#ওঁগো_বঁধু
পর্ব ২২
#জান্নাতুল_মাওয়া_লিজা
নির্ভানা কিচেনে যেতেই রাফসান পুরো রুমটার তল্লাসী শুরু করলো।
আগে তো মাথায় আসে নি। এখন মা মনে করিয়ে দিতেই সে উন্মাদের ন্যায় যত্রতত্র খুঁজতে লাগলো।
দেয়াল ঘড়ি, ফোনের চার্জার, কি হোল, টেবিল ল্যাম্প সর্বত্রই সে ঠুঁ মারলো। রুমে সিক্রেট হিডেন ক্যামেরা তার বাবা লাগাতেই পারে, এমনটা তার মায়ের ধারণা হলেও সেটা সত্যিও হতে পারে।
কারন বাসর ঘরে হিডেন ক্যামেরার জের ধরেই রায়হান মাহমুদ তাকে অজ্ঞান অবস্থায় আবিষ্কার করেছিলো, এ জাতীয় তথ্য নাকি ড্রাইভার আজমত আলী শায়লা মাহমুদকে দিয়েছিলো।
কিন্তু নাহ! তেমন কিছুই সে পেলো না।
তার মানে এই রুমের মধ্যে মেয়েটার সাথে সে যাচ্ছেতাই ব্যাবহার করতে পারে, তা কেউ, কক্ষোনো জানবে না। আর মেয়েটাও কাউকে জানাবে না সে ব্যাপারে সে নিশ্চিত।
রাফসান এসব ভেবেই একটু সুস্থির হয়ে বসতেই রাফসানের ফোনে কল এলো। রায়হান মাহমুদের কল।
রাফসান শান্ত স্বরে বললো,
” হ্যাঁ বাবা বলো!”
রায়হান মাহমুদও আদুরে স্বরে বললেন,
” শোনো বাবা রাফসান, সকালে একটু ব্যস্ত ছিলাম বলে জিজ্ঞেস করা হয়নি। এখন আমি ফ্রি আছি তো! তো তোমার ঐ কোম্পানি এসটাবলিশ করার ব্যাপারে তোমার সব কাগজ পত্র ও তোমাদের আট জনের প্রাইমারি প্ল্যান সম্পর্কে জানতে চাই। আমার অনেক অভিজ্ঞ ফ্রেন্ড আছে তাদের সাথে আমি এ ব্যাপারে আলোচনা করবো। তুমি প্লিজ আমাকে একটা মেইল করো এসব ডিটেইলিং এর!”
রাফসান বাবাকে আমতা আমতা করতে করতে বললো,
” বাবা আমাদের হোল টিম অনেকদূর এগিয়ে গিয়েছি এ ব্যাপারে। আমরা আর যে এস সি হতে কোম্পানি রেজিস্ট্রেশন করেছি, ডিরেক্টরেট জেনারেল অব ড্রাগ এডমিনিস্ট্রেশন এর থেকে ড্রাগ লাইসেন্স ও নিয়ে নিয়েছি, জি এম পি সার্টিফিকেশন ও পেয়ে গেছি। ইনভারনমেন্ট ক্লিয়ারেন্স ও নিয়েছি। এখন শুধু দরকার অনলি ক্যাশ, নাথিং মোর।
রায়হান সাহেব এক দ্বীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন,
” ওহ! আমাকে না জানিয়েই এত দূর তোমরা এগিয়ে গিয়েছো? তোমরা সবাই তো নতুন! একবার আমাকে জানাতে পারতে আগেই। ক্যাশও অনেক সময় ততটা কাজে লাগে না, যতটা না একটা ভালো পরামর্শ কাজে লাগে। দেশের হাজার হাজার এন্টারপ্রেনার আমার কাছ থেকে সাজেশন নেয়, আমার সেমিনার এটেন্ড করে। আর তুমি? বেশ! ভালো! আমাকে না জানিয়েই যখন এত দূর তাহলে আমার আর কি ই বা করার? আমি রাখছি।
রায়হান মাহমুদ একপ্রকার হতাশ হয়েই কলটা কেটে দিলেন।
যে ছেলে ওয়াশরুমে যেতেও বাবার অনুমতি নিতো সে ছেলে তার সাথে সামান্য পরামর্শ করতে পারলো না? এত বড় একটা ডিল অথচ সে তার বিজনেস মার্কেট এনালাইটিক বাবাকে একবারো জানালো না?
