#তৃষিত_তরঙ্গ —১২
#প্রানেশা_আহসান_শীতল
“ সাবরিহা? ওও সাবরিহা?”
“ উমম।”— ঘুম জড়ানো গলায় জবাব এলো। মুসাওয়াদ তাকিয়ে আছে। সাবরিহার কোনো নড়চড় পরিলক্ষিত না হওয়ায় চাদর ধরতেই সাবরিহা নড়েচড়ে চাদর টেনে নিজেকে আবারো আবৃত করে নিয়ে নিজের মুখ ঢেকে ঘুমানোর চেষ্টা করে। তা দেখে প্রশ্রয় হাসলো মুসাওয়াদ তারপর ধীরে আবারো ডাকে,
“ ওও সাবরিহা? উঠুন, শাওয়ার নিতে হবে। সারাদিনে তো কিছু খানও নি। পরে অসুস্থ হয়ে যাবেন।”
“ হুম!” — আবারো একই ভাবে জবাব এল। হতাশ শ্বাস ফেলল মুসাওয়াদ তারপর ধীরে সাবরিহাকে কোলে তুলে নিল। তা মুহুর্তেই টের পেয়ে বিস্ফোরিত চোখে তাকায় সাবরিহা। তারপর হতবক গলায় বলে,
“ এই কি করছেন। নামান আমাকে!”
মুসাওয়াদ ওয়াশরুমের দিকে যেতে যেতে বলে,
“ হাটতে পারবেন আপনি? সে অবস্থায় আছেন?”
লজ্জায় মুখ রক্তাভ হল মেয়েটার। মুসাওয়াদ আর কিছু বলল না। ধীরে সাবরিহাকে এনে বাথটবে রেখে পানি ছেড়ে দিয়ে নিজেও বিপরীত পাশ থেকে সাবরিহার পাশে এলো। সাবরিহার ঘুম এখনো কাটে নি। মুসাওয়াদ সাবরিহার গালে হাত রাখে। সাবরিহাও নিজেও আদুরে ছানার মতো নিজের গালটা আরেকটু মুসাওয়াদের হাতের আদলে রেখে চোখ বন্ধ করে নেয়। মুসাওয়াদ দেখলো তারপর হেসে ধীরে সাবরিহাকে টেনে এনে নিজের সাথে মিশিয়ে নিয়ে,সাবরিহার পিঠ ঠেকে মুসাওয়াদের পুরুষালী বক্ষে,সাবরিহা হেলান দিয়ে কিছু একটা বলছিলো, মুসাওয়াদ সেদিকে পাত্তা না দিয়ে কাঁধের কাছে নাক ঘষে৷ সাবরিহা বিড়বিড় করে বলে,
“ প্লিজ, নো মোর; লেফটেন্যান্ট।”
মুসাওয়াদ শুনলো তবে তেমন কোনো প্রতিক্রিয়া না দিয়ে কাঁধে গভীর চুমু খায়, সে জানে সাবরিহা এখন স্টেবল না এখন তাকে বিরক্ত করে লাভ নেই। তাই কানের কাছে ফিসফিস করে বলে,
“ দ্যাট স্মেল, ইট’স নট জাস্ট পারফিউম, ইট’স এ্য প্রমিজ। লাইক স্মেল লাইক ইউ ওয়ার মেড ফর মি।”
সাবরিহা পিলপিলে চোখে তাকালো। মুসাওয়াদ তার কথার সাথে নজর সাবরিহার দিকেই রেখেছিলো সাবরিহা ঘাড় ঘুরিয়ে কেমন দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তাই সাবরিহাকে পুরোপুরি নিজের সাথে জাপ্টে ধরে নিজের পুরো শরীরের ভার পানিতে ছেড়ে দিয়ে এক প্রকার বড় বাথটব-টায় ঢুব দিল। সেখান থেকে মাথা তুলতেই সাবরিহা লম্বা শ্বাস টানল। হুট করে এমন করায় ভরকে গেছিল মেয়েটা। মুসাওয়াদ এখনো একই দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তারপর বলে,
“ এবার আমার একটুও ফিরে যেতে ইচ্ছে করছে না মিসেস…!”
সাবরিহা হেসে ফেলে তারপর বলে,
“ নিজেকে সামলান জনাব, এমন হলে মিশনে থাকবেন কি করে?”
