মনবিবাগী দিওয়ানা পর্ব-৪১ এবং শেষ পর্ব

0
2

#মনবিবাগী_দিওয়ানা
#পর্ব_৪১ #প্রথম_পরিচ্ছদ_শেষ_পর্ব
#প্রিমা_ফারনাজ_চৌধুরী

ঝিনুক একটা হীরের আংটি পেয়েছিল কাবিরের ঘর পরিষ্কার করার সময়। নিঃসন্দেহে সেটি ইথিকার। ঝিনুকের লোভ হয়েছিল প্রথমে। কিন্তু পরে কি তার মনে হলো ভাবিমণির জিনিস ভাবিমণিকে ফেরত দেয়া দরকার। তাই সে ইথিকার সাথে যোগাযোগ করার অনেক চেষ্টা করলো। একদিকে দেওয়ানদের সামনে তার নাম উচ্চারণ করা বারণ অন্যদিকে তাদের বাড়িতে যাওয়া বারণ। ঝিনুক ভেবে পাচ্ছিল না কি করবে। লায়লা খালাকে বললে তিনি তিলকে তাল করবেন। তাই ঝিনুক আপাতত চুপ করে আছে। সুযোগ পেলেই ভাবিমণির হাতে আংটিটা তুলে দেবে। বিনিময়ে তিনি তাকে খুশি করবেন এটা ঝিনুক জানে। সামনে তার বিয়ে। যদি দেখা হয়ে যায় তাহলে ভাবিমণিকে বিয়েতেও দাওয়াত দেবে সে।

___

“এবার নিজের মনের মতো কাউকে পছন্দ করে বিয়ে করতে বলো ওকে। বোঝাও জীবন কারো জন্য থেমে থাকেনা। থামাতে নেই। আমি আর কিছু বলবো না ওকে। কিছু বললে কানে তুলছেনা কথা।”

লুবনা বেগম কাওসার দেওয়ানের কথাগুলো মনোযোগ দিয়ে শুনলেন। বললেন,

“একটা সংসার ভাঙার পর এত তাড়াতাড়ি আরেকটা সংসারের কথা ভাবা যায় না। আপনার ছেলেকে আপনি নিজে চেনেন না? কোম্পানির শেয়ার বিক্রি করে দিত যাচ্ছিল। কাদিন আটকেছে ভাগ্যিস। ছেলেটার কপাল কেন এত খারাপ হতে হলো বলুন তো? জেনেশুনে কোনোদিন কারো ক্ষতি তো করিনি। সেই ছোটবেলা থেকে খানের ছেলেরা ওর পেছনে পড়ে আছে ক্ষতি করার জন্য। এই বয়সে এসেও ছাড়লো না। আমার ছেলের সুখ শান্তি নষ্ট করে দিল।”

কাওসার দেওয়ান চুপচাপ বসে রইলেন। কি বলে সান্ত্বনা দেবেন তিনি? কাবিরকে কিভাবে বোঝাবেন এভাবে থেমে থাকলে ওই খানেরা আরও পেয়ে বসবে। ওদের মোক্ষম জবাব দেয়া উচিত। নিজের ভালোটা বোঝা উচিত।

কিরণ দরজার সামনে এসে বলল,”মা শোনো।”

“বল।”

“তাহমিনা আপা ফোন করেছে। আপু শুয়ে আছে। কথা বলতে চাইছেনা। তুমি একটু কথা বলবে?’

লুবনা বেগম বাইরে বেরিয়ে এলেন। ফোনটা কানে চেপে বললেন,

” কেমন আছিস মিনা মা?”

তাহমিনা সালাম কথা বলা শুরু করলো। জানালো খানরা কি কি পরিকল্পনা করছে। বাড়িতে কি কি শোনা যাচ্ছে। আর্যাব খানকে বাড়ি ফিরে এসেছে।
তারা কল্পকে বাড়িতে তোলার কথাবার্তা বলছে। আর আনঝিল খানমের বিয়ে নিয়ে বিশাল প্রস্তুতি চলছে। পাকা কথা হয়ে গেছে, এখন শুধু দিনক্ষণের অপেক্ষা। নতুন বর একজন সফটওয়্যার ডেভেলপার, পরিবারসহ কানাডায় থাকে। বিয়ের পর তারা ওখানেই সেটেল করবে। এগুলো তাদের আগের পরিকল্পনা। বর ইলিনা হকের এক আত্মীয়। ইথিকার সাথে ছেলেটারও ভালো বন্ডিং আছে।

লুবনা সবটা শোনার পর কাঁদতে বসে গেলেন। সবাই যে যার মতো ভালো আছে। শুধু তার ছেলেটা কারো কথা শুনতে রাজী নয়। কিন্তু লুবনা বেগম এবার প্রতিজ্ঞা করলেন তিনি কাবিরকে রাজী করিয়ে ছাড়বেন। কাওসার দেওয়ানকে বললেন, এবার নিজের ছেলের জন্য যোগ্য পাত্রী তিনি নিজেই খুঁজে বের করবেন। ছেলেকে সুখী না দেখা পর্যন্ত তিনি হাল ছাড়বেন না।

_______

কল্পনার সোয়েটার গায়ে দেয়া খুব একটা পছন্দ না। লুবনা বেগম প্রায়সময় চেঁচান কেন এত শীতের মধ্যেও তার গায়ে সোয়েটার নেই এই কারণে। তবুও কল্পনা সোয়েটার পরেনা। সে সাদা একটা শাল জড়িয়ে কাশতে কাশতে ছাদে এসে দাঁড়ালো। গত দুদিন ধরে ভীষণ জ্বর তার। কাশি কমছেনা কিছুতেই।

জোসেফ এসেছিল দেখা করতে। জেদ ধরে বসেছিল অনেকক্ষণ। কল্পনা দেখা দেয়নি। ঘরের সামনে এসে দাঁড়িয়েছিল অনেকক্ষণ। অনেক ডেকেছিল। সে চুপ করে ঘরে বসে মুখ চেপে ধরে কেঁদেছে কিন্তু কাউকে বুঝতে দেয়নি। জোসেফও আর না পেরে চলে গেল। বলে গেল সে আর আসবে না। কল্পনা সেটা শুনে আরও বেশি কষ্ট পেয়েছে।

কুয়াশাজড়ানো রাত। চারপাশ ঝাপসা ভীষণ। এদিকটায় কয়েকদিন ধরে নেড়িকুকুরের উৎপাত বেড়েছে। তারা দলবেঁধে ডাকাডাকি করছে। কল্পনা কখনো একা একা ছাদে আসেনা। এই ছাদেই মায়ের লাশ পড়ে থাকতে দেখেছিল সবাই। তখন সে অনেক ছোট। তিন বছর বয়স মাত্র। কিছু মনে নেই তার। থাকার কথাও নয়।

অন্তরা খানম মাকে খুন করেছিল অথচ মায়ের সাথেই তার অন্যরকম বন্ডিং ছিল। বড়ফুপু কে মা ভয় পেত সেই হিসেবে অন্তরা খানমই একমাত্র ননদ ছিল মা যাকে বেশি পছন্দ করতো, যার সাথে বেশি সময় কাটাতো, মিশতো। অথচ মায়ের সরলতা, বিশ্বাসের সুযোগ নিয়ে অন্তরা খানম মাকে শেষ করে দিয়েছিল। মায়ের বিয়ের পরপরই তাদের সেই পুরোনো বাড়িটা ভেঙে ফেলা হয়। খান পরিবার আর দেওয়ান পরিবার আলাদা হয়ে যায়। কিন্তু অন্তরা খানমকে দাদীমা ভালোবাসতেন বলে তিনি রোজ আসাযাওয়া করতেন দেওয়ান বাড়িতে। অনেকটা বাবার আশেপাশে থাকার ছলে। অবশ্য মা এসব জানতো না।

ছোট মা’ই বলেছিলেন এসব। চাচাকে বাবার আগেই বিয়ে করিয়ে দিয়েছিলেন দাদীমা। কারণ বাবা কখনোই বিয়েশাদির প্রতি আগ্রহী ছিলেন না। তিনি সবসময় ব্যবসা বাণিজ্যের জন্য এই দেশ ওই দেশ ঘুরে বেরিয়েছেন। কাজের মধ্যে ডুবে থাকতেন। কাজ ছাড়া উনার জীবনে অন্য কিছু প্রাধান্য পায়নি কখনো।

তিনি বিয়ে করে সংসারী হবেন এই ধরণের পুরুষ মানুষ ছিলেন না। কিন্তু মাকে দেখার পর তিনি বড় দ্বিধা নিয়ে বিয়েতে মত দেন। আর তারপর সেই বিয়ে বিদ্বেষী মানুষটা হুট করে কেমন সংসারী হয়ে উঠলেন মায়ের সংস্পর্শে।

