#ওঁগো_বঁধু
পর্ব ২০
#জান্নাতুল_মাওয়া_লিজা
রাত ভোর। বহু দূরে কোথাও হতে মোরগ ডাকার শব্দ ভেসে আসছে। ডাকছে ব্যালকনিতে যত্নে পোষা পায়রা ও পাখিগুলোও। যান্ত্রিকতার নগরীতে বৃক্ষ ও পক্ষীকূলের অভাব থাকলেও বনানী এলাকাটা রাজধানীর অন্য সকল অভিজাত এলাকা হতে ভিন্ন এক এলাকা। এ এলাকাটি গাছ গাছালির এক মহাসমারোহ দিয়ে তৈরি। বস্তুতপক্ষে এলাকাটি রাজধানীর ধনীদের জন্য আরামদায়ক করে বিশেষ পরিকল্পনা মোতাবেক তৈরি। তাই এ এলাকায় বৃক্ষরাজীর সমারোহ তথা পাখিদের সমাগমও বেশি। নির্ভানার দৃষ্টি সেদিকেই। আকাশে বিস্তৃত উদিয়মান সূর্যের সাথে সাথে তার দৃষ্টি সেই ভোরের পক্ষীকূলের দিকেই।
রাফসান তখনো একাগ্রচিত্তে ঘুমাচ্ছে।
নির্ভানা তার দিকে একবার তাকালো। মানুষটাকে ঘুমন্ত অবস্থায় কত মোহনীয় লাগে! তার একবার ইচ্ছে করছে এই অবস্থায় তার কপালে একটু স্পর্শ করতে। কিন্তু নাহ! সম্ভব না! রাফসান বি’রক্ত হবে নিশ্চিত।
তবে, এসব কি করছে রাফসান তার সাথে? নানা ধরণের ভাবনা নির্ভানার মস্তিষ্কে নাড়া দিচ্ছে।
গত রাতেও রাফসান একই কাজ করেছে। পার্টি থেকে নেচে স্বীয় কক্ষে সে নির্ভানাকে হাতে ধরে নিয়েই প্রবেশ করেছে সবার চোখের সামনে। তবে রুমে ঢুকেই হাত ছেড়ে দিয়ে সে ওয়াশ রুমে ঢুকে যায়। তারপর বেরিয়ে আগের দিনের মতোই কোনো কথা না বলেই ঘুমিয়ে পড়ে।
নির্ভানার প্রতি তার যেনো বিন্দুমাত্র আগ্রহ ও আকর্ষণ নেই।
তবে রাফসান মুখে না বললেও তার চোখ বলে দিচ্ছিলো উক্ত কক্ষে নির্ভানার উপস্থিতি তার জন্য বি’রক্তিকর। আর বাহির মানুষের সামনে রাফসান যা করছে তা এক অনভিপ্রেত অভিনয়।
এভাবেই সবার সামনে প্রনয় দেখিয়ে বদ্ধ কক্ষে প্রলয় দেখাবে রাফসান?
এজন্যই রাফসান বলেছিলো, ” ভীষণ রকম অবহেলা সে করবে!”
নির্ভানার চোখ দিয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়লো এসব ভেবে।
এদিকে দাদা দাদীর জন্যও মন খারাপ লাগছিলো নির্ভানার। কিন্তু দাদা দাদী এ বাড়িতে এখনি নয় বরং কিছুদিন পর আসবে তা স্পষ্ট করে জানিয়ে দিয়েছে। বনানীতে গাছ গাছালি বেশি থাকলেও আশুলিয়ার ওদিকটার মতো না। দাদা দাদী আর যান্ত্রিক ঢাকা শহরে থাকতে চান না। ওখানেই এসি ছাড়াই ঘুমাতে চান আর প্রাকৃতিক ফুরফুরে বাতাসে নি:স্বাস নিতে চান।
কিন্তু রাফসান নির্ভানাকে নিয়ে আশুলিয়ার বাড়িতে দাদা দাদীর আনুকুল্যে থাকতে পারবে না, কারন সে যে নতুন প্রজেক্ট শুরু করতে যাচ্ছে, তার জন্য তাকে বনানীতেই থাকতে হবে। শেয়ার হোল্ডারদের বাকি সবাই গুলশান, বনানীতেই থাকে। মাঝে মাঝে মিটিং, কনফারেন্স সব তাদের গুলশানের হোটেল ওয়েস্টিনেই হবে। অনলাইনে এসব কনফারেন্স করলে প্রাইভেসি থাকে না। একশ বিশ কোটি টাকার মামলা এখানে। প্রাইভেসি না থাকলে তো সাইবার ক্রিমিনালদের হাতে ধরা পড়ে সব টাকা খোয়াতে হবে।
