উপসংহার পর্ব-১৫

0
12

#ধারাবাহিক গল্প
#উপসংহার
পর্ব-পনেরো
মাহবুবা বিথী

—-তোমাকে আমি এতোটা বোকা ভাবিনি। তুমি কি সত্যিই কি বুঝো না, নাকি বুঝেও না বুঝার ভান করো?
সন্ধার আলো আঁধারিতে আমার মনটা বিষন্ন হয়ে ছিলো। কেননা ভেবেছিলাম কোন অপরিচিত পুরুষ লোকের সাথে দেখা করতে হবে। কিন্তু এ যে রাহাত সেটা বুঝতে পেরে আমার তো খুশী হওয়ার কথা। কিন্তু হঠাৎ মনে হলো আমি এক বাচ্চার মা। আর রাহাত অবিবাহিত একজন পুরুষ মানুষ। ওর বাবা মা কি আমাদের এই বিয়েটা মেনে নিবে?
—-কি ভাবছো জবা? আর কতোদিন আমাকে অপেক্ষায় রাখবে? আমাকে শাবাবের বাবা হওয়ার অধিকার টুকু দিবে না?
রিফাতের কথায় অনুনয় ঝরে পড়ছে। কিন্তু আমি তো আমার প্রথম বিয়ের কথা ভুলতে পারিনি। সেখানে ছেলের মা রাজী ছিলো। ছেলে রাজী ছিলো না। মায়ের চাপে পড়ে বিয়ে করেছে। আর রিফাত যদি মোহের বশবর্তী হয়ে ওকে বিয়ে করতে চায় অপরদিকে ওর বাবা মা যদি রাজী না থাকে সেক্ষেত্রে এই বিয়ে সুখের হবে না। তার থেকে বিয়ে না করাই ভালো। আমি খুব শান্ত আর শীতল স্বরে রাহাতের দিকে তাকিয়ে বললাম,
—-দেখো রাহাত, তুমি একটা অবিবাহিত পুরুষ মানুষ। আমার মতো এক বাচ্চার মাকে তোমার বাবা মা পুত্রবধু হিসাবে মেনে নিবেন না। তুমি বরং তোমার বাবা মায়ের পছন্দে বিয়ে করো। কারণ বিয়ে শুধু দুটো মানুষের সাথে হয় না, দুটো পরিবারের সাথে হয়। তাছাড়া শাবাবকে উনারা মেনে নিতে নাও পারেন। এটা জোর জবরদস্তী করলে পারিবারিক অশান্তি শুরু হতে পারে। সুতরাং আমার বিয়েতে কোনো মত নাই। এই আমি আমার ছেলেকে নিয়ে বেশ আছি। আমাকে এখন যেতে হবে। রাত হয়ে যাচ্ছে।
কথাগুলো শেষ করে পা বাড়াতেই একটা বলিষ্ট হাত আমার হাতটা ধরে টান দিলো। আমি নিজেকে সামলাতে না পেরে রাহাতের বুকের কাছে ধাক্কা খেলাম। পারফিউমের সুবাসের সাথে একটা পুরুষালি ঘ্রাণ আমার সমস্ত ইন্দ্রিয়তে ছড়িয়ে পড়লো। আমার রক্ত বিন্দুতে অদ্ভূত শিহরণ খেলা করতে লাগলো। কেমন একটা ভালোলাগার সুখানুভতিতে আমি আবিষ্ট হয়ে থাকলাম। ভালোই লাগছিলো। কিন্তু সন্ধার আলো আঁধারীতে আশেপাশের মানুষের কৌতূহলী দৃষ্টির মাঝে নিজেকে এভাবে উপস্থাপন করতে ভালো লাগছে না। সেকারণে রাহাতের হাতের মুঠি থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিলাম। এরপর রাহাত আমাকে নিয়ে একটা রেস্টুরেন্টে বসলো। তারপর খুব আবেগ মিশ্রিত গলায় বললো,
—-আমাকে ফিরিয়ে দিও না জবা। আমি তোমাকে সত্যি অনেক ভালেবাসি। নিজের ভালোবাসার বিচার করার জন্য আমি গত তিনমাস তোমাকে না বলে উধাও হয়ে গেলাম। এমনকি তোমার সাথে মোবাইলের সমস্ত যোগাযোগ বন্ধ করে দিলাম। বিশ্বাস করো এক মুহুর্তের জন্য তোমাকে ভুলতে পারিনি। বাবা মাকে বিষয়টা জানালাম। মিথ্যা বলবো না আব্বা শুনে প্রথমে অনেক রেগে গিয়েছিলো। তবে তোমার ব্যাপারে আম্মা শুরু থেকেই পজেটিভ। আম্মাই পরবর্তী কালে আব্বাকে ম্যানেজ করলো।
