ওঁগো বঁধু পর্ব-১০

0
7

#ওঁগো_বঁধু

পর্ব ১০

#জান্নাতুল_মাওয়া_লিজা

কে? কে এসেছে গেইটে?

রানুর ভেতরের অস্থিরতা তার পায়ে ভর করলো। দৌড়ে গেলো প্রধান ফটকের কাছে। হ্যাঁ! সেই মানুষটি এসেছে, তার প্রাণের স্বামী এসেছে যে।
রানু জানে রাফসান তাকে নয়, তার দাদা দাদীকে দেখতে এসেছে। সে তাকে স্বামি মানলেও স্ত্রী তাকে কোনোদিনই মানবে বা রাফসান। রাফসান যে এখানে আসবে তা রানুর চিন্তাতে আগে থেকেই বিরাজ করছিলো। তবে এতো দেরিতে গোটা একটা সপ্তাহ পার করে যে আসবে তা সে ভাবেনি।
রাফসান হয়তো এই সাত দিনে তাকে ভুলেই গেছে। যাকে মনেই নেয়নি তাকে আবার ভুলে যাওয়া কি?
সে তো রাফসানের চিন্তারো বাইরে।

এসব ভাবতে ভাবতেই দরজার কী হোল হতে চোখ সরিয়ে সে ফিসফিসিয়ে মালতিকে ডাকলো।

” মালতি বুবু..”

মালতি এ বাড়ির কাজ করে।
রানু এ বাড়িতে আসার পর থেকে তাকে মালতি বুবু করেই ডাকে।

মালতি দরজা খুলতেই রাফসান স্ত্রস্ত পায়ে ভেতরে প্রবেশ করলো।

” এতো দেরি করলি, সামান্য এই গেইট খুলতে?”

রাফসানের কন্ঠে বিচলতা।

রানু রান্নাঘরের ভেতরে দৌড়ে পালালো। রানু আর কোনোদিন যে মানুষটার সন্মুখেও যেতে চায় না। সে আর কারো মর্মপীড়ার কারনও হতে চায় না। রানু রাফসানের জীবন থেকে চলে গেছে, তাকে এটাই জানতে দেওয়া হোক! এই অনুরোধই রানু করেছে রায়হান মাহমুদ তালুকদারকে। রায়হান মাহমুদ তালুকদার রানুর এমন কথা মানতে মোটেও রাজী হয়নি। রানু তার বাবা মায়ের কাছেও চলে যেতে চেয়েছিলো একেবারে, সেকথাও রায়হান মাহমুদ মেনে নেয়নি। তবে কিছুদিনের জন্য এই আশুলিয়ার ফার্মহাউযে তাফ বৃদ্ধ বাবা মায়ের সাথে রাখার অনুমতি দিয়েছে মাত্র।

” ভাইজান আপনে? আছেন কেমন?”

মালতির এহেন প্রশ্নের উত্তর এলো না রাফসানের নিকট হতে। রাফসানকে উদভ্রান্ত দেখালো। তার চোখ দুটি যেনো নিভে আছে। আর মুখটাও নিস্প্রান। শুকনো ঠোঁট দ্বয় জিহবায় ভিজিয়ে সে বরঞ্চ উলটো প্রশ্ন করলো,

” দাদা, দাদী কোথায় রে মালতি? ”

মালতি ঘড়ির দিকে চেয়ে হাস্যোজ্জল মুখে বললো,

” ভাইজান নয়টার উপরে বাজে তো, দাদা-দাদী তো, রাতের খানা খেয়ে নামাজ পড়ে, মাথায় তেল দিয়ে ঠান্ডা মাথায় ঘুমায়া গেছে। এক্কেবারে তাহাজ্জুতে উঠবো, জানেনই তো! ”

রাফসানকে ভীষণই চিন্তিত মনে হলো। কপালের ভাঁজগুলো দূর থেকেও স্পষ্ট দেখতে পারছে রানু।

আসলেই তো, এ কোন সময়ে এলো সে? দুনিয়া উল্টাপাল্টা হয়ে যাবে, তবে দাদা দাদীর তাড়াতাড়ি ঘুমানোর কোনো হেরফের হবে না।

এ কয়দিনে দাদা দাদীকে দেখতে আসার জন্য সময় হয়ে উঠেনি তার। সারাদিন শুধু বিভিন্ন টেস্ট করাতে করাতেই দিন চলে গিয়েছে। সেনাবাহিনীর মতো ডিফেন্স বাহিনীতে একদন আনফিট কাউকে কর্মরত রাখবে না! তার গোটা শরীরের সব রিপোর্ট হাতে পেয়ে সে পুনরায় চাকরিতে প্রবেশের অনুমতি পায়নি। কারন এখনো সে ততটা সবল হয়ে উঠতে পারেনি।
তারপরো সব রিপোর্টের উপর ভিত্তি করে তাকে পুন:নিয়োগ করা যেতে পারে। সে সম্পর্কে রাফসান আশাবাদী।

