উপসংহার পর্ব-০৯

0
19

#ধারাবাহিক গল্প
#উপসংহার
পর্ব-নয়
মাহবুবা বিথী

দিন কারো জন্য বসে থাকে না। আপন গতিতে সময়গুলো বয়ে যায়। শুধু মানুষের কষ্টের সময়গুলো যেন যেতে চায় না। আমার এখন তাই মনে হয়। রাতের খাবার খেয়ে আম্মা
আর বুবু ঘুমিয়ে পড়েছে। বুবুর দিকে তাকিয়ে দেখি কি নিশ্চিন্তে বুবু ঘুমাচ্ছে। আমার মতো ভাগ্য তো বুবুর নয়। ফয়সলভাই ওকে ভালোবাসে। উনার শরীরটা একটু স্ট্যাবল হওয়াতে রংপুর থেকে উনাকে দিনাজপুর মেডিকেলে শিফট করা হয়েছে। এখানে চলে আসাতে বুবুও খানিকটা টেনশন মুক্ত হয়েছে। হয়তো সে কারণেই গভীর ঘুমে নিমগ্ন। বুবুর একজন ভালোবাসার মানুষ আছে। আর আমি বড়ই দূর্ভাগা। এই পৃথিবীতে আমাকে ভালোবাসার কোনো মানুষ নেই। আচ্ছা, আমার সাথে মুশফিকের কোনো সম্পর্ক গড়ে উঠেনি। তবুও কেন আমি মুখ ফুটে আমার মা কিংবা শাশুড়ীর কাছে আমাদের ডিভোর্সের কথাটা বলতে পারছি না? নিজের উপর বড্ড রাগ হচ্ছে। নাকি নিজের অজান্তে আমি ঐ সংসারের মোহে আটকে যাচ্ছি। প্রণয়ের কোলাহলে মুখরিত পরিবেশে আমার জীবনটা কখনও মেতে উঠবে না। এটাও আমি জানি খুব শীঘ্রই মুশফিক আমাকে ডিভোর্স দিয়ে দিবে। আজ একবৎসর দুই মাস দশদিন সময় পার হয়ে গেল অথচ মুশফিকের সাথে আমার দাম্পত্য সম্পর্ক গড়ে উঠেনি। যে সম্পর্ক গড়েই উঠেনি তাকে টেনে নিয়ে যাবার কোনো অর্থ নেই। আমাদের দুজনেরই মুক্তি দরকার। যত তাড়াতাড়ি মুক্তি পাবো ততই মঙ্গল।
আকাশে আজ গোল থালার মতো পূর্ণিমার চাঁদ উঠেছে। জানালা দিয়ে চাঁদের রুপালী আলো বিছানার উপর এসে পড়েছে। চাঁদের কিয়দংশ আলো বুবুর মুখের উপর এসে পড়েছে। সেই আলোতে বুবুকে অপরুপ লাগছে। আমার দৃষ্টি জানালা দিয়ে বাইরের চরাচরে নিক্ষিপ্ত হলো। চাঁদের আলোয় পুরো পৃথিবী আজ উদ্ভাসিত। বড় ইচ্ছে হয় এরকম চাঁদের আলোয় আমি আমার ভালোবাসার মানুষের হাত ধরে মেঠোপথ ধরে বহুদূর হেঁটে যাবো। জানি না এই জীবনে আমার সাধ পূরণ হবে কিনা।
সারারাত আমার দুচোখের পাতা এক হয়নি। ভোরের দিকে চোখটা কেবল লেগে এসেছে। আম্মার ডাকাডাকিতে ধড়ফড় করে বিছানা ছেড়ে উঠলাম। আম্মা আমার দিকে তাকিয়ে বললেন,
—-যে ছেলেটাকে ফয়সল চিনে ফেলেছিলো ওর নাম সাইফুল। ওর লাশ আত্রাই নদীর তীরে ভেসে উঠেছে। আর আকমল চেয়ারম্যানকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।
আমি একটু ভয় পেয়ে গেলাম। আম্মার চেহারার দিকে তাকিয়ে মনে হলো উনি নিজেও একটু ঘাবড়ে গিয়েছেন। সেদিকে লক্ষ্য করে আম্মাকে বললাম,
—-তোমার কি ধারণা,সাইফুলকে কে মেরেছে?