“ মনে পড়লেই চলে আসবো।”
খিলখিল শব্দে হেসে ফেলে সাবরিহা তারপর বলে,
“ উদ্ভট কথা। মিশনে কোন দেশে যাবেন, কবে ফিরবেন, তা ওখানে না গেলে জানবেন কি করে? আর যুদ্ধের মাঝ পথে কে ছেড়ে আসে?”
জবাব করলো না মুসাওয়াদ। সাবরিহা কিছুসময় তাকিয়ে থেকে পরপর হাঁচি দিতেই মুসাওয়াদ গভীর চোখে মেয়েটার মুখ পর্যবেক্ষণ করে। অনেকটা সময়ই হয়েছে পানিতে তাই মুখের কিছু জিনিস পরিবর্তন লক্ষণীয়। তাই মুসাওয়াদ কপাল কুঁচকায় আর গালে হাত স্লাইড করতে করতে গম্ভীর কণ্ঠে বলে—
“ আপনার অ্যালার্জি?”
“ হু!” — নিজেকে যতটা সম্ভব হচ্ছিলো লুকিয়েছে সাবরিহা তবে অ্যালার্জির যেন সাবরিহার সুখ সহ্য হচ্ছিলো না। মুসাওয়াদ আর কিছু বললো না। হাত বাড়িয়ে গরম উষ্ণ পানির ট্যাপ টা ছেড়ে দিতেই পানিটা উষ্ণ হয়ে উঠল। পানি সহনশীল উষ্ণ অনুভব হতেই পনির ট্যাপ বন্ধ করে সাবরিহাকে ছেড়ে বাথটব থেকে উঠে আসে। সাবরিহা অবাক চোখে তাকাতেই মুসাওয়াদ গম্ভীর কণ্ঠে বলে,
“ অনলি টেন মিনিট’স মিসেস কায়ান। দ্রুত শাওয়ার নিয়ে উঠে আসবেন।”
কথাটা বলে নিজেই ওয়াশরুমের ঝর্ণার নিচে দাঁড়ায়। আকর্ষণীয় পেশিবহুল ফুলেফেঁপে থাকা শরীর বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়ছে তা দেখে সাবরিহা ঢোক গিলল। কে বলেছে একটা মানুষকে এতোটা আকর্ষণীয় হতে হবে? কে বলেছে একটা লোককে দেখলে পুরো দুনিয়া থামকাতে হবে। কিন্তু সাবরিহায় থমকায়। এই যে এখন থমকেছে। আর ভাবতে পারলো না সাবরিহা, সারা শরীরের ভর ছেড়ে দিয়ে অনেকটা সময় ঢুব দিয়ে রইলো তারপর ধীরে সেখান থেকে উঠে বডিওয়াশ নিয়ে তা শরীরে দিতেই সারা শরীরে জ্বলন অনুভব হলো। শ্বাস ভারী হলো সাবরিহার, সে জানে এই জ্বলুনি কিসের। তবুও ঠোঁটে ঠোঁট চেপে ধীরে বড়িওয়াশ মেখে পাশ থেকে কল ছেড়ে দিতেই আবারো পানি বদল ঘটল। সাবরিহা অনেকটা সময় আশপাশ খেয়াল না করেই পানিতে ছিলো, কি মনে করে পাশ ফিরতেই মুসাওয়াদের দেখা মিললো। ধক করে উঠলো মেয়েটা। মুসাওয়াদ বুকের কাছে হাত ভাজ করে সাবরিহার দিকে গম্ভীর তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। ভীষণ শান্ত তার মুখ, তবে অর্ধ উন্মুক্ত ও একটা সাফেদ টাওয়াল প্যাঁচানো মুসাওয়াদকে আকর্ষণী লাগছে। ঢোক গিললো সাবরিহা, হাতের বাইসেপ্স, গলার ও বক্ষের কাছের রগ, গলায় উঁচু অ্যাডাম এ্যাপেল, কপালের রগ ফুলে ফেঁপে আছে সাথে চোখ আটকালো মুসাওয়াদের কাঁধের, নিজেকে দমাতে ওখানে পর পর বেশ কয়েকটা কামড় পড়েছিলো৷ জায়গাটা এখন যাচ্ছে তাই হয়ে আছে। লজ্জায় চোখ সরিয়ে নিলো তা দেখে মুসাওয়াদ ধীরে বলে,
“ আপনি উঠবেন না আমি উঠাবো?”
“ উঠছি!”