ছেলে তাহলে আউট অব কন্ট্রোল।
রায়হান সাহেব ছেলের এ ধরনের আচরনে বিচলিত হলেন।
বাবা হুট করে ফোন রেখে দেওয়াতে রাফসান আবারো অগ্নিশর্মা হয়ে গেলো। মনে মনে গর্জাতে লাগলো,
” আমাকে না জানিয়ে যে আমার বিয়ে ঠিক করে ফেলেছে, আর তাকে না জানিয়ে কোম্পানি তৈরি করে ফেললেই দোষ? টাকার প্রসঙ্গ উঠতেই কল কেটে দেয়! আজ বাসায় এলে আমি সরাসরি তার কাছে সম্পত্তির ভাগ বাটোয়ারা চাইবো, ইটস ফাইনাল!
.
.
রান্না করা খাবারের মোঁমোঁ গন্ধে মাতাল গোটা মাহমুদ’স প্যালেস।
সবাই এসে ভীড় করেছে রান্নাঘরে। সবার হাতেই প্লেট বা বাটি। রুহশান, তটিনি ও মেহরোজ, সাথে হেল্পিং হ্যান্ড যারা আছে তাদের হাতেও বাটি।
নির্ভানা একদিকে রান্না করে নামাচ্ছে আরেকদিক হতে এই তিনজন সব ছোঁ মেরে নিয়ে নিচ্ছে।বিশাল কিচেনে সবাই একটা একটা করে ইজি চেয়ার নিয়ে বসে গেছে।
” বিদেশি খাবার খেতে খেতে দেশি খাবারের স্বাদই ভুলে গিয়েছিলাম নিভ, বুঝলা?”
রুহশান এক পিস বড় আস্ত গলদা চিংড়ি সমেত চিংড়ি মাছের মালাইকারী খেতে খেতে একথা বলতে লাগলো নির্ভানা কে।
আর ওদিকে তটিনি একটা চিজ কেকের বড় এক পিস খেতে খেতে বলতে লাগলো,
” ব্রো, আজই আমার ওয়েট এটলিস্ট দু কেজি বেড়ে যাবে মনে হচ্ছে, এই কেকের চিজটা এত বেশি ইউনিক আর ফ্রেশ! আচ্ছা ভাবি তুমি এই চিজ কোন পেইজে অর্ডার করে পেয়েছো?”
নির্ভানা মৃদু হেসে বললো,
” এই তো আমি এই মাত্র বানালাম, একটু আগে, সেজন্যই এত ফ্রেশ। আর বাইরে থেকে অর্ডার করা গুলোতে ক্যামিক্যাল থাকে সাথে প্রিজারভেটিভ। কিন্তু আমারটা স্বাস্থ্যকর!।তোমার ওয়েটও বেশি বাড়বে না,।কারন আমি চিনির বদলে স্টেভিয়া ব্যবহার করেছি,।এটা।স্বাস্থ্যকর।”
নির্ভানার কথা শুনে তটিনি আরো বড়সড় করে এক কামড় বসালো কেকের গায়ে।
মেহরোজ বসেছে এক বাটি মাশরুম স্যুপ নিয়ে।
সে সরাসরি স্যুপের বাটিতে চুমুক বসিয়েছে। কারও সাথে কথা বলারও ধৈর্য্য নাই তার। হাতের ঈশারায় বুঝিয়ে দিচ্ছে স্যুপটা ওয়াও হয়েছে। সে শুধু চামচ দিয়ে ঢোকঢোক করে গিলেই যাচ্ছে।
তারপর একদমে শেষ করে বলে উঠলো,
” মাশরুম স্যুপ এতো ভালো কই শিখলে ভাবি?”
উত্তরে নির্ভানা বললো,
” তুমি এত সুন্দর করে সাজানো কই শিখলে?”
