উপসংহার পর্ব-১৬

0
1

#ধারাবাহিক গল্প
#উপসংহার
পর্ব-ষোলো
মাহবুবা বিথী

শাবাবের ডাকে খুব ভোরে আমার ঘুম ভেঙ্গে গেল। বিছানা থেকে ধড়মড় করে উঠে পড়লাম। প্রথমে মনে হলো স্বপ্ন দেখছি। পরে ঘুমের রেশ কেটে গিয়ে বাস্তবের আঙ্গিনায় পা রাখতে গিয়ে মনে পড়লো, এখানে শাবাব কিভাবে আসলো?”আর রাহাতই বা কোথায়? গতরাত তো আমার বাসর রাত ছিলো। মনে মনে ভাবলাম, শাবাব হয়তো আমার মায়ের সাথে এসেছে। সেই কারনে ওকে জড়িয়ে ধরে জিজ্ঞাসা করলাম,
—-নানুমনি কোথায়?
—-নানুমনি তো বাসায়? জানো আম্মু,তোমার জন্য আমার মনটা অনেক খারাপ হয়েছিলো।
—-আমারও হয়েছে বাবা। তুমি কার সাথে এসেছো?
—রাহাত আঙ্কেলের সাথে অনেক রাতে এসেছি। তোমাকে ডাকতে চেয়েছিলাম।
আঙ্কেল বলল,”তোমার মা অনেক টায়ার্ড,সকালে ডেকো। তোমাকে দেখে সারপ্রাইজড হয়ে যাবে। আম্মু তুমি আমাকে দেখে সারপ্রাইজড হওনি?”
—-হয়েছি তো বাবা,ভীষণ সারপ্রাইজড হয়েছি।
—–আমি এখানে কেন তোমার জানতে ইচ্ছা হয়নি?
—-হয়েছে, আঙ্কেলকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম?
—-আঙ্কেল কি বললো?
—-আম্মু তোমার মনে আছে, আমি একদিন বলেছিলাম তুমি আমি আর রাহাত আঙ্কেল এক খাটে ঘুমাবো। সেই কথাটা আঙ্কেল শুনে ফেলেছিলো। আমার কথা রাখতেই আঙ্কেল তোমাকে বিয়ে করেছে। আম্মু তুমি খুশী হয়েছো?
আনন্দে উদ্ভাসিত শাবাবের উজ্জ্বল মুখের দিকে তাকিয়ে বললাম,
—-তুমি খুশী থাকলে আমিও খুশী থাকবো। আমার পৃথিবীটাই তো তোমাকে ঘিরে।
—আম্মু আমার পৃথিবীটাও তোমাকে ঘিরে। তবে আমাদের পৃথিবীতে নতুনএকজনের আজ আগমন ঘটেছে। আমাদের সম্পর্কটাও বদলে গিয়েছে। আজ আমি একজন বাবা পেলাম। অবশ্য জ্ঞান হওয়ার পর থেকেই রাহাত আঙ্কেলকে আমি বাবার জায়গায় বসিয়ে দিয়েছি।
সেদিন অবাক হয়ে শাবাবের কথাগুলো শুনছিলাম আর ভাবছিলাম সাত বছরে ছেলেটা আমার অনেক ম্যাচিউর হয়ে গিয়েছে। আসলে শাবাবের যখন দুবছর বয়স তখন থেকেই রাহাতের সাথে শাবাবের সম্পর্ক শুরু হয়। গ্রুপ স্টাডি করার সুবাদে ও প্রায়শ আমার বাসায় আসা যাওয়া করতো।
তবে শাবাবকে আমার শ্বশুর বাড়িতে সবাই সহজভাবে নিলেও আমার শ্বশুর নিতে পারছেন না। বিয়ের রাতেই রাহাত গিয়ে ওকে নিয়ে আসাতে উনি মনে হয় মনক্ষুন্ন হলেন। অবশ্য হওয়ারই কথা আর একজনের সন্তানকে রাহাত নিজের সন্তান ভেবে আদর করছে এটা আমার শ্বশুরের পক্ষে এতো তাড়াতাড়ি মেনে নেওয়া সম্ভব হয়নি। হয়তো সে কারনে উনি আমার বিয়ের পরদিন চলে গেলেন। সিফাত, সাবেরা আর আমার শাশুড়ী থেকে গেলেন। শ্বশুরের আচরণ দেখে শাশুড়ী মা আমার মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,
