ওঁগো বঁধু পর্ব-১৩

0
13

#ওঁগো_বঁধু

পর্ব ১৩

#জান্নাতুল_মাওয়া_লিজা

গোমতি নদীর দু:খকে ডিঙ্গিয়ে কুমিল্লা শহর মাথাচাড়া দিয়ে গড়ে উঠেছিলো দুই শতাধিক বছর আগে। বড়ই মনোরোম দেখতে এ নদী কিভাবে কুমিল্লার দু:খ নামে পরিচিত হয়, তা রাফসানের মাথায় আসছে না।
সুবিস্তৃত ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের উপর দিয়ে সজোরে গাড়ি চালিয়ে যাচ্ছে রাফসান।
আপাতত সে-ও এই কুমিল্লা পার হচ্ছে ইলোরার অন্ধকার দিক খুঁজে পাওয়ার কষ্টকে ডিঙ্গিয়ে।
খোদাকে সে ধন্যবাদ জানাচ্ছে যে, ইলোরার প্রতি সে অতটাও দুর্বল হয়ে যায়নি।

সময় সবে ভোর পাঁচটা। আকাশ মেঘাচ্ছন্ন বলে সূর্য দৃশ্যমান না হলেও পূব আকাশ কোনটা তা ঠিকই বোঝা যাচ্ছে আকাশের রং দেখে। রাফসান
বেশ জোরেই চালাচ্ছে গাড়ি। রাস্তা যানজট বিহীন, মাথা ঠান্ডা, রাস্তার ল্যাম্পপোস্ট গুলোর কোমল হলুদ আলো, আর গত হয়ে যাওয়া গতরাতের অতীত সবকিছুই তাকে দ্রুত সামনে পার হয়ে যাওয়ার তাগাদা দিচ্ছে যেনো।

মাত্র বিশ মিনিট হলো ফজরের আযান হয়েছে। একটা মসজিদের গেইটের সামনে গাড়ি দাঁড় করিয়ে রেখে ফজরের নামাজ আদায় করেই রাফসান যাত্রা শুরু করেছে। নামাজ পড়েই মনটা তার এত শান্ত হয়েছে। তাছাড়া ইলোরার ব্যাপারটা হয়তো তাকে এখনো কাঠঠোকরার মতো ঠোকরাতো। তার ফোনটাও ডেড হয়ে আছে গত রাত হতেই। দুদিন আগেই যে হারিয়ে যাওয়ার নাটক করেছে, আজ তাকে আর কে খুঁজবে? তবুও রাস্তার পাশে একটা দোকানে থেকে কিছু অর্থের বিনিময়ে পাঁচ মিনিটের জন্য ফোনটা চার্জ করে নিলো একটা চার্জার কিনে।
বাবাকে কল করে জানানো উচিত যে, সে ঠিক আছে।
তবে ফোন খুলে আহত হলো। যা ভেবেছিলো, তাই ই। বাবা, দাদা, দাদী কেউই কল করেনি তাকে, তবে মা কয়েকবার কল করেছে এমন নোটিফিকেশন পেলো মিসড কল এলার্ট হতে, ভয়েস মেসেজ ও পেলো একটা।

মা শুধু এটুকুই বললো,

” ফোন খুলেই একটা কল দিও, বাবা।”

কাউকেই সে কিছু জানিয়ে আসেনি। শুধু গাড়িটা বের করার সময় ড্রাইভার আলাউদ্দিন মিয়াকে বলেছিলো,
” চাবিটা দেন কাকা, আমি নিজেই ড্রাইভ করবো, আর বাসার কেউ জিজ্ঞেস করলে জানাবেন, আমার ফিরতে দেরি হবে।

মা মেসেজ পাঠিয়ে রেখেছে, তদুপরি রাফসান মা কে কল না দিয়ে বাবাকেই কল দিলো, ফোনটা খুলেই। কারন রাফসান ভালো করেই জানে, অভিমানে প্রকাশ না করলেও, তার জন্য তার বাবাই সবচেয়ে বেশি উদ্বীগ্ন আছে এই মুহূর্তে।

তবে তিন তিনবার কল করার পরো রায়হান মাহমুদ রাফসানের কল রিসিভ করলেন না।

রাফসানের আর বুঝতে বাকি রইলো না যে, বাবার মনটা তার থেকে অন্য কোথাও মোড় নিয়েছে।

বাসায় পৌঁছার পরও রায়হান সাহেব কোনো কথা বললেন না, রাফসানের সাথে।
যে রাফসানের- বাবা একদিকে, আর বাকি দুনিয়া আরেকদিকে; সে রাফসানের প্রতি বাবার উদাসিন্যে মনটা ভেঙ্গে টুকরা টুকরা হয়ে গেলো।

