মনবিবাগী দিওয়ানা পর্ব-২০+২১+২২

0
190

#মনবিবাগী_দিওয়ানা
#পর্ব_২০
#প্রিমা_ফারনাজ_চৌধুরী

আর্যাব খানকে এগোতে দেখে কাসেদ কল্পনার হাত ধরে চেঁচিয়ে উঠল,

“তুই যাবি এখান থেকে? মা গাড়িতে একা বসে আছে। বড় ভাই ফোন দিচ্ছে। চল।”

কল্পনা আর্যাব খানের দিকে চোখ লাল করে তাকিয়ে দাঁতে দাঁত চিবিয়ে কিছু একটা বিড়বিড় করে মেয়েটাকে নিয়ে চলে যেতে লাগল।

আর্যাব খান আরাম করে গাড়িতে ঠেস দিয়ে দাঁড়াল। কল্পনারা সবাই চলে যাচ্ছে। কল্পনা যেতে যেতে ঘাড় ফিরিয়ে তাকাল। জুতোর ধূলো ঝাড়ল আর্যাব খানকে দেখিয়ে দেখিয়ে তারপর তাচ্ছিল্যের সাথে চোখ ফিরিয়ে নিয়ে চলে যেতে লাগল। আর্যাব খান হাসল। তার হাসির রোগ বারোমাস।

______

দেয়ালের সব ছবি ইথিকা সরিয়ে ফেলেছে। কাবির পছন্দ করেনি ওসব। তার আগে ভাবা দরকার ছিল।
ছবিগুলো সব যত্ন করে তার অ্যালবামে রেখে দিল। কাবির বাইরে গেছে। ড্রেসিং টেবিলটা ইথিকার পছন্দ হয়নি। ওটা পাল্টে আনবে। ইথিকা ডিজাইন দেখিয়ে দিয়েছে। একস্ট্রা বারো হাজার টাকা বেড়ে গেছে ওই ডিজাইনের ড্রেসিং টেবিলটাতে। কাবির তবুও কিছু বলেনি। ইথিকার পছন্দের দাম দিয়েছে।

ইথিকা ছবিগুলো অ্যালবামে রেখে নিজের কাপড়চোপড় গুছিয়ে রাখল কাবার্ডে। ওয়েস্টার্ন আউটফিটগুলো নীচের ড্রয়ারে রেখে উপরে সব শাড়ি আর সেলোয়ার-কামিজ সাজিয়ে রাখল। লুবনা বেগম বলেছেন সেলোয়ার-কামিজ পরতে কোনো অসুবিধা নেই।

লুবনা বেগম কল্পকে নিয়ে ফিরে আসার পর ইথিকা কল্পনার চেঁচামেচি শুনতে পেয়েছে। মেঝ ভাইয়ার নাম নিয়েছিল সে। হয়তো মেঝ ভাইয়া তাকে কিছু বলেছে। ইথিকা কান পাতেনি। কল্পনা তার বাপের বাড়ির কাউকে পছন্দ করেনা সেটা সে জানে। তাছাড়া ওর রাগও বেশি। ইথিকার একদম পছন্দ না কল্পনাকে।

কল্পনা বোধহয় এখনো চেঁচাচ্ছে। চেঁচাচ্ছে নয় ঠিক কাউকে কিছু অভিযোগ দিচ্ছে। কাবিরকে?

ইথিকা ঘর থেকে বের হলো। কাদিনের মুখোমুখি হতেই কাদিন বলল,

“ড্রেসিং টেবিলটা এসেছে। লোকজন আসছে।”

কিছুদিন আগে হলেও ইথিকা এইসব কথার মানে বুঝত না। আজ বুঝতে পেরেছে। কাদিনের এই কথার মানে হচ্ছে লোকজন ড্রেসিং টেবিলটা নিয়ে আসছে, আর সে এই ঘর থেকে সরে যাক। বাপরে এত নিয়মকানুন। এই বাড়ির মেয়েরা কি কঠোর নিয়মের মধ্যে বড় হয়েছে।

ইথিকা হাঁটতে হাঁটতে লুবনা বেগমের ঘরের পাশ দিয়ে যাচ্ছিল। কাবিরকে ওই ঘর থেকে বের হতে দেখা গেল। কল্পনা কিরণকেও দেখা গেল। নিশ্চয়ই তার নামে বদনাম করেছে ভাইয়ের কানের কাছে।

ইথিকা রান্নাঘরে চলে গেল। রাতের খাবারের আয়োজন চলছে। বড়ফুপুকে দেখে ইথিকা চলে আসার জন্য নিচ্ছিল। আবার কি মনে করে রান্নাঘরে ঢুকল। লায়লা খালা শুরুতেই মুখ মোচড় দিল। ঝিনুক চোখ লাল করে যদিও তাকে শাসাচ্ছে মুখ না মোচড়ানোর জন্য। কাবির ভাইজান একবার টের পেলে চাকরি যাবে।

ইথিকা বলল,”রাতে আমি ভাত খাই না।”

বড়ফুপু ঘাড় ফিরিয়ে তাকাল। উনি বোধহয় কিছু একটা খাচ্ছিলেন। এই মোটা মহিলাটি সারাক্ষণ কি যেন চিবোতে থাকে। পান? হয়ত তাই। ঠোঁট সারাক্ষণ লাল হয়ে থাকে।

“রাতে কি খাও তুমি?”

বড়ফুপু প্রশ্নের উত্তরে ইথিকা বলল,

” স্যুপ, স্মুদি, স্যালাড। হালকা কিছু হলেই হবে।”

“নিজে বানিয়ে খাও বাপু।”

ইথিকা নিজের জন্য বয়েলড এগ, তারপর কলা, দুধ, ওটস, প্রোটিন পাউডার দিয়ে প্রোটিন স্মুদি বানিয়ে নিয়েছে। সে কাজ পারেনা এমন না। মায়ের সাথে সাথে সে কিচেনে কাজ করতো মায়ের হলিডে থাকলে। চাইলে সব পারে। কিন্তু চেষ্টা করেনা। আলসেমি তার শিরায় শিরায়। ছোট থেকেই সে আহ্লাদে আহ্লাদে বড় হয়েছে। অসুস্থ হলে ডাক্তার নার্স তাকে ঘিরে থাকত। কিছু খেতে ইচ্ছে হলে হরেক রকমের পদ সামনে হাজির হতো। কিন্তু এখন জীবনটা অন্যরকম হয়ে গেছে।

কিরণ কিচেনের দরজার কাছে এসে দাঁড়াল।

“ভাবি ভাইয়া ঘরে ডাকছে। এই ড্রেসিং টেবিলটা ঠিকঠাক হয়েছে কিনা দেখে নাও।”

ইথিকা তার খাবারগুলো নিয়ে বেরিয়ে গেল। ঘরে ঢুকতেই কাবির তার দিকে তাকাল। তারপর বিছানার উপর থেকে পেপারগুলো সরিয়ে নিতে নিতে বলল,

“সব দেখে নাও। ঠিকঠাক আছে কিনা।”

ইথিকা ট্রে’টা টেবিলে রেখে ড্রেসিং টেবিলের সামনে গিয়ে দাঁড়াল। তার পছন্দ হয়েছে। তার জিনিসপত্রগুলো সাজিয়ে নিল সে। আয়নায় কয়েকটা টিপও লাগিয়ে দিল। ওখান থেকে যেটা ইচ্ছে হয় সেটা সে কপালে পরে। যদিও এই বাড়ির কেউ কপালে টিপ পরেনা।

কাবির আড়চোখে তার কাজকর্ম দেখতে লাগল। তারপর দেয়ালে চোখ পড়তেই খেয়াল হলো ছবিগুলো সরিয়ে ফেলা হয়েছে। কিছু না বলে সে বেরিয়ে গেল। ইথিকা একদৌড়ে দরজার কাছে ছুটে গিয়ে বলল,

“আমি কিন্তু সব ছবি সরিয়ে ফেলেছি। এইবার কথা না বললে চলে যাব।”

কাবির তার দিকে ফিরে তাকাল। বলল,

“কল্পকে ডাকছি।”

ইথিকা ভড়কে গেল। কল্পকে কেন?

কিছুক্ষণ পর কাবির ঘরে এল। পিছুপিছু কল্পনা। পা টিপে টিপে সেও কাবিরের পেছন পেছন ঘরে ঢুকল। ইথিকা বুঝতে পারছেনা কি হচ্ছে। কাবির কল্পনাকে বলল,

“তোমার ভাবির পাশে গিয়ে দাঁড়াও।”

কল্পনা ভাইয়ের আদেশ অমান্য করলো না। কাবির ইথিকাকে বলল,

“আমি তোমাদের আজকে মিলিয়ে দিচ্ছি। ভবিষ্যতে যাতে না শুনি তোমাদের মধ্যে কথা কাটাকাটি হয়েছে। ও তোমার বোনের মতো। ভুল দেখলে চেপে রাখবে। দোষ দেখলে শোধরে দেবে।তার কাজও এটাই।”

ইথিকা কল্পনার দিকে তাকাল। তারপর চোখ সরিয়ে গম্ভীর মুখে দাঁড়িয়ে রইলো। কাবির বলল,

“কল্পকে জড়িয়ে ধরো। কল্প!”

কল্পনা এগিয়ে এল। ইথিকাও একহাত বাড়িয়ে কল্পনাকে জড়িয়ে ধরল। শেষে কাবির বলল,

“তুুমি যাও। বড়ফুপুকে পাঠাও।”

কল্পনা বেরিয়ে গেল। কিছুক্ষণ পর বড়ফুপু এল। কাবির ইথিকাকে মাফ চাইতে বলল ওমন ঔদ্ধত্য দেখানোর জন্য। বড়ফুপুকেও অনুরোধের সুরে বলল ইথিকার সাথে ভালোভাবে কথা বলতে। কারণ সে সুযোগ দিয়েছে। সে কোনো ফাঁকফোকর রাখতে চায় না যাতে ভবিষ্যতে ইথিকা আঙুল তুলে বলতে পারে যে তাকে এই বাড়ির কেউ সুযোগ দেয়নি। সে চায় না ইথিকার কোনো অভিযোগ থাকুক। সে নিজের কাছে পরিষ্কার থাকতে চায়।
তার কথা পরিষ্কার। সুযোগ যখন দিয়েছে তখন পুরোটাই দেবে। আর সেই সুযোগ ইথিকা যেভাবে ব্যবহার করবে ঠিক সেরকম ফল পাবে।

কথাগুলো দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা বাড়ির বাকি সদস্যরাও শুনতে পেয়েছে। লুবনা বেগম খুশি হয়েছেন তা দেখে। ছেলেটা পরিষ্কার করে নিজের মতামত জানিয়ে দিয়েছে। এবার বউ কি করে তা দেখার পালা।

ইথিকা বড়ফুপুকে সালাম করতে গেলে তিনি আটকে ফেলে জড়িয়ে ধরলেন। বললেন,

“তুমি ভালো হয়ে থাকলে আমার কিছু বলার দরকার নেই। ওদেরকে কোলেপিঠে মানুষ করেছি তো। কেউ ওদের ক্ষতি করুক সেটা আমি বরদাস্ত করতে পারিনা। বিয়ে যখন হয়েছে তখন সংসারী হওয়ার চেষ্টা করো। সবার কপালে কাবিরের মতো বর জোটেনা। আসি।”

বড়ফুপু বেরিয়ে গেলেন। একে একে সবাই চলে গেল। এমনকি কাবিরও। লুবনা বেগম এসে ইথিকার কাঁধে হাত রাখতেই ইথিকা চমকে উঠল। লুবনা বেগম তার চোখের জল মুছে দিয়ে বলল,

