ্যেশ্য করে বলতে থাকলো,
” কি থেকে কি হয়ে গেলো শায়লা ভাবি? ভাইয়ের ব্রেইন ওয়াশ হয়ে গেছে। বাড়ির দাঁড়োয়ানের বউ হওয়ার যোগ্যতা যার নেই, সে কিনা এ বাড়ির ছেলের বউ হয়ে এসেছে!”
মলি মাহমুদ বলে উঠলো,
” আবার একেই ভাইয়া মাথায় তুলে তুলে রাখছে। এত আদর! এত আপ্যায়ন! যেনো ও কোনো রাজার ঘরের রাজকণ্যা!”
শায়লা দাঁত কটমট করে বলে উঠলো,
” ভিখারির ঘরের ভিখারি! আমাকে না জানিয়েই তোমার ভাই যখন ওই ভিখারির সাথে কন্ট্রাক্ট সাইন করে, তখন ভেবেছিলাম আগে কিডনি দিয়ে নিক, পরে ওদেরকে টাকা দিয়ে বিদায় দেবো। পঞ্চাশ লাখের জায়গায় এক কোটি দিলেই ওরা বদলদাবা করে বিদায় হয়ে যেতো। কিন্তু তোমার ভাই কি করলো? বিয়ের দিন পর্যন্ত ধার্য করলো। একবার কোর্টে বিচারকের সামনে বিয়ে দিলো। যেনো সে বিয়ে কেউ সহজে ভাঙ্গতে না পারে। আর পরের বার দিলো ফার্মহাউজে, লোকজন দাওয়াত করে, আয়োজন করে, ঢাকঢোল পিটিয়ে। হাজার মানুষ দাওয়াত করলো, আর আসলো কে? চামচিকা? মান সম্মানের ভরাডুবি? জানো না সোসাইটিতে এতদিন আমার যে স্ট্যাটাস ছিলো, সব স্পয়ল করে দিয়েছে তোমার ভাই! এখন কারো সাথেই আগের মতো মিশতে পারি না। মিশবোই বা কিভাবে? কোনো মুখই রাখেনি যে সে আমার! লজ্জা! লজ্জা আর লজ্জা! ”
মলি বলে উঠলো,
” এখনো সময় আছে ভাবি, রাফসানের মুখের দিকে দেখেছো? ছেলেটা দুইদিনেই কেমন শুকিয়ে গিয়েছে! ঐ মেয়ে এই বাড়িতে রাফসানের সাথে আরো কিছুদিন থাকলে, রাফসান নির্ঘাত আবার অসুস্থ্য হয়ে যাবে, তবে এবার রাফসানের হার্ট যাবে! শি ইজ হার্টলেস! ”
শায়লা অনুতাপ করে বলে উঠলো,
” আহা রে! ছেলেটা আমার, বাবার হুকুমে বি*ষপান করেছে ছেলেটা আমার! কতবার বলেছি, তোমার বাবার বুদ্ধিতে চলো না তুমি, কিন্তু মায়ের কথা শুনেনি, এখন কত বড় সর্বনাশটা হয়ে গেলো! ছেলেটার লাইফ হেল হয়ে গেলো! ”
মলি বলে উঠলো,
” ভাবি, যে পর্যন্ত ঐ ব্লাডি বেগারের বাচ্চাকে এ বাড়ি থেকে বিদায় না করতে পারছি, ততদিন আমি আর যাবো না এ বাড়ি ছেড়ে! ”
জলি বলে উঠলো,
” আ’ম উইথ ইউ মলি, নিজের ভাইপোকে এভাবে বিপদে রেখে আমিও যাবো না, তাছাড়া, আমাদের বাচ্চারা তো সব দেশের বাইরের থাকে! আমার স্মেলি আগামী মাসেই গ্র্যাজুয়েশন শেষ করে দেশে ফিরবে! ”
শায়লা বিস্ময়ে বলে উঠলো,
” মাত্র দু বছরেই গ্র্যাজুয়েশন শেষ? আমার রুহশানের তো চার বছর হয়ে গেলো?”
জলি দ্বীগুন আনন্দে আত্মহারা হয়ে বললো,
” মেয়ে আমার এত বেশি ট্যালেন্ডেড যে চার বছরের কোর্স দু বছরেই শেষ করে নিয়েছে! ওর সাথে রাফসানকে বড্ড মানাবে? তাই না ভাবি?”
শায়লা একটা ঢোক গিলে বললো,
” তা তো বটেই!”
( চলবে)