এদিকে সকালে বাসায় ফিরেও রাফসান বাবাকে পেলো না। দু দিন ব্যাপী চলা ঢাকা চেম্বার ইন কমার্সের আন্তর্জাতিক সেমিনারের অতিথি হিসেবে তিনি সেখানে গিয়েছেন।
দুপুরে খেতে বসেও বাবা নেই।
রাতে খাবার টেবিলে বসেও রায়হান মাহমুদ এড়িয়ে গেলেন রাফসানকে। রাফসান অনেকক্ষণ সেখানে বসেই বাবার জন্য অপেক্ষা করলেও কোনো লাভ হলো না। খাবার টেবিলে বসে পুরো সময় জুড়ে তিনি ফোনকলে ব্যস্ত থাকলেন। সুতরাং দুজনের মধ্যে চললো, না কোনো চোখাচোখি আর না কোনো বাক্য বিনিময়।
দ্রুত খাবার খেয়ে রায়হান সাহেব শুতে চলে গেলেন।

অসুস্থ্য হওয়ার পর থেকে বন্ধু-বান্ধবরা খোঁজ খবর নিলেও বিয়ে করার পর তার আর কোনো বন্ধু নেই যেনো। সবাই তাকে এভয়েড না করলেও সে ই সবাইকে এভয়েড করে যাচ্ছে। কারন ভিখারির মেয়ে রানুকে বিয়ে করেছে, সে খবর তো আর কারো কাছে অজানা নয়! আর চাকরি হারানোর পর সহকর্মীদের সাথেও যোগাযোগ বন্ধ।
এভাবে রাফসানের একাকিত্বে যোগ হলো নতুন মাত্রা।
.
.

নির্ভানা আজ হালকা সাজগোজ করেছে। কোমর ছাড়িয়ে যাওয়া লম্বা কেশগুচ্ছ পরিপাটি করে বেঁধেছে। আগে সেগুলো অসমান ছিলো, দাদীই মালতিকে দিয়ে সেগুলো সমান করে কাটিয়ে নিয়েছে। আর রায়হান মাহমুদকেও বলে দিয়েছে তার নতুন নাম নির্ভানা মাহমুদ তালুকদার।
রায়হান মাহমুদ রানুর একটা জন্ম সনদ করিয়ে নিয়েছে। সেখানেও নাম এটাই রাখার জন্য আবেদন করেছে।
অজ পাড়াগাঁয়ে বড় হওয়া রানু এত পরিপাটি থাকারই কি বুঝে? দাদীই তাকে সর্বদা পরিপাটি হয়ে থাকার নির্দেশ দিয়েছে। মালতি তাকে সুন্দর করে শাড়ী ও ড্রেস পড়া শিখিয়েছে। মালতি মেয়েটা কাজের মেয়ে হলে কি হবে, সে অনেক কিছু জানে, একটা পার্লারে কাজ করতো সে আগে।

দাদীর কথাতেই আজ নির্ভানা সুন্দর করে সেজেছে।
কারন তার কাছে দাদীর আদেশ শিরোধার্য।

আয়নার সামনে বেশ অনেকক্ষণ বসে বসে কয়েকদিন আগে মেহরোজ তাকে যেভাবে সাজিয়ে দিয়েছিলো ঠিক সেই অনুকরনেই সাজলো নির্ভানা। মেহরোজ তাকে কিভাবে সাজিয়েছিলো তা সে মনোযোগের সাথে খেয়াল করেছিলো সেদিন।
ওয়ারড্রব হতে স্যান্ড ব্রাউন আর পার্পল কালারের একটা শাটিন থ্রি পিস বের করে নিয়েছে সে। সাথে চোখে কাজল আর ঠোঁটে লিপগ্লস দিয়ে সে নিজেই লজ্জা পাচ্ছিলো দাদা দাদীর সামনে যেতে।

সেজে গুজে দাদা দাদীর সামনে যেতেই তারা দুজনের একপলে বেশ কিছুক্ষণ নাতবউয়ের দিকে তাকিয়ে রইলেন। দাদী তাকে আগলে ধরে বললেন,

” মাশাল্লাহ!”