তার অনেক আগে থেকেই অন্তরা খানমের পাগলামি চোখে পড়তো উনার। বাবার বারো বছরের ছোট ছিলেন অন্তরা খানম। খান আর দেওয়ান পরিবারের সব ছেলেমেয়েদের মধ্যে অন্তরা খানম ছিল সবার ছোট। আর কামরান দেওয়ান ছিল দুই পরিবারের ছেলেমেয়েদের সবচেয়ে বড়। অন্তরা খানমের ছেলেমানুষী, পাগলামি বাবা অপছন্দ করতেন। তিনি বিরক্ত হতেন এত ছোট একটা মেয়ে উনাকে অন্য দৃষ্টিতে দেখছেন ভেবে। অথচ তিনি এমন একটা মানুষ যার পাশে ওই ছোট্ট মেয়েটা বড্ড বেমানান ছিল। মানুষের হাসির খোরাক হওয়ার জন্য অন্তরা খানমকে প্রশয় দেয়াটাই যথেষ্ট ছিল।

তিনি অনেকবার সাবধান করেছন অন্তরা খানমকে। দাদীমাকে পর্যন্ত বারণ করে দিয়েছিলেন তার সাথে কম মিশতে। কিন্তু দাদীমা অন্তরা খানমকে ভালোবাসতেন খুব। অন্তরা খানমের মা নাচগান নিয়ে ব্যস্ত থাকতেন। ঘরে থাকতেন না তেমন। তাছাড়া প্রথম সন্তান আমিন খানের জন্মের দীর্ঘ দশ বছর পর দ্বিতীয় সন্তান হওয়ায় তিনি বুকের দুধটুকুও দিতে পারেননি অন্তরা খানমকে।

দাদীমাই কোলেপিঠে বড় করেছিল অন্তরা খানমকে। তাই হয়তো সেই ডানপিটে মেয়েটার আবদার আহ্লাদগুলো মেনে নিতেন খুব সহজে।

ছোট’মার বিয়ের সময় সে খুব বড়াই করে বলেছিল, দেখবে এই বাড়িতে তোমার বড় জা হয়ে আসবো আমি। ছোট মা নাকি খুব হেসেছিল তার কথা শুনে। ছোট মা অন্তরা খানমের বড় হবে। ছোট মা অবাক হতো এই ভেবে কোথায় কামরান দেওয়ান, আর কোথায় অন্তরা খানম। মেয়েটা কি অবুঝ ছেলেমানুষী করে বেড়ায় সারাদিন।

তারপর হুট করে বাবার বিয়ে ঠিক করে বসেন দাদাভাই। একপ্রকার জোরজবরদস্তি করে বাবাকে বিয়েতে বসান তিনি। বাবা বিয়ে করবেন না বলেননি। তিনি আরও কিছুদিন সময় চেয়েছিলেন। মাকে পছন্দ করতেন তিনি। কিন্তু নানাভাই সময় দিতে চাননি। তখন অন্তরা খানমের বয়স আঠারো। বাবার বয়স ত্রিশের কোটায়। অষ্টাদশী অন্তরা খানম বাবার বিয়ের কথা শুনে সে কি পাগলামি!

বাড়ির বড়রা এসব জানতেন না।
যেদিন আমিন খানের কানে গেল তিনি ভীষণ মারধর করে সারাদিন ঘরে বন্দী করে রাখলেন বোনকে। মরে গেলেও কামরান দেওয়ানের কাছে তাকে বিয়ে দেবেন না তিনি। দুই পরিবারের শত্রুতা তখন চরম পর্যায়ে বাড়ি ভাগাভাগি নিয়ে।

কারো সাথে ভালো সম্পর্ক নেই। শুধু দাদীমাই অন্তরা খানমের সাথে সম্পর্ক রেখেছিল। মেয়েটিকে তিনি কোলেপিঠে মানুষ করেছেন তাই উনি মায়া ছাড়তে পারেননি সহজে। যেদিন মাকে মারা হলো এই ছাদে সেদিন অন্তরা খানম আচার নিয়ে এসেছিল দাদীমার জন্য। কেউ কল্পনাও করতে পারেনি সে এরকম একটা কাজ করতে পারে। অথচ দাদীমা ভেবেছিলেন সে শোধরে যাচ্ছে। তার বুঝ এসেছে। কিন্তু না। বাবা দাদীমাকে দোষ দিয়েছিলেন সবার আগে। মারা যাওয়ার আগে তিনি খুব কাঁদছিলেন এই বলে ছেলের বউয়ের মৃত্যু আর ছেলের জেল এই সবকিছুর পেছনে উনিই দায়ী ছিলেন। অন্তরার প্রতি স্নেহান্ধ উনার সংসারটাকে তছনছ করে দিয়েছিল।

লুবনা বেগম একটা কথা বারবার বলেন, কেউ পাগলের মতো চাইলে তাকে পেতে হয়, তাকে তা দিতে হয়। নইলে সব তছনছ হয়ে যায়।

চোখের সামনে দাদা আর কানিজের সংসারটা কেমন ছারখার হয়ে গেল। একজনের অকালমৃত্যু, অপরজনের যাবজ্জীবন। ছেলেমেয়েদুটোকে উনিই মানুষ করেছেন কোলেপিঠে। কখনও এক মুহূর্তের জন্যও মনে হয়নি কাবির, কাসেদ আর কিরণের সঙ্গে কল্প আর কাদিনের কোনো তফাত আছে। সবার প্রতি সমান মমতা, সমান শাসন, আর নিখাদ ভালোবাসা দিয়ে তিনি বড় করেছেন তাদের।

কল্পনা ছাদে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলো। কিছুক্ষণ পর ঝিনুক এল। পেছনে দাঁড়িয়ে বলল,

“আপা খালাম্মা বলছে ঘরে চলে আসতে। এখানে ঠান্ডা। তোমার কাশি বাড়বে।”

কল্পনা তার দিকে ফিরলো। শালটা গায়ে আরও ভালো করে জড়িয়ে নিয়ে বলল,

“তোর নাকি বিয়ে ঠিক হয়েছে?”

ঝিনুক উপর-নীচ মাথা দুলিয়ে বলল,”হ্যাঁ আপা।”

“বর কি করে?”

“সিএনজি চালায় আপা।”

“তোর পছন্দ হয়েছে?”

“হু।”

কল্পনা ম্লান হাসলো।

“আমারটাই হলো না।”

ঝিনুক মাথা তুলে তার মলিন হয়ে চেহারার দিকে তাকিয়ে বলল,”কিন্তু খানরা যে বলে ওদের বাড়ির ছেলের সাথে তোমার বিয়ে হয়ছে।”

কল্পনা চুপ করে রইলো।

ঝিনুক আংটিটার কথা বলতে চাইলো কিন্তু কল্পনার চোখমুখ দেখে আর বললো না। ভাবিমণির নাম্বারটা পাওয়া গেলে ভালো হতো। ওই মহিলা নাকি আবার বিয়ে করছে। কোনসময় শ্বশুরবাড়ি চলে যায় কে জানে। বড্ড পাষাণ ওই মহিলা।

___________

বাংলাদেশ পুলিশ সদর দপ্তরে অভিযোগ জানিয়েছিলেন ক্রাইম ইনভেস্টিগেশন ডিপার্টমেন্টের Shadow Cipher Unite এর সাব ইন্সপেক্টর জোসেফ মেহতাজ।

সাধারণ পুলিশের বাইরে থেকে জোসেফ আর তার ইউনিটের অফিসারদের বাছাই করা হয়েছিল। প্রযুক্তি, ভাষা, মনস্তত্ত্ব, অস্ত্র চালনায় দক্ষতা ও চেহারা পরিবর্তনে পারদর্শী বিধায় তারা শুধুমাত্র রাষ্ট্রের জন্য হাই-রিস্ক, হাই-প্রোফাইল মামলার তদন্ত করে। তাদের পরিচয় অনেক সময় গোপন রাখা হয়। সরকারি খাতায় পর্যন্ত পুরো নাম নথিভুক্ত নেই তাদের।