মেহরোজের মনে পড়ে গেলো সেদিন সে যে রানুকে
সাজিয়েছিলো বাবার চাপে পড়ে। সেদিন কি বাজে বিহেভ ই না দেখিয়েছিলো। তাই দু:খপ্রকাশ করে সে বললো,
” স্যরি ভাবি ওইদিনের জন্য। আমি তোমাকে আজ আবারো সাজিয়ে দেবো। তবে তুমিও মনে হয় সাজা শিখে গেছো!”
নির্ভানার মনটা খুশিতে ভরে উঠছে সবাই ওর সাথে এত সুন্দর করে কথা বলছে! আর খাবারের গন্ধে সবাই যে এভাবে রান্নাঘরে চলে এসে খেতে থাকবে তা তার কাছে অভাবনীয় মনে হচ্ছে।
খেতে খেতেই, খাওয়াতে খাওয়াতেই তটিনি মেহরোজের সাথে ভালো একটা বন্ধুত্ব হয়ে গেলো নির্ভানার।
খাওয়া শেষে সবাই রুহশানের কাছে ব্রিটেনের গল্প শুনতে বসেছে, সবাই রুহশানকে ঘিরে বসেছে,
রুহশান গল্প বলার মুডে বলছে,
” ওখানে নিজেরটা নিজে রান্না করে খেতাম। প্রতিদিন সকালে উঠেই ওটমিল, এক গ্লাস দুধ আর একটা আপেল। দুপুরে স্যামন স্যান্ডউইচ সাথে সালাদ আর পেনকেক। বিকালে খেতাম রেস্টুরেন্টে। রাতে বাসায় এসে কোনো কোনোদিন ভাত চড়াতাম। কখনো পুড়ে ছাই, আবার কখনো আলুভর্তার মতো। তাই বেশির ভাগ সময়ই নুডলস, পাস্তা খেয়েই রাত পার করতাম। এভাবেই চলতো আমার দিনকাল।
কোনো খাবারই এত ফ্রেশ ছিলো না। সবকিছুই প্রিজার্ভ করা।”
সবাই রুহশানের দু:খে দু:খিত হলো। আহা রে! বেচারা ভাইয়া!
তটিনি বলে উঠলো,
” তোমার জি এফ রা তোমাকে খাওয়াতো না?”
রুহশান গাল ফুলিয়ে বললো,
” আমার আবার জি এফ! ”
মেহরোজ বললো,
” দেশে থাকতেই তো প্রতিমাসে জি এফ চেইঞ্জ করতি, তাহলে ওখানে?”
রুহশান বললো,
” ওখানে জি এফ অনেক এক্সপেনসিভ কিছু। আর ব্রিটিশ দের জি এফ বানানো চাট্টিখানি কথা নয়। আমি ওখানে পড়াশুনা করতে গিয়েছিলাম, জি এফ বানাতে নয়, গট ইট।
তটিনি বললো,
” জানি জানি, দেখেছি দেখেছি, তোমার সাথে ব্রেক আপের পর এক ব্রিটিশ মেয়ে দেখেছি তোমাকে গালিগালাজ করে পিটানি দিচ্ছে। সেই পিটানির পিক আবার সে তোমাকে ট্যাগও করেছিলে। তুমি ট্যাগ রিমুভ করার আগে আমি আবার দেখেও ফেলেছি সেটা! হা হা! আর আমার ফোনে সেটা সেইভ করাও আছে। বলেই মেহরোজ ভাইকে সহ সবাইকে সেটা দেখালো। দেখিয়েই তটিনি দৌড়। কারন সে জানে তার ভাই এখন ছবিটা ডিলিট।করে দেবে আর তাকে দেবে মাইর।
ছবি দেখেই রুহশান তটিনিকে এক দৌড়ে ধরতে গেলো। তটিনি আবার দৌড় লাগালো।
এভাবেই ভাই বোনদের মাঝে খুনশুঁটি লেগে রইলো বেশ অনেকক্ষণ।
তবে রাফসান এসবে কোনোদিনও যোগ দিতো না।
সে এরমধ্যে একবারো নিজের রুম থেকে বাইরে বের হয়নি।
