মনবিবাগী দিওয়ানা পর্ব-৩+৪+৫

0
1

#মনবিবাগী_দিওয়ানা
#পর্ব_৩ (আরও লেখা যোগ হয়েছে)
#প্রিমা_ফারনাজ_চৌধুরী

দেওয়ান

বাড়ির মেইন গেট আচমকা বন্ধ হয়ে গেল। একের পর এক গাড়ি আটকে গেল। উচ্চস্বরে বেজে চলা গান মুহূর্তেই থেমে গেল। কনেপক্ষের লোকজন হতভম্ব! এ কী ঘটলো? এভাবে কেউ গেট বন্ধ করে দেয়?

কনের ভাইরা প্রথমে কিছু বুঝতে না পেরে একে অপরের দিকে তাকাল। তারপর চশমা খুলে ভালো করে দেখল দেওয়ান বাড়ির দোতলার বারান্দায় সোজা হয়ে, নির্লিপ্ত দৃষ্টি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে কাবির দেওয়ান। এই মুহূর্তে সবকিছুর ওপর তার নিয়ন্ত্রণ।

গেটের সামনে হট্টগোল শুরু হয়ে গেল। কনের ভাইরা গর্জে উঠল, চিৎকার করে দারোয়ানদের হুকুম দিল—”গেট খোলো!”

কিন্তু দারোয়ানরা কাবিরের আদেশের অপেক্ষায় চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল। তাদের কিছু করার নেই।

কনে আর তার ভাইরা এবার কাবিরের দিকে তাকাল। আগুন ঝরছে তাদের চোখে। কিন্তু কাবির দু-হাত পেছনে ভাঁজ করে নিশ্চল দাঁড়িয়ে আছে। একটুও বিচলিত নয় সে। সে দেখতে চায় এরা আর কী কী করতে পারে!

___

কনেপক্ষের গাড়ির পেছনে বরপক্ষের গাড়িগুলোরও গতি বন্ধ হয়ে গেল। একে একে গাড়ি থেকে নেমে এল কাওসার দেওয়ান এবং তার ছোট ভাই কাশেম দেওয়ান। কনের ভাইরা উত্তেজিতভাবে গাড়ি থেকে লাফিয়ে নেমে তাদের সামনে গিয়ে দাঁড়াল। গর্জে উঠে বলল,

“আমার বোন এখনও বাড়িতে প্রবেশ করেনি। এর মধ্যে এসব কী হচ্ছে?”

কাওসার দেওয়ান ক্ষোভ লুকিয়ে বলল, “আমাকে কাবিরের সাথে কথা বলতে দাও।”

বলতে বলতে তিনি দ্রুত ফোন হাতে তুলে কাবিরকে কল দিলেন। ফোন রিসিভ করে কাবির নিশ্চয়তা দিয়ে বলল, কনে ভেতরে যেতে পারবে, তবে কনের ভাইদের ভেতরে ঢুকতে দেওয়া হবে না।”

লাউডস্পিকার থাকায় কাবিরের কথাটি শোনা মাত্র কনেপক্ষের সবাই তা শুনতে পেল। কনের ভাইরা রেগে গিয়ে মুখ চড়কাল। ছোট ভাই আগ্রহের সাথে বলল,”ভাই এসব কি?”

সেঝটা তীব্র রাগে বলল, “মগের মুল্লুক পেয়েছে নাকি?”

বড় ভাই চোখ পাকিয়ে সবাইকে এক নজরে দেখল। কিন্তু মুখ থেকে কিছু বের হলো না। মেঝটা হাত তুলে বলল, “ওয়েট ওয়েট ইথু তুই একা ভেতরে যাবি নাকি আবার বাড়ি চলে যাবি?”

ইথিকা বলল,”একা একা আমি ওই বাড়িতে যাব না। দরকার পড়লে বাড়ি চলে যাব।”

তার ভাই বন্ধুরা একসাথে হাত তুলে ‘হোহো’ করে আওয়াজ তুলল। ইথিকা তীক্ষ্ণ কণ্ঠে কাওসার দেওয়ানকে উদ্দেশ্য করে বলল,

“আঙ্কেল, আমার ভাইদের এত অপমান করার মানে কী?”

কাওসার দেওয়ান তাচ্ছিল্যভাবে বলল, “ও নাচ গান পছন্দ করে না। ভালো হয় যদি তুমি আমাদের সঙ্গে চলো। তোমার ভাইরা পেছন পেছন আসুক।”

ইথিকা তার বিরক্তি গোপন করতে না পেরে বলল, “অদ্ভুত!”

কাওসার দেওয়ান একপাশে সরে গিয়ে ফোনে কাবিরের সঙ্গে রেগে রেগে কথা বলতে লাগলেন,

“গেট খুলতে বলো কাবির! রাগ সামলাতে না পারলে আমাদের ডুবে মরতে হবে। তুমি জানো না সঠিক জবাব দেওয়ার সময় এখনো আসেনি, কতবার বলতে হবে তোমায়?”

কাবির রাগ সামলে গেট খোলার আদেশ দিল।
দেখল ইথিকা লেহেঙ্গাটা ধরে শ্বশুরবাড়ির লোকজনের সামনে হেঁটে হেঁটে দেওয়ান বাড়ির গেট পার করে ভেতরে ঢুকে পড়েছে।

কাবির একদৃষ্টিতে চেয়ে রইল। এর শেষ কোথায় সে জানেনা। কিন্তু এটুকু জানে এই মেয়ে ঝড় হয়ে তার জীবনে আচমকা প্রবেশ করেছে। এই ঝড় সব এলোমেলো করে দেবে। সবটা।

তার জীবন এমনকি নিজের জীবনও। কাবির দেওয়ানের পাল্টা জবাব কত ভয়ংকর হতে পারে তা সম্পর্কে বিন্দুমাত্র ধারণা নেই খান পরিবারের। অন্যায়ের সাথে সে কোনোদিন আপোস করেনি। এবারও করবে না।

___

ইথিকা দরজার সামনে এসে দাঁড়াতেই দরজা খুলে দিল বাড়ির পরিচারকরা। ইথিকা দেখল কাবির দাঁড়িয়ে আছে কিছুটা দূূরে। মুখ গম্ভীর। দৃষ্টি অন্যত্র। তার দিকে ভুল করেও তাকাচ্ছে না। সে পা বাড়াবে অমন সময় কাবির অন্যত্র তাকিয়ে বলে উঠল,

“মা তাকে বলে দাও এই বাড়িতে আমি বেয়াদবি বরদাস্ত করব না। তাকে বাড়ির সমস্ত আদবকায়দা মেনে চলতে হবে। নইলে এই বাড়ি ছাড়া পুরো পৃথিবী পড়ে আছে তার জন্য।”

ইথিকা বাড়ানো পা’টা আর বাড়াল না। হাঁ করে কাবিরের দিকে চেয়ে রইলো। বাড়িতে আসতে না আসতেই টুপিওয়ালার এত হুকুম, এত রাগ! আনবিয়ারেবল। এসব সে সহ্য করবে না কিছুতেই।

কাশেম দেওয়ান এসে কাবিরের পিঠে হাত বুলিয়ে বলল,”তুই আমাদের সাথে চল। এখানে দাঁড়িয়ে থেকে লাভ নেই। ওরা বউ ঘরে তুলুক।”

কাবির যেতে চাইল না। জোর করে নিয়ে যাওয়া হলো তাকে। চালাকি করে সরিয়ে নিয়েছে তাকে কাওসার সাহেব। তবে যাওয়ার সময় ইথিকার দিকে একবার তাকিয়েছে। কিন্তু ওই দৃষ্টিতে কি ছিল ইথিকা জানেনা। নিজের সদ্য বিবাহিতা স্ত্রীর দিকে কেউ ওভাবে তাকায়?

কাবিরের মা পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার জন্য সবাইকে মিষ্টি আর ফুল নিয়ে আসতে বলল।

মিষ্টি, মালা আর ফুল, নিয়ে আসা হলো। বউকে মালা পরানো হলো। মিষ্টি খাওয়ানো হলো।

ননদরা সবাই মিলে ইথিকাকে নিয়ে বাড়ির ভেতরে ঢোকার মুহূর্তেই ইথিকা থেমে গেল। একরাশ জেদ নিয়ে বলল,

“ভাইয়ারা কোথায়? ভাইয়াদের ছাড়া একা বাড়িতে ঢুকব না। বড় ভাইয়া!”

তার ডাক পড়তে দেরি, আর ভাইদের হাজির হতে এক মুহূর্তও লাগল না। সবাই একসঙ্গে লম্বা লম্বা পা ফেলে এমনভাবে এগিয়ে এল দেখে মনে হল বিজয়ী সৈনিকেরা যুদ্ধ শেষে দুর্গ দখল করতে এসেছে।

বাড়িতে ঢুকেই গপাগপ মিষ্টির প্লেট খালি করে ফেলল, ফুলের থালা ছিনিয়ে নিয়ে একে অপরের দিকে ছুড়ে দিল। মুহূর্তের মধ্যে সাদা স্প্রের ফিনকি উড়ে গেল বাতাসে, ইথিকার ননদদের মাথায় সাদা আস্তরণ পড়ল। তারা বিরক্ত হয়ে সরে পড়ল। উফ! এই বাঁদরগুলোর জ্বালায় আর রক্ষে নেই!

কিন্তু কনের ভাইদের এতেই ক্ষান্ত থাকলে হয়! ইথিকাকে নিয়ে সোজা কাবিরের ঘরের দিকে রওনা দিল তারা।

বড় ভাইটা প্রথমে দরজার ফ্রেমে হেলান দিয়ে দাঁড়াল, বাকিরা একে একে ঘরে ঢুকে ঘুরেফিরে চারপাশ দেখতে লাগল।

কাবিরের আতর মেখে নাক কুঁচকালো। বলল, ঘ্রাণটা চমৎকার। কিন্তু এসব ভালো মানুষদের জন্য। তাদের বমি পাচ্ছে কারণ তারা ভালো মানুষ নয়।

তারপর সাজানো খাটের দিকে তাকিয়ে ইথিকাকে বলল,”এটা তোর পছন্দ হয়েছে?”

ইথিকা নাকের নথ খুলতে খুলতে নাক কুঁচকে বলল,”নো। বাসি ফুল দিয়ে সাজিয়েছে। স্মেলটা বাজে।”

তার কথা শেষ হতে না হতেই ভাইয়েরা ফুলের দিকে ঝাঁপিয়ে পড়ল। খাটের উপর উঠে মেঝেতে ছড়িয়ে দিল পাঁপড়ির স্তূপ।

বড় ভাইটা আরাম করে ডিভানে বসে পা তুলে বলল, “চালিয়ে যা!”