—-চেয়ারম্যান ছাড়া ওর সাগরেদের গায়ে হাত তোলার সাহস এই তল্লাটে কারো নাই। ফয়সল যেহেতু ওকে চিনে ফেলেছে সে কারণে আমাকে ফাঁসাতে পারলো না। তারই শোধ হিসাবে ওকে মেরে ওর আন্ডারগ্রাউন্ডে সবাইকে সতর্ক করে দিলো।
—-কিন্তু পুলিশ তোমাকে সন্দেহের তালিকায় রাখবে।
—-রাখলে রাখুক। জলে বাস করতে হলে কুমিরের সাথে লড়াই করে টিকে থাকতে হবে। এখন হাসপাতালে চল। হাসপাতাল থেকে ফয়সলকে বাড়ী নিয়ে আসি।
—-কি বলছো? ভাইয়া আরো কিছুদিন হাসপাতালে থাকুক।
—-না,আমি দরকার হলে বন্ড সই দিয়ে ওকে বাড়ী নিয়ে আসবো। চেয়ারম্যান সুবিধার মানুষ না। স্বার্থের জন্য নিজের ছেলেকে খুন করতে দ্বিধা করবে না।
বুবুর দিকে তাকিয়ে বললাম,
—-তোমার কি একই মত?
—-হুম,আমারও ভীষণ ভয় করছে।
—-সাইফুলের মরার খবর তোমরা কোথায় পেলে?
—-সোহেল এসেছিলো।
রাতে ঘুম না হওয়াতে আমার মাথা ব্যথা করছে। সে কারণে আম্মাকে বললাম,
—-তোমরা হাসপাতালে যাও। আমি বাসায় থাকি।
কিন্তু আম্মা আমাকে বাসায় একা রাখতে চাইলেন না। অগত্যা আমাকেও হাসপাতালে যেতে হলো। ফয়সল ভাইকে বন্ড সই দিয়ে রিলিজ করে বাসায় নিয়ে আসা হলো। আম্মা আর বুবু মিলে ফয়সলভাইয়ের খুব যত্ন নিতে লাগলো। আমার দিকে তাকিয়ে ফয়সল ভাই বললেন,
—-দুবছর পর তোমাকে দেখলাম। অনেক পরিবর্তন হয়েছে তোমার। গিন্নী গিন্নী ভাব হয়েছে। বরটাকে সাথে নিয়ে আনলে না কেন? আলাপ পরিচয় হতো।
—-ওর সামনে পরীক্ষা। সেই কারণে আসতে পারেনি। আপনি আগে ভালোমতো সুস্থ হন। আলাপ পরিচয়ের সময় তো ফুরিয়ে যাচ্ছে না।
এরমাঝে দুটোদিন পার হয়ে গেল।ওদিকে আমার ননদ সেঁজুতির ফোন আসলো। আমার শাশুড়ী নাকি আবার হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে। আমাকে এয়ারে করে তাড়াতাড়ি ঢাকায় ফিরতে বললো। ভেবেছিলাম আরো কিছুদিন থাকবো। কিন্তু তা আর হলো না। এদিকে আম্মা মনে হয় কিছু একটা আঁচ করতে পেরেছেন। সে কারণে আমাকে নিরিবিলিতে ডেকে নিয়ে বললেন,
—-তুই আসলি তিনদিন হলো, কিন্তু মুশফিককে ফোন দিয়ে তোর খবর নিতে দেখলাম না। তোর দাম্পত্য জীবনে সব ঠিক আছে তো?
আমি এই মুহুর্তে আম্মাকে কিছু বুঝতে দিতে চাইলাম না। কারণ এখানকার পরিবেশটা তথবৈচ হয়ে আছে। এসময় আম্মার খুব মানসিক জোরের প্রয়োজন। সে কারণে আম্মাকে সাহস দিয়ে বললাম,
—-ওর সাথে আমার ম্যাসেঞ্জারে কথা হয়। তুমি বরং বুবুকে আবার কলেজে ভর্তি করে দাও।
—সেটা আমিও ভেবে রেখেছি। তবে ফয়সল সুস্থ না হওয়া অবদি রেবাকে ভর্তি করা যাবে না। চেয়ারম্যানের চ্যালারা আবার কি করে বসে কেজানে?