—-তোমার শ্বশুরের কথায় তুমি কিছু মনে করো না। আমার ছেলে যেহেতু শাবাবকে নিজের সন্তানের জায়গায় বসিয়েছে আমিও ওকে আমার নাতির জায়গায় বসিয়ে দিয়েছি। সারাজীবন আমার কাছে শাবাবের আদর যত্নের অভাব হবে না।
আমার শাশুড়ী মা আমার উপর খুব খুশী। কারণ জীবনের বাস্তবতায় আমাকে সব কাজেই পারদর্শী হতে হয়েছে। আমার খুব সকালে ঘুম থেকে উঠতে হয়। ভোরে ঘুম থেকে উঠে ফজরের নামাজ পড়ে কিচেনে গিয়ে চা বানিয়ে বিস্কুট সহকারে দিয়েন আসি। এরপর রুটি সবজি রেডী করে টেবিলে দিয়ে দিলাম। সাথে ডিম পোচ আর আপেল কেটে দিলাম। এরপর দুপুরের রান্না, রাতের ডিনার সব আমি এক হাতেই করে নিলাম। শাশুড়ী মা আমার কাজকর্ম দেখে ভীষণ সন্তুষ্ট। এর মাঝে আমার চাকরির অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটার হাতে চলে আসলো। কর্পোরেট চাকরি হয়েছে। বেতন প্রচুর তবে খাটুনি বেশী।
এক সপ্তাহ পর সিফাতও চলে গেলো। তবে সাবেরা আর শাশুড়ী মা থেকে গেলেন। সাবেরা এখান থেকে ভার্সিটির ভর্তি কোচিং এর জন্য উদ্ভাসে ভর্তি হলো। এর মাঝে আমি রাহাত আর শাবাব মিলে আমাদের বাসায় বেড়াতে গেলাম। বুবুর মেয়েটার জন্য আড়ং থেকে জামা, নকশী কাঁথা কিনে নিলাম। জন্মের পর আদুরীকে আমার কিছু দেওয়া হয়নি। এতে অবশ্য বুবু কিছু মনে করেনি। ও আমার সমস্যাটা বোঝার চেষ্টা করে। রাহাত বাসাটা ছেড়ে দিতে বললো। আম্মাকে আমাদের সাথে থাকতে বলা হলো। কিন্তু আম্মা কয়েকদিনের জন্য আমাদের গ্রামের বাড়িতে যেতে চাইছেন। রাহাত অবশ্য সাথে সাথে রাজী হয়ে গেল। অবশেষে আম্মা বুবু আর ফয়সল ভাইয়ের সাথে দিনাজপুরের হিলিতে চলে যাবেন। শুধু শুধু ঐ বাড়িটা রেখে লাভ নেই। রাহাত আর আমি গিয়ে বাড়িওয়ালাকে জানিয়ে দিলাম। সামনের মাস থেকে আমরা আর এই বাসায় থাকছি না।
বুবুরা চলে যাবার এক সপ্তাহ পার আমার শাশুড়ী মা আমাদের নিয়ে দিনাজপুরে যেতে চাইলেন। যদিও শাবাবের স্কুল খোলা আছে তারপরেও ভাবলাম চাকরিতে জয়েন করলে দিনাজপুরে যাওয়া সম্ভব হবে না। শাবাবের পড়া হয়তো পরে ম্যানেজ করে নিতে পারবো কিন্তু নতুন চাকরিতে এক সপ্তাহ ছুটি পাওয়া সম্ভব হবে না। সে কারনে মনে হলো এই সুযোগটা কাজে লাগাই। আমার ননদ, শাশুড়ী মা, শাবাব আর রাহাত মিলে গ্রামের বাড়িতে চলে গেলাম। আমাদের যাওয়ার খবর শুনে অনেক আত্মীয় স্বজন আমাকে দেখতে এসেছিলো। কিন্তু শাবাবকে নিয়ে সবাই কানাঘুষা করতে লাগলো। অনেকে আবার রাহাতকে খােঁচা দিলো। আমার ফুফু শাশুড়ী রাহাতকে তো বলেই বসলেন,