দাদা দাদীকে এসব যুক্তি শুনিয়েই রাফসান নির্ভানাকে আশুলিয়া হতে নিয়ে চলে এসেছে বনানীতে।
এদিকে সকাল সকালই টিচার এলো নির্ভানার। কারন রায়হান মাহমুদের কড়া নির্দেশ নির্ভানাকে যে করেই হোক পড়াশুনাটা করে নিতেই হবে, তা সে যেখানেই থাক না কেনো। নির্ভানারও এই বয়সে পড়া শিখতে কোনো অলসতা নেই। ছোটো বয়সের প্রবল জ্ঞানতৃষ্ণা এই বড়বেলাতেই ঘুচাতে তার আপ্রাণ চেষ্ঠা। যা একবার শুনে বা দেখে, তাই সে আয়ত্ব করে নেয় মুহূর্তের মধ্যেই।
বনানীর মাহমুদ’স প্যালেসে নির্ভানার নতুন টিচার মিস এলিনা গোমেজ। তিনি এক নৈশ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক। সে এ ভোর সকালেই নির্ভানাকে পড়িয়ে যাবেন। পড়ার জন্য নির্ভানার কাছে এ সকালের সময়টাই শ্রেয়।
নির্ভানার পড়ার জন্যও রায়হান মাহমুদ একটা আলাদা কক্ষ বরাদ্দ করে দিয়েছেন। সকল প্রকার দেশি বিদেশি রাইটারের অসংখ্য বইয়ের সমারোহ আছে সেখানে। মানুষটা নির্ভানার জন্য এতটা নিবেদিত প্রান!
নির্ভানার নতুন শিক্ষক বেশ অভিজ্ঞ। তার ত্রিশ বছরের অভিজ্ঞতা আছে বিভিন্ন বয়স্ক ও গণশিক্ষা স্কুলে।
সকালে পড়া শেষ হলে খাওয়ার টেবিলে বসে নির্ভানা অবাক হলো।
আজ তার সাথে সবাই খেতে এসেছে। সে যেনো সবারই আদরের মধ্যমনি। শায়লা তাকে খাবার সার্ভ ও করছে। শায়লা তাকে দেখে দেখে খাওয়াচ্ছে,
” বউমা, এটা খাও, ওটা খেয়ো না, তোমার এমনিতেই স্বাস্থ্য খারাপ ।”
শায়লার এহেন আচরন রায়হান মাহমুদের কাছে সন্দেহকর পরিলক্ষিত হলো। কারন পৃথিবীর অন্য কাউকে না হলেও সে তার স্ত্রী কে তো হাড়ে হাড়ে চেনে। এত সহজেই সে রানুকে নির্ভানা রুপে নিজের স্বীয় পুত্রের বঁধু হিসেবে মেনে নিয়েছে সেখানে তার খটকা লাগছে।
আগে যেখানে মলি ও জলি মাহমুদ তাকে দেখে ঘৃণায় বাঁচেনি আজ তারাই নির্ভানার সাথে হাসিমুখে কথা বলছে।
” বউমা! তোমার নতুন নামটা অনেক সুন্দর হয়েছে তো, নির্ভানা, একদম আনকমন এক নাম, আচ্ছা, কে দিয়েছে এই নাম?”
মলি মাহমুদের এহেন প্রশ্নে নির্ভানা প্রথমে হতবাক হয়ে গেলো যে, মলি মাহমুদ তাকে বৌমা বলে ডাকছে! সে নিরুত্তর লাজুক চেয়ে রইলো, তবে রাফসান উত্তর করলো, সে আধিক্যতা করে বলে উঠলো,
” কে আর রাখবে আমার বউয়ের নাম, দাদাভাই ছাড়া! আমার বউয়ের অর্ধেক শেয়ার হোল্ডার তো যেনো সে ই। সে তো আবার স্বঘোষিত কবি। সেজন্যই তো কাব্যসুধা মিশ্রিত নাম রেখেছে ‘নির্ভানা’ তুমি বুঝো না ফুপি!”