এত রান্না বান্না করে নির্ভানা এদিকে ভীষণই ক্লান্ত। রায়হান সাহেব ফিরবেন রাত্রে। শায়লাও নিজের আই টি ফার্মে ব্যস্ত। মলি ও জলি মাহমুদও ব্যস্ত নিজের প্রতিষ্ঠিত ফ্যাশন ও বুটিকস হাউজ নিয়ে। তার মানে বড়রা কেউ নেই বাসায়।
ওদিকে দুপুরের রান্নাবান্না সব নির্ভানাই করে নিয়েছে বলে কুক ও বুয়ারা সবাই আরামে বসে আছে। তারা শুধু নির্ভানাকে এটা ওটা যোগান দিয়েছে।
আজ দুপুরের সবার জন্য রান্না হয়েছে বিভিন্ন প্রকার ভর্তা, চিংড়ি মাছের মালাইকারী, খাসির চাপ, গরুর মাংসের চুইঝাল আর সাদা পোলাও ও ভাত। আর ডেজার্ট হিসেবে চিজকেক। যার অর্ধেক শেষ হয়ে গেছে।
নির্ভানা রুমে ঢুকতেই রাফসানকে দেখতে পায় ল্যাপটপ কোলে নিয়ে কি জানি দেখছে। পায়ে ব্যান্ডেজ। মেজাজ চটে আছে তার। হঠাৎ ই ল্যাপটপ কোল থেকে আঁছড়ে ফেলে সে। রাগে থরথর করে কাঁপছে রাফসান।
নির্ভানা সেটি তুলে নিয়ে স্ক্রিনের দিকে তাকায়। সেখানে নির্ভানার সাথে রাফসানের বিয়ের ছবির মিমস বানিয়ে কেউ তাকে মেইল পাঠিয়েছে। ভিড়িওতে দেখা যাচ্ছে নানা ধরনের কু রুচিপূর্ণ কথাবার্তা দিয়ে ভর্তি।
নির্ভানা অবাক হলো। সাথে প্রচন্ড এক ধাক্কা যেনো খেলে গেলো সমস্ত শরীর জুড়ে।
তার জন্য রাফসানকে এরকম অপমানের স্বীকার হতে হচ্ছে ভেবে নিজেকে সে দোষ দিলো আরো একবার।
ওদিকে শায়লার সাথে রাফসানের তখনকার কথোপকথন গুলোও তার কানে তখনো বাজছে।
কি করবে সে এখন? উপরের দিকে চাইলো সে।
” আল্লাহ তুমিই বলে দাও কি করবো আমি?”
এমন সময় তটিনির কল এলো।
” ভাবি, দ্রুত গোসল সেরে ফ্রেশ হয়ে এসো। ইমপরটেন্ট কাজ আছে! হারি আপ। ”
অত:পর ভাঙ্গা মন নিয়েই নির্ভানা গোসল সেরে ফ্রেশ হয়ে এলো। তার দীঘল কালো চুলগুলো দিয়ে টপটপ করে জল গড়িয়ে পড়ছে ফ্লোরে। তাকে যার পর নাই মোহনীয় লাগছে। এক অদ্ভূত প্রশান্ত তার মুখের অভিব্যক্তি।
শিফন জর্জেটের এক নজরকাড়া আসমানী ড্রেস সে পড়েছে। রাফসান না চাইতেও একবার নজর চলে গেলো নির্ভানার পানে।
আয়নার সামনের টুলে মেরুদন্ড সোজা করে বসে সে নিজেকে দেখছে। আর তাকে পেছন থেকে দেখছে রাফসান। রাফসান নিজেকে শাসালো। এই মেয়ে তার বউ হতে পারে না। চেহারা যতই সরস হোক, সে একটা ভিখারির মেয়ে এই ট্যাগ তার লেগেই আছে।
রুমে কড়া নড়তেই দেখে তটিনি এসে হাজির।
” ভাইয়াকে নিয়ে দ্রুত আসো, আমরা সবাই একসাথে লাঞ্চ করবে!”
তটিনি চলে যেতেই নির্ভানা রাফসানের দিকে চাইলো জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে, লাঞ্চ করার জন্য যাবে কিনা সে?
কিন্তু রাফসান ধমকের স্বরে বললো,
” আমার সাথে একই রুমে আছো ভালো কথা। কিন্তু এমন ভাবে থাকবে যেনো বাতাসও বুঝতে না পারে যে, তুমি এ রুমে রয়েছো গট ইট!”
(চলবে)