“গুরুজনের সামনে ভুল স্বীকার করলে, ছোটদের ভুল ক্ষমা করে দিলে কেউ ছোট হয়ে যায় না। তুমি আজকে প্রমাণ করে দিয়েছ তুমি ছোট নও। মন থেকে সব ঝেড়ে ফেলে ভালো থাকার চেষ্টা করো।”

____________

“ইনামের জন্মদিন কালকে। তোমার ভাবিকে বললাম ওকে একদিনের জন্য ছাড়তে। ছাড়ল না। আসলাম রাগে কিড়মিড় করছে।”

ইথিকা বলল,”তুমি ভাবিদের বাড়িতে যাও। ভাবিকে নিয়ে আসো।”

ইলিনা বেগম অবাক হয়ে বললেন,

“আমি ওদের বাড়িতে যাব? অসম্ভব। এসব কথা বলো না।”

ইথিকা রেগে গিয়ে বলল,”তাহলে আর নাতির খোঁজ নিওনা। ভাবি যাবেনা তোমাদের বাড়িতে। ইনামকে ভুলে যাও। ও ওর মায়ের কাছে ভালো থাকবে।”

ইলিনা বেগম বললেন,”কিন্তু তোমার বড় ভাই তো পাগল হয়ে যাচ্ছে ছেলের জন্য।”

ইথিকা রেগে গিয়ে বলল,”তাহলে বউকে যেতে দিল কেন? ভাবি তো বেরোতেই চাইছিল। বেরোতে দিলে কেন? একবার যখন বের হয়েছে তখন তাকে আর বাড়িতে নিয়ে আসতে পারবে না।”

ইলিনা বেগম দুশ্চিন্তায় পড়ে গেলেন। বললেন,

“জোরজবরদস্তিও করলে বিষ খাবে বলল। আমি জানিনা এখন কি করবো। আসলামও রাগের বশে কি করে ফেলে বুঝতে পারছিনা। আচ্ছা ফোন রাখো। তুমি ওখানে ভালো আছ? সব ঠিকঠাক?”

ইথিকা মৃদুস্বরে বলল,”হুম।”

“ঠিক আছে। কোনো সমস্যা হলে জানিও। ওহ হ্যাঁ জেসি এসেছিল কাল। আমি ওর মা বাবার সাথে কথা বলেছি। ওরা এখনো সিদ্ধান্ত জানায়নি।”

ইথিকা বলল,”ওর বাবা মা রাজী হবে বলে মনে হয় তোমার?”

ইলিনা বেগম সন্দিগ্ধ কণ্ঠে জানতে চাইলেন,

“কেন বলছ?”

“কল্প ওদের বাড়ির বউ হয়ে যাচ্ছে। ও জোসেফকে বারণ করে দেবে ভাইয়ার সাথে যাতে জেসির বিয়েটা না হয়। সারাক্ষণ জোসেফের সাথে কথা হচ্ছে ওর। তোমার কি মনে হয় জোসেফের সাথে ও এই বিষয়ে কথা বলছেনা?”

ইলিনা বেগম বললেন,

“যেখানে জেসি রাজী আছে সেখানে কল্পর কথায় জোসেফ কেন রাজী হবে না? সংসার তো জেসি আর আর্য করবে।”

ইথিকা বলল,”কল্প আমাদের পরিবারকে পছন্দ করেনা। ও চাইবেনা ভাইয়ার সাথে ওর ননদের বিয়ে হোক।”

ইলিনা বেগম চুপ করে রইলেন। বললেন,

“আর্যকে এই বিষয়টা জানাতে হবে।”

“ভাইয়া বিয়েতে মত দিয়েছে?”

“ও জীবনেও বিয়েতে মত দেবে বলে তোমার মনে হয়? জোর করে বিয়ে পরিয়ে দিতে হবে। ওর বিয়েটিয়ে এসবে মন নেই। দেখি কি করা যায়। তুমি সাবধানে থেকো।”

“ওকে। ড্যাড কোথায়?”

“কাজে। তুমি অফিসে যাওনি?”

“না, কাবির বলেছে ও সামলে নিচ্ছে। আমি কিছুদিন যেন বাড়িতে সময় কাটাই।”

“বেশ, যা ভালো মনে হয় করো। কিন্তু সাবধানে থাকবে। নিজের ভালো নিজেকে বুঝে নিতে হবে। ওদের বাড়ির বড়দের যত কথা কম বলবে ততই ভালো। কাবিরের সাথে সব ঠিকঠাক থাকলেই হলো।”

“হুম।”

ইলিনা বেগম ফোন রেখে দিল।

______

কল্পনা গোসল সেড়ে আসতে না আসতেই ফোন বেজে উঠল। কিরণ এসে ফোনটা তুলে কল্পনার দিকে বাড়িয়ে দিল। কল্পনা বলল,

“এখন আবার?”

কিরণ বলল,”নাও না। কি বলতে চাইছে দেখো।”

কল্পনা ফোন রিসিভ করে বলল,

“আসসালামু আলাইকুম।”

জোসেফ সালামের জবাবটা বড় করে দিল। কল্পনা হাসল। বলল,

“আপনার খাওয়াদাওয়া নেই?”

“না, সব অনিয়ম। বউ বাড়িতে এলে নিয়মকানুন মেনে চলার চেষ্টা করবো।”

কিরণ বলল,”ওলেবাবালে।”

কল্পনা তাকে ধুম করে কিল দিয়ে বলল,

“সর এখান থেকে।”

কিরণ ফোনের কাছে গিয়ে বলল,”জিজু আপনার কারণে আমার বোনও আজকাল সবকিছুতে অনিয়ম করছে।”

জোসেফ প্রাণখোলা হেসে বলল,

“এটাই জোসেফ মেহতাজে কামাল।”

কল্পনা বলল,”আহারে এত খুশি হয়ে লাভ নেই সাহেব। এসব অনিয়ম আমার নিজেরই পছন্দ না। আমি অনিচ্ছাকৃত ভাবে অনিয়ম করছি খাবারদাবারে। কিন্তু আপনি ইচ্ছে করে।”

জোসেফের প্রশ্ন ছুটে এল,

“অনিচ্ছাকৃত ভাবে কেন?”

কল্পনা কিরণকে ইশারা করলো ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে। কিরণ হেসে বলল,

“আচ্ছা বাবা যাচ্ছি। তুমি আর দুই ঘন্টায়ও ফোনটা কাটবে না। এত কি কথা বলো দুজন কে জানে।”

কিরণ বেরিয়ে গেল। কল্পনার গল্পসল্প দুই ঘন্টায়ও শেষ হলো না।

____

কাবির রাতে বাড়ি ফেরেনি। সকালে বাড়ি ফিরতেই ইথিকা তার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল।

“সারারাত কোথায় ছিলেন?”

তার রাগান্বিত চেহারা দেখে কাবিরের হাসি পেলেও সে হাসল না।

“তুমিই একমাত্র বউ। চিন্তা নেই। বন্ধুর বাড়িতে গিয়েছিলাম। আসতে দেয়নি।”

ইথিকা একটু শান্ত হলো। অথচ সে ভেবেছে সে আবার কোনো ভুল করেছে তাই কাবির বাড়ি ফেরেনি। কাবির ওয়েস্টকোট খুলে ইথিকার দিকে ভুরু কুঁচকে তাকাল।

“ভয় পেয়েছিলে?”

ইথিকা উপর-নীচ মাথা দুলিয়ে বলল,

“হুম।”

কাবির ফিরে গিয়ে হাসল। এসব বিশ্বাস হওয়ার মতো কথা? আনঝিল খানম ভয়ও পায়?

কাবির কখনোই সামনে ফিরে শার্ট পাল্টায় না। প্রতিবারের মতো আজও সে পিঠ ঘুরিয়ে দাঁড়িয়ে বোতাম খুলছে ধীরে ধীরে। চুপচাপ।

ইথিকা হঠাৎ খুনসুটি ভরা কণ্ঠে বলে উঠল,

“আমি কিন্তু সব দেখতে পাচ্ছি।”

কাবির চমকে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল। চোখেমুখে ধরা পড়ে যাওয়া মানুষটার ঘাবড়ে যাওয়া দেখে ইথিকা হেসে উঠে আয়নার দিকে আঙুল তুলে বলল,
“ওখানে, আয়নাতে।”

আয়নাটা একটুখানি ঝাপসা, কিন্তু তবুও সেখানে প্রতিফলিত হচ্ছে কাবিরের অবচেতন খোলস। মজবুত পিঠ, প্রশস্ত কাঁধ, সূর্যছায়া মেশানো ত্বক। সে বোতাম খোলা বন্ধ করতে গিয়েছিল। কি মনে করে আবারও বোতাম ছাড়িয়ে নিতে নিতে বলল,

“দেখারই জিনিস।”

ইথিকা বলল,”অবশ্যই অবশ্যই।”

বলেই সে হাসতে লাগল। কাবিরের মুখ স্বাভাবিক হতে হতে আবারও গম্ভীর হয়ে গেল। ইথিকা বলল,

“মধুওয়ালা কি মধু খায় না?”

কাবিরের প্রশ্ন,”কেন?”

ইথিকা ঠোঁট চেপে হেসে বলল,”মুখে মধু নেই, ঠোঁটে হাসি নেই।”

“একটা মানুষ সারাক্ষণ হাসবে?”

“হাসবে।”

“তুমি চেষ্টা করো।”

ইথিকা হাসল,”জি আচ্ছা।”

তার মাথা হঠাৎ চক্কর দিয়ে উঠছে। পুরো পৃথিবীটা ঘুরছে যেন। সে টেবিলের উপর হাত চেপে দাঁড়াল। কাবির সরু চোখে তাকিয়ে রইল। কি হলো হঠাৎ?

ইথিকা মাথা চেপে ধরে ঢলে পড়ে যাচ্ছিল। কাবির দ্রুতবেগে ছুটে এসে তাকে শক্ত করে ধরল। মুখ ধরে ডাকাডাকি করলো।

ইথিকা তার হাতের উপর পড়ে আছে। হঠাৎ অজ্ঞান হয়ে গেল কেন?

কাবির তাকে কোলে তুলে নিয়ে বিছানায় শুয়ে লুবনা বেগমকে ডাকতে যাবে তখুনি ইথিকা চোখ মেলে তাকাল। কাবির হতভম্ব!

ইথিকা চোখ টিপে দিল। খিলখিলিয়ে হেসে উঠল।
কাবির কিছু বলার জন্য শব্দ খুঁজে পাচ্ছে না। তার রাগ দেখে ইথিকা হাসতে লাগল জোরে জোরে। হাসতে হাসতে সেই ফাঁকে কাবিরকে কাছে টেনে নিয়ে বলল,

“চেষ্টা করলাম। এবার হাসুন।”

কাবির সরে যেতে চাইলে ইথিকা তার শার্ট খামচে ধরে রেখে বলল,

“আমি আপনার কাছে ড্রেসিং টেবিল চেয়েছি। দিয়েছেন। এবার আপনি আমার কাছ থেকে কিছু চান। নতুন কিছু। অবশ্যই দেব।”

কাবির তার মুখের দিকে চেয়ে রইলো। হয়তো এত কাছাকাছি এসেও এতটা অনুভব করা হয়নি কখনো। কাবির সুযোগ হাতছাড়া করলো না। সুযোগ পেলে সেটা কাজে লাগাতে হয়। তাই সে ইথিকার কাছ থেকে জানতে চাইল,

“মাজহাব কোথায়?”

