#ওঁগো_বঁধু
পর্ব ১৬
#জান্নাতুল_মাওয়া_লিজা
সূর্যোদয়ের পর থেকেই শুরু হওয়া একটানা পাখির কলতান এখনো চলছে চারপাশে। আশুলিয়ার এ বাংলো বাড়িটারও যে একটা নাম আছে তা নির্ভানা আগে খেয়াল করেনি। আসলে কঠিন শব্দ পড়তে পারেনা বলেই বাড়ির নাম তার গোচরে আসে নি। এ বাংলো বাড়ির নাম ‘অন্তরিক্ষের পুঞ্জিকা’। অর্থাৎ আকাশের নক্ষত্রপুঞ্জের সমারোহ। এ কয়দিন শিক্ষকের কাছে পড়ার জন্য এত কঠিন উচ্চারনও তার এখন আয়ত্বে এসে গেছে। তবে আকাশের নক্ষত্রপুঞ্জ সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করা এখনো তার হয়নি। তার একেবারে বেশিকিছু জেনে ফেলার আগ্রহ দেখে তার শিক্ষকও দ্বীধাগ্রস্ত হয়ে পড়ে।
এখানে আসার পর নির্ভানার মনে হতো, সে নিজের গ্রামেই আছে। সকালে একঝাঁক শালিক কিচিরমিচির করে পরেই আবার কোথাও একটা দুটো কোকিল কূ রবে ডেকে উঠে। আবার কখনো চড়ুই ঝাঁক বেঁধে সভা করে। ঘুঘু, ফিঙ্গে ও কিছু বিদেশি হংস এদিকের জলাভূমির নিকটের ঘাস, লতাগুল্মে চড়ে বেড়ায় সারদিন ব্যাপী। আজ রোদের বর্ণ বেশি দ্যুতিময় লাগছে নির্ভানার কাছে।
সে টিচারের কাছ থেকে তার নামের বানান শিখে নিয়ে লিখেছে অনেকবার। আর সে লেখার পৃষ্ঠাতেই মনের অজান্তে নিজের নামের পাশে লিখে রেখেছে রাফসানের নাম। চেতনায় ফিরে আবার সে কেটেও দিয়েছে সে। এভাবে কয়েকবার লিখে কেটে, লিখে কেটে সর্বশেষের লিখাটা আর কাটেনি সে। ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে রেডি হতে হতে সে দেখছিলো কাগজটা আর হাসছিলো।
মানুষটাকে সে যতটা কঠোর ভেবেছিলো, সে সেরকম না। গতরাতে ফোনে বলা বাক্যগুলো মনে হতেই সে বারবার লজ্জা পাচ্ছিলো।
” আমার পথের সঙ্গী হবে?” এই বাক্যটা মনে হতেই নির্ভানার মনটা উচ্ছ্বসিত হয়ে গেলো। ” আমায় ক্ষমা করবে, স্বামি হিসেবে গ্রহণ করবে?” নির্ভানা এসব মনে করতেই লজ্জালাল হয়ে গেলো।
সে আয়নায় নিজেকে লক্ষ করলো সত্যিই তার গালের দুই পাশে ঈষৎ লাল হয়ে আছে। এই প্রথম সে নিজেকে দেখে নিজেই বিস্মিত হলো। মায়ের কথা সত্য বলে মনে হলো। মা ঠিকই বলেছিলো, তার গায়ের বর্ণ আসলে শ্যামলা নয় বরং ফর্সা। এখানে থেকে ভালো খেয়ে পরে আর যত্ন নিয়ে তার গায়ের প্রকৃত বর্ণ ফিরতে ধরেছে। নিজেকে সুন্দর দেখতে কোন না নারী চায়? তবে এতদিন ক্ষুধা, দারিদ্র ও দৈন্যতার যাতনায় সে ইচ্ছেটা মরে গিয়েছিলো হয়তো। সে ইচ্ছে আবার পূনর্জন্ম লাভ করেছে। ভীষণই সুন্দর করে সাজলো আজ নির্ভানা। একটা সোনালী পাড়ের হালকা সবুজ শাড়ী পড়লো সে। সাথে লম্বা চুলগুলোতে রঙ্গিন ফিতের ফ্রেঞ্চ বিনুনী করে নিলো। সামনের ছোট চুলগুলোকে হিট দিয়ে কার্ল করে দুপাশ বের করে রাখলো। হাতে পড়ে নিলো মানানসই স্টোনের আংটি ও চুড়ি। গ্লাস হিল পড়ে হাঁটা আয়ত্ব করেছে বলে হিলই পড়ে নিলো।
হটাৎ ই ডাক পড়লো,
” কই নির্ভানা? আসো আমরা সবাই রেডি!”