মেঝটা তার পানির গ্লাস হাতে নিয়ে আদেশ দিতে থাকল। খাট সাজানো ফুলগুলো ছিঁড়ে ধপাস ধপাস করে বিছানায় শুয়ে পড়লো কয়েকজন।

কাবির দেওয়ানের ভাইবোনরা এসে দেখলো
সারা ঘর এই দঙ্গল দুরন্ত লোকদের দখলে। কাসেদ তাদের শান্ত গলায় বলল,

“আসলাম ভাই বড় ভাই এসে এসব দেখলে হুলস্থুল ঘটিয়ে ছাড়বে। আপনারা এসব কি শুরু করেছেন?”

ইথিকার বড় ভাই আসলাম খান সেকথা কানেও তুলল না। তাদের উচ্ছ্বাস, দস্যিপনা একফোঁটাও কমল না। বরং কনের মেঝ ভাই আরযাব খান আরও দেমাগ দেখিয়ে বলল,”ওই গলা নীচে নামা। কুটুম হই তোদের। যা আমাদের আপ্যায়নের ব্যবস্থা কর।”

কাবিরের বোন কল্পনা বলে উঠল,

“নেশাখোরদের আবার আপ্যায়ন? এমন জোকার আগে কেউ দেখেছে?”

আরযাব খান তার দিকে কপাল কুঁচকে তাকাল। তেড়ে এলে কাসেদ কল্পনাকে পেছনে লুকিয়ে ফেলল। আরযাব খান কাসেদকে বলল,

“তোদের ভাইবোনকে শিখিয়ে পড়িয়ে দিবি আমাদের সাথে যেন ওভাবে কথা না বলে। নইলে খবর করে ফেলব।”

কাদিন দাঁত চেপে বলল,”তোমরা এরকম করতে থাকলে তোমাদের বোনের সংসারই নষ্ট হবে কিন্তু। ফুলগুলো ছিঁড়লে কেন? প্রথম দিন এসে এসব কি শুরু করেছ? তোমাদের লজ্জা নেই বোনের বাসর ঘরে ঢুকে পড়েছ?’

আরযাব খান ফিক করে হেসে উঠলো। তার সাথে সাথে বাকিরাও হেসে উঠলো। ইথিকার ভাই সেঝটা হাসতে হাসতে বলল,

“অজ্ঞান পার্টিকে জ্ঞান বিতরণ করছিস?”

কিরণ রাগ করে কাদিনকে বলল,

“ভাইয়া চলো এখান থেকে। এরা সবকটা নির্লজ্জ।”

ঠিক তখনি কিরণের হাত খপ করে ধরে ফেলে আরযাব খান বলল,”বড় ভাই এই চয়সটা কেমন?”

আসলাম খান চোখ তুলে তাকাল। কিরণ ভড়কে গেছে। কল্পনা কিরণকে ছাড়িয়ে নিয়ে বলল,

“এই আরযাব খান সাবধান করে দিচ্ছি। এইসব দুই নম্বরী বাইরে গিয়ে করো। আমার বোনদের দিকে নজর দেবেনা। লম্পট, দুই নম্বরী লোক।”

আরযাব খান সাথে সাথে তার আঙুল মোচড়ে দিয়ে বলল,”বাপের দুই নাম্বার ছেলে আমি। দুই নম্বরী কাজ তো করবই।”

“নেশাখোর মাতাল।”

“নেশা মদে হয় না। তোমার কথা শুনলে হয়।”

ইথিকার সেঝ ভাই আশিষ এগিয়ে এসে বলল,

“তোমার নাম কি যেন? তুমি কত নাম্বার? বিশ নাকি ত্রিশ? এখানে তো মেয়েছেলের অভাব নেই দেখছি। দেওয়ানিরা বংশবৃদ্ধিতে কিন্তু এক্কেবারে ফার্স্ট! বলতেই হবে। তেজ, এনার্জি, আর কথার ঢং বেশি এদের।”

সাথে সাথে কষে একটা চড় পড়লো তার গালে। সবাই স্তব্ধ! হতভম্ব! কাদিন আর কাসেদ হাসলো। বেশ করেছে। চড় মেরে কল্পনা দাঁতে দাঁত চেপে বলল,”মুখ সামলে কথা বলবি।”

আশিষ খানের গর্জনে কল্পনা পেছাতে গিয়েও শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে রইল।

“তুই আমাকে চড় মারলি কোন সাহসে?”

আশিষকে ধরে রেখেছে তার ছোট ভাই আরিশ খান। কিন্তু তাতে কী আসে যায়? আশিষের চোখ ধাঁধিয়ে গেছে রাগে। কিরণ কল্পনাকে টেনে নিয়ে যেতে লাগল। আশিষ খান বলল,”এই কল্পনা তোর হাত যদি আমি না ভাঙি!”

কল্পনা ঠোঁটে বিদ্রূপ ফুটিয়ে যেতে যেতে বলল, “আরেক গালে চড় খাবি।”

আশিষের মুখ রক্তিম হয়ে উঠল। হাত মুষ্টিবদ্ধ। পাশে দাঁড়ানো আরয়াব খান তার কাঁধে হাত রেখে কিছু ইঙ্গিত করল। আশিষ গা ঝাড়া দিয়ে সরে এল, কিন্তু চোখের আগুন নিভল না।

ওদিকে দাঁড়িয়ে ইথিকা বিস্ময়ে ফিসফিস করল কাদিনকে, “ওর সাহস কত? ভাইয়ার গালে চড় বসিয়ে দিল!”

কাদিন ঠোঁট বাঁকিয়ে বলল, “যখন হাত ধরে টানাটানি করছিল তখন কিছু বলেননি ভাবি।”

ইথিকার মুখ শক্ত হয়ে গেল। শক্ত কণ্ঠে বলল,

“একদম ভাবি ডাকবে না! এইসব সম্বোধন একদম সহ্য হয় না আমার। ট্রাই সামথিং নিউ।”

কাসেদ পরিস্থিতি সামাল দিতে এগিয়ে এল, “ভাইয়া চল। বড় ভাই সব বুঝিয়ে দেবে!”

ইথিকার ছোট ভাই আরিশ খান কাসেদের উদ্দেশ্যে বলল,”

“ওই বড় ভাইয়ের বউ হয়! সম্মান দিয়ে কথা বল।”

আরিশ খানের কথায় কাসেদ ঠোঁট বাঁকিয়ে সরে যাচ্ছিল। কিন্তু আরিশ তার কাঁধ চেপে ধরতেই কাসেদ আচমকা ঘুরে তার মুখে একটা ঘুষি বসিয়ে দিল। মুহূর্তের মধ্যে পরিস্থিতি বদলে গেল। একে অপরের কলার চেপে ধরে দুই দিক থেকে ঘুষি চালাতে লাগল।

কাদিন ছুটে এসে কাসেদকে সরিয়ে আনার আগেই আরিশ আরেকটা ঘুষি খেয়ে টলতে টলতে পেছনে গেল। ইথিকা আতঙ্কে চেঁচিয়ে উঠল,

“কাবির! কাবির! হেল্প!”

মারপিট থামল না। আর্যাব খান আর কাদিন মিলে শেষমেশ দুজনকে ছাড়িয়ে আনল। ততক্ষণে দুজন অনেক আঘাত পেয়েছে।

কাদিন হতাশ হয়ে মাথা নাড়িয়ে বলল, “তোদের সমস্যা এটাই। যেখানে যাস, সেখানেই লাথি খাস!”

আর্যাব খান সঙ্গে সঙ্গে চেঁচিয়ে উঠল, “ওই, কে লাথি খায়?”

কাদিন দাঁতে দাঁত চেপে কাসেদকে নিয়ে বেরিয়ে যেতে লাগল। যেতে যেতে কাসেদ হুমকি দিল, “তোকে পাই আমি!”

আরিশও ছেড়ে দেওয়ার পাত্র না। কলার ঝেড়ে বলল, “বাইকের নিচে চাপা দেব তোকে! শুধু একলা পাই!”

ইথিকা হতাশ হয়ে ধপ করে বিছানায় বসে পড়ল, “হোয়াট রাবিশ আরিশ? এভাবে কেউ মারপিট করে?”

আরিশ গম্ভীর মুখে বলল, “তোর দেবর আমাকে প্রথম মেরেছে!”

আশিষ রাগে ফোঁস ফোঁস করে বলল, “আরেহ, আমাদেরই পিটিয়ে গেল! আমাকে চড়। ওকে ঘুষি।”

আসলাম খান চুপচাপ সব শুনছে। কিন্তু কোনো মন্তব্য করল না। আশিষ আর আরিশ খান ডিভানে গা এলিয়ে দিয়ে গজগজ করতে লাগল। এত অপমান তারা নিতে পারছেনা। আর্যাব খান হঠাৎ ডান হাতের এক আঙুল উপরে তুলে বলল,”আইডিয়া!”

আশিষ সঙ্গে সঙ্গে সটান দাঁড়িয়ে পড়ল, “কি?”

আর্যাব খান চোখ টিপে হেসে বলল, “ওস্তাদের মার শেষ রাতে!”

সবার ঠোঁটের কোণায় ধূর্ত হাসি ফুটে উঠল। ইথিকা বলল, “মেঝ ভাইয়া আমার রেস্ট দরকার। তোমরা থাকবে নাকি চলে যাবে?”