—-হুম,তা ঠিক।
ফোনটা বেজে উঠলো। মোবাইলের স্ক্রীনে তাকিয়ে দেখি একটা অচেনা নাম্বার থেকে কল এসেছে। ধরবো না ভেবেও কি মনে করে ফোনটা রিসিভ করলাম। ওপাশ থেকে একটা বলিষ্ট পুরুষ কন্ঠ বলে উঠলো,
—+তোমার মোবাইলে প্লেনের টিকিট পাঠিয়ে দিয়েছি। তাড়াতাড়ি চলে আসো। আম্মুর শরীর খুব একটা ভালো না। বার বার তোমার খোঁজ করছে। আর কটাদিন একটু কষ্ট করো। এরপর তোমাকে চিরজীবনের মতো মুক্তি দিয়ে দিবো।
মুশফিকের সাথে কথা বলছি দেখে আম্মা রুম থেকে বের হয়ে গেল।ফোনটা রাখার সাথে সাথে আম্মা আবার ঘরে এসে আমাকে বললেন,
—–তোর শাশুড়ীর শরীর কি বেশী খারাপ? ফয়সলের এই কাহিনী না থাকলে আমিও তোর সাথে চলে যেতাম।
—-তোমার যেতে হবে না। দোয়া করো যাই হোক না কেন ভালোর জন্য যেন হয়। আমার জন্য একটা গাড়ীর ব্যবস্থা করো। সৈয়দপুর এয়ারপোর্টে যেতে হবে।
ভেবেছিলাম সপ্তাহখানিক থাকবো। তা আর হলো না। অগত্যা কোনো রকমে মুখে কিছু দিয়ে দুপুর একটার মধ্যে গাড়ি ভাড়া করে এয়ারপোর্টের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিলাম। চারটার সময়ে পৌঁছে গেলাম। আমার প্লেনের সময় সন্ধা ছয়টা। কখনও প্লেনে উঠিনি। বেশ থ্রীল অনুভব করছি। এয়ারপোর্টের আনুষ্ঠানিকতা শেষ করে ছ,টা বাজার দশ মিনিট আগে প্লেনের অপেক্ষায় লাউঞ্জে কিছুক্ষণ বসে থাকলাম। অবশেষে প্লেনে উঠার সময় হয়ে এলো। প্লেনে উঠার কিছুক্ষণ পরেই সন্ধার আলো আঁধারীতে চারপাশ ছেয়ে গেল। জানালার কাছে বসেও তেমন কিছু আর দেখতে পেলাম না। ঘন্টাখানিকের মধ্যে ঢাকায় পৌঁছে গেলাম। মুশফিক আগে থেকেই এয়ারপোর্টে গাড়ি নিয়ে অপেক্ষা করছিলো। প্লেন ল্যান্ড করার সাথে সাথে ফোন দিয়ে আমার লোকেশন জেনে আমাকে গাড়িতে তুলে নিলো। আজ শুক্রবার হওয়াতে রাস্তায় বেশ জ্যাম। ঘন্টা দেড়েকের মধ্যে স্কয়ার হাসপাতালে পৌঁছে গেলাম। কেবিনে ঢুকে ব্যাগ থেকে পোশাক বের করে বদলে নিলাম।এরপর শাশুড়ীর কাছে যেতেই উনি অভিমান করে বললেন,
—-অসুস্থ মানুষটাকে রেখে গেলে একটা ফোন দিয়ে খোঁজ নিলে না?
—-আমার ভুল হয়ে গিয়েছে মা। এখন কেমন আছেন?
—-আলহামদুলিল্লাহ, ভালো আছি। আমার কাছ থেকে আর কোথাও যাবে না।
—-ঠিক আছে।
ডাক্তার রুমে চলে আসাতে আমি আর সেঁজুতি বের হয়ে করিডোরে দাঁড়ালাম। সেঁজুতি আমার দিকে তাকিয়ে চোখ ছলছল করে বললো,
—-ভাবি আম্মুর শরীর খুব একটা ভালো না। ডাক্তার বলেছে ক্যান্সার আবার ফিরে এসেছে। সময়ও ফুরিয়ে এসেছে।
একথা বলেই ও ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো। আমি ওকে সান্তনা দেওয়ার ভাষা খুঁজে পেলাম না। শুধু ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিলাম। ঐ রাত্রেই আমার শাশুড়ীকে আইসিইউতে নেওয়া হলো। কেননা উনার শ্বাসকষ্ট শুরু হয়েছে। একমাস মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ে আমার শাশুড়ী না ফেরার দেশে চলে গেল। আমার মনটা ভীষণ খারাপ হলো। তবে নিজেকে এটাই বলে সান্তনা দিলাম এই পৃথিবী থেকে সবাইকে চলে যেতে হবে। কারণ আল্লাহপাক আমাদের দুদিনের সফরের জন্যই পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন। আর এরসাথে যোগ হয়েছে দুনিয়ার পরীক্ষা।
এরমাঝে দুসপ্তাহ পার হয়ে গেল। সেঁজুতি এ বাড়িতে বেশকিছুদিন থাকলো। তবে ও মনে হয় কিছু একটা আঁচ করতে পেরেছে। সেদিন দুপুরে খেয়ে বিছানায় শরীরটা এলিয়ে দিয়েছি। এমন সময় দরজা নক করে সেঁজুতি বললো,
—-ভাবি আসবো?
