ওঁগো বঁধু পর্ব-১৮+১৯

0
7

#ওঁগো_বঁধু
পর্ব (১৮+১৯)
#জান্নাতুল_মাওয়া_লিজা

রাফসান গভীর লেকের পানিতে ডুবে গেছে! দাদীর আকাশ পাতাল চিৎকারে দাদা হতভম্ভ হয়ে গেলেন। কিছুক্ষণ আগেও তো লেকের ধারেকাছে স্বল্প পানিতে দাঁড়িয়ে ছিলেন তিনি, নির্ভানার সাথে কথাবার্তা বলছিলেন। নির্ভানার গ্রামে সাঁতার কাটার গল্প শুনছিলেন। সামান্য এক মিনিটের ব্যবধানেই এখন কিনা শুনে রাফসান পানিতে ডুবে গেছে?

কিন্তু, একি নির্ভানা কই?

কোনো কিছু না ভেবেই নির্ভানাও ঝাঁপিয়ে পড়েছে লেকে। নির্ভানা ডুব দিয়েছে অথৈ তে। দাদীর চোখে অশ্রু চলে এলো। বেচারি মেয়েটা কেনো আবার পানিতে ঝাঁপ দিতে গেলো? মেয়েটা পাগল নাকি? এখন এক সাথে দুজনই গেলো! নির্ভানা ও রাফসান দুজনেই পানির নিচে, ভাবতেই দাদীরও শ্বাস রোধ হয়ে আসতে লাগলো।

দাদাও ভাবতে লাগলেন, এই একটুখানি মেয়েটা কি একা পারবে রাফসানকে উঠাতে?

দাদার মন চাইলো যদি তিনি পারতেন, পানিতে ঝাপিয়ে পড়তেন। নিরুপায় হয়ে কাঁদো কাঁদো মুখে তিনি হাঁটু পানিতে দাঁড়িয়ে রইলেন। এসব দেখেই সাথেই থাকা তাদের ড্রাইভারও পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়লো।

কিন্তু ত্রিশ সেকেন্ডের মধ্যেই রাফসানকে উঠিয়ে ফেলেছে নির্ভানা। নির্ভানার হাতের মুষ্টিতে রাফসানের শার্টের এক পাশ ছিঁড়ে চলে এসেছে।
আর নির্ভানার গায়ের ওড়না পেঁচিয়ে গেছে রাফসানের গলা দিয়ে। বলতে গেলে এক আজগুঁবি জড়ানো প্যাঁচানো অবস্থা দুজনেরই। ভেজা কাপড়ের লজ্জা ঢাকতে
রাফসানের বুকে নিজেকে লুকিয়ে নিলো নির্ভানা।
রাফসান নিজের গলার সাথে পেঁচানো নির্ভানার ওড়না খুলে তাকে ঢেকে দিলো।

দাদা হাত উঁচিয়ে বলে উঠলেই,

” হায়! এই মেয়েটা কি যাদু জানে নাকি? ”

দাদীও অবাক হলেন।

বার বার মেয়েটা এভাবে রাফসানকে..?.. রক্ষা করার মালিক তো উপরালাই, আর মেয়েটা যেনো তারই প্রদত্ত রক্ষাকর্তী।

ওড়না দিতে দিতেই জলে টুইটম্বুর রাফসান দু চারটা কাশি দিলো শুধু। অবাক বিষয়! কাশতে কাশতে সাথে হাসছেও সে। ডুবে গিয়েও কেউ এভাবে হাসে নাকি? দাদা দাদীর চোখে মুখে এখনো উৎকন্ঠা। তবে হাবভাবে বুঝাই যাচ্ছে কিছুই হয়নি রাফসানের। আর বাকি সব ঠিক আছে।

দাদী খোদার দরবারে শোকরিয়া করতে করতে কাছে এলেন। রাফসানকে জড়িয়ে কেঁদে উঠলেন। যেনো আসন্ন মারাত্মক জীবনঘাতী বিপদ থেকে বেঁচে গেছে সে!