নির্ভানা লজ্জায় লাল হয়ে গেলো।

গোসলের আগে দাদী তাকে নিজের ব্যবহৃত রুপচর্চার একটা প্যাক বানিয়ে দিয়েছে। এক চা চামচ বেশন, এক চিমটি হলুদ আর এক চা চামচ টক দই। সব কয়টি উপাদান একসাথে মিশিয়ে মুখে বিশ মিনিট করে মেখে রাখলে রোদে পোড়া কালচে দাগ দূর হয়, সাথে ত্বক হয় প্রাণবন্ত ও দ্যুতিময়।

নির্ভানা কে নিজের হাতে মুখে ওসব লাগিয়ে দিতে দিতে দাদী মিতারা মাহমুদ বলেছেন,

” একসময় এগুলা প্রতিদিন মাখতাম, রোদে পুড়ে স্কুলে যেতাম বলে মা এগুলা মাখতে দিতো। স্কুল থেকে ফিরতেই মা ঝাড়ি দিয়ে বলতেন, এগুলা মাখ! তখন চামড়া টানটান ছিলো, শরীরে যৌবন ছিলো, মনে স্ফুর্তি ছিলো, মাখতাম এগুলা। আর এখন বুড়া বয়সে এসব করে কি করবো? এখন মাটির টানে আছি, যখন উপর থেকে হুকুম আসবে, তখন মাটিতে মিশতে হবে! তাই না বুবু?”

দাদীর এসব কথা নির্ভানা মনোযোগ দিয়ে শুনে আর মাঝে মাঝে উত্তর করে।

” দাদী, দোয়া করি আপনি আরো বহুদিন বাঁচেন, আর আপনি কিন্তু এখনো অনেক সুন্দরীই আছেন। তাই না দাদা?”

নির্ভানার একথা শুনে মিতারা মাহমুদ হো হো করে হেসে উঠে। আর নাজিম মাহমুদ বলে উঠলেন,

” হ্যাঁ গো, হাসো কেনো? নাতবউ ঠিকই বলছে তোমারে, তোমার স্কিনে এক চমৎকার জেল্লা আছে। তবে শুধু নাতবউকে একটা রেসিপিই দিলা কেনো? কমলার খোসা দিয়া আর মসুর ডাল আর গোলাপ জল মধু দিয়া কি বানিয়ে জানি মাখতা মুখে, বলো ঐসব, বলো? সারাদিন মুখে খালি একের পর এক মাখতেই থাকতা তুমি, তা কি বলবা না নাতবউকে?!”

বলেই বর্ষিয়ান নাজিম মাহমুদ তালুকদারো হো হো করে হেসে উঠেন।

নির্ভানা তার দাদা ও দাদী শাশুড়ীর এসব রসিকতা মন দিয়ে শুনে আর নির্ভেজাল আনন্দ নেয়। এই বৃদ্ধ মানুষ দুটিকে তার ভীষণই নিষ্পাপ মনে হয়। পরম পূজনীয় এ দুই ব্যক্তির প্রতি শ্রদ্ধায় তার মাথা নত হয়ে আসে। কত বড়লোক এই দুই ব্যক্তি। অথচ নেই কোনো অহংকার আর আত্মগরিমা। বাবা মা, বোনরা তাকে একবারের জন্যও দেখতে আসেনি। ফোনে তারা বলেছে, তারা নাকি কক্সবাজার বেড়াতে গিয়েছে, সমুদ্র দেখতে । টাকা পেয়ে তার আপন বাবা মাও তাকে ভুলে গিয়েছে! এটা নির্ভানাকে যার পর নাই পীড়া দিচ্ছে। আর তার বাবা মারই বা কি দোষ? তার স্বল্প বুদ্ধিসম্পন্ন বাবা মা তো ভাবছে যে, রানু ওখানে ভালোই আছে, রানীর মতো দিনাতিপাত করছে। রাফসান যে তাকে ঘৃণা করছে, এই বিষয়টা শাহের আলী ও ছখিনার মাথায় এক বারের জন্যও আসেনি। কিন্তু সে তার এই প্রাণের মানু্ষ রাফসানের ঘৃণার কারনেই দাদা দাদীকে সাথে নিয়ে আলাদা বাস করছে তা তো আর সে তার বাবা মা কে জানায় নি।

হঠাৎ ই একটা কথায় নির্ভানার ভাবনার দুনিয়ায় ভাটা পড়ে,
” ভাবি আপনি কিন্তু ম্যালা ফর্সাই আছেন, আগে ভাবছিলাম আপনি শ্যামলা । কিন্তু এইখানে আইসা আপনার আপনার নিজের রং ফিরছে! ”

সাহায্যকারী মেয়ে মালতির এই কথার সাথে নাজিম মাহমুদ তালুকদার স্বর মিলিয়ে বললেন,

” হ্যাঁ, নাতবউ, মালতি কিন্তু একদম ঠিক বলেছে। ইংরেজীতে একটা কথা আছে, ইউ আর নট ব্যাডলুকিং বাট ইউ আর পুউর, মানে তুমি দেখতে অসুন্দর ছিলে না বরং তুমি গরীব ছিলে!”