ইথিকা প্রশ্নটা শোনামাত্রই একঝটকায় তাকে দূরে সরিয়ে বিছানা থেকে নেমে গেল। একমুহূর্তও দেরী না করে বেরিয়ে গেল ঘর থেকে। কাবির ওয়াশরুমে চলে গেল। মুখে পানি দিতে দিতে ভাবল, মাজহাবের লাশ যে করেই হোক খুঁজে বের করতে হবে।

নাজিফাকে সে চাকরি দিয়েছে। আগামী মাস থেকে চাকরিতে জয়ন করবে। খুব ছোটখাটো একটা পোস্টে। পরবর্তীতে প্রমোশন হবে। এখন মাজহাবের লাশটা পেয়ে গেলে সে জোসেফের সাথে কথা বলবে এই ব্যাপারে। নাজিফা কি খুনীদের শাস্তি চাইবে? মাজহাব তো অপরাধী। ইথিকার দোষ বেশি। কিন্তু মাজহাবও সমান অপরাধী। তাই বলে সে মৃত্যু ডিজার্ভ করেনা। মৃত্যুর আগের দিন মাজহাব ফোন দিয়ে তাকে বলেছিল সে কিছু বলতে চায়। সে একটা গ্যাঁড়াকলে পড়ে গেছে। তার প্রেমিকা তাকে হুমকি দিচ্ছে। কিন্তু মাজহাব কিছু বলার সুযোগ পায়নি। ইথিকা তাকে সুযোগ দেয়নি। মাজহাবকে সত্যিই মেরে ফেলল সে? কাবির ওসব নিয়ে আর ভাবতে চাইল না। মাজহাবের কথা মনে পড়লে ইথিকার চেহারার দিকে তাকাতে ইচ্ছে করেনা তার। মনে হয় আস্ত একটা খুনীর সাথে সে সংসার করছে। সে সব জানে কিন্তু তার হাতে প্রমাণ নেই। আর যেদিন প্রমাণ আসবে সেদিন কি হবে? কি করবে সে? সে মনেপ্রাণে চিরটাকাল খানদের ধ্বংস চেয়েছে। বড় জ্যাঠার নিখোঁজের পর এমন একদিনও বাদ যায়নি যেদিন সে আল্লাহর কাছে ফরিয়াদ জানায়নি খানদের ধ্বংস চাওয়া নিয়ে। ওরা একদিন সত্যি সত্যি গর্তে পড়বে। কিন্তু সেই সুদিনটা দেওয়ানদের জন্য যেন দুর্দিন না হয়ে দাঁড়ায়।

ইথিকা রান্নাঘর থেকে আর বেরোয়নি। লুবনা বেগমের সাথে হাতে হাতে কাজ করে দিচ্ছে। কাবির বুঝে গেছে সে মাজহাবের বিষয়টা এড়িয়ে যেতে চাইছে। কিন্তু তাকে জানতে হবে মাজহাবের খুনটা কে করেছে? ইথিকার সাথে সব মিটমাট না হলে সে পুরোপুরি সংসারে মন দিতে পারবে না। ইথিকাকে তার আপন মনে হবে না। সারাক্ষণ মনে হবে সে খুনী। নৃশংস খুনী।

ইথিকা সন্ধ্যায় কাবিরকে আর এড়িয়ে যেতে পারলো না। ঘর থেকে বেরিয়ে যাচ্ছিল তড়িঘড়ি করে। তখুনি কাবির ঘরে এসে দরজা আটকে দিল।

“তুমি সত্যিটা স্বীকার না করে আর পালিয়ে পালিয়ে থাকতে পারবে না আনঝিল। আমাকে যদি আপন মনে করে থাকো তাহলে সত্যিটা স্বীকার করো।”

ইথিকা ঘামছে। তার নাকের ডগায় ঘাম জমেছে। কপাল ঘামছে। কাবির আবারও জোর দিল।

“সত্যিটা বলো আমাকে। কে খুন করেছে মাজহাবকে?”

ইথিকার চোখে জল জমে উঠল। সে মেঝের দিকে তাকিয়ে থাকল। কাবির গর্জে উঠল,

“সত্যিটা বলো।”

ইথিকা কেঁপে উঠল,”আমি বলেছি।”

কাবিরের কপাল কুঁচকে গেল।

“মানে?”

ইথিকার ঠোঁট কাঁপছে। সে কাঁপা গলায় বলল,

“খুন করতে আমি বলেছি। আমার কথায় ভাইয়ারা..

কাবির স্তব্ধ হয়ে গেছে।

” তুমি ওকে ভালোবাসতে?”

ইথিকা কাবিরের দিকে চোখ তুলে তাকাল। কাবির প্রশ্নটা আরও জোর দিয়ে করল,

“বাসতে? বিয়ে করতে চেয়েছিলে। বিয়েতে রাজী না হওয়ায় সন্দেহ জন্মেছিল। খোঁজ নেয়ার পর ওর বউয়ের কথা জানতে পারো। তারপর খুন। সবটা কত সহজ তাই না? তোমার বুক কাঁপেনি?”

ইথিকা চুপ।

“কাঠগড়ায় দাঁড়ালে তুমিও সমান অপরাধী আনঝিল। ভুক্তভোগী আমি আর নাজিফা।”

ইথিকা দুপাশে মাথা নাড়তে নাড়তে বলল,

“আমি ভাবতেও পারিনি ভাইয়ারা এভাবে ওকে মেরে ফেলবে। আমি এমনটা হোক চাইনি।”

কাবির নিজেকে সামলে নিল। ইথিকার দিকে ধীরপায়ে এগিয়ে এসে বলল,

“আমাকে মাজহাবের খবর দাও।”

ইথিকা তার দিকে চোখ রেখে বলল,”সেটা আমি জানিনা। ভাইয়ারা জানে। আমাকে ওরা এখনো কিছু বলেনি। আমি জানিনা মাজহাবের লাশটা কোথায়। অনেকবার জানতে চেয়েছি। কিন্তু মেঝ ভাইয়া চেপে গিয়েছে। বাকিদের বারণ করে দিয়েছে।”

“তাহলে ওকে খুঁজতে সাহায্য করো। করবে?”

ইথিকা চুপ করে রইল এবার।

“চুপ কেন?”

ইথিকা জানতে চাইল,”আপনি আমাকে পুলিশে দেবেন?”

“পুলিশ তোমাদের ইশারায় চলে।”

ইথিকা বলল,

“আমি মাজহাবকে এভাবে মারতে চাইনি। আমার রাগ হয়েছিল খুব এটা সত্যি। ও আমাকে ঠকিয়েছে। ও ওর পরিবারের পছন্দে বিয়ে করেছে সেটা আমাকে জানায়নি। দিনের পর দিন আমাকে ঠকিয়েছে। আমি ওকে বাঁচতে দিতে চাইনি ঠিক কিন্তু এভাবে মৃত্যুও দিতে চাইনি।

কাবির বলল,

“ভালোবাসলে কেউ কাউকে ঠকাতে পারেনা, কেউ কারো ক্ষতি করতে পারেনা আনঝিল। তুমি কাউকে ভালোবাসলে তার চোখের দিকে তাকিয়ে কখনো মিথ্যে কথা অব্দি বলতে পারবে না। তুমি মাজহাবকে কখনো ভালোবাসোনি। সেও না।
যাইহোক আমি জমিজমার কাগজপত্রগুলো তোমাকে দিচ্ছি না। তোমার যা আমারও তা। তাই নয় কি?”

ইথিকা কপাল কুঁচকে বলল,

“আমাকে যাচাই করছেন? যাচাই করতে করতে ক্লান্ত হয়ে যাবেন কিন্তু আমাকে দূরে ঠেলে দেয়ার সুযোগ জীবনেও পাবেন না। এই জনমে আমি আপনাকে আর ছাড়ছিনা। আপনিও পারবেন না।”

“আমাকে ধরে রেখে কি হবে?”

“দেখি কি হয়। আমার যেদিন মনে হবে আমি আপনাকে আমার সবটা দিয়ে ভালোবাসতে পেরেছি সেদিন আমি মনে করব আমার জীবনের সবচেয়ে পূণ্যের কাজটা করেছি।”

কাবির হালকা হেসে তার মাথা চাপড়ে দিয়ে বলল,

“তোমার পাপ মুছে পূণ্যর ঘড়া পূরণ হোক।”

ইথিকা চোখ মুছে চট করে জানতে চাইল,

“আর আর….আমাকে?”

“কি আমাকে?”

“আমাকে কবে ভালোবাসবেন?”

কাবির কিছু একটা ভেবে বলল,

“যেদিন আমি তোমার দিকে পুরোপুরি তাকাতে পারব।”

ইথিকা বলল,

“এখন পারেন না? এখনো তো তাকিয়ে আছেন।”

কাবির মাথা নাড়ল। গলায় একরাশ ক্লান্তি, ধরা স্বর,

“না, এখন তোমার দিকে তাকালেই আমার চোখ কড়া আলোয় ঝলসে যায়। আমি এমন কাউকে চেয়েছিলাম, যার দিকে তাকালে মনে হবে সে আমারই অংশ। না বাড়তি, না কমতি। না উপরে, না নীচে। তুলনার বাইরে, পার্থক্যের ঊর্ধ্বে। আমাদের মাঝখানে কোনো দেয়াল নেই, দরজা নেই। কিন্তু এখন তুমি আর আমি দুই প্রান্তের মানুষ। তুমি স্রোতের তালে ভেসে চলা উচ্ছ্বল নদীটি।আর আমি সেই বিপরীতমুখী টানেই ভেসে যাওয়া ক্লান্ত পালতৌলা নৌকাটি।”

ইথিকা বলল,”একদিন ঠিক ভালোবেসে ফেলবেন।”

______________

ইথিকা একটা পুরোনো ডায়েরি হাতে নিয়ে বিছানায় বসে পড়ছিল। ডায়েরির পাতাগুলো হলুদে মোড়া, কালি কিছুটা ঝাপসা। তবু শব্দগুলো এখনো জ্যান্ত।

ডায়েরিটা বহু বছর আগের। ভেতরে লেখা প্রতিটি বাক্য সময়ের ভাঁজে জমে থাকা নীরব আত্মকথন।
ডায়েরির পাতার কোণে আঁচড়ে আঁচড়ে লেখা—”অন্তরা খানম”।

ইথিকার ফুপু।

ডায়েরির ভাঁজে গুঁজে রাখা কিছু ছবি সাদাকালো, বিবর্ণ, তবুও চোখ ধাঁধিয়ে দেয়।
সেই মুখ, সেই হাসি, সেই চাহনি…
ইথিকার কাছে ফুপুর অসংখ্য ছবি আছে, কিন্তু এই কয়েকটা ছবি তার বুক কাঁপিয়ে দেয়। সে নিজেও তো কম সুন্দর নয়। তবু ফুপুর সৌন্দর্যের কাছে নিজের রূপটা অনেকটা ফিকে।

আর সবচেয়ে অদ্ভুত ব্যাপার। ওই অসাধারণ সৌন্দর্যও আটকাতে পারেনি দেওয়ান বংশের ছেলেটাকে। সে ফুপুর সৌন্দর্যে কাবু হয়নি, মোহিত হয়নি। ইথিকা যতবার ডায়েরিটা পড়ে ততবার তার মনে হয়, কিছু কিছু মানুষকে ভালোবাসা অপরাধ।
আর সেই মানুষটাকে ভুলতে না পারা… আরও বড় অপরাধ।

ফুপু অন্তরা খানমও সেই অপরাধটাই করেছিলেন।ভুল মানুষকে ভালোবেসেছিলেন।

তখন খান এবং দেওয়ান বংশের সন্তানরা এক বাড়িতে বড় হচ্ছিল। কলিমউদ্দিন দেওয়ান আর আখতারুজ্জামান খান, দুই সৎভাই।

একজনের স্ত্রী ছিলেন পর্দানশীন, ধর্মভীরু, নামাজ-রোজায় দয়াময়। আর অন্যজনের স্ত্রী ছিলেন বেপরোয়া, উড়নচণ্ডী, উচ্ছৃঙ্খল।