আরযাব খান বলল,”চলে যাব। বড় ভাই চলো।”

আসলাম খান মাথা দুলিয়ে উঠে দাঁড়াল। তারপর ইথিকার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল,

“কেউ কিছু বললে আমাদের জানাবি। ওদের মুখ বাঁকা করে দেব।”

ইথিকা মাথা দুলিয়ে বলল,”ওকে।”

ভাই তার মাথার উপর ঠোঁট চাপলো। বাকিরা মাথায় চাপড় দিয়ে, গাল টেনে দিয়ে বেরিয়ে গেল। ইথিকা দরজা পর্যন্ত তাদের বাড়িয়ে দিল। তারপর সাজসহ বিছানায় দু-হাত মেলে শুয়ে পড়ল। সে সময় নিয়ে চেঞ্জ করবে। তারপর আরাম করবে। কাজের বুয়া ঝিনুককে বলে দিয়েছে সে রাতে কোনো খাওয়াদাওয়া করবে না। তাকে যেন কেউ ডিস্টার্ব না করে।

_______

রাত সাড়ে এগারোটার দিকে বাড়ি ফিরেছে কাবির। কারো সাথে কথা না বলে নিজের ঘরের দিকে চুপচাপ পা বাড়ায়।

দরজা ধাক্কা দিল। কিন্তু কেউ দরজা খুলল না। কাবিরের কপাল কুঁচকে যায়। সে দরজায় শব্দ করে। কোনো আওয়াজ আসে না। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার পর ধীরেধীরে দরজাটা খুলে যায়।

কাবির মেঝের দিকে তাকিয়ে ঘরে প্রবেশ করে দরজাটা বন্ধ করে। ইথিকার বিয়ের লেহেঙ্গাটা বিছানার উপর ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। মেঝেতে সব ফুলের পাপড়ি।

কাবির সব দেখতে দেখতে হেঁটে কাবার্ড খুলে। নিশ্চয়ই ওই অসভ্যগুলোর কাজ এসব। নারী ছায়াটি তারকিছুটা পেছনে দাঁড়িয়ে আছে চুপচাপ।
সে একটা পাতলা শাড়ি পরেছে বেবি পিংক রঙের। স্লিভলেস ব্লাউজ। মুখে প্রসাধনী নেই। তবুও চকচক করছে তার ত্বক। ঠোঁটে লিপগ্লস দিয়েছে। চোখে হালকা কাজল।

নীচের ঠোঁট কামড়ে ধরে কাবির দেওয়ানকে আপাদমস্তক দেখতে লাগল সে। অথচ তাকে দেখেও না দেখার ভান ধরছে এই লোক। নিজেকে নিয়ে খুব গর্ব এই পুরুষের। খুব দম্ভ। খুব অহংকার। সব চূর্ণ করবে সে।

কাবির তার কাবার্ড খুলে শার্ট হাতে নিয়ে ঘাড় ফিরাতেই তাকে ওভাবে তাকাতে দেখে কপাল কুঁচকে ফেলল। ইথিকা বলল,”আপনি ঘুমাবেন কোথায়?”

কাবির শার্টটা কাঁধে নিস্পৃহ কন্ঠে বলল,”আমার বেডে।”

“আর আমি? আপনার পাশে? আপনার পাশে ঘুমানো যাবে? সত্যি? ওমাইগড বিশ্বাস হচ্ছে না।”

কাবির শক্ত কন্ঠে বলল,”তুমি আমাকে রাগাতে চাইছ?”

“শুনেছি দেওয়ানিরা রেগে গেলে মানুষ খুন করে। আমাকেও কি খুন করবেন?”

ইথিকার সহজ সরল প্রশ্ন। কাবির তার চোখের দিকে তাকিয়ে বলল,

“দেওয়ানিরা যখন তখন হাতে অস্ত্র ধরেনা। খানদের মতো হঠকারিতা দেখানোর আগে তারা দুবার ভাবে।”

ইথিকা ঠোঁটের কোণায় হাসির রেখা টেনে বলল,

“একটা কলঙ্কিত, নোংরা, বরবাদ, নষ্টা মেয়েকে বিয়ে করার আগে কি দুবার ভেবেছেন? আচ্ছা সেকথা থাক। সেই নষ্টাকে নিজের ঘরে দেখতে কেমন লাগছে কাবির সাহেব? আপনাদের ভাষায় আমাকে প্রস্টিটিউট বলা হয়।”

কাবিরের দৃষ্টি অন্যত্র ঘুরানো ছিল। ইথিকার দিকে দৃষ্টি ঘুরিয়ে তাকাতেই ইথিকার ঠোঁটের কোণার হাসিটা তার আপাদমস্তক জ্বালিয়ে দিল। শার্টটা বিছানায় ছুঁড়ে ইথিকার দিকে তেড়ে এসে সে বলল,

“তুমি জেনেশুনে স্বেচ্ছায় আমার জীবনটা নষ্ট করলে? তোমাকে বিয়ে করার চাইতে বন্দুকের সামনে বুক পেতে দেয়া তো আরও সহজ ছিল।”

ইথিকা তার রাগের আস্ফালন দেখে পিছিয়ে গিয়ে কাঠকাঠ গলায় বলল,

“ঘৃণা করার ফল তো ভোগ করতেই হবে। আমার দুঃসময়ে নষ্টা বলে থুতু ফেলেছেন আপনি আর আপনার পরিবার। আজ সেই মেয়ে আপনার সব দখল করতে এসেছে। বলেছিলাম না বিয়েটা করেই ছাড়ব? করেই ছাড়লাম। খানরা যেটা বলে সেটা করে।”

কাবির নিজেকে সামলালো। বড় জেঠা ফিরে আসা অব্দি তাকে শান্ত থাকতে হবে। এদের সাথে তর্ক জড়ানো যাবে না। সে বলল,

“বেশ মানলাম। এবার বড় জেঠার খোঁজ দাও। উনাকে তোমরা গুম করেছ তাই না?”

“খুনীকে খুন করলে পাপ হয় না,” দাঁত শক্ত করে বলল ইথিকা, চোখে দপদপ করা আগুন।

কাবিরের চোয়াল শক্ত হয়ে গেল। আক্রোশে ইথিকার কব্জি চেপে ধরল সে, গলা দিয়ে কঠিন আওয়াজ বেরিয়ে এল,

“আল্লাহর কসম, বড় জেঠার কিছু হলে খানদের অস্তিত্ব থাকবে না। আমি কি করতে পারি তুমি আর তোমার ভাইরা কল্পনাও করতে পারবে না!”

ইথিকা ব্যথায় মুখ কুঁচকে উঠে ফিসফিস করে বলল, “লাগছে আমার…”

কাবিরের হাত ধীরে ধীরে শিথিল হলো, তবে চোখের আগুন নিভল না। ইথিকা তার লাল হয়ে যাওয়া কব্জি মালিশ করে নিঃস্পৃহ স্বরে বলল,

“এই প্রস্টিটিউট আপনার বিছানায় থাকতে রাজি আছে। খুব সন্তুষ্ট করবে আপনাকে।”

ঘরটা নিস্তব্ধ হয়ে গেল। কাবিরের শিরায় শিরায় রাগের স্রোত বয়ে গেল। চোখের সামনে লাল পর্দা নামলো। কিছু না বলে সে বেরিয়ে গেল ঘর থেকে একরাশ ঘৃণা বুকে নিয়ে।

ছাদে এসে থমকে দাঁড়াল। আকাশের গায়ে নীলচে কালো মখমলের মতো রাতটা মেখে আছে। তারার আলো টুকরো টুকরো হিরের দানার মতো ছড়িয়ে আছে। এক কোণে চাঁদ আধখানা ঝুলে আছে।

কাবির ধীর পায়ে গিয়ে সাদা চেয়ারে বসে পড়ল। চোখ বন্ধ করল গভীর ক্লান্তিতে। চারপাশ নিস্তব্ধ, শুধু দূর থেকে ভেসে আসছে কোনো গাড়ির হর্ন, কোনো পাখির রাতজাগা ডানা ঝাপটানোর শব্দ। কপালে হাত রাখল সে। রাগে মাথাটা ঝিমঝিম করছে।

ওয়ালিমার দিনটা শেষ হয়ে যাক। বড় জেঠা ফিরে আসুক। তারপর ঠিক করবে সে কি করবে। কিন্তু খানরা যদি কথা না রাখে? বড় জেঠার প্রতি তাদের ক্ষোভ কম নয়। যদি তাকে খুন করে ফেলে, তাহলে নিশ্চয়ই একটা কারণ দাঁড় করিয়ে ফেলবে।

কাবিরের রাতটা ছাদেই কাটল। ফজরের আজানের সময় সে মসজিদে চলে গেল। ফিরে এসে দেখল ওয়ালিমার আয়োজন শুরু হয়েছে। বাবুর্চি আর কসাই চলে এসেছে। গরু জবাই হয়েছে। মাংস কাটাকাটির তদারকি করছে কাসেদ আর কাদিন। কাবির নিজের ঘরে চলে গেল পাঞ্জাবিটা পাল্টাতে। ঘরে এসে ইথিকাকে না দেখে তার কপালে ভাঁজ পড়লো। ও ওই শাড়িতে বাইরে চলে গিয়েছে? বাড়িজুড়ে হাজারটা মেহমান। তার পুরো শরীর দেখা যাচ্ছিল ওই শাড়িতে।

সে তড়িঘড়ি করে ঘর থেকে বের হয়ে কল্পনাকে ডাকবে অমন সময় ইথিকাকে একটা ট্রে হাতে এগিয়ে আসতে দেখল।

গায়ে খয়েরী রঙের শাড়ি। ফ্লোরাল ফুলহাতা ব্লাউজ। মাথায় চুলগুলো খোলা। ট্রে নিয়ে কাবিরের পাশ দিয়ে যেতে যেতে চোখ টিপে দিয়ে বলল,

“আপনি জিতেছেন নিঃসন্দেহে।”

কাবির হকচকিয়ে গিয়ে গিয়ে সেখান থেকে চলে গেল। মায়ের ঘরের পাশ দিয়ে যেতে যেতে বড় ফুপুর মুখে শুনলো,

“কত্তবড় বেয়াদব মেয়ে দেখেছ? কাবিরের নাম ধরে ডাকছে। ওর ভাইয়ের বয়সী জামাইকে নাম ধরে ডাকা? আজ ছাড় দিলাম। কাল আর ছাড় দেব না। কত্তবড় বেয়াদব মেয়ে।”

এদিকে দুপুর হতে না হতেই দেওয়ান বাড়ির সামনে আবারও হৈচৈ শোনা গেল। খানরা এসেছে তাদের চৌদ্দ গুষ্ঠি নিয়ে।

বিয়েটা শুক্রবার রাতে হয়েছে। শনিবারে ওয়ালিমা। যোহরের নামাজ পড়তে মসজিদে গিয়েছে কাবির আর তার আত্মীয়স্বজনেরা।

বাড়িতে তখন নাচগান চলছিল। ক্যামেরাম্যানরা ঘিরে ধরেছে বউ আর বউয়ের ভাই বন্ধুদের।

হঠাৎ কেউ একজন বলল,”দেওয়ানিরা চলে এসেছে। এসব বন্ধ করো।”

ইথিকা ভালো মেয়েদের মতো চুপচাপ বসে রইলো তার ভাই আর মা বাবাদের মাঝখানে। তাদের ফ্যামিলি ফটো তোলা হচ্ছে। কাবির বাড়িতে প্রবেশ করামাত্রই ইথিকার চোখ পড়লো তার উপর। কাবির চোখ সরিয়ে কাসেদকে ডেকে বলল,

“খাওয়ার টেবিলে গিয়ে তদারকি কর। এখানে এসব দেখে লাভ নেই। আজ যেন কোনো ঝগড়া না হয়। কালকের সব ঘটনা আমার কানে এসেছে।”

কাসেদ মাথা দুলিয়ে চলে গেল। কল্পনা কি একটা বলতে আসছিল কাবিরকে। তখুনি ইথিকা এসে কল্পনার হাত ধরে বলল,

“চলো আমার সাথে ছবি তুলবে। কিরণকেও ডাকো।”

কল্পনা কিছু বলার আগে সে টানতে টানতে নিয়ে গেল। কল্পনা ইতস্তত বোধ করল কাবির উপস্থিত থাকায়। ছবি তোলা শেষ হতে না হতেই ইথিকার মেঝ ভাই বলে উঠল,

“এই ইথু সবাইকে নামতে বল।”

বলতে দেরী বন্ধুবান্ধব নিয়ে স্টেজের উপর লাফিয়ে উঠে যেতে দেরী করেনি। কল্পনা কিরণকে নিয়ে দ্রুত সরে পড়লো মনে মনে একশ একটা গালি দিয়ে।

তখনি আরযাব খান পেছন থেকে বলল,”

“Attractive!”

