উপসংহার পর্ব-১৭

0
11

#ধারাবাহিক গল্প
#উপসংহার
পর্ব-সতেরো
মাহবুবা বিথী

আমি বারান্দায় এসে দাঁড়ালাম। আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখি চাঁদটা অস্তরাগে চলে যাচ্ছে। একটু পরেই ফজরের আজান দিবে। চারিদিকটা বেশ আলোকিত হয়ে উঠলো। একেই মনে হয় সুবহেসাদিক বলে। দূরের মসজিদে ফজরের আজান শোনা যাচ্ছে। আমি ওজু করে ফজরের নামাজ আদায় করে নিয়ে বারান্দায় এসে ইজিচেয়ারটায় বসলাম। ভোরের এই প্রকৃতিটা আমার ভীষণ ভালোলাগে। এই সময় পৃথিবী থাকে বড্ড নিস্তদ্ধ। এই নিরবতার মাঝে আমি শান্তি খুঁজে পাই। আজ ছুটি নিয়েছি। রাত একটায় শাবাবের ফ্লাইট। যতবার এই কথাটা ভাবছি ততবারই বুকের ভিতরটা ভেঙ্গে চুরমার হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু আমার করার কিছু নেই। মা হয়ে স্বার্থপর হতে পারলাম না। আসলেই তো শাবাবের নিজের একটা ভবিষ্যত আছে। এখন কমপিটিশনের যুগ। আমেরিকা থেকে পড়াশোনা করলে ওর ক্যারিয়ার আরো উজ্জ্বল হবে। মা হয়ে আমার এটাই তো কাম্য হওয়া উচিত। ডোরবেলটা বেজে উঠলো। বুঝেছি রাহাত আসছে। দরজা খুলে দিতেই রাহাত আমাকে বললো,
—-শাবাব কোথায়?
—-ও আছে ওর রুমে,তুমি জার্ণি করে এসেছো,হাতমুখ ধুয়ে ফ্রেস হয়ে নাও। তারপর না হয় ওর ব্যাপারে খোঁজ খবর করো।
—-ছেলেটা আজ চলে যাবে। সব প্রয়োজনীয় জিনিস ঠিকমতো নিলো কিনা সেটা দেখতে হবে না? এতো আর ঢাকা বা চিটাগাং নয়। সাত সমুদ্দের পাড়ে ছেলেটা চলে যাবে।
রাহাতকে যতই দেখি ততই আমি অবাক হই। যাক আমি আর কথা না বাড়িয়ে কিচেনে গিয়ে চায়ের পানি চুলায় চাপিয়ে দিলাম। শাবাবের রুমের দরজা লক। নক করতে চাইছিলাম। কি মনে করে নক করলাম না। চা রেডী করে বিস্কুটসহ টেবিলে দিয়ে দিলাম। রাহাত হাতমুখ ধুয়ে টেবিলে চলে আসলো। শাবাব ও দরজা খুলে বের হয়ে রাহাতকে বললো,
—-বাবা তুমি কখন আসলে?
—-এই তো একটু আগে আসলাম। তোমার সব কিছু গুছানো হয়েছে। টিকিটটা ডাউনলোড করে প্রিন্টআউট করে নাও।
শাবাব শুধু মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানালো। ওর চেহারার দিকে তাকিয়ে দেখলাম,রাতজাগার সচিত্র ছবি ফুটে উঠেছে। বুঝে পেলাম না ওর রাত্রি জাগরনের হেতু কি? আমি রাত জেগেছি, আমার নাড়ী ছেড়া ধন চলে যাবে বলে। আমি শাবাবের সামনে যেতে পারছি না। চোখ দিয়ে অনবরত পানি ঝরছে। রাহাতের সামনেও নিজের এই চেহারাটা দেখাতে পারছি না। নিজেকে বড্ড ছোটো মনে হচ্ছে। আসলেই কি গাছ যেমন ফল কি তেমনই হয়? কিন্তু আমি তো স্বার্থপর না। সারাজীবন সবার কথা ভেবেছি। এমনকি শাবাবের আপন দাদী তারও খেদমত করতে দ্বিধা করিনি কিংবা তার ছেলের দ্বিচারিতা আচরণ জানা সত্বেও তারদিকে অভিযোগের আঙ্গুল তুলিনি। নিজের ভাগ্য বলে মেনে নিয়েছি। ডোরবেলটা আবারও বেজে উঠলো। দরজা খুলে দেখি আম্মা বুবু ফয়সলভাই আর আদুরী চলে এসেছে। আমি অবাক হয়ে বললাম,
—-তোমরা না জানিয়ে হঠাৎ এসময়?