আর্যাব খান একজন উচ্চপদস্থ পুলিশ অফিসার। পদবীতে অ্যাডিশনাল এসপি। এই উচ্চপদস্থ কর্মকর্তার নামে আসা অভিযোগের চার্জশিট খুলতে দেরী হয়নি সদর দপ্তরে। আর তাদের দপ্তরে ডাকাও হয়েছে জরুরি ভিত্তিতে। জোসেফ যখন দপ্তরে গিয়ে পৌঁছালো তখন আর্যাব খান আর আমিন খানও সেখানে উপস্থিত। জোসেফ এসপি আহসানের পেছনে গিয়ে দাঁড়ালো। পুলিশের আর গোয়েন্দা বিভাগের বাঘা বাঘা সব অফিসারগুলো সেখানে উপস্থিত।

জোসেফকে দেখামাত্রই আর্যাব খান নড়েচড়ে বসে গলা হেলে হাসলো। জোসেফ সটান দাঁড়িয়ে থেকে চোরা চাহনিতে আর্যাব খানের দিকে তাকালো। তাকে হাসতে দেখে জোসেফ অবাক না হয়ে পারলো না। এত ঘৃণিত একটা কাজ করার পরও দাঁত বের করে হাসছে। অথচ এরাই নাকি জনগণের চোখে সন্ত্রাস দমনকারী।

আইজিপি স্যার এবং গোয়েন্দা বিভাগের ডিআইজি স্যারের মধ্যেকার কথোপকথন চললো দেড়ঘন্টা যাবত।

তারপর কথাবার্তা শেষ হয়ে জোসেফের দিকে একটা রিপোর্ট বাড়িয়ে দেয়া হয়। যাতে স্পষ্ট লেখা,

“অভিযুক্ত অতিরিক্ত পুলিশ সুপার জনাব আর্যাব খান এবং তাঁর পিতা গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের মাননীয় সমাজকল্যাণ মন্ত্রী জনাব আমিন খান, তদন্ত কর্তৃপক্ষের কাছে স্বেচ্ছায় উপস্থিত হয়ে ১৬১ ধারার অধীনে লিখিত ও মৌখিক জবানবন্দি প্রদান করেন। তাঁরা ঘটনার দায় স্বীকার করেন। জবানবন্দিতে তাঁরা উল্লেখ করেন যে, আর্যাব খান ও ভিকটিম কল্পনা দেওয়ানের মধ্যে পূর্বে দীর্ঘমেয়াদী একটি ব্যক্তিগত সম্পর্ক বিদ্যমান ছিল। পরবর্তীতে ভিকটিম সম্পর্ক অস্বীকার করে অন্যত্র বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হতে যান। আর সেই কারণেই মানসিক প্রতিক্রিয়ার ফলেই এই অপরাধ সংঘটিত হয় বলে তাঁরা দাবি করেন।

ডিআইজি মহোদয় তদন্ত সংশ্লিষ্ট সকল তথ্য পর্যালোচনা করে মন্তব্য প্রদান করেন যে, এ ধরনের অপরাধকে ব্যক্তিগত প্রতিহিংসাজনিত ঘটনা হিসেবে বিবেচনা করা যেতে পারে। একইসঙ্গে তিনি পরামর্শ প্রদান করেন, জোসেফ মেহতাজ ও বাকি তদন্ত কর্মকর্তাদের উচিত পেশাদার দৃষ্টিভঙ্গি বজায় রেখে তদন্ত কার্যক্রম সম্পন্ন করা এবং অপ্রাসঙ্গিক আবেগগত সম্পৃক্ততা থেকে বিরত থাকা। অভিযোগকারী এসআই জোসেফ মেহতাজ কর্তৃক উত্থাপিত উক্ত অভিযোগটি প্রাপ্ত তথ্য-উপাত্ত ও সাক্ষ্যপ্রমাণের আলোকে ভিত্তিহীন প্রতীয়মান হওয়ায় তা গ্রহণযোগ্য বিবেচিত হয়নি।”

জোসেফ রিপোর্ট পড়ামাত্রই সসম্মানে তা রেখে দিয়ে অনুমতি চাইলো যাওয়ার। ডিআইজি স্যার তাকে আদেশ দিলেন। জোসেফ রাগে হনহনিয়ে বেরিয়ে এল। তার পেছন পেছন ক্রাইম ইনভেস্টিগেশন ডিপার্টমেন্টের বাকি অফিসারেররাও বেরিয়ে এল। পেছনে কার যেন হাসির শব্দ শোনা গেল। এরা সবাই দলবেঁধেছে একসাথে। অন্যায়কারীরা অন্যায়ের বিচার করতে পারেনা কভু।

জোসেফ বাইরে বেরিয়ে এসে শক্ত হাতে গাড়ির দরজা টেনে ভেতরে বসে পড়লো। কাবির ফোন করছে আপডেট জানার জন্য। জোসেফ ফোন রিসিভ করলো না। যে বিচার আইন করতে পারেনা সেই বিচার তাকেই করতে হবে।

গাড়ি ছাড়ার পূর্বেই আর্যাব খানকে দেখা গেল। জোসেফ চোখে চশমা নামিয়ে গাড়ি স্টার্ট দিল। আর্যাব খান ঠোঁট গোল করে বাঁশি বাজাতে বাজাতে জানালার সামনে এসে দাঁড়ালো। সানগ্লাস নাকের কাছে নামিয়ে জোসেফকে বলল,

“লুজার!!”

জোসেফ সামনে তাকিয়ে আছে। আর্যাব খান হো হো করে হেসে সরে পড়ছিল জোসেফ রোদ চশমা রেখে দিয়ে তৎক্ষনাৎ গাড়ি থেকে নেমে তার কলার চেপে ধরতেই পুলিশ আর গোয়েন্দা বিভাগের অফিসারেরা ছুটে এসে দুজনকে দু’দিকে সরিয়ে নিল। আর্যাব খান হেসে বলল,

“ষাঁড় খেপেছে!! তোকে বলেছিলাম না আমার সাথে লাগতে আসবি না। কিন্তু তুই তো কানে শুনিস না। বয়রার জাত বলে কথা।”

জোসেফ আচমকা হেসে ফেললো। সবার হাত থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে গাড়ির দিকে এগোতে এগোতে বলল,”মেয়েমানুষের থুতু খাওয়া পাবলিক দিচ্ছে জ্ঞান।”

বলেই থুতু ছুঁড়লো মাটিতে। আর্যাব খান গর্জে উঠলো,”ওই কি বললি?”

জোসেফ গাড়ির দরজা ধরে থেমে গেল। ঘাড় ফিরিয়ে তাকাল। ঠোঁটের কোণায় বিদ্রুপের হাসি ছড়িয়ে বলল,

“নিজেই বয়রা হয়ে গেলি নাকি? বললাম তুই একটা থুতু খাওয়া পাবলিক। হাঁটতে বসতে ঘুমাতে তোর থুতু খাওয়া লাগে। তাও মেয়েমানুষের। এতবড় দামড়া অফিসার হয়েছিস তাও মেয়েমানুষ তোর মুখে থুতু ছুঁড়ে। ছিঃ!”

আর্যাব খান কঠোরভাবে তাকালো। তারপর আচমকা হেসে ফেলে বলল,

“খাবারে পেট ভরে। আর থুতুতে মন। তুই ওসবের কি বুঝবি? ওইখানে অনেক রকম ব্যাপার স্যাপার আছে। তোকে কানে কানে এক্সপ্লেইন করবো? কাছে আসি?”

জোসেফ বলল,”সাহস থাকলে আয়।”

আর্যাব এগিয়ে আসতেই জোসেফ তেড়ে এসে তাকে জোরে একটা ধাক্কা দিয়ে বসলো। ঘটনার তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় উপস্থিত একজন দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা সরাসরি হস্তক্ষেপ করে বললেন,

‘এসআই জোসেফ মেহতাজ, সিনিয়র অফিসারের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকুন।’

পরিস্থিতি যাতে আরও উত্তপ্ত না হয় সেজন্য উপস্থিত কর্মকর্তাদের উভয় পক্ষকে পৃথক করতে আদেশ দিলেন।

দুজনকে দু’দিকে সরিয়ে নেয়া হলো। জোসেফের গাড়ির দিকে এগোচ্ছিল। হঠাৎ এসপি আহসান পেছন থেকে বলে উঠলেন,

“Power resists force, but not precision”

জোসেফ থমকে দাঁড়ালো। ধীরেধীরে ঘাড় ফিরিয়ে এসপি আহসানের চোখ বরাবর তাকালো। এসপি আহসান বললেন,

“ক্ষমতার সঙ্গে পারা যায় না বলেই, তার ফাটল খুঁজে কাজ করতে হয়। আশা করছি জোসেফ মেহতাজ সেটাই করবে ভবিষ্যতে।”

জোসেফ ঠোঁটে হালকা হাসির রেখা টেনে বলল,

“সিউর স্যার।”