—-তোর তো কপাল রে রাহাত। চাকরি করা বউ সাথে বাচ্চা তোর আর কিছু কষ্ট করতে হবে না। সব রেডিমেট।
রাহাত ও উত্তর দিয়েছিলো,
—–কপালের জোর আছে বলেই তো জবার মতো মেয়েকে বিয়ে করতে পেরেছি।
তবে রাহাত ফুফুর কথাগুলো আমার শ্বশুরের কানে তুলেছিলো। উনিও বললেন,
—-এরকম কথা তোকে শুনতে হবে বলেই তোর বিয়েতে আমার মত ছিলো না।
রাহাতও শান্তস্বরে বলেছিলো,
—-এটা তো একটা বিয়ে ভাঙ্গার জন্য কোনো কারণ হতে পারে না।
—-সেজন্য আমি তীব্রভাবে বাঁধাও দেইনি। তবে তোমাকে এই কথাগুলো শোনার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে। আর যত তাড়াতাড়ি পারো বাচ্চা নিয়ে নাও।
—-বাচ্চা তো আমাদের হাতের বিষয় নয়। আল্লাহপাক যখন চাইবেন তখনই আমাদের বাচ্চা হবে।
—-তবে একটা কথা তোমায় বলে রাখছি একগাছের ছাল কখনও আর একগাছে জোরা লাগে না।
—-তা আমি জানি না বাবা,তবে শাবাবকে আমি আমার সন্তানের জায়গায় বসিয়ে দিয়েছি। সুতরাং তোমরা ওকে কখনও পরগাছা ভেবো না।
আমি পাশেররুম থেকে ওদের বাপ ছেলের সব কথাই শুনতে পেয়েছি। রাহাতের কথাগুলে শুনে আমার চোখের কোনটা ভিজে গেল। অথচ আজ মনে হচ্ছে রাহাতের বাবা ভুল কিছু বলেনি। সত্যিই তো এক গাছের ছাল আর এক গাছে জোরা লাগে না। তা,নাহলে রাহাতের এতো ভালেবাসায় বেড়ে উঠা শাবাব কিভাবে আমাদের ছেড়ে আমেরিকায় ওর বাবার কাছে চলে যেতে পারছে? সেবার একটু বেশীদিন মানে একসপ্তাহ থেকেছিলাম। এরপর আমাদের বাড়িতে গিয়ে আম্মাকে নিয়ে ঢাকায় চলে আসি। আমার ননদ সাবেরাও আমার সাথে চলে আসে।
তবে এরপর থেকে শ্বশুরবাড়িতে আমার খুব একটা যাওয়া হতো না। কারণ রাহাত শাবাবকে নিয়ে গ্রামে ঘুরতে বের হলেই নানা জনে নানা কথা বলতো। রাহাত যখনি বলে শাবাব ওর ছেলে তখনি গ্রামের কিছু মানুষ বলা শুরু করতো, বিয়ের বয়স ছ’মাস হলো না আর এখনি এতোবড় ছেলে পয়দা করে ফেললি?
এসব নানাবিধ কারনে শ্বশুরবাড়িতে আমার থাকা হতো না কিংবা রাহাত থাকতে চাইতো না। আমাকেও অনেক কথা শুনতে হতো। রাহাতের এক চাচী আমার শাশুড়ীকে বললেন,
—-তোমার বউমা জাদু জানে। দেখলে না আমাদের সোনার টুকরা ছেলেকে কিভাবে বস করে ফেললো?