কিন্তু দাদা দাদী এগিয়ে যেতেই রাফসান আরো জোরে হেসে দিলো। হেসে বলতে লাগলো,

” স্যরি দাদা, দাদী। তোমরা এত ভীতুর আন্ডা! এটা কিছু ছিলো না, আমি তো ডুবি নি জলে। শুধু নিজেকে পরখ করছিলাম যে, কতক্ষণ এভাবে ডুবে থাকতে পারি। আর তাই দেখে তোমরা কিনা ভাবলে যে, আমি ডুবে গেছি? আর তোমাদের এই পাগলী নাতবউ কিনা ভেবেছে,আমি ডুবে গেছি। তোমাদের যন্ত্রণায় আমি একটু ডুবার প্র‍্যাকটিসও করতে পারবো না নাকি? ”

রাফসানের এরকম ছেলেমানুষী কথা শুনে উপস্থিত সবাই ভ্যাবাচ্যাকা খেলো।
দাদী বলে উঠলেন,
” বলিস কি? এরকম ছেলেমানুষী কেউ করে?”

দাদীর চিৎকারে আগত জনতার একজন টিককারির স্বরে বলে উঠলো,

” এখন মানুষ খালি আজাইরা চিল্লায়! কোন চিল্লানী যে আসল আর কোনটা নকল তা বুঝা দায়!”

রাফসানরা সেসব কথা কানে তুললো না।
নির্ভানা তখনো রাফসানের কথা বিশ্বাস করতে পারছে না। কারন সে রাফসানকে পানির নিচে তলিয়ে যেতে দেখেছিলো। জলে ডুব দিয়ে সে সজোরে টেনে হিঁচড়ে রাফসানকে তুলে। আর রাফসান কিনা সেসব অস্বীকার করছে?

দাদা বলতে লাগলো,

” ডুবার প্র‍্যাকটিস করার আগে আমাদের একবার বলতে পারতি যে, ডুবে থাকার প্র‍্যাকটিস করবি, তাহলে তো আমি স্টপ ওয়াচ নিয়ে টাইম গনণা করতে পারতাম!”

রাফসান হেসে বললো,

” তার দরকার ছিলো না, আমি পরাজয় বরণ করে নিচ্ছি। তোমাদের নাতবউয়ের চেয়ে আমার দম কম। আমি ওর মতো এতক্ষণ ডুবতে পারতাম না।”

নির্ভানা দাদা নাতীর কথাবার্তা এসব চুপচাপ শুনলো, তবুও কিছু বললো না সেসব কথা।

দাদী আর কথা না বাড়িয়ে সবাইকে নিজ নিজ ভেজা কাপড় পরিবর্তন করে নেওয়ার নির্দেশ দিলেন। আর তারপরের প্ল্যান, নির্ভানার নিজ হাতে রান্না করা খাবার খাওয়ার, যা তারা নিজেদের সাথে বহন করেই এনেছে।

খাওয়া শেষে দুজনকে একাকী বসতে দিয়ে দাদা দাদী অন্যত্র বসলেন। এভাবে নির্জনে দুজন একাকী বসায় নির্ভানা লজ্জালাল হয়ে গেলো। বুক দুরদুর করতে লাগলো। প্রাণের প্রিয় মানুষটার সাথে তার একাকী কিছু সময় তার জীবনে যোগ হতে যাচ্ছে। তার পরো তার ভেতরটা অস্থির।

মুখোমুখি একটা কেবিনে দুজন বসেছে। কেবিন বলতে জায়গাটা পুরোপুরি মাঝ লেকের পানির উপরে। একটা মালদ্বীপ মালদ্বীপ ভাইব আনার প্রচেষ্ঠা। একটা বাঁশের পুলের উপর দিয়ে প্রায় আধা কিলোমিটারের উপর হেঁটে এসে এখানটায় বসতে হয়। আর সে স্থানটাও বাঁশ, কাঠ দিয়ে তৈরি। স্থানটি গোলাকার। কয়েকটা বেতের সোফা গোলাকারে সাজানো আছে। বসার স্থানের মাথার উপরের অংশটা একটা চাতাল। গ্রামের কৃষকেরা মাঠে কাজের সময় রোদ থেকে বাঁচতে যেরকম চাতাল পড়ে সেরকমটা। লেকের দুই পাশেই অসংখ্য গাছের মনোমুগ্ধকর সজ্জা। সাথে ছোটো ছোটো মরিচ বাতির সজ্জা। সন্ধার পরই এসবের সৌন্দর্য্য পরিলক্ষিত হয়, তাও বুঝা যাচ্ছে। চারপাশ পানি আর পানি। নির্ভানা চারপাশ চেয়েচেয়ে দেখছে। রাফসান হালকা কেশে তার দৃষ্টি আকর্ষণ করলো। চারপাশ ঘুরেঘুরে দেখলেও নির্ভানার অন্তর্দৃষ্টি কিন্তু রাফসানের পানেই।