কল্পনা আর কিরণ ফিরেও তাকাল না। বিরক্ত হয়ে একটা চেয়ার টেনে বসতে যাবে আশিষ এসে লাথি দিয়ে চেয়ারটা হালকা সরিয়ে দিতেই কল্পনা ধপ করে পড়ে নীচে। আরযাব খান আশিষকে ফ্লাইং কিস ছুঁড়ে দিয়ে কিরণ আর কল্পনার দিকে তাকিয়ে হেসে বলল,

“সো স্যাড!”

ইথিকা দেখল কাবির রক্তচক্ষু নিয়ে তাকিয়ে আছে আশিষের দিকে। ইথিকা সাবধান করার আগেই কাবির চেঁচিয়ে উঠে আঙুল তুলে,

“এই দাঁড়া! তোর সাহস কত?”

আশিষ খান ঘাড় ফিরিয়ে তাকায়। কাবির এগিয়ে আসতে গেলে আসলাম খান তার পথ আটকে দাঁড়িয়ে বলল,

“সম্পর্কটা হাসিঠাট্টার হয়ে গেছে। ওদেরকে ওদের মতো করে থাকতে দে। তোর বোন কাল চড় মেরেছিল। আজ ও শোধ তুলেছে।”

কাবির দাঁত কটমট করে কিছু বলার আগেই সেখানে আসলাম খানের স্ত্রী হাজির হয়। কাবির সংকোচে পড়ে যায়। আসলাম খানের স্ত্রী তাহমিনাও আড়ষ্ট হয়ে পড়ে। তবুও অনুরোধের সুরে বলে,

“ছেড়ে দিন। ওদের সাথে তর্কে জড়িয়ে নিজেকে সস্তা বানাবেন না। নিজের সম্মান ধরে রাখতে মাঝেমধ্যে ছাড় দিতে হয়।”

কাবির দ্রুত ওদের সামনে থেকে চলে গেল।
আসলাম খান স্ত্রীর দিকে ক্ষিপ্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,

“এই ফকিন্নির বাচ্চা ওকে দেখলেই তোর কথা বলতে ইচ্ছে করে কেন? চোখ তুলে নেব তোর। দূরে থাক। ওর বিয়ে হয়েছে আমার বোনের সাথে। পুরোনো প্রেম উতলে উঠছে তার। বেহায়া।”

তাহমিনা অপমান সইতে না পেরে চোখে জল লুকিয়ে বিড়বিড় করে বলল,”অমানুষের জাত।”

আসলাম খান এদিকওদিক তাকিয়ে রাগ সামলে বলল,”বাড়ি ফিরি। তোর এমন অবস্থা করব আমি। বড্ড বাড় বেড়েছে তোর।”

ইথিকা এসে বলল,”ভাবি এসো আমার সাথে। ভাইয়া তুমি এখানেও ওকে বকছো?”

তাহমিনা তার হাত থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে বলল,

“তোমার সাথে দাঁড়িয়ে ছবি তোলার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে নেই আমার। ছাড়ো।”

বলেই সে চলে যাচ্ছিল। আসলাম খান বলল,

“ইচ্ছে থাকবে কি করে? শোন ইথু এই ডাইনির তোর বরের দিকে নজর আছে। সাবধান!”

তাহমিনা থমকে গেল। কান্না গিলে ফিরে তাকালো। রাগসমেত বলল,”গজব পড়ুক ওই মুখে। যে মুখে এমন জঘন্য কথা উচ্চারিত হয়।”

চলমান……

#মনবিবাগী_দিওয়ানা
#পর্ব_৪
#প্রিমা_ফারনাজ_চৌধুরী

ওয়ালিমায় আর কোনো বাড়াবাড়ি হয়নি। কল্পনা আর কিরণকে ওদের সামনে যেতে বারণ করে দিয়েছে কাবির। ওই ছেলেগুলোর নজর খারাপ। চোখ দিয়ে গিলে খায়।

আমিন খানের পাঁচ সন্তানই অমানুষ হয়েছে। একটাও মানুষ হয়নি। পড়াশোনা করলেই যে স্বশিক্ষিত হওয়া যায় না তার প্রমাণ এরাই। বরাবরের মতো বড়লোকের দুলালের ঘরের দুলাল ওরা। সাধারণ মানুষের সাথে চণ্ডালের মতো ব্যবহার করে। নিজেদের খেয়াল খুশিমতো চলাফেরা করে। বাঁধাহীন জীবনযাপন অভ্যস্ত আনঝিল খানম ইথিকার দশাও এক।

ইথিকা বেড়ে উঠেছে পরম আদরে। মা-বাবার চোখের মণি সে। মা বাবা আর ভাইদের ভালোবাসায় মোড়া জীবনে অভাব-অনটন তো দূরের কথা, অবহেলা, তাচ্ছিল্য কিংবা অপমান কেমন তা কখনো অনুভবই করতে হয়নি তাকে। যা চেয়েছে তাই পেয়েছে সে।

কিন্তু তাই বলে সে নরম তুলোয় মোড়া মেয়ে নয়। চ্যালেঞ্জ নিতে ভালোবাসে। এডভেঞ্চারের নেশা তার রক্তে মিশে আছে। ভাইদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ছোটবেলায় সাইকেল চালানো শিখেছিল, তারপর চারচাকার স্টিয়ারিং ঘুরিয়ে শহরের রাস্তায় তীব্র বেগে ছুটেছে, আর বাইক চালাতে ভীষণ পারদর্শী সে।

স্কাইডাইভিং, বাঞ্জি জাম্পিং, সার্ফিং, র‍্যাফটিং, প্যারাগ্লাইডিং, স্কুবা ডাইভিং নামক ভয়ংকর এডভেঞ্চারেও যে মেয়ে দমেনি সেই মেয়েকে দমানোর সাধ্যি কার?

কাবির দেওয়ানের সংসারের ঘরণী হয়ে জীবন পার করার জন্য সে বিয়েটা করেনি অত শর্তসাপেক্ষে। করেছে শোধ নেয়ার জন্য। দেওয়ানদের জীবনটাকে জাহান্নামে পরিণত করার জন্য। নিজেদের নিয়ে তাদের খুব অহংকার, খুব গর্ব। সব চূর্ণ করার প্রতিজ্ঞায় বিয়েটা করেছে ইথিকা। আর এই খেলায় সে নেমেছেই নিজেকে ভেঙেচুরে।

দেওয়ান পরিবার জানে কতটা নোংরা খেলায় নামতে পারে ওরা। আজ থেকে প্রায় পঁচিশ বছর আগেও ওরা এমন নোংরা খেলায় মেতে উঠেছিল। আর ফলাফল হয়েছে ভয়ংকর। যার মাশুল দিতে হয়েছে খান বাড়ির বড় সন্তান কামরুল দেওয়ান আর বড় বউ সাজেদা বেগমকে। হয়ত এবার কাবিরকেও দিতে হবে।

কাবিরের মা লুবনা বেগম ভীষণ শান্ত স্বভাবের মহিলা। ভীষণ ভদ্র পরিবারের সন্তান। নিজ সন্তানরাও উনার সেই গুণটা পেয়েছে। ছেলে মেয়েদের নৈতিকতার শিক্ষা দিয়েছেন। কিন্তু পুত্রবধূর মতো মেয়ে তিনি এই প্রথম দেখছেন। এ কেমন মেয়ে? বিয়ের পরদিনই রান্নাঘরে এসে যে মেয়ে নিজের খাবার নিজে তৈরি করে করে ঘরে নিয়ে গিয়ে একা একা খেয়ে নেয় তাকে কি বলা উচিত উনি জানেন না। উনি বাকহারা হয়ে গিয়েছিলেন সকাল সকাল তাকে পাতলা একটা শাড়ি গায়ে ঘর থেকে বেরোতে দেখে। অনেক বলেকয়ে ফুল হাতা ব্লাউজটা পরিয়েছেন। বলেছেন, ঘোমটা না দাও কিন্তু শালীনভাবে চলাফেরা করো। তোমার শ্বশুরবাড়ির লোকজন ধার্মিক। এভাবে চলাফেরা করলে দৃষ্টিকটু লাগে।”

ইথিকা সেই অনুরোধটাও ঠেলে দেয়ার স্পর্ধা রাখে কিন্তু তবুও অনুরোধটা রাখল। লুবনা বেগম এতে খুশি হয়েছেন। কিন্তু যখন কানে এল কাবির ছাদে রাত কাটিয়েছে তখন মনটা আবারও ভারী হয়ে গিয়েছিল।

ওয়ালিমার অনুষ্ঠান শেষ হওয়ার পর তিনি ইথিকাকে সেকথা বলতেই ইথিকা মুখ ঝামটা দিয়ে বলল,

“আপনার ছেলেকে জিজ্ঞেস করুন কেন ছাদে ঘুমিয়েছে। আমাকে কেন এসব জিজ্ঞেস করছেন? আমি আপনাকে উত্তর দিতে বাধ্য নই।”

তীব্র মন খারাপ নিয়ে তিনি সেই ঘরে ঢুকেছেন আর বের হয়নি।

এদিকে কল্পনার কোমর ব্যাথা বেড়েছে। ওভাবে পড়ে যাওয়ার পর ব্যাথা হওয়াটা স্বাভাবিক। কিন্তু তার রাগ কমছেনা। জানোয়ারগুলো কয়েকদিন পরপরই বাড়িতে আসবে। ইচ্ছে করে সবকটাকে খু*ন করে ফেলতে। কাজের বুয়া ঝিনুক তার কোমরের পাশে মলম মালিশ করছে। কল্পনা তাকে থামিয়ে দিয়ে বলল,

“হয়েছে। আর লাগবে না। তুই ঘুমিয়ে পড়। ওদিকে কি খবর জানিস?”