সেই উচ্ছৃঙ্খল বাড়ির এক কোণে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকত একটা মেয়ে। অন্তরা খানম। খান বাড়ির ছোট মেয়ে হওয়ায় তাকে কেউ খুব একটা খেয়াল করত না। কিন্তু সে দেখত দুই বাপ-জেঠার কোন্দল, অশান্তি, দ্বন্দ্ব।

আর দেখত সেই মানুষটিকে…
যে প্রতিবার দুই বাড়ির কোন্দল শেষে বিজয়ের রঙ মেখে বাড়ি ফিরত, যার বিচার আচার, কথা, শাসন,বারণ সবকিছু তাকে মুগ্ধ করতো।
সে আর কেউ নয়। দেওয়ান বংশের বড় ছেলে, কামরান দেওয়ান।

অন্তরা খানমের চোখে সে নায়ক ছিল।
আর সেই নায়কের দিকে অপার মুগ্ধতায় তাকিয়ে থাকত সে।

ইথিকা যতবার ডায়েরির পাতা উল্টায়,
ততবার তার ইচ্ছে হয় এই দেওয়ান বংশের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করতে। কি করে ওরা মারতে পারলো ফুপুকে।

ডায়েরির প্রথম পাতায় লেখা,

“আমি অন্তরা খানম। দেওয়ানের দিওয়ানা।”

কিন্তু সেই দেওয়ান?
যার কণ্ঠস্বর মেয়েটির হৃদয় কাঁপাতো, যার উপস্থিতিতে তার দিন রাত গুলিয়ে যেত, যার রাগ দেখে সে মিটিমিটি হাসত, যার বন্দুক ধরার ভঙ্গি দেখে চোখ জুড়িয়ে যেত সেই মানুষটিই একদিন তার বুক চিরে প্রাণ নিয়ে নিয়েছিল।

ইথিকার দমবন্ধ লাগে। নিজের স্যুটকেসের ভেতর থেকে খুব গোপনে একটা পিস্তল বের করেছিল সে। চোখের সামনে সেটাকে ধরে রেখে সে একদৃষ্টে কিছুক্ষণ চেয়ে রইল পিস্তলটার দিকে ।

অপর মানুষটা তাকে পাগলের মতো ভালোবাসে জেনেও তার বুকে গুলি ছোঁড়ার মতো সাহস দেওয়ানিরা রাখতে পারলে, খানরাও সেই গুলি বুক পেতে নেয়ার সাহস দেখিয়েছে। কোনদিক দিয়ে কম খানরা?

কোনোদিক দিয়ে কম না। বরং অপরাধী দেওয়ানরা। ওরা ভালোবাসার মর্যাদা দিতে পারেনি বলে যুদ্ধটা শুরু হয়েছিল।

ইথিকা পিস্তলটা রেখে দিয়ে ডায়েরির পাতায় চোখ রাখল। ছবিগুলোর সবটা অন্তরা খানমের নয়। অনেকটা যুবক কামরান দেওয়ানেরও। ফুপুও ছবি তুলতে পছন্দ করতো। তখনকার একটা পুরোনো সাদাকালো ক্যামেরা ছিল ফুপুর। অবহেলিত ক্যামেরাটি কি জানে আরও একটি অবহেলিত ফুল কতশত সুখ দুঃখের স্মৃতি সে জমিয়ে গেছে তার বুকের ভেতর?

ডায়েরির প্রতিটি পাতায় পাতায় অন্তরা খানম হাসছে এখনো। লুকিয়ে লুকিয়ে কামরান দেওয়ানকে দেখা চোখদুটো ইথিকা এঁকেছে। ড্যাড বলেছে অনেকটা মিলেছে। ফুপুর চোখ আরও সুন্দর। এই যে সে ডায়েরিতে চোখ বুলাচ্ছে মনে হচ্ছে চোখদুটো তার দিকে তাকিয়ে হাসছে। দাদাভাই বলেছিল গুলি খাওয়ার পরও অন্তরা খানম যতক্ষণ বেঁচেছিল ততক্ষণ তার ঠোঁট সেই চিরাচরিত লাজুক হাসিটি লেপ্টে ছিল। তার শেষ কথা ছিল,

“ওকে কেউ মেরো না।”

ইথিকা পৃষ্ঠা উল্টাল। অন্তরা খানম লিখেছে,

“আজ সকাল থেকে বৃষ্টি হচ্ছে খুব। সকালে ইচ্ছেমতো ভিজেছি তাই জ্বর এসেছে। মনে হচ্ছে বিকেল হতে না হতেই মরে যাব। ও একবারও দেখতে এল না আমায়। আচ্ছা, আমি তো ছোট মানুষ। আমার উপর কীসের এত রাগ?”

চলমান…

#মনবিবাগী_দিওয়ানা
#পর্ব_২১
#প্রিমা_ফারনাজ_চৌধুরী

জোসেফ গাড়ি থামিয়ে বারবার হাতের কব্জিতে থাকা ঘড়ি দেখছে। কল্পনার আসার কথা তিনটায়। এখন প্রায় ৪টা বাজতে চলল। মেয়েটা কি আজকে আসবে না? ফোনও রিসিভ করছেনা। না এলে বলে দিলেই হয়। এভাবে তার সময় নষ্ট করার কি দরকার? জোসেফের রাগ হচ্ছে। অদ্ভুত মেয়ে। কত করে সে রাজী করাল। আচ্ছা যার সাথে দুদিন পর বিয়ে হবে তার সাথে দেখা করতে, কথা বলতে কি সমস্যা? আজকাল এমন মেয়েও আছে?

জোসেফের বিরক্তি বাড়ছে বৈকি কমছেনা।

সে হাঁটতে হাঁটতে রাস্তার পাশে একটা বেঞ্চে গিয়ে বসে হেলান দিয়ে। বাতাসে রাস্তার ধূলো উড়ছে। জোসেফ ভ্রু কুঁচকে বসে রইল। হঠাৎ চোখ সরু করে সে দেখল একটা মেয়ে এগিয়ে আসছে। বোরকা পরেছে। মুখও ঢাকা নিকাবে। ধীরপায়ে হাঁটছে। জোসেফ দাঁড়িয়ে পড়ল। এতক্ষণে ম্যাডামের আসার সময় হলো?

কল্পনা তার সামনে এসে দাঁড়াল। তার চোখদুটো হাসছে। কারণ জোসেফ এখনো বিরক্তি নিয়ে তাকিয়ে আছে তার দিকে।

“আসসালামু আলাইকুম।”

জোসেফ রাগ করে সালামের জবাবটাও দিল না। দিয়েছে কিন্তু কল্পনা না শোনেমতো। কল্পনা হাসতে লাগল। জোসেফ রাগ করে বেঞ্চে বসে পড়েছে। কল্পনা নিকাবটা খুলল। বলল,

“বেঞ্চে বসতে পারি?”

জোসেফ কিছু বললো না। কল্পনা দূরত্ব রেখে বসল। জোসেফের দিকে চেয়ে হাসতে লাগল। জোসেফ বলল,

“এভাবে হাসলে আমার রাগ কমবে না।”

“কিভাবে কমবে?”

“একটা মানুষ কতক্ষণ অপেক্ষা করতে পারে?”

কল্পনা হেসে বলল,

“ভালোবাসা যেখানে বেশি অপেক্ষাও সেখানে ততটাই বেশি।”

জোসেফ নিজেকে শান্ত করে তার দিকে তাকাল এবার।

“চেহারা দেখার সৌভাগ্য হবে আমার? কিছুদিন পর আমার বউ করছি। পারলে এখনি করে ফেলতাম।”

কল্পনা ধীরেধীরে নিকাবটা খুলল। বলল,

“সৌভাগ্যে হয়েছে।”

জোসেফ এবার একটু শান্ত হলো।

“আমি খুব অধৈর্য মানুষ কল্পনা। অপেক্ষা করতে ভালো লাগেনা আমার।”

কল্পনা হেসে বলল,”আমারও না।”

জোসেফ রেগে বলল,”এটা হেসে বলার কি আছে?”

“একজন যে মুখ গোমড়া করে আছে এখনো।”

জোসেফ নিজেকে স্বাভাবিক করার চেষ্টা করলো। সে সহজে রাগ করেনা। মাঝেমধ্যে করে। নিজের প্রিয় মানুষদের সাথে। ব্যস।

কল্পনা একটু দূরে তাকিয়ে বলল,

“মানুষ সুন্দর মানুষের জন্য অপেক্ষা করতে ভালোবাসে।”

“আমিও তাই।”

“আমি তো কালো।”

“ওটাই আমার দরকার।”

কল্পনা আবারও হাসল। জোসেফ রেগে গিয়ে বলল,

“এভাবে হাসলে কিন্তু আমি চলে যাব। আমাকে এতক্ষণ দাঁড় করিয়ে রেখে এভাবে হাসা হচ্ছে? আমি পিছে পিছে ঘুরছি বিষয়টা খুব উপভোগ করছেন তাই না?”

কল্পনা হেসে বলল,”হয়তো তাই। মেয়েরা চায় তার পছন্দের মানুষ তার পেছন পেছন ঘুরুক। তাকে জ্বালাতন করুক।”

“আমি আপনার পছন্দের মানুষ?”

কল্পনা জিভে কামড় দিয়ে বলল,

“মুখ ফস্কে সত্যি কথাটা বলে ফেললাম।”

জোসেফ বিজয়ীর মতো হাসল এবার। গোমড়া ভাবটা দূর হয়ে গেল।

“ইয়েস। অল ক্রেডিট গোজ টু জোসেফ মেহতাজ। আমি পেরেছি।”

কল্পনা তার উত্তেজনা দেখে হাসছে। এত পাগল মানুষও হয়?

জোসেফ তার একটু কাছে ঘনিয়ে এসে বসল।

“আমার ইচ্ছে করছে আপনাকে নিয়ে এখুনি পালিয়ে যেতে। বিয়েটা একটু আগানো যায় না?”

কল্পনা বলল,”তর সইছেনা?”

“সইবে কি করে? আঠাশটা বছর বউ ছাড়া থাকছি। আর কত?”

কল্পনা হেসে ফেলল। সে কি আজকাল বেশি হাসছে? অথচ সবাই বলে সে খুব রাগী। হাসেনা সহজে। সত্যি কি তাই? কিন্তু জোসেফের সাথে কথা বলার সময় সে এত হাসে কেন?

জোসেফ তার হাত ধরে তাকে টেনে তুললো। কল্পনা হকচকিয়ে গিয়ে বলল,

“কোথায় যাচ্ছি?”

জোসেফ থেমে গিয়ে কপাল কুঁচকে তাকাল।

“ভয় করছে?”

কল্পনার সাহস ফিরে এল।

“উহু।”

“তবে?”

“কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন সেটা জানতে পারব না?”