এবার রাফসানের কাশি শুনে সে চারপাশ হতে দৃষ্টি ফিরিয়ে আনলো। তবে রাফসানের চোখাচোখি বসলেও চোখের দিকে তাকানোর সাহস তার নেই। তবে একবার চোখ পড়তেই সে দেখতে পেলো রাফসান তার দিকেই তাকিয়ে হাসছে।

হেসেই প্রশ্ন করলো,

” আমার মতো হ্যান্ডসাম বর থাকতে এত প্রকৃতি দেখছো কেনো?”

এ প্রশ্নের উত্তর নির্ভানার জানা নেই। রাফসান নিজেকে হ্যান্ডসাম বলছে! আরে সে তো নির্ভানার দৃষ্টিতে শ্রেষ্ঠ সুপুরুষ।

নির্ভানা রাফসানের দিকে চাইলো। খাড়া নাক, চওড়া কপাল, সিল্কি উড়ন্ত চুল, ঢুলুঢূলু চোখ দুটি। মানানসই ফর্সা গায়ের রঙ! নির্ভানার চোখ ফেরানো দায়। রাফসান নিজের চায়ের কাপে চুমুক দিলো।

নির্ভানা এখনো গোঁলক ধাঁধায় রয়েছে। লোকটাকে সে স্পষ্ট দেখলো যে পানিতে ডুবে যাচ্ছে আর সে কিনা এই কথাটা নাকচ করে দিলো সরাসরি?

রাফসানের সাথে সরাসরি কথা বলার সাহস তার নেই। তবুও ভয়ে ভয়ে রাফসানকে প্রশ্ন করলো,

” আপনি তো ডুবে যাচ্ছিলেন, আমি দেখলাম। তবে দাদা দাদীকে মিথ্যে বললেন কেন?”

রাফসান নির্ভানার এহেন প্রশ্নে কিয়ৎক্ষণ মৌন থেকে বিমুঢ় নয়নে পকেট থেকে একটা সিগারেট বের করলো।

কিন্তু পরক্ষণেই মুখভঙ্গি পরিবর্তন করে সিগারেটটা ফ্লোরে ফেলে দিয়ে পা দিয়ে ডলে ফেলে দিলো। তারপর গম্ভীর স্বরে নির্ভানাকে জিজ্ঞেস করলো,

” হুউম, ঠিকই ধরেছো। আমি ডুবেই যাচ্ছিলাম আসলে। দাদা দাদীকে বিষয়টা লুকিয়েছি, কারন তাতে তারা অযথা চিন্তা করতো। তবে আচ্ছা! আমি ডুবে গেলেই তোমাকেও কেনো ঝাঁপ দিতে হবে শুনি?”

নির্ভানার ইচ্ছে করছিলো নিজের ভালোবাসার কথা রাফসানকে জানিয়ে দিতে। কিন্তু নিজেকে সংযত করে রাফসানকে অবাক করে দিয়ে নির্ভানা বললো,

” কারন আপনার ডোবা, ভাসার সাথে আমারও ডোবা ভাসা নির্ভর করে… ”

রাফসান এক উপহাসের হাসি হেসে ভ্রু উঁচিয়ে সুধালো,

” ওহ তাই নাকি? কেমন ডোবা ভাসা? আচ্ছা, মনে করো আমি যদি মরে যাই, তুমিও কি আমার সাথেই মরতে চাইবে?”

নির্ভানা হ্যাঁ বোধক উত্তরই দিতো। কিন্তু সে কোনো উত্তর করলো না। ক্ষণিক লজ্জা আর খানিক দ্বীধা তাকে আঁকড়ে ধরলো।

রাফসান এবার তাকে প্রশ্ন করলো,

” আচ্ছা, মনে করো গ্রহণ করার পরো আমি তোমাকে ভীষন রকম অবহেলা করলাম, তাহলেও কি তুমি আমার সাথেই থাকবে?”

