#ধারাবাহিক গল্প
#উপসংহার
পর্ব-দুই
মাহবুবা বিথী
সময়টা ২০০০ সাল। আমাদের বাড়িটা ছিলো একদম বর্ডারের কাছাকাছি হিলি বন্দরের কাছে। চৌচালা টিনের ঘর। দুটোরুম আর লাগোয়া বারান্দা ছিলো। উঠোন পেরিয়ে রান্না ঘরে যেতে হয়। বাথরুমটা বেশ দূরে ছিলো। তবে বৃষ্টি হলে টিনের চালের ফুটো দিয়ে পানি গড়িয়ে পরতো। একরুমে আমি আর বুবু থাকতাম আর একরুমে আমার বাবা মা থাকতেন। সেই দিনগুলো খুব সুন্দর ছিলো।শীতকালে আমি আর বুবু খুব ভোরে উঠতাম। ফজরের আযানের সময় ঘুম ভেঙ্গে যেতো। এরপর পা টিপে টিপে ঘর থেকে বের হয়ে বরই গাছের তলায় গিয়ে বড়ই কুড়াতাম। এতো ভোরে গাছতলায় না আসলে বরই পাওয়া যেতো না। গ্রামের সব ছেলে মেয়েরা এসে বরই নিয়ে যেতো। এরপর বাড়িতে ঢুকেই আমাদের দু’জনের ঘরটায় বরইগুলো লুকিয়ে রেখে কাথামুড়ি দিয়ে আবার শুয়ে পড়তাম।আম্মা দেখতে পেলে খুব রেগে যেতেন। কেননা আম্মার কথা হচ্ছে এতো ভোরে গাছের তলায় জ্বীনরা থাকে।আমার বুবু অবশ্য আমার থেকেও আরো বেশী সুন্দরী ছিলো। গ্রামে সেসময় একটা কথার বেশ প্রচলন ছিলো। সুন্দরী মেয়েদের ঘাড়ে নাকি জ্বীন সওয়ার হয়। আম্মা ফজরের আযানের সময় উঠে ওজু করে নামাজ পড়ে নিয়ে আমাদের পুরো উঠোন ঝাড়ু দিতেন। এরপর মুরগীর ডোব খুলে হাসমুরগী গুলোকে খাবার দিয়ে চুলো ধরিয়ে চায়ের পানি বসিয়ে দিতেন। আব্বাও ঘুম থেকে উঠে নামাজ পড়ে গরু ছাগল বের করে বাইরে বেঁধে রাখতো। চা হয়ে গেলে আম্মা আমাদের সবাইকে ডাকতেন। আমরা রান্নাঘরে চুলোর পাশে গোল হয়ে বসে গরম গরম চা আর মুড়ি জলপান খেতাম। বুবু তখন দশম ক্লাসে পড়তো। আমি ক্লাস সেভেনে পড়তাম। আমাদের স্কুল দুপুর বারোটায় শুরু হতো। আর বিকাল চারটায় ছুটি হতো। চা নাস্তা করেই দু’জনে গোসল করে স্কুলে যাওয়ার প্রস্তুতি নিতাম। আমি আর বুবু একসাথেই হেঁটে স্কুলের পথে রওয়ানা হতাম।বুবু আর আমি বাসা থেকে কিছুদূর যাওয়ার পর এলাকার কিছু ছেলে বুবুর পিছু পিছু স্কুল পর্যন্ত আসতো। আবার ছুটির সময় আমাদের পিছু পিছু বাড়ীর কাছাকাছি যেতো তবে আম্মাকে ওরা খুব ভয় পেতো। আমার আম্মা অন্য রকম মানুষ ছিলেন। তার চোখের দিকে বেশীক্ষণ তাকিয়ে থাকা যেতো না। মনে হতো উনি উনার চক্ষু দিয়ে গিলে খাবেন। আমাদেরকে কড়া শাসনে বড় করেছেন। আমাদের দুবোনকে বলতেন আমরা যেন সোজা স্কুলে যাই আর ছুটির পর ঠিকসময় বাড়িতে চলে আসি। এর অন্যথা হলে আমাদের স্কুলে যাওয়া বন্ধ করে দিবেন। কিন্তু বুবু খুব দুষ্ট