উপসংহার পর্ব-০৫

0
2

#ধারাবাহিক গল্প
#উপসংহার
পর্ব-পাঁচ
মাহবুবা বিথী

আমার শাশুড়ী মায়ের ব্রেস্টে ক্যান্সার ধরা পড়েছে। স্টেজ ফোর অবস্থায় নাকি আছে। খুব দ্রুত অপারেশন করতে হবে। ডাক্তারের কাছে সেরকমই শুনলাম। হয়তো আমার ধারণা ভুল হতে পারে। কেন যেন মনে হলো এতোদূর থেকে আমার মতো এক গরীবের মেয়েকে বউ করে আনার উদ্দেশ্য তাহলে কি বউয়ের পরিচয়ে বুয়া কিংবা আয়ার কাজগুলো করা। কেননা গতকালকে বউ হয়ে এ বাড়িতে আসলাম আর আজকে আমাকে শাশুড়ীকে দেখভাল করার দায়িত্ব চাপিয়ে দিলো। উনারা চাইলেই তো একজন নার্স রেখে দিতে পারতেন। আমাকে এখানে দায়িত্ব পালন করতে নিয়ে আসা হলো কেন? গতকাল আমাদের বাসর রাত ছিলো। অথচ মুশফিক আমার দিকে ফিরেও তাকায়নি। বরং আমি বিছানায় ঘুমের ভাণ করে চোখ বন্ধ রেখে শুয়েছিলাম। সে কারনে মুশফিক রাতে কি কি করেছে সবই আমি জানি।
ঢাকার উত্তরার দক্ষিনখানে আমার শ্বশুর বাড়ি। বিশাল দোতলা বাড়ি। গেটের কাছেই বাগানবিলাসের ঝাড়।আমার কাছে রাজপ্রসাদের মতই লেগেছে। গেট দিয়ে ঘরে ঢুকতেই সামনে পানির ফোয়ারা। নানা রকমের ফুলের গাছ লাগানো রয়েছে। গাড়ি থেকেই নামতেই হাসনার হেনার মিষ্টি সুবাস নাকটাকে ছুঁয়ে দিলো। মুশফিকের বেডরুমটাও বেশ বড়। রুমের সাথে লাগোয়া বারান্দাটাও বড় আছে। আমার শ্বশুর রিটায়ার জজ ছিলেন। বুঝতেই পারছি আর্থিকদিক থেকে বেশ সচ্ছল ছিলেন।
ডিম লাইটের মৃদু আলোতে রুমের ভিতরে থাকা ডিভানটায় শুয়ে একটা মেয়ের সাথে ওকে ল্যাপটপ খুলে কথা বলতে দেখলাম। মেয়েটার নাম রত্না। মুশফিক ওকে রত্না বলেই ডাকছিলো। ল্যাপটপ খুলে ভিডিও অন করতেই ওপাশ থেকে মেয়েটা বলে উঠলো,
—–কি ব্যাপার মুশফিক,তুমি অনলাইনে কেন? আজ না তোমার বাসর রাত।
একথা বলেই ল্যাপটপের ওপাশে থাকো মেয়েটি হাসতে লাগলো। না ওকে আমার দেখা হয়নি। তবে গলার স্বরটা বেশ মিষ্টি। রত্নাকে হাসতে দেখে মুশফিক রেগে গিয়ে বললো,
—–মাই ফুট বাসর রাত।
—-আহ্ চটছো কেন? মাত্র তো কয়েকদিনের ব্যাপার। একটু ধৈর্য ধরো। আন্টি সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরে আসলেই আমরা আমাদের কাজটা সেরে ফেলবো। তাছাড়া তোমার বিহেভ এমন হলে মেয়েটা কি ভাববে বলতো?
—-ও ঘুমিয়ে পড়েছে। এই শোনো, আমি না তোমার কারণে বিয়ে করতে বাধ্য হয়েছি। এতোদিন ধরে জীবনকে কিভাবে সাজালাম আর এখন কি পরিনতি হলো?