“না, চোখ বন্ধ করে চলুন। দেখি কতটুকু ভরসা অর্জন করতে পেরেছি।”

কল্পনা বলল,”বেশ।”

__________________

“ঝিনুক আমাকে কেমন লাগছে বলো তো।”

ঝিনুক ইথিকাকে দেখামাত্রই অপলক তাকিয়ে রইল। ইথিকা তার দিকে সরু চোখে তাকিয়ে বলল,

“বলো।”

ঝিনুক একটু নড়ে উঠল। মৃদুস্বরে বলল,”সুন্দর বললেও কম হয়ে যাবে। কাবির ভাইয়া আসার আগে সাজ পাল্টাবেন না। আমার কথা বিশ্বাস না হলে উনার কাছ থেকে সত্যিটা জেনে নেবেন আরও ভালো করে।”

ইথিকা ফিক করে হেসে ফেলল। আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়াল। সে আজকে লাল টকটকে শাড়ি পরেছে। নাকে নথ পরেছে। সিঁথি পেড়ে মাঝখানে টিকলি পরেছে। পায়ে ঘুঙুর পরেছে। হাতে চুড়ি, গলায় সুন্দর একটা গয়না। একদম লাল বধূর মতো। অন্তরা খানমের মতো। অন্তরা খানমও এভাবে বউ সেজেছিল একদিন। মোটা করে কাজল পরেছিল। ডায়েরির পাতায় লেখা ছিল।

“আমি একদিন বউ সেজে বসেছিলাম। সে আমার দিকে ফিরেও তাকায়নি। না তাকিয়েই বলেছিল, জঘন্য। অথচ সেদিন কোনো পুরুষের সাধ্য ছিল না আমাকে অসুন্দর বলার।”

ইথিকা আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের কাজলমাখা চোখ দুটোকে গভীর মনোযোগে দেখতে দেখতে ভাবল সেদিন কি ফুপুর চোখও এমন কাজল কালো ছিল?

ছিল হয়ত, কিন্তু সেই কাজল কালো চোখ এত স্বাভাবিক ছিল না। ব্যথার নদী জমে ছিল সেই কাজলকালো চোখদুটোতে। চোখের কোণা বেয়ে নেমে আসা অশ্রুর রেখাগুলো কি ভয়ংকর করে তুলেছিল ফুপুকে!

ফুপু ডায়েরিতে লিখেছিল, জ্বর বেড়ে যাওয়ায় দাদাভাই একজন ডাক্তার নিয়ে এসেছিল। ডাক্তার এসে ফুপুকে দেখে থমকে গিয়েছিল। বিস্ময় গলায় প্রশ্ন করেছিল,

“সামান্য জ্বর হলে চোখের নিচে এমন কালো দাগ হয়?”

ফুপু তখন জ্বরের ঘোরে হালকা হাসি হেসে বলেছিল,

“এই সামান্য জ্বরে ভোগা আমাকে দেখে যদি আপনি এতটা ভড়কে যান, তাহলে বড় রোগটার ক্ষত দেখলে তো পালিয়ে যাবেন ডাক্তার সাহেব।”

ডাক্তার বড় রোগটার ক্ষত বুঝতে পারেনি। হয়ত ফুপু ছাড়া ওই ক্ষতটা কোনোদিন কেউ দেখেনি ডায়েরির পাতাগুলো ছাড়া।

“ঘুঙুরগুলো বেশ পুরোনো।”

ঝিনুকের কথার জবাবে ইথিকা বলল,

“এগুলো আমার ফুপুর। দাদুর মতো উনিও একজন নৃত্যশিল্পী ছিলেন। এখনো কি সুন্দর দেখো।”

ঝিনুক বলল,”আপনার পা সুন্দর। তাই বেশি সুন্দর লাগছে ভাবি।”

ইথিকা তার কথা শুনে হাসল। প্রশংসা পেতে কার না ভালো লাগে। সে জানে সে সুন্দর। তার রূপে মুগ্ধ হয়ে কত চোখ থমকে দাঁড়ায়, কত দৃষ্টিতে আকাঙ্ক্ষা জ্বলে ওঠে । কিন্তু অমন মুগ্ধতা নিয়ে কাবির দেওয়ান কোনোদিন তাকাননি। তার রূপ কাবিরের চোখে কোনও গুরুত্বই পায় না। যেমন গুরুত্ব পায়নি অন্তরা খানমের রূপের সৌন্দর্য কামরান দেওয়ানের কাছে। অন্তরা খানমের চোখধাঁধানো রূপ, তার তাম্রবর্ণ গাল, দীপ্তিময় চোখ, অমন নজরকাঁড়া সৌন্দর্য হেরে গিয়েছিল এক শ্যামল তরুণীর কাছে।

আচ্ছা, দেওয়ান বংশের ছেলেদের হৃদয় কি পাথর দিয়ে তৈরি? লোকে জানে তারা দয়াবান, নরম মনের। অথচ খান বাড়ির সেই ছোট ঘরের কোণাটা জানে, ধূলো জমা ডায়েরিটা জানে, আর ইথিকা জানে এই দেওয়ানরা ঠিক কতটা পাথর। কাবির দেওয়ান তার এক চুল পরিমাণও কম নন।

তার আর ফুপুর মধ্যে পার্থক্য এটাই। ফুপু হাজার চেষ্টা করেও, শত অনুরোধ, কাকুতি মিনতি, চোখের জল বিসর্জন দিয়েও এক মুহূর্তের জন্য কামরান দেওয়ানকে নিজের করে পায়নি। ফুপু বামুন হয়ে থেকে গিয়েছিল, চাঁদ ধরার সৌভাগ্য হয়নি। কিন্তু ইথিকা সেটা করে দেখিয়েছে। সে কাবির দেওয়ানকে পেয়েছে নিজের করে, দেখিয়ে দিয়েছে সে যা চায় সব পেয়ে ছাড়ে। ফুপু তার কাছে হেরে গিয়েছে। ফুপুকে সে হারিয়ে দিয়েছে। তার বলতে ইচ্ছে করছে দেখো, আমি ভিক্ষা করে নয় জয় করে নিচ্ছি।

ঝিনুক হঠাৎ বলল,”আমি আসছি।”

সে বেরিয়ে গেল। কারণ কাবির আসছে। তার গলার আওয়াজ শোনা যাচ্ছে এখান থেকে। হয়তো লুবনা বেগমের সাথে কথা বলছে অথবা লায়লা খালার সাথে। লায়লা খালাকে একটু আওয়াজ করে কথা বলতে হয়। কানে একটু কম শোনে। ইথিকার মনে হয় লায়লা খালা তার কথা একদমই শুনতে পান না। নাকি ইচ্ছে করে শোনেন না কে জানে। কাজের বুয়া পর্যন্ত তাকে অপছন্দ করে। এসব মনে পড়লেই ইথিকার রাগ লাগে।

কাবির দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকল। ইথিকাকে দেখল। হেঁটে আলমিরার সামনে গিয়ে দাঁড়াল। হাতের ফাইলটা ভেতরে রেখে দিয়ে হাতের ঘড়ি খুলতে খুলতে জানতে চাইল,

“আজকেও ভিডিওগ্রাফার আসছে নাকি?”

ইথিকা হাসিমুখে বলল,”এসে গেছে এখুনি।”

কাবির কপাল কুঁচকে তাকাল তার দিকে।

“কে?”

ইথিকা আয়নায় আঙুল তাক করল। কাবির আয়নায় তাকাল। আয়নায় তাকে দেখা যাচ্ছে।

কাবির ব্যস্ত গলায় বলল,

“কিরণ ভালো ছবি তুলতে জানে। ওকে ডেকে দেব আমি। একটু অপেক্ষা করো।”

ইথিকার চেহারা মলিন হয়ে এল।

কাবির নিজের কাজের ফাঁকে ফাঁকে কোম্পানির ব্যাপারে নানান কথা বলতে লাগল ইথিকাকে।

“মার্কেটিং টিম এবারও কোয়ার্টার্লি টার্গেট মিস করেছে। API sourcing-এর দাম বাড়ছে, অথচ সাপ্লায়াররা ডেলিভারি ডেট মেইনটেইন করতে পারছে না। এদিকে, আমাদের third-phase clinical trial-এ ডেটা ইনকন্সিসটেন্সি ধরা পড়েছে। ইউরোপিয়ান রেগুলেটরি বোর্ড থেকে আবার রিভিউ এসেছে। একটার পর একটা। নিঃশ্বাস ফেলার জোঁ নেই।”

ইথিকা কিচ্ছু শুনল না। একটানে নাকের নথ, টিকলি, গয়না খুলে ফেললো। নথ টান দিয়ে খোলায় নাক লাল হয়ে গেল। টিকলি টান দেয়ায় চুল এলোমেলো হয়ে এল। ঠোঁটের লিপস্টিকও মুছে ফেলল হাতের উল্টোপিঠে। চোখ মুছল। কাজল লেপ্টে গেল। টিকলি, নথ, গয়না, চুড়ি সব মেঝেতে ছুঁড়ে মারতেই শব্দ হলো। কাবির তার দিকে ফিরে হতভম্ব! সামান্য কারণে এত রাগ! এসবের মানে কি।

ইথিকার চোখদুটো তার নাকের পাটার মতো লাল হয়ে এসেছে। কাবিরের চোখে তাকে ভয়ংকর লাগছে।

কাবির কিছু বুঝতে পারল না। শুধু খেয়াল করলো ইথিকা কাঁদছে। মানুষ কিছু একটা ভেবে ভেবে কাঁদলে যেভাবে কাঁদে ঠিক সেভাবে। নিজের দুঃখে নয়।

কাবির আর উপয়ান্তর না দেখে ক্যামেরাটা নিয়ে এল। ইথিকার মাথায় ঘোমটা পরিয়ে দিল। কয়েকটা ছবি তুললো। ছবি তোলা শেষে ক্যামেরাটা ইথিকার পাশে রেখে নাক টেনে দিয়ে বলল,

“সবকটা ছবি জঘন্য হয়েছে। বলেছিলাম আমি ভালো ছবি তুলতে পারিনা। দেখে নিতে পারো।”

কাবির যাওয়ার কিছুক্ষণ পর ইথিকা দু-হাত তার গাল মুছল। তারপর নাক টেনে ক্যামেরাটা নিয়ে ছবিগুলো দেখতে লাগল। আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে ডায়েরির লেখার সাথে ইথিকার ছবিগুলো মিলে গিয়েছে। অন্তরা খানম এমন বিধ্বস্ত অবস্থায় ঘরের এককোণায় বসে কাঁদছিল সেদিন ঠিক এইভাবে। ওইদিন অন্তরা খানমের চোখের জল মুছে দেয়া তো দূর কেউ তার কান্নাটাও দেখেনি। অথচ ইথিকার কি সৌভাগ্য! কাবির দেওয়ান তার দিকে টিস্যু বাড়িয়ে দিয়েছিল।

_______________

“এতক্ষণে কোনো ভদ্র বাড়ির মেয়ে বাড়ি ফেরে? ঝড়ে তো পুরো ভিজে গেছিস।”

কল্পনা ভিজেবিড়ালের মতো চুপসে যাওয়া মুখে তাকিয়ে বলল,

“বৃষ্টি চলে এল হুট করে। বুঝতেই পারিনি। সরি ছোট মা। ভাইদের বলো না কিছু।”

লুবনা বেগম রাগ করে বললেন,

“সরি টরিতে কি হবে? কাদিন রেগে গেছে কেন তোকে আমি একা ছাড়লাম।”

“উনি তো ছিলই।”

লুবনা বেগম ফিসফিসিয়ে বললেন,

“তাও। বিয়ের আগে কেউ এভাবে ঘোরাফেরা করে?”

কল্পনা আরও চুপসে গেল। লোকটা কথা শুনছিল না। কি করার ছিল তার। সবার সাথে তো আর ঘাড়ত্যাড়ামি করা যায় না।

লুবনা বেগম তাকে ছাড়লেন। কল্পনা দ্রুত উপরে চলে গেল। কাপড়চোপড় পাল্টে বাবার ঘরে ঢুকল।

“বাবা ওঠো। এখনো ঘুমিয়ে আছ তুমি? এভাবে সারাদিন ঘুমোলে হবে?”