—এ তুমি কি বলছে সালেহা? যতটুকু জানি আমার রাহাতই ওকে পছন্দ করতো বেশী। এসব কথা থাক। আমি ওদের বিষয় নিয়ে তোমার সাথে কথা বলতে চাইছি না।
আমার শাশুড়ী মা সেদিন প্রতিবাদ করাতে আমার ভীষণ ভালো লেগেছে। মানুষের কথা আমার খুব একটা গায়ে লাগে না।
এতোকিছুর পরেও শ্বশুর বাড়িতে থাকতে চাইতাম কিন্তু রাহাত আমায় বলতো,
—দেখো, তোমার সম্মান মানেই আমার সম্মান। তুমি অসম্মনিত হলে সেটা আমারই বুকে বিঁধবে। তাই আমি বেশীদিন গ্রামে থাকতে চাই না।
আমিও কখন ও এই বিষয় নিয়ে উচ্চবাচ্য করিনি। কারণটা হচ্ছে শাবাব। এতটুকু বয়সে ওর মনের উপর যেন কোনো রকম চাপ না পড়ে।

শুরু হলো নতুন জীবন। সাবেরা আমার কাছেই থাকতো। চাকরি করতাম বলে শাবাবকে দেখাশোনা করার জন্য কখনও আমার মা কখনও বা শাশুড়ী মা আমার বাসায় থাকতেন। আল্লাহপাকের কাছে অনেক শোকরিয়া পৃথিবীতে অল্প কিছু খারাপ মানুষের দেখা পেলেও আল্লাহপাক অনেক বেশী ভালো মানুষের সাথে আমার সাক্ষাত ঘটিয়েছেন। যেমন রাহাতের মা,বোন ভাই ওর বাবাও আমার সামনে কখনও আমাকে কষ্ট দিয়ে কিছু বলেননি। শাবাবের ফুফু সেঁজুতির সাথে আমার এখনও সুসস্পর্ক রয়েছে। মাঝে মাঝে ওর মেয়ে মৌমিতাকে নিয়ে আমার বাসায় বেড়াতে আসে। রাহাতও ওকে নিজের বোনের মতো দেখে। আমি বুঝি মুশফিক ওর মাধ্যমেই শাবাবের খোঁজ খবর রাখতো।
আমি বরাবর আমার দায়িত্বজ্ঞান নিয়ে খুব সচেতন। সাবেরা আমার এখান থেকে লেখাপড়া শেষ করার পর ওর পছন্দের ছেলের সাথে বিয়ে দিলাম। সাবেরা ইডেন কলেজ থেকে সোসিওলজিতে অনার্স মাস্টার্স কমপ্লিট করেছে। ওর বর আয়মান ঢাকা ভার্সিটি থেকে মার্কেটিং এ অনার্স মাস্টার্স কমপ্লিট করেছে। বরকে নিয়ে সুখেই সংসার করছে। আমি যখন থেকে দায়িত্ব নিতে শিখেছি তখন থেকে জ্ঞানত কারো দায়িত্বে অবহেলা করিনি। আমার শ্বশুর আমার হাতের উপর দিয়ে দুনিয়া থেকে চলে গেলেন। শাশুড়ী এখনও মাঝে মাঝে আমার কাছে আসেন। ডাক্তার দেখিয়ে কিছুদিন থেকে চলে যান। আমার আম্মাও তাই করেন। বুবুর শাশুড়ী মারা যাবার পর আম্মা কখনও বুবুর কাছে থাকেন। আবার কখনও আমার কাছে আসেন। অথচ আমার ছেলে আমাকে ফেলে রেখে তার কথিত বাবার কাছে দিব্যি চলে যাচ্ছে। ওর যেন কোনো পিছুটান নেই। অথচ আমি আর রাহাত ওর জন্য জীবনে কত বড় সেক্রিফাইস করেছি তা এখন আর ওর হিসাবের মধ্যে পড়েনি। জীবন মনে হয় এমনি। ফোনটা বেজে উঠলে। স্ক্রীনে তাকিয়ে দেখি রাহাত ফোন দিয়েছে। রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে রাহাত বলে উঠলো,
—-রাত তো শেষ হতে চললো এখনও ঘুমাওনি?
—-তুমি কি করে বুঝলে,আমি ঘুমাইনি?
—-তোমার মনের উপর দিয়ে যে ঝড় বয়ে চলেছে তাতে তোমার দুচোখে ঘুম আসবে না এটা আমি ভালোভাবেই অনুধাবন করতে পারি। শোনো,শাবাবের বিষয়টা ওর উপর ছেড়ে দাও। ঐ বিষয়টা নিয়ে বেশী মনখারাপ করো না। এতে আবার তোমার শরীর খারাপ করবে। সময়ের সাথে সবকিছু দেখবে আস্তে আস্তে ঠিক হয়ে যাবে। সকালে দেখা হবে। ফোন রাখলাম।
আসলে কি সময়ের সাথে সবকিছু ঠিক হয়ে যায় নাকি মানুষ ঠিক হওয়ার অভিনয় করে। তবে ভিতরের ক্ষত যে সেরে উঠে না এটা আমার থেকে বেশী কেউ জানবে না।

চলবে