সাবরিহার কথা কথা শুনে মুসাওয়াদ নিজের হাত এগিয়ে দেয় তারপর বলে,
“ গিভ মি ইয়োর হ্যান্ড।”
সাবরিহা তাকালো মুসাওয়াদের দিকে তারপর ধীরে নিজের হাত মুসাওয়াদের হাতের মাঝে দিয়ে জিজ্ঞেস করে—
“ টাওয়াল?”
সাবরিহার দিকে চোখ বুলায় তারপর অন্যদিকে থাকা সাফেদ টাওয়াল টা সাবরিহার দিকে এগিয়ে দিতেই সারিহা তা নিজের হাতে তুলে নেয়। তারপর বাথটব থেকে নেমে বলে,
“ আপনি একটু বাহিরে যান। আমি একটু পর ডাকছি!”
কপাল কুঁচকায় মুসাওয়াদের তারপর গম্ভীর কণ্ঠে জানতে চায়,
“ কেনো?”
“ চেইঞ্জ করবো?”
“ হু-হু?”
“ কিছু না। দাঁড়ান।”
ফ্রেশ হয়ে টাওয়াল পেঁচিয়ে আয়নায় তাকাতেই মুসাওয়াদ সাবরিহার পিছনে দাঁড়ায়। তারপর তার লম্বা ভেজা চুল গুলো দেখল। চুল থেকে টপটপ করে পানি পড়ছে। মেয়েটার ঠান্ডার সমস্যা তাই আর কিছু না ভেবে, ওয়াশরুমের বড় আয়নার সাথে এটাচ গ্লাসের বড় কাবার্ড টাইপ ড্রয়ারের থেকে একটা হেয়ার ড্রায়ার বের করে। ততক্ষণে সাবরিহা হাতে লোশন ঘষছিল। মুসাওয়াদ কোনো কথা না বলেই তার চুল শুকানোর জন্য চিরুনি ও হেয়ার ড্রায়ার দিয়ে সুন্দর মতো আঁচড়ে দিচ্ছে। সাবরিহার কেনো যেনো এমন কেয়ারিং দিক গুলো ভালো লাগছে সাথে মনে মনে একটু মন খারাপও হচ্ছে মুসাওয়াদ চলে যাবে এটা ভেবে। তাই কিছু না বলে তৃষিত ব্যাক্তির ন্যায় সে মুসাওয়াদকে দেখছে। মুসাওয়াদ নিজের কাজ শেষ করে বলে,
“ ডান ম্যাডাম।”
সাথে সাথেই ভাবনা ভঙ্গুর হয় সাবরিহার। চোখে হাসলো মেয়েটা। মুসাওয়াদ দেখলো তারপর সব ঘুছিয়ে রেখে সাবরিহাকে আবারো কোলে তুলে নেয়। সাবরিহা এবার প্রতিক্রিয়া করে নি। মুসাওয়াদ খুব যত্নে সাবরিহাকে বিছানায় বসিয়ে কাবার্ডের থেকে একটা লাল শাড়ি বের করে আনে। তারপর এগিয়ে এসে সাবরিহার দিকে তা এগিয়ে দিতেই সাবরিহা মিষ্টি করে হেসে বলে,
“ শুনুন না?”
“ বলুন ম্যাডাম… আপনার কি উপকার করতে পারি?”
কথা বলার ভঙ্গি দেখে হেসে ফেলে সাবরিহা তারপর বলে,
“ আমার লাগেজে নেইলপালিশ আছে, নেইল পেইন্ট করে দেবেন?”
অবাক হয়ে যায় মুসাওয়াদ সাথে অবিশ্বাস্য গলায় শুধায়—–
“ আমি?”
“ হ্যাঁ!”
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে,
“ আচ্ছা বসুন।”
মুসাওয়াদ লাগেজ থেকে বড় একটা কসমেটিকসের ব্যাগ বের করে ছয়টা নেইলপালিশ পায়। সাবরিহা দেখে বলে,
“ পুরোটাই নিয়ে আসুন!”