কল্পনা শব্দ করে সুইচ টিপে আলো জ্বালিয়ে দিল।

আর তখুনি তার চক্ষু ছানাবড়া। বাবা বিছানায় শোয়া অবস্থায় কাঁপছে। চোয়াল শক্ত হয়ে উঠেছে। কপাল জুড়ে ঘাম। কল্পনা বাবার কাঁপা হাতটা শক্ত করে ধরল। আতঙ্কিত হয়ে বলল,

“কি হয়েছে? কি হয়েছে আমাকে বলো। বাবা।”

কামরান দেওয়ান জানালার দিকে আঙুল তাক করলেন। জানালার শিক ধরে অন্তরা দাঁড়িয়েছিল এতক্ষণ। জীবন্ত অন্তরা। সেই বিধ্বস্ত অন্তরা। এলোমেলো লাল শাড়িতে, লেপ্টে যাওয়া কাজল কালো চোখ নিয়ে, এলোমেলো চুলে, ভয়ংকর চেহারা নিয়ে অন্তরা যেভাবে তার নিজের ঘরের জানালার শিক ধরে দাঁড়িয়েছিল ঠিক সেভাবে।

“কে ছিল বলো না। ছোট মা। কিরণ? তাড়াতাড়ি আয়। বাবা কেমন করছে দেখ। কাকে দেখেছ বাবা?”

কামরান দেওয়ান অস্ফুটস্বরে বললেন,

“অন্তরা।”

বাকি সবাই যখন তার ঘরে ছুটে যাচ্ছিল কল্পনার চেঁচামেচি শুনে ঠিক সেসময় লাল শাড়ি পরা কেউ একজন মৃদুতালে হাঁটতে হাঁটতে কাবিরের ঘরের দরজা ভেতরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিল।

চলমান…..

#মনবিবাগী_দিওয়ানা
#পর্ব_২২
#প্রিমা_ফারনাজ_চৌধুরী

কামরান দেওয়ানকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছে এই ঝড়বৃষ্টির রাতে। বুকের ব্যাথাটা বেড়ে গিয়েছিল। কল্পনার কান্নাকাটি, কাদিনের অস্থিরতা, বাড়িসুদ্ধ লোকের আহাজারি দেখে কাবির শুরুতেই কিছু না বুঝলেও একপাশে গুটিসুটি মেরে দাঁড়িয়ে থাকা ইথিকাকে দেখে তার সবটা পরিষ্কার হয়ে গিয়েছিল। এমনকি লুবনা বেগমও ক্ষেপে গিয়েছেন ইথিকার উপর। ইচ্ছে করে হোক কিংবা অনিচ্ছায় এরকমটা করা উচিত হয়নি ইথিকার। সে কেন ওভাবে জানালার পাশে গিয়ে দাঁড়াল অমন বিধ্বস্ত অবস্থায়?

কাবির নিজেকে আর সামলাতে পারেনি। ইথিকার নিষ্পাপ চাহনি দেখেও সে টলেনি। ফলস্বরূপ ইথিকার জায়গা হয়েছে বাইরে। কাদিন দরজাটা বন্ধ করে দিয়েছিল। কল্পনা রাগে ফুঁসছিল। ওই মেয়ে আর কোনোদিন এই বাড়িতে না এলে সে খুশি।

কামরান দেওয়ান বিপদমুক্ত হওয়ার পর কাওসার দেওয়ান চুপিসারে লুবনা বেগমকে বললেন,

“খান বাড়ির কারো ফোনটোন এল না। ওদের মেয়ে কি ওদের বাড়িতে যায়নি? ওরা এত চুপ কেন?”

লুবনা বেগমও চিন্তিত হয়ে পড়লেন। তাই তো। ইথিকা কোথায় গেল? কাবির হাসপাতালের করিডোরে বসেছিল। কল্পনা আর কিরণ তার পাশে বসা। কাসেদ আর কাদিনও সেখানে উপস্থিত। তারাও পাশাপাশি দাঁড়িয়ে কথাবার্তা বলছিল।

কাওসার দেওয়ান লুবনা বেগমকে ইশারা করলেন ইথিকার ব্যাপারে আপাতত কিছু না বলতে। কল্পনা বলে উঠল,

“ভাইয়া বাবাকে আজকে ছেড়ে দেবে?”

কাবির বলল,”আজ থাকুক। কাল ফিজিক্যাল কন্ডিশন কেমন তা দেখে বাড়ি নিয়ে যাব। কাদিন ওদের নিয়ে যাও তুমি।”

কল্পনা বলল,”আজ আমি এখানে থাকব। বাবার দেখভাল করবো।”

কাবির বলল,”কোনো দরকার নেই। নার্স আছে। তুমি বাড়ি যাও। রেস্ট নাও।”

কল্পনা বলল,”থাকিনা এখানে। তোমরা যাও। ভাইয়া আমার জন্য খাবার নিয়ে আসবে না হয় পরে।”

কাদিন কাবিরকে বলল,”থাক ও যখন থাকতে চাইছে।”

সবাই বাড়ি ফিরে এল। কল্পনা তার বাবার সাথে থেকে গেল। আরেকটা রোগীর পরিবারের সাথে তার পরিচয় হয়েছে। সেখানে তার সমবয়সী একটা মেয়ে আছে। তার সাথে বেশ ভাব জমেছে কল্পনার। কথা বলতে বলতে মেয়েটা কল্পনাকে তাদের সাথে ডিনার অফার করলো। কল্পনা অনুরোধ ফিরিয়ে দিতে পারেনি। তাদের সাথে খেয়ে নিয়েছে। কাদিনকে আসতে বারণ করেছে।

___________

নিশ্ছিদ্র রাত। বৃষ্টি থেমেছে কিছুক্ষণ আগে। এখনো টুপটাপ পড়ছে হালকা পাতলা বৃষ্টির ফোঁটা। আবারও ভারী বৃষ্টি নামতে পারে।

ঘড়ির কাঁটা সাড়ে দশটায় এসে থেমেছে । দূরে কোথাও গানের ফাংশনের হালকা আলো ঝলমল করছে। মঞ্চে বাজছে বেজগিটার, মাইক্রোফোনে গলা ছেড়ে গাইছে কেউ, মাঝে মাঝে ভেসে আসছে করতালির শব্দ।

আর্যাব খান কানে সাদা ইয়ারফোন। গাড়ির দরজা খুলে সবে বসতে যাবে, এমন সময় চোখে পড়ল জেসিকে।

সাদা-আকাশি রঙের সেলোয়ার-কামিজ পরা, চুলখানি খোলা, চোখে হালকা কাজল। চেহারাটা এমনিতেই মিষ্টি, আজ যেন আরও বেশি। এই মেয়ে তার বউ হয়ে লাভ আছে। লোকে বলবে আর্যাব খান একটা চমৎকার সুন্দরী বউ পেয়েছে।

জেসি এগিয়ে এল। মুখে হাসি।

“আশিষের আজকের পারফরম্যান্সটা দারুণ হয়েছে। তুমি তো দেখতেই যাওনি!”

আর্যাব খান বাঁকা হাসল।

“বাংলার ভাত মাছ খেয়েদেয়ে হিন্দি আর ইংলিশ গানের ধর্ষণ করছে। ওসব দেখে আমার কাজ নেই।”

জেসি চেহারা মলিন হয়ে এল।

“দীর্ঘদিন বিদেশ বিভূঁইয়ে কাটানোর পর ওখানকার মিউজিক, কালচার ভালো লাগলে সেটা অপরাধ নয়।”

আর্যাব খান হাসল।

“হে হে। অপরাধ হলেও সমস্যা কি ডার্লিং? খানরা ক্রাইম করবেনা তো কে করবে? ওটা সমস্যা না। সমস্যা অন্য কোথাও।”

জেসি তার পাশাপাশি বসল।

“তুমি মেবি ভাইয়ার সম্পর্কে কিছু জানতে চেয়েছ।”

আর্যাব খান হেসে বলল,”মনের কথা কিভাবে বুঝে ফেলো?”

জেসি হাসল।

“ইটস আ ম্যাজিক। ভাইয়া আমাদের বিয়েতে সমস্যা করবে কিনা এখনো বুঝতে পারছিনা। তবে আমার সাথে আগের মতো কথাবার্তা বলছেনা। তোমাকে ও টোটালি পছন্দ করছেনা। ওর বিয়েটা হয়ে যাক তারপর বাকিটা দেখা যাবে।”

আর্যাব খান মনোযোগ দিয়ে পুরোটা শুনে বলল,

“তোমার ভাইয়ের বউ কিন্তু আমার কালা বেয়াইন।”

জেসি অবাক হয়ে বলল,”ভাবির সাথে তোমার কি ঝগড়া আছে?”

আর্যাব খান হাসল,

“আমার দয়ার শরীর। আমি চড়, লাথি, জুতোপেটা খেয়েও ক্ষমা করে দিই।”

জেসির কপাল কুঁচকে গেল।

“কি বলছ? কে কাকে চড়, লাথি, জুতো পেটা করেছে?”

“বেয়াইন আমাকে মাঝেমধ্যে আদর যত্ন করে। এমন সুন্দর বেয়াই পেয়েছে চড়ের ছুতোয় ছুঁয়ে দেয় আর কি।”

জেসি রেগে গিয়ে বলল,”মানেটা কি?”

আর্যাব খান হো হো করে হাসল।

“ডার্লিং তুমি কিন্তু এবার রেগে যাচ্ছ।”

জেসির মেজাজ খারাপ হতেই আর্যাব খানও তীক্ষ্ণ মেজাজে বলল,

“ওই বাড়ির মেয়েকে ভাইয়ের বউ করছো মানে কপালে দুঃখ আছে। কথায় কথায় হাত নাড়ে ওই মেয়ে। তোমার ভাই বোন সবাইকে জুতোপেটা করবে মতের অমিল হলে। আমার কথা মিলিয়ে নিও। বাই। পকেট গরম করে আসি।”

বলেই চোখে চশমা লাগিয়ে হাঁটা ধরল।
জেসি তার পথ আটকে দাঁড়াল।

“তোমাকে জুতোপেটা করেছে? আয়েম সিরিয়াস আর্য।”

আর্যাব খান চশমা নাকের কাছটায় নামিয়ে জেসির দিকে তাকাল। চোখ টিপে দিয়ে বলল,

“ওকে আমি কি দিয়ে পেটাই দেখো শুধু।”

জেসি আবারও তার পথ আটকে দাঁড়াল।

“ভাইয়া কিন্তু ছাড়বেনা তোমাকে।”

“বিয়েটা ভেঙে দাও। বিয়ে ভাঙার দুঃখে বেয়াইন কাঁদবে। আর আমি আর তুমি নেচেনেচে আমাদের বিয়েটা সেড়ে নেব। এরচেয়ে বড় রিভেঞ্জ আর কি হতে পারে?”

“কি চাইছ তুমি?”

“দেওয়ানিদের কান্না। বাস! সামান্য কিছু। শালার বেঈমান বোনটা বিয়ে করে জামাইয়ের দিওয়ানা হয়ে গেছে। হারামিটা।”

জেসি বলল,”ভাইয়া কল্প ভাবিকে পছন্দ করে বিয়ে করছে। বিয়ে ভাঙা এত সহজ নয়। ভাইয়া মাকে বলেছে বিয়ের পর কল্পনার সাথে মায়ের না জমলে ভাবিকে আলাদা রাখবে।”

“জীবনেও জমবেনা। ওই মেয়ের সাথে তোমার ভাইয়ের বিয়ে হলে তোমার মা বাবা ছেলে হারাবে, আর তুমি ভাই। গ্যারান্টি দিচ্ছি। কথা মিলিয়ে নিও।”

জেসি চিন্তিত হয়ে বলল,

“আমি কি করতে পারি?”