নির্ভানা অকপটে উত্তর করলো,

” আমার আম্মারে আব্বা প্রায়ই পিটাইতো তাও তো আম্মা সারাটা জীবনই ওখানেই কাটালো! এখন তো আব্বার ভুল ভাঙ্গছে। আম্মারে আর পিটায় না। আব্বা এখন অনুশোচনা করে। দুজনের মিল মোহাব্বত এখন মাশাল্লাহ। আর কোনো ঝগড়া মারামারি হয়না তাদের। আসলে বুঝলেন, বার বার সঙ্গী পরিপরিবর্তন করলেই সুখ হয় না, সুখ তো আসে ধৈর্য্য ধরে আল্লাহকে ডাকলে। ”

রাফসান চাতুর্যপূর্ণ হাসি হেসে বললো,

” আচ্ছা, দেখি তোমার আল্লাহ তোমাকে কি সুখ দেয়? আর কোন ধরণের সুখ দেয়। ”

নির্ভানা পালটা প্রশ্ন করলো,

” কেনো? আমার আল্লাহ বলছেন কেনো? আপনি আল্লাহকে বিশ্বাস করেন না?”

রাফসান স্পষ্ট করে উত্তর করলো,

” আল্লাহ বিশ্বাস করি, তবে সুখ বিশ্বাস করি না। কারন চির সুখ বলতে কিছু নেই। ”

নির্ভানা কিছুক্ষণ চুপ থেকে আস্তে করে বললো,

” যদি চাহিদা কমিয়ে নেই, আর শোকর করি। তবে যা আছে তাই নিয়েই আমরা সুখী!”

রাফসান হেসে বললো,

” বাহ! বুদ্ধিমতি আছো তুমি। বেশ দার্শনিক বাক্যও বলতে পারো দেখি! আচ্ছা কাল তোমাকে নিয়ে বনানীর বাসায় চলে গেলে যাবে তুমি আমার সাথে?”

নির্ভানা দৃঢ়চিত্তে উত্তর করলো,

” আপনি আমার স্বামি, যেখানে রাখবেন, আমি সেখানেই থাকবো, আপনার অবাধ্য হওয়ার সাহস আমার নেই!”

এদিকে ওয়েটার এলো নাস্তা নিয়ে।

খাওয়া দাওয়া সাঙ্গ করার পর সেদিনের মতো ঘুরাঘুরি সাঙ্গ হলো তাদের।

.
.

আকাশে পূর্ণ চাঁদ থাকলেও আলো ছড়াতে পারছে না। কারন আকাশ বড়ই মেঘলা।
নির্ভানা সেদিকেই তাকিয়ে আছে সজল চোখে। তার মনের মেঘ যেনো আরো বেশি ঘন কালো। সে একাগ্রচিত্তে শুধু একটাই কথা ভাবছে, রাফসানের সেই কথাটা।
” তোমাকে গ্রহণ করার পরো যদি তোমাকে ভীষণ রকম অবহেলা করি?”

অর্থাৎ রাফসান তাকে গ্রহণ করবে বটে, তবে ভীষণ রকম অবহেলাও করবে। তাহলে এ কি ধরনের গ্রহণ করা? এ কি গ্রহণ করা নাকি গ্রহণ করার নাটকের অন্তরালে ভীষণ রকম বর্জন!

সেসব ভাবতে ভাবতেই তার ভাবনাতে ভাটা পড়লো। রাফসান সদ্যই গোসল করে বের হয়ে এসেছে ওয়াশ রুম হতে। তার শরীর বেয়ে অল্প করে পানি পড়ছে।
নির্ভানা আরেকটা টাওয়েল এগিয়ে দিলো তার দিকে, কিন্তু রাফসান সেটা নিতে হাতটাও বাড়ালো না।
আজ সে নিজেই আর নির্ভানা একই কামরায় ঘুমাবে বলে দাদা দাদীকে এনাউন্স করে দিয়েছে।

দাদী হাসতে হাসতে বলেছে,
” তুমি তোমার নিজের বউকে নিয়ে ঘুমাতে চাও, সে আবার আমাদেরকে জিজ্ঞেস করার কি আছে? এক্ষুণি নিয়ে যাও ওরে! এক্ষুনী নাও!”