দাদীর আওয়াজ পেয়ে দ্রুতপদে নিচে নেমে গেলো নির্ভানা। নির্ভানাকে প্রথম এহেন রুপে দেখে দাদী ঠোঁট গোল করে কপালে একটা চুম্মা দিয়ে
” মাশাল্লাহ” বললেন।
দাদাও মশকরা করে বললেন,
” তুমি তোমার দাদীকেউ একটু সাজাতে বুবুজান! যদি এই বুড়ো বউটা আবার একটু জোয়ান লাগে!”
দাদার এহেন কথায় দাদী বিরক্তির স্বরে বললেন,
” নিজেও তো বুড়ো হয়েছো, আবার জোয়ান বিবি লাগে তোমার?”
এমন সময় রাফসান এলো। সে আগের বেশেই আছে। তার টি শার্ট খানিক কুঁচকে আছে সাথে প্যান্ট টাও। সে যেনো ইদানিং পোশাকের ব্যাপারে উদাসীন হয়ে গেছে।
হাসিমুখে রাফসান দাদাকে বললো,
” ভেবোনা দাদাভাই, আমারটাও তোমার, তোমারটাও তোমার, জিতে গেলা তুমি, এবার খুশি?”
নাতির এহেন মশকরাতে দাদা দাদী দুজনেই হেসে দিলো।
রাফসান নির্ভানার দিকে তাকিয়ে অবাক হওয়ার ভঙ্গিতে ভ্রু উঁচিয়ে বললো,
” লুকিং গর্জিয়াস! নিউ লুক ইনডিড!”
নির্ভানা কাঙ্ক্ষিত ব্যক্তির মুখে কাঙ্ক্ষিত প্রশংসাবাক্য শুনে লজ্জাস্নাত হয়ে গেলো।
কি বলবে ভেবে না পেতেই দাদা একটা কাশি দিয়ে দুজনের দিকে দুজনের অপলক চেয়ে থাকায় বিঘ্ন ঘটালো।
দুজনেই লজ্জা পেয়ে দুজন থেকে চোখ সরিয়ে নিলো।
মালতি দূরে দাঁড়িয়ে থেকে হাসছিলো এসব দেখে শুনে।
” তো কই যাওয়া হবে আজ?”
দাদার প্রশ্নে রাফসান উত্তর দিলো,
“পাশেই তো নন্দন পার্ক, ওখানেই যাবে নাকি ফ্যান্টাসি তে? দুটোতেই পানিতে ভেজার ব্যবস্থা আছে, ভিজতে পারবে তো এই শরীরে?”