—-তাহলে আঙ্কেল আন্টিকেই বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে আসতে বলো।
—-তুমি বলছো তাহলে?
—-যতটুকু জানি তুমি ঠসা নও। আমার কথাটা স্পষ্টই শুনতে পেয়েছো।
একথা বলে আমি মিটি মিটি হাসতে লাগলাম। রাহাত অবাক হয়ে আমার হাসির পানে তাকিয়ে বললো,
—-এতো সুন্দর নির্মল হাসি দেখার জন্য আমি এতোদিন ধরে অপেক্ষা করেছি। আচ্ছা তুমি কেন নিজেকে শামুকের মতো গুটিয়ে রাখতে।
—-আসলে আমার প্রথম বিয়ের বিষময় অভিজ্ঞতা আমাকে দ্বিতীয়বার কাউকে ভালোবাসতে কিংবা বিয়ে করতে বাঁধা হয়ে দাঁড়াতো। সেকারনেই নিজেকে নিজের মাঝে আবদ্ধ রাখতাম। মুশফিক মানে শাবাবের বাবার সাথে আমার বিয়েটা সুখকর ছিলো না। কিভাবে থাকবে বলো? বাসর ঘরেই জানলাম উনি মায়ের পছন্দে বিয়ে করেছে। কিন্তু উনার নিজের পছন্দ আছে। সে কারনে আমার সাথে দাম্পত্য সম্পর্কে উনি যাবেন না।
এমন সময় রাহাত একটা অদ্ভুত প্রশ্ন করলো। আসলে এক্ষেত্রে আমি রাহাতের দোষ দিবো না। কেননা ওর জায়গায় থাকলে আমিও এমন প্রশ্ন করতাম। ও আমাকে বললো,
—-জবা তুমি যদি কিছু মনে না করো তাহলে একটা বিষয় জানতে চাইছিলাম।
আসলে আমিও চাইছিলাম ওর কিছু জানার থাকলে জেনে নেওয়াই ভালো। তবে ওর প্রশ্নের ধরণ আর বডি ল্যাঙ্গুয়েজ দেখে মনে হলো,শাবাবের কথাই জানতে চাইছে।
তাই আমি সহজ সরল ভঙ্গিতে ওর মুখের দিকে তাকিয়ে বললাম,
—-শাবাবের বিষয়ে জানতে চাইছো তো?
ও মুখে কিছু বললো না। তবে মৌনতা সম্মতির লক্ষণ। সেটা বুঝেই আমি ওকে বললাম,
—বৈবাহিক ধর্ষণ সম্পর্কে তো শুনেছো? আমি ওর কাছে বৈবাহিক ধর্ষণের শিকার হয়েছিলাম। সেদিন অবশ্য ও ড্রাঙ্ক অবস্থায় ছিলো। ঘটনাটা ঘটেছিলো কিছুটা স্বৈরাচারবাদী পুরুষত্ব থেকে। আমার শাশুড়ী মারা যাবার পর আমি ওকে ডিভোর্স দিতে চাই। যেহেতু আমার সাথে ও দাম্পত্য সম্পর্ক চালাবে না তাহলে কিসের ভিত্তিতে আমি ও বাড়িতে থাকবো। কিন্তু আমার মতো হত দরিদ্র পরিবারের মেয়ের মুখ থেকে ডিভোর্স শব্দটা আশা করেনি। ও ভেবেছিলো আমি হয়তো ওর হাতে পায়ে ধরে থাকতে চাইবো।
—-কিন্তু তুমি না বললে,উনার নিজের পছন্দ ছিলো?
—-ছিলোতো,কিন্তু ঐ মহিলা তখন ইউএসএ তে ছিলো। তাছাড়া বৈধভাবে একটা মেয়ের শরীর ভোগ করার সুযোগ হয়তো সে হাতছাড়া করতে চায়নি। মুশফিকের প্রতি আমার অনেক রাগ ক্ষোভ আর অপমান জমে আছে। কিন্তু যখনি ভাবি ও আমার শাবাবের বাবা হয় তখনি সেটা বহিঃপ্রকাশ ঘটাতে পারি না। কথাগুলো এক নিঃশ্বাসে বলে আমি নিরব হয়ে গেলাম।
আমার নিরবতা দেখে রাহাত আমাকে বললো,
—চলো, আমরা আমাদের আজকের দিনটাকে সেলিব্রেট করি।
এরপর ও অনেক খাবারের অর্ডার করলো। দুজনে পেটপুরে খেয়ে বাড়ির পথে রওয়ানা দিলাম। রাহাত একটা সিএনজি ভাড়া করে আমাকে বাসায় নামিয়ে দিয়ে ও হলে ফিরে গেল।