জলি মাহমুদ বলে উঠলো,
” তার মানে কি বলতে চাইছিস তুই? তোর দাদাভাইয়ের রাখা নাম কি তোর পছন্দ হয়নি? ”
রাফসান নির্ভানার এক হাত নিজের হাতে লুফে নিয়ে বললো,
” তা নয় ফুপি, তবে আমি হলে আমার বউয়ের নাম রাখতাম নির্ভানা নয় শুধু নিরু! আমার নিরুবতী!”
বলেই সে নির্ভানার চোখের দিকে চাইলো। নির্ভানাও চাইলো। তবে সে রাফসানের দৃষ্টির ভাষা বুঝতে পারলো। সে দৃষ্টি প্রখর হলেও, সে দৃষ্টিতে মিশে আছে তার জন্য ঘৃণা ও অবজ্ঞা। নির্ভানা বুঝতে পারলো, সবার সামনে রাফসান তার সাথে ভালো ব্যবহার ও ভালোবাসা দেখাবে। আর সবার অন্তরালে দেখাবে ঘৃণা ও অবজ্ঞা।
রাফসান তার বউয়ের দিকে এভাবে তাকিয়ে আছে দেখে তটিনি বলে উঠলো,
” কনট্রোল ইউরসেল্ফ ব্রো, তুমি মাম্মি পাপার সামনেই বউয়ের সাথে রোমান্স করছো!”
তটিনির একথা শুনে সবাই হো হো করে হেসে উঠলো।
রায়হান মাহমুদ মেয়ের কথাটা এড়ালেন না।
বললেন,
” এ জামানার ছেলেরা বাপের সামনে রোমান্স করতে লজ্জা পায় না, ক্যারি অন রাফু। আমি তোমার আর নির্ভানার আরো বেশি রোমান্স দেখতে চাই। তোমরা আজীবন এভাবেই হাসি খুশি থাকো আর বেশি বেশি রোমান্স করো আমি এটাই চাই!”
শায়লাও হাসলো, তবে তার চোখে কটাক্ষের ছাপ স্পষ্ট। সে একটা ব্রেডে বাটার লাগাতে লাগাতে বলে উঠলো,
” রাফু, তোমার নতুন প্রজেক্ট সম্পর্কে তোমার বাবাকে বলেছো?”
স্ত্রীর কথায় রায়হান মাহমুদ একটু নড়েচড়ে বসলেন।
” নতুন প্রজেক্ট মানে? তোমার মা কি বলছে রাফু?”
রাফসান সামান্য ইতস্তত করতে করতে বলে উঠলো,
” আসলে বাবা, আর্মির জব হারানোর পর আমি নিজেকে খুবই লো ফিল করছি। যাকে এককথায় বলে ইনফেরিয়রিটি কমপ্লেক্স! কারো সামনে যেতে পারছি না, মিশতে পারছি না, কথা বলতে পারছি না। তাই কিছু একটা করতে চাচ্ছি। এভাবে বসে বসে আর কতদিন?”
রায়হান সাহেব ছেলের চোখের দিকে কড়া চোখে তাকিয়ে বললেন,
” বসে বসে বলছো কেনো? তোমার বাবারটা খাবে তুমি? তোমার বাবার মানে তোমারই। ইনফেরিয়রিটি কমপ্লেক্স ফিল করার কোনো কারনই নেই!”
রাফসান প্রত্তুত্তর করলো,
” পাপা, তোমারটা আমার হলেও মুখে মুখে শুধু, কাগজে কলমে তো আর না। আমার ভালো লাগে না এসব, আমার মতো বয়সের হলে, তুমি পারতে এভাবে কিছু না করে বাবার টাকায় বসে বসে থাকতে পড়তে?”
রায়হান মাহমুদ অনুনয়ের স্বরে ছেলেকে বলে উঠলেন,
” কিন্তু তোমার শারীরিক কন্ডিশন তো ভালো না রাফসান। আগে তো শরীর পরে সোশ্যাল এন্ড ফিনানসিয়াল স্ট্যাটাস এন্ড কন্ডিশন।”
শায়লা চট করে রায়হান মাহমুদকে বলে উঠলো,
” প্লিজ রায়হান, আগে শুনবে তো ছেলে কি করতে চায়! কি বলতে চায়!”
রায়হান সাহেব বললেন,
” হ্যাঁ বলো!”