দাদার মনে ফূর্তি। সে মালতিকে আরো এক সেট করে কাপড় আর টাওয়েল আনার আদেশ দিয়ে তড়িঘড়ি করে গাড়িতে উঠে বসলো। তার অনুসরনে দাদী, নির্ভানা ও মালতিও উঠে বসলো। দাদা দাদী বনানীর বাড়ি মাহমুদ’স প্যালেসে থাকা অবস্থায় লাঠি দিয়ে হাঁটতেই পারতো না, আর সেই দাদা দাদী দুজনেই এখানে আশুলিয়ায় এসে লাঠি ছাড়াই হাঁটছে দেখে অবাক বনে গেলো রাফসান।
দাদা হেসে একটা সানগ্লাস চোখে লাগাতে লাগাতে বললেন,
” আমাকে ইয়াং মনে হচ্ছে না রাফু দাদুভাই? আসলে সবই তোমার বউয়ের যত্ন, ওর হাতের ভালো খাবার আর যত্নতেই আমি ও তোমার দাদী এমন সবল হয়ে লাঠি ছাড়াই হাঁটছি”
“তোমার বউ” শব্দ দুটো প্রথম বারের মতো শুনে রাফসান যেনো একটা জটকা খেলো।
ছয় সিটের গাড়িতে নির্ভানা তার পাশে এসে বসলো, কারন দাদী তাকে ঠেলে রাফসানের পাশে বসালো। দাদা দাদী বসলো ড্রাইভারের পেছনের সিটে। আর তাদের পেছনে রাফসান ও নির্ভানা। রাফসানের এত কাছে সে কোনোদিন আসেনি সে। রাফসানের সাথে নিজের বাহু ও ঘাড়ের যে অংশ স্পর্শ হচ্ছিলো সেখানে যেনো এক স্বর্গীয় অনুভূতি অনুভূত হচ্ছে। দুরুদুরু বুকে সে ভাবতে লাগলো,
” তাহলে কি সব ঠিক হতে যাচ্ছে রাফসানের সাথে?”
সে মনে মনে উপরওয়ালাকে ধন্যবাদ জানালো। গাড়িতে ড্রাইভার একটা মিষ্টি গান ছেড়ে দিলো।
” তেরে হাত মে, মেরা হাত হো, সারে জান্নাতে, মেরা সাথ হো…”
নির্ভানা গানটার অর্থ জানে। সে অপেক্ষা করতে লাগলো, কবে নিজের ইচ্ছায় রাফসান তার হাতটা নিজের হাতে স্পর্শ করবে।
নির্ভানার ইচ্ছেকে সত্য হতে বেশি সময় লাগলো না।
নির্ভানার ডান পাশে বসা রাফসান নির্ভানার ডান হাতটা নিজের করতলে লুফে নিয়ে চেপে ধরলো।
একটা শিরশিরে ভালোলাগার অনুভূতি শিরদাঁড়া দিয়ে প্রবাহিত হলো নির্ভানার, সাথে সাথেই তার সর্বাঙ্গ ঝাঁকুনি দিয়ে কেঁপে উঠলো। ভালোবাসার মানুষের প্রথম হাতে ধরার অনুভূতি এমন হয়? তা জানা ছিলো না নির্ভানার। আবেগে তার গলাও ধরে এলো। এসির মধ্যেও রাফসান নির্ভানার করতল হতে আর্দ্র এক অনুভূতি পেলো। হঠাৎ ই নির্ভানার দিকে চোখ পড়লো তার লুকিং গ্লাসে। একি! মেয়েটা কাঁদছে কেনো? হাউ সিলি!
” এনি প্রবলেম? কাঁদছো কেনো?”
নির্ভানার কানের কাছে মুখ এনে বললো রাফসান।
নির্ভানা চোখের পানি মুছে বললো,
” এমনিতেই”
” অলওয়েজ হাসবে, আমি কান্না পছন্দ করিনা!”
গমগমে কন্ঠে উক্ত কথা বলতেই নির্ভানা কান্না চাপিয়ে হেসে দিলো। রাফসান এবার প্রথমবার চাইলো তার মুখপানে।
মেয়েটাকে হাসলে তো বেশ সুন্দর লাগে! এই প্রথম অনুভূতিটা মস্তিষ্কে একবার নাড়া দিলো রাফসানের। পরক্ষণেই মনকে শাসালো,
” নো ফিলিংস অনলি ডিলিংস! ডিল শেষ তো রানু মতি তুমিও বিদায়! সো মনের দরজায় তোমার নো এন্ট্রি। তুমি শুধু ক্ষণকালের অভিনয় ছাড়া আর কিছুই নাহ!”
