ওঁগো বঁধু পর্ব-০৮

0
2

#ওঁগো_বঁধু
পর্ব ৮
#জান্নাতুল_মাওয়া_লিজা

বাসায় প্রবেশ করেই শায়লার উত্তেজিত কন্ঠস্বর কর্ণগোচর হওয়া, এটা রায়হান মাহমুদের জীবনে নতুন কিছু নয়।

তার গোটা জীবনের বেশিরভাগ সিদ্ধান্তেই দ্বীমত করেছিলো শায়লা। তাই দাম্পত্ত কলহ প্রায় নিত্তনৈমিত্তিক ব্যাপার ছিলো তাদের জীবনে।

তবে আজ শায়লার কন্ঠে একটু বেশিই ঝাঁজ পাচ্ছে সে। কারন সাথে তার নিজের সহোদর দু বোনও যুক্ত রয়েছে।

তারা তিন জনই বিষন্ন বদনে ড্রয়িং রুমে বসে আছে।

শায়লার গোলগাল ফর্সা চেহারাটা রক্তবর্ণ ধারণ করে আছে। সে সোফায় বসে ক্রমাগত দু পা নাড়াচ্ছে। ভেতরে ভেতরে সে ভীষণই অস্থির, যা তার সর্বাঙ্গের হেলদোল দেখলেই স্পষ্ট প্রতিয়মান হচ্ছে।

রানুকে নিয়ে ভেতরে প্রবেশ করামাত্রই শায়লা স্বামিকে উদ্দ্যেশ্য করে বাঁজখাঁই স্বরে শায়লা বললো,

” দাঁড়াও! কথা আছে”

রায়হান মাহমুদ দাঁড়ালো। রানুও থতমত খেয়ে দাঁড়ালো। শায়লার চিৎকার শুনে তার পা কাঁপছে।

শায়লা পুনরায় জিজ্ঞেস করলো,

” রাফসান কোথায়? ”

রায়হান মাহমুদ আমতা আমতা করে বললো,

” ওর ফিরতে দেরি হবে, ওর এক ফ্রেন্ডের সাথে মিট করতে…”

শায়লা রায়হান মাহমুদের মুখ থেকে কথা কেড়ে নিলো।

” জানি, সাইকিয়াট্রিস্ট এর কাছে গিয়েছে, তুমি যা শুরু করেছো, শুধু সাইকিয়াট্রিস্ট না, ওকে পাগলা গারদে…”

এবার রায়হান মাহমুদ শায়লাকে থামিয়ে বলা শুরু করলো,

” আমি কি করা শুরু করেছি আবার?”

শায়লা ভারিক্কি স্বরে বলা শুরু করলো,

” এনাফ, রায়হান এনাফ! প্রথমত একার সিদ্ধান্তে এই মেয়েকে আমার ছেলের সাথে বিয়ে দিয়েছো, তা ঠিক আছে, আমি চুপ করে ছিলাম, কিচ্ছুটি বলিনি। ওর বাবাকে নগদ পঞ্চাশ লক্ষ টাকা, কোটি টাকার ফ্ল্যাট, গাড়ি দিয়েছো, তাও ঠিক আছে, তাও মানলাম, কিচ্ছুটি বললাম নাহ! এসব নাহয় ঐ ছোটোলোক ফকিরের শর্ত ছিলো, তবে কোন শর্তে তুমি ওরে এই বাড়িতে এনে এরকম কোলের উপর বসিয়ে পোষা বিড়ালের মতো আদর করছো বসিয়ে বসিয়ে?”

রায়হান মাহমুদ এহেন উত্তেজিত কন্ঠস্বরের বিপরীতে অতি নম্র স্বরে উত্তর করলো,

” বাড়ির বউকে বাড়িতে রাখবো না, তো কি বাইরে রাখবো নাকি?”

বেশি রাগলে জলি মাহমুদ তোঁতলায়। সে তোঁতলাতে তোঁতলাতে বলে উঠলো,

” হ..হ..হ্যাঁ, ব..ব..বাইরে রাখবে না তো বাসায়? হাউ পসিবল? ওর মতো আনকালচার একটা মেয়ে কিভাবে এই পরিবারের সাথে থাকে? পরিস্কার পরিচ্ছন্নতা, ডাইনিং টেবিল ম্যানার, কারো সাথে কথা বলার ম্যানার, কিচান ম্যানার, সোসাইটির মানুষের সাথে চলাফেরার ম্যানার, এসব কোনো কিছু কি জানে সে? না আছে অক্ষর জ্ঞান আর না আছে আর কোনো একটা বাস্তবসম্মত জ্ঞান। সবকিছুর একটা সামঞ্জস্য আছে তো ভাইয়া, তাই না?”