এসপি আহসান তাকে আশ্বাস দিয়ে চলে গেলেন। জোসেফ গাড়িতে উঠে বসলো। মা ফোন দিচ্ছে ঘনঘন। তিনি ভয়ে আছেন। একমাত্র ছেলেকে তিনি এইসব জটিলতায় জড়াতে দিতে চান না। কিন্তু না চাইতেও যেই জটিলতায় জোসেফ জড়িয়ে পড়েছে। কিছু করার নেই। খেলাটা ওরা শুরু করেছে আর শেষ করবে সে।

______________

সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের তৃতীয় তলার শেষ প্রান্তে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত একটা কক্ষ। দেয়ালে বাংলাদেশ সরকারের ছবি।

নিজ আসনে বসে আছেন আমিন খান। তিনি সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী। ইচ্ছে করেই কক্ষের আলো কমিয়ে রেখেছেন। চোখ বুঁজে রেখেছেন কপালে আঙুল চেপে। বাইরে থেকে কেউ অনুমতি চাইলো। অনুমতি দেয়ামাত্রই একজনকে আসতে বলা হলো। কাবির ধীরেধীরে ভেতরে প্রবেশ করলো।

টেবিলের ওপর এসে পড়লো কিছু
জমিজমার ফাইনাল কাগজপত্র, কোম্পানির শেয়ারের চুক্তিপত্র।

আমিন খান ধীরে ধীরে সব কাগজ পড়লেন।
তারপর চশমার ফাঁক দিয়ে তাকালেন কাবিরের দিকে।

“তোমাকে একা ডেকেছি কেন জিজ্ঞেস করলে না তো?”

কাবির শান্ত গলায় বলল,

“আপনি না ডাকলেও আসতাম। আজই সব মিটিয়ে চলে যাচ্ছি আপনার মন্ত্রণালয় থেকে। যাতে আপনাদের মুখ আর কখনো দেখতে না হয়।
নিজের সুখ তো পাগলেও বোঝে। কাগজগুলো দেখে নিন। আপনার মেয়েকেও দেখাবেন। দেওয়ানরা এই জমিগুলো ছেড়ে দিলে তাদের সম্পত্তির একটা কোণাও নড়বে না। সবটা হালাল টাকায় অর্জিত সম্পদ। তাদের ভয় নেই।”

আমিন খান হাসলো। বলল,

“খুশি হলাম। কিন্তু আমাদের মুখ তোমাদের আরও দেখতে হবে কাবির। বসো।”

“বসতে আসিনি।”

আমিন খান বলল,”আমরা কল্পকে বাড়িতে নিয়ে আসবো।”

কাবির কপাল কুঁচকে বলল,”কি কারণে?”

“কারণ সে খান বাড়ির বউ।”

কাবির বলল,”নতুন তামাশা।”

সে বেরিয়ে যাচ্ছিল। আমিন খান বলল,

“খানরা কোনো কথা এমনি এমনি বলে না। সব সাক্ষী প্রমাণ আছে আর্যর হাতে। তোমার দাওয়াত থাকলো। আনঝিলের বিয়ে ঠিক করেছি। সামনের মাসে ওর ফ্লাইট। তাই দ্রুত আয়োজন করেছি। সময়মতো চলে এসো। অবশ্য খান বাড়ি থেকে দাওয়াত যাবে স্পেশালভাবে। আমরা কল্পনাকে নিয়ে আসতে যাব আজকে।”

কাবির বেরিয়ে গেল। দাঁড়ালো না একমুহূর্তও। বাড়ি থেকে ফোন আসছে। কাবির ফোন রিসিভ করে লুবনা বেগমকে বলল,”হ্যাঁ আসছি।”

বাড়ি ফিরতেই দেখলো সোফায় কয়েকটা নতুন মুখ বসে আছে। কাবির কুশলাদি বিনিময় করে কপাল কুঁচকে কাওসার দেওয়ানের দিকে তাকালো। কাওসার দেওয়ান চোখ সরিয়ে নিলেন। কাবির মেহমানদের উদ্দেশ্যে বলল,

“বসুন আপনারা। আমি আসছি।”

কাবির উপরে চলে গেল। মাকে ডাকতেই লুবনা বেগম হাজির হলেন তার ঘরে। বললেন,

“কথাটা পুরোপুরি শুনে তারপর চেঁচাও কাবির।”

কাবির হাতে ঘড়ি খুলতে লাগলো। লুবনা বেগম বলতে লাগলেন,

“এই মেয়েটা খুব ভালো। হাসিখুশি, পড়াশোনা জানা, সবচেয়ে বড় কথা সম্ভ্রান্ত পরিবারের মেয়ে। মা বাবা ভাই বোন সবাই কত ভদ্র।”

কাবির বলল,”বয়স?”

লুবনা বেগম ঢোক গিললেন।

“কিরণের বয়সী।”

কাবির গর্জে বলল,”মানে????”

লুবনা বেগম চুপসে গেলেন। কাঁদোকাঁদো হয়ে বললেন,

“তোমার অবাধ্য কখনোই হবে না। বয়সের ফারাক থাকলে ওই সম্পর্কটা আরও মজবুত হয়। আমার দিকে তাকাও একবার। আমি তোমার চিন্তায় খেতে পারছিনা, ঘুমাতে পারছিনা। আমাকে তোমার জীবনটা গুছিয়ে দিতে দাও। একটা বেঈমানের জন্য তুমি কেন থেমে থাকবে?”

কাবির ঘড়িটা রেখে দিতে দিতে বলল,

“তুমি গ্যারান্টি দাও আমি এই বিয়েতে সুখী হবো। তাহলে করবো কোনো প্রশ্ন ছাড়াই।”

লুবনা বেগম চুপ হয়ে গেলেন। কাবির মায়ের সাড়াশব্দ না পেয়ে ঘাড় ফিরিয়ে তাকালো। হেসে বলল,”পারবে না তাই তো?”

লুবনা চোখ মুছলেন। কাবিরকে অবাক করে দিয়ে বললেন,”পারবো।”

কাবির কাবার্ড খুলতে গিয়ে থেমে গেল। লুবনা বেগম বলল,

“মায়ের দোয়া কখনো বিফলে যায় না কবির। আমি মা হয়ে তোমাকে বলছি তুমি এই বিয়েতে অনেক সুখী হবে। এত সুখী হবে যে তোমার সুখ দেখে ওই অমানুষরা কাঁদবে।”

কাবির শব্দ করে কাবার্ডের দরজা বন্ধ করে বলল,

“বিয়ে বিয়ে বিয়ে। তোমরা আর কিছু বোঝো না? আমি শান্তিতে আছি একা থেকে। আমার ভালো থাকার জন্য অন্য কোনো মেয়ের দরকার নেই। কোনো মেয়ে এসে আমার জীবনটা পাল্টে দিতে পারবে না। জীবনে ভালো থাকার জন্য নিজেই যথেষ্ট মা। ভালো থাকার প্রতিযোগীতায় সেই জেতে যে নিজেকে ভালোবাসে। আমি আমার জন্যই এনাফ! সবাইকে থামাও। আর তুমিও থামো। এসব তামাশা বন্ধ করো।”

লুবনা বেগম চিল্লিয়ে বললেন,

“না বন্ধ করবো না। মা হিসেবে আমার দায়িত্ব আমার ছেলের সংসার গুছিয়ে দেয়া। আমি তোমার কথা শুনবো না কাবির। ওই মেয়ে তোমার সব কেড়ে নিয়ে দিব্যি বিয়ে করে নিচ্ছে ধেইধেই করে। আর তুমি এখানে পঁচে মরবে?”

কাবির বিড়বিড়িয়ে বলল,”বাড়িতেও থাকা যাবে না দেখতে পাচ্ছি।”

লুবনা বেগম তার সামনে দাঁড়িয়ে পড়লেন। ছেলের যাওয়া আটকে বললেন,

“বেরিয়ে যাচ্ছ? মায়ের কথা অমান্য করলে সন্তানেরা সুখ পায় না কাবির। আমি এখন যা বলছি তা তুমি কয়েক বছর পর ঠিকই অনুধাবন করতে পারবে। তুমি এই বিয়েটা করবে ব্যস। নইলে আমার মরা মুখ দেখবে। এটা ছেলেমানুষী মনে হলে ছেলেমানুষীই।”

কাবির তারপরও বেরিয়ে যাচ্ছিল। কামরান দেওয়ান সামনে এসে দাঁড়ালেন। কাবির উনাকে দেখে বললেন,

“সবাই মিলে এসব করছো তাই না?””