—–তুমি কেন আমার উপর দোষ চাপিয়ে দিচ্ছো?
—–কারণ তুমি আমাকে বিয়ে করতে রাজী হলে না বলে মায়ের পছন্দে আমাকে বিয়ে করতে হলো।
—-আজ রাজী হয়নি বলে কাল রাজী হবো ন একথা তোমায় কে বললো? আসলে আন্টি অসুস্থ না হলে এই ঝামেলা হতো না। আমার পক্ষে তো গ্রাজুয়েশন কমপ্লিট করে দেশে থেকে তোমার অসুস্থ মায়ের সেবা করা সম্ভব নয়। আমি যেহেতু ইউ এস এ সিটিজেন আমাকে তো আমেরিকায় যেতেই হবে। আর তোমার সাথে বিয়ে হলে আমি তোমাকে বাংলাদেশে রাখতাম না। আমার সাথে করেই ইউএসএ তো আসতাম। তখন তোমার অসুস্থ মায়ের সেবা কিংবা দেখভাল কে করতো? তার থেকে এটাই তো ভালো হলো, বিয়ে করে ফুলটাইম কাজের লোক যোগাড় করে নিলে।
নিস্তদ্ধ রাত। আকাশে বড় থালার মতো চাঁদ উঠেছে। পৃথিবী আজ রুপালীর আলোর ঝর্ণা দিয়ে স্নান করছে। সে আলোর কিয়দংশ জানালার ফাঁক গলে মুসফিকের ডিভানের উপর এসে পড়েছে। আর আমার ভিতরটায় মুহুর্তেই অমাবস্যার আঁধারে ঢেকে গেল।কথাগুলো সেদিন আমার শরীরে কাঁটার মতো বিঁধেছিলো। আসলেই সে রাতে ঐ কথাগুলো শোনার পর আমি কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়েছিলাম। ভাবলাম সারাজীবন আমাকে অন্যের উচ্ছিষ্ট ভালোবাসা নিয়ে জীবন কাটাতে হবে। কিন্তু সেই মুহুর্তে কিছু করার ছিলো না। কি ভেবে শ্বশুর বাড়িতে আসলাম আর কি ঘটলো আমার জীবনে? আসলেই মানুষের জীবনের গতি বড়ই পরিবর্তনশীল। আর এই পরিবর্তনটা বলে কয়ে আসে না। হঠাৎ করেই জীবনের তটভুমিতে হাজির হয়। সে কারণেই পরিবর্তিত পরিস্থিতির সাথে মানিয়ে নিতে হয়। মানিয়ে না নিলে হা হুতাশ করলে জীবনের এগিয়ে যাওয়া কঠিন হয়ে পড়ে। আমি সামনের দিকে হাঁটবো বলে পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে নিজেকে খাপ খাইয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে দুবছর মুশফিকের সংসারে ছিলাম।কিন্তু শেষ রক্ষা করতে পারিনি। তবে যা হয় ভালোর জন্যই হয়।
মুশফিকের হাতে সেদিন ড্রিংক্সের গ্লাস দেখে প্রথমে বুঝে উঠতে পারেনি গ্লাসে কি ছিলো। ভেবেছিলাম জুস কিংবা কোল্ড ড্রিংক্স হবে। তবে একটা তীব্র গন্ধ নাকে এসে লাগছিলো। পরে বুঝেছিলাম ওটা মদ ছিলো। কারণ রত্না ওকে বলছিলো,
—-মুশফিক বেশী খেয়ো না। নেশায় চূড় হলে পরে দেখা যাবে ঐ মেয়েটাকে আমি ভেবে ওর সাথে রোমান্স করতে শুরু করবে।
—-রোমান্স করলে করবো। আমাকে বিয়ে করার আগে তোমার একথা মনে ছিলো না?