বুবু তৎক্ষনাত বলে উঠলো,
—-ছেলেটা এতো দূরদেশে যাচ্ছে আমরা কি না এসে থাকতে পারি?
আম্মা আমার দিকে তাকিয়ে বললেন,
—নানুভাইয়ের ফ্লাইট কয়টায়?
আমি কিছু বলার আগেই শাবাব এসে বললো,
—-নানুমনি কেমন আছো?
—-ভালো, আমাদের ছেড়ে এতো দূরে চলে যাচ্ছো তোমার মন খারাপ করবে না?
—-মনতো খারাপ হবে। সেখানে তো কোনো খবরদারী চলে না। কিন্তু এখন না গেলে হয়তো চারবছর পর পিএইচডি করতে যেতে হতো।
আমি মনে মনে বললাম,
—-সেটাই তো ভালো হতো।
রাহাত সবাইকে সালাম দিয়ে ফয়সল ভাইকে বললো,
—-ভাইয়া কেমন আছেন?
—-আলহামদুলিল্লাহ, ভালো আছি। শুধু হাইপ্রেসার নিয়ে একটু যন্ত্রণায় আছি।
এরপর আদুরী এসে আমায় জড়িয়ে ধরে বললো,
—-খালামনি তুমি কেমন আছো? আমাকে তো ভুলেই গিয়েছো।
আমি ওর কপালে চুম্বন এঁকে দিয়ে বললাম,
—-তুই তো আমার মা,তোকে কি ভোলা যায়?
আদুরীটা দেখতে ভীষণ সুন্দরী। ও যে আমার শাবাবের উপর দুর্বল এটা আমি ভালোই বুঝতে পারি। ওকে শাবাবকে ভাই বলে খুব একটা ডাকতে দেখিনি। শাবাবও একটু আত্মকেন্দ্রিক। হাই হ্যালো ছাড়া আদুরীর সাথে খুব একটা কথা বলে না। আমি আদুরীর অনুভব বুঝতে পারি কারণ ঐ বয়সটাতো আমারো ছিলো। এবছর এসএসসি পাশ করেছে। ছাত্রী হিসাবে যথেষ্ট মেধাবী। মনে মনে ভেবেছি,
শাবাব চলে গেলে বুবুকে বলবো আদুরীকে ঢাকার ভালো একটা কলেজে ভর্তি করে দিতে। গোল্ডেন ফাইভ পাওয়ার কারণে ঢাকার যে কোনো নামকরা কলেজে ও ভর্তি হতে পারবে। আদুরী শাবাবের দিকে তাকিয়ে বললো,
—-কেমন আছো?
—-ভালো,তুই কেমন আছিস? কোন কোন কলেজ গুলোতে অ্যাডমিশন নিয়েছিস? ঢাকার কলেজগুলোতে ভর্তি হওয়ার চেষ্টা কর।
—তুমি তো চলে যাচ্ছো ঢাকায় ভর্তি হয়ে লাভ কি?
আদুরীর কথা শুনে আমরা সবাই ওরদিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম। এমনকি শাবাবও অবাক হয়ে বললো,
—-আমার যাওয়ার সাথে তোর ভর্তি হওয়ার কি সম্পর্ক?