ঝিনুক দুপাশে মাথা নেড়ে বলল,

“অনেকক্ষণ ওদিকে যাইনি আপা। কিন্তু তখন দেখলাম বৌমণি কার সাথে যেন ফোনে কথা বলছে। আমাকে আঙুলের ইশারায় চলে যেতে বলল।”

কল্পনা বলল,”ওর ভাইদের সাথে। শয়তানি বুদ্ধি তো নিতে হবে। কে জানে আবার কি পরিকল্পনা করছে। বড় জেঠার খোঁজ ওরা আদৌ দেবে?”

ঝিনুক চলে গেল। কল্পনা ধীরে ধীরে চোখ বুজল। কালই বৈঠকে মুখোমুখি বসবে দুই বাড়ির লোকজন। কী সিদ্ধান্ত নেয়া হবে কে জানে? বিচার-সালিশ তো কেবল খানদের হাতের খেলনা। ওরা চাইলে নিয়ম বদলায়, সত্যকে মিথ্যা বানায়, অন্যায়কে ন্যায়ের পোশাক পরায়। ক্ষমতার দম্ভে ওরা অমানুষ হয়ে গেছে। সব পারে ওরা। দেওয়ানদের শান্তি ওদের সহ্য হয় না, তাই তো এমন নোংরা খেলায় মেতে উঠেছে। দেওয়ানদের ভালো থাকতে দেবে কেন? কিন্তু ভাই তো একটা ভালো জীবনসঙ্গী আশা করে।

কল্পনা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। ওদিকে তাহমিনার কি দশা হলো কে জানে? মেয়েটাকে দেখে বড়ে মায়া হয় কল্পনার। ওকে তো বরাবরই ভাইয়ার পাশে ভেবে এসেছিল সে। কতশত স্বপ্ন দেখেছিল তাহমিনা। মজা করে তাকে ননদিনীও ডাকত।

তারপর কি যেন হয়ে গেল। আল্লাহ কেন যে ওর কপালে ভাইয়াকে না রেখে একটা অমানুষ জুটিয়ে দিল?

কল্পনার দমবন্ধ হয়ে আসে এই ভেবে নিজের সমস্ত স্বপ্ন জলাঞ্জলী দিয়ে একটা অমানুষের ঘর করছে তাহমিনা। সব জেনেশুনেও ভাইয়া কিচ্ছু করতে পারেনি। সব পথ বন্ধ করে দিয়ে খানরা মজা লুটছে ঠিকই। কতটা নীচু ওরা।

কল্পনা মনেপ্রাণে বিশ্বাস করে এমন একটা দিন আসবে যেদিন ওদেরও সব পথ বন্ধ হয়ে যাবে। পালানোর রাস্তা থাকবে না।

___

মার খেয়ে তাহমিনা বিছানায় কুঁজো হয়ে শুয়ে আছে। তার তিন বছরের বাচ্চা ছেলেটা কাঁদছে। কান্নার আওয়াজ শুনে আসলাম খান ঘরে এল। বলল,

“তোমার সমস্যা কি? আর দুটো দেব চড়? ওকে কোলে নাও।’

তাহমিনা মাথা তুলল না। তার মুখটা দেখা যাচ্ছে না। গালে পাঁচ আঙুল বসে গেছে। আসলাম খান শেষমেশ বিরক্ত হয়ে বাচ্চাটাকে কাঁধে তুলে বেরিয়ে গেল। আরিশকে ডেকে বলল,

“বাবুকে নিয়ে যা।”

আরিশ তাকে কোলে নিয়ে চলে গেল। চাচাদের পেলে তার আর কাউকে লাগে না। আসলাম খান ফের ঘরে এসে তাহমিনার হাত ধরে টেনে তুলল। তাহমিনার মনে হচ্ছে তার দাঁত নড়ে গেছে। এত জোরে কোনো মানুষ চড় দিতে পারে না। এরা অমানুষ। সে মেঝেতে থুতু ফেলল। সব রক্ত। আসলাম খান মেঝেতে রক্তমাখা থুতু দেখে বলল,

“দাঁতে কি হয়েছে?”

তাহমিনা বলল,”আপনি আমাকে মেরে ফেলছেন না কেন?”

আসলাম খান বলল,”গলার আওয়াজ নীচে। তুমি কাল তোমার বাপের বাড়ি চলে যাবে। আমার ছেলে আমার কাছে থাকবে।”

“আপনার মুখে তুইটাই ভালো মানায়।”

“ফকিন্নিদের ভালো ব্যবহার সহ্য হবে কেন?”

তাহমিনা দেয়ালে কপাল ঠুকরে বলল,

“আল্লাহ তুমি আমার মরণ দাও না কেন?”

আসলাম খান তাকে থামিয়ে কষে আরেকটা চড় বসায় গালে। তাহমিনা সজোরে কেঁদে উঠে বলল,

“আপনারা পুরো পরিবার মরবেন একসাথে। আমার কথা মিলিয়ে নেবেন।”

____

ইথিকার সাথে তর্ক লেগেছে বড় ফুপুর। কথায় কথায় বড় ফুপু বলল,

“নষ্টা মেয়ে। তোমার চাইতে ফুটপাতে পড়ে থাকা ভিখারি মেয়েগুলোরও দাম আছে।”

ইথিকা স্তব্ধ হয়ে গেছে। বড়ফুপু বলল,

“তোমার চাইতে আমাদের বুয়া ঝিনু অনেক দামী বুঝলে? তুমি একটা নষ্টা মেয়ে। নষ্টামি করে শেষমেশ ওই ছেলেকে বাপ ভাইয়ের হাতে মারালে। আর এখন এসেছে আমার কাবিরের জীবনটা নষ্ট করতে।”

ইথিকা বলল,”আপনি সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছেন।”

বড়ফুপু বলল,”একদম চুপ। এটা তোমার বাপের বাড়ি নয়। এই বাড়িতে তোমার মর্জিমতো চলাফেরা করতে পারবে না।”

পরিস্থিতি উত্তপ্ত হচ্ছিল। কল্পনা আর কিরণ মিলে বড়ফুপুকে সরিয়ে নিল কোনোমতে। ওদিকে ইথিকা ঘরে গিয়ে জিনিস ভাংচুর করে কেঁদেকেটে তার ভাইদের সব বলে দিয়েছে।

তার বড় ভাই বলল,”ওদের এতবড় সাহস? তোর সাথে কাজের বুয়ার তুলনা দেয়?”

ইথিকা বলল,”আমি কি করব এখন? আমার রাগ কমছেনা। ওই মহিলাকে আমার খুন করতে ইচ্ছে করছে।”

আরযাব খান ফোন কেড়ে নিয়ে নিজের কানে ধরে বলল,”বুড়ির ভাইকে জবাই করব। কাল সকালে লাশ যাবে ওদের বাড়িতে। দু’দিন যেতে না যেতেই অপমান?”

কথাবার্তা চলছিল ঠিক তখুনি দরজা ঠেলে কাবির ঘরে ঢুকল। ইথিকা ফোন কেটে দিল। গাল মুছে স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বসে থাকল বিছানায়। কাবির আলতো হাতে বিছানায় একটা প্যাকেট রাখল। বলল,

“আমার বন্ধু দিয়েছে নতুন বউয়ের জন্য। ও আসতে পারেনি। উপহার পাঠিয়ে দিয়েছে।”

ইথিকা প্যাকেটটা হাতে নিল। তারপর ছুঁড়ে মারল মেঝেতে। কাবির হতভম্ব। সে প্রশ্ন ছুঁড়ল সাথে সাথে,

“কেন ছুঁড়লে এভাবে?”

ইথিকা বলল,”এত সস্তা শাড়ি আমি পরিনা। কাজের বুয়াদের কাউকে দিয়ে দেবেন।”

বলেই শুয়ে পড়ল বিছানায়। কাবিরের বিছানায় পাশাপাশি শুতে ইচ্ছে হলো না রাগে, ঘৃণায়। সে ডিভানে শুয়ে পড়ল। শুধু কাল সকালের অপেক্ষা।

চলমান..

#মনবিবাগী_দিওয়ানা
#পর্ব_৫
#প্রিমা_ফারনাজ_চৌধুরী

পরদিন ভোর হতেই কদমতলীতে গোপন বৈঠকের আয়োজন করা হলো। জায়গাটা নিরিবিলি, বড় একটা পুরোনো বটগাছের নিচে বাঁশের বেঞ্চ পাতা। খানরা আগে থেকেই উপস্থিত, আর দেওয়ানরা এল খানিক পরে। সৌজন্যের খাতিরে হাতে হাত মেলানো হলো, তারপর সবাই নিজেদের জায়গায় বসল।

চায়ের বন্দোবস্ত করেছে খানরা। ধোঁয়া ওঠা কাপগুলো একে একে সবাই তুলে নিল, শুধু কাবির ছাড়া। সে নির্লিপ্তভাবে বসে রইল।

আসলাম খান ঠোঁটের কোণে বিদ্রুপের হাসি টেনে বলল,

“বিষ মেশাইনি, নিশ্চিন্তে খেতে পারিস।”

কাবির তাকাল না, কোনো উত্তরও দিল না। শুধু কাদিনের দিকে চোখের ইশারায় কিছু বলল, তারপর আবার নরম সবুজ শিশির ভেজা ঘাসের দিকে তাকিয়ে থাকল । মাথার ওপর ছায়া ফেলেছে বিশাল গাছের ডালপালা। বাতাসে পাতাগুলো হালকা দুলছে।

ঠিক তখনই দূর থেকে ভেসে এল পায়ের আওয়াজ। আশিষ খান আর আরিশ খানের মাঝখানে ধীরগতিতে এগিয়ে আসছে ইথিকা। তার গায়ে একটা সাদা শাল জড়ানো, বাতাসে শালের প্রান্ত দুলছে। মুখের দুপাশে দু’গাছি চুল উড়ছে হালকা হাওয়ার সাথে, কিন্তু সে সামান্যতমও বিচলিত নয়। চোখে কাঠিন্যে, মুখে অদ্ভুত গাম্ভীর্য।