বলে এক ধমকে নির্ভানাকে রাফসানের জন্য বরাদ্দকৃত ঘরে পাঠিয়ে দিয়েছে।

এভাবে দাদা দাদীর সামনেই স্বামীর ঘরে শুতে যেতে নির্ভানার লজ্জা যেনো ঘরের ফ্লোরও টের পাচ্ছিলো। কারন সেই বাসর রাতের পর তারা আর কোনোদিন এক হয়নি। সে হিসেবে বাসর রাত যেনো আজ রাতেই।

রাফসান নির্ভানাকে এক হাতে টেনে নিজের ঘরে নিয়ে বসিয়ে দিলো।

দাদা দাদী এসব দেখে মুখ টিপে হাসলেন।

নির্ভানা রাফসানের টাওয়েল প্যাঁচানো শরীরের দিকে চাইলো। ভীষণ রকমই আকর্ষণিয় সে দেহ দেখে মনের ভেতরটা তার উছলে উঠলো।

কিন্তু দাদা দাদীর সামনে হাত ধরে টেনে আনলেও রাফসান ওয়াশ রুম থেকে বের হয়ে নির্ভানার দিকে ফিরেও তাকালো না।

একটা টি শার্ট আর পায়জামা পড়ে সরাসরি সে বিছানায় গা এলিয়ে দিলো।

নির্ভানা সেদিকেই চেয়ে রইলো অবাক হয়ে।

একটা বাক্যও আর বললো না রাফসান।
চেয়ে থাকতে থাকতেই নির্ভানা রাফসানের ঘুমিয়ে পড়া টের পেলো। লোকটা মৃদুস্বরে নাক ডাকছে!

এবারে নির্ভানার বোধ হলো, কেনো রাফসান তাকে ভীষণ রকম অবহেলার কথা বলেছিলো তখন।
ভীষণ রকম অবহেলা তাহলে এমনই হয়?
এক ঘরে এনে রেখেও এক পৃথিবী সমান দূরত্ব!

নির্ভানার দুচোখ হতে ঘুম উবে গেলো। সে ঘরের বাতি নিভিয়ে দিলো। একটা বই নিয়ে সোফায় টেবিল ল্যাম্পের আলোয় বসে বসে পড়তে লাগলো দু:সহ দূরত্বের যাতনা ঘুচানোর জন্য।

.
.
মাহমুদ’স প্যালেসে এক উৎসব উৎসব ভাব জমে উঠেছে দ্বীর্ঘদিন পর। ব্রিটেন থেকে দ্বীর্ঘ দু বছর পর ফিরছে রায়হান মাহমুদের ছোটো পুত্র রুহশান। শায়লা তার বাবা মা, ভাই বোন ও তাদের ছেলে মেয়ে সহ নিকট বন্ধু বান্ধবী ও আত্মীয় স্বজন সবাইকে দাওয়াত দিয়ে এক পার্টির আয়োজন করেছে রুহশানের আগমনকে কেন্দ্র করে।
তবে রায়হান মাহমুদ খুশি অন্য কারনে। পুত্র রাফসান তার পুত্রবঁধু নির্ভানাকে স্ত্রী হিসেবে মেনে নিয়েছে, এটাই তার পরম কাম্য ছিলো।

আজ দুজনকে একসাথে দেখতে পাবে ভেবে রায়হান সাহেবের ভীষণই খুশি লাগছে।

দুজনই আজ এ বাড়িতে ফিরছে।

স্ত্রী শায়লাও নির্ভানার সাথে কথা বলছে দেখে রায়হান মাহমুদের মনটা ফুরফুরে লাগছে।

বাড়িতে ঢুকার সাথে সাথেই দুই ননদ মেহরোজ ও তটিনিও যে নির্ভানাকে এভাবে বরণ করে নেবে তা সে কোনোদিন ভাবতে পারেনি।

যে মেহরোজ ও তটিনি ভ্রু কুঁচকে তাকাতো তারাও ভাবির কাছাকাছি ঘুরছে।

নির্ভানাকে ভেতরে প্রবেশ করা দেখা মাত্রই দুই ফুপি শাশুড়ী মলি ও জলি মাহমুদও অবাক হলো। অবাক হলো বলতে টাস্কি খেলো তারা।
এ মেয়ের চেহারা তো পুরাই পরিবর্তন!