কামরান দেওয়ান বলল,

“তোর জীবনটা আমার জন্যই ছারখার হয়েছে। আমি জানিনা তুই আমাকে কোনোদিনও ক্ষমা করবি কিনা। হয়তো এজন্যই আমার মেয়ের জীবনে এত..

কাবির চেঁচিয়ে উঠে বলল,

“তোমরা সবাই মিলে কি নাটক শুরু করলে বলোতো? তোমার জন্য আমাকে ওই বিয়েটা করতে হয়েছে বলে আমি কল্পকে অভিশাপ দেব ভাই হয়ে? তোমরা এইসব ভাবলে কি করে? আমি আজকের এই অবস্থার জন্য কাউকে দোষারোপ করিনা। দোষ আমার নসীবের। তোমরা পথ ছাড়ো এখন। আমি উনাদের বলছি এই বাড়িতে বিবাহযোগ্যা ছেলে আরও দুটো আছে।”

লুবনা বেগম বললেন,

“আল্লাহর কসম করে বলছি কাবির তুমি যদি আজ বেরিয়ে যাও বাড়ি থেকে তাহলে ফিরে এসে আমার মরা মুখ দেখবে। তারপর তুমি সুখে থাকবে। দেশ বিদেশে ঘুরতে পারবে। কেউ তোমাকে কিচ্ছু বলবে না। মা আর তোমার পিছুপিছু ঘুরবে না কোনো আবদার নিয়ে।”

কাবির কাওসার দেওয়ানকে বলল,

“দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কি শুনছো? কিছু বলছো না কেন মাকে?”

কাওসার দেওয়ান বলল,

“নিজের ছেলেকে সুখী দেখতে চাওয়া মা বাবার অধিকার। আগেও তোমার সুখের জন্য তোমার সব কথা শুনেছি আমরা। বলেছিলাম ওই তিক্ত সম্পর্কটা থেকে বেরিয়ে আসতে। তুমি শোনোনি। আমাদেরও চুপ করিয়ে দিয়েছিলে। এবার তোমার আমাদের কথা শোনা উচিত। বিশেষ করে তোমার মায়ের।”

কাবির সটান দাঁড়িয়ে রইলো। লুবনা বেগম চোখমুখ মুছে নিলেন। দূরে দাঁড়িয়ে থাকা কিরণকে ডাকলেন। কিরণ এসে ফোনটা বাড়িয়ে দিল। লুবনা বেগম ফোনটা কাবিরের সামনে এনে রাখলো। বলল,

“একবার দেখো ছবিটা। ও তোমাকে খুব ভালো রাখবে, এটা আমার মন বলছে। মায়ের মন কখনো ভুল কথা বলেনা কাবির।”

লুবনা বেগম তার চোখের সামনে তুলে ধরলো ফোনটা। কাবির ছবিটা দেখলো না। মায়ের হাতটা আলতোভাবে সরিয়ে দিয়ে বলল,

“আমাকে আমি নিজেই ভালো রাখতে পারিনি সেখানে পরের মেয়ে কি করে ভালো রাখবে? বেশ, তোমাদের যখন মনে হচ্ছে আমার ভালো থাকার জন্য একটা মেয়ে দরকার তখন আমি তোমাদের আর কিচ্ছু বলবো না। কিন্তু একটা কথা পরিষ্কারভাবে জানিয়ে দিই আর কারো ভালোমন্দের দায়বার আমি নিতে পারবো না। কারো সুখ দুঃখের দায়ভার আমার নয়। যদি কেউ আসে তার ভালোমন্দের দায়ভার যদি তোমরা নিতে পারো তবেই আসবে। আমি কিচ্ছু জানিনা। কেউ আমাকে আর কিচ্ছু বলতে আসবে না। আমি আর কারো কিছুতে নেই। আমার কিচ্ছু দরকার নেই। কাউকে দরকার নেই।”

বলতে বলতে চলে গেল সে। লুবনা বেগম কান্নায় ভেঙ্গে পড়লেন। কিরণ মায়ের গাল মুছে দিতে দিতে নিজেও কাঁদছে। লুবনা বেগম ছবিটার দিকে তাকালেন। চোখ মুছতে মুছতে আবারও কাঁদতে লাগলেন। বললেন,

“আমি দায়িত্ব নিলাম। একদিন তুমিও স্বেচ্ছায় তার দায়িত্ব নিয়ে নেবে। ভালো থাকার জন্য ভালো রাখার দায়িত্ব নিয়ে নিতে হয়। তুমিও নিয়ে নেবে আমি জানি।”

কাবির ছাদে গিয়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা একটা চেয়ারে ধপ করে বসে পড়লো। হঠাৎ মনে হলো এই ছাদে আসাটাই একদম উচিত হয়নি। দিনভর অক্লান্ত পরিশ্রমের পর বাড়ি ফিরে ছাদের এককোণা দখল করা আনঝিল খানমকে সে দেখেছিল লাল পাড়ের সাদা শাড়ি পরা বাঙালি বধূর সাজে, বড় বড় রেস্টুরেন্ট ক্যাফের ক্যান্ডেললাইট নাইটকেও হার মানিয়েছিল কয়েকটা মোমবাতি জ্বালিয়ে নিজ হাতে যত্ন করে রান্না করা ডিনার আইটেমগুলো। ভালোবাসা বাসি এমনি এমনি হয়নি। প্রতিটা সেকেন্ড, প্রতিটা মিনিট, প্রতিটি ঘন্টা, মেপে মেপে বয়ে যাওয়া প্রতিটা সময় কাজ করেছিল তাদের কাছে আনার চেষ্টায়।

একপ্রান্তে দাঁড়িয়ে একজন প্রাণখুলে হাসতো। অপরজন অপরপ্রান্তে দাঁড়িয়ে চুপচাপ দেখতো, শুনতো। বিরক্তি, অবজ্ঞা, মান অভিমান, অহংকার, দম্ভ পেরিয়ে ভালোবাসাদের আসতে সে অনেক সময় লেগেছে। অনেক।

কাছে এসে দাঁড়িয়ে শার্টের একটা বোতাম লাগিয়ে দিতেও যেখানে অনেকটা ভরসা আর ভালোবাসার দরকার হয়। সেই ভালোবাসা কপালের চামড়ায় ঠোঁট ছুঁয়ে আদর করা থেকে শুরু করে আঙুলে আঙুলে আর শরীরের বিন্দু বিন্দুতে মিলে মিশে একাকার হয়ে যাওয়ার মুহূর্তটুকুই প্রমাণ করে ভালোবাসার মাত্রাটা ঠিক কতটুকু ছিল। তারপরও সেখানে ফাঁকফোকর থেকে গিয়েছিল। ছলনা, প্রতারণা সবটুকু লুকিয়ে ছিল তার আড়ালে। কি যত্ন করে মানুষ ভাঙা যায় তা আনঝিল খানম বেশ ভালোভাবে আয়ত্ত করেছিল। নয়তো যতটুকু ভালোবাসলে আর দূরে যাওয়া যায় না ততটুকুই ভালোবেসেছিল কাবির দেওয়ান। তারপরও আনঝিল খানম গিয়েছে। ভালোবাসা, সংসার, স্বামী, সন্তান সবটাই তাকে দিয়েছিল উপরওয়ালা। তবুও দুমুঠোয় তা আঁকড়ে ধরেনি সে।

কাবির ছাদ থেকে চলে গেল।

সে আজ থেকে ভালোভাবে বাঁচবে। তাকে ভালো থাকতে হবে। কারণ তার উপর অনেক মানুষের ভালো থাকা নির্ভর করছে। আনঝিল খানমের স্মৃতি, নামধাম সব একদিন সে ভুলে যাবে। পথ চলতে চলতে কোনোদিন যদি সেই নাম শুনে তাকে থমকাতে হয় তাহলে সেদিনই যেন তার মৃত্যু হয়।

________

আর্যাব খান সোফায় শুয়ে চোখ বুঁজে রেখেছিল।
আমিন খান তার ঘাড় চেপে ধরে বললেন,”আমি তোমাকে জেসির দিকে ঝুঁকিয়ে দিয়েছি আমাদের ভালোর জন্য। তুমি ওকে ছাড়লে কেন? ওকে হাতে রাখলে ওর ভাইকেও সোজা করা যেত। ওই ছেলে এখন শক্তপোক্তভাবে আমাদের পেছনে লেগেছে। তোমাকে বলি একটা, তুমি করো একটা।”

আর্যাব খান বিরক্ত হয়ে তাকালো। নিজেকে বাবার হাত থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে বলল,”জেসি বউটাইপ না। বউটাইপ হচ্ছে দেওয়ানি। জেসি আমার বোন বোন টাইপের। তাকে দেখলে ইথুর মতো গাল টেনে দিতে ইচ্ছে করে। আর কিচ্ছু না।”

এত বকাঝকার পরও রসিকতা করছে দেখে ইলিনা হক বলে উঠলেন,

“ওরা বিয়েটাই মানেনা। তুমি ওকে জোর করে এনে সংসার করাবে? সেটা আদৌ সম্ভব?”