তাকে দেখে কাবিরের মুখে একটুও ভাবান্তর এল না, কিন্তু তার চোখদুটো খানিকটা সংকীর্ণ হয়ে গেল।

ইথিকা এসে বাবার চেয়ারের পেছনে দাঁড়ায় বুকে হাত ভাঁজ করে।

কাবিরের সঙ্গে চোখাচোখি হলো। কালো পাঞ্জাবি গায়ে বসে আছে সে নিজস্ব দম্ভ নিয়ে। গলায় সাদা মাফলার ঝুলিয়ে একপাশে তুলে দিয়েছে।

মুহূর্তখানেক স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকল দুজন, তারপর একসাথে চোখ সরিয়ে নিল।

স্বামী স্ত্রী হলেও এখন তারা একে অপরের শত্রু। স্বামী-স্ত্রীর হিসেবে একে অপরকে কবুল করছে কিন্তু মিত্র হিসেবে নয়। এই সম্পর্কের ভবিষ্যৎ কী? শেষ কোথায়? এক ছাদের নিচে থাকলেও তারা কোনোদিন একে অপরের মিত্র হতে পারবে না। মনে ঘৃণা পুষে সংসার হয় না। সংসার মানে বোঝাপড়া, মানিয়ে নেওয়া। কিন্তু যখন সম্পর্কের ভিত্তিতেই শত্রুতা তখন সেই বোঝাপড়া সম্ভব হবে কি করে? কাবির নিঃশব্দে একটা দীর্ঘ শ্বাস ফেলল।

তাদের আলোচনা গড়ালো জমিজমার পুরোনো বিরোধে, খান আর দেওয়ানদের সেই দীর্ঘদিনের দ্বন্দ্বে। আখতারুজ্জামান খান ও কলিমউদ্দিন দেওয়ানের বাবা ছিলেন একজনই, কিন্তু মা আলাদা। মায়ের পদবী ব্যবহার করা শুরু করেছিল তারা মায়েদের সিদ্ধান্তে।

বাবার মৃত্যুর পর দুই মা যে দ্বন্দ্বের আগুন জ্বালিয়েছিলেন তা এখনো দাউদাউ করে জ্বলছে উত্তরসূরিদের হৃদয়ে।

খানরা বরাবরই দাবি করে এসেছে, দেওয়ানরা অন্যায্যভাবে বেশি জমি দখলে রেখেছে। অথচ বাস্তবে প্রতাপের দিক থেকে খানরাই এগিয়ে।

ক্ষমতা, প্রতিপত্তি সবকিছুই তাদের হাতে। কিন্তু তবুও জমির লোভ ত্যাগ করতে পারেনি তারা। জমির খাতায় মালিকানার হিসাব যা-ই বলুক, খানদের দৃষ্টিতে দেওয়ানদের হাতে থাকা প্রতিটি কাঠা তাদের প্রাপ্য।

আর সেই দাবিকে আরও পোক্ত করে পঁচিশ বছর আগের সেই ঘটনা, যা দুই পরিবারকে রক্তের বন্ধন থেকেও আলাদা করে দিয়েছে। বছর পেরিয়েছে, প্রজন্ম বদলেছে, কিন্তু সেই স্মৃতি আজও ভোলেনি কেউ। বরং সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বিরোধের শিকড় আরও গভীরে প্রোথিত হয়েছে।

দেওয়ানরা ব্যবসা-বাণিজ্যে এক দশক ধরে দারুণ সফল। তাদের সাফল্য খানদের গা জ্বালানোর কারণ। ঈর্ষার আগুনে জ্বলতে থাকা খান পরিবার তাই তাদের পথে বসিয়ে দিতে চায় বহুদিন ধরেই। গোপনে গোপনে চক্রান্ত, ষড়যন্ত্র কিছুই বাদ রাখেনি।

আসলাম খান পেশায় রিয়েল এস্টেট ব্রোকার, কিন্তু ব্যবসার আড়ালে কীভাবে ফায়দা লুটতে হয়, তা সে ভালোই জানে। অন্যদিকে আরযাব খান পুলিশের উঁচু পদে থেকেও আইনের অপব্যবহারে সিদ্ধহস্ত। ঘুষ, চাঁদাবাজি, অনৈতিক লেনদেন, এমন কোনো অপকর্ম নেই যা সে করেনি। সাধারণ দরিদ্র মানুষরা তার নাম শুনলেই ভয়ে কাঁপে। কত মানুষের দীর্ঘশ্বাস, অভিশাপ নিয়ে তাদের দিনরাত কাটে সে হিসেব কে রেখেছে?

আর আশিষ খান ও আরিশ খান এখনো বাপের হোটেলে আরামে দিন কাটায়, বিলাসিতায় মত্ত।

আর এদিক দেওয়ান বাড়ির কাবির সম্পূর্ণ ভিন্ন। সততা, নিষ্ঠা আর পরিশ্রম দিয়ে নিজেকে গড়ে তুলেছে সফল উদ্যোক্তা হিসেবে। তার ব্যবসার মূল ক্ষেত্র মধু উৎপাদন ও রপ্তানি। বহুবছর ধরে খানদের এই মধুর ব্যবসা রয়েছে। কাবিরের হাত ধরে সেই ব্যবসা আরও উপরে উঠেছে।

খান পরিবারের নিজস্ব মধুর খামার রয়েছে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে। বিশেষ করে পাহাড়ি ও বনাঞ্চলসংলগ্ন এলাকায় যেখানে ফুলের পরাগায়ন স্বাভাবিকভাবে বেশি হয়।

কাবির তার মধুর উন্নত প্রক্রিয়াকরণ, বিশুদ্ধতা পরীক্ষা ও ব্র্যান্ডিংয়ের মাধ্যমে তার কোম্পানিকে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নিয়ে গেছে যা খানদের ঈর্ষার কারণ বটে। স্থানীয় বাজার ছাড়িয়ে মধ্যপ্রাচ্য, ইউরোপ ও এশিয়ার বিভিন্ন দেশে কাবিরের কোম্পানি মধু সরবরাহ করে। তার এই সাফল্য খানদের চোখে তীব্র কাঁটার মতো বিধে।

এছাড়াও সমাজে দেওয়ানদের একটা আলাদা জায়গা আছে। তাদের আড়ালে দাঁড়িয়েও মানুষ তাদের সুনাম করে।

কিন্তু খানদের ক্ষেত্রে তা ব্যতিক্রম। মানুষ সামনে তাদের প্রতি শ্রদ্ধা দেখালেও আড়ালে প্রতিনিয়ত অভিশাপ দিতে থাকে। অন্যের জীবন জাহান্নাম বানিয়ে কিভাবে নিজেরা বিলাসিতায় মত্ত থাকতে পারে তা খানদের না দেখলে কেউ বুঝতেই পারবে না ।

আলোচনার একপর্যায়ে কাবির বলে উঠল,

“আমি বড় জেঠার খোঁজ না পাওয়া অব্দি কোনো কাগজে সই করব না। শেয়ারের ব্যবসা নিয়ে আমার কোনো দ্বিমত নেই কিন্তু বড় জেঠা আগে ফিরুক। কথা ছিল বিয়েটা হলে বড় জেঠার খোঁজ এনে দেবে। আরযাব খান কথাটা কি ভুলে গিয়েছে?”

আরযাব খান কপাল কুঁচকে বলল,

“আমি কি সুপারম্যান যে তোমার জেলখাটা বড় জেঠা কোথায় তা আমি জানব? পাগল মানুষ। কোথায় গিয়ে মরে আছে কি করে জানব? পুলিশ তাকে খুঁজছে। না পেলে আমাদের কিছু করার নেই।”

কাবির দাঁড়িয়ে পড়লো সাথে সাথে।

“কথা ঘুরাবিনা একদম।”

কাওসার দেওয়ান তার হাত ধরে ফেলল শক্ত করে। আরযাব খান বলল,

“গায়ে হাত তুলবি নাকি?”

কাবির বলল,”হাত নোংরা করতেও আমার আলসেমি আছে। কিন্তু যা বলছি সেটা শুনে রাখ। বড় জেঠার যদি কিছু হয় তাহলে আমি কাউকে ছাড়ব না।”

আসলাম খান বলল,”আমার ফুপুকে মারছে তোর জেঠা।”

কাদিন বলে উঠল,”আর আমার মাকে তোমার ফুপু মেরেছে।”

আসলাম খান গর্জে বলল,”প্রমাণ দেখা। তোর জেঠা আমার ফুপুকে প্রকাশ্যে গুলি করে মেরেছে। তোর মাকে ফুপু মেরেছে এটার প্রমাণ কোথায়? তোর মাকে তোর বাপই মেরেছে। তোর পাগল বাপ।”

কাদিনের রক্ত টগবগ করে ফুটতে থাকে। বয়োজ্যেষ্ঠ আখতারুজ্জামান খান হাত তুলে চেঁচিয়ে বলে,

“থামো সবাই। কি শুরু করলে? এরকম করতে থাকলে শত্রুতা বাড়তেই থাকবে। কলিমউদ্দিন তুই কি চাস তা তোর ছেলে আর নাতিদের বলে দে।”

বৃদ্ধ কলিমউদ্দিন দেওয়ান কাবিরকে বলেন,

“কাগজে সইখানা করে দাও দাদুভাই।”

কাবির নিজ সিদ্ধান্ত অটল।

“অসম্ভব। আমি একটা সইও করব না। এদের আমি একদণ্ডও বিশ্বাস করিনা। যারা মানুষের জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলতে পারে তারা সবকিছু করতে পারে। বড় জেঠাকে সুস্থ স্বাভাবিক অবস্থায় না পাওয়া অব্দি আমি কোনো কাগজে সই করব না।”

ইথিকা বলল,”আপনার জেদ ছাড়ুন। যা বলছে তাই করুন। শুধু শুধু কেন ঝামেলা বাড়াচ্ছেন?”

তার কথা শেষ হওয়ার আগেই কাবির গর্জে উঠে বলল,

“এই চুপ। আমাকে তোমার গোলাম ভেবেছ? তোমার কথা কেন শুনব আমি? একদম পন্ডিতগিরি দেখাবে না। তোমার কি কাজ এখানে?”