নির্ভানা বাড়িতে প্রবেশ করেই একে একে সবাইকে পায়ে হাত দিয়ে সালাম করলো।

কাজের মেয়ে তামান্না এসে অবাক হওয়া ভঙ্গীতে বললো,

” ভাবি এই কিছুদিনেই আপনারে তো আর চেনাই যায়তাছে না! এত সুন্দর লাগতেছে কেন রে! এক্কেবারে ফিল্মের নায়িকা রশ্মিকা মান্দানার মতো লাগতেছে আপনেরে। ঔ যে এনিম্যাল ছবিতে শাড়ি পড়ে যেমন লাগছিলো সেইরকম লাগতেছে আপনেরে!”

তামান্নার কথা শুনে নির্ভানা হেসে দিলো। সাথে সবাই হেসে দিলো।

” সত্যিই তোমার চেহারা রশ্মিকা মান্দানার মতো, নাক মুখ, চোখ, আগে খেয়াল করিনি! আসলে চেহারা তোমার মাশাল্লাহ। এখন থেকে ভালো যত্ন করবে, সবসমঅয় কেমন?”

বলে উঠলো জলি মাহমুদ।

নির্ভানার সাথে ভালোভাবে কথা না বলে আর মলি ও জলি মাহমুদের আর উপায় নেই। মূলত এ বাড়ির সবাই এখন রায়হান মাহমুদের চাপে কাবু। তাদের পথ দুটো। হয় নির্ভানাকে বউ হিসেবে সহজভাবে মেনে নিতে হবে আর না হয় রায়হান মাহমুদের মন থেকে ব্লক খাবে।

রায়হান মাহমুদ এবার ঢাকা চেম্বার অব কমার্সের সভাপতি পদপ্রাপ্ত হয়েছেন। সাথে তিনটা বড় বড় কাজের টেন্ডার এবার তার হাতে।

তাই বোনরাও ভাইয়ের মন যোগানোর চেষ্ঠায় আছে।
রাফসান ঢোকার অনতিবিলম্ব পরেই রুহশানের প্রবেশ ঘটলো বাড়িতে। রায়হান আর শায়লা দুজনেই তাকে এয়ারপোর্টে বরন করতে গিয়েছিলো।

নির্ভানা শায়লাকেও সালাম করতেই সেও অবাক হলো। নির্ভানাকে দেখা মাত্রই উপরে একটা ঠাঁট হাসি দিলেও মনে মনে শায়লার একটা বাক্যই খেলে গেলো,
” ফকিন্নির ঝি, যাস্ট ওয়েট এন্ড সি!”

মনে মনে এসব বললেও সে বাইরে বাইরে মাথায় হাত বুলিয়ে আশির্বাদ করলো নির্ভানাকে।

ওদিকে সবার সামনেই রাফসান রুহশানের নিকট নির্ভানাকে পরিচয় করিয়ে দিলো।

” দিস ইজ ইউর গর্জিয়াস ভাবী, রুহশান!”

রুহশান এসে খুশিতে ভাবিকে জড়িয়ে ধরতে উদ্যত হলো।

এসবে অনভ্যস্ততাহেতু নির্ভানা লজ্জা পাচ্ছে দেখে রাফসান ঈশারায় ভাইকে বারণ করলো জড়িয়ে না ধরতে। রুহশান নিজেকে সংযত করলো।

নির্ভানা রুহশানের দিকে চাইলো। স্টাইলের কোনো কমতি নেই রুহশানর মধ্যে। মাথার চুলেই তার দশ রকমের রং। হাতে পায়ে, ঘাড়ে জায়গায় জায়গায় তার অসং্খ্য ট্যাটু। তার পোশাক আশাক পুরোই ওয়েস্টার্ণ ও অত্যাধুনিক। এককথায় টপ টু টো সে এক পুরোদস্তুর ফ্যাশন শো। চেহারার পঞ্চাশ পার্সেন্ট তার শায়লার আর পঁচিশ পার্সেন্ট তার বড়ভাই রাফসানের আর বাকি পঁচিশ পার্সেন্ট তার নিজস্ব।