রাফসান বলতে লাগলো বিস্তারিত,
” আমি আর আমার আরো সাতজন ফ্রেন্ড মিলে আমরা একটা ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানি এস্টাবলিশ করতে চাই। যেটার মূল প্ল্যান অনুযায়ী আমাদের প্রত্যেককে প্রথমে বিশ কোটি করে শেয়ার করতে হবে। এটা কোম্পানির প্রথম মূল ইনভেস্টমেন্ট। তারপর পর্যায়ক্রমে আরো লাগবে। তবে এত লোন তো আমার পক্ষে পাওয়া সম্ভব না, তুমি জানোই!”
রায়হান মাহমুদ খেতে খেতেই বললেন,
” তো তুমি চাচ্ছো আমি তোমাকে বিশ কোটি টাকা লোন দেই?’
” না, বাবা আমি চাচ্ছি তুমি আমাকে লোন না টাকাটা দিয়েই দাও, পার্মানেন্টলি!”
নির্ভানা সহ ডায়নিং টেবিলে বসে থাকা প্রত্যেকে পিতা পুত্রের কথাবার্তা মনোযোগ দিয়ে শুনছিলো।
রায়হান সাহেব বুঝলেন, ছেলে পিতার কাছে নিজের পৈতৃক সম্পত্তির ভাগ বুঝে চাচ্ছে।
রায়হান সাহেব একটা দ্বীর্ঘ নি:শ্বাস ফেলে কিছু ভেবে বললেন,
” গিভ মি সাম টাইম, বিশ কোটি এরেঞ্জ করতে আমার কিছুদিন সময় লাগবে।
” বাবা, বেশিদিন ওয়েট করাইয়ো না প্লিজ। তুমি তো আমাদের গার্মেন্টস এর শেয়ারটা বিক্রি করে দিয়ে আমাকে টাকাটা দিতে পারো।
রায়হান মাহমুদ এবারে চটে গেলেন। তারপর বললেন,
” গার্মেন্টস এর বিজনেস আমার বাবা দাদার বিজনেজ, এটা বিক্রি করলে আমাদের রক্তের সাথে বেঈমানী হবে যে, তাই আমি এটা বিক্রি করতে পারবো না বাবা। তবে ডোন্ট ওরি, আমি একটা ব্যবস্থা করবোই করবো। তুমি এখন নির্ভানাকে নিয়ে কোথাও হতে ঘুরে আসো তো!”
নিজের প্রস্তাবের সদুত্তর না পেয়ে রাফসান ভেতরে ভেতরে রাগে ফুঁসে উঠলো।
তাই খাওয়া শেষ না করেই সে ডায়নিং থেকে উঠে চলে গেলো কিছু না বলেই।
শায়লা এবার রাগে ফুঁসে উঠলো রায়হানের প্রতি,
” ছেলেটাকে শুধুশুধু ক্ষ্যাপালে কেনো রায়হান? বিশ কোটি তোমার কাছে কোনো ব্যাপারই ছিলো না, আমি জানি, তারপরো ছেলেটাকে মানা করলে? নতুন একটা কিছু করতে যাচ্ছে, কই ইনস্পায়ার করবে উলটো আরো মানা করে দিচ্ছো!”
রায়হান সামান্য ইতস্তত করে বললো,
” আমি কি মানা করেছি নাকি? আমি একটু বুঝে শুনে দেখি আগে। ও নতুন বিজনেসে নামবে। বয়স কম। ও আর কতটুকু জানে বুঝে? তুমি ওকে একটু বুঝিয়ে বলো যে, যেনো কিছুদিন ওয়েট করে। আমি আগে দেশে বিদেশে খোঁজখবর লাগাচ্ছি। তারপর টাকাটা নাহয় দেবো। তারপর কাজ শুরু করবে ও। তাছাড়া শুরুতেই লস খেয়ে সব ইনস্পাইরেশন হারাবে তো। ”
সবাই রায়হানের উক্ত কথা স্বীকার করে নিলো।
ঠিকই তো ভালোভাবে জেনে বুঝে ইনভেস্ট না করলে তো ধরা খাওয়ার সম্ভাবনা একশত পার্সেন্ট।
নির্ভানা খাওয়া শেষ করে রাফসানের জন্য এক কাপ চা হাতে রুমে চলে গেলো।
” আপনার জন্য চা..! ”
বাক্যটা শেষ করার আগেই রাফসান নির্ভানার হাতের চায়ের কাপ ছুঁড়ে মারলো।
ফ্লোরে পড়ে টুকরা টুকরা হয়ে গেলো কাপখানা।
( চলবে)