সবাই কেঁপে উঠল। ইথিকা চুপসে গেল। তাকে এভাবে বলতে পারল? কাওসার সাহেব কাবিরের উদ্দেশ্যে বলল,

“কাবির শান্ত হও। আমরা অন্য প্রসঙ্গে যেতে পারি। এভাবে কোনোকিছুর সমাধান হবে না।”

কাবির বহুকষ্টে শান্ত হয়ে বসল। দুই পরিবারের মধ্যে চুক্তি হয়েছে বিয়ের আগে। এই চুক্তির মধ্যেই বহু হিসাব-নিকাশ, পুরনো দ্বন্দ্বের আপস, আর ভবিষ্যতের মোড় ঘোরানোর গোপন চাল লুকিয়ে ছিল তা বুঝতে পেরেছিল দেওয়ানরা। কিন্তু তারপরও মত দিতে হয়েছিল বড় জেঠাকে জেল থেকে ছাড়াতে।

চুক্তিগুলো ছিল এমন, দেওয়ানদের বিরুদ্ধে যত মামলা রয়েছে, সেগুলো তুলে নেবে খানরা। বিশেষ করে দেওয়ান পরিবারের বড় সন্তান কাবিরের জেঠা যিনি দীর্ঘদিন ধরে জেলে আছেন তাকে মুক্ত করার ব্যবস্থা করবে।

বিনিময়ে দেওয়ানরা তাদের লাভজনক শেয়ারের ব্যবসায় খানদের অংশ দেবে। এতে খানরা একপ্রকার ব্যবসার নিয়ন্ত্রণও পাবে।

দুই, যেসব জমিজমা নিয়ে দুই পরিবারের মধ্যে বছরের পর বছর বিরোধ চলেছে, তা মিটমাট হবে। দেওয়ানরা বিতর্কিত জমিগুলো খানদের নামে লিখে দেবে। যাতে ভবিষ্যতে এ নিয়ে আর কোনো সমস্যা না থাকে।

চুক্তির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ। ইথিকা খানমকে দেওয়ানদের ছেলের সঙ্গে বিয়ে দিতে হবে, যাতে দুই পরিবারের বন্ধন আরও দৃঢ় হয়।

কিন্তু জেল থেকে ছাড়িয়ে আনার পর বড় জেঠা হঠাৎ নিখোঁজ হয়ে যায়। দেওয়ান বাড়ির সবার দৃঢ় বিশ্বাস এসবের পেছনে খানদেরই হাত আছে। দেওয়ানদের হাতে রাখার জন্য তারা এমন ঘৃণ্য কাজ করতেই পারে।

আলোচনার শেষ পর্যায়ে গুরুজনেরা কথা বলল। কাবিরদের কথা বলা নিষিদ্ধ করা হলো। আখতারুজ্জামান খান বলল,

“যেহেতু আমরা এখন একটা সম্পর্কে আবদ্ধ হয়েছি সেহেতু আমি চাই না আর কোনো খুনাখুনি হোক আমাদের মধ্যে। আমাদের সবার উচিত কামরানকে খুঁজে বের করা। কাবির আর ইথিকার বিয়ে হয়েছে। ওরা সুখী হোক এটাই আমার শেষ চাওয়া।”

কাবির চুপচাপ বুড়োর নাটকীয় কথাবার্তা শুনছিল। অথচ সবকিছুর মাস্টারমাইন্ড এই বুড়ো। মৃত্যুর দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে এত নাটক করতে পারে তা এই আখতারুজ্জামান খানকে না দেখলে বোঝার উপায় নেই।

বৈঠক শেষ হলো এই কথা দিয়ে যে আপাতত কামরান দেওয়ানকে খুঁজে বের করতে হবে। তার আগে কোনো কথা হবে না। কোনো সই দেবে না। আজকের আলোচনায় শেষ জয়টা দেওয়ানদেরই হলো।

কদমতলী থেকে ফেরার জন্য দেওয়ানরা সবাই গাড়িতে উঠে পড়ল। দাদাভাই ইথিকার দিকে তাকিয়ে বলল, “যাও, বরের সঙ্গে চলে যাও।”

ইথিকা গায়ে শালটা ভালো করে জড়িয়ে ধীর পায়ে কাবিরের গাড়ির দিকে এগিয়ে গেল, দরজার হাতলে হাত রাখল। কিন্তু দরজা খুলে বসার আগেই ইঞ্জিন গর্জে উঠল। কাবির গাড়ি ছেড়ে দিল। ইথিকা হতভম্ব!

ধুলো উড়িয়ে কাবিরের গাড়ি সামনে এগিয়ে গেল, তার অস্তিত্বকেই অগ্রাহ্য করে। দাদাভাই ও অন্যরা বিস্মিত চোখে দৃশ্যটা দেখল। কয়েক সেকেন্ড নীরব থাকার পর দাদাভাই বিরক্ত স্বরে বলল, “কী হলো এটা?”

ইথিকা কোনো উত্তর দিল না। শালের আড়ালে হাত দুটো শক্ত করে মুঠো করল। ঠোঁট চেপে ধরে সামনের গাড়িটা হারিয়ে যেতে দেখল। আরযাব খান গাড়ির দিকে পিস্তল তাক করতেই আসলাম খান হাতটা নামিয়ে দিয়ে বলল,”পাগলামি রাখ।”
ইথিকা রাগে কাঁপছে তখনো।

______________

ইথিকা রাগ মাথায় নিয়ে দেওয়ান বাড়ি পৌঁছামাত্রই লুবনা বেগম এসে বলল,”কাবিরের সাথে তো বাড়ি ফিরতে পারতে বৌমা।”

ইথিকা বলল,”আপনার ছেলে আমাকে অপমান করেছে। আমাকে ফেলে চলে এসেছে। এভাবে চলতে থাকলে আমি এই বাড়িতে থাকব না।”

বড় ফুপু এসে বললেন,”বেশ করেছে। তুমি ওখানে কেন গিয়েছ? ভাইদের হয়ে গান গাইতে? যার বউ হয়ে এই বাড়িতে এসেছ তার বিরুদ্ধে দাঁড়াতে? তুমি এই বাড়িতে না থাকলে আমরা বরং খুশিই হব বুঝলে?”

ইথিকা বলল,”আমি আপনার সাথে কথা বলছিনা।”

“একদম চুপ।”

বড় ফুপুর ধমক খেয়ে ইথিকা আর এক মুহূর্তও দাঁড়াল না। চোখের কোণে আগুন নিয়ে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে গেল। পায়ের ভারী শব্দ জানান দিচ্ছিল তার রাগ।

ঘরে ঢুকতেই চোখে পড়ল, কাবির দেওয়ান ফোনে ব্যস্ত। টেবিলের ওপর অনেকগুলো কাগজ ছড়ানো, পাশে খোলা ল্যাপটপে ওয়ার্ড ফাইল দেখা যাচ্ছে।। ইথিকা মুখ খুলতেই কাবির একহাত তুলে ইশারায় থামিয়ে দিল। সে মনোযোগ দিয়ে ফোনের ওপাশের জনের কথা শুনছিল, মাঝে মাঝে ধীর গলায় জবাব দিচ্ছিল।

“প্যাকেজিংটাও ঠিকমতো করাও, আর শুনো, শহরের নতুন দোকানগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ করেছ? এবার থেকে রেগুলার সাপ্লাই দেবে ওখানে।”

ফোনের ওপাশের মানুষ মনে হয় কিছু বলল, কাবির সাথে সাথে মাথা নাড়িয়ে বলল, “ঠিক আছে। তুমি আমার সঙ্গে পরে বসো খাতাপত্র নিয়ে।”

ফোন রেখে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল কাবির। ইথিকা তখনও দরজার কাছে দাঁড়িয়ে, ঠোঁট বাঁকিয়ে তাকিয়ে আছে। কাবির তাকে দেখেও না দেখার ভান করল, গম্ভীর মুখে টেবিলের নথিপত্র গুছাতে লাগল।

ইথিকা বলল,”আপনার বড়ফুপু আমার সাথে সারাক্ষণ ঝগড়া করছে। উনি ভেবেছেনটা কি? আমি বউ হয়েছি বলে আমার সাথে যা ইচ্ছে তাই করবে?”

কাবির ল্যাপটপটা অফ করল। ইথিকা তার পেছনে এসে দাঁড়াল। বলল,

“আমি শুনতে পাচ্ছেন আমার কথা?”

কাবির তার দিকে ফিরে তাকাল। বলল,

“পাচ্ছি। এখন বলো কি করলে তুমি খুশি হবে। ফুপুকে গুলি করব?”

ইথিকা হকচকিয়ে গিয়ে বলল,

“আপনি আমার সাথে মজা করছেন? আজ আলোচনায় জিতে এসে নিজেকে খুব বড় কিছু মনে করছেন দেখছি।”

কাবির বলল,”তোমার সাথে তর্ক করার রুচি নেই আমার। সামনে থেকে সরো।”

ইথিকা সরল না। বরং তার বুকে হাত ঠেকিয়ে ধাক্কা দিয়ে বলল,

“আপনি ওদের বলে দেবেন আমার সাথে যেন ঝগড়া না করে। আমি কি করতে পারি ওদের কোনো ধারণাও নেই।”

কাবির সোজাসাপটা বলল,”যতদিন আছ ততদিনে মানিয়ে চলো। তোমার স্থায়ীত্ব বেশিদিন না এই বাড়িতে। কথা কানে গেল?”

বলেই কাবির তাকে সরিয়ে দিয়ে নিজের কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। ওদিকে ফোন বাজছে আবার। ফোনটা নিতে যাবে তখুনি ইথিকা ফোনটা তুলে নিল। কলটা কেটে দিয়ে ফোনটা পেছনে লুকিয়ে কাবিরকে বলল,

“আমার স্থায়ীত্ব বেশিদিন না একথা বলে ভয় দেখাচ্ছেন?”

কাবির তার দিকে তাকিয়ে একটা বড় দীর্ঘশ্বাস ফেলল। তারপর আলতোভাবে কব্জির উপর ধরল। ইথিকা তার দিকে রাগত দৃষ্টিতে চেয়ে আছে। কাবির ধীরেধীরে তার হাত থেকে নিজের ফোনটা কেড়ে নিতে নিতে বলল,

“কোন দুঃখে আমি তোমার সাথে সারাজীবন কাটাব বলতে পার? জীবনটা কি ছেলেখেলা? তোমার আর আমার পথ আলাদা। দুই মেরুর দুজন মানুষ একই ছাদের নীচে রাত কাটাতে পারে কিন্তু ওটাকে সংসার বলে না। তুমি তোমার মতো কাউকে ডিজার্ভ করো। আমি আমার মতো কাউকে। তোমার কাছে ডিভোর্স তো কোনো ব্যাপারই না তাই না?”