দাদা দাদীর সাথে দেখা করতে পারেনি এজন্য রাফসানের মন ভীষণ খারাপ। এ সাত দিনের প্রতিটি দিনগুলো কাটতো তার বিভিন্ন টেস্ট করিয়ে। আর রাত হলেই চোখে ক্লান্তি। তবে ক্লান্তিকর ঘুমে সঙী হয় নানা ধরনের দু:স্বপ্ন।

” ভাইয়া কি খাইয়া আইছেন? না খাইয়া থাকলে ডায়নিং এ খাবার আইনা দেই, খাইয়া, শুইয়া পড়েন, সকালে উইঠা দাদা দাদীর লগে স্বাক্ষাত কইরেন”

মালতির প্রশ্নে রাফসানের অনুভুতি হয় যে, রাফসানের পেটভরা ক্ষুধা ততক্ষনে।

সে দ্রুত হাত ধুয়ে ডায়নিং এ বসে গেলো।

সব খাবার আইটেম এসে হাজির হলো।

রাফসান চেটে পুটে দ্রুত খাওয়া সাঙ্গ করে, রানু দূর হতে দেখছিলো রাফসানের এ তৃপ্ততা।

রাফসান প্রসন্ন বদনে জিজ্ঞেস করলো,

” বহুদিন পর দাদীর হাতের রান্না খেলাম! কি যে মজা হয়েছে! তবে কি রে মালতি, দাদী দেখি এখানে এসে নিজেই রান্না করে! ঐ বাসায় তো সুস্থ্যই থাকে না, এখানে এসে দিব্যি রান্নাও করছে তাহলে?”

রাফসানের এহেন প্রশ্নে মালতি না বুঝেই সব বলে দিলো,

” দাদী তো রান্ধে নাই, হে কি আর রান্ধা পায়? বয়স হইছে না? ভাবিজান সব রাঁনছে”

“ভাবিজান? কে সে? নতুন কাজের কেউ?

“না না, ভাবিজান, আপনার বউ, রানু ভাবি!”

রাফসানের চোখ রাগে খুবলে উঠলো,

” ঐ মেয়ে এখানে উঠেছে?”

” ভাই, মেয়ে মেয়ে করছেন কেন? ভাবি তো উনি! ”

রাফসান দ্রুত দাঁড়িয়ে গেলো।

“কোথায় ওকে ডাকো! ডাকো ওকে! ”

রাফসানের চিৎকার শুনে দ্রুত মালতি বলে দিলো ভাবি কিচেনেই আছে। সে বলছে, সামনে আসবে না আপনার।

রাফসান দাঁতে দাঁত চেপে কিচেনের দিকে চলে এলো।

পকেট থেকে একটা চেইক বের করে কি জানি লিখে রানুর নাক বরাবর ঢিল ছুড়লো।

” এই নিন, আপনাকে ব্লাংক চেইক দিলাম। টাকার এমাউন্ট নিজেই লিখে নিয়েন। ভবিষ্যতে আপনাকে যেনো আমাদের ছায়াও মাড়াতে না দেখি!”

রানু গোঙ্গিয়ে কেঁদে উঠলো।

” নাউ গেট লস্ট! আই সে গেট লস্ট রাইট নাউ ”

রানু দৌড়ে বেরিয়ে গেলো, এখন তাকে থামানোর কেউ নেই।

কিন্তু ঠিক তখনি শক্ত একটি হাত রানুকে আটকে ফেললো।

” এনাফ রাফসান, এনাফ! তোমার কথা চিন্তা করে স্বার্থপরের মতো রানুকে আমি ঐ বাড়ি হতে চলে আসার অনুমতি দেই। তবে এখন আমি তোমার আসল রুপটা দেখলাম, আসলে তুমি কোনো অংশেই আমার মতো না, তুমি পুরোটাই তোমার মতো। ঠিক আছে তুমি চলো তোমার রাস্তায় আর আমি আমার রাস্তায়। ”

বাবার এ ধরনের কথায় রাফসান বাইরে চলে গেলো দ্রুত পায়ে। এ বাড়িতে আর কোনোদিনও না। দাদা দাদীকে ছাড়া খারাপ লাগবে, তবে কিচ্ছু করার নেই। দাদা দাদীও যে ঐ হতচ্ছাড়া মেয়েমানুষের পক্ষে।

রায়হান সাহেবও শক্ত অবস্থান নিলেন। রাফসানের নিঁখোজ হওয়ার নাটকে এবার আর তিনি টলবেন না। রানুকে গ্রহণ না করলে প্রয়োজনে ত্যাজ্যপুত্র করবেন ছেলেকে।
.
.