মনে মনে এই বলে এক ডেভিল হাসি হাসলো রাফসান। ওদিকে অন্য এক হাতে সে নির্ভানাকে তার ঘাড়ে শুইয়ে দিলো সে।
দাদা দাদী সামনের সিটে বসেও বুঝতে পারছিলো ওদের দুজনের মধ্যে কিছু হচ্ছে।
নির্ভানার মনে হতে লাগলো, যদি সে এভাবেই রাফসানের ঘাড়ে মাথা দিয়ে সারাজীবন পার করে দিতে পারতো!
পুরো রাস্তা জুড়ে নির্ভানা যেনো রাফসানেই বিলিন হয়ে থাকলো।
.
.
“ভাবী! আমাদের স্মেলি, আমাদের স্মেলি! কাল স্মেলি এক্কেবারে চলে আসছে জার্মান হতে। মায়ের কোলে চিরদিনের জন্য আসছে মাম্মিটা আমার! ”
জলি মাহমুদের অতিরিক্ত উচ্ছ্বসিত স্বরে বলা একথায় শায়লা কটাক্ষের সুর তুলে বললো,
” ওহ! তাই বুঝি? জার্মান সরকার বুঝি এবার ওর স্টুডেন্ট ভিসা ক্যান্সেল করলো?”
জলি অগ্নিমূর্তি হয়ে বড়গলা করে বললো,
” ইশ ভাবী! তুমি তো জানো না, আমাদের মা মেয়ের বিশ্বের একশ তিনটা দেশের ভিসা ফ্রি, ওদের বাবা একজন ইন্টারন্যাশনাল পাইলট তুমি তো জানোই!”
শায়লাও এবার আগের চেয়ে বেশি কটাক্ষ করে বললো,
” জলি তোমার স্মেলি তো সেই আট বছর বয়স থেকেই একা একা জার্মান চলে গেলো, তুমি বললে যে স্টুডেন্ট ভিসায় যাচ্ছে, আজ অবধি সে ওখানকার সিটিজেনশীপ পেলো না, তাই আমি ভাবলাম আর কি?”
জলি ক্ষেপে গিয়ে বললো,
” বিদেশে পড়ালেখা করলে কি হবে? আমার স্মেলি পুরাই বাঙ্গালি। দেশে এলেই বিয়ে দিয়ে দেশেই রেখে দেবো ভাবছি। সেই দুজন ছোটো থাকতেই ভেবেছিলাম, রাফসানের সাথে স্মেলিকে বিয়ে দেবো ভেবেছিলাম। আর দেখো কি হতে কী হলো। হঠাৎ ই এক্সিডেন্টালি ঐ ভিখারির মেয়ের সাথে বিয়ে হয়ে গেলো রাফসানের। ঐ ভিখারিটা তো দূরে গেলোই, এখন দেখি স্মেলি যদি রাজী হয়…!
শায়লা একটা হাসি দিয়ে বললো,
” তোমার মেয়ে কি এতই ফেলনা হয়ে গেছে যে, আমার বিবাহিত ছেলের সাথে তোমার মেয়ের বিয়ে দিতে হবে? আমি ভালো ছেলে খুঁজে দেবোনি স্মেলির জন্য, ডোন্ট ওরি!”
জলি আমতা আমতা করে বলে উঠলো,
” না ভাবি, রাফসানই আমার স্মেলির জন্য বেস্ট ছেলে। ঘরের মেয়ে তাহলে ঘরেই থাকলো। রাফসান তো আএ ওই ভিখারিনী কে টাচ ও করে নাই। তাহলে সমস্যা কি? ঐ মেয়েকে ডিভোর্স দেওয়ানোর ব্যবস্থা করো, তাহলে হিসাব মিলে যাবে! ”
শায়লা চাতুর্যপূর্ণ হাসি হেসে বললো,
” দশ কোটি দিতে পারবে আমাকে? তাহলে ডিভোর্সের ব্যবস্থা করে দেবো!”
(চলবে)