“সংসার না জুতো পরিষ্কার করাবো একবার আনতে পারলে।”

ইলিনা হক বললেন,”পারবেনা, জোসেফও কল্পকে এত সহজে ছাড়বেনা। ওদের অনেকদিনের সম্পর্ক। তুমি বিয়ে বিয়ে করলে দরকার পড়লে ডিভোর্স লেটার ধরিয়ে দেবে কিন্তু কল্পর আশেপাশেও তুমি যেতে পারবেনা। আমি তোমার ছেলেমানুষী দেখে অবাক হচ্ছি আর্য।”

আর্যাব খান ভয়ানক রেগে গিয়ে বলল,

“না এলে ওকে ওই গোয়েন্দার কাছেও যেতে দেব না। দরকার পড়লে পুড়িয়ে মারবো তবুও না। আমার হাত থেকে এত সহজে ছাড় পাবেনা ও।”

আসলাম খান বলল,”তুই এত মজনু কবে থেকে হলি ওই মেয়ের জন্য?”

আর্যাব খান হাসলো।

“তুমি বোধহয় জানো না বন্ধুকে কাছে রাখতে হয়। শত্রুকে আরও কাছে। না বুঝলে বউয়ের আঁচলের তলায় বসে থাকো। আমাকে ফালতু কথা বলবে না।”

আসলাম খান অবাক হয়ে বলল,

“ওই তুই আমাকে ভয় দেখাচ্ছিস নাকি? মা তুমি দেখেছ?”

ইলিনা হক বিরক্তির সাথে বললেন,

“আর্য এইসব ছাড়ো। তোমার বাবার ইমেজ নষ্ট হবে তুমি এইসব করতে থাকলে। তুমি যত প্রমাণ দেখাও না কেন কল্পকে ওই পরিবার এত সহজে ছাড়বে না। আশিষ সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরুক। আর ইথুর একটা ব্যবস্থা হোক। আমার মাথা খারাপ করো না।”

আর্যাব খান সোফায় বসে রইলো মাথা নীচে ঝুঁকিয়ে। আশিষের গুলির শোধ তো অন্তত নিতে হবে সবার আগে।

____

খানরা এসে ঝামেলা পাকালো দেওয়ান বাড়ির সামনে। সাথে লোকলস্করও এনেছে। কাউকে ভেতরে ঢুকতে দেয়া হলো না। আর না পেরে গেইট ভাঙচুর করতে লাগলো ছাত্রলীগের কয়েকটা ছেলেপেলেসহ। শেষমেশ কামরান দেওয়ান বেরিয়ে এলেন। তিনি কল্পনাকে একটা ঘরে বসিয়ে ভেতরে বাইরে তালা মেরে রেখেছেন। আসলাম খান বলল,

“বাড়ির বউ বাড়ি ফিরুক। ওদের বিয়ের এত এত প্রমাণ দিয়েছি সব তো আর মিথ্যে না। কাজী সাহেব বলুন কিছু।”

কামরান দেওয়ান গর্জে উঠলেন,

“এইসব দু পয়সা দিয়ে সাজিয়ে আনা কাজীর কথায় আমি আমার মেয়েকে ছাড়বো তোরা ভাবলি কি করে?”

আসলাম খান বলল,”আরেহ জেঠা ওরা গোটা একটা দিন একসাথে ছিল।”

কাদিন তেড়ে গিয়ে সাথে সাথে ধাক্কা দিল আসলাম খানকে। আরিশ এসে কাদিনের কলার চেপে ধরলো। কাদিন তাকে ঘুষি মেরে সরিয়ে দিয়ে বলল,

“আর একটা বাজে কথা বললে এখানে পুঁতে ফেলবো সবকটাকে।”

কামরান দেওয়ান কাদিনকে টেনে নিয়ে এলেন। বললেন,

“তোদের এই মিথ্যে রেজিস্ট্রি পেপার আমরা মানিনা। আগে ভেবেছিলাম কাজী ডেকে বিয়েটা দেব। কিন্তু এবার তোরা দেখবি আমি ঢাকঢোল পিটিয়ে আবার আমার মেয়েকে জোসেফ মেহতাজের কাছে কিভাবে বিয়ে দিই। তোরা কুত্তার মতো ঘেউঘেউ করতে থাক সবাই মিলে।”

আসলাম খান বলল,”লোকলস্কর আরও আনব নাকি?”

কামরান দেওয়ান বললেন,

“আমি পুলিশ ডেকে পাঠিয়েছি। বাকি কাজ ওরা করবে।”

অনেকরাত অব্ধি খানরা ওখানে দাঁড়িয়েছিল লোকলস্কর নিয়ে। পুলিশের সাথে তাদের কথা কাটাকাটি, তর্কাতর্কি চললো অনেক্ক্ষণ। পুলিশ
কাবির ছিল না বাড়িতে। তাই দেওয়ান বাড়ির সবাই একটু হলেও ভয়ে জড়োসড়ো ছিল। লায়লা খালা বারবার ঝাঁটা নিয়ে তেড়ে যাচ্ছিল বাইরে। কাদিন আর কাসেদ না আটকালে সত্যি সত্যি ঝাঁটা দিয়ে পিটিয়ে আসতো।

কল্পনা ঘরের ভেতর একা একা বসেছিল। জোসেফ তার ফোন ধরছেনা। ওইদিন দেখা না দেওয়ায় তার উপর খেপেছে। বড় ভাই বলেছে সে গুরুত্বপূর্ণ কাজে নেমেছে। আর এই কাজে সফল হলে আর্যাব খান, আসলাম খান এমনকি আমিন খানের মতো লোক মুখ থুবড়ে পড়বে দেশের মানুষের সামনে। কল্পনা ওটা শোনার পর ভয়ে আছে। যে মিশন যতবড় তার কাজের ঝুঁকিও ততটাই বেশি। জোসেফের কিছু না হোক। কিছু হলে সে নিজেকে ক্ষমা করতে পারবেনা। সবটা এলোমেলো হয়ে যাবে তার।

___________

ঝিনুকের বিয়ে তাই সে চিরদিনের জন্য বিদায় নিচ্ছে দেওয়ান বাড়ি থেকে। লুবনা বেগম বড়ো দয়ালু মানুষ। ঝিনুক সেই পনের বছর বয়সে এই বাড়িতে এসেছে। আজ চলে যাওয়ার সময় লুবনা বেগম তাকে বুকের সাথে জড়িয়ে ধরে রাখলেন। চোখ ভিজে উঠছে। মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করে দিয়ে বললেন,

“অনেক অনেক সুখী হ মা। তোর মামু আর কিছুদিন সময় দিল না আমাদের। নইলে আমি তোকে দেখেশুনে বিয়ে দিতাম।”

ঝিনুকের চোখে জল। মনে মনে বিড়বিড়িয়ে বলল,”আমি তোমার কাছেই থেকে যেতে চেয়েছি মা।”

লায়লা খালা কাঁদছে। ঝিনুক তার দিকে এগিয়ে যেতেই কেঁদে উঠলো সশব্দে। ঝিনুক তা দেখে হাউমাউ করে কান্না শুরু করে দিল। কিরণ এসে ছাড়িয়ে নিয়ে বলল,

“তুই তো এই শহরেই থাকছিস। দুলাভাইকে নিয়ে বেড়াতে চলে আসিস মাঝেমধ্যে। কাঁদিস না।”

ঝিনুক কল্পনার কাছ থেকে বিদায় নিচ্ছিল। সেই সময় কাসেদ এসে তাড়া দিল।

“ঝিনুক তাড়াতাড়ি বের হও। তোমার বাবা চেঁচাচ্ছেন। আমি তোমার ব্যাগপত্রগুলো গাড়িতে তুলে দিয়েছি। যাও।”

কল্পনা বলল,”ভাইয়া এইভাবে বলে? তুমি তো ওকে তাড়িয়ে দিচ্ছ রীতিমতো।”

কাসেদ কপাল কুঁচকে ফেললো। সে একটু বদমেজাজি। কথাবার্তা ধরণ অগোছালো। ভেবেচিন্তে কথা না বলার জন্য প্রায়সময় কাবিরের বকুনি খায়। ঝিনুকের দিকে কপাল কুঁচকে চেয়ে বলল,

“এভাবে কান্নাকাটির কি আছে? বিয়ের জন্য তো লাফাচ্ছিলে এতদিন।”

ঝিনুক চুপ করে রইলো। চোখ থেকে টপটপ করে জল পড়ছে। কাসেদ বলল,

“ঠিক আছে, কেঁদো না আর। যাও তোমার মামু চিল্লাপাল্লা করছেন।”

ঝিনুক এগিয়ে এসে তার পা ছুঁয়ে সালাম করলো। তারপর লুবনা বেগমের দেয়া শাড়ি, গয়না, টাকাপয়সা বুকের সাথে বেঁধে ধীরপায়ে হাঁটতে হাঁটতে বেরিয়ে গেল দেওয়ান বাড়ি থেকে। কাসেদ কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। তারপর মাথাঝাড়া দিয়ে চলে গেল। কিরণকে ডাকলো।

“মা কোথায়?”