রুহশান নির্ভানাকে দেখে এবারে যেনো হাসতে হাসতে গড়াগড়ি খেলো। নির্ভানা নিজের দিকে তাকালো। তাকে দেখে এভাবে হাসার কী আছে সে বুঝতে পারলো না। একটা কালো ও সোনালী রং য়ের সিল্ক শাড়ি পড়েছে সে। গলায়, হাতে কানে কালো স্টোনের গহনা। পার্টির অন্য সবার মতো সেও সাবলীল ভাবেই আছে। তাকে সবাই বলেছে সুন্দর দেখাচ্ছে। তাহলে তাকে দেখে হাসার কী হলো তা নির্ভানার বোধগম্য হলো না।

রুহশান হাসতে হাসতে হাত তালি দিতে লাগলো,
এভাবে হাসছে দেখে রাফসান ধমকি দিয়ে ভাইকে বললো,

” ব্রো, কনট্রোল ইউরসেল্ফ, ইউ আর নট আ কিড অর উই আর নট জোকার”

ভাইয়ের শাসানী খেয়ে রুহশান নিজেকে সংযত করে নিলো। তারপর ভাইয়ের কানের কাছে গিয়ে ফিসফিস করে বললো,

” মাম্মি তো বলেছিলো তুমি নাকি এক কালো কুচকুচে পেত্নিকে বিয়ে করেছো, বাট আমি তো দেখছি ভাবী ইজ কোয়াইট প্রিটি! কি জানি একটা বলিউড নায়িকা আছে না? তার মতো দেখতে..”

তারপর সে আর নিজের ফিসফিসানি ধরে না রাখতে পেরে জোর গলাতেই নির্ভানাকে বলে দিল,

” ভাবী, ইউ আর মোর প্রিটি দ্যান মাই অল জি এফ! ”

মানে রুহশানের সব জি এফ দের চাইতেও নির্ভানা বেশি সুন্দরী দেখতে! অবাক করা বিষয়!

একমাত্র দেবরের মুখে এত প্রশংসা শুনে নির্ভানা সবাইকে আরো অবাক করে ব্রিটিশ একসেন্টেই বলে উঠলো,

” থ্যাংক ইউ ব্রো, বাট ইউ আর নট প্রিটি দ্যান মাই হাবি!”

রুহশান সহ পার্টিতে উপস্থিত অন্য সবাই নির্ভানার ব্রিটিশ একসেন্টের ইংলিশ শুনে চোখ গোল করে চাইলো।

পার্টিতে উপস্থিত সবাই এভাবে বলাকে বাহবা জানালো।

তবে রায়হান মাহমুদ সবচেয়ে বেশি খুশি হলেন।

নির্ভানাকে কোমড়ে জড়িয়ে গানের তালে তালে রাফসানের ওয়েস্টার্ন ডান্স দেখে। নির্ভানা মেয়েটা এত দ্রুত এ ওয়েস্টার্ন ডান্সও শিখে গেছে তা দেখে সবাই একপ্রকার টাস্কি খেলো। শাড়ী পড়েই সে রাফসানের সাথে নাচছে পিয়ানোর তালে তালে।

শ্যাড়ো লাইটের আড়ালে নির্ভানা রাফসানকে এত নিকটে পাওয়ায় নিজেকে যেনো হারালো।

রাফসানকে কাছে পাওয়া যেনো জান্নাতই পাওয়া বলে বোধ হলো নির্ভানার।
সে আলগোছে নিজের মাথা রাফসানের বুকে রেখে দিলো৷ রাফসান বিরক্ত হলো। রাফসান সরিয়ে দিতে উদ্যত হতেই রায়হান মাহমুদের চোখ সেদিকে পড়লো। তাই আর অন্যথা না করে নির্ভানার কাছে আসাকে বরণ করে নিলো। যে করেই হোক বাবার মনে জায়গা করে নিতেই হবে!

তাই আবার নির্ভানার মাথায় নিজের হাত স্পর্শ করে তাকে আরো বেশি করে আগলে নিলো।
নির্ভানা দুচোখ বুজে নিলো পরম তৃপ্তিতে।

(চলবে ইইনশাল্লাহ )