#ধারাবাহিক গল্প
#উপসংহার
পর্ব-চার
মাহবুবা বিথী
অবশেষে আমার বিয়ে ঠিক হয়ে গেল। আম্মাকে অনেক বোঝানোর চেষ্টা করলাম। আসলে আমি লেখাপড়া করতে চেয়েছিলাম। অন্তত এইচএসসি পাশ করলেও হতো। কিন্তু আম্মার এক কথা
—–তোমার বোন বংশের মুখে চুনকালি মাখিয়েছে। তুমি আবার কি করে বসো তার কোনো ঠিক ঠিকানা নাই। আমি আর কোনো রিস্কের মধ্যে থাকতে চাই না। এমনিতেই তোমার বাবার অসুস্থতা নিয়ে হিমশিম খাচ্ছি। তুমি আর এখন কোনো ঝামেলা বাঁধিয়ো না। ভালোই ভালোই বিয়েটা হয়ে যেতে দাও। তোমার বোন যে কাহিনী করেছে তাতে তোমার জন্য ভালো কোনো প্রস্তাব আসবে বলে মনে হয় না। যারফলে বাবা মায়ের কাছে মুশফিক হীরার টুকরা ছেলে। আর হবে নাই বা কেন। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজী সাহিত্যে অনার্স ফাইনাল ইয়ারে পড়ছে। আমি অবশ্য একটু অবাক হয়েছিলাম। মুশফিক কেন আমাকে বিয়ে করতে রাজী হয়েছে? সে সময় আমার মনে হয়েছে, মফস্বল শহরে বেড়ে উঠা এই আমি কখনও ওর সাথে তাল মিলিয়ে চলতে পারবো না। এটা তো মুশফিক জানতো। তাছাড়া ওর নিজের পছন্দের কেউ নাই সেটাও বিশ্বাস করতে মন চাইতো না। আমার বিয়ের বিষয়টা সব মিলিয়ে কেমন গোলমেলে লেগেছিলো। লাগলে কি হবে? আম্মা তো ঐ মুহুর্তে আমার কথার পাত্তা দেননি।
অগত্যা বিয়ের দিন চলে এলো। মুশফিক আর ওর আম্মু মিলে দশ জনের মতো বরযাত্রী এসেছে। ওদেরকে এখানকার একটা স্থানীয় হোটেলে রাখা হয়েছে। আমাদের বাসায় এতোজনের ব্যবস্থা করা সম্ভব হবে না। ওরা ঢাকা থেকে আমার জন্য শপিং করে এনেছে। ওদের ড্রাইভার এসে দিয়ে গিয়েছে। বেনারশী শাড়ি তার সাথে ম্যাচ করে গোল্ডেন কালারের ওড়না, ব্লাউজ পেটিকোর্ট,অর্ন্তবাস,জুতো স্যান্ডেল কোনোকিছু বাদ যায়নি। ড্রাইভারের হাত দিয়ে বিয়ের শাড়ি পাঠিয়ে দেওয়াটা আমার কাছে শোভন লাগেনি। কিন্তু আম্মাকে দেখলাম মুখে কুলুপ এঁটে থাকতে। শাশুড়ী বিয়ের গয়নাটা দেননি। ওটা আগামীকাল বিয়ে পড়ানোর পর আমার পরিয়ে দিবেন। ড্রাইভার আম্মার কাছে সেরকমটাই বলেছে। তবে বিয়ের বেনারশীটা খুব দামী মনে হলো। কেন যেন এতো দামী শাড়ীটা আমাকে টানলো না। অথচ প্রতিটি মেয়ে তার বৌ সাজবার বেনারশী শাড়ি থেকে শুরু করে সব বিষয়ে প্রচন্ড খুঁতখুঁত করতে থাকে। তারা নিজে পছন্দ করে শপিং করে। অথচ আমি কোনো আগ্রহ বোধ করছি না। হয়তো এই মুহুর্তে আমি কারো বৌ হবার মতো মানসিক অবস্থানে নেই। বড় শখ ছিলো নিজের শখের পুরুষটাকে নিজে পছন্দ করে বরণ করবো। তা আর আমার ভাগ্যে হলো না। বুবুর ভুলে আমার জীবন চিত্রটাও পাল্টে গেল। সারা রাত আমার দুচোখে ঘুম এলো না। ভাবছি বাবা মা কি করে পারলো আমাকে এতো দূরে বিয়ে দিতে? তাদের ছেড়ে যেতে আমার প্রচন্ড কষ্ট হচ্ছে। তাদের হচ্ছে না?