তারপর এক শুভদিন দেখে আমার বিয়ে ঠিক হলো। বেশ তাড়াহুড়ো করেই বিয়ে ঠিক হলো। কারন রাহাতের ভাই সিফাতের গার্লফ্রেন্ড আছে।সিফাত হাজী দানেশে পড়ে। মেয়ের বাবা মা যখনি জানতে পেরেছে তাদের মেয়ে একটা সম্পর্কে আছে তারাও আর দেরী করতে চাইছিলো না। রাহাতের বাবা মা ভাই বোন এসে বিয়ের তারিখ ঠিক করে আমাকে আংটি পরিয়ে গেল।

রাহাত খুব দ্রুত একটা অ্যাপার্টমেন্টে ফ্লাট ভাড়া করলো। আমাকে সাথে নিয়ে খাট ড্রেসিং টেবিল একটা ক্লসেট,এক সেট সোফা আর একটা ডাইনিং টেবিল কিনলো। বাকি জিনিস চুলা থেকে শুরু করে হাড়ি পাতিল বালতি ও নিজেই কিনে নিলো।

অবশেষে এলো আমার সেই কাঙ্খিত দিন। আমার বোন আর দুলাভাই বোনের মেয়েটা এসেছিলো। ওরা আমার মোহাম্মদপুরের বাসায় রয়ে গেল। শাবাবকে রাহাত আনতে চেয়েছিলো। আম্মা দেননি। বলেছিলেন আগামি কাল যাবে। এদিকে রাহাতের মা বাবা ভাইবোন রাহাতের ফ্লাটে চলে এসেছিলো। খুব ঘরোয়া ভাবে আমার বিয়েটা হয়েছিলো। খুব বেশী আত্মীয়স্বজন আসেনি। তখন বুঝিনি কেন এভাবে বিয়ে হলো। প্লানটা রাহাতের বাবার ছিলো। উনি আসলে উনার আত্মীয়স্বজনের কাছে শাবাবের বিষয়টা গোপন রেখেছিলো। এটা আমি বিয়ের পরে জেনেছিলাম। এমনকি রাহাতও জানতো না।

যাইহোক আমি বাসর খাটে বসে আছি। শাবাবের জন্য খুব খারাপ লাগছে। তবে এটুকু বুঝেছি জীবনের প্রয়োজনে মাঝে মাঝে বাস্তবতাকে মেনে নিতে হয়। রাত বারোটা বাজে। রাহাত এখনও রুমে ফিরেনি। আমাদের ভার্সিটির বন্ধুবান্ধব এসেছে। রাহাত ওদের সাথে আছে। হঠাৎ দরজা খোলার শব্দে আমার ঘরের নিরবতা দ্বিখন্ডিত হলো। আমি একপলক ওর দিকে তাকিয়ে লজ্জায় মাথাটা নুইয়ে রাখলাম। আমি বুঝে পেলাম না আজ কেন ওকে এতো লজ্জা লাগছে। আমি কিছুতেই বুঝে উঠতে পারছি না,আমার এমন কেন লাগছে। এক অজানা শিহরণে আমার দেহের স্পন্দন কেঁপে কেঁপে উঠছে। রাহাত ধীর লয়ে রাজপুত্রের মতো হেঁটে বাসর খাটে বসলো। তারপর পকেট থেকে একটা আংটি বের করে আমায় পরিয়ে দিলো। আমি ওর দিকে তাকিয়ে বললাম,
—-তোমাকে দেওয়ার মতো আমার যে কিছুই নাই।
রাহাত ঘোমটা খুলে আমার দিকে তাকিয়ে বললো,
—-তুমি নিজেই তো একটা দামী রত্ন। আল্লাহপাকের কাছে শোকরিয়া যে উনি তোমাকে আমার জীবন সঙ্গিনী হিসাবে দান করেছেন। চলো আমরা দু’জন শোকরানার নামাজ আদায় করি।
আমি মন্ত্রমুগ্ধের মতো ওর কথাগুলো শুনছিলাম। আর আমার নিজের অজান্তে চোখের পাপড়িগুলো সিক্ত হয়ে উঠলো।

চলবে