বান্দরবানের নাইখংছড়ি পাহাড়। ধূষর কাঁকরের উপর সবুজের মহাসমারোহ চলে এ পাহাড়শৃঙ্গে। প্রতিরক্ষা বাহিনীর এক হেলিকপ্টার ছুটে চলছে বিশাল বেগে এ পাহাড়েরই উপর দিয়ে।

বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর পাঁচজন প্রশিক্ষনরত কর্মকর্তা এ হেলিকপ্টারে। জংলি রং য়া এ হেলিকপ্টার হতে একে একে প্যারাস্যুট নিয়ে লাফিয়ে পড়ছেন সব সেনাসদস্য।

মেজর রাফসান বিন রায়হান তালুকদার প্রায় সাড়ে চারশ ফিট উচ্চতা হতে ঝাঁপিয়ে পড়লো প্যারাস্যুট নিয়্র। কিন্তু প্যারাস্যুট কোনোক্রমেই খুলছে না।

ঠিক মৃত্যুমুখে পতিত হওয়ার আগেই নিচে অবস্থিত পাহাড়ি লেকে ঝাঁপিয়ে পড়লো সে। দুচোখ বন্ধ হয়ে এসে শ্বাসরোধ হয়ে গেলো পানির চাপে।
যমদূত যেনো নিজের হাতে চেপে ধরলো রাফসানের ফুসফুস, যেনো সামান্য অক্সিজেনও নিতে না পারে সে।

হঠাৎ ই দুধর্ষ ডলফিনের মতো সাঁতারু কেউ একজন এসে জাপ্টে ধরে উঠালো রাফসানকে। বুকে চাপ দিয়ে সি আর পি দিয়ে অত:পর মুখে মুখ চেপে ফু দিয়ে শ্বাস চালু করলো কেউ একজন। রাফসান ধীরে ধীরে চোখ খুললো। শ্যামবদনের এক মেয়ে তার চোখের সামিনে স্পষ্ট হলো।

“একি রানু? তোমার সাহস কিকরে হয়? ”

স্বপ্নের মধ্যেই চিৎকার করে উঠলো রাফসান।

ধড়ফড় করে উঠে বসলো সে। পাশে রাখা গ্লাস হতে ঢকঢক করে পান করে নিলো গোটা একগ্লাশ পানি।

রানু তাকে স্বপ্নেও ছাড়বে না?

না স্বপ্নে রানু তো তাকে বাঁচিয়েছে? বাস্তবের মতোই। এসেছে ভাবতে ভাবতেই রাফসানের ডানহাত চলে গেলো তার বা পাশের কিডনির স্থলে। ওটা তো রানুরই দেওয়া। ওটা তো রানুরই অঙ্গ! যা নিজের বক্ষপিঞ্জরের নিচে বহন করে চলছে সে।

রাফসানের হাত থেকে কাঁচের গ্লাস পড়ে গেলো।

তাজা র’ক্তে ভেসে গেলো সাদা ফ্লোর।

” ওগুলো রানুরই রক্ত? যা আমি প্রতিনিয়ত শরীরে বহন করে চলছি?”

রাফসানের দৃষ্টি স্তব্ধ হয়ে গেলো।

সে দ্রুত সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলো। রানুকে সে সকল মোহরানা পরিশোধ পূর্বক ডিভোর্স দিয়ে দিবে আগামীকাল সকালেই। আর সকালেই সে ইলোরাকে বিয়ের প্রস্তাব দেবে।

ইলোরা তাকে বিয়ে করতে রাজী হবে তো? আর রানু তাকে ডিভোর্স দেবে তো?
এসব চিন্তায় রাফসানের আর ঘুম এলো না সারারাত!

ভোরের প্রকৃতি কেমন হবে, তা রাতের আকাশই প্রায় বলে দিতে পারে। সারা রাত রাফসানের নির্ঘুম কেটে ভোর রাতে যখন সামান্য ঘুম এলো তখনি তার ফোনে মেইলটি এলো। প্রতিরক্ষা মন্ত্রনালয় হতে।

” মেজর রাফসান, ইউ আর নট ইলিজেবল ফর জয়েনিং ইলিভেন্থ আর্মড ফোর্স ব্যাটালিয়ন। ইউ আর সাসপেন্ডেড ফ্রম বাংলাদেশ আর্মি , এজ ইউর মেডিক্যাল কন্ডিশন ইজ নট সাফিসিয়েন্ট ফর জয়েনিং। ”

এ মেইল দেখে রাফসানের মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়লো।

তার এতো শখের চাকরি, আর নেই!

(চলবে)