এরমাঝে আদুরী নিজেকে সামলে নিয়ে বললো,
—-না,মানে তুমি আমাকে গাইড করতে সে কারনেই বলছিলাম।
শাবাব নিজের রুমের দিকে চলে যেতে যেতে বললো,
—-গাইড করার জন্য টিচার আছেন,কোচিং সেন্টার আছে। আমার গাইড করার প্রয়োজন আছে বলে মনে করি না।
আমি ওদের সবাইকে ফ্রেস হতে বললাম। এরপর টেবিলে নাস্তা দিয়ে দুপুরের খাবারের আয়োজন করলাম। শাবাবের পছন্দ করা খাবারগুলো আজ রান্না করেছি। কোনো রকমে রান্না করা আর কি? মনের ভিতর তো শান্তি নাই।দুপুরে সবার খাওয়া দাওয়া শেষ হবার পর আমার মনে হচ্ছে শরীর শক্তিগুলো যেন ফুরিয়ে আসছে। শাবাবের যাওয়ার সময় যতো ঘণিয়ে আসছে আমার অস্থিরতাও ততই বেড়ে যাচ্ছে। দুপুরে আমি ভাত মুখে তুলতে পারিনি। সবারই মন খারাপ। শাবাবকে বড় করতে আমার পরিবারের কারো অবদান অস্বীকার করার উপায় নেই। বুবুও যেমন ওকে জন্মের পর দেখভাল করেছে আমার মায়ের অবদান কম নয়। আম্মাতো এখন পর্যন্ত ওর দেখভাল করে। আম্মা আর বুবু দুপুরে কিছু মুখে দিয়ে রুমে শুয়ে আছে। এমনকি রাহাতের আম্মাও যখন ঢাকায় আমার কাছে আসে নিজের নাতির মতই আচরণ করে।
আমিও নিজের কষ্টকে আড়াল করতে কাজের বাহানায় কিচেনে সময় কাটাতে লাগলাম। আমার হেলপার মিনারা বেগম ভালোই কাজ গুছিয়ে করে। তারপরও আমি আজ কাজের মাঝে নিজেকে ব্যস্ত রাখছি। খাবারগুলো সব ফ্রিজে তুলে রাখছি। রান্না করা সব খাবারই পড়ে আছে। কেউই শান্তি করে খেতে পারেনি। মনে হচ্ছে এ যেন শোকের বাড়ি।
রাহাত অবশ্য শাবাবের সাথে আছে। অবশেষে চলে এলো বিদায়ের ক্ষণ। মাগরিব পেরিয়ে এশার ওয়াক্ত চলে আসলো। ফোনটা বেজে উঠলো। তাকিয়ে দেখি সেঁজুতি ফোন দিয়েছে। রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে বলে উঠলো,
“ভাবি আমি জানি তোমার মন প্রচন্ড খারাপ। কিন্তু ছেলেটার ভবিষ্যতের কথা ভেবে সামলে নাও। ওদিকে ভাইয়াও তো কতো বছর ধরে একা থাকে। ইদানিং তার শরীরও খুব একটা ভালো থাকে না। যতই অপরাধ করুক সে তো তোমার সন্তানের পিতা। শেষ বয়সে নিজের ছেলের সাথে একটু সময় কাটিয়ে আনন্দে থাকুক।”
মনে মনে বললাম সবাই নিজের দিকে ঝোল টেনে কথা বলে। সেটাতো আর বলতে পারবো না। ওর কথার উত্তরে বললাম,
—-সেঁজুতি আমার মন নিয়ে তোমার এতো দুঃশ্চিন্তা না করলেও চলবে। আসলে আমার তো মনই নাই তার আবার ভালো খারাপ।
—এতো তোমার অভিমানের কথা। ঐ প্রসঙ্গে এখন আর কথা না বলি। আমি আর মৌমিতার বাবা ন,টার দিকে এয়ারপোর্টে পৌঁছে যাবো। তোমরাও ঠিক সময়ে চলে এসো।
ফোনটা রেখে এশার নামাজ আদায় করে রাহাত আর শাবাবকে প্রস্তুতি নিতে বললাম। রাহাতও শাবাবকে রেডী হতে বলে ওজু করে নামাজে দাঁড়ালে। শাবাব নিজের রুমের দরজা লক করে রেডী হতে লাগলো। কিন্তু দু’ঘন্টা পেরিয়ে গেল ও রুম থেকে বের হলো না। এদিকে এয়ারপোর্টের যাওয়ার সময় পার হয়ে যাচ্ছে। অজানা আশঙ্কায় আমার বুকটা কেঁপে উঠলো।

চলবে