রাত পেরিয়ে আমার বিয়ের ঘন্টা বেজে উঠলো। আম্মা এলাকার জহির চাচাকে ডেকে এনেছেন। উনি ভালো রাঁধতে পারেন। আমাদের এলাকায় কারো বিয়ে, মুশলমানী আকীকা কিংবা মৃত বাড়ির রান্না উনিই করে থাকেন। খুব আন্তরিক। বাজার সদাই থেকে শুরু করে মেহমানদের খাওয়ানো সব উনার লোকজন বেশ সুন্দরভাবে সামলে নেয়। সারা রাত ধরে রান্না হয়েছিলো। পুরো বাড়িতে পোলাও কোর্মা জর্দার সুবাস ছড়িয়ে পড়েছিলো। খুব বেশী মানুষজনকে আম্মা দাওয়াত করেননি। বুবু পালিয়ে যাওয়াতে আত্মীয় স্বজন আমাদেরকে একরকম বয়কট করে চলে। আব্বা আম্মার কিছু বন্ধু বান্ধব শুভাকাঙ্খিরা আমার বিয়েতে অংশ নিয়েছেন। বিয়ে পড়ানোর পর আমার শাশুড়ী মা আমাকে দুহাতে গোলাপ বালা কানে তিনলহরীর ঝুমকো গলায় সীতাহার পায়ে রুপার নুপুর পরিয়ে দিলেন। শাশুড়ী মাকে বেশ অসুস্থ মনে হলো। আমার একমাত্র ননদ সেঁজুতি শাশুড়ী মাকে সামলে রাখছেন। ও নর্থসাউথে বিবিএ পড়ে। ওর ও নাকি বিয়ে ঠিক হয়ে আছে। শুনলাম আমার বিয়ের পর শাশুড়ী মায়ের একটা অপারেশন হবে। শাশুড়ী মায়ের অসুস্থতা সেরে গেলে ওর বিয়ের আয়োজন করা হবে। যাওয়ার সময় চলে এলো। বুবুর কথা মনে পড়ছে। বুকের ভিতরটা ওর জন্য ব্যথায় মোঁচড়াতে লাগলো। আম্মাকে আমার রুমে ডেকে আনলাম। দরজার সিটকিনি লাগিয়ে আম্মার দিকে তাকালাম। আম্মা আমার দিকে নিস্প্রভ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। বুবু চলে যাবার পর আম্মাকে কখনও হাসতে দেখিনি। আম্মার হাতদুটো আমার হাতের মুঠোয় নিয়ে বললাম,
—-আমি তোমাদের সব কথা মেনে বিয়েটা করে ফেললাম। কিন্তু তোমাদের আমার একটা কথা রাখতে হবে।
—-কি কথা?
—আগে কথা দাও আমার আবদারটা তোমরা রাখবে।
কিছুক্ষণ ভেবে আম্মা আমাকে আশ্বাস দিলেন উনি আমার কথা রাখবেন। আম্মা হয়তো ভাবেনি আমি বুবুর বিষয় নিয়ে কথা বলবো। বুঝতে পারলে এতো সহজে আমাকে কথা দিতেন না। আমি আম্মার হাত দুটো ধরে কাঁদতে কাঁদতে বললাম,
—-আম্মা বুবুকে তোমরা মেনে নাও। ওকে আর কষ্ট দিও। একটা ভুল হয়তো ও জীবনে করে ফেলেছে। তাই বলে ওকে এভাবে নিঃশেষ হতে দিও না।
—-এখন এ বিষয়টা নিয়ে আমি কথা বলতে চাইছি না।
—-তুমি কিন্তু আমাকে কথা দিয়েছো। আমার আবদার তুমি রাখবে।
—-তখন তো বুঝিনি তুমি যে তোমার কলঙ্কিনী বোনের জন্য সুপারিশ করবে।
—-যাই হোক কথা যেহেতু তুমি দিয়েছো রাখতে তোমাকে হবে। নয়তো আমি শ্বশুরবাড়ি যাবো না।