আর্যাব খান ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসল।

“বিয়ে না ভাঙতে পারলেও বিয়ের পর বেশি তেড়িবেড়ি করলে পিটিয়ে সোজা করে ফেলবে।”

“আচ্ছা বাদ দাও ওসব। আমাদের বিয়ের সমস্ত ইভেন্টের খরচ কিন্তু…

আর্যাব খান দূরে ছিটকে পড়ল। আঙুল নেড়ে বলল,

“নো নো নো। পকেট খালি করা যাবে না ডার্লিং। মানুষকে খাইয়ে লাভ নেই। সেই টাকা দিয়ে বরঞ্চ শাঁ করে থাইল্যান্ড ঘুরে আসা যাবে।”

জেসি হেসে উঠে বলল,”তুমি না সত্যি। বিয়েতে মত দিয়েছ এটাই যথেষ্ট। আচ্ছা বলো, বিয়ের দিন আমি কি রঙের শাড়ি পরবো?”

“তোমার চামড়ার কালার। দেখে মনে হবে তুমি কিছুই পরোনি। হা হা।”

অট্টহাসিতে ফেটে পড়ল আর্যাব খান। জেসি তার শক্ত বুকে কিল মারতে মারতে বলল,

“পাজিইইই।”

তক্ষুণি আর্যাব খানের ফোনটা বেজে উঠল। সে বিরক্তির সাথে ফোনের স্ক্রীনের দিকে তাকিয়ে বলল,

“আমিন খানের ডার্লিং বড়ো জ্বালাচ্ছে আজকাল।”

বলেই ফোনটা রিসিভ করে কানে দিল।

“ইয়োমম ডার্লিংয়ের সাথে আছি।”

ইলিনা বেগম বললেন,

“ইথু নাকি দেওয়ান বাড়িতে নেই। ও এখানেও আসেনি।”

“কেন কি হয়েছে?”

ইলিনা বেগম সবটা খুলে বললেন। আর্যাব খানের চোয়াল শক্ত হয়ে এল। ফোনটা পকেটে ভরে জেসিকে বলল,

“বাড়ি যাও। আমার কাজ আছে।”

“আমাকে নামিয়ে দাও।”

“পারব না। রিকশা নাও।”

জেসি বলল,”আর্য আমি একা..

আর্যাব খান গাড়িতে উঠে গাড়ি ছেড়ে দিল দ্রুত। তার গাড়িটা গিয়ে থামল হাসপাতালের সামনে। তড়িঘড়ি করে গাড়ি থেকে নেমে সে কেবিন নাম্বার খুঁজে নিল। দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকতেই চোখে পড়ল কল্পনা বাবার শিয়রের কাছে মাথা রেখে ঘুমোচ্ছে। আর্যাব খানকে দেখে সে চমকে উঠল।
আর্যাব খান হনহনিয়ে এগিয়ে এসে তার হাত শক্ত করে চেপে ধরে একটানে বাইরে নিয়ে এসে বলল,

“ইথু কোথায়?”

কল্পনা ধস্তাধস্তি করে একঝটকায় নিজের হাত ছাড়িয়ে নিল। দাঁতে দাঁত পিষে বলল,

“জাহান্নামে গেছে।”

“ওই দেওয়ানি!”

আর্যাব খান গর্জে উঠে তার গলা চেপে ধরতে হাত বাড়াল। কিন্তু ধরলো না।

“আমার বোন কোথায়? দেওয়ানদের চৌদ্দ গুষ্ঠি কোথায়? পালিয়েছে নাকি?”

কল্পনা আওয়াজ করে হাসল।

“তোমার ভয়ে পালাবে? তুমি তো একটা জোকার। শোনো ফ্রিতে একটা উপদেশ দিই। সার্কাস দেখিয়ে ভালোই পকেট গরম করতে পারবে। এখন যা করছো তার চাইতে অনেকটা বেটার ওই কাজটা। যাও। খেটে খাও। আমার কাছে এসেছে বোনের খোঁজ নিতে। যত্তসব ফালতু বেকার।”

আর্যাব খান রাগ সামলাতে এদিকওদিক তাকিয়ে কপাল চেপে ধরলো কয়েক আঙুলের সাহায্যে। কল্পনা কেবিনে ঢুকে যাচ্ছিল। আর্যাব খান আবারও তার হাত চেপে ধরতে যাবে তখুনি ঘুরিয়ে কষে একটা চড় বসাল কল্পনা। আর্যাব খানও সাথে সাথে তাকে চড়টা ফিরিয়ে দিল। নার্স ছুটে এসে বলল,

“কি হচ্ছে এখানে?”

আর্যাব খানকে দেখে নার্সও চুপসে গেল।

“স্যার আপনি এখানে?”

আর্যাব খান কিছু বলার আগেই একদলা থুতু তার মুখের উপর এসে পড়ল। মুহূর্তে থমকে গেল সবকিছু। কল্পনার পাশে এসে দাঁড়ানো সেই মেয়েটি, এমনকি আশেপাশের নার্সরাও অবিশ্বাস আর বিস্ময়ে জমে গেল।

আর্যাব খান ধীরে ধীরে মুখ ফিরিয়ে তাকাল। তার চোখের দৃষ্টিতে আগুন। অপমান, রাগ আর অপ্রতিরোধ্য প্রতিশোধস্পৃহায় জ্বলজ্বল করে উঠল তার চাহনি।

কল্পনা কেবিনের ভেতর ঢুকে ভেতর থেকে দরজা বন্ধ করে দিল। নার্সের একজন ছুটে এসে টিস্যু বাড়িয়ে দিল আর্যাব খানের দিকে। বলল,

“স্যার আমরা আপনাকে কিভাবে হেল্প করতে পারি?”

আর্যাব খান কিছু একটা বিড়বিড় করল। হাতের মুঠো শক্ত করে নিল। এই কল্পনাকে যদি সে তার পায়ের কাছে না ফেলে, তার অহংকার চূর্ণ না করে তার নামও আর্যাব খান নয়। আপাতত ইথুকে খুঁজে বের করতে হবে। ওর কিছু হলে সে এই দেওয়ানদের ছাড়বে না।

সে কেবিনের দরজার দিকে তাকাল। নার্সকে ইশারায় ডেকে নিয়ে গিয়ে কিছু একটা বললো। নার্সটা মাথা দুলিয়ে বলল,

“আমি চেষ্টা করছি স্যার।”

____________

বাড়ির সবাই ঘুমিয়ে পড়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। বাইরে অনেক ঝড়। মনে হচ্ছে কাল সকালের আগে এই ঝড় আর থামবে না। ইথিকাকে নিয়ে অনেকক্ষণ কথাবার্তা হয়েছে। কাবিরের কানে না যায় মতো সবার যে যার মতো বলল ইথিকা এখানে যেতে পারে, ওখানে যেতে পারে। বড়ফুপু বলল, ওই মেয়ে খুকী নয়। বিদেশ বিভূঁইয়ে এক করা মেয়েমানুষ। নিশ্চয়ই কোথাও গিয়ে নিশ্চিন্তে ঘুমাচ্ছে।

লুবনা বেগম বিছানায় শুয়েও শান্তি পাচ্ছে না। কাবির কি করছে দেখে আসা উচিত। ছেলেটার কপালে কেন এত খারাপ হতে হলো। বউটাকে এত বোঝানোর পরেও সে একটুও শোধরাল না।

তিনি উঠে বসলেন। ধীরপায়ে বিছানা থেকে নেমে ঘর থেকে বেরোলেন। কাবিরের ঘরের সামনে গিয়ে ভাজিয়ে রাখা দরজা একটুখানি ঠেলে দেখলেন কাবির বিছানায় শুয়ে আছে। চোখদুটো খোলা। একহাতের উল্টোপিঠ কপালের উপর অন্য হাতটা পেটের উপর দিয়ে শুয়ে আছে। কপালে ভাঁজ। ছেলেটার নিশ্চয়ই আজকে আর ঘুম হবে না। মেয়েটা কোথায় যে গেল।

লুবনা বেগম আবারও ঘরে ফিরে এলেন। কিছুক্ষণ পায়চারি করলেন। তারপর নিজের ফোন থেকে ইথিকাকে ফোন করলেন। ফোন ঢুকছেনা কিছুতেই। মেয়েটার যদি কোনো বিপদআপদ হয়?

লুবনা বেগম ফোন দিয়েই গেলেন।

কিছুক্ষণ পর আশ্চর্যজনক ঘটনাটি ঘটল। ইথিকা ফোন রিসিভ করলো। লুবনা বেগম বললেন,

“হ্যালো বৌমা। শুনতে পাচ্ছ? কোথায় তুমি?”

ইথিকা কান্না জড়ান গলায় বলল,”রাস্তায়।”

“এ কেমন কথা মা? বাড়ি চলে এসো।”

ইথিকা কান্না আড়াল করে বলল,

“আপনার ছেলে আমাকে একটা ফোনও দেয়নি।”

“তুমি কেন তোমার জেঠুকে ভয় দেখাতে গেলে? জানো না উনি অসুস্থ মানুষ?”

“আমি ভয় দেখাতে গিয়েছি? আমি কিচেনে পানি আনতে গিয়েছিলাম। ফেরার পথে আমাকে নাজিফা বলল, জেঠুর ঘরে কীসের যেন শব্দ হয়েছে। আমি সেজন্য জানালার পাশে দাঁড়িয়ে দেখছিলাম জেঠুর কি হয়েছে। উনি আগে থেকেই ছটফট করছিলেন। বুকের ব্যাথাটা আগে থেকেই লাগছিল। আমাকে দেখার পর আরও রিয়েক্ট করলেন। আমি কি জানতাম যে সব দোষ আমার ঘাড়ে এসবে পড়বে?”

লুবনা বেগম বললেন,”হায় আল্লাহ ভুল বুঝাবুঝি হয়েছে। তুমি ফিরে এসো মা।”

“আমি আর ফিরব না। আমার আর ভালো লাগছেনা এত পরীক্ষা দিতে। আমি যতবারই চাইছি নিজেকে শোধরাতে ততবারই আপনার ছেলে আমাকে ভুল বুঝে দূরে সরিয়ে দিচ্ছে। পান থেকে চুন খসলেই আমার দিকে আঙুল উঠে।”

লুবনা বেগম চুপসে গেলেন। এখন মেয়েটাকে কিভাবে বুঝিয়ে বাড়ি ফিরিয়ে আনবেন তিনি।
লুবনা বেগম বললেন,

“আমি কাবিরকে সব বলছি। তুমি ফিরে এসো। ঝড়বৃষ্টির রাতে বিপদ হতে পারে। ফিরে এসো মা।”

ইথিকা ক্লান্ত হয়ে বলল,

“আমি আর পরীক্ষা দিতে পারছি না। আপনার ছেলে আমার পাশে থাকলে হয়তো ভেবে দেখতাম কিন্তু আমি একা কিছু পারব না। এই সংসার আমার জন্য না। আমি কাবিরের যোগ্য না।”

ইথিকা কেঁদে উঠে ফোনটা কেটে দিল। লুবনা বেগমের অস্থির হয়ে উঠলেন। ভাইজানের বুকের ব্যাথা আগে থেকে বেড়ে গিয়েছিল? তারমানে সবাই ভুল বুঝেছে? কিন্তু নাজিফা চুপ থাকলো কেন ইথিকাকে বের করে দেয়ার সময়? এজন্যই কি ইথিকা বারবার নাজিফার মুখের দিকে তাকাচ্ছিল?