—-,হুম আসো,
সেঁজুতি রুমে এসে খাটের কোনায় বসলো। শাশুড়ী মা মারা যাবার পর থেকে আমি আমার শাশুড়ী মায়ের ঘরেই থাকি। মুশফিক নিজের মতো করে ওর রুমে থাকে। সেঁজুতি কেমন যেন ইতস্তত করতে লাগলো। আমি ওর দিকে তাকিয়ে বললাম,
—-তুমি কি আমাকে কিছু বলবে?
—-হুম,কিছু কথা ছিলো। তবে তুমি কিভাবে নিবে সেটা ভেবেই আমার অস্থির লাগছে।
—-তুমি নির্দ্ধিধায় বলতে পারো। আমি স্বাভাবিকভাবে নিবো।
—-,বলছিলাম কি তোমার সাথে ভাইয়ার সম্পর্কটা আমার কাছে কেমন যেন খটকা লাগে। তোমাদের দুজনকে দেখে মনে হয় তোমরা যেন দুই মেরুর বাসিন্দা। তাছাড়া—-
—-তাছাড়া কি?
—-জাবেদ বললো,ভাইয়াকে নাকি প্রায় একটা মেয়ের সাথে ঘোরাফেরা করতে দেখা যায়। ভাইয়া কি পরকীয়া সম্পর্কে জড়িয়েছে? যদি কোনো ঝামেলা থাকে তা আলোচনার মাধ্যমে মিটিয়ে ফেলো।
—আসলে ধরে বেঁধে কখনও পীরিত হয় না। তাই আমার মনে হয় তোমার ভাইয়ার সাথে আমার সম্পর্কটা আর বেশীদূর গড়াবে না। খুব দ্রুতই আমাদের ডিভোর্স হয়ে যাবে। কারণ তোমার ভাইয়া মায়ের মন রক্ষার্থে আমাকে বিয়ে করেছে। উনার নিজের পছন্দের মানুষ আছে।
—-কিন্তু তুমি ভাইয়ার বৈধ স্ত্রী। সেক্ষেত্রে তোমার অধিকারটা প্রবল। তুমি কেন তোমার অধিকার ছেড়ে দিবে?
—তোমার ভাইয়া তো আমাকে কখনও স্ত্রীর মর্যাদাই দেয়নি। সেখানে অধিকার বোধ কিভাবে আসে?
—-তবুও ভাবি,একবার চেষ্টা করে দেখো। এই সংসারটা ভাঙ্গনের হাত রক্ষা করা তোমাদের সবার দায়িত্ব।
আমার নিরবতায় সেঁজুতি আর কথা বাড়ালো না। ওয়াশরুমে যাওয়ার উসিলায় সেঁজুতি আমার সামনে থেকে সরে গেল।
দুদিন পরেই সেঁজুতি চলে গেল। এখন পুরো বাড়িতে আমি দিনের বেলা বলতে গেলে একাই থাকি। তবে দুজন কাজের হেলপার রয়েছে। দিনের বেলা আমার তেমন একটা অসুবিধা হয় না। তবে ইদানিং রাতের বেলায় আমার অস্বস্তি হয়। কেননা মুশফিকের আচরণে কেমন একটা পরিবর্তন এসেছে। ও ইদানিং আমার সাথে সময় কাটাতে চায়। আমার শাশুড়ী মায়ের স্মৃতিগুলো নিয়ে আমার সাথে আলোচনা করে। কিন্তু আমার ভালো লাগে না। আমি মুক্তির অপেক্ষায় দিনগুনতে লাগলাম। কেননা আমি কারো কাছে অপশনাল সাবজেক্ট হয়ে থাকতে চাই না। এরমাঝে চল্লিশ দিন সময় পার হয়ে গেল। আমি সময় বুঝে একদিন ওকে আমাদের ডিভোর্সের বিষয়টা মনে করিয়ে দিলাম।সে শুনলো কিন্তু মুখে কিছু বললো না।সেদিনই সন্ধাবেলায় ও বাইরে গেল। ফিরলো রাত বারোটায়। তবে আমার ধারণা সেদিন ও ড্রাঙ্ক অবস্থায় ছিলো। কেননা ডোরবেল বাজানোর পর দরজা খুলে দেওয়ার সাথে সাথে আমি ওর গায়ে বিকট গন্ধ পাই। আমার গা,টা গুলিয়ে উঠে। দ্রুত আমি ঘরে চলে আসি। কিন্তু দরজার ছিটকিনি লাগাতে ভুলে যাই। আর মুশফিকও আমার পিছু পিছু রুমে চলে আসে। এবং ঐ রাতেই আমার সাথে জোর করে শারীরিক সম্পর্ক করে। বাইরে সেদিন তুমুল ঝড়। আমি শক্তিতে ওর সাথে পেরে উঠিনি। যার ফলে যা ঘটার তাই ঘটলো। আমি খুব অপমানিত বোধ করলাম।

চলবে