মলি মাহমুদ বড় বোন জলি মাহমুদের সাথে তালে তাল মিলিয়ে বলে উঠলো,

” ও এখানে আমাদের সাথে একই টেবিলে খাবে, একই সাথে থাকবে! এসব হয়না। তখন আমি, আমরা, তুমি আমরা সবাই ইমোশনাল ছিলাম, ইমোশনে পড়ে আমরা এই বিয়ের ব্যাপারে রাজীও হয়ে গিয়েছিলাম, কিন্তু এখন তুমি ডিপলি থিংক করো তো একটু, তুমি নিজে কি ইচ্ছে করলেই এখন একজন ভিক্ষুকের সাথে বন্ধুত্ব করতে পারবে? এই পজিশনে থেকে? তার সাথে একসাথে খেতে পারবে? শুতে পারবে? তুমি যদি না পারো তবে আমরাও পারবো না। আর তোমার রাফসানও পারবে না! ওর উপর দিয়ে কি যাচ্ছে জানো তুমি? বুঝো তুমি? কেমন বাবা তুমি? ”

এবার রায়হান মাহমুদ ক্ষেপে গেলো,

” গত চল্লিশ দিন আগে যে ছেলে আই সি ইউ তে মৃত্যুর সাথে লড়ছিলো, তখন তোরা কই ছিলি? কই ছিলো তোদের এসব লেকচার? সেদিন এই ভিখারীর মেয়ে রানু যদি কিডনি না দিতো আজ রাফসানের কবরে ঘাস গজিয়ে যেতো!

শায়লার দিকে আঙ্গুলি নিক্ষেপ করে বললেন,

“আর তুমি শায়লা! ছেলেকে হারিয়ে শোক মানাতে আজ। সেটাই কি তাহলে ভালো ছিলো? আমি বুঝলাম, সেটাই তাহলে ভালো হতো! জীবিত রাফসানকে চোখের সামনে হাঁটতে চলতে দেখে তোমাদের মোটেই ভালো লাগছে না বুঝেছি, মৃত রাফসানই তোমাদের কাম্য ছিলো। এই মেয়েটার দিকে তাকাও, হতে পারে ওর বাবা ফকির, তাই বলে ও কি বিধাতার সৃষ্টি নয়? ও নিজের জীবনকে ঝুঁকিতে ফেলে একটা কিডনি কি বিলিয়ে দেয়নি? তাহলে ওকে মানতে এত সমস্যা কেনো তোমাদের?”

মলি মাহমুদ বলে উঠলো,

” ভাইয়া, তুমি ওর বাবাকে প্রয়োজনে আরো এক কোটি টাকা বেশি দিয়ে দিতে। তাও রাফসানের অমতে বিয়ে ঠিক করার চুক্তিতে সাইন করা তোমার ঠিক হয়নি। এই দেখো রাফসানের ফোনও অফ। ড্রাইভারকেও সে ফেরত পাঠিয়ে দিয়েছে। ও মিথ্যে বলেছে। সে কোনো সাইকিয়াট্রিস্ট এর কাছেও যায়নি। কোথায় গিয়েছে তা কেউ জানে না, কখন ফিরবে তার কোনো ঠিক নেই!
শুধু একটা মেসেজ পাঠিয়েছে সে, সে আর এ বাড়িতে থাকবে না, ওর নি:স্বাস বন্ধ হয়ে আসছে।

এত সব কথাবার্তা শুনে বিশেষ করে রাফসানের নিঁখোজ হওয়ার খবর শুনে রানু ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো,

” শ্বসুর আব্বা, আপনারা আমাকে অনেক দিয়েছেন, আমি আপনাদের কাছে কৃতজ্ঞ। আমাকে এবার যেতে দেন। আমি এই বাসায় থাকলে আপনাদের এত সমস্যা, আমি আগে বুঝি নাই, জানি নাই। এত বুঝার মতো আমার বুদ্ধিও নাই। আমাকে ছোটো ভেবে মাফ করবেন। তবে আমাকে এখন আমার মা বাবার কাছে রাইখ্যা আসেন। জান গেলেও আমি আমার বাবা মারে এসব কিছুই বলমু না। বলমু যে আমি এমনিতেই আসছি। তারপর ঐখানেই থাইকা যাইমু, বা অন্য কোথাও চইলা যাইমু। তবুও আপনাদের কষ্ট আমি চাই না!”