নিজের জন্য বড্ড করুণা হচ্ছিলো। অবশেষে এরকম মাতাল লম্পট চরিত্রের মানুষকে কিনা আমাকে স্বামী হিসাবে পেতে হলো।
একসপ্তাহ হাসপাতালে থেকে শাশুড়ী মাকে নিয়ে বাসায় ফিরলাম। উনাকে কেমো দেওয়া শুরু হলো। একদিকে শাশুড়ীর সেবা অন্যদিকে প্রতিরাতে মুশফিকের রত্নার সাথে ভিডিও কলে কথা বলা। আমার কাছে অসহ্য লাগছিলো। কোন নারীর ভালো লাগবে নিজের স্বামীকে তার প্রেমিকার সাথে রাত জেগে কথা বলতে দেখলে? ওদের হাসির শব্দের সাথে সাথে কিছু ভালগার কথাবার্তার কারনে আমার ঘুমও আসতে চাইতো না। একসময় আমি আমার শাশুড়ী মায়ের সেবার কথা বলে উনার রুমেই থাকতে শুরু করলাম। আমার শাশুড়ী একটু সামলে উঠলে উনি সেঁজুতির বিয়ে দেওয়ার জন্য উঠে পড়ে লাগলেন। শেষ পর্যন্ত তড়িঘড়ি করে সেঁজুতি র পছন্দের পাত্রের সাথে ওকে বিয়ে দেন। এতে অবশ্য আমার উপর চাপ বেড়ে যায়। সেঁজুতি যতদিন ছিলো শাশুড়ীর সেবা যত্নে সেও অংশ নিতো।
আসলে ঐ দুবছর আমার কেটেছে শাশুড়ী মায়ের সেবা করে। যদিও মুশফিকের আচরণে শাশুড়ীর উপর অনেক রাগ হয়েছিলো। তবে সে রাগটা আমার সে সময়ের পরিবেশ বেশীদূর গড়াতে দেয়নি। আমার বিয়ের কিছুদিন পরেই আব্বা মারা যায়। এরপর আম্মা একা হয়ে পড়ে। ওদিকে বুবুর শ্বশুরবাড়িতে বুবুর উপর নানা রকম অত্যাচার চলতে থাকে। বুবু কনসিভ করেছিলো। কিন্তু ফয়সল ভাইয়ের আয় নেই বলে বুবুর শ্বশুর বুবুকে জোর করে হাসপাতালে ভর্তি করে বাচ্চা এবরশন করানোর ব্যবস্থা নেওয়া হয়। এতে বুবুর প্রচন্ড রক্তক্ষরণ হয়। অবস্থা খুব খারাপ হয়ে পড়ে। তখন ফয়সলভাই এসে আম্মাকে খবর দেয়। আম্মা প্রথমে রাজী হয়নি। ফয়সলভাই আমাকে ফোন করে জানিয়ে দিলে আমি তখন শর্তের কথা মনে করিয়ে দেই। অগত্যা আম্মা ফয়সলভাইয়ের সাথে বুবুকে নিয়ে হিলি থেকে রংপুর মেডিকেলে ভর্তি করে। ওখানে একসপ্তাহ থাকার পর বুবু সুস্থ হয়। এরপর থেকে বুবু আর শ্বশুরবাড়ী যায়নি। কারণ আম্মা ফয়সলভাইকে শর্ত দিয়েছিলো বুবুকে পেতে হলে আম্মার কাছে এসে ঘরজামাই থাকতে হবে। তা,না হলে আম্মা ফয়সল ভাইয়ের আব্বার নামে নারী নির্যাতনের মামলা করে দিবে। শেষ পর্যন্ত ফয়সল ভাইকে আম্মার শর্ত মেনে নিতে হয়। কেননা শর্ত না মানলে আম্মা ফয়সলভাইকে বুবুর সাথে দেখা সাক্ষাত করতে দিবে না। তারপরও আমার কাছে মুশফিকের থেকে ফয়সল ভাইকে উৎকৃষ্ট মনে হতো। আমার শ্বশুর জজ হতে পারেন কিন্তু ছেলেকে সুশিক্ষায় বড় করতে পারেননি। শাশুড়ী বুঝতেন এইজন্য উনার ভিতরে একধরনের অপরাধ বোধ কাজ করতে দেখেছি। আমাকে মাঝে মাঝে সান্তনা দিয়ে বলতেন, একসময় সব ঠিক হয়ে যাবে। ছেড়ে গেলেই তো যেতেই পারতাম। তবুও ভাবলাম জীবনকে একটু সুযোগ দিয়ে দেখি কি হয়?
আমার মায়ের সংসারে এতো ঝামেলা দেখে কোনোদিন আমার জীবনের অশান্তির খেরোখাতার হিসাব আম্মাকে দেইনি। বেচারা কতো সহ্য করবে। একদিনে স্বামীর শোক অন্যদিকে বড় মেয়ের সংসারে অশান্তি এরপর যদি আমার লম্পট স্বামীর গুনগান তার কাছে বলি তাহলে তাকে সুস্থ রাখাই মুশকিল হয়ে যাবে।

চলবে