নির্ভানা দাদার কথার অর্থ বুঝতে পারলো, অর্থাৎ মানুষ কখনো অসুন্দর হয়না, বরং সে গরীব। কারন গরীবদের জীবন যাপন প্রণালীই তাদেরকে অসুন্দর বানিয়ে দেয়। জীর্ণ- শীর্ণ বস্ত্র, অযত্নের শরীর, রোদ- বৃষ্টি মাথায় করে বাঁচা, রোগ-শোক, অভাব-অপুষ্টি ইত্যাদির কারনেই একজন দরিদ্র মানুষ অসুন্দর মানুষে পরিনত হয়। তারা যত সুন্দরই হোক না কেনো কালক্রমে ঢাকা পড়ে তাদের গায়ের প্রকৃত রুপ, চেহারার সৌন্দর্য্য ও শারীরিক গড়ন।

নির্ভানার তার মায়ের কথা মনে পড়ে, মা তাকে প্রায়ই বলতো,
” ছোড়োবেলায় তুই ধলা ফুরফুরা ছিলি রে রানুমতি!”

রানু মায়ের একথা শুনে নিজের দিকে তাকাতো আর ভাবতো,

” মা, কই গেলো সেই ধলা ফুরফুরা রং, ওগুলা কি বানের জলে ধুইয়া চইলা গেছে?”

এই প্রশ্নের উত্তরে রানুর দিকে তাকিয়ে তার মায়ের একটা দ্বীর্ঘশ্বাস ফেলা ছাড়া উপায় ছিলো না। কারন কিশোরি মেয়েকে গায়ে দেওয়ার মতো একটা সাবান, চুলে দেওয়ার একটা চিরুনি, আর ভালো একটা সূতির বস্ত্র কেনার সামর্থও তারা রাখে না। এমন অভাবি মানুষদের সৌন্দর্য বানের জলে ভেসে যাবে না তো, কোথায় যাবে?

.
.

হঠাৎ ই ব্যালকনি দিয়ে বাইরে তাকিয়ে নির্ভানা চমকে উঠলো।

রাফসান! তার প্রাণের স্বামি এ বাড়িতে এসেছে! এটা তো রাফসানেরই গাড়ি। না চেনার কোনো কারনই নেই তার। তবে এ বাড়িতে সে কেনো এসেছে? নিশ্চয়ই দাদা দাদীকে দেখতে, নইলে কি আর?

সে তার নিজের কক্ষেই লুকিয়ে গেলো। তার ছায়াও যেনো রাফসানকে না মাড়াতে হয়, রাফসানতো সেকথাই তো জানিয়ে দিয়েছিলো।

হৃদপিন্ডের প্রকোষ্ঠ প্রকম্পিত হলো তার প্রিয় মানুষের এ বাড়িতে আনাগোনায়।

বির্ভানা তার নিজের হৃৎস্পন্দন গুনতে পারছিলো।

হঠাৎই তার ডাক পড়লো নিচ থেকে।

” নির্ভানা, নির্ভানা বলে ডাকছেন দাদী মা”

নির্ভানা নিচে নেমে গেলো মাথায় ঘোমটাটা টেনে নিয়ে।

দাদী ডায়নিং এ রাফসানের সাথে বসে আছেন।

নির্ভানা সভয়ে ডায়নিং এ এলো। মনে মনে আল্লাহকে ডাকতে লাগলো সে।

রাফসান কি তার বিরুদ্ধে আরো কোনো ব্যবস্থা নিতে এসেছে? সে কি আরো চিৎকার, চেঁচামেচি করবে তার সাথে? এসব প্রশ্ন তার মাথায় আসতে লাগলো।

এসব কোনোকিছু করলে সে মাথা নত করে এ বাড়ি থেকে বের হয়ে যাবে রাফসানের খুশিমতো, সেটাই ভেবে নিলো সে।

নির্ভানা আসছে না দেখে দাদী পুনরায় ডাকতে শুরু করলো। তবে ভয়ে তার শরীর আড়ষ্ট হয়ে আসছে। ওখানে গেলে তো সেই মানুষটা নির্ঘাত তাকে অপমান করবে, তার পরো দাদী সেখানে তাকে কেনো যেতে বলছে? সেই প্রশ্নও চলে আসছে।

এখন এত ডাকাডাকির পর, অগ্যতা না গিয়ে কোনো উপায় নেই। তাই সে ভীতপায়ে এগিয়ে গেলো।

থমকে থমকে পা ফেলে ডায়নিং এ আসতেই, দাদী চেঁচিয়ে বললেন,

” রাফু খেতে এসেছে, ওকে তাড়াতাড়ি খেতে দাও!”

নির্ভানা বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেলো।

এই মানুষটা খাবে? তাও আমার রান্না করা খাবার, আমার হাতেই?

( চলবে)