তিনি কাবিরের ঘরে ছুটে গেলেন। দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকতেই দেখলেন কাবির নেই।

__________________

গাড়িটা ঝড়ের ভিতর দিয়ে তীব্র গতিতে ছুটে চলেছে। বাইরে অঝোর বৃষ্টি। উইন্ডশিল্ডে ঝড়ের ক্রুদ্ধ সুর বাজছে। রাস্তায় তেমন কোনো গাড়ি নেই।

কল্পনা আর্যাব খানের ডান হাতের ওপর অস্থিরভাবে কিল মারছে।

“গাড়ি থামাও। কোথায় নিয়ে যাচ্ছ আমাকে? তোমার বোনকে খোঁজার দায়িত্ব আমার নয়। গাড়ি থামাও বলছি।”

আর্যাব খান চুপচাপ। স্টিয়ারিং শক্ত করে চেপে ধরে আছে। চোয়ালটায় চাপ পড়েছে, হালকা ফুলে উঠেছে। জবাব না দিলেও তার ভিতরে যে ঝড় বইছে, সেটা স্পষ্ট।

নার্সদের সাহায্য নিয়ে কল্পনাকে কেবিন থেকে বের করে হাসপাতালের বাইরে নিয়ে এসেছে সে। ইথুকে আজ না পেলে কাবিরও কাল সকালে কল্পনাকে আর খুঁজে পাবে না। ওদের কারণে ইথু বাড়ি ছেড়েছে তাই খোঁজার দায়িত্ব ওদেরও আছে।

“তুমি গাড়ি থামাও আর্যাব খান।”

আর্যাব খান উন্মাদের মতো গাড়ি চালাচ্ছে। কল্পনার মনে হচ্ছে তার আয়ু খুব বেশি নেই। এই যাত্রায় সে মরে যাবে। মাথা ঘুরছে। বমি পাচ্ছে।

কল্পনা আর থাকতে না পেরে চেঁচিয়ে উঠল,
“দোহাই লাগে। গাড়ি থামাও না হয় স্পিড কমাও! নাফরমান!”

আর্যাব খান কোনো কথা না বলে তাকে এক ঝাঁকুনিতে সরিয়ে দিল। কল্পনা হঠাৎ ধাক্কা খেয়ে কপালে প্রচণ্ড ব্যথা অনুভব করল। দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে এল। কপাল চেপে ধরে বসে রইলো সে। সে যতই নিজেকে সাহসী দেখাক তবুও মনের ভেতর একটা ভয় তাকে কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছে। সে এর আগে অনেকবার আর্যাব খানকে চড় থুতু মেরেছে, জুতো ছুঁড়ে মেরেছে, কথায় কথায় অপমান করেছে। সবকিছুর প্রতিশোধ নিতে সে তার সাথে নষ্টামি করবে না তো? এই ঘুষখোর অসৎ পুলিশ অফিসারগুলোর ইতিহাস ঘাঁটতে গেলে কত নোংরামি যে বের হবে তার ইয়ত্তা নেই। কল্পনার নিজেকে নিয়ে ভয় হচ্ছে এবার। নিজের মাথা শান্তও করতে পারছেনা সে। মাথা ঠান্ডা না হলে সে ভুলভাল কাজ করে বসে। তার কাছে ফোনটাও নেই। বাইরে বড় ভাই দাঁড়িয়ে আছে বলে তাকে নার্সগুলো তাকে বাইরে ডেকে এনেছিল। কিছু বুঝে উঠার আগেই আর্যাব খান তাকে টেনেহিঁচড়ে গাড়িতে তুলেছে। কয়েকটা লোক ছুটে আসতে চাইছিল আর্যাব খানকে দেখে এগিয়ে আসেনি।

হঠাৎ জোরে ব্রেক কষল আর্যাব খান। কল্পনার মনে হলো পেটের ভেতরের সব নাড়িভুঁড়ি বের হয়ে এল বুঝি। আর্যাব খান গাড়ি থামিয়ে দিল। দরজা খুলে নিজে বের হলো। কল্পনা তার সাথে সাথে গাড়ি থেকে বেরিয়ে এসে বলল,

“কোথায় তোমার বোন? তোমার বোন কোথায় মরতে গেছে তা আমি কি করে জানব? আমাকে এক্ষুণি পৌঁছে দাও। নইলে আমি…

আর্যাব খান তার দিকে নির্বিকার দৃষ্টিতে তাকাল। ঠান্ডা স্বরে প্রশ্ন করল,

“নইলে কি করবে?”

মেঘের মাড়ানো এবং ঝড়ে ভাসানো বাতাস কল্পনার শরীরে গাঢ় শিরশিরানি ঢেলে দিল। জলের ফোঁটা একের পর এক তার গায়ে পড়ছে। তীব্র বাতাসের ঝাপটা সইতে না পেরে সে গাড়ির দিকে তাড়াতাড়ি পা বাড়াল। ভেতরে ঢুকে দরজাটা বন্ধ করে দিল তাড়াতাড়ি। আর্যাব খান দরজায় ধাক্কা দিয়ে কঠিন স্বরে চেঁচাল,

“দরজা খোলো।”

কল্পনা আরাম করে বসে বিড়বিড়িয়ে বলল, “হেডম থাকলে খুলে দেখাও।”

আর্যাব খান অনেকক্ষণ চেঁচাল। গাড়ির জানালা সে ভাঙতে পারবে না। তার অনেক টাকা লস হবে। গাড়ির ক্ষয়ক্ষতি করা যাবে না। কল্পনাও দরজা খুলবে না। বরঞ্চ সে সিটে হেলান দিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে। আর্যাব খানের ইচ্ছে হলো গুলি করে এখানেই উড়িয়ে দিতে। তাকে বের করে দিয়ে আরামে ঘুমোচ্ছে! একবার দরজা খুলুক। গাড়ির নীচে পিষে মারবে।

হাঁটতে হাঁটতে কিছুটা দূরে চলে গেল সে। পকেট থেকে পিস্তলটা বের করতেই তার ঠাণ্ডা ধাতু আঙুলের স্পর্শ পেল। কিছুক্ষণ ডান-বামে পায়চারি করলো।

ধীরে ধীরে তার হাতটা শক্ত হতে থাকল। তারপর চোখের পলকে সময় নষ্ট না করে গুলি ছুড়ে দিল। গুলির শব্দ কল্পনার কানে তীক্ষ্ণ বেগে প্রবাহিত হলো। মনে হলো মেঘমালা ফেটে গিয়ে বজ্রপাত হলো তার ভেতরে। বুকের ভেতর হঠাৎ তীব্র ঝাঁকুনি, হৃদস্পন্দন দ্রুততর হয়ে গেল। সে তাড়াতাড়ি গাড়ি থেকে বের হয়ে দাঁড়াল। গুলি কে ছুঁড়েছে? কাকে মেরেছে?

ঠিক তখনই টর্চলাইটের তীক্ষ্ণ আলো তার চোখে এসে পড়ল। চোখগুলো ছটফট করে বন্ধ করে নিল সে। অন্ধকারের মাঝে কিছুটা সময় কেটে গেল। তারপর যখন চোখ খুলল, তখন দেখা গেল, একটা লম্বা ছায়া তার দিকে পিস্তল ধরে দাঁড়িয়ে আছে। পিস্তলের ব্যারেল থেকে বের হওয়া ধোঁয়া আর ছায়াটির শীতল নিষ্ঠুর দৃষ্টি দেখে কল্পনার মাথা অবচেতনভাবে দুলে উঠল। না সে বাঁচতে চায়। সে যতই পিছু হটলো, ছায়াটি ততটাই ঘনিয়ে এল তার দিকে।

_____________________

রাস্তার ধারে মাতাল লোকগুলোর সাথে দাঁড়িয়ে বোতলে মুখ লাগিয়ে চোক চোক করে মদ খাচ্ছে ইথিকা। সামনেই নাইট ক্লাবটা। কাবিরের কেন যেন বারবার মনে হচ্ছিল ইথিকা এই নাইট ক্লাবে থাকতে পারে।

ইথিকা হাসছে। এলোমেলো কথা বলছে। গায়ে একটা সাদা কূর্তি। ওড়না গলার সাথে লেপ্টে আছে। চুল এলোমেলো। লোকগুলোকে দেখে মনে হলো বড়লোকের বখাটে ছেলে। দিনদুনিয়ার হুঁশে নেই তারা। কয়েকটা ছেলে ইথিকার দিকে বাজেভাবে তাকাচ্ছে মাঝেমধ্যে। ইথিকার শরীরের উপর তাদের কুনজর। ইথিকার সেদিকে হেলদোল নেই। সে বকবক করেই যাচ্ছে। উচ্চস্বরে হাসছে। ঢলে পড়ছে লোকগুলোর গায়ের উপর।

একজন হঠাৎ পিছন থেকে ইথিকার কোমর জড়িয়ে ধরে তাকে নিজের দিকে টেনে নিল। ইথিকার মুখে তখনও আধখালি গ্লাসের ঘোলা মদ। সে তা সরাসরি ছুড়ে দিল লোকটার মুখে। তারপর ভাঙা হাসিতে খিলখিলিয়ে উঠল। আরেকজন এসে তার হাত টেনে নিজের কাঁধে তুলে নিল। দুজনের কাঁধে ভর দিয়ে, টালমাটাল পায়ে ইথিকা নাইট ক্লাবের দিকে এগিয়ে চলল নেশা আর অবসাদের ভারে ভারাক্রান্ত হয়ে।

এই দৃশ্যটুকু দূর থেকে দেখে স্তব্ধ হয়ে গেল কাবির। তার চোখের সামনে যেন সবকিছু ঘোলা হয়ে গেছে। এ মেয়ের জন্যে সে এই ঝড়ের রাতে পাগলের মতো সারা শহর চষে বেড়াচ্ছে। আর সে?

তার ফোনে বারবার মায়ের নাম ভেসে উঠছে। একবার, দু’বার… সে কোনোটা রিসিভ করলো না। অবশেষে বিরক্ত হয়ে ফোনটাই বন্ধ করে দিল। গাড়িতে উঠে ইগনিশন ঘোরাল। তারপর বাড়ির পথে রওনা দিল। এই সম্পর্ক আর কোনোদিন জোড়াতালি দেয়া সম্ভব না। অনেক ধৈর্যের পরীক্ষা দিয়েছে সে। আর নয়। আজ এখানেই সব শেষ।

বাড়িতে ফিরেই দেখল অস্বাভাবিক একটা নীরবতা ছড়ানো চারপাশে। সবাই জেগে আছে, চোখে মুখে উৎকণ্ঠার ছায়া। লুবনা বেগম তাড়াতাড়ি ছুটে এলেন,

“কাবির অনেক বড় বিপদ ঘটে গেছে। বৌমার ফোন থেকে কেউ একজন কল দিয়ে বলছে মুক্তিপণ দিতে হবে… নইলে তারা নাকি বৌমাকে…

শব্দটা আর মুখে আনার সাহস হলো না লুবনা বেগমের। কাবির স্তব্ধ হয়ে গেল। লুবনা বেগম আরও বললেন,

“তোমার জেঠুর বুকের ব্যাথা বৌমাকে জানালার ধারে দেখার আগেই বেড়েছে। নাজিফার মুখে শোনো। ওই বৌমাকে বলেছে ভাইজানকে দেখতে। আমরা সবাই ভুল বুঝেছি। এখন কিছু একটা করো। মেয়েটার ক্ষতি হয়ে গেলে….

সবকিছু কাবিরের মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে। ওই লোকগুলো তাহলে কারা? আনঝিল ওদের চেনেনা? সে ভুল বুঝল? এত বড় ভুল? কাবিরের চোখ নাজিফার দিকে ছুটে গেল। নাজিফা তার চাহনি দেখে আরও জবুথবু হয়ে দাঁড়াল। কাবিরের সূক্ষ্ম দৃষ্টি তার ভয়ার্ত চাহনির আড়ালে অন্য কিছু খুঁজছে। নাজিফা কি ইচ্ছে করে ইথিকাকে জেঠুর ঘরে পাঠিয়েছে? কোনটা সত্যি আর কোনটা মিথ্যে?

কাবির দ্রুত বেরিয়ে গেল। নাইট ক্লাবেও ইথিকার কোনো অস্তিত্ব নেই।

চলমান….