মুসাওয়াদ আর তেমন কিছু বলে নি। উল্টো নিয়ে এসে সাবরিহার পাশ বসতেই সাবরিহা নিজের হাত তুলে দেয়। মুসাওয়াদ অনেকটা সময় আঙ্গুল গুলোর দিকে তাকিয়ে থেকে একটা এ্যাশ রংয়ের নেইলপালিশ তুলে নিয়ে তা কাঁপা হাতে আঙ্গুলের নখে ছোঁয়ায়। সাবরিহা অনেক উৎসাহ নিয়ে তাকিয়ে আছে। মুসাওয়াদ ভীষণ ধৈর্য নিয়ে নিয়ে তা দিয়ে দিতেই সাবরিহা বিশ্বজয়ের হাসি দিতে আলতো ভাবে এগিয়ে এসে মুসাওয়াদের ওষ্ঠে চুমু খায় তারপর সরে এসে নিজের আঙ্গুলে ফু দিয়ে শুঁকাতে চায়। মুসাওয়াদ নিজের বউয়ের বাচ্চামি দেখে হেসে ফেলে তারপর উঠে এসে কাবার্ড থেকে একটা সাদা শার্ট বের করে পড়ে নেয়। সাবরিহা অবাক চোখে মুসাওয়াদের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে—
“ রেডি হচ্ছেন?”
“ হ্যাঁ। একটু পরই হয়তো গাড়ি আসবে ক্যান্টনমেন্ট থেকে।”
“ আপনি গাড়ি নেবেন না?”
“ উহু; মিশনে গেলে আমরা বেশিরভাগ সময় দেশে থাকি না তাই শুধু শুধু গাড়ি নিয়ে কি করবো।”
“ ওহ!” — মাথা নাড়ালো সাবরিহা। ততক্ষণে তার রেডি হওয়া শেষ হয়েছে। মুসাওয়াদ আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুল ঠিক করতে করতে সাবরিহার দিকে তাকিয়ে বলে,
“ শুঁকায় নি?”
সাবরিহা নিজের হাতের দিকে তাকালো। শুকিয়ে গেছে তবে মুসাওয়াদকে এখন মিথ্যা বলে দেরি করাতে ইচ্ছে হলো তাই বলে,
“ উহু!”
মুসাওয়াদ ঘুরে তাকালো।তারপর বলে,
“ এখনো? আমার দেরী হচ্ছে তরঙ্গ। স্যেল আই হেল্প ইউ ওয়ার দ্য শাড়ি?”
“ না- না। আমি পারবো।”
ভরকানো গলায় জবাব দিতেই, চোখ ছোট ছোট করে তাকাল মুসাওয়াদ, সাবরিহা যে মিথ্যা বলছিল তা সে বুঝেছিল তাই আর কিছু না বলে শুধু বলে,
” তাহলে ফাস্ট করুন। সকাল থেকে কিছু খান নি। সে খেয়াল আছে?”
“ আপনিও কিছু খান নি।”
“ আমার ব্যাপার আলাদা সাবরিহা।”
জবাব দিলো না সাবরিহা। হাত খোঁপা করে শাড়ি তুলে নিয়ে বলে,
“ আপনি একটু ওইদিকে তাকান।”
“ সাবরিহা?”
“ আচ্ছা, আচ্ছা। একটুই তো।”
“ ও-কে!”— বিরক্ত শ্বাস ফেলে ঘুরে তাকায় মুসাওয়াদ। সাবরিহা একটা শ্বাস ফেলে শাড়ি পড়ায় মনোযোগ দেয়। কিছুক্ষণ পর বলে,
“ শেষ। “
“ আমিও!” — কথাটা বলেই মুসাওয়াদ নিজের ভ্রু চুলকে আলতো হাসল। সাবরিহা কথার অর্থ না বুঝে তাকাতেই তার চোখ যায় আয়নায়৷ আয়নায় তাকে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে সাথে সামনে মুসাওয়াদকেও। তাহলে মুসাওয়াদ সাবরিহাকে এতোটা সময় আয়নায় সম্পূর্ণ দেখেছে? লজ্জায় এবার মাটিতে মিশে যেতে ইচ্ছে হচ্ছে। মুসাওয়াদ ঘুরে তাকিয়ে সাবরিহার মুখ দেখে ব্যঙ্গ করে বলে,
“ আপনাকে দেখে আমি আসলেই শেষ, এখন যদি বলি আর—!”
কথাটা সম্পূর্ণ করতে পারেনি মুসাওয়াদ। সাবরিহা হাত দিয়ে কান চেপে ধরে উচ্চ গলায় বলে,
“ আল্লাহর ওয়াস্তে একটু চুপ করুন নির্লজ্জ লোক। আপনি এমন করলে মিশনে যেয়ে থাকবেন কি করে?”
“ তারজন্যই যেতে ইচ্ছে করছে না লিটল ওয়েভ!”
—–
চলবে… 😵💫