কিরণ দৌড়ে এসে বলল,

“জানো নতুন ভাবি অসম্ভব পাজি।”

কাসেদ বিরক্ত হয়ে বলল,

“তো আমি কি করবো? কল্প সারাদিন ঘরে বসে বসে চোখমুখ ফুলিয়ে কি অবস্থা করেছে। ওকে ঘর থেকে বের করে ছাদে নিয়ে যা। সব তোকে শিখিয়ে দিতে হয় কেন?”

কিরণ ভড়কে গিয়ে বলল,”কথাটা আস্তে করে বললে হতো না?”

“তোরা মেয়ে মানুষের জাত সোজা কথা বুঝিস?”

কিরণকে বড় বড় কথা শুনিয়ে সে চলে গেল। কিরণ হতবাক হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। হুদাই রাগ দেখালো তার সাথে।

_________________

সেই দিনটা ঘনিয়ে এল। কিন্তু সকাল থেকে কাবির বাড়িতে নেই। বিয়ে রাতে। মেয়ের বাড়িতেই আয়োজন হয়েছে। বরপক্ষ খেয়েদেয়ে বউ নিয়ে চলে আসবে

কাবির বাড়ি ফিরলো একদম সন্ধ্যার দিকে।
তাও কাউকে দেখা না দিয়ে ছাদে চলে গেল। কাওসার দেওয়ানকে বলেছে, সে সময়মতো রেডি হয়ে নেবে। কোনো চেঁচামেচি চায় না সে। বড়ফুপু কিছু বলতে গিয়েও বললো না আর।

কাবির এসেছে শুনে লুবনা বেগম ছাদে চলে এল। দেখতে পেল ছাদে পানির ট্যাপ ছেড়ে কাবির মাথা নামিয়ে রেখেছে তার নীচে। পানি গড়িয়ে তার বুক পিঠ অব্দি ভিজিয়ে দিচ্ছে। লুবনা বেগম ছুটে এসে ট্যাপ বন্ধ করে দেন। শাড়ির আঁচলে মাথার পানি মুছে দিতে দিতে বললেন,

“এমা জ্বর নাকি? গা এত গরম কেন? আজকেই তোমার জ্বর উঠতে হলো?”

কাবির জবাব দিল না। লুবনা বেগম বললেন,

“ওঠো, ভেজা শার্ট বেশিক্ষণ গায়ে রাখতে নেই। ওঠো, ঘরে চলো। কাবির!”

কাবির মায়ের দিকে চোখ তুলে তাকালো। ছেলেকে তাকাতে দেখে লুবনা বেগম মুখ ফিরিয়ে নিলেন সাথে সাথে। চোখ আড়াল করলেন। কাবির একটা প্রশ্ন করলো শুধু।

“তুমি আমার মাথায় আবার পাগড়ি পড়াতে যাচ্ছ? তোমার হাত কাঁপবেনা?”

লুবনা মুখটা আরও ফিরিয়ে নেন। গাল ভিজে যাচ্ছে। কাঁপা গলায় বললেন,

“কাঁপবেনা। স্বামী সংসার সন্তান ফেলে চলে যেতে তার বুক কাঁপেনি। আমারও কাঁপবেনা। তোমারও উচিত নয়।”

কাবির আর কিচ্ছু বললো না। উঠে গেল। চুপচাপ হেঁটে চলে যেতে লাগলো। লুবনা বেগম শাড়ির আঁচল টেনে মুখে চেপে ধরলেন। পাষাণ হৃদয়হীন মেয়ে, তুই কি করে গেলি এটা?

_____

লুবনা বেগম ছেলেকে পাগড়ি পরাতে পারেননি। কাবির পাগড়ি ছাড়াই বেরিয়ে গিয়েছে। বিয়ে সে পাগড়ি ছাড়াই করবে।

কিছুক্ষণ পর বাইরে হঠাৎ হৈচৈ লেগে গেল। কাওসার দেওয়ান জানালেন কাবির নেই কোথাও। গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়েছে। কোথায় চলে গেল একা একা?

কল্পনা বারান্দায় দাঁড়িয়ে দেখলো জোসেফ এসেছে। সেও কাবিরের চিন্তায় চিন্তিত। কল্পনা জোসেফের দিকে চেয়ে রইলো। জোসেফ কানে চেপে ধরে এদিকওদিক তাকাতেই হঠাৎ কল্পনাকে দেখলো। অনেকদিন পর একটুখানি চোখের দেখাটা খুব দরকার ছিল। জোসেফ যতক্ষণ না চোখ সরিয়ে নিল কল্পনা ততক্ষণ তাকিয়ে রইলো।

কাবিরের গাড়িটা এসে থেমেছে খান বাড়ির সামনে। গেইট বন্ধ। কাবির গাড়ি থেকে নামলো। খান বাড়ির বারান্দার দিকে তাকালো। ভেতরে গানবাজনা হচ্ছে। আশিষ খান হাসপাতাল থেকে ফিরেছে সেই উপলক্ষে। অনেক মানুষজন দেখা যাচ্ছে সেখানে।

কাবির কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকলো। অনেক প্রশ্নের উত্তর মেলেনি এখনো। হয়তো আর মিলবে না। সে যাকে দেখতে চাইলো তার দেখা পেল না।

আবার গাড়িতে এসে বসলো। ফিরে এল দেওয়ান বাড়িতে। সবাই এসে ঝেঁকে ধরলো তাকে।

“কোথায় গিয়েছিলে?”

কাবির সেই প্রশ্নের জবাব না দিয়ে কাদিনকে বলল,”সবাই চলে এলে গাড়ি ছাড়তে বলো।”

বাপ চাচা মামা খালু, মা মামীরা ফুপুরা গিয়ে বউ তুলে নিয়ে আসবে। মোটমাট ছয়টা গাড়ি রওনা দিল কনের বাড়ির উদ্দেশ্যে। অবশ্য কাসেদ আর তার কয়েকজন বন্ধু যায়নি। তারা বাইরে চেয়ার টেবিলে বসে গল্প জুড়ে দিয়েছে।

বাড়ির মেয়েরা বাড়িতেই আছে। তারা নতুন বউয়ের জন্য নতুন করে বাড়ি সাজাচ্ছে। বিয়ে উপলক্ষে জেসিও এসেছে দেওয়ান বাড়িতে। কল্পনা, কিরণ, জেসি আর তাদের আরও কয়েকজন কাজিন মিলে গল্পগুজব করছে। ঝিনুকও এসেছে বিয়ে উপলক্ষে। বউ দেখার পর সে চলে যাবে।

প্রায় ঘন্টা তিনেক পর এক ফাঁকে ড্রয়িং রুমটা পরিষ্কার করতে করতে হঠাৎ একটা ফোন খুঁজে পেল সে। কিরণের ফোন। সেখানে ইথিকার নাম্বারটা খুঁজে পেল। বাড়িতে কেউ নেই তাই সাহস করে ফোন করলো। ঝিনুকের হাত কাঁপছে। কিরণ আপা ফোন করেছে মনে করে রিসিভ না করলে তখন?

কিন্তু তা হলো না। কিছুক্ষণ পর একটা মেয়েলী কণ্ঠস্বর শোনা গেল।

“হ্যালো!”

ঝিনুক ফিসফিস করে বলল,

“ভাবিমণি আমি ঝিনুক বলছি। আপনার একটা আংটি আমার কাছে। আপনার ফোন নাম্বার পাচ্ছিলাম না তাই ফোন করতে পারিনি।”

“ও এজন্যই তাহলে আংটিটা আমি খুঁজে পাইনি। তুমি আমার কাছ থেকে কিছু টাকাপয়সাও পেতে। তুমি কি সেটা আজকেই দিতে চাচ্ছ?”