ছিলো। যতই আম্মার আদেশ থাকুুক স্কুলে আসা যাওয়ার পথে মানুষের গাছের ফল গুলো আর গাছে থাকতো না। বুবুর পেটের ভিতর চলে যেতো। আম্মুর শাসন যতো কঠিনই হোক বুবুর কাজ বুবু করে যেতো। তবে তার শাসনটা পরবর্তীতে বজ্রআঁটুনি ফসকা গিঁড়োর মতো হয়ে গেল। সে কথায় পরে আসছি। প্রতিদিন আমরা স্কুল থেকে না ফেরা অবদি আমাদের বাড়ীর সামনের রাস্তাটায় আম্মা পায়চারী করতেন।আব্বা হয়তো তখন হাটে গিয়েছে। এজন্য ছেলেগুলো বেশ দূর থেকেই চলে যেতো। কারণ ওরা জানে আম্মার কাছে ধরা পড়লে নিস্তার নেই। কান ধরে আম্মা ওদেরকে ওদের বাবা মায়ের কাছে নিয়ে যাবে। আমি মাঝে মাঝে ভাবতাম এই ছেলেগুলোর কি ক্লান্ত লাগে না, প্রতিদিন বুবুর পিছু পিছু হাঁটতে? বুবুকে একদিন জিজ্ঞাসা করেছিলাম,
—-ওরা যে তোমার পিছু পিছু আসে, তোমার অস্বস্তি লাগে না?
বুবু বেশ সুন্দর একটা হাসি দিয়ে বলে,
—-না,অস্বস্তি লাগে না। বরং ভালোই লাগে। সুন্দরী মেয়েদের পিছনে ছেলেরা ঘুরঘুর করবে এটাই তো স্বাভাবিক।
—-আম্মা যদি দেখে ফেলে তোমার কি অবস্থা হবে বুঝতে পারছো?
—-কেন এখানে আমার কি দোষ? আমি কি ওদেরকে আমার পিছনে আসতে বলেছি? নাকি ওদেরকে আমার বডিগার্ড হওয়ার জন্য নিয়োগ দিয়েছি?
তবে আমি ঠিকই বুঝতে পারতাম। বুবু এই বিষয়টা খুব এনজয় করতো। আড়চোখে ঐ ছেলেগুলোর দিকে তাকিয়ে মিষ্টি করে হাসতো। ছেলেগুলো বুবুরদিকে অপলক তাকিয়ে থাকতো। বুবু সুন্দরী হওয়ার কারনে তখনি আমাদের বাসায় ঘটক আসা যাওয়া করতো। কিন্তু আম্মুর ঐ এক কথা। উনি উনার মেয়েদের অনেকদূর লেখা পড়া করাবেন। এখন বিয়ে দেওয়ার প্রশ্নই আসে না। এর মাঝে বুবুর এসএসসি পরীক্ষা শেষ হলো। বুবু এখন কলেজে ভর্তি হবে। আমাদের বাসা থেকে কলেজটা বেশ দূর। আব্বা বুবুর জন্য একটা রিকশা কিনলেন। ঐ রিকশা ওয়ালা বুবুকে সকালে নিয়ে যায় আর বিকালে নিয়ে আসে। মাঝের সময় টুকুতে উনি রিকশা ভাড়ায় চালাতেন। তবে আমার খুব চিন্তা হতে লাগলো। কলেজ দূরে হওয়াতে বুবু আবার কোনো বাজে ছেলের পাল্লায় পড়ে কিনা কে জানে? সে জন্য আগ বাড়িয়ে বুবুকে জ্ঞান দিতে গেলাম।
—-বুবু তোমার পিছনে ছেলেরা যেভাবে ঘুরঘুর করে নিজেকে ঠিকঠাকভাবে সামলে রেখো। দেখো আবার কোনো বাজে ছেলের পাল্লায় পড়ো না।
বুবু ক্ষিপ্ত হয়ে আমার দুগালে কষে থাপ্পর লাগিয়ে আম্মাকে গিয়ে বললো,
—–আম্মা, জবাকে একটু শাসন করবেন। ও আমার সাথে বেয়াদবি করেছে।
আমি কাঁদতে লাগলাম। আম্মা আমার কাছে এসে জানতে চাইলো কি হয়েছে?