“আপনাদের কাছেও কোনো ব্যাপার না।”

“তুমি আমার জীবনে আসার পর ডিভোর্স “কোনো ব্যাপার না” হয়ে গেছে। আগে অনেক বড় ব্যাপার ছিল।”

“আমি কি করেছি?”

“তুমি ডিভোর্সটা সহজ করে দিয়েছ আমার চোখে।”

ইথিকা হেসে ফেলে বলল,

“আপনার নিজেকে নিয়ে খুব অহংকার না? আপনি সত্যবাদী যুধিষ্ঠির, পরোপকারী, দায়িত্বশীল, সম্মানিত সফল মানুষ। কিন্তু একটা কথা কানে ভালো করে ঢুকিয়ে নিন। আপনার এই অহংকারের মর্যাদা কোনোদিন কেউ দেয়ার জন্য আপনার জীবনে আসবে না। আমি আসতে দেব না। যাকে দেখে থুতু ছিটেছিলেন তার সাথে আপনাকে ঘর করতে হবে। না ধরতে পারবেন না ছাড়তে পারবেন।”

কাবির তার চোখের দিকে তাকিয়ে বলল,

“তুমিও এই বাড়িতে পড়ে থেকে কিচ্ছু পাবে না। আমি তোমাকে ইচ্ছাকৃত উপেক্ষা করব না। অপমান করব না। অবহেলা প্রশ্নেই আসে না। তুমি আমার কিছু হলে তখন এসব করতাম। তুমি আমার কিছুই না। তুমি না আমাকে কষ্টে মারতে পারবে না আমাকে হেনস্তা করে নিজে খুব আরামে থাকবে। কোনোটাই হবে না।”

ইথিকা বাঁকা হেসে বলল,”আপনি আমাকে পাত্তা না দিলে আমি বোধহয় মরে যাব? ইশশ!”

কাবির বলল,”না মরে যাবে না। মরে যাওয়া এত সহজ না। কিন্তু তোমার জায়গাটা নড়বড়ে হয়ে যাবে। তুমি ভেবেছ আমি তোমাকে খুব অত্যাচার করব, বেঁধে রাখব, স্বাধীনতা দেব না। আর তুমি ঠিক তাই তাই করবে যা আমি অপছন্দ করি। কিন্তু আমি তোমাকে এখনি বলে দিচ্ছি। তুমি যা ইচ্ছে তাই করতে পার।”

ইথিকা বলল,”সত্যি? আবার পরে বলবেন না তো আমি নির্লজ্জ?”

“বলব না। কাল রাতে ভাবলাম তোমার আমার সম্পর্কটা নেহাতই একটা চুক্তি। হ্যাঁ তোমার কাছে এটা বিয়ে হতেই পারে কিন্তু আমি এই সম্পর্কের প্রতি একটুও টান অনুভব করছিনা। তাই তোমার উপর অধিকার দেখানোর ব্যাপারটা হাস্যকর। তুমি তোমার ইচ্ছেমত চলাফেরা করো। আমার কোনো আপত্তি নেই।”

ইথিকা হাঁফছেড়ে নাটকীয় ভঙ্গিতে বলল,”উফ মনে হচ্ছে উদ্ধার করে দিয়েছেন। মিস্টার কাবির দেওয়ান আমাকে স্বাধীনতা দেয়ার আপনি কে? আমি বরাবরই স্বাধীন। আমাকে আমার মা বাবা স্বাধীনতা দিয়েছে। আপনি দেয়ার কে? আপনি না দিলেও আমি যেন আপনার হাতে বাঁধা পড়ার জন্য বসে আছি? শুনুন আমি একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছি।”

কাবির কপাল কুঁচকে বলল,”কি?”

“আমি একা থাকতে চাই। আই মিন এই বাড়িতে থাকব না। অন্য কোথাও একা থাকব। বিয়ের পর মেয়েদের আলাদা স্পেস দরকার হয়। এরকম ভরা বাড়ি আমার ভালো লাগেনা।”

কাবির বলল,”সমস্যা কি? থাকো। টাউনে আমাদের বাসা আছে। ওখানে থাকতে পারবে। নিজের ইচ্ছেমত থাকো। আমারও রাতের ঘুমটা ভালো হবে।”

ইথিকা খেঁকিয়ে উঠে বলল,”কি বললেন?”

কাবির তার দিকে ফিরে বলল,”মানে আমি আমার বেডে আরামে ঘুমাতে পারব। আরেকটা কথা।”

“কি?”

কাবির একটু ইতস্তত করে বলল,

“যখন তখন আমার গায়ে হাত না দিলে খুশি হব। কে আমার গায়ে হাত দেবে, কে দেবেনা এই সিদ্ধান্ত নেয়ার স্বাধীনতা নিশ্চয়ই আমার আছে?”

ইথিকা গোলগোল চোখে তাকাল। বুকে হাত ভাঁজ করে বলল,

“ওকে ফাইন। আরেকটা কথা আমি কাল একটা ক্যাম্পে যাচ্ছি। আপনি কাইন্ডলি আপনার ওই প্যানপ্যানানি ফুপুকে বলে দেবেন। বিরক্তিকর মহিলা। না বললে আবার বলবে কিছু বলিনি কাউকে। অসহ্য।”

কাবির জানতে চাইল,”কতদিনের জন্য যাচ্ছ?”

ইথিকা বলল,”হতে পারে দুই তিন সপ্তাহ। অনেক ঘুরব।”

কাবির বলল,”যাক কিছুদিনের জন্য তো রেহাই পেলাম।”

ইথিকা ফের বলল,”একটা কথা বলি?”

“বলো।”

“আপনার দাঁড়ি গোঁফগুলো একদম রাজ-রাজাদের মতো। এগুলো স্টাইলিশ করে ছাঁটতে পারেন। আমার ফ্রেন্ডসরা দেখে বলবে তোর বর সিরাজুদ্দৌলার আমলে পড়ে আছে। মানে বুঝতেই পারছেন কি বলছি?”

কাবির গালে হাত বুলিয়ে বেরিয়ে যেতে যেতে বলল,”নজর ঠিক করো।”

ইথিকা তার পিছু পিছু ছুটে গিয়ে বলল,

“আ”এম সিরিয়াস কাবির।”

কাবির যেতে যেতে বলল,”তোমার ফ্রেন্ডসরা এলে আমাকে জানিও। সিরাজুদ্দৌলার পোশাক পড়ে বসে থাকব।”

ইথিকা বিরক্ত হয়ে বলল,”ডিজগাস্টিং!”

কাবির সোজা চলে গেল। ইথিকা মনে মনে বিড়বিড় করে বলল,”ঘুমের মধ্যে কেটে দেব সব দাঁড়ি। তারপর যা হবার হবে।”

রাতে কাঁচি নিয়ে ঘুমন্ত কাবিরের পাশে গিয়ে বসল সে। রাত গভীর, পুরো বাড়ি নিস্তব্ধ। শুধু ঘড়ির কাঁটা একটানা শব্দ করে যাচ্ছে।

কাবির বিছানার একপাশে নির্ভার ঘুমে মগ্ন, পাশ ফিরে শুয়ে আছে। গম্ভীর মুখটা তখন বেশ শান্ত। ইথিকার চোখেমুখে দুষ্টু হাসি খেলা করছে।

সে ধীরে ধীরে শরীরটা কাবিরের দিকে সামান্য ঝুঁকিয়ে গালে কাঁচিটা লাগাতে যাবে হঠাৎ কাবির নড়ে উঠল। ইথিকার হাত থেমে গেল। নিঃশ্বাস বন্ধ করে স্থির হয়ে রইল সে।

কাবির চোখ খুলল। কিছুটা বিভ্রান্ত হয়ে সামনের দিকে তাকাতেই দেখল ইথিকা তার পাশে বসে আছে, হাতে কাঁচি। সে একঝটকায় উঠে পড়ল।ইথিকার কাছ থেকে কাঁচিটা কেড়ে নিতে যেতেই ইথিকা ধপাস করে শুয়ে পড়ল। তার পিঠের নীচে কাঁচিটা। কাবির তার পিঠের নীচে হাত গলিয়ে কাঁচিটা খুঁজতে খুঁজতে বলল,

“এবার বাড়াবাড়ি হচ্ছে। তুমি সবকিছু নিয়ে তামাশা করতে পার না। কোন সাহসে দাঁড়িতে হাত দাও?”

ইথিকা তার দিকে তাকিয়ে শক্ত কন্ঠে বলল,
“আমি পর পুরুষের দাঁড়িতে হাত দিইনি। বরের দাঁড়িতে হাত দিয়েছি। আমি না চাইলে এই দাঁড়ি রাখতে পারবেন না।”

“ফালতু কথা বলবে না একদম। জীবনে নিজের মর্জিমাফিক সব হয় না।”

কাবির কাঁচিটা ধরামাত্রই ইথিকা তার হাতটা পিঠ দিয়ে শক্ত করে চেপে ধরল। কাবির অস্বস্তিতে ভুগল। গলা খাঁকারি দিয়ে বলল,

“খানি পিঠ আলগা করো। কাঁচি টান দিলে ব্যাথা পাবে। এককথা বারবার বলব না।”

ইথিকা শক্ত কণ্ঠে বলল, “আগে কাঁচিটা নিয়ে দেখান।”

কাবির দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “আমি এখনো নিতে পারি। কিন্তু তুমি ব্যথা পাবে।”

ইথিকা ঠোঁট বাঁকিয়ে বলল,

“আমি এত সহজে ব্যথা পাই না। সাহস থাকলে কাঁচিটা নিন।”

কাবির তার চোখের দিকে তাকিয়ে দেখল তাকে ও পরীক্ষা করছে। সে আঘাত করার সাহস রাখে কিনা?

তাই সে আর তর্ক না করে কাঁচিটা ধরে হ্যাঁচকা টান দিল। ঠিক সেই মুহূর্তে ইথিকার শরীর ঝাঁকিয়ে উঠল, ব্যথায় চোখ কুঁচকে সে অপ্রত্যাশিতভাবে কাবিরকে জড়িয়ে ধরল। কাবির হতভম্ব হয়ে দেখল কাঁচির ধার শুধু তার ব্লাউজই ছিঁড়েনি পিঠেও আঘাত করেছে। রক্ত বেরিয়ে এসেছে।

কাবির পিঠের ওইখানে ইথিকার শাড়ি দিয়ে আলতোকরে চেপে ধরে বলল,

“হয়েছে। কাল সকালে চার বাঁদর খান হাজির হয়ে জানতে চাইবে তাদের বোনের পিঠে কেন ছুরি চালালাম?”

চলমান..