“জি।”

“কোথায় তুমি এখন?”

“দেওয়ান বাড়ির সামনে নইলে বটতলার দিকে আসেন। আমি ওইদিকে আছি।”

ইথিকা বলল,”বটতলা নয় তুমি দেওয়ান বাড়ির সামনে দাঁড়াও। আমি একঘন্টা পর যাচ্ছি।”

ঝিনুক বলল,”আচ্ছা এই নাম্বারে আর ফোন দিয়েন না। আমি ফেঁসে যাব।”

“ওকে, তুমি চাপ নিওনা।”

ঝিনুক ঘন্টাখানেক পর বাড়ি থেকে বেরোতে যাচ্ছিল। কাসেদ এগিয়ে এসে বলল,

“কোথায় যাওয়া হচ্ছে?”

ঝিনুক কেঁপে উঠলো। বলল,”আমার একটা কাজ আছে ভাইয়া।”

“কীসের কাজ?”

“এক্ষুণি যাব আর আসবো। আমার মামাতো বোন আসবে কিছু টাকাপয়সা দিতে।”

কাসেদ বলল,”ঠিক আছে। এক্ষুণি যাবে, এক্ষুণি আসবে।”

“জি।”

ঝিনুক বেরিয়ে গেল। বাইরে বেরিয়ে এসে দেখলো ভাবিমণি নামছে একটা রিকশা থেকে। পরনে একটা শর্ট বোরকা। নামমুখ ঢাকা। চেনায় যাচ্ছে না যে এটা ভাবিমণি। কল্প আপা আর ভাবিমণি একই রকম বোরকা কিনেছিল সেবার। কল্প আপা সেটা অনেকবার পরলেও ভাবিমণিকে পরতে দেখা যায়নি কারণ তিনি বোরকা হিজাব পরেন না। ইথিকা অন্ধকারে দাঁড়িয়ে হাতের ইশারায় ডাকলো ঝিনুককে।

______

আর্যাব খানের ফোন বাজছে। সে মদের নেশায় ডুবে ছিল। মেজাজ খারাপ লাগছে। ফোন ধরামাত্রই গালাগালি দিয়ে বলল,

“হাসপাতাল থেকে এসে মরতে গিয়েছিস কোথায়?”

আশিষ উত্তেজিত গলায় বলল,”ব্রো তোমার দেওয়ানি এখন আমাদের সামনে।”

আর্যাব খান লাফ দিয়ে উঠে বসলো সোফা ছেড়ে।

“কোথায়? টেনেহিঁচড়ে যেভাবে পারিস সেভাবে নিয়ে আয়।”

আশিষ বলল,”সেটা সম্ভব না। মনে হচ্ছে জোসেফের বাচ্চাও এখানে এসেছে। তার গাড়িটা দেখেছি। তুমি আমাকে অনুমতি দিলে আমি একটা কাজ করতে পারি।”

“কি কাজ?”

“তোমার দেওয়ানির এমন হাল করবো যাতে তাকে জোসেফ মেহতাজ জীবনেও একসেপ্ট না করে। তোমার কাছে ফিরতে বাধ্য হয়।”

আর্যাব খান বলল,”কি করবি?”

আশিষ বলল,”আগে আগে দেখো হোতা হ্যায় ক্যায়া।”

কাবির দেওয়ানের গুলির আঘাতের প্রতিশোধ তো নিতেই হতো আশিষ খানকে। সে আরিশকে ইশারা করলো। দুজনেই দুইটা বাইকে বসেছে। বাইকগুলো একটু দূরে পার্ক করে তারা একটা সিএনজি ধরলো। সিএনজি চালক তাদেরই লোক। সিএনজি চালককে বুঝিয়ে দিল কি কি করতে হবে। সিএনজি তাদের কথাশুনে চালক মাথা নাড়লো।

ঝিনুককে পাঁচ হাজার টাকা দিল ইথিকা। ঝিনুক খুশি হলো। ইথিকা আংটিটা পেয়ে বলল,

“এটা আমাকে কে দিয়েছে বলোতো?”

“কে?”

ইথিকা আংটিটার দিকে তাকিয়ে হেসে বলল,”কাবির দেওয়ান। তাই হারিয়ে যাওয়ার পর মনে হয়েছে ব্যাপার না। কিন্তু এখন ভাবছি এটাকে কোথায় রাখব।”

ঝিনুক ইথিকার পাশাপাশি হাঁটতে হাঁটতে বলল,

“কাল না আপনার বিয়ে?”

ইথিকা হাসলো।

“এনগেজমেন্ট। ঘরোয়া অনুষ্ঠান হবে।”

তারপর দেওয়ান বাড়ির দিকে তাকিয়ে বলল,

“আজ বাড়িতে এত মেহমান কেন?”

ঝিনুক অবাক হয়ে বলল,”এ কি আপনি জানেন না?”

অবশ্য জানার কথাও নয়। কারণ বিয়ের বন্দোবস্ত এমনভাবে করা হয়েছে যাতে খানরা টেরও না পায়। কাওসার দেওয়ান কোনো হৈ-হুল্লোড় চাননি বিয়েতে। কল্পর বিয়েটাও ওভাবেই দিয়ে দেবেন উনারা।

ইথিকা কপাল কুঁচকে বলল,

“কি জানিনা?”

ঝিনুক একনিঃশ্বাসে বলল,”আজ বড় সাহেবের বিয়ে। ছোট খালাম্মার বাপের বাড়ি থেকে বউ আনছে। কত্ত মিষ্টি মেয়ে। আপনি জানেন না কিছু?”

ইথিকা তার কথা শুনতে শুনতে পেছনে চোখ ঘুরিয়ে দেখলো একটা সিএনজি। কিছু বুঝে উঠার আগেই সিএনজিতে বসা দুটো মুখোশ পরা কিছু একটা ছুঁড়ে দিল তাদের দিকে। ছুঁড়ে দেয়ামাত্রই শাঁ করে চলে গেল সিএনজিটা। ইথিকা সাথে সাথে চিৎকার দিয়ে উঠলো। হাত দিয়ে মুখ চেপে ধরে সে মাটিতে লুটিয়ে পড়লো। গড়াগড়ি খাচ্ছে, কাঁপছে, ছটফট করছে। মুখটা পুড়ছে। এসিডে দগ্ধ হচ্ছে পুরো মুখ। ঝিনুকও রাস্তার ধারে পড়ে গেল, গড়াতে গড়াতে কাঁদতে লাগলো প্রাণভয়ে, অসহ্য যন্ত্রণায়। মৃত্যু আর কত কাছে?

চারপাশ থমকে গেল।

তাদের আর্তনাদে কেঁপে উঠলো চারদিক। বাতাস থমকে দাঁড়াল। দেওয়ান বাড়ির আশেপাশে যারা ছিল সবাই ছুটে এল। কাসেদ এসে ঝিনুককে দেখে থমকে গেল! কিছুটা দূরে ছটফট করতে করতে থেমে যাচ্ছে আনঝিল খানম।

কেউ কিছু বোঝার আগেই নেমে এল ভয়াবহ নিস্তব্ধতা। এই দৃশ্য মৃত্যুর থেকেও নির্মম।

তার কিছুটা পর বিয়েবাড়ির গাড়িগুলো নতুন বউ নিয়ে হাজির হলো দেওয়ান বাড়ির সামনে। চারপাশে লোকজনের ছোটাছুটি। গাড়িতে বসে কাবির জানালার বাইরে তাকিয়ে আছে। কি হয়েছে কেউ কিছু বলছে না। শুধু আল্লাহ আল্লাহ করছে। লোকজনের জন্য গাড়ি থেমে গেছে। কাবির ভীড়ের দিকে চেয়ে রইলো। তার পাশে বসে আছে ঘোমটা পরা নববধূ।

কামরান দেওয়ান স্তব্ধ হয়ে বসে আছেন নতুন বউয়ের সাথে কথা বলার পর থেকে। বিয়ে পরানো হয়ে গেলেও তিনি কাউকে সত্যিটা বলেননি। মেয়েটা হুবহু অন্তুর মতো করে হাসতে হাসতে নির্লজ্জের মতো কথা বলে! নইলে নতুন বউ তার জেঠশ্বশুরকে কখনো বলে?

“আপনি এখনো অনেক হ্যানসাম আছেন জেঠুমণি। আরেকটা বিয়ে করতে পারবেন।”

১ম পরিচ্ছেদ….
অর্ধসমাপ্ত…

আমি মন্দ রিভিউর অপেক্ষায়…