জলি মাহমুদ রানুর এসব কথা শুনে সাথে সাথে নিজের ভাইয়ের কাছে এসে বলল,

” ভাইয়া দেখছো, এই মেয়েও থাকতে চায় না। তেল আর জল যে কোনো কালে মেশে না তা এ ও বুঝে গেছে, পারলে ওর মোহরানা যে পঞ্চাশ লাখ টাকা, সেটা সহ ওর সব গহনাগাটি দিয়ে ওকে ওর বাবার কাছে দিয়ে আসো। ও সারা জীবন পায়ের উপর পা তুলে কাটিয়ে দিতে পারবে। ইচ্ছে করলে আরেকটা বিয়েও…

এবার যা ঘটলো, তা জলি মাহমুদ কল্পনাও করতে পারলো না। সপাৎ করে এক চ’ড় বসলো তার গালে রায়হান মাহমুদের দিক হতে।

জলি নিজের গাল চেপে ধরে বলে উঠলো,

” ভাইয়া…!

শায়লা অগ্নিশর্মা হয়ে এলো,

” রায়হান! আজ বেশি করলে তুমি…”

ঠিক সে সময় বাড়ির উপর তলা থেকে নেমে এলেন বাড়ির বয়োজেষ্ঠ্য দুজন নাজিম মাহমুদ তালুকদার ও মিনারা মাহমুদ তালুকদার।

মিনারা বলে উঠলো,

” চুপ যাও বউমা! মুখে মুখে খালি তর্ক তোমার! কোনোদিন শ্বসুর শাশুড়ীর খেদমত করেছো তুমি? না স্বামির জন্য এক গ্লাস পানি না নিজের জন্য এক গ্লাস পানি ঢেলে খেয়েছো? ছোটোবেলায় ছেলেমেয়ের কোনো সেবা করছো? বা কোনোদিন রান্না করে কিছু খাওয়াইছো? ছেলে অসুস্থ ছিলো, না ওর কোনো সেবা যত্ন করেছো? আর এই মেয়ে রানু বিয়ের রাতেই নিজের স্বামিকে পাঁজাকোলা করে হসপিটালে নিয়ে গেছে। সারা রাত কেঁদে দোয়া করেছে স্বামির জন্য। আমি সেদিনই বুঝে গিয়েছিলাম, এ মেয়ে কি জিনিস! কালো হলেই কি? বিয়ের আগেই আমি এ মেয়ে দেখেছিলাম। এ মেয়ের চোখে মুখে এক অদ্ভূত মায়া কাজ করে। যা তোমার ধলা ফুরফুরা বদনে আমি কোনোদিন দেখিনি!”

শাশুড়ীর এসব কথাবার্তায় শায়লা রাগে কাঁপতে লাগলো, রায়হান মাহমুদের দিকে চেয়ে বললো,

” রায়হান! তোমার মা কিন্তু আমাকে যার পর নাই, অপমানিত করছে। আমি কত বড় ঘরের মেয়ে, তা সে ভালো করেই জানে। আর আমাকে সে এসব বলে?”

শায়লাকে থামিয়ে নাজিম মাহমুদ বলে উঠলেন,

” শুধু বড় ঘর, বড় ঘর করো, জানি তোমার বাবা, ভাই বিশাল বড়লোক। তবে মনটা তোমার বড় না বউমা। তোমার কাছে বিয়ে মানে কাঁচের পুতুল হতে পারে, তবে এই ভিখারির মেয়ে রানুর কাছে না। এদের জীবনে বিয়ে একবারই হয়, একজনকেই এরা আমৃত্যু স্বামি হিসেবে জানে। জেনে রাখো। রাফসান আরো তিনটা বিয়ে করলেও এই মেয়ে রাফসানকেই নিজের স্বামি বলে মেনে শ্রদ্ধা, সম্মান করবে। ”

নাজিম মাহমুদ অত:পর রায়হান মাহমুদের দিকে চেয়ে বললেন,

” বাবা রায়হান, এমনিতেই এই বাড়িতে আমার মন টেকে না। সারাক্ষণ এসির বাতাস আমার ভালো লাগে না। আমার আমি চাই আজ হতে এই রানুকে নিয়ে আমাদের সাভারের বাড়িতে গিয়ে উঠবো। শীতলক্ষ্যা নদীর তীরের বাতাস ঐদিকে খুব আসে। জায়গাটাও সুন্দর। গ্রাম না হলেও প্রায় গ্রামীন পরিবেশ। আমি আর তোমার মা রানুকে নিয়ে ঐ বাড়িতেই চলে যাচ্ছি। শায়লা, তোমরা থাকো এখানে সুখে শান্তিতে। ”

রায়হান মাহমুদ মা বাবার এ প্রস্তাব মেনে নিলেন সুন্দরভাবে।

তবে রাফসানকে আগে খুঁজতে হবে, কোথায় আছে সে?

( চলবে)