আমি বলতে গিয়েও থেমে গেলাম। কারণ আমি যদি বলি বুবুর পিছনে ছেলেরা ঘুরঘুর করে। সাথে সাথে আম্মু বুবুর লেখাপড়া বন্ধ করে দিবে। তাই কথাটা গলাটা পর্যন্ত আসা মাত্রই ঢোক গিলে আবার পেটের ভিতর ঢুকিয়ে নিলাম। তবে আমার মায়ের নিয়ম তো আলাদা। সে কারনে বুবুকে একদিন নিজের ঘরে ডেকে নিয়ে গেলেন। আমাকেও ডেকে নিলেন। খাটের উপর আম্মু আসন গেড়ে বসলেন।আমি আর বুবু আম্মার সামনে কয়েদীর মতো দাঁড়িয়ে আছি। এরপর বুবুরদিকে কঠিন চোখে তাকিয়ে বললেন,
—-তুমি কলেজে পড়তে চাও?
—-জ্বী আম্মা,
—-তাহলে আমার কথা মন দিয়ে শোনো। তোমাকে আপাদমস্তক ঢেকে কলেজে যেতে হবে।
বুবু অবাক হয়ে বললো,
—-আম্মা আমি আপনার কথা কিছুই বুঝলাম না।
—-তোমাকে বোরকা পড়ে নেকাবে মুখ ঢেকে কলেজে যেতে হবে। এভাবে যেতে রাজী হলে পড়াব নচেৎ বিয়ে দিয়ে দিবো। ঘটকরা বড্ড জ্বালাতন করছে।
আমি বুবুর দিকে তাকিয়ে দেখি ভাসা ভাসা চোখদুটো পানিতে ভিজতে লাগলো। আম্মা রেগে গিয়ে বললেন,
—-আমি কাঁদার মতো কিছু বলিনি। তুমি কি সিদ্ধান্ত নিলে আমাকে জানিও। তোমার সিদ্ধান্তের উপর নির্ভর করবে পড়াশোনা হবে কি হবে না।
একথা বলে আম্মু রুম থেকে বের হয়ে গেলেন। আমি বুবুকে বললাম,
—-তুমি বোরকা পড়তে রাজী হয়ে যাও। তা,না হলে আম্মা তোমার লেখাপড়া বন্ধ করে দিবেন।
বুবু রেগে গিয়ে বললো,
—-আবার জ্ঞান দিতে আসছিস?
আমি আর কিছু বললাম না। অগত্যা বুবু বোরকা পড়তে রাজী হয়ে গেল। আম্মা বুবুকে সরকারী মহিলা কলেজে ভর্তি করে দিলেন।
আমার আব্বা খুব শান্তিপ্রিয় মানুষ ছিলেন। সংসারের কোনো জটিলতার মাঝে আব্বা থাকতেন না। আর আমাদের দুবোনকে প্রচন্ড ভালোবাসতেন। স্কুল থেকে ফেরার পর আব্বা বাসায় আমাদের ভাত খাইয়ে দিতেন। এতে অবশ্য আম্মা খুব রেগে গিয়ে বলতো,
—-মেয়েদের লাই দিয়ে মাথায় তুলো না। পরের বাড়িতে সেই হাড়ি ঠেলে ভাত খেতে হবে।
আম্মার এসব কথা আব্বার মাথার উপর দিয়ে চলে যেতো।
সেদিন মুষলধারে বৃষ্টি হয়েছিলো। বুবু টিনের ছিদ্র বরাবর প্লাস্টিকের গামলা দিয়ে দিলো। যাতে পানি ওখানটায় গিয়ে পড়ে। আমি জেগে থেকে বুবুর কাজ দেখছিলাম। বুবু একসময় আমার দিকে তাকিয়ে বলে,
—-জবা, তুই ঘুমিয়ে পড়।
বৃষ্টির শব্দে আমার দুচোখে ঘুম আসছিলো না। টিনের চালে বৃষ্টির শব্দ শুনতে আমার বেশ ভালো লাগে। সে কারনে বুবুকে বললাম,
—-আমি জেগে থেকে তোমার কাজে উৎসাহ দেই।
—-আমাকে আর উৎসাহ দিতে হবে না। নিজের চরকায় তেল দিয়ে ঘুমিয়ে পড়।
আমি ঘুমের ভাণ করে বিছানায় শুয়ে থাকলাম।বৃষ্টিটা একসময় থেমে গেল। বুবু পা টিপে টিপে বিছানা থেকে নামলো।
চলবে