আম্মা মনে হয় আমার কথা শুনে বেকায়দায় পড়লেন। অগত্যা আমার প্রস্তাবে রাজী হলেন। বিয়ের সব আনুষ্ঠানিকতা শেষ করে আমিও শ্বশুরবাড়ির পথে পা বাড়ালাম। যাওয়ার সময় আব্বার কাছে বিদায় নিতে গেলাম। স্ট্রোক করাতে আব্বার কথায় জড়তা আছে। তাই মুখে কিছু প্রকাশ না করে আমার দিকে তাকিয়ে অঝোরে কাঁদলেন। আম্মার চোখে অবশ্য কোনো পানি ছিলো না।শুধু আমার মাথায় হাত রেখে বললেন,
—-বাবা মায়ের সম্মান রক্ষা করে চলবে। পরিবারের সবার সাথে মানিয়ে নিবে।
আমি আম্মার কথার অর্থ বুঝলাম না। কারণ আমাকে কেন মানিয়ে নিতে হবে। বরং ওরা আমাকে মানিয়ে নিবে। আমি আমার চেনা জগত ছেড়ে ও বাড়িতে চলে যাচ্ছি। শাশুড়ী আর ননদ স্বাভাবিক থাকলেও মুশফিক একটু বিরক্ত হয়েছিলো। ও আমার ননদ সেঁজুতিকে তাড়া দিতে লাগলো। উঠোন পেরিয়ে আমাদের গেটের বাহিরে সাদা রংয়ের একটা ট্যাক্সি দাঁড়িয়ে আছে। গাড়ির কাছে আসাতে ড্রাইভার দরজা খুলে দিলো। সীটে বসতেই শীতল হাওয়া শরীরে ছুঁয়ে দিলো। এধরণের দামী গাড়িতে আমার কখনও চড়া হয়নি। সীট বেল্টটা বাঁধতে পারছিলাম না। মুশফিক বেঁধে দিলো। পাগড়ী খুলে মুশফিক আমার পাশে বসলো। সামনের সীটে সেঁজুতি বসলো। আরো একটা মাইক্রোবাস এসেছে। সেটাতে বাকিরা সবাই বসলো। ঢাকার উত্তরার দক্ষিণখানে আমার শ্বশুরবাড়ি। হিলি বন্দর থেকে যখন ঢাকার উত্তরাতে পৌঁছায় মনে হলো অনেকদূর চলে এসেছি। আর কি আমি যেতে পারবো আমার বাবার বাড়িতে? বুকের ভিতরটা হাহাকার করে উঠলো। বিশাল দোতলা বাড়ি। বাড়ির গেটের কাছে পৌঁছাতেই দারোয়ান গেটটা খুলে দিলো। গাড়ি ভিতরে প্রবেশ করলো। সেঁজুতি আমাকে নিয়ে বাসর ঘরে বসালো। কিছুক্ষণ পর মুশফিক ঘরে আসলো। আমাকে এভাবে খাটের উপর জুবুথুবু হয়ে বসে থাকতে দেখে বললো,
—-ক্লসেটে তোমার কাপড় রাখা আছে। চেইঞ্জ করে ফেলো। আর তোমাকে একটা কথা বলে রাখি। আমি আম্মুর কারনে তোমাকে বিয়ে করতে রাজী হয়েছি। সুতরাং তোমাকে মানিয়ে নিতে আমার সময়ের প্রয়োজন।
মুশফিকের কথা শুনে আমিও যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। ক্লসেট থেকে একটা সুতি শাড়ি বের করে বিয়ের ভারী পোশাক চেইঞ্জ করে পরে নিলাম। মুশফিকের কথাটা শুনে কেন যেন মনে হলো আমার বিয়েটাতে ঘাপলা আছে।
কিছুদিন পরে বুঝেছিলাম কেন আমাকে এ বাড়িতে বউ করে আনা হয়েছে। তবে আমিও পরিস্থিতির সাথে মানিয়ে চলার চেষ্টা করেছিলাম। ঐ যে কথায় আছে না, “কপালে না থাকলে ঘি ঠকঠকালে হবে কি? আমার অবস্থাও সে রকম হয়েছিলো।
পরদিন আমার শাশুড়ীকে নিয়ে মুশফিক স্কয়ার হাসপাতালে ভর্তি করে দিলো। শাশুড়ীকে দেখাশোনার জন্য আমাকে হাসপাতালে থাকতে হলো। শুরু হলো